ভালবাসি প্রকৃতি

ভালবাসি প্রকৃতি

Saturday, August 31, 2019

মেঘনার জল, করে টলোমল...

শুক্রবার আমার কাছে ঘুম দিবস! সারা সপ্তাহ যদি ঘুমাই, তার পরেও বৃহস্পতিবার দিনটি আসলে চেম্বারের সকল কাজই আমার কাছে অসাড় লাগে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই শরীর ও মনে একটা ছুটি ছুটি ভাব থাকে। সেই স্কুল জীবনে যেমন মনে হতো, আজ বৃহস্পতিবার হাফ ক্লাস! দুপুরেই ছুটি! আজ তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে খেলাধুলা করা যাবে! অথবা রমজানের আগের সময়টা যেমন সামনেই একমাস ছুটি! ঠিক তেমনি বৃহস্পতিবার ছুটি আনন্দ ছারা মাথায় আর কোন কিছু কাজ করে না। বৃহস্পতিবার রাতে একটু বেশি সময় টিভি দেখা, রাত জাগা। অতপর গভীর রাতে ঘুমোতে যাওয়া এবং অনেক বেলা করে ঘুম থেকে ওঠা! তাই বলে প্রয়োজনে যে শুক্রবারেও আগে আগে উঠি না তা কিন্তু নয়। আজ শুক্রবার সকাল সকাল ঘুম ভাঙ্গে শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মাহবুবুল হকের ফোনে। ফোন রিসিভ করতেই জানিয়ে দিলো আজ বারোটার দিকে চাঁদপুর ঘাটে যাবো। আমাকেও সঙ্গী করতে চায়। আমার যেহেতু ঘোরাঘুরির বাতিক আছে তাই এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম।
বারোটায়ই চলে এলাম বন্ধুর বাড়ি। কিন্তু যথারীতি বারোটায় আমরা রওয়ানা দিতে পারলাম না। সারে বারোটায় রওয়ানা দিলাম আমরা। সফর সঙ্গী হিসাবে আরো যোগ দিলো বন্ধু মানিরুল ইসলাম, এডভোকেট জালাল আহম্মেদ সবুজ সাথে গাড়ির দায়িত্বে আছেন বুলবুল। গুটি বসন্ত হলে যেমান গালে গর্ত হয়ে যায় ঠিক তেমনি গুটি বসন্তে আক্রান্ত রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে এক পর্যায়ে বিরক্ত বোধ করছিলাম। ভেদরগঞ্জ থেকে ডামুড্যার সংযোগ সড়কের কাছে গিয়ে খোজ খবর করছিলাম ভালো রাস্তা আছে কোন দিক দিয়ে। একজন আমাদের দেখিয়ে দিলো-মোল্লার হাট দিয়ে একটা রাস্তা আছে যেটা দিয়ে অনেকটা ভালো রাস্তা পাওয়া যাবে। আমরা মোল্লারহাট ব্রিজ পার হয়ে গ্রামীণ রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছি দূর্বার গতিতে। শুক্রবার রাস্তা একদম ফাঁকা। রাস্তার দুই ধারে সবুজ আর সবুজ। মাঝে মাঝে সুদৃশ্য বাড়ি আর পুকুর। কিছু দুর পর পর একসাথে চার-পাঁচটা বাড়ি আবার সবুজ আর সবুজ। রাস্তা এক পর্যায়ে আবার গুটি বসন্তে আক্রান্ত রাস্তায় গিয়ে মিশে গেলো। আমরা হরিনাঘাট গিয়ে একটি হোটেলের সামনে গাড়ি রেখে ইলিশ ভাজা দিয়ে ভাত খেলাম। পেট ঠিক তো সব ঠিক। খাওয়া দাওয়ার পর এবার চিন্তা ভাবনা চলছে কি করা যায়! আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ওপার যাবো।
চাঁদপুর মাছের বাজারের বেশ সুনাম আছে। সিদ্ধান্ত নিলাম ট্রলার দিয়ে মেঘনা পার হয়ে চাঁদপুর মাছঘাটে যাবো। কিন্তু হরিনা ঘাটে কোন ট্রলার পাওয়া গেলো না। ঘাট থেকে এখনই ফেরি ছাড়বে। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো ওপার ফেরিঘাট থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে চাঁদপুর মাছঘাট। আমরা ফেরিতে উঠে গেলাম। ফেরির একদম সামনের দিকে দাড়িয়ে গেলাম। ফেরিতে পণ্যবাহী ট্রাক ছাড়া বাকী যে কয়টা বাস ও মাইক্রো বাস উঠেছে সবই চট্রগ্রামের ফটিকছড়ি যাবে। মাইজ ভান্ডারির ভান্ডার শরীফ যাওয়ার জন্য রওয়ানা দিয়েছে। গাড়িতে ভান্ডার শরীফের ফ্ল্যাগ পত পত করে উড়ছে। বাসের ছাদে ভান্ডার শরীফের গুণকির্ত্তন করে গান বাজছে। সব গানই জিকিরের সাথে! বাতাশ খেতে খেতে নদীর দুই ধারের হোগলার বন দেখতে দেখতে আমরা বিনা ভাড়ায়ই পৌছে গেলাম চাঁদপুর ফেরিঘাট। ফেরিঘাটে পৌছাতে পৌছাতে জোয়ার এসেগেছে। ফেরির পল্টুনের গোড়ায় হাটু পানি জমে গেছে। ভান্ডার শরীফগামী বাসে উঠে পানি পার হয়ে মোড় থেকে সিএনজি নিয়ে চলে গেলাম চাঁদাপুর শহরে ব্রিজের গোড়ায়। সেখান থেকে ইজিবাইক নিয়ে মাছ ঘাটে গিয়ে দেখি এলাহি কান্ড। ইলিশ আর ইলিশ! যেদিকে তাকাই শুধু ইলিশ মাছ! বড় বড় মাছ ধরা নৌকা ঘাটে নোঙ্গর করা আছে। টুকরি ভরা মাছ নিয়ে আড়তে এসে স্তুপ করছে শ্রমিকরা। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম মাছের দৃশ্য। মাছের দাম তুলনামূলক বেশি দেখে বন্ধু মাহবুব কিছু মাছ কিনলো। ককসিটে বরফ দিয়ে ভালো করে প্যাক করে দিলো বিক্রেতা। এবার ফেরার পালা। মাছ দেখতে দেখতে সন্ধা ঘনিয়ে এসেছে। যাওয়া নিয়ে টেনশন দেখা দিয়েছে। রাতের আধারে ট্রলারে যাওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত হবে চিন্তা করলাম আমরা। কিন্তু যেভাবে এসেছি সেভাবে যেতে চাইলে রাত দশটা বেজে যাবে নদী পার হতেই। আমরা ট্রলার ঘাটে গিয়ে একটা ট্রলার নিলাম। আসল মজাটা হলো ট্রলারেই।
রাতের আঁধারে মেঘনা নদীতে ট্রলারে ভ্রমণ এতটা মন মুগদ্ধকর, প্রশান্তিদায়ক, আনন্দময় হতে পারে চিন্তা করিনি। মাথার উপর তাঁরা ভরা বিশাল আকাশ। দূর আকাশে তাঁরারা চেয়ে আছে আমাদের দিকে। চাঁদপুর থেকে ফেরার পথে চাঁদের দেখা না পেলেও তাঁরারা আমাদের হতাশ করেনি। অসংখ্য উজ্জল তাঁরার উপস্থিতি আমাদের পূলকিত করেছে বেশ। ট্রলারের বেঞ্চে বসে ছোট বড় ঢেউ এর ধাক্কা বেশ ভালোই লাগছে। ঢেউয়ের ধাক্কা বেশি শক্তিশালী হলে অবশ্য প্রাণ আর বুকে থাকতো না! মূল নদী পার হয়ে তীরের কাছ দিয়ে ছুটে চলেছে ট্রলার। কাশবন, হোগলা বনে ঘেরা চর। বাতাশে দুলছে বন। আমরা এগিয়ে চলেছি তীর ঘেষে। মূহুর্তেই যেন পৌছে গেলাম হরিনাঘাটে। যাওয়ার সময়টা যেমন দীর্ঘ লেগেছিলো আসার সময়টা মূহুর্তে শেষ হয়ে গেলো। আসলে ভালো সময় বেশিক্ষণ থাকে না। কষ্টের সময় শেষ হতে চায় না। আমরা হরিনাঘাট থেকে মেঘনা নদীর মধুর স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে চলে এলাম শরীয়তপুর সদরে। বিদায় বেলায় তাই কিছু পঙতিমালা দিয়ে শেষ করতে চাই-
মেঘনার জল করে টলোমল
বয়ে চলেছে নিরবধি
রূপে তাহার মোহিত হয়ে ভাবি,
বার বার যেতে পারতাম যদি!

No comments:

Post a Comment