ভালবাসি প্রকৃতি

ভালবাসি প্রকৃতি

Wednesday, August 14, 2019

জাতীয় শোক দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলিঃ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একই সূত্রে গাঁথা

আমার জন্ম আটাত্তরে। একাত্তর, পচাত্তরেরও অনেক পরে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ দেখিনি, যুদ্ধ পরবর্তী হাহাকার দেখিনি, সুবিধাবাদীদের লুটতরাজ দেখিনি, ক্ষমতালোভীদের হাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে হত্যাযজ্ঞও দেখিনি। অনেক কিছুই দেখার সুযোগ হয়নি। যখন বুঝতে শিখেছি, জানতে শিখেছি তখন থেকেই দেখেছি বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী মানুষের শাসন, শোষণ, ভাষন, আষ্ফালন, প্রচার, অপপ্রচার, বিকৃতি, আত্ম-স্বীকৃতির মহাউৎসব। কিন্তু আগুন কখনো চাপা থাকেনা শুনেছি সেই ছোটবেলা থেকেই। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আগুণের মত শক্তিশালী সেটা অনুভব করেছি এবং এখনও তা অনুভব করছি। দাবিয়ে রাখার শত চেষ্টায়ও সেই ভাষণ দাবিয়ে রাখতে পারেনি বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষীরা। শত প্রতিকূলতার পরেও কানে এসেছে সেই ভাষণ। কখনো মৃদু সুরে, কখনো উচ্চ সুরে। শুনেছি সেই ভাষণ মুগ্ধ হয়ে। দল কী বুঝতাম না, দল কেন করে বুঝতাম না, দল কারাই বা করে তাও বুঝতাম না। নিজের অজান্তে তবুও হৃদয়ে গেথে গেছে সেই ভাষণ। তাইতো মনে হয় বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ একই সূত্রে গাঁথা, এক অবিচ্ছেদ্য নাম।

আমাদের একটা স্বাধীন দেশ হবে, একটা স্বাধীন পতাকা থাকবে, একটা সংবিধান থাকবে যেখানে থাকবে মানুষের অধিকারের কথা, মানুষে মানুষে থাকবে না ভেদাভেদ এমন চিন্তা যারা করতেন তাদের মধ্যে নেতৃত্বে ছিলেন যে মহামানব তিনিই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবুর রহমান একদিনে মহামানব হয়ে ওঠেননি, একদিনে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেননি। দীর্ঘ বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে মহামানব হয়ে উঠতে, বাংঙ্গালি জাতির পিতা হয়ে উঠতে। যার কাছে ধনী গরিব, মুসলিম-অমুসলিম, জাত-পাতের কোন বিচার ছিলো না, ছিলো মানবতার বিচার। তাইতো শত চেষ্টাও বঙ্গবন্ধুকে মানুষের হৃদয় থেকে সরাতে পারেনি একচুলও। বঙ্গবন্ধু তাই মুক্তিকামী মানুষের নেতা হয়ে হৃদয়ে বেঁচে আছে, থাকবে।
একটা ভাষণ মানুষকে কতটা বদলে দিতে পারে, একটা ভাষণ মানুষের মনে কতটা আশা জাগাতে পারে, একটা ভাষণ মানুষকে কতটা উদ্বুদ্ধ করতে পারে তা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ না শুনলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না। এখন মানুষের মধ্যে অবিশ্বাসের বিষ ছড়িয়ে গেছে শিরায়-উপশিরায়। নেতাদের ভাষণ এখন কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। নিজেদের সুবিধার জন্য যা-তা বলে ফেলেন মঞ্চে দাড়িয়ে। সত্যির সাথে মিথ্যার মিশ্রন এতটাই ঘটায় যে সত্যটাও তখন আর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না বা কেউ বিশ্বাসও করে না। বঙ্গবন্ধুর নির্লোভ, নিঃস্বার্থ, বিদ্রোহী, মানব দরদী ভাষণ শুনে, তাঁর কথা বিশ্বাস করে, তাঁর কথার উপর আস্থা রেখে বুকের তাজা রক্ত দিতে ঝাপিয়ে পড়েছিলো লক্ষ লক্ষ মানুষ। সেই লক্ষ লক্ষ মানুষের বুকের তাজা রক্তে লিখেছে স্বাধীন বাংলার নাম, এঁকেছে একটি স্বাধীন দেশের পতাকা, ছিনিয়ে এনেছে একটি স্বাধীন দেশের মানচিত্র। দেশ ও জাতির জন্য মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন বার বার যে মহামানব সেই আমাদের বঙ্গবন্ধু, বাঙ্গালি জাতির পিতা। নিজ স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে দেশ ও জাতির কল্যানে বঙ্গবন্ধু যে আহবান জানিয়েছিলো জাতি তার ডাকের যথাযথ সাড়াই দিয়েছিলো সেদিন। তাইতো আজ স্বাধীন দেশে স্বাধীন ভাবে কথা বলি, কাজ করি, মুক্ত জীবণযাপন করি।
একটি ভাষণ কতটা উদ্দীপক, কতটা জ্বালাময়ী, কতটা আবেগী, কতটা বাস্তবসম্মত, কতটা বিশ্বাসযোগ্য হলে মানুষ তাঁর কথা শুনে ঝাপিয়ে পড়েছিলো মৃত্যুর মুখ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে সেটা বর্তমান স্বাধীন দেশের দিকে তাকালেই কেবল অনুধাবন করা যায়। তাইতো দীর্ঘদিন পরে হলেও ইউনেস্কোর একটি উপদেষ্টা কমিটি ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে দেয়া বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণটিকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামান্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ ধরনের দলিলগুলো যে ‘মেমোরি অব দা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ অন্তর্ভূক্ত করা হয় সে তালিকায় এ ভাষণটিকেও অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। সারা বিশ্ব থেকে আসা প্রস্তাবগুলো দু’বছর ধরে নানা পর্যালোচনার পর উপদেষ্টা কমিটি তাদের মনোনয়ন চূড়ান্ত করে বলে ইউনেস্কোর ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়। মূলত এর মাধ্যমে বিশ্ব জুড়ে যেসব তথ্যভিত্তিক ঐতিহ্য রয়েছে সেগুলোকে সংরক্ষণ এবং পরবর্তী প্রজন্মের যাতে তা থেকে উপকৃত হতে পারে সে লক্ষ্যেই এ তালিকা প্রণয়ন করে ইউনেস্কো। ইউনেস্কো মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। মেমোরি অব দা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে এখন পর্যন্ত অন্তর্ভূক্ত হয়েছে সব মহাদেশ থেকে ৪২৭টি গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টস বা কালেকশন। ইউনেস্কোর যে উপদেষ্টা কমিটি এ মনোনয়ন দিয়েছে সেই কমিটির বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের ন্যাশনাল আর্কাইভসের মহাপরিচালক ড. আব্দুল্লাহ আলরাইসি। প্যারিসে ইউনেস্কো সদর দপ্তরে ওই বৈঠকে তিনি ছাড়াও উপদেষ্টা কমিটির আরও ১৪ জন সদস্য ছিলেন যারা সবাই বিশ্বখ্যাত বিশেষজ্ঞ। আজকের স্বীকৃতিই বলে দেয় সেদিনের ভাষণ শুনে বীর বাঙ্গালি কোন ভুল করেনি।
সকল মানুষের রক্তের রং একই হয় কিন্তু সকল রক্তের আচরন, স্বভাব এক নয়। কিছু রক্তের স্বভাব নির্লোভ, কিছু রক্তের স্বভাব হয় ঘাতকের। এই দেশে যেমন নবাব সিরাজ উদ দ্দৌলা, বঙ্গবন্ধুর মত মহামানব জন্ম নিয়েছিলো তেমনি কিছু মীর জাফর, ঘসেটি বেগমও জন্ম নিয়েছিলো। সকল বাঙ্গালির রক্ত পরিস্কার, নির্লোভ, উদার, ইমানদার বলা যাবে না। এ অঞ্চলে বেইমানের ছড়াছড়ি বৃটিশ শাসন-শোষণের সময় যেমন ছিলো, স্বাধীনতা পরবর্তীতেও ছিলো, আজো আছে। তাইতো মীর জাফররা, ঘসেটি বেগমরা যুগে যুগে জন্মনেয় এবং তাদের রক্তের স্বভাবসুলভ কাজগুলো করে দেখায়। বঙ্গবন্ধু কেবল দেশের জন্যই ভেবেছিলো, দেশের মানুষের কথা ভেবেছিলো। কিন্তু ঘাতকরা ভেবেছিলো তাদের স্বার্থের কথা, জিঘাংসার কথা, প্রতিহিংসার কথা। তাইতো বুলেট সেদিন ঘাতকের নিশানা খুজে পেয়েছিলো। একটি জাতির পিতা, যার জন্য পেলাম একটি স্বাধীন দেশ, যার কথায় লাখো মানুষ ঝাপিয়ে পড়েছিলো সেই বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করতে আমাদের বুক কাপেনি এতটুকুও। কারন আমাদের রক্তে যে মীর জাফর, ঘসেটি বেগমদের রক্তের উপাদান প্রবাহমান আছে।
কষ্ট লাগে যখন ভাবতে হয় যার জন্য স্বাধীনতা পেলাম তাঁকেই হত্যা করতে বুক কাঁপেনি, হাত কাপেনি স্বাধীন দেশের ঘাতকদের। আজও ঘাতকরা ওৎপেতে আছে। আজও ঘাতকরা বুক ফুলিয়ে চলে। কতটা নির্লজ্জ হলে এমনটা করতে পারে। ঘাতকরা জানতো না, মহামানব দেহ ত্যাগ করলেই সব শেষ হয়ে যায় না, থেকে যায় তার আদর্শ, থেকে যায় তার নীতি, থেকে যায় তার বাণী, থেকে যায় তার ঐতিহাসিক ভাষণ। বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে আর নেই কিন্তু আমরা বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে, তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ অনুসরন করেই পথ চলছি। তাইতো বঙ্গবন্ধুদের মৃত্যু হয় না। যেমন মৃত্যু হবে না লাখো শহীদের রক্ত দানের-জীবন দানের ইতিহাসের, তাঁদের ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশের। তাইতো সবাই বলেন, বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ একই সূত্রে গাঁথা, এক অবিচ্ছেদ্য নাম। জাতীয় শোক দিবসে সেই মহান নেতার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।

No comments:

Post a Comment