ভালবাসি প্রকৃতি

ভালবাসি প্রকৃতি

Saturday, July 28, 2018

পথের পদ্য ॥ ২ ॥ পথের ভাবনা (তৃতীয় গ্রন্থের পান্ডুলিপি)


পথের পদ্য ॥ ২ ॥ পথের ভাবনা

আসাদুজ্জামান জুয়েল



উৎসর্গ

বাংলাদেশের সাধারণ সহজ-সরল মানুষের উদ্দেশ্যে
যারা সবকিছু সহজভাবে চিন্তা করেন
এবং
আমার প্রয়াত মা রওশনারা বেগম
পিতা আবদুর রশিদ খান






কিছু কথা

পৃথিবী আমার কাছে সবচেয়ে বড় পাঠশালা। আর সেই পাঠশালায় পড়তে হলে ঘুরতে হয়। ঘুরতে কার না ভাল লাগে। আমার তো বেশ ভাল লাগে। সেটা দেশেই হোক আর বিদেশেই হোক। ঘুরতে ঘুরতে রাস্তায়, ফুটপাতে, অলিতে, গলিতে, শহরে, বন্দরে যেখানেই যা দেখি তাই আমার হৃদয় কাড়ে। পথে ঘুরতে ঘুরতে যে বিষয় গুলো আমার হৃদয় কাড়ে সেই বিষয়গুলো নিয়ে লিখতেও পছন্দ করি। পৃথিবীর পাঠশালায় পাঠ নেয়ার সাথে সংবাদ পত্র, বই পাঠেরও বিকল্প নাই। দুনিয়াতে প্রতিনিয়ত ঘটছে নানান ঘটনা। কোন কোন ঘটনা হৃদয় কাদায়, কোন কোন ঘটনা হাসায়, কোন ঘটনা স্তব্ধ করে, কোন ঘটনা বিক্ষুব্ধ করে, কোন ঘটনায় পূলকিত হই, লিখতে তাগিদ অনুভব করি। আর সেই সব ঘটনা নিয়ে লেখাই আমার পথের পদ্য। আর পথের পদ্য গ্রুপের এই বইয়ের নাম পথের ভাবনা। 
আমি যখনই কিছু একটা লিখি তা গণমাধ্যমে ছেড়ে দেই। সেটা প্রকাশিত পত্রিকা, অনলাইন পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অথবা ব্লগে। লেখাগুলো প্রকাশের সাথে সাথেই আমার পাঠক বন্ধুরা মন্তব্য করেন। কেউ সমালোচনা করেন, কেউ একমত হয়ে আলোচনা করেন, কেউ পরামর্শ দেন, কেউ দেন উৎসাহ। আমি কৃতার্থ আমার পাঠক বন্ধুদের কাছে যারা আমার লেখাগুলো গ্রহণ করে এবং আমায় একের পর এক লিখতে উৎসাহ দিয়ে সহযোগীতা করে। 
আমি কৃতার্থ আমার আইনজীবী বন্ধুদের কাছে যারা আমাকে লেখায় প্রতিনিয়ত উৎসাহ যুগিয়েছেন। লেখালিখি করতে গেলে, তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে, ঘুরতে গেলে অনেক সময় প্রয়োজন হয়। আমার কর্মজীবণের ফাকে যতটুকু সময় অবশিষ্ট থাকে তা পরিবারের প্রতি বরাদ্দ রাখা উচিত ছিলো। কিন্তু আমি আমার পরিবারকে সেই সময় দিতে পারিনি তাই আমি কৃতার্থ আমার সহধর্মীনি মুনমুন সুলতানা লুনার কাছে যে আমাকে লিখতে সময় দিয়েছে এবং উৎসাহ দিয়েছে। কিছু মানুষ আছে যাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ঋণ শোধ করা যায় না। আমার লেখালিখিতে যাদের কাছে ঋণি হয়ে আছি তারা হলেন, আমার বোন কোহিনুর আক্তার শিখা, বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মাহবুবুল হক, জাপানের সিমানী ইউনিভার্সিটিতে সুনামী সিমুলেশন নিয়ে অধ্যয়নরত ভূতত্ববিদ ভবিষ্যতের ডক্টর শামীম আজিজ, প্রফেশনাল না হয়েও যিনি অসাধারণ প্রচ্ছদ শিল্পী মোঃ ফরিদ হোসেন, গান পাগল বন্ধু শামীম সরদার, আমার লেখার কড়া সমালোচক মোস্তাফিজুর রহমান নয়ন যাদের উৎসাহে, প্রশ্রয়ে, আসকারায় আমার লেখালিখি। 
আমি আগেই বলেছি, আমি কোন লেখক নই। তাই আমার লেখায় শব্দ গঠনে, বানানে অনেক ভুল আছে। অনেক তথ্য যেহেতু ধার করা তাই ভুল তথ্যেরও সন্নিবেশ ঘটতে পারে বা ঘটেছে এটা আমি অবনত মস্তকে স্বীকার করছি। আমি আমার অযোগ্যতাকে লুকাতে চাই না। অনিচ্ছাকৃত ভুলগুলো আমার অজ্ঞতা, অযোগ্যতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই আমার ভুল গুলো পাঠক বন্ধুরা উদার চিত্তে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে লেখাটা গ্রহণ করবেন বলেই আমার আশা।
আসাদুজ্জামান জুয়েল
আইনজীবী
শরীয়তপুর।








সূচীপত্র

জোকের তেল, তাবিজ-হালুয়া আর কত কাল?
ছেঁড়া দুই টাকার নোট .....
নগরীর উৎপাত ঃ লিফলেট বিলি
ভাল ঋণ-মন্দ ঋণ ॥ ব্যাংকার ও আইনজীবীর দায়
জঙ্গি-মঙ্গি কিছুই নয় ॥ ইসরাইল শান্তিকামী বিশ্বের জন্য আজরাইল
কুকুর-বিড়াল-বৃদ্ধ-মহিলা-শিশু-গরু-গন্ড মূর্খ দেখলে সাবধান!!
আমার মায়ের ডাক ও মুখ
সাগরে ভাসছে মানবতা ঃ কোথায় এখন মানবাধিকার?
নেতা ভক্তির নমুনা!!!
১০ কেন এমন হয়!! এই দেশেতে মৃত্যু ভাগ্য তাদের কেন নয়?
১১ চোখের বালি...
১২ রামু বৌদ্ধ বিহার দর্শন, চুল্লবর্গ বিক্রয়ের নামে প্রতারনা!
১৩ শরীয়তপুরের লিজা হত্যা ॥ হলুদ সাংবাদিকতায় আতঙ্ক ছড়ায় একদল জানোয়ার
১৪ অতীত ঐতিহ্যের কাশ-পিতল শিল্প ঃ আজ শিল্পীও নেই শিল্পও নেই
১৫ পাগল নিয়ে পাগলামী
১৬ আপা নিয়ে চাপাচাপি
১৭ রাজীতিক ও আমাদের শিক্ষা
১৮ দাদুর নির্বাচনী গল্প
১৯ ডানপন্থীর চেয়ে বামপন্থীই ভালো
২০ দোষ আমারই!!
২১ শরীয়তপুর-চাঁদপুর সড়ক ও হরমুজ মিয়ার শেষ ইচ্ছা!
২২ মা আসে মা যায়। এ এক প্রকৃতির চক্র
২৩ মাদক নিয়ে মাতামাতি ক্রস ফায়ারে হাতাহাতি
২৪ কষ্ট করে ধরা আসামী বিচারক ছাড়ে আইনজীবীরা ছাড়ায়!
২৫ মাদক মুক্ত সমাজ গড়ার সহজ পদ্ধতি ॥ প্রয়োজনে রেশন প্রথা চালু করুন!!!
২৬ বিচার বহির্ভূত হত্যা ॥ ভয় হয়, প্রেসরিলিজের বিষয় হতে পারেন আপনিও!
২৭ বাবার কষ্ট ও বাবা হওয়ার তৃপ্তি ॥ বাবা সেকালে ও একালে
২৮ বিচার বিভাগ ও চিকিৎসা দু’ই আস্থার জায়গা ॥ বিতর্ক করলে আমাদেরই ক্ষতি
২৯ ইকবাল সোবহান চৌধুরী ও মাহমুদুর রহমানের উপর হামলা একই সূত্রে গাথা




-----------------------------------------------------


জোকের তেল, তাবিজ-হালুয়া আর কত কাল?

॥ ০১ ॥ 
নিয়াজ সাহেব ফুটপাত দিয়ে হাটতে হাটতে হঠাৎ থেমে গেলেন। পাশেই একটি জটলা। গোল হয়ে উৎসুক মানুষের ভির। কথার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। কৌতুহল আটকে রাখতে পারলেন না। নিয়াজ সাহেব তাকালেন ভিরের দিকে। 
ভিরের দিকে তাকাতেই তার চোখ আটকে গেলো একটি লাল প্লাস্টিকের বড় বলের দিকে। বল ভর্তি তরতাজা জোক কিলবিল করছে। গ্রামে এই জোকগুলোকে বলা হয় করাতি জোক। ময়লা আবর্জনা ভর্তি পুকুরে নামলে এই জোকগুলো পায়ের সাথে লেপটে থাকে। রক্ত চোষা জোকগুলো মুহুর্তেই মোটা হয়ে যায় রক্ত খেয়ে। দেখলেই কেমন গা ঘিন ঘিন করে! 
নিয়াজ সাবে কৌতুহল নিয়ে দাড়িয়ে গেলেন। দেখলেন বল একটি নয় পাঁচটি। প্রতিটি বলে হাজার হাজার জ্যান্ত জোক। কিলবিল করছে। দেখলেই কেমন গা গুলায়! একটার গা বেয়ে আরেকটা বলের প্রাচীর বেয়ে উপর উঠে আসার চেষ্টা করছে পেট মোটা জোকগুলো। জোকগুলো বল বেয়ে বেয়ে উঠে যেতে চাইছে বাইরে। যেই না উঠতে চাইছে অমনি এক ব্যক্তি লাঠি দিয়ে বলের কাধে বাড়ি দিলো। আর অমনি উঠতে থাকা লকলকে জোকগুলো ঝর ঝর করে পড়ে গেল বলে রাখা পানিতে। ছোট খাট একটি জটলা। লক লকে রোগা পাতলা একজন লোক। বিদঘুটে চেহারা। জোক দেখলে যেমন গা ঘিন ঘিন করে তেমনি লোকটাকে দেখলেও গা ঘিন ঘিন করে। তেল চিটচিটে একটি ফতুয়া পড়া। পান খাওয়া দাত। তরমুজের বিচির মত দেখতে। মুখে কাচাপাকা দারি। লোকটি প্লাস্টিকের মোড়ার উপর বসা। হাতে একটি তেলতেলে লাঠি। লাঠিটাই তার প্রধান হাতিয়ার। কোন কিছু দেখাতে লাঠিটা ব্যবহার করছেন। আবার প্লাস্টিকের বল বেয়ে উঠে যাওয়া জোকগুলোকে নামাচ্ছেন। লাঠি দিয়ে বলের উপর বাড়ি মারলে মন্ত্রের মত কিছু জোক সুর সুর করে নেমে যাচ্ছে আর কিছু জোক যেন লাফ দিয়ে বলের পানিতে ঝাপ দিচ্ছে। মোড়ায় বসে লাঠি হাতে লোকটা লেকচার দিচ্ছে। তাদের কথাকে সবাই লেকচার আর তাদেরকে সবাই লেকচারার বলেই ডাকে।
না, এই ব্যাক্তি পিএসসির মাধ্যমে বিসিএস দিয়ে লেকচারার হননি। আবার বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও লেকচারার নন তিনি। তিনি রাস্তার লেকচারার। রাস্তায় লেকচার দিতে দিতে লেকচারার হয়েছেন। কথায় আছে না? বকতে বকতে হয় বক্তা, আর পিটাতে পিটাতে হয় তক্তা! উনি বকতে বকতে বক্তা অর্থাৎ লেকচারার হয়েছেন! 
তো, লেকচারার সাহেব বসে আছেন লাঠি হাতে। বলগুলি ভর্তি জোক। একটা বড় প্লাষ্টিকের কাগজ বিছানো। তার চতুর্দিকে সারি সারি বয়াম। বয়াম ভর্তি বড় সাইজের জোক। এক একটি জোকের সাইজ হবে আট থেকে দশ ইঞ্চি। দেখলে মনে হবে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে জোকগুলো।
নিয়াজ সাহেব দাড়িয়ে পড়লো জোকগুলো দেখে। জোক দেখে তার গা ঘিন ঘিন করতে লাগলো। তবুও দেখার ও লেকচার শোনার ইচ্ছা সংবরণ করতে পারলো না। লেকচারার সাহেব তার লেকচার শুরু করলো-
-ভাই সাব। জীবনে অনেক কিছু দেখেছেন আর অনেক কিছু শুনেছে আবার অনেক চিকিৎসা নিয়েছেন। কোন ওষুধে কাম হয় নাই। আমার কাছে আজ শুনে যান কিভাবে সফল হবেন। ওষুধ কিনতে হবে না। শুনলে কিনতে হয় না, দেখলে ও কিনতে হবে না। কেনা না কেনা আপনার ব্যাপার! নিয়মটা শুনে যান কিভাবে বানাইবেন আর কিভাবে ব্যবহার করবেন। এই জোকের তেল ব্যবহার করলে ---শক্ত মজবুত হবে। ব্যাথা বেদনা দুর হবে।
প্লাস্টিকের বলের উপর তেলতেলে লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরে বললেন-
যাবেন না। নিয়মটা শুনে যাবেন। আমার এই ঔষধের নিয়ম জানলে ঔষধ আর নিয়ম না জানলে বিষ। তাই নিয়মটা শুনে যাবেন।  
এভাবে প্রায় অর্ধশত রোগের নাম বললো যা কিনা অনেক এমবিবিএস ডাক্তাররাও ভাল করার কথা বলতে পারে না। সেই সব রোগের জন্য লেকচারার সাহেব শতভাগ গ্যারান্টিসহ চিকিৎসার নিশ্চয়তা দিলেন।
একটু দম নিয়ে লেকচারার সাহেব আবার শুরু করলেন-
ঃ আমার ওষুধ আপনাদেরকে কিনতে হবে না। নিয়মটা শুনে যান। আর ওষুধ বানানের পদ্ধতিটা জেনে যান। নিজে বানাইয়া ব্যবহার করবেন। ভাল না হলে মুখের উপরে ছুড়ে মারবেন। এই দেহেন, এরকম দুইটি মোটা জীবন্ত জোক নিবেন। জোক দুটির মুখে লবন দিয়ে মেরে একটি ঝুনা নারিকেল (পাকা নারিকেল) নিবেন। নারিকেলের মুখ ছিদ্র করে পানি ফেলে দিবেন। চাইলে পানিটা নিজে খেতে পারেন অথবা আপনার বিবি বাচ্চাকেও খাওয়াইতে পারেন। পানি শেষ হলে এই জোক দু'টাকে ভিতরে ভরবেন। এর সাথে ভরবেন পারদ, ---- সহ ---
এভাবে আট দশটি উপাদানের নাম বলে একটু দম নিলেন। প্লাস্টিকের বলের ঘারে বাড়ি মারতে মারতে আবার শুরু করলেন। 
এর পর নারিকেলের মুখটা বন্ধ করে আমাবষ্যা-পূর্ণিমার মাঝামাঝি রাতে কালিঘাটে গিয়ে এক নিশ্বাসে মাটির নিচে পুতে রাখবেন। রাতটা যেন শনিবার হয়। এর পর তিন মাস পরে আবার শনিবার রাতে তুলে আনবেন। হাতল ছাড়া ভোতা দা দিয়ে এক কোপে কেটে নারিকেল দুই ভাগ করে ফেলবেন।
মনে রাখবেন কোপ দেয়ার সময় নিঃশ্বাসটা যেন বন্ধ থাকে। আর কাটবেন এক কোপে! সামচুর মত কোপাইলেই হইবো না।
কাটার পরে দেখবেন ভিতরে ক্যাদার মত হয়ে গেছে। সেই ক্যাদার মত বস্তু এক নিশ্বাসে তুলে একটি মাটির পাতিলে এক পোয়া সরিষার তেল, এক পোয়া তিলের তেল, ----- দিয়ে মাটির পাতিলে মাটির চুলায় তেতুলের লাকরি (চলা কাঠ) দিয়ে ভাল করে জাল দিতে হইবো।
মনে রাখবেন, গ্যাসের চুলায় রানলে কিন্তু হইবো না। এর পর যেই তেল বাইর হইবো সেই তেল নতুন একটা গামছা দিয়া ছাকবেন। ছাকা তেল দিয়া মালিশ করবেন। ঘা, প্যাচরা, দাউদ, একজিমায় লাগাইবেন। রাতে খাউজাইয়া রাতেই লাগাইবেন সকালে কইতে পারবেন না কোন খানে খাউজাইছেন আর কোন খানে লাগাইছেন। এত ভাল কাজ করবো। ইনশআল্লাহ। ভাল নিয়ত করে লাগাইবেন। দেখবেন সকল রোগ ভাল হয়ে গেছে।
ভাই সাব। আমি আগেই কইছি, আমার ওষুধ নিয়ম জানলে ওষুধ নিয়ম না জানলে বিষ!। সেদিন হাটে থেকে এক লোক ওষুধ কিনছে। পরদিন তার পুতেরে লইয়া আইছে। বলে, মিয়া কি ওষুধ দিছেন? পুতের বিচি ফুইল্যা গেছেগা! আমি কইলাম, ক্যা কি হইছে? লোকটায় কয় ওষুধ লাগানোর পর তার পুতের বিচি ফুইল্যা ঢোল হইয়া গেছে! আমি জিগাইলাম কেমনে ব্যবহার করছেন? লোকটায় কয়, ক্যান? আপনি যেমনে বলছে তেমনেইতো লাগাইছি।
আমি জিগাইলাম কেমনে লাগাইতে কইছি কনদিহি?
লোকটায় কয় প্রথমে হারিকেনের উপর পুতের বিচি গরম করছি, তারপর তেলডা লাগাইছি। এহন দেহি পুতের বিচি ফইল্যা বড় ঢোল হইয়া গেছে। 
এইবার বোঝেন অবস্থা! আমি কইছি, হারিকেনের উপর তেলডা গরম কইরা বিচিতে লাগাইতে আর উনি বিচি গরম কইরা তেল লাগাইছে! দোষ কি আমার ভাই সাব? তাইতো বলি নিয়ম না জানলে বিষ। 
তবে ভাই আর একটা কথা, আমার ওষুধ ঘারে ব্যাথায় লাগাইবেন, মাজায় ব্যাথায় লাগাইবেন, পিঠে ব্যাথায় লাগাইবেন কিন্তু মনের ব্যাথা হলে লাগাইবেন না। এ ওষুধ মনের ব্যাথা সারে না। 
কিন্তু ভাই সাব। আমি জানি আপনারা এত কিছু জোগার করতে পারবেন না। একটা যদি ভুল হয় তবে ক্ষতি হয়ে যাবে। তাই আমি আপনাদের কথা ভেবে তৈরী করে রেখেছি। মূল্য এক দাম পঞ্চাশ টাকা। কিন্তু প্রচার পাবলিসিটির জন্য আজ পঞ্চাশ টাকা নেব না। আজ একদম পানির দরে দিয়ে যাব দু’একটা কাস্টমার ধরার জন্য। আমার ওষুধে যদি রোগ ভাল হয় তবে দু’একটা রুগি আমারে আপনারার দিবেন না বাজান? আমি জানি দিবেন। তাই একে দুই ভাগে ভাগ করে এক ভাগ ফেলে দিলাম। বাবারা হাতে থাকে কত? জোরে বলুন।
পাঁচ-ছয়জন লোক বলে উঠলো-
ঃ পচিশ টাকা।
ঃ পচিশ টাকাকে পাঁচ ভাগ করে দুই ভাগ ফেলে দিলাম। থাকে কত?
ঃ পনের টাকা।
ঃ হ্যা! পনের টাকা দিয়ে এখন সর্ব প্রথম যে ভাই আমারে সরমান (সম্মান) করবেন আমি তাকে এমন একটা সরমান করবো যা আপনি ভাবতেও পারছেন না।
প্রথম একজন হাত তুলতেই একে একে দশ-বার জন হাত তুলে দাড়িয়ে গেল। বেশ ভালই বিক্রি হলো। নিয়াজ সাহেব হতাশ হয়ে চলে গেল তার কাজে। যেতে যেতে ভালছেন, এও কেনে মানুষ? কিভাবে সহজ সরল মানুষগুলোকে ঠকাচ্ছে আমাদের চোখের সামনে। 
॥ ০২ ॥ 
বিশিষ্ট আলেম মানুষ। চারমুষ্ঠি দাড়ি। কাঁচা-পাকা দাড়িতে মেহেদী দেয়ায় বেশ ভালই লাগছে। নূরানী চেহারা দেখলেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করবে। সামনে নানান রকম জিনিস নিয়ে বসে আছেন। একটা করে ধরেন আর একদমে বলে যান-
ঃ এটা ধনেশ পাখির ঠোট, একটু দিয়ে দিলাম; এটা মহা সমুদ্রের কট মাছের কাটা, একটু কেটে দিলাম; এটা বনরুই এর ছাল, একটু কেটে দিলাম; এটা কুলুকুলু গাছের ছাল, একটু কেটে দিলাম; এটা ফাঁসির দড়ি, একটু কেটে দিলাম; এটা জারজ মানুষের হাড়, একটু কেটে দিলাম; --- ।
এভাবে প্রায় পঞ্চাশ ধরনের জিনিস একটু কেটে দিলাম-একটু কেটে দিলাম বলে কেটে দিলো। এরপর কিছু কাগজ পেচিয়ে একটা তাবিজ তৈরী করলো। একটা মাদুলিতে ভরে বলে-
ঃ ভায়েরা। নিজের চোখে দেখলেন কতগুলি আইটেম একটু করে কেটে দিয়ে দিলাম। এর হাদিয়া যদি হাজার টাকাও ধরা হয় তবে এর মূল্য দেয়া হবে না। শুধুমাত্র আপনাদের কথা ভেবে এর হাদিয়া নেব দশ টাকা চার আনা। এক দাম এক রেট। কোন দামাদামি নেই। এটা তেলে চুবাইয়া গায়ে মাখবেন, গায়ের রং ফর্সা হবে। পানিতে চুবাইয়া পানি খাইবেন পেটের সকল ওষুক ভাল হইবো। গলায় বাধবেন- ভাল গান গাইতে পারবেন, হাতে বাধবেন- হাতে শক্তি বাড়বো। কিন্তু মাজায় বাধবেন না। যে যেই নিয়ত করে বাধবেন ভাল হয়ে যাবে ইনশআল্লাহ। একশত ভাগ গ্যারান্টি। ভাল হয় নাই এমন প্রমান এখন পর্যন্ত কেউ দিতে পারে নাই। দিতে পারলে মূল্য ফেরৎ। আর আমি জানি কেউ দিতে পারবেও না।
এখানেও একজন প্রথম ‘সরমান’ করার জন্য দাড়িয়ে গেলো। এর পর আর ক্রেতার অভাব হলো না। সরলমতি-কোমলমতি সাধারণ লোকের কান্ড দেখে হতাশ নিয়াজ সাহেব দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে চলে গেল।

॥ ০৩ ॥ 
বিশাল একটি লাল ত্রিপল বিছিয়ে তার উপর চলচ্চিত্রের ফিল্ম রাখার বক্সে ভরা বিভিন্ন শুকনা দ্রব্য। এক একটা দেখাচ্ছে, তার নাম ও গুনাগুন বলছেন হাকিম সাহেব। না। এই হাকিম কোন হুকুম করার হাকিম না। ইনি ইউনানী দাওয়াখানার চিকিৎসক বিশিষ্ট হারবাল গবেষক! হেকিম আবদুল কুদ্দুস মিয়া। পাত্রে সাজানো দুই শতাধিক দ্রব্য দেখিয়ে পাশে রাখা দশ-বারটি হরলিকস এর বয়াম ভর্তি গুরা একটা চকচকে স্টিলের বলে রাখলো। সেই সাথে কিছুটা মধু, ঘি, কিসমিস দিয়ে মাখালেন। এর পর নাম না জানা অপরিচিত কিছু গুরা দিলেন। দেয়ার সময় এক একটি দেখিয়ে বললেন-
ঃ এটার নাম বাতাসের আগা, আর এটার নাম রৌদ্রের গুরা। আর এখন দিচ্ছি কিছু পাহাড়ের ঘাম।
এই সব মিশিয়ে তৈরী হলো এক অনন্য হালুয়া। যা দেখতে অনেকটা চাটনির মতো। হাকিম সাহেব ঘোষনা দিলেন এই হালুয়া খেলে নব্বই বছরের বুড়ার বয়স মনে হবে আঠারো কি উনিশ। আর বার বছরের কিশোর খেলে বিশ কি বাইশ বছরের যুবকের মত উন্মাদ হয়ে যাবে। ওষুখ থাকলেও খাবেন আর না থাকলেও খাবেন। যতবড় কোষ্ঠকাঠিন্যই হোক না কেন এটা খেলে বাথরুমে যেয়ে কোৎনা দিতে হবে না। শুধু পিছনের কাপড়টা তুলে বসলেই হবে। দেখবেন ওষুধের কেরামতি। খেয়ে আপনি রাতে ঘুমাবেন কিন্তু আমার ওষুধ ঘুমাবে না। আমার ওষুধ সমানে কাজ করবে।
চটকদার কথা শুনে রিক্সা চালক, শ্রমজীবি টাইপের লোকজন ত্রিশ টাকা, পঞ্চাশ টাকা মূল্যের বিভিন্ন ফাইল কিনে নিলো। সর্ব রোগের মহৌষধ মাত্র ত্রিশ টাকা-পঞ্চাশ টাকা। এ সুযোগ হাত ছাড়া করাটাই যেন বোকামি!
নিয়াজ সাহেব বোকা বনে গেলেন। হায়রে বোকার দল! এগুলো খেলে এমনিতেই পেট খারাপ হয়ে পেট নেমে যাবে। কষাতো থাকবেই না নির্ঘাৎ ডায়রিয়া হয়ে যাবে।
বন্ধুরা, উপরের তিনটা ঘটনা কোন গাল গল্প নয়। আমাদের দেশের পথের ধারের বাস্তব ঘটনা। এভাবেই প্রশাসনের নাকের ডগায় আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ সকল রোগের ঔষধ হিসেবে ফুটপাতের লেকচারারদের পাতা ফাঁদে ধরা দিয়ে কিনে নিচ্ছে নানান তেল-মালিস করার জন্য, নিচ্ছে তাবিজ, খাচ্ছে হালুয়া আপদ-বালা-মুসিবত থেকে ভাল হবার জন্য।
সবার মনে একটাই প্রশ্ন, কেনই বা তারা এসব কিনে নিচ্ছে। ব্যবহার করে অপ চিকিৎসার শিকার হচ্ছে। আসলে অজ্ঞতা, অশিক্ষার সাথে সাথে সরকারের অবহেলা কি নাই। আছে। সরকার যদি যথাযথ স্বাস্থ্য সেবা দিতে পারতো। চিকিৎসক নামের একশ্রেণীর কিছু কষাই এর হাতে যদি রোগিকে জবাই হতে না হতো তবে কেউ এই সর্টকাট চিকিৎসায় উৎসাহী হতো না। আমাদের যেমন শিক্ষার অভাব আছে। আছে অবকাঠামোর অভাব। তেমনি আছে চিকিৎসকদের মানসিকতার অভাব। চিকিৎসকদের সুচিকিৎসা এখন সেবা নয় পন্য হয়ে গেছে। চিকিৎসকরা যদি অজ্ঞ, সহজ, সরল রোগিদের হাসপাতালমুখি করে সঠিক চিকিৎসা নিতে উৎসাহী না করে তবে তারা হাসপাতাল বিমুখ থেকেই যাবে। আর রাস্তায় দাড়িয়ে কিনবে জোকের তেল, তাবিজ আর হালুয়া।
আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে আমাদের? আসুন সবাই মিলে সচেতন হই। অসুখ বিসুখ হলে চিকিৎসকের সরনাপন্ন হই। সকল চিকিৎসকই খারাপ না। গুটিকয়েক অপচিকিৎসকের কারনে মানুষ হতাশ হচ্ছে। এখনো অনেক চিকিৎসক আছে যারা সমাজকে দিয়ে যাচ্ছে। অপ চিকিৎসা থেকে দুরে থাকি এবং সবাই মিলে অপ চিকিৎসা থেকে দুরে থাকি এবং সবাই মিলে অপচিকিৎসকদেরও মানসিক চিকিৎসা করাই।


-----------------------------------------------------



ছেঁড়া দুই টাকার নোট .....

কেমন আছেন?
জাবেদ সাহেব রিভলবিং চেয়ারে বসা। চোখ আধ বোজা, একটু একটু দোল খাচ্ছিল। প্রশ্নটা শুনে একটু নড়েচড়ে বসলেন। এক গাল অরেঞ্জ ফ্লেভারের হাসি হেসে উত্তর দিলেন-
ঃ ভাই ছেঁড়া দুই টাকার নোটের মত আছি আরকি।
উত্তরটা শুনে একটু অবাকই হলাম। এটা আবার কেমন ভাল থাকা! জিজ্ঞেস করলাম-
ঃ তার মানে ?
ঃ মানে? মানে বাসে বলেন, দোকানে বলেন, যেখানেই যাবেন ছেঁড়া ফাটা দুই টাকার নোটের অবস্থা খারাপ হলেও চলছে। আমার অবস্থা অনেকটা তাই। ভাল না হলেও জীবন চলে যাচ্ছে একরকম।
কথাটা জাবেদ সাহেব মন্দ বলেননি। দুই টাকার নোটের যা অবস্থা! ছেঁড়া, ময়লা, দেখলেই মনে হবে বাংলাদেশের এই দুই টাকার নোটের উপর দিয়ে সিডর বয়ে গেছে বার বার। ধ্বংসের ছাপটা তাই স্পষ্ট।
দুই টাকার নোটের মূল্যমান যদিও দুই টাকা অর্থাৎ দুই শত পয়সা এটা সবারই জানা। যে বিষয়টা না জানেন সে হয় শিশু নয় পাগল। কিন্তু দুই টাকার একটি নোট জোড়া দিতে অনেক সময় দেখা গেছে পচাত্তর পয়সার আঠা, পচিশ পয়সার স্কচ টেপ, কখনওবা কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে। দুই টাকার একটি নোটে দুই থেকে দুই দশে বিশটি জোড়া তালি পেলে অবাক হওয়ার কোন কারন নেই। বরং কোন দুই টাকার নোটে যদি জোড়া তালি না পাওয়া যায় তবে ভাবতে হয়;
হায়! দেশের জালিয়াত চক্রের মাথা বুঝি গেছে! দুই টাকার মত মূল্যমানের নোটেরও কি শেষ পর্যন্ত জাল ছেপে নিলো? হ্যাঁ! নতুন দুই টাকার নোট দেখলে জাল কিনা সেটাই চিন্তা করে প্রথম!!
তবে নোট যতই ছেঁড়া বা ফাটা হোকনা কেন তার কদর আছে। বাসের কণ্ট্রাক্টরকে যতই ছেঁড়া-ফাটা নোট দেন কোন সমস্যা হবে না। মামা ডেকে প্লাস্টিকের হাসি হেসে সাদরে গ্রহন করবে টাকাটা। আবার যখন ভাংতি দেবে তখন ঐ দুই টাকার ছেঁড়া-ময়লা নোটই আপনাকে ধরিয়ে দেবে। যদি নিতে না চান তবে হাসি মাখা মুখে বলবে-
ঃ মামা নেন। না চললে আমারে ফেরৎ দিয়েন।
ঃ তোমাকে পাব কোথায়?
ঃ গাড়ির নাম্বারটা লেইখা লন! কোন সমস্যা হইবো না।
ঃ তোমার তো সমস্যা নাই, সমস্যা তো আমার।
ঃ মামা আমারতো সমস্যা নাই, আপনারও সমস্যা হইবো না।
তবে সত্যিই কোন সমস্যা নাই। যাকে দেই তাকেই বলি সমস্যা নাই। যে দেয় সেই বলে সমস্যা নাই। সত্যিই এক সময় ছেঁড়া দুই টাকার নোট এতটা ‘চল’ হয়ে গেল যে কয়েন পকেট থেকে পড়ে যাবে ভেবে মানুষ ছেঁড়া দুই টাকার নোট চেয়ে নেয়া শুরু করে।
ছেঁড়া টাকার কথা বলতে বলতে ছেঁড়া টাকা নিয়ে তৈরী করা একটা বিজ্ঞাপন চিত্রের কথা মনে পড়লো। ভালই লেগেছে দেখে, আপনাদেরও নিশ্চই মনে আছে!!
এক ভদ্র মহিলা বাজারে গিয়ে দোকানির কাছ থেকে কিছু তরি-তরকারি, শাক-সবজি কিনলেন। যার মূল্য হলো-ধরুন আটানব্বই টাকা। দোকানিকে ভদ্র মহিলা একশত টাকার একটি তরতাজা কচকচে নতুন নোট দিলেন। দোকানি ভদ্র মহিলাকে দিল ছেঁড়া দুই টাকার একটা নোট। তা আবার যেন তেন নোট নয় সিডরে বিধ্বস্ত দুই টাকার নোট! নোট দেখে ভদ্র মহিলাতো ক্ষেপে গেলেন। রাগে ক্ষোভে গজরাতে গজরাতে বললেন-
ঃ আরে! আপনাকে এত সুন্দর একটা নতুন নোট দিলাম। অথচ আপনি আমাকে এমন একটা ছেঁড়া ফাটা নোট দিলেন? বদলে ভাল একটা নোট দেন। এটা চলবে না।
দোকানি বললো-
ঃ কন কি আফা! চলবো। দুই টাহার নোট আবার অচল আছে নাকি? লাম্বারটা আছে কিনা হেইডা খালি দেখবেন।
ঃ না না এটা চলবে না। আমায় টাকা বদলে দিন।
দোকানি আর ভদ্রমহিলা চেচামেচি শুরু করে দিলো। ‘চলবে আর চলবে না’ এ কথা নিয়ে শুরু হয়েছে দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি। দুজনে ঝগড়া চলছে ফাটাফাটি। এমন সময় এক অতি বুদ্ধিমান মহিলা এসে বললেন-
ঃ দেখি টাকাটা চলবে কিনা?
দোকানি একটু হালে পানি পেল। ভদ্র মহিলাকে টাকাটা দেখিয়ে বললো-
ঃ দেহেন তো মেডাম! টাহাডা বোলে চলতো না?
ঃ হুম!! দেখছি, চলে কি না?
এই বলে ভদ্র মহিলা টাকাটা তার হাতে নিয়ে সবজির ঝুড়িতে ফেলে হাত ইশারা করে বলেন-
ঃ আসো সোনা, আসো, এদিকে আসো।
ঝুড়িতে পড়ে থাকা টাকা আগের মতই পড়ে রইলো। কোন নড়াচড়া করলো না। এবার একটু ধমকের সুরে-
ঃ আয়, আয় বলছি। এদিকে আয়।
এতেও যখন টাকা নড়লো না তখন জোড়ে ধমক দিয়ে বললো-
ঃ আয়, আয় বলছি। নইলে দেব মার।
যথারিতি রেজাল্ট আগের মতই। অসুস্থ, ক্লান্ত দেহে নিথর হয়ে পড়ে রইল দুই টাকার নোটটি। এত ডাকাডাকির পরও যখন টাকাটা ভদ্র মহিলার কথা মত আসলো না। একটু নড়লোও না। যেখানে রয়েছে সেখানেই পড়ে রইলো। তখন ভদ্র মহিলা দোকানিকে বললো-
ঃ নাহ! দেখুন ভাই, কত বললাম। টাকাটা চললো না। মনে হয় চলবে না!
ক্রেতা ভদ্র মহিলা ফিক করে হেসে দিলো কান্ড দেখে।
দোকানি নোটটা রেখে দুটি কয়েন ধরিয়ে দিলো। দোকানিকে বোকা বানিয়ে গেল। এটা দোকানি বুঝতে পারলেও কিছু যে বলার নেই তাও বুঝতে পারলো। দোকানি অস্ফুট স্বরে বললো, আফা আপনেও নতুন তবে অচল টাকাই দিয়া গেলেন, যেখানে রাখছি সেখানেই পড়ে আছে, নড়েও না চড়েও না!!
বোকা বনে কয়েন দিলেও দুই টাকার নোট ছেঁড়া হোক, ফাটা হোক এর কদর যে আছে এটা কেউ অস্বীকার করবে না।
দেশের অবস্থা কি? রাজনীতির অবস্থা কি? অর্থনীতির অবস্থা কি? সামাজিক অবস্থা কি? খেলাধুলার অবস্থা কি? শিক্ষা-সংস্কৃতির অবস্থা কি? বাজারের অবস্থা কি? আয়ের অবস্থা কি? ব্যায়ের অবস্থা কি? সাধারণ মানুষের অবস্থা কি? এভাবে প্রশ্ন করলে প্রশ্নের অভাব হবে না।
এসব প্রশ্নের উত্তরে যদি বলা হয় যে, দুই টাকার নোটের মত, তবে কি ভুল হবে। সব কিছুরই অবস্থা ছেঁড়া, ফাটা, জোড়া তালি দেয়া, ক্ষয়িষ্ণু তবুও চলছে, চলে এবং চলবে।
আসলে ছেঁড়া দুই টাকার নোট কেন চলে? সাধারণ হিসাব এটা। যখন ভাংতি দেয়ার জন্য নতুন নোটের চাহিদা মোতাবেক যোগান থাকে না, তখনইতো চলে! দেশে যখন সুস্থ রাজনীতির অভাব, সুস্থ সংস্কৃতির অভাব, সুশাসনের অভাব, হাল ধরার যোগ্য লোকের অভাব দেখা দেয় তখন ছেঁড়া দুই টাকার মত চাহিদার যোগান হিসেবে চলে আসে অযোগ্য অপশক্তি। তাই দেশে দরকার সুস্থ রাজনীতির ধারা, গণতন্ত্রের ধারা, পরিকল্পিত অর্থনীতির ধারা। নইলে ছেঁড়া ফাটা নোট যেমন ঘুরে ফেরে হাতে হাতে আর শাসনের ভারও চলে যাবে ছেঁড়া ফাটা লোকের হাতে। যার পরিনাম ভাল হবে না।



-----------------------------------------------------


নগরীর উৎপাত ঃ লিফলেট বিলি

॥ ০১ ॥  
রফিক সাহেব ব্যস্ত ব্যবসায়ী। মতিঝিল ব্যাংক পাড়া থেকে কাজ সেরে দ্রুত বেড়িয়েছেন মিরপুর যাবেন বলে। মিরপুরগামী বাসের টিকেট কেটে বসেছেন জানালার ধারে। ভয়ংকর সীসা ও কার্বনডাই অক্সাইড মেশানো ফুরফুরে বাতা আসছে জানালা দিয়ে। বসে বসে ভাবছেন ব্যবসার কথা। হঠাৎ একটি ভিজিটিং কার্ড সাইজের শক্ত কাগজের টুকরো ক্ষেপনাস্ত্রের গতিতে এসে আঘাত করলো রফিক সাহেবের কপালে। আৎকে উঠলেন! দ্রুত জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলেন, নেকাবে মুখ ঢাকা বোরকা পড়া এক মহিলা। হাতে অনেকগুলো ভিজিটিং কার্ড নিয়ে জানালা দিয়ে ক্ষেপনাস্ত্র বা রকেট লাঞ্চার এর গতিতে ছুড়ে ছুড়ে মারছে যাত্রীদের দিকে। অনেকেই রফিক সাহেবের মত আৎকে উঠে তাকাচ্ছে জানালার দিকে। 
জানালা ছেড়ে অতঃপর ছুড়ে মারা কার্ডটির দিকে তাকালেন রফিক সাহেব। দেখেন একটি রুহানী দরবার শরীফ ও দাওয়াখানা’র বিজনেস কার্ড। কার্ডটিতে বড় বড় হরফে লেখা আছে ‘চিশতিয়া রুহানীয়া হুজুরীয়ার ওপেন চ্যালেঞ্জ। সপ্তাহের সব দিন খোলা। চিঠির মাধ্যমেও দাওয়াই দেয়া হয়। দেশে থাকুন আর বিদেশে থাকুন আমাদের ওপেন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করুন। বিফলে মূল্য ফেরত পাবেন। সফল হলে আস পাশের আরো দু’একজন রুগি পাঠাবেন ইনশাল্লা। আমরা অত্যন্ত যতেœর সাথে চিকিৎসা দিয়ে থাকি। যে যে রোগের চিকিৎসা দেয়া হয়- প্রেমে ব্যর্থতা, ব্যবসায় উন্নতি হয়না, পার্টনারের সাথে মনমালিন্য, স্ত্রীর সাথে অমিল, স্ত্রী অন্যের পরকীয়ায় হাবুডুবু খাচ্ছে, স্বামীকে বস করতে চান (গাধা বানতে চান), বিদেশ যাত্রায় বাধা, পাওনা টাকা নিয়ে টালবাহানা, রাজনীতিতে ব্যর্থতা, পুরাতন হাপানি, গ্যাষ্ট্রিক, আলসার, পড়াশুনায় অমনোযোগ। যেকোন সমস্যার জন্য চলে আসুন’। 
কার্ডটি পড়ে রফিক সাহেব নিজের অজান্তেই হেসে ফেললেন। লোকে বলে সব সম্ভবের দেশ আমার সোনার বাংলাদেশ! তাইতো মনে হচ্ছে এদের কথায়! কি না পারো এরা? আমাদের এতো সমস্যা!! আমাদের দেশের নেতা নেত্রীরা হিমসীম খাচ্ছে। কর্মকর্তা কর্মচারীরা দিন রাত খেটে যাচ্ছে। সমাজ কর্মীরা বিভিন্ন ফরমুলায় সমাজকে বদলাতে চাইছেন। চিকিৎসকরা চেষ্টা করে যাচ্ছে রোগ শোক সারানোর জন্য। অথচ এদের যদি আমরা নিয়োগ করে আমাদের সমস্যা গুলি তাদের হাতে ধরিয়ে দেই তবে কত সহজেই তারা সমাধান করে দিতে পারত!! এতে সময়ও বাঁচবে আবার অর্থও বাঁচবে। আমাদের বিশেষজ্ঞরা, আমাদের বিশাল জনশক্তি অন্যকাজে সময় দিতে পারবে!!
রফিক সাহেব কথাগুলো ভাবে আর মনে মনে হাসে। আহ্ কি বিচিত্র এই দেশ!!
॥ ০২ ॥ 
মহসিন সাহেব মেয়েকে নিয়ে মতিঝিল এসেছিলেন। থাকেন নারায়নগঞ্জে। মেয়ে একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দেবেন। ইন্টারভিউ শেষে নারায়নগঞ্জের বাসে রওয়ানা দিয়েছেন বাসায় যাবেন বলে। বাসে বসে মেয়ের কাছ থেকে ইন্টারভিউ সম্পর্কে খোজ খবর নিচ্ছেন। 
বাস যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা মোড়ে ট্রাফিক সিগনালে থামার সাথে সাথে বাসের জানালা দিয়ে মেয়ের কোলে এসে পড়ল একটি রঙ্গীন ফোল্ডিং লিফলেট। তাকাতেই দেখাগেল লিফলেটের উপরে একটি রঙ্গীন ছবি যাতে এক যুবক এক যুবতীকে আলীঙ্গন করে আছে। তাকিয়ে বাবা ও মেয়ে দুজনই বিব্রত। লিফলেটটি একটি ইউনানী দাওয়াখানার। 
এই লিফলেটেও একই ধরনের লেখা। যেখানে লেখা আছে- যৌন চিকিৎসা সহ সকল রোগের চিকিৎসা ১০০% নিশ্চয়তার সাথে করা হয়। হেপাটাইটিস এ-বি-সি-ডি থেকে জেড পর্যন্ত, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, এইচআইভি-এইডস সহ সকল রোগ। তারা ছবি দেখেও রোগ নির্ণয় করে ঔষধ দিতে পারে। আবার বিদেশ থেকে নির্ধারিত ফি পাঠিয়ে দিলে তারা ডাকযোগে ঔষধ পাঠিয়ে দেয়। ভাল হওয়ার বিষয়ে কোন চিন্তা করার প্রয়োজন নেই!! ১০০% নিশ্চয়তাতো আছেই। 
রফিক সাহেব বা মহসিন সাহেবের মত বিব্রতকর অযাচিত বিড়ম্বনায় আমরা সকলেই পরি। এটা বর্তমানে একটি নগরের উৎপাতে পরিণত হয়েছে। নগরির যাত্রাবাড়ী, সায়দাবাদ, মতিঝিল, গুলিস্থান, শাহবাগ, প্রেসক্লাব, ফার্মগেট, মহাখালীসহ অটো ট্রাফিক সিগনালের অথবা যে কোন বাস স্টপেজের কথাই বলুন না কেন এ উৎপাদ আপনাকে সহ্য করতেই হবে। 
খোজ নিলে দেখতে পাবেন এক শ্রেণীর ইউনানী দাওয়াখানা ও ঝারফুকদাতা ভন্ড হুজুরগন এসব বিজ্ঞাপন প্রচার করে সহজ সরল মানুষকে আকৃষ্ট করে। এসব দাওয়াখানা ও দরবার শরীফগুলোতে সাধারণত যৌন রোগকেই প্রাধান্য দেয়া হয় বেশী। এছাড়া সংসারে অমিল, প্রেমে ব্যর্থতা, বিদেশ যাত্রায় বাধা, শত্রুকে বধ করা, ক্যান্সার, গ্যাসট্রিক, আলসার, হেপাটাইটিস বি সহ সকল রোগের ব্যাপারে ১০০% নিশ্চয়তার সাথে কাজ করার প্রলোভন দেখায়। 
এই প্রচার কার্ড বা লিফলেটগুলো বিলি করার কাজে এক শ্রেণীর হত দরিদ্র মহিলা ও যুবকদের ব্যবহার করা হয়। সামান্য পারিশ্রমিক দিয়ে এদের কাজ করানো হয়। এই কাজে নিয়োজিত যুবক ও মহিলারা অনেক সময় পকেট মারার কাজেও ব্যস্ত থাকে। 
আপনি বাসে উঠছেন, সুযোগ বুঝে দক্ষ হাতে পকেট থেকে কখন যে মানিব্যাগটা নিয়ে নিয়েছে আপনি তা টেরও পাবেন না। আবার জানালার পাশে মোবাইলে কথা বলছেন। হঠাৎ মোবাইল টান মেরে উধাও!! আপনি শত চেচামেচি করেও আর মোবাইল ফিরে পাবেন না। শশুর বাড়ি থেকে নতুন ঘড়ি উপহার পেয়েছে! হাতে দিয়ে ঢাকায় এসেছেন। বাসে উঠে আনমনে বসে আছেন জানালার কাছে হাত দিয়ে। দেখবেন কেউ খুলে নিয়ে গেছে। ধরার কোন সুযোগই পাবেন না। শুধু হাত থেকে মোবাইল বা ঘটিড়ই নয়, কান থেকে দুল কানসহ ছিড়ে নিয়ে দৌর মারে এসব দৌরবিদেরা!!!! আপাত দৃষ্টিতে দেখতে লিফলেট বিলিকারী মনে হলেও এরা সময়-সুযোগ মত হয়ে যায় ছিনতাইকারী, পকেটমার। 
এ বিষয়ে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির উপরে গবেষণা করেন এমন কয়েক বন্ধুর সাথে আলাপ করলে তারা বলেন, এ সকল ভন্ড চিকিৎসক, ফকির, হুজুর, কবিরাজ আমাদের দেশের কোমলমতি মানুষের মনের স্পর্শকাতর বিষয়ে আঘাত করে তাদের উদ্দেশ্য সফল করে। অজ্ঞতার কারনে স্পর্শকাতর বিষয়ে কাউকে বলতে পারে না সাধারণ লোকজন। গোপন সমস্যা বা গোপন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বা চিকিৎসকদের সাথে অনেকেই কথা বলতে চায়না এবং লজ্জা বোধ করেন। অনেক শিক্ষিত লোকও তার সমস্যা নিয়ে সবসময় যথাযথ বিশেষজ্ঞর সাথে আলাপ করেন না, লজ্জাবোধের কারনে। ফলে ঐসব ভূয়া লোকের চটকদার কথায় সাধারণ মানুষ পটে যায়। 
চিকিৎসকদের সাথে আলাপ করলে তারা বলেন, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষকে সহজেই আকৃষ্ট করার জন্য এসব চটকদার বিজ্ঞাপন বিলি করা হয়। অশিক্ষা ও অজ্ঞতার জন্য সাধারণ মানুষ এদের কাছে গিয়ে প্রতারিত হয় প্রতিনিয়ত। তারা যে ঔষধ দেয় তাতে কোন রোগ ভালতো হয়ই না বরং অনেক সময় বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। নিজেদের সমস্যার কথা তো বলতেই পারে না আবার প্রতারিত হওয়ার কথাও বলতে পারে না। এসকল প্রতারকদের হাত থেকে দুরে থাকাই ভাল। শিক্ষাই পারে এ সকল প্রতারণার থেকে আমাদের রক্ষা করতে। আর প্রশাসন একটু হস্তক্ষেপ করলেই আমরা বিব্রতকর এসব লিফলেট বিলিকারীদের হাত থেকে বাঁচতে পারি, সাধারণ মানুষও প্রতারণার হাত থেকে বাঁচতে পারে।


-----------------------------------------------------

ভাল ঋণ-মন্দ ঋণ ॥ ব্যাংকার ও আইনজীবীর দায়

ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান পন্য হলো ঋণ। আপনি-আমি বিশ্বাসের সাথে টাকা জমা রাখি ব্যাংকে বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। আমাদের জমানো সেই আমানতের বিনিময়ে সুদ বা মুনাফা যে নামেই ডাকি না কেন পেয়ে থাকি। সেই সুদ বা মুনাফাটা দেয় কোথা থেকে? আমাদের আমানতের টাকা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করে। বিনিয়োগ থেকে আসা লভ্যাংশ বা সুদ বা মুনাফার একটা অংশ আমাদের দেয়। আর বাকীটা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের বিভিন্ন প্রয়োজন মেটায়। যেহেতু আমানতের টাকা বিনিয়োগ করে মানে ঋণ দেয় সেক্ষেত্রে ব্যাংক ঝুকি নেয়। এই ঝুকির প্রকৃয়ায় কে কে জড়িত, কার কতটুকু দায় সেটাই বিবেচ্য বিষয়। 
ঋণের সাথে জড়িত জামানত, জামানত হিসাবে সবচেয়ে ভাল বস্তু জমি, জমির সঠিকতা যাচাইয়ে দরকার আইন জানা লোক মানে আইনজীবী, আর সেই কাজটা করেন ব্যাংকের মনোনিত প্যানেল আইনজীবী বা আইন উপদেষ্টা। আমি যেহেতু একজন আইনজীবী, সাথে বিভিন্ন ব্যাংকের মনোনিত প্যানেল আইনজীবী বা আইন উপদেষ্টা, তাই ভাল ঋণ-মন্দ ঋণের বিষয়ে আমার নিজস্ব কিছু মতামত সকলের সাথে শেয়ার করতে চাই। 
ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পন্য ঋণ বা লোন। আর ঋণ বিক্রি অন্য সকল পন্য বিক্রির মত নয়। অন্য সকল পন্য ক্রেতাকে দিতে বা গছিয়ে দিতে পারলেই বিক্রেতার দায়িত্ব অনেকাংশে শেষ। কিন্তু ঋণ এমন পন্য যা বিক্রয়ের পরে বিক্রয়োত্তর সেবা-সুশ্রসা করতে হয়। ঋণ গ্রহীতা বা লোনের ক্রেতা ভাল থাকলে ঋণ ভাল। ঋণের ক্রেতা যদি ভাল না থাকে তবে ঋণ ভাল থাকবে না মন্দ ঋণে বা ক্লাসিফাইড লোন হয়ে যাবে। 
একটি ঋণ বা লোন বিক্রয় করার পূর্বে ক্রেতা সম্পর্কে অর্থাৎ ঋণ গ্রহীতা সম্পর্কে ব্যাংকের ভাল ধারনা থাকতে হবে। ব্যাংক অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ঋণ গ্রহণে আগ্রহী ব্যক্তি সম্পর্কে ভাল ভাবে খোজ নিয়ে একটা সুন্দর মধুর সম্পর্ক তৈরী করে। ঋণ নিতে আগ্রহী ব্যক্তির একটি হিসাব খুলে লেনদেন করতে বলা বা পূর্বের খোলা হিসাবের হিসাব বিবরণী (স্টেটমেন্ট) বা লেনদেন প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা। আমার বন্ধু বিশিষ্ট ব্যাংকার মোঃ কামরুজ্জামান মিন্টু সবসময় বলতেন, একটি ভাল ঋণ হলো সুখি মানুষের জামার মত। সারা রাজ্য ঘুরে যেমন সহজে সুখি মানুষের জামা মেলে না। তেমনি ভাল ঋণ গ্রহীতাও মেলা ভার। বন্ধু সবসময় বলতো, লেনদেন প্রতিবেদন দেখে ব্যাংক সন্তুষ্ট হলে ঋণ গ্রহণে আগ্রহী ব্যক্তির (৫ সি) (১) ঈযধৎধপঃবৎ, (২) ঈধঢ়রঃধষ, (৩) ঈড়হফরঃরড়হ, (৪) ঈড়ষষধঃবৎধষ ও (৫) ঈধঢ়ধপরঃু অর্থাৎ ১) চরিত্র, ২) মূলধন, ৩) অবস্থা, ৪) জামানত ও ৫) সক্ষমতা এই বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা খুবই জরুরী। একটা মানুষ চরিত্রবান না হলে তার বাকী পাঁচটি গুণ থেকেও লাভ নেই। আর ঋণ গ্রহীতার মূলধন কেমন আছে, তার বর্তমান অবস্থা কেমন, ঋণ গ্রহণ করে সে তা সুদাসলে ফেরত দিতে পারবে কিনা, তার জামানত কেমন, তার সক্ষমতা আছে কিনা এই বিষয়গুলো পর্যালোচনা শেষে যদি মনে হয় ভাল হবে তবেই ঋণ গ্রহীতার কাছ থেকে জামানত হিসাবে বন্ধক রাখার জন্য মূল্যবান জমির কাগজপত্র সংগ্রহ করে ব্যাংক মনোনিত একজন প্যানেল আইনজীবীকে দেন। প্যানেল আইনজীবী কাগজপত্র ভালভাবে দেখে চেইন ডকুমেন্টস (জেনোলজি) মিলিয়ে জমির মালিকানা স্বত্ব নির্ধারণ করে একটি আইনগত মতামত প্রস্তত করে ব্যাংক বরাবর প্রেরণ করেন। এ পর্যায়ে আইনজীবী সাহেবের প্রাথমিক কাজ শেষ। এর পর ব্যাংক আইনজীবী সাহেবের দেয়া মতামতের কাগজ নিয়ে নিজেরা এবং থার্ড পার্টি (কোন সার্ভে প্রতিষ্ঠান) দিয়ে জমির মূল্যায়ন (ভ্যালুয়েশন) করেন। অনেক ব্যাংক একজন প্রকৌশলী দ্বারা মূল্যায়ন করে থাকেন। জমির মূল্য নির্ধারন করে দুই ভাবে। একটি হলো জমির বাজার মূল্য ও জমির তৎক্ষণি বিক্রয় মূল্যমান (ফোর্স সেল ভ্যালু) নির্ধারণ করা। অর্থাৎ জমির স্বাভাবিক বাজার মূল্য কত এবং তাৎক্ষণিক ভাবে বিক্রি করতে চাইলে কত টাকা বিক্রি করা যাবে তা নির্ধারণ করা। তাৎক্ষণিক বিক্রয় মূল্যমান (ফোর্স সেল ভ্যালু) যা নির্ধারণ করা হয় তা থেকে অনেক কম অর্থাৎ নিরাপদ দুরত্বে থেকে ঋণ গ্রহনে আগ্রহী ব্যক্তিকে ব্যাংক ঋণ দিয়ে থাকেন। 
গ্রাহক এর নিকট থেকে সংগৃহীত কাগজপত্র ব্যাংক আইনজীবীর কাছে সরবরাহ করে, সেই সরবরাহকৃত কাগজপত্র পর্যালোচনা করেই একজন আইনজীবী তার আইনগত মতামত দিয়ে থাকেন। গ্রাহক যে কাগজপত্র সরবরাহ করলো (যেমন-বিভিন্ন খতিয়ানের পর্চা, মূল দলিল, মূল দলিল না থাকলে সইমোহরকৃত দলিল, খাজনার দাখিলা, ডিসিআর এর কপি, নির্দায় সনদ, ট্রেড লাইসেন্স, আয়কর সনদ, জাতীয় পরিচয় পত্র, ওয়ারিশ সনদ ইত্যাদি) সেই কাগজপত্র সঠিক আছে কিনা বা জাল কিনা তা যাচাই-বাছাই করার জন্য ব্যাংকের লোনস এন্ড এডভান্স এর অফিসার ভেটিং ও সার্চিং এর কাজ সম্পন্ন করে। ভেটিং ও সার্চিংয়ের কাজ ব্যাংক নিজেই তার অফিসার দিয়ে বা কোন থার্ড পার্টি দিয়ে বা আইনজীবীর মাধ্যমে বা অন্য কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দিয়ে করতে পারেন বা করেন। সার্চিংয়ের কাজটি করার জন্য জেলা রেকর্ড শাখা, জেলা রেজিষ্ট্রার অফিস, সাব-রেজিষ্ট্রার অফিস, সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিস, স্থানীয় ভূমি অফিস, ইউনিয়ন বা পৌরসভা, আয়কর অফিস, নির্বাচন অফিস সহ সংশ্লিষ্ট অফিস সমূহে যোগাযোগ করে তল্লাশির মাধ্যমে নিজ চোখে দেখে মূল্যায়ন ও দলিলপত্রের সঠিকতা যাচাই করে থাকেন।  
ব্যাংকে অনেকেই জাল টাকা নিয়ে আসেন, ব্যাংকাররা সেই জাল নোট অনেক সময় ধরতে পারেন না, দিন শেষে হয় টাকা বান্ডিলে ঢুকে গ্রাহকের কাছে চলে যায় আর ধরা পরলে জমা দিতে আসা ব্যক্তির কাধে বা পরে ধরা পরলে দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তার ঘারে দায় চাপে। ঠিক তেমনি, দলিল সঠিক না জাল, মিউটেশন ঠিক আছে কি নাই, খতিয়ানের পর্চা সঠিক না টেম্পারিং করা, খাজনা দাখিলা, ডিসিআর কপি, নির্দায় সনদ, ওয়ারিশ সনদ ইত্যাদি ইত্যাদি কাগজপত্র যাচাই করার জন্য বেশিরভাগ সময়ই আইনজীবীর পক্ষে তহশিল অফিস, এসিল্যান্ড অফিস, জেলা রেজিষ্ট্রার অফিস বা সাব-রেজিষ্ট্রার অফিস, ইউনিয়ন বা পৌরসভা কোথাও যাওয়া সম্ভব হয় না এবং যাওয়ার কথাও না।
একটা আইনগত মতামত এর জন্য আইনজীবীকে ব্যাংক (লোন গ্রহীতার কাছ থেকে নিয়ে) দুইশত টাকা থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত দিয়ে থাকে। এই সামান্য টাকার বিনিময়ে আইনজীবীকে পাঁচ থেকে দশ পাতার (ক্ষেত্র বিশেষ আরো বেশি) একটি আইনগত মতামত দিতে হয়। এই সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আইনগত মতামতের সাথে সার্চিং ও ভেটিং কেউ আশা করে না এবং কেউ দেয়ও না। সার্চিং ও ভেটিং এর কাজ আইনগত মতামতের সাথে সংযুক্ত নয়। এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। 
একটা ঋণের ক্ষেত্রে একজন গ্রাহক ব্যাংকে আসলো, কাগজপত্র দিল, আইনজীবী আইনগত মতামত দিয়ে দিল আর ব্যাংক গ্রাহককে শত কোটি টাকা ঋণ দিয়ে দিলো এমনটা নয়। ঋণ গ্রহণে আগ্রহী ব্যক্তি ঐ ব্যাংকে হিসাব খোলেন, লেনদেন করেন, লেনদেনের মাধ্যমে তার বিভিন্ন বিষয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ব্যাংক। তার নৈতিক চরিত্র, তার ব্যবহার, তার ব্যবসা, তার প্রয়োজন, তার লেনদেন তার ঋণ ধারণ ও পরিশোধের ক্ষমতা ইত্যাদী নানান বিষয় ব্যাংক পরীক্ষা করে তাকে ঋণ দেয়ার কথা চিন্তা করে গ্রাহকের নিকট থেকে কাগজপত্র সংগ্রহ করেন। দীর্ঘ লেনদেন করার পরেও যে ব্যাংকার প্রতারক গ্রাহককে চিনতে পারলো না সেই গ্রাহককে কয়েকটি কাগজ দিয়ে কিভাবে চিনবে আইনজীবী? একটি নকল দলিল তো আসল ষ্ট্যাম্পে তৈরী করে, একটা নকল মিউটেশন তো আসল সিল মোহর দিয়েই তৈরী করে। হাজার হাজার কর্মকর্তার স্বাক্ষর কি আইনজীবী সাহেবের চেনা? আর কাগজ জাল হোক আর আসল হোক উকিলের কাজ চেইন ডকুমেন্টস মিলিয়ে দেখা। কাগজের সঠিকতা প্রমান করবে যার উপর সার্চিং ও ভেটিং এর দায়িত্ব সেই কর্মকর্তার বা ব্যক্তির। 
এবার বলি ঋণ কিভাবে খারাপ হয় সে বিষয়ে আমার ধারনা। আমার সামান্য অভিজ্ঞতায় দেখেছি গ্রহীতাকে ঋণ দিয়ে অনেক ব্যাংক আর কোন খবর রাখে না। ঋণ পাস হওয়ার পর সেই ঋণ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সে নিয়মিত লেনদেন করবে, কিন্তু অর্থঋণ মামলা করার সময় ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেখেছি ঋণ পাস হওয়ার পর চেকের এক পাতা খরচ করে পুরো টাকা তুলে নিয়ে আর কোন যোগাযোগ করেনি এবং লেনদেনও করেনি। ঋণ দেয়ার পর ঋণের কোন পরিচর্যা করেনি। পরিচর্যা ছাড়া কোন কিছু কি ভাল হয়? পরিচর্যা ছাড়া কি কোন ভাল ফল পাওয়া যায়? পরিচর্যা ছাড়া বাগানে তো আগাছাই জন্মাবে তাই না? গ্রাহক কেন ব্যাংকে আসছে না, কেন লেনদেন করছে না, সেকি নিঃশেষ হয়ে গেছে? গেলে তাকে কিভাবে সহযোগীতা করে আবার দাড় করিয়ে টাকাটা আদায় করা যায়? সেই বিষয়ে ব্যাংকের অনেক দায়িত্ব আছে যা ব্যাংকারগণ করে না। তারাতো অনেক ক্ষেত্রে ঋণ দিয়েই খালাস!!! ফলে ঋণ আর আদায় হয় না, ব্যাংকের গুনতে হয় শতকোটি টাকার লোকসান।
অনেকে ব্যাংকের সেই লোকসানের দায় দিতে চান আইনজীবীর উপর যে কিনা মাত্র দুইশত পঞ্চাশ টাক থেকে তিন হাজার টাকার বিনিময়ে আইনগত মতামত দিয়েছেন। মাসে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে যে ব্যাংকারদের রাখা হয়েছে তদারকির জন্য তারা কি দায়ী নয় এই লোকসানের জন্য? কেন একজন বাজে লোককে ঋণ দেয়া হলো? কেন ঋণ দেয়ার পর তদারকি করা হলো না? ঋণের বন্ধকি দলিলে ও অপ্রত্যাহারযোগ্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নী দলিলে তো লিখে নিলেন আইনজীবীর মাধ্যমে যে, যে কোন সময় তদারকির জন্য ব্যাংককে তার ব্যবসা বাণিজ্য, গোডাউন, প্রকল্প পরিদর্ন করতে দিতে বাধ্য থাকিবেন। আইনজীবী শত টাকার পারিশ্রমিক নিয়ে শত কোটি টাকার দায় কিভাবে নেবে? আসলে অন্যের ঘারে দায় চাপানোটা আমাদের অভ্যাষে পরিনত হয়ে গেছে। 
আবার অনাদায়ী ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংক অর্থঋণ আদালতে মামলার মাধ্যমে পদক্ষেপ নেয়। অনেকে মনে করেন, আইনজীবী মামলায় সময় নিয়ে ঘুরায় এবং সময় ক্ষেপণ করেন। আসলে কথাটা সত্যি নয়। আমি বেশ কিছু মামলা পরিচালনা করেছি এবং এখনও করছি। আমার যে ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা হয়েছে তা থেকে বলছি, প্রত্যেক ব্যাংকই আইনজীবীকে ব্যাংকের নির্ধারিত সিডিউল দেখে বিল প্রদান করেন। একটা মামলার জন্য বিভিন্ন বিষয় মিলে একটা বিল হয়ে। উদাহরণ হিসাবে বলি, একটা মামলা পরিচালনার জন্য একশত টাকা বিল হলো। পচিশ টাকা মামলাটা দায়ের করার পর আইনজীবীকে দেয়া হবে। এর পর চুড়ান্ত শুনানীর আগে আরো পচিশ টাকা দিবে। বাকী পঞ্চাশ টাকা দিবে রায় পাওয়ার পর। এই মামলাটা যদি দশটা তারিখ ঘুরে নিষ্পত্তি হয় তাতে আইনজীবীকে ঐ একশত টাকাই দেবে দশটা টাকাও বেশি দেয়া হবে না আর যদি একশতটা তারিখ ঘুরে মামলাটি নিষ্পত্তি হয় তাতেও দশটা টাকা বাড়াবে বা কমাবে না। টাইম পিটিশন বা হাজিরার জন্য কোন ফি ধার্য নাই। মামলা দায়েরের সময়ই বিলের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে যায়। দশ দিনে মামলা শেষ হলে ঐ একশত টাকা আবার দশ বছর ঘুরে নিস্পত্তি হলেও ঐ একশত টাকা। তাই মামলাটা ঘুরিয়ে আইনজীবীর কোন লাভ নাই বরং লস, দ্রুত নিস্পত্তি করতে পারলে পকেটে অবশিষ্ট টাকাটা আসবে, নিস্পত্তি যত দেরিতে বিল তত দেরিতে। আর নিষ্পত্তি হলে বরং জারি মোকদ্দমার উদ্ভব হবে, আইনজীবী আবার নির্ধারিত ফি পাবে, নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জারি মোকদ্দমার উদ্ভব হবে না। এবার বুঝুন এখানে আইনজীবীর কি কোন লাভ আছে? তাই অহেতুক দোষারোপ করে আইনজীবীকে হেয় করে কি লাভ?
আমি কিছু ব্যাংকের ঋণের বিষয় জানি। ব্যাংকিং ব্যবসায় প্রধান প্রোডাক্ট কি, সবাই জানে ঋণ বা লোন, যা আগেও আলোচনা করেছি। ব্যাংক লোন সেল করে। এক সময় কিছু ব্যাংকের লোন সেল করতো ব্যাংকটির একটি ব্রাঞ্চের সামনের কয়েকজন দোকানদার। কারো দুই লাখ টাকা ঋণ চাই, দোকানদার বললো, দুই লাখ নিবি কিরে! তোকে দশ লাখ তুলে দেই!! ব্যবসায়ী দুই লাখ খরচ করে দশ লাখ টাকা ব্যাংকের কাছ থেকে কিনে নিলো!! সেই যে গেল আর ফিরে এলো না!! ব্যবসায়ীর কথা, কে টাকা ফেরত দেব? আমিতো লোন কিনছি? কিন্তু তার ঐ অনৈতিক কথা কি আইন শুনবে? পরবর্তীতে কি হলো, সেই বিক্রয়কৃত ঋণের গ্রহীতাদের বিরুদ্ধে মামলা হলো। অতঃপর জমি বিক্রয় করে, জেল খেটে বিভিন্ন ভাবে ঋণ পরিশোধ করলো, আবারও সহযোগীতা করলো সেই আইনজীবী!!
আইনজীবীদের কাজের উপর মহামান্য হাইকোর্ট বাস্তব সম্মত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। আইনজীবীগণ যেহেতু প্রদত্ত কাগজের উপর মূল্যায়ন করেন তাই একজন আইন উপদেষ্টা তার আইনগত অভিমতের জন্য দায়ী নয়। 
এ প্রসঙ্গে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগের বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হক এবং বিচারপতি মোঃ নুরুল ইসলাম কর্তৃক আব্দুস সামাদ বনাম রাষ্ট মামলার [ইখঈ (১৯৯৬) ঢ়ধমব ৬৩] জাজমেন্টে বলেছেন, “অ খবমধষ অফারংবৎ পধহহড়ঃ নব সধফব ষরধনষব ভড়ৎ ঃযব ড়ভভবহপব ড়ভ ভড়ৎমবৎু ধহফ পৎরসরহধষ নৎবধপয ড়ভ ঃৎঁংঃ ভড়ৎ মরারহম যরং ষবমধষ ড়ঢ়রহরড়হ.”
অনেকতো বললাম, এবার বাস্তবতায় আসি। বাস্তবকে অস্বীকার করার ক্ষমতা কারো নেই, আমারতো নেই-ই। বাস্তব ঘটনা হলো ভালো মন্দ সব জায়গায়ই আছে। ভাল ব্যাংকার যেমন আছে তেমনি ভাল আইনজীবীও আছে। খারাপ ব্যাংকার যেমন আছে তেমনি খারাপ আইনজীবীও আছে। ভাল ঋণ গ্রহীতা যেমন আছে, তেমনি ঋণ গ্রহীতা খারাপও আছে। সবাই সমান নয়, ভাল মন্দ সবজায়গায়ই বিরাজমান। আইনগত মতামত দেয়ার ক্ষেত্রে, বন্ধকনামা দলিল, অপ্রত্যাহারযোগ্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নী দলিলসহ বিভিন্ন দলিল পত্র মুসাবিদা ও প্রস্তুতের ক্ষেত্রে আইনজীবীকে সততার তপ্ত কড়াইয়ের উপর বসে বরফ শীতল ঠান্ডা মাথায় যেমন কাজ গুলো করা উচিত তেমনি ব্যাংকারদের উচিত সঠিক গ্রাহক বাছাই করা, গ্রাহককে যথাযথ পরিচর্যা করা, গ্রাহক কর্তৃক সরবরাহকৃত তথ্য, উপাত্ত, দলিল দস্তাবেজ ভালভাবে যাচাই বাছাই করা এবং সত্যিকারের ব্যবসায়ী-গ্রাহককে ঋণ দিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা ও দেশের অর্থনীতিকে সবল রাখা।
আমার এই লেখা কোন সাফাই গাওয়ার জন্য নয়। ব্যাংকার ও গ্রহকদের মনে কষ্ট দেয়ার জন্যও নয়। বাস্তবতার আলোকে আমার পর্যবেক্ষণ পাঠকের সাথে শেয়ার করলাম মাত্র। আমার লেখায় কেউ মনে কষ্ট পেলে আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।


-----------------------------------------------------


জঙ্গি-মঙ্গি কিছুই নয় ॥ ইসরাইল শান্তিকামী বিশ্বের জন্য আজরাইল

দেশ এখন আতঙ্কের এক জনপদ। আর আতঙ্কের নাম জঙ্গি। দেশে বিদেশে জঙ্গি মানেই ইসলামিক জঙ্গি! এমন ভাবে মিডিয়া প্রচার করে যেন বিশ্বে আর অন্য কোন ধর্মীয় উগ্রবাদী বা জঙ্গী নাই। আর আমাদেরও দুর্ভাগ্য যেই উগ্রবাদী ধরা পরে, তার নামের আগে থাকে মোহাম্মদ শব্দটা। আবার হামলা শেষে আল্লাহু আকবার স্লোগান দিয়ে বীর দর্পে চলে যায় বা যাওয়ার চেষ্টা করে। ফলে জঙ্গি মানেই ইসলাম ধর্মের লোক! অথচ সমস্ত বিশ্বেই উগ্রবাদ এখন একটি বিষ ফোড়ার মত যন্ত্রনাদায়ক ব্যধি যা অন্য দেশের মত আমাদের দেশেও আছে। রাজনৈতিক কারনে হোক বা রাষ্ট্রীয় কারনে হোক নাশকতার ঘটনা ঘটার সাথে সাথে কৌশলগত কারনে সরকার তা অস্বীকার করে। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে বেশ কিছু অঘটনের জন্ম দেয় জঙ্গিরা। আরো অঘটন ঘরার হুমকি মাথায় নিয়ে ঘুরছি আমরা। হুমকিগুলো সত্যিও হতে পারে আবার এক শ্রেণীর লোকের উড়ো চিঠিও হতে পারে। কিন্তু হুমকিকে তো আর সাধারণ ভাবে নেয়া যায় না। অঘটন না ঘটলেই ভাল, সতর্ক না থাকলে ঘটেওতো যেতে পারে!
সারা বিশ্বে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ঘটছে হত্যাযজ্ঞ। কেউ গাড়ি চালিয়ে শত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। আবার কেউবা গ্রেনেড ফাটিয়ে, কেউবা গুলি ফুটিয়ে, কেউ কেউ আবার ছুড়ি-চাকু-ধারালো অস্ত্র নিয়ে নেমে পড়ছে নাশকতায়। ঘটনা ঘটিয়ে কেউ পালিয়ে যাচ্ছে, আবার কেউ পালাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী পরিবারের-দরিদ্র পরিবারের, আলেম বেশে-জালেম বেশে, শিক্ষক হয়ে-শিক্ষার্থী হয়ে নাশকতাকারীর খাতায় নাম লিখিয়ে চালাচ্ছে হত্যাযজ্ঞ। বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবার মাদ্রাসা থেকে প্যাগোডার সব স্থানেই বিরাজ করছে নাশকতাকারীরা। শুধু দোষ পড়ে ধর্মীয় লেবাসের উপর। সব যায়গায়ই চলে ধর্মের অপ ব্যাখ্যা। নাশকতাকারীরা কেবলই জঙ্গি তাদের কোন ধর্ম নেই। ধর্ম কখনো সাধারণ মানুষ হত্যার অনুমতি দেয় না। এক শ্রেণীর লোভি ধর্মান্ধরা নাশকতার পথ বেছে নিয়ে নিজেদের ধর্মীয় উগ্রবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কলকাঠি নাড়ছে পিছনে বসে ধর্মীয় নেতার বেশে মুখোশধারী কিছু কুচক্রী। তারা বিশ্বের বিশেষ কোন এস্যাইনমেন্ট কার্যকর করছে মাত্র। যে বেশে নিজেদের জাহির করলে কার্য সিদ্ধি করা যাবে সেই বেশই ধারণ করছে। আসলে তারা ধর্মের কেউ না। শান্তি প্রিয় বিশ্ববাসীর শান্তি দেখলে তাদের গা জলে। বিশ্ব বাণিজ্যের বড় পরিবেশক এই মুখোশধারীরা। সাধারণ মানুষ সাধারণ চোখে দেখে, সাধারণ জ্ঞানে তাদের চিনতে পারে না। ফলে তাদের মিঠা কথায় ভিটা খালি করে জড়িয়ে যাচ্ছে উগ্রপন্থায়।  
আমাদের দেশে সম্প্রতি দুজন সমকামী জঙ্গিদের হামলায় নিহত হয়। সাথে সাথে পশ্চিমা বিশ্বের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। বিশ্ব মোড়ল তেতে উঠে। ঘটনার নিন্দা, তদন্তের আগ্রহ, নিজের দেশের নাগরিকদের সতর্ক করা সহ নানান পদক্ষেপ নেয়। আমাদের দেশের ঘটনার কিছু দিন পর আমেরিকায় এক সমকামি জঙ্গি সমকামিদের ক্লাবে হামলা চালিয়ে অর্ধশত সমকামীকে গুলি করে মেরে ফেলে। এবার আর ঐ মোড়লদের মুকে কথা ফোটে না। আমাদের দেশের অঘটনের পর সবাই বলে গোয়েন্দারা কি করেছে? তারা কেন আগাম তথ্য পেল না ইত্যাদি। মোড়লদের দেশে এতবড় ঘটনা ঘটলেও তাদের নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ে কোন কথা হয় না। তাদের তথ্য প্রযুক্তি জ্ঞান, অস্ত্র-শস্ত্র, সুযোগ-সুবিধা কোন কমতি না থাকলেও নাশকতার কোন পূর্বাভাষ তারা জানতে পারে না, আমাদের দেশের নিরাপত্তা বাহিনী কিভাবে জানবে? আসলে নাশকতাকারীরা মনে মনে যা চিন্তা করে তা কোন প্রযুক্তিতেই ধরা পরে না। আর নাশকতাকারীরা ধর্মীয় লেবাশ নেয়। ভারতে উগ্র হিন্দুবাদীরা যে চিন্তা চেতনা নিয়ে হঠাৎ অঘটন ঘটায় সেটা দেখে কেউ কি ধারনা করতে পারে তাদের মনে এত ঘৃন্য চিন্তা বিরাজ করছে? আমাদের দেশে যাদের আমরা ইসলামীক জঙ্গি বলে আখ্যা দেই তাদের দেখলে কি বোঝার উপায় আছে তাদের মনে এমন ঘৃন্য চিন্তা বিরাজ করছে? করার পর বোঝা যায় তারা কতটা ঘৃন্য মানব রুপি ঘাতক।  
সারা বিশ্বে এত নাশকতা এত হানাহানি এত প্রাণহানী কিন্তু বিশেষ একটা দেশে কোন অঘটন ঘটে না তাহলো ইসরাইল। ইসরাইলের মানুষ কি এতই ধোয়া তুলসি পাতা! তারা কি এতই সতর্ক যে তাদের দেশে কোন অঘটন ঘটার আগেই সতর্ক হয়ে যায়!! আমার তো তা মনে হয় না। ইসরাইলের মত বর্বর জাতি শান্তিকামি বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি আছে বলে আমাদের জানা নেই। ইসরাইলীরা ফিলিস্তিনের মাটিতে যে পরিমান বোমা ও গুলি বর্ষণ করেছে, যদি না করতো তবে অস্ত্র উৎপাদনকারীদের অস্ত্র নিয়ে কান্না করা ছাড়া কোন উপায় থাকতো না এবং ইসরাইল আজ আর ধরনীর উপর থাকতো না, অস্ত্রের বারে দেবে সাগরের তলদেমে দিয়ে ঠেকতো। ইসরাইলীরা ফিলিস্তিনের যে পরিমানের নারী-শিশু-সাধারণ মানুষ হত্যা করেছে এর বিচার হলে সমগ্র ইসরাইল জাতিকে একাধিকবার ফাঁসির দড়িতে ঝোলাতে হবে। যে জাতি নারী-শিশু কাউকেই বাদ দেয় না তারা এত সাধু আর সতর্ক হয় কি করে? ইসরাইলের মত ছোট্ট একটি রাষ্ট্র কিভাবে এত সাহস পায়? 
বিশ্বে বড় বড় অঘটন যা হয়েছে তা জানে না এমন মানুষ পাওয়া যাবে না। বলদেও জানে আমেরিকায় দুইটা জোড়া বিল্ডিং বিমান দিয়া ভাইঙ্গা দিছে জঙ্গিরা। আমেরিকার ঐ টুইন টাওয়ারে হামলা হলো। হাজার হাজার মানুষ মারা গেল। বিশ্বের এমন কোন দেশ নাই যেই দেশের দুই চার দশ জন করে নাগরিক মারা যায় নাই। সব দেশের মানুষই মারা গেছে শুধু ইসরাইলের কোন নাগরিক মারা গেছে তা শোনা যায় নাই। লাদেনকে জ্ঞানীগুনিরাই কিছুটা চেনতো আর চেনতো আমেরিকা। টুইন টাওয়ার ভাঙ্গা হলো বিমান দিয়ে, নাম হলো লাদেনের! ঘোষণাও দিল লাদেন যে সেই ভাঙ্গিয়েছে। গোপন জায়গা থেকে টেপ আসে, দাড়ি পাগড়িওয়ালা একজন ঘোষণা দেয়, বাহবা জানায়, আর আমেরিকার সুরসুরি বাড়ে! এবার শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ। নিরপরাধ মানুষ মেরে জঙ্গি দমনের নামে একের পর এক দেশ ধ্বংশ করে নিজেদের মানবতা প্রতিষ্ঠা করে আমেরিকা। দীর্ঘ দিন পরে আবার স্বীকারও করে যুদ্ধ করাটা ভুল ছিল। কিন্তু ভুলের মাসুল দেয় না। ভুলের মাসুল গুনতে হয় সাধারণ জনগনকে। টুইন টাওয়ার হামলার পর যা ঘটেছে সবারই জানা আছে, আফগানের সুন্দরী বউ আমেরিকার ভাবি!! আফগানে যত সম্পদ আছে সব লুন্ঠন করা শেষে লাদেন গেল পাকিস্তানে। এর পরও আমেরিকা নিজেদের মানবতার প্রতীক হিসাবে নিজেদের জাহির করে, সাধু সাজে। একটি গল্প বলি, এক ব্যক্তি সারা জীবন মানুষের বাড়ি বাড়ি চুরি করেছে। চুরিই ছিল তার পেশা। সেই চোর মৃত্যুশয্যায়। শয্যাপাশে তার সন্তানেরা। চোর তার সন্তানদের ডেকে বললো, বাবারা, আমিতো সারা জীবন মানুষের বাড়ি বাড়ি চুরি করেছি যা তোমরা জান এবং তোমরা আমাকে সব সময় সহযোগীতাও করেছো। আমি আর বেশিক্ষণ মনে হয় তোমাদের মাঝে নাই। সময় হয়ে গেছে। তোমরা দুনিয়ায় এমন কাজ করবে যাতে সবাই আমায় ভাল বলে। এই বলে কিছুক্ষণ পর চোর মারা গেল। শোক কাটিয়ে উঠে চোরের সন্তানেরা চিন্তা করে কি এমন কাজ আমরা করতে পারি যাতে বাবাকে মানুষ ভাল বলবে! তারা এতদিন বাবার সাথে চুরিতে সহযোগীতা করত। বাবা মারা যাওয়ার পর এখন তারাও চুরি করা শুরু করেছে। একদিন ভাইয়েরা মিলে আলোচনায় বসল। সবাই মিলে চিন্তা ভাবনা করলো, কি কাজ করলে মানুষ বাবাকে ভাল বলতে পারে। চিন্তা ভাবনা শেসে এবার তারা চুরি ছেড়ে ডাকাতি শুরু করলো। কয়েক দিন ডাকাতি করার পর মানুষের মুখে বাবা সম্পর্কে ভাল কথা শুনতে না পেয়ে এবার কাজের ধরণ পরিবর্তন করলো। সবাই মিলে ডাকাতি করা শেষে বাড়ি-ঘরে আগুন দিয়ে দেয় এবং ঘরে যুবতী মেয়ে, বাড়ির বউদের পালাক্রমে ধর্ষণ শুরু করলো। এবার ফল পেল নগদে! সবাই বলাবলি করছে, আহারে! ওদের বাবা কত ভাল মানুষ ছিল! শুধু চুরি করতো! আর তার ঘরে কি কুলাঙ্গার হয়েছে, ডাকাতি করে, ডাকাতি শেষে ঘরে আগুন দেয়, জুয়ান বুড়া মানে না, ধর্ষন করে। ওদের চাইতে ওদের বাবা অনেক ভাল ছিল। আমেরিকাকে আমরা ভাল বলি। কিন্তু আমেরিকা সেই চোর যার সন্তান ইসরাইল ডাকাতি শেষে ঘরে আগুন দেয় এবং গুরা-বুড়া মানে না ধর্ষন করে। 
যা হোক, আমেরিকা পাকিস্তানের যেখানেই হামলা করা দরকার লাদেন সেখানেই যায়! পাকিস্তানিরাতো এক বিচি ফেলে দেয়া বলদের মত। ওটা না আবাল না দামড়া। আমেরিকাকে সুযোগ দিয়ে নিজেদেরই অস্তিস্ব সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। নিজেরাই এখন একটি জঙ্গি রাষ্ট হিসাবে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে। আর জঙ্গি দমনের নামে সাধারণ মানুষ মেরে আমেরিকা হয়েছে মানবতার দেশ! 
আমেরিকা হলো সেই দেশ যে, ইসরাইলকে দিয়ে কার্য সিদ্ধি করে নিজেই আবার মলম নিয়ে দৌড়ায়। ইসরাইলকে দিয়ে বিশেষ এসাইনমেন্ট এক্সিকিউট করতে গিয়ে মাঝে মধ্যে নিজের দেশেও দু’একটা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে যা নিরবে সহ্য করছে। কিন্তু ইসরাইল থাকছে ধরাছোয়ার বাইরে। ফেসবুকের কারনে বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। সমর্থিত, অসমর্থিত নানা উৎস হতে তথ্য ভেষে বেড়ায় অনলাইনে। এমন অনেক তথ্যের মধ্যে যে তথ্য ভেষে বেড়াচ্ছে তা হলো আজকের এই আইএসআইএস আমেরিকারই সৃষ্টি! আইএসআইএস এর অন্যতম শ্রষ্টাদের মধ্যে ইসরাইলের প্রাধান্যই বেশি। তবে তারা পানির মত। পাত্রে স্থান নেয়ার সাথে সাথে সেই পাত্রের রূপ নেয়। আইএসআইএস যেহেতু ইসলাম এর নাম ব্যবহার করে, তাই ইসরাইলীরা ইসলাম পন্থির রূপ ধারণ করে থাকতে পারে। বাংলাদেশেও অনেক জঙ্গি পাওয়া যাচ্ছে বা যাদের খোজা হচ্ছে তাদের তালিকায় নব্য ইসলাম গ্রহণকারীর আধিক্য বেশি। মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী, হুরের জন্য মরতে রাজী। জঙ্গিদের কাছে এমন এক মস্তিস্ক প্রক্ষালন যন্ত্র আছে যা দিয়ে মাথা এমন ভাবে ওয়াশ করা হয় যে, যা শেখানো হয় তাই বলে। তাদের মাথায় জেহাদ, জেহাদ আর জেহাদ!! কারন জেহাদে মরলে শহীদ, শহীদ বিনা হিসাবে বেহেস্তে, আর বেহেস্তে হুরের ব্যবস্থা!! তাহলে দুনিয়ায় থেকে কি লাভ, জেহাদে জাব (নাশকতায়), শহীদ হব (অপারেশন থান্ডার বোল্টে গুলি খেয়ে মরব) এই হলো তাদের দর্শণ। পবিত্র কোরআন এসব তথাকথিত শহীদরা পড়ে বা বুঝে বলে মনে হয় না। পড়লে বা বুঝলে এমন কাজে পা বাড়াতো না।
ইসলামের লেবাসে নাকি অনেক ইসরাইলী মোসাদের সদস্য জঙ্গি সদস্য হিসাবে নাম লিখিয়েছে! জঙ্গি মরে কিন্তু ইসরাইলী বাংশোদ্ভুত কোন জঙ্গি মরেছে শোনা যায় নাই। তাই জঙ্গি-মঙ্গি কিছ্ইু না। আমেরিকার ইশারায় ইসরাইলীরা বিশেষ এসাইনমেন্ট এক্সিকিউট করছে এমনটাই ধারনা পাওয়া যাচ্ছে ইন্টারনেট বিশ্বে! ইসরাইলই আজরাইল শান্তিকামী বিশ্বের জন্য!!
  
-----------------------------------------------------    



কুকুর-বিড়াল-বৃদ্ধ-মহিলা-শিশু-গরু-গন্ড মূর্খ দেখলে সাবধান!!

যারা গাড়ি চালান অর্থাৎ বাই সাইকেল থেকে শুরু করে ভারী যানবাহন (রেল গাড়ি ছাড়া!) তারা সবসময় কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকেন। নিজেতো সতর্ক থাকেনই শুভাকাঙ্খিদের, পরিচিত জনদেরও সর্বদা সতর্ক করেন। 
সবসময় বলেন, সাবধানে গাড়ি চালিও! যে কোন সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে! সতর্ক দৃষ্টি রাখবা গাড়ি চালানোর সময়!  
রাস্তা দেখে শুনে চলবা! হঠাৎ কোন কিছু সামনে চলে আসতে পারে বা পিছন থেকে ধাক্কা দিতে পারে তাই দেখে শুনে চলবা।  
কুকুর বিড়াল থেকে সাবধান! যে কোন সময় গাড়ির সামনে কুকুর বিড়াল চলে আসবে। কুকুর বিড়ালের লোমের কারনে সহজে গাড়ির চাকা তাদের উপর দিয়ে উঠে না। আর যদি উঠেযায় তবে চাকা পিছলে গিয়ে দুর্ঘনটা ঘটে থাকে তাই সাবধান থাকা জরুরী। 
গরু ছাগল কিন্তু আৎকা দৌর মারে!! গরু ছাগল রাস্তায় চলার সময় ডান বাম দেখে না। চিন্তা ভাবনার ক্ষমতা যেহেতু তাদের নাই তাইতো তাদের বলদ বলে। সেই গরু ছাগল দেখে শুনে চলবা। 
বুড়া মানুষ কিন্তু কানে কম শোনে!! বৃদ্ধ মানুষ কানে কম শোনে। শারীরিক অক্ষমতার কারনে সে দ্রুত রাস্তা পারাপার হতে পারে না। চোখেও ঝাপসা দেখে। নানা সমস্যার কারনে বৃদ্ধ মানুষকে সম্মান দেখিয়ে সাবধানে গাড়ি চালাতে হবে। 
শিশুরা কিন্তু হঠাৎ দৌড় দেয়!! শিশুরা তো কোমল। তাদের সাত পাঁচ ভাবার সময় কই! রাস্তা ঘাটে শিশুরা মনে যা চায় তাই করে। যে কোন সময় অভিভাবকের হাত থেকে ছুটে দৌর মারতে পারে। একা একাই রাস্তায় এসে পড়তে পারে। আর মহিলারাও রাস্তা পারাপারের সময় একটু বেখায়ালী হয়। এই বিষয়গুলো মাথায় রেখেই পথ চলবা। 
পাগলের কিন্তু মাথা ঠিক নাই!!! পাগল তো পাগলই! পাগলের মাথা ঠিক থাকলে কি সে পাগল হতো। কথায় বলে না? পাগলে কি না খায়, পাগলে কি না করে? তাই পাগল দেখলে সাবধান! পাগল যে কোন মূহুর্তে যে কোন কিছু করে বসতে পারে। তাই সাবধানে গাড়ি চালাবে, ইত্যাদী ইত্যাদী। 
আমার অভিজ্ঞতায় নতুন একটি বিষয় যুক্ত হয়েছে সেটা হচ্ছে গরু-ছাগলের মতই একটা প্রাণী আছে তা হলো গন্ডো মূর্খ। এই গন্ড মূর্খ হতেও সাবধান হতে হবে। 
ঈদুল ফিতরের আগের রাতে আমি মটরসাইকেল চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েছি। গাড়ি থেকে পড়ে দুই হাটু ছুলে গেছে। দুই হাতের বিভিন্ন স্থানে ছুলে গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে আমার বাম চোখের কোনায়। বাম চোখের ভ্রুর উপরে এবং বাম চোখের কোনায় পিচ ঢালা রাস্তার ঘষায় ত্বক উঠে গেছে। মারাত্মক যন্ত্রনায় স্থানীয় কিছু বিবেকবান মানুষ আমাকে তুলে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালের জরুরী বিভাগের কর্মীরা আমার ক্ষত জায়গাগুলো ধুয়ে মুছে ঔষধ লাগিয়ে দিয়েছে। বন্ধু ডাক্তার মাহবুবুল হক আমায় হাসপাতাল থেকে নিয়ে এসে ঔষধ কিনে বাসায় পৌছে দেয়। আস্তে আস্তে শুরু হয় ব্যাথা। চোখ ফুলে ঢোল! ফুলার চোটে চোখের সাটার বন্ধ হয়ে গেল! এক চোখ দিয়ে দেখার যে কি যন্ত্রনা তা অনুভব করলাম। দুই দিন লাগলো চোখের ফুলা কমতে। আস্তে আস্তে চোখ খুলে এখন দুচোখেই দুনিয়া দেখি। ঘা এখনও শুকায়নি। ঘা শুকাতে অন্তত মাস খানেক লাগবে। ত্বক আগের অবস্থায় ফিরবে কিনা আমি জানি না। ত্বকের সৌন্দর্য ফিরা নিয়ে আমার তেমন কোন দুশ্চিন্তাও নেই। এই কালো মুখের (পোড়া মুখের নয়!!) কালো ত্বক আর নতুন করে কি সুন্দর হবে? 
এবার আসি আমার দুর্ঘটনার কথায়। ঈদুল ফিতরের আগের রাত সাড়ে দশটার দিকে আমি আর আমার বন্ধু ডাক্তার মাহাবুবুল হক কোর্ট এলাকা থেকে চা সেবা করে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। ডাক্তারকে হাসপাতালের সামনে নামিয়ে দিয়ে আমি বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। চৌরঙ্গীর মোড় থেকে কিছুদুর আসার পর দুর থেকে দেখলাম ইটালী প্লাজার সামনে দাড়িয়ে এক ব্যক্তি ভ্যানে করে চটপটি-ফুসকা বিক্রি করছে। ফুচকাওয়ালার চারপাশে ছয়-সাতটি কুকুর ঘোরাঘুরি করছে। আমি এগিয়ে আসছি আর দেখছি দৃশ্যটা। আমি যখন ফুচকাওয়ালার কাছাকাছি আসি ঠিক তখনই ফুচকাওয়ালা একটা লাঠি হাতে নিয়ে কুকুরগুলোকে কুকুরের মত তাড়া দেয়!! জ্ঞান শুন্য কুকুরগুলো ভয়ে দিক বিদিক ছোটে জীবনের ভয়ে। কথায় বলে না, মাইরেরে ভয় পায় পাগলেও! একটা সুঠাম দেহী কুকুর দৌরে এসে আমার মোটর সাইকেলের সামনের চাকায় এসে ধাক্কা খায়! ব্যাস!! অমনি আমার গাড়ি বাম দিকে কাত হয়ে পিচ ঢালা রাস্তায় পড়ে গড়িয়ে যেতে থাকে। আমি হলাম ভারী জানবাহনের মত! মোটা মানুষ! তাই কিছুদুর ছেচড়ে গিয়ে অতপর ঘর্ষণজনিত কারনে গতি থেমে যায়! ততক্ষণে যা হবার তা হয়ে গেল। আমার বাম পা গাড়ির নিচে। দেহ জাগিয়ে সহযোগীতার জন্য অপেক্ষা করছি কারন নিজে উঠার শক্তি পাচ্ছি না। বেকুব ফুচকাওয়ালা আমাকে টেনে তোলার জন্য এগিয়ে না এসে দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছে! আমি তাকে ধমক দিয়ে বললাম, বেটা তোল আমাকে। এর পর সে আমার কাছে এগিয়ে আসলো। ফুচকাওয়ালা আসতে আসতে আসপাশের দোকান থেকে দুর্ঘটনার শব্দ পেয়ে লোকজন ছুটে আসলো। আমাকে প্রথমে রাস্তা থেকে তুলে পাশের একটা দোকানের সিড়িতে বসালো। আমার গাড়িটা রাস্তা থেকে তুলে এনে দোকানের সামনে লক করে গাড়ির চাবিটা একজনের হেফাজতে রেখে আমাকে জানালো যে চাবি তাদের কাছে আছে। আমি কপালের বাম দিকে যন্ত্রনা অনুভব করে হাত দিয়ে ধরে দেখি হাত রক্তে লাল হয়ে গেছে। মাথাটা ডানে ঘুরলো না বামে ঘুরলো জানিনা, অনুভব করলাম মাথা ঘুরাচ্ছে!! হাত গড়িয়ে এবং কপালের রক্ত কপল বেয়ে পড়া দেখে দোকানদার ভাই এক মুঠো টিসু পেপার এনে দিলে আমি টিসু পেপারগুলো একসাথে চেপে ধরলাম কপালের ক্ষতস্থানে। চৌত্র মাসে মাঠের শুস্ক মাটি যেমন পানি পেলে শুশে নেয়, মূহুর্তের মধ্যে টিসু পেপার ভিজে চপচপা হয়ে গেল। আমার উদ্ধারকারীরা রিক্সা ডাকাডাকি করছে আমি শুনতে পাচ্ছি। এরই মাঝে একটা রিক্সা পাওয়া গেল। উদ্ধারকারীদের একজন আমাকে ধরে রিক্সায় উঠিয়ে তার ভাগিনাকে ফোনে বললো একটু দোকানে গিয়া বয় আমি ভাইকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। রিক্সায় বসে আমাকে ধরে রাখছে, এরই মধ্যে আমি আমার ফোন বের করে ডাক্তার বন্ধুকে ফোন দিলাম। বলে রাখা ভাল, আমার ডাক্তার বন্ধু দশবার ফোন দিলে একবার ধরে, মাঝে মাঝে ধরেও না! আমার ভাগ্য ভাল, ফোন দেয়ার সাথেই ফোন রিসিভ করলো এবং আমি তাকে বিষয়টি জানালাম। ডাক্তার মাহবুব এর বাড়ি হাসপাতালের পাশেই। সে দ্রুত হাসপাতালে আসলো। আমাকে রিক্সা থেকে ধরে নামিয়ে রিক্সার ভাড়া সেই পরিশোধ করে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে গেল। আমাকে ডাক্তার বন্ধুর কাছে দিয়ে সাথে আগন্তুক বন্ধু চলে গেল। তার সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ভাষা নাই। ধন্যবাদ বন্ধু। ডাক্তার বন্ধু আমাকে জরুরী বিভাগের বেডে বসিয়ে দিয়ে লোক ডাকলো এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিল। জরুরী বিভাগে দায়িত্বরত ডাক্তার ছিল সুমন পোদ্দার। ঈদের কারনে সকল ডাক্তার ছুটিতে যাওয়ায় টানা তিন দিন তার উপরই জরুরী বিভাগের দায়িত্ব পড়েছে বলে সে কথার ফাকে জানালো। এর পর একে একে আমার রক্তাক্ত স্থানগুলো প্রথমে পরিস্কার পানি দিয়ে মুছে দিল এবং পরে ক্ষতস্থানগুলোতে তরল ঔষধ লাগিয়ে দিল। ঔষধ এক এক স্থানে দেয় আর সেই স্থানে একেকটা কামড়ের মত যন্ত্রনা অনুভূত হয়! ছোট হলে চিৎকার দিতাম কিন্তু বয়স বিবেচনায় চিৎকার দিতেও পারছি না, পাছে লোকে যদি হাসে। ডাক্তার সুমন পোদ্দার বন্ধু মাহবুবকে জিজ্ঞাস করলো, স্যার ব্যাথা নাশক ইনজেকশন দিয়ে দেব? কথাটা শুনে আমার মনে হলো, যদি দেয় তবে দুর্ঘটনার থেকেও বেশি আহত হব! আমি তাদের কথপোকথন শুনে বললাম, ইনজেকশন নেব না খাওয়ার ঔষধ যা লাগে দিতে পারো! শুনে দুজনেই হাসলো। বন্ধু মাহবুব সুমন পোদ্দারকে বললো, ইনজেকশনকে ভয় পায় এ কারনে আমি হাজার বার বলার পরেও আজ পর্যন্ত সে জন্ডিসের টিকা দিতে পারেনি, বলে দুজনেই হাসলো। বন্ধু মাহবুব আমায় জিজ্ঞাস করলো আর কোথাও ব্যাথা অনুভব হচ্ছে কিনা, কেমন লাগছে, কোন অস্বাভাবিকতা অনুভব হচ্ছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বললাম একটু জ্বলে! একটু ব্যাথাও করে। শুনে বন্ধু বললো ওটা কিছু না, ঠিক হয়ে যাবে। কয়েকদিন সময় লাগবে। আমি বাড়িতে ফোন দিয়ে যানাতে যাব তখন বন্ধু বললো ফোন দেয়ার দরকার নাই, তুই যথেষ্ট ভাল আছিস। ফোন দিলে সবাই চিন্তা করবে, শুধু শুধু ফোন দিয়ে তাদের চিন্তা বাড়িয়ে কি লাভ!! ভাল আছি কথাটা শুনে একটু সাহস বাড়লো। ডাক্তার যেহেতু দেখে বলছে ভাল আছিস তাহলে আর খারাপ থাকি ক্যামনে!! পরে বেড থেকে নামিয়ে আমাকে নিয়ে হাসপাতালের বাইরে গিয়ে প্রয়োজনীয় ঔষধ কিনল। এর পর একটা রিক্সা ডেকে দুজনে গেলাম দুর্ঘটনাস্থলে। গিয়ে দেখি গাড়ি লক করাই আছে। রিক্সা থেকে নেমে আমি গাড়ি চালু করে দেখি গাড়ির কোন ক্ষতি হয়নি, চলছে। বন্ধু বললো চালাতে পারবি? আমি বললাম পারবো। বন্ধু রিক্সাটা না ছেড়ে আমায় বললো তুই আস্তে আস্তে চালিয়ে যা আমি রিক্সা নিয়ে তোর পিছন পিছন আসি। আমাকে বাসায় পৌছে দিয়ে বন্ধু রিক্সাটা নিয়ে চলে গেল, এই না হলো বন্ধু। এখানে বলে রাখা ভাল, আমার জীবণে দুর্ঘটনা যাতীয় সকল সময় এবং সকল অসুস্থ্যতার সময় আমার বন্ধু আমার পাশে থেকেছে একারনে তার প্রতি কৃতজ্ঞতাটাও আমার আকাশ সীমা পর্যন্ত।  
নিজের কথাতো অনেক বললাম! এই ঘটনায় আমার অভিজ্ঞতার কথাটা এবার বলে শেষ করি। সবাই বলে কুকুর, বিড়াল, গরু, ছাগল, পাগল, শিশু, বৃদ্ধ হতে সাবধান! আমি মনে করি, গরু ছাগলের মত গন্ড মূর্খ হতেও সাবধান থাকা দরকার। কারন, ফুচকাওয়ালা কুকুর গুলোকে এমন সময় তাড়া না দিলেও পারতো! তার বিবেক বিবেচনা থাকলে বোঝা উচিত ছিল, তাড়া খেয়ে কুকুরগুলো ছুটে গিয়ে আমার মোটর সাইকেলে ধাক্কা খাবে, আমি যদি না থাকতাম, যদি একজন পথচারি থাকতো তবে কুকুর গুলো পথচারীর সাথে ধাক্কা খেয়ে তার পায়ে কামড় বসিয়ে দিতে পারতো। যদি বড় গাড়ি এসে পড়তো তবে কুকুর বড় গাড়ির চাকার নিচে গেলে চাকা পিছলে গাড়ি নিয়ন্ত্রন হারিয়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটাতে পারতো! তাই কুকুর তাড়া দেয়ার সময় তার আশেপাশের পরিবেশ পরিস্থিতি দেখা উচিত চিল। এখন আমার কাছে কুকুরের বিবেচনা আর ফুচকাওয়ালার বিবেচনা একই মনে হলো। তাই গরুর সাথে গন্ড মূর্খ হতেও সাবধান হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি! সমস্যা হলো দেখেতো আর গন্ড মূর্খ চেনা যায় না!!!


-----------------------------------------------------


আমার মায়ের ডাক ও মুখ

মা... মা... মা...। পৃথিবীতে যত কিছু আছে মায়ের সাথে কোন কিছুরই তুলনা করা যায় না। পৃথিবীতে যত কথা, যত শব্দ আছে মা শব্দের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোন শব্দ খুজে পাইনি। এত মধুর, এত সুরেলা, এত মমতা মাখা, এত আবেগী একটা শব্দ যে মা ডাকাতেই তার স্বাদ পাওয়া যায়। অন্য কোন ডাকে বা অন্য কোন শব্দ উচ্চারনে এত প্রশান্তি লাভ করা সম্ভব নয়। 
আমার মা নেই। বিগত ৩০ মার্চ ২০১২ তারিখে আমার মা আমাদের চির বিদায় দিয়ে পৃথিবী থেকে চলে গেছে। কোন শান্তনাই মায়ের অভাব পুরন করতে পারেনি। কোন ডাকেই মায়ের মমতা মাখা আবেগ পূর্ন করতে পারেনি। কোন কিছুতেই মন শান্ত হয় না, আজও শান্ত হয়নি, আর হবেও না জানি। কারন মা তো আর ফিরে আসবে না। মায়ের কাছে শত আব্দার করেছি ফেরায়নি কোন আব্দারই। কত অভিমান করেছি মা মনে রাখেনি। শত রাগের পরেও খাবার সময় ঠিকই রাগ ভেঙ্গে ডাক দিয়েছে। বাড়িতে ফিরতে দেরি হলে খোঁজ নিয়েছে। মুখ ভারি দেখলে শান্তনা দিয়েছে। ভিতরে হিংসা দেখলে উপদেশ দিয়েছে। এমন উদার গর্ভধারিনী জননী ছাড়া আর কে হতে পারে? এমন নির্লোভ ভালবাসা মা ছাড়া আর কে দিতে পারে? সবই উপলব্ধি করতে পারছি এখন যখন মা আর কাছে নেই। মায়ের জন্য কিছুই করতে পারিনি-অপরাধবোধ কাজ করে প্রতিনিয়ত। কিন্তু মার কোন দিন কোন চাওয়া ছিল না আমার কাছে। কোন দিন কিছু চায়ওনি। আর মায়েরা কোনদিন কিছু চায়ও না, শুধুই দেয়। দিতে দিতে নিঃশেষ হয়ে যায় তবুও দেয়া ফুরায় না। মাকে আর কিই বা দিব, কিই বা দেয়ার আছে আমাদের। মায়ের মুখের মধুর ডাক এখনও কানে বাজে। আমার মা আমাকে বাবা বলেই ডাকতো। কি মধুর সে ডাক। এখন আর ডাকে না কিন্তু প্রতিনিয়ত প্রতিধ্বনি বাজে কানে। এখনও সমাধির পাস দিয়ে যাওয়ার-আসার সময়, নিরবে নিভৃতে থাকার সময়, একলা পথ চলার সময় শুনি সেই মধুর বাবা ডাক। আমার মা আমাকে এতটাই বাবা ডেকেছে যে মায়ের মৃত্যুতে আমার কাছে মনে হয়েছে আমি মা হারাইনি আমার আদরের সন্তান হারিয়েছি। মা হারিয়ে প্রথমে ডুকরে ডুকরে কেদেছি দেখে অনেকেই শান্তনা দিয়েছে। আস্তে আস্তে ডুকরে কাদা থেমে গেছে। এখনও কাদি। তবে নিরবে নিভৃতে। বুকের ভিতর মা হারানোর ব্যাথা যে কত কষ্টের তা পরিমাপের কোন যন্ত্র নেই, প্রকাশের কোন ভাষা নেই। এখন আর চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়ে না। মুখ ফ্যাকাশে হয় না। কিন্তু বুকের ভিতর চিন চিন ব্যাথা হয়, কথা জড়িয়ে যায়, অনুভব করি তখন গর্ভধারিনী মা আর নেই, আর আসবে না। সব ব্যাথা ভুলে যাওয়া যায় না। আঘাতের ব্যাথা সেরে যায়, বন্ধুদের দেয়া কষ্ট মুছে যায়, মা হারানোর ব্যাথা শত চেষ্টায়ও ভুলে থাকা যায় না। ভুলবই বা কি করে? মায়ের যে অবদান, মায়ের যে আত্ম ত্যাগ, মায়ের যে ভালবাসা, মায়ের যে উদারতা, মায়ের যে মমতা তার সাথে তো কোন কিছুরই তুলনা করা যায় না! তাই মা হারানোর ব্যাথা কখনো যায় না, যাবেও না। এখন দুঃখ পেলে মায়ের দেয়া শান্তনাগুলো কানে বাজে, এখনো কষ্ট পেলে মায়ের কথাগুলো মনে পরে, এখনও মনে হিংসা-ক্রোধ দানা বাধলে মায়ের উপদেশগুলো কানে বাজে, শান্ত হয়ে যাই, উদার হতে চেষ্টা করি। একজন মা এতটা উদার, মমতাময়ী কি করে হয় ভেবে পাই না। তাই মনে মনে ভাবি, মা ছিল, মা থাকবে। লোকচক্ষুর আড়ালে গেলেও মায়ের অস্তিত্ব টের পাই, দেখানো পথে হাটতে চেষ্টা করি। চিরদিন যেন মায়ের দেখানো পথে হাটতে পারি আল্লাহর কাছে সেটাই চাই। মায়ের দোয়াতেইতো আজকের আমি, আমার অবস্থান, আমার সবকিছু।  
দেখতে দেখতে অনেকটা বছর কেটে গেল। আমিও বাবা হলাম আবার। গত ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ আমি বাবা হয়েছি। আল্লাহর কাছে আমি একটা মা’ই চেয়েছিলাম। মহান আল্লাহ আমার মনের কথা শুনেছেন। আমাকে একটা কন্যা সন্তান দিয়েছে সৃষ্টিকর্তা। আমার মায়ের বিদায়ে আমি কেদেছি। আবারও কাদলাম আমার নতুন মায়ের কান্নার শব্দে, নতুন মাকে কোলে নিয়ে। আমার কন্যার নামও রেখেছি মায়ের নামের সাথে মিল রেখে। আমার মায়ের নাম ছিল রওশনারা বেগম। আমার কন্যার নাম রওশন আসাদ প্রিয়ন্তী। প্রিয়ন্তী একটু একটু করে বড় হচ্ছে। সে আস্তে আস্তে বিভিন্ন শব্দ করতে শিখছে। বুঝে কোন শব্দ করে না জানি। কিন্তু প্রিয়ন্তীর মুখে প্রথমেই সেই মায়ের ডাক। আমার মা আমাকে সবসময় বাবা বলেই ডাকতো। প্রিয়ন্তী মুখ দিয়ে আব্বু আব্বু শব্দ উচ্চারন করে! সকল শিশুই শুরুতে দাদা, দাদি, বু শব্দ উচ্চারন করে। আমার কন্যা স্পষ্টই আব্বু শব্দ উচ্চারন করে! আমি অভিভূত হই, অবাক হই না। আল্লাহ আমার মাকে নিয়ে আবার আমাকে মা দিয়েছে। সৃষ্টিকর্তা আমাদের অভাব বোঝেন। তাই আমার কন্যা আমাকেই ডাকছে। কন্যার মুখে আব্বু শব্দ শুনে আমি মহান ¯্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আমার মায়ের গায়ের রং ছিল কালো কিন্তু অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা নিয়ে জন্মেছিল। তার জ্ঞান গরিমায় তাকে মরহুম ফজলুর রহমান কোতোয়ালের মেয়ে না বলে অনেকে ছেলে বলতো!! আমার মায়ের গায়ের রং আমি পেয়েছি। আমার কন্যার গায়ের রং তার মায়ের মত। কিন্তু প্রিয়ন্তী মুখের গড়ন পেয়েছে আমার মায়ের মত। আমার মায়ের মুখ গোলাকার, সর্বদা হাসি মাখা। রাগলেও কখনো ধরা দিত না। শত কষ্ট, অভাব-অনটন আমার মায়ের মুখে ছাপ ফেলতে পারেনি। গোলাকার হাসিমাখা মায়ের সে মুখ আমি ভুলতে পারি না। সর্বদা আমার চোখের সামনে ভাষে। আমার মেয়ের গোলাকার হাসিমাখা মুখ দেখে আমি মায়ের মুখের সাথে মিলিয়ে ফেলি। প্রিয়ন্তীর মুখের দিকে তাকালে আমি আমার মায়ের কথা মনে করি। তাই প্রিয়ন্তীকে আমার নাম ধরে ডাকা হয়না। আমি মা বলেই ডাকি। আমি বাড়ি ফিরলে যেমন আমার মায়ের মুখ উজ্জল হয়ে যেত। কন্যার মুখেও তেমনি আমি বাড়ি ফিরলে হাসি ঝড়ে পরে। আমার বাড়ি ফেরার পর সে ঘুমে থাকলেও জেগে ওঠে। 
আমার মায়ের অনেক আচরণই আমি আমার কন্যার মধ্যে খুঁজে ফিরি। কিছু কিছু মিলে যায়। আমি দেখে আনন্দ পাই। আমি সবসময় বলি, আমার কন্যা যেন আমার মায়ের মত বুদ্ধি পায়, মেধা মননে যেন মায়ের মত হয়। সে যেন আমার মায়ের মত উদার, মমতাময়ী হয়। সে যেন সকলের প্রশংসা কুড়ায়। আমি আমার কন্যার ভিতর আমার মায়ের মুখ ও ডাক ফিরে পেয়েছি। সেই ডাক ও মুখ ফিরে পাই, কখনো বেশি পাই। কিন্তু মাকে ভুলতে পারি না, পারবোও না। ভাল থাকুক আমার নতুন মা, শান্তিতে থাকুক আমার মা.............


-----------------------------------------------------


সাগরে ভাসছে মানবতা ঃ কোথায় এখন মানবাধিকার?

সম্প্রতি সময়ে দেশে সবচেয়ে আলোচিত খবর অবৈধ ভাবে মানব পাচার। জীবিকার তাগিদে ছোট নৌকাযোগে উত্তাল সাগর পারি দিয়ে কর্মের সন্ধানে ছোটা মানুষগুলো পড়ছে বিপদে। অতঃপর গ্রেফতার, মৃত্যু, গণকবর! ভূখা নাঙ্গা হাড্ডিার কিছু মানুষের প্রতিচ্ছবি বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই ঘটনা যখন চরম অবস্থায় পৌচেছে তখন সরকার সহ বিশ্ব বিবেকের গায়ে সামান্য সুরসুরি লাগছে। আসলে এমন কেন হচ্ছে? 
আজ থেকে দশ-পনের বৎসর আগেও লোক মুখে শুনেছি, মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছি মানুষ ইটালী যাচ্ছে মাছের ফ্রিজিং গাড়িতে করে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পৌছাতে না পারলে মানুষ হিমায়িত অবস্থায় গিয়ে পৌছায়। হিমায়িত মাছের মূল্য আছে কিন্তু হিমায়িত মানুষের মূল্য নাই দুই পয়সাও! আবার দিনের পর দিন পায়ে হেটে, বন জঙ্গল পার হয়ে বরফের চাদরের উপর দিয়ে হেটে যায়, স্থানীয় ভাবে তাকে বলে ডাংকিমারি!! প্রকৃত শব্দটা কি হবে আমি নিজেও জানি না। ভূক্তভোগীদের জিজ্ঞেস করলে বলে ঐ এলাকায় বরফের খাল, নদী পায়ে হেটে পার হওয়াকে ডাংকিমারি বলে। 
সেই সময়কার ডাংকিমারি করে যারা দেশে খালি হাতে শুধু জীবন নিয়ে ফিরে আসছে তাদের অনেকের সাথে আমার কথা হয়েছে পেশার কারনে। একসময় আমি সাংবাদিক ছিলাম। প্রথম আলো, কালেরকন্ঠ পত্রিকায় কাজ করেছি দীর্ঘদিন। পেশার কারনে মানুষের সাথে কথা বলেছি, মিশেছি, তাদের হৃদয় ভাঙ্গার গল্প শুনেছি। এই ঘটনায় আমার পরিচিত জন, আত্মীয় স্বজন, কন্ধু বান্ধবও ছিল। আমার এক বিয়াই এভাবে অবৈধ পথে ইটালী যাওয়ার চেষ্টা করে জীবন নিয়ে দেশে ফিরত এসেছে। দেশ থেকে পাকিস্তান হয়ে যাওয়ার চেষ্টাকালে প্রথমেই পড়ে মাফিয়াদের হাতে। সেখানে মাফিয়ারা আটকে রেখে মুক্তিপণ দাবী করে। মুক্তিপণ দিয়ে আবার পাড়ি দেয়। বরফের নদী পায়ে হয়ে যখন আলোর সন্ধান পাবে সেই মুহুর্তে গ্রেফতার। অতঃপর দেশে ফেরত। 
আরেক পরিচিতজন এভাবেই দিন রাত বরফের উপর দিয়ে পায়ে হেটে এক স্টেশনে পৌছার পর দেখে পায়ে আর জোর নেই। পাটাই যেন বরফ হয়ে গেছে। আগুনে ছেকার জন্য পা রাখে আগুনের উপর। আস্তে আস্তে পা একটু গরম হয় ঠিকই কিন্তু আগুনের তীব্রতা অনুভব করতে পারে না। অনুভবের সেই বোধ শক্তি হারিয়ে গেছে। পরবর্তীতে দেখা গেল তার পায়ে পচন ধরেছে। যতটা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় পা গরম করা উচিত ছিল ততটা দ্রুত পা গরম করায় তার পায়ে পচন ধরে। পরবর্তীতে তাকে দেশে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হলো। চিকিৎসা শেষে তার দুই পায়ের অর্ধেকটা করে কেটে ফেলতে হলো। জীবন জীবিকার টানে সুস্থ্য অবস্থায় বিদেশের পথে পাড়ি জমালেও পঙ্গু হয়ে গেল সে। এখন আর স্বাভাবিক অন্য দশজনের মত হাটতে পারে না, পছন্দ মত জুতা পড়তে পারে না। এভাবেই মানুষগুলো পণ্যের মত বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে কেউ জীবন নিয়ে পালায় আবার কেউ জীবন দেয়। পিছনে ফেলে যায় অনেক স্মৃতি, পরিবার, ভালবাসার মানুষগুলো আর একরাশ স্বপ্ন।
আমাদের সকলের মনে একটাই প্রশ্ন, কেন মানুষগুলো এভাবে জীবনের ঝুকি নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে? বন জঙ্গল বরফের উপর দিয়ে জীবনকে সংকটে ফেলছে? এর অনেক কারন আছে যা বোধ্যারা ভাল বলতে পারবেন। তবে আমার কাছে যে কারনগুলো মনে হয় তা আমি আপনাদের সাথে একটু শেয়ার করে নিতে পারি।
অশিক্ষাঃ যারা জীবনের ঝুকি নিয়ে সমুদ্র, বন জঙ্গল বাড়ি দিচ্ছে তাদের বেশির ভাগ মানুষই অত্যন্ত অশিক্ষিত। অশিক্ষিত মানুষগুলো দেশে তেমন ভাল কোন কাজ করতে পারে না। তাদের ধারনা দেশে যেহেতু কিছু করতে পারলাম না তাই বিদেশ গিয়ে নিজের ভাগ্যটা পরিবর্তন করে ফেলবো দ্রুত সময়ে। বিদেশে গিয়ে যে কোন কাজই করবো কেউ দেখবে না। বিদেশের ঐ কাজই দেশে করলে একটু শরম লাগে!! তাই বিদেশে গিয়ে নিম্নমানের কাজই হোক আর উচ্চমানের কাজই হোক করে মোটা টাকা নিয়ে দেশে এসে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকিব!!
অগ্যতাঃ অশিক্ষিত এই মানুষগুলো জ্ঞান গরিমায়ও ছোট, কাজের অভিজ্ঞতাও কম, অনেকেই একদম অযোগ্য। বিদেশ বিভূইয়ে কি করতে পারবো, কি করতে হবে, কিভাবে যাওয়া যায়, কোন পথ বৈধ কিছুই জানা নেই। আর অগ্য-অনভিজ্ঞ এই মানুষগুলো বিদেশ পাড়ি দিয়ে বিপদে পরে নিজে, বিপদে ফেলে পরিবারকে, বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেশ ও জাতিকে। 
কাজের অভাবঃ দেশে জনসংখ্যা অনুপাতে কাজের অভাব। এক্ষেত্রে সরকারের বিশাল গাফিলতি আছে নিঃসন্দেহে। সরকার উদ্যোগি হয়ে নাগরিকদের পর্যাপ্ত কাজের ক্ষেত্র, সুযোগ করে দিতে ব্যার্থ হওয়ায় মানুষগুলো পিপিলিকার মত দল বেধে বিপদের মুখে ঝাপ দিচ্ছে। 
উচ্চাভিলাশী মনঃ আমাদের দেশের সাধারণ মানুষগুলোর উচ্চাভিলাশী মন আজকের এই পরিস্থিতির জন্য অনেকটা দায়ী। দেশে কাজ করতে মন চায় না। দেশের কাজকে ছোট করে দেখে। একই কাজ ক্ষেত্রবিশেষ নিম্নমানের কাজ বিদেশে করতে মন্দ লাগে না। দেশে নিজের উদ্যোগে, নিজের মেধা খাটিয়ে, অল্প পূজি দিয়ে কাজ করতে উদ্যোগি হয় না এই মানুষগুলো। সবসময় চেয়ে থাকে উচু তলার মানুষের দিকে। তাকিয়ে তাকিয়ে মনের ভিতরে হিংসা পয়দা করে আর বলে আমারও এমন বাড়ি হতে হবে, আমারও এমন গাড়ি থাকতে হবে, আমিও দুহাত খুলে টাকা খরচ করবো!!! কিন্তু সবসময় যদি উপর দিকে না তাকিয়ে নিচের দিকে তাকাই তবে আজকের পরিস্থিতির মত উষ্ঠা খাওয়ার সম্ভাবনা থাকতো না। দ্রুত বড়লোক হওয়া যায় না। আস্তে আস্তে হলে সেটা মজবুত হয় এবং বেশিদিন টিকে থাকে। অন্যের অর্থবিত্তের দিকে না তাকিয়ে নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী চলার মানসিকতা থাকলে কেউ বিপদে ঝাপ দিত না। তাই উচ্চাভিলাসী মনকে সংযত করতে হবে। 
সরকারের ব্যর্থতাঃ সবচেয়ে বড় সমস্যা সরকারের উদাসীনতা ও ব্যর্থতা। সরকারের কাজ প্রতিটি নাগরিকের জীবন জীবিকার খেয়াল রাখা। প্রতিটি নাগরিককে যথাযথ ভাবে শিক্ষিত করে, কর্মদক্ষ করে গড়ে তোলা। শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনের পর যার যার যোগ্যতা অনুযায় কাজের ব্যবস্থা করা। আমাদের সরকার কি সেটা নিশ্চিত করতে পেরেছে? আমাদের সরকার কখনোই সেটা করতে পারেনি। পারলে আজকের এ দৃশ্য দেখতে হতো না। লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার পড়ে আছে কাজের সুযোগ পাচ্ছে না। লাখ লাখ বেকার কর্মী পরে আছে কাজে লাগছে না। কাজের সুযোগ করে দিলে এভাবে কেউ বিপথগামী হতো না। সরকারের উদাসীনতা চরম পর্যায়ে পৌছে গেছে। ঘুষ, দুর্নিতি এমন রূপ ধারণ করেছে যার কারনে রাতের আধারে, দিনের আলোয় মানুষ ছোট্ট নৌকায় করে সাগর পাড়ি দিতে যাচ্ছে। দেশের অভ্যন্তর থেকে অবৈধ ভাবে মানুষ বাইরে যাবে আর বাইরে থেকে ভিতরে ঢুকবে এটা কি করে সম্ভব হয়? তাহলে দেশে নিরাপত্তার জন্য হাজার কোটি টাকা খরচ করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন পোষা হয়? দেশের ভিতর প্রতারক চক্র ঘুরে ঘুরে মুরগি কেনার মত করে বোকা-অগ্য মানুষগুলোকে কিভাবে বিদেশে পাচার করে? দালালরা কিভাবে পার পেয়ে যায়। দালালদের টাকার ভাগ কি প্রশাসনের লোকজন পায় না? না পেলে কেনই বা তাদের বাধা দেয় না? সাধারণ মানুষ তার শেষ সম্বল ভিটে মাটি বিক্রি করে, স্থানীয় এনজিওর কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে পাড়ি দিচ্ছে বিদেশে। প্রতারিত হয়ে কি শুধু অর্থ বিত্তই হারায়, হারায় তার স্বপ্নও। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে চোখে শরষে ফুল দেখে গৃহকত্রী। পিতা-ভাই হারিয়ে নিঃশ্ব হয় সন্তান-স্বজন। সামান্য রোজগারের জন্য বিদেশে পারি দিয়ে কত মায়ের বুক খালি হলো, কত স্ত্রী স্বামী হারা হলো, কত সন্তান পিতা হারা হলো, গভীর সমুদ্রে মাছের খাবারে পরিনত হল আপনজন। 
ঝুকিপূর্ণ বিদেশ পাড়ি দেয়ার ক্ষেত্রে শুধুকি পুরুষই, নারী-শিশুরাও সামিল হয়েছে। নারীরা হয়ে যাচ্ছে ভোগের পন্য। নির্যাতন স্বীকার করে উজ্জল ভবিষ্যতের আশায় ছুটে যাচ্ছে সমুদ্র  পাড়ি দিতে। ভবিষ্যতের উজ্জলতা ম্লান হয়ে যাচ্ছে মুহুর্তেই। দালালের ক্ষপ্পরে পরে জিম্মি হয়ে দেশে কিছু থাকলে তা বিক্রি করে টাকা তুলে দিচ্ছে মাফিয়ার হাতে। সেই টাকাও যাচ্ছে অবৈধ পথে। দীর্ঘদিন যাবৎ এমনটা হচ্ছে সরকার কি কিছুই জানে না? আর কত না জানার ভান করে থাকবে সরকার। আর কত??
দেশে একজন মানুষ ক্রসফায়ার হলে বা অবহেলায় মৃত্যু হলে বা অপঘাতে মৃত্যু হলে আমরা জেগে উঠি। জেগে ওঠাই স্বাভাবিক। আমাদের সাথে বিশ্ব বিবেকও জেগে ওঠে। আজ হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে, গণকবর আবিস্কার হচ্ছে, সমুদ্রে অনাহারে থাকা মানুষগুলোকে তীরে ভিরতে দিচ্ছে না।
কেন এখন বিশ্ব বিবেক জেগে উঠছে না। কেন কঠর ভাবে নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা হচ্ছে না? সাগরে ভাসমান মানুষগুলো হোক বাংলাদেশ বা মিয়ানমারের। তারাওতো মানুষ। বিশ্ব বিবেক কেন প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করছে না আজ। এক পৃষ্ঠা প্রেস রিলিজ বা একটু চোখ রাঙ্গানি দিয়েই কি তাদের দায়িত্ব শেষ? হাড্ডিসার কঙ্কালের মত মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকালে বড় মায়া হয়। এই মানুষগুলো যেখানে যেতে চাইছিল সেখানে গিয়েও কোন কাজ করতে পারবে বলে আমার মনে হয়না। আর এ মানুষগুলো দেশে এসেও কোন কাজ করতে পারবে কিনা আমি জানি না। বেশিরভাগ অভিযাত্রীই যেখানে যাবে সেখানের বা ফেরত আসলে দেশের বোঝা হয়ে দাড়াবে। এই জনগণ আর জনশক্তি থাকবে না। 
অসহায় মানুষগুলো দেখে বড় মায়া হয়। নিজের বিবেকের কাছে কেন যেন প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, কোথায় আজ মানবতা? মানুষ হিসাবে আমাদের কি এ ঘটনা চেয়ে চেয়ে দেখতেই হবে? কিছুই কি করার নেই? ঠুটো জগন্নাথরা কি বিবৃতি দিয়ে পেয়ালায় পেয়ালায় চিয়ার্স করবে? দালালরা কি বহাল তবিয়তেই তাদের কাজ চালিয়ে যাবে আর আমাদের রাষ্ট্রীয় জানোয়াররা কি দালালদের টাকায় শরীরের মেদ বারাবে?


-----------------------------------------------------


নেতা ভক্তির নমুনা!!!

আমাদের দেশে নেতার প্রতি সাধারণ মানুষের ভক্তি দিন দিন যেন উঠেই যাচ্ছে! তবে সাধারণ মানুষের নেতার প্রতি ভক্তি উঠে গেলেও অসাধারণ মানুষের যেন নেতার প্রতি ভক্তির শেষ নেই। রাজনীতির মাঠে সাধারণ জনগন নেতাকে যে দৃষ্টিতেই দেখুকনা কেন অসাধারণ জনগন মানে এক শ্রেণীর কর্মীর কাছে নেতারা পিতার চেয়েও বেশি শ্রদ্ধাভাজন!! 
আমাদের দেশে নেতাকে কেউ গুরু বলে, কেউ ওস্তাত বা ওস্তাদ বলে, কেউ দাদা বলে আবার কেউ ভাই বলে, কেউ কেউ ভাইয়াও বলে, কেউ বস বলে, কেউ লিডার বলে, কেউ কেউ হুজুরও বলে থাকে। দেখা গেছে, বাপেও বলে দাদা আবার ছেলেও বলে দাদা, নাতী বড় হয়েছে, সেও বলে দাদা। দাদা যেন ঐ নেতার নাম হয়ে গেছে!! কেউ কেউ একই ভাবে ভাই বলে, কেউ কেউ একটু বেশি আদর করে বলে ভাইয়া!! বাপে-পুতে একসাথে এমন ভক্তি ভরে সম্বোধন অন্য কোন সম্পর্কে দেখা যায় বলে মনে হয়না!! নির্বোধ নেতাদের এমন পাম দেয় চতুর কর্মীরা যা নেতা বুঝতে পারে না এবং নির্বোধ কর্মীদের এমন বাশ দেয় নেতারা যা কর্মীরা বুঝতে পারে না!!! সবই ঐ তৈলাক্ত বাশের অংক!
নেতার পিছু একজন তথাকথিত কর্মী যে সময় ব্যয় করে তা নিজের কর্মের বা ধর্মের পিছনেও ব্যয় করে না। তাইতো এক নেতার মুখে বলতে শুনেছি যে, আমি আমার নেতার নাম যতবার যপেছি ততবার যদি মহান আল্লাহকে ডাকতাম তবে আজ আমি অনেক বড় অলি আল্লাহ হতাম। এই হলো সেই মহান নেতার বাণী। সেই নেতার পিছনেও দেখেছি শত শত কর্মী দিন রাত ঘুরে বেড়াতো!! 
নেতা ঠিকই বুঝতে পেরেছেন সে তার নেতার নাম যপে কোন কিছুই হতে পারেনি। তারপরও তিনি যখন নেতার আসনে তখন তিনি একবারও তার কর্মীদের বলেনি যে, তোমরা আমার পিছু পিছু এভাবে ঘুরোনা, আমার নাম এত যপে লাভ নেই, আমার পেছনে এত সময় না দিয়ে নিজের কাজের পিছনে সময় দাও, আমার পিছনে সময় দেয়া মানে নিজের পিছনে বাশ নেয়া, আর নিজের পিছনে সময় দেয়া মানে বাশ বেয়ে সাফল্যের চুড়ায় ওঠা!!! 
ওকথা বলবেনা কোনদিনও। কারন তথাকথিত কর্মীদের বিমোহিত করে রাখে নেতারা নানান আশার বাবল ফুলিয়ে। 
সম্প্রতি এক দৃশ্য নেতার প্রতি ভক্তির এক অপূর্ব নিদর্শন বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে। একটি ভবনের টয়লেটে নিজে মুত্র বিষর্জন করে এসে বাইরে করিডোরে দাড়িয়েছি মাত্র। হঠাৎ সুনামীর জলের মত অথবা মৌচাকের মত যেভাবেই বলেননা কেন, ঐ ভবনের বিভিন্ন দরজা দিয়ে মানুষ ঢুকছে। তাকিয়ে একটু অবাক হলাম। ভাবলাম বাইরে কি পুলিশ লাঠিচার্জ করছে!!! এভাবে মানুষ কেন দল বেধে এদিকে আসছে? সাথে সাথেই বিষয়টা পরিস্কার হয়ে গেল। তাকিয়ে দেখি এক নেতা ঢুকছে ঐ ভবনে। নেতা অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ভিষণ বেগে-প্রবল আবেগে আমার পাশ কাটিয়ে ঢুকে গেল টয়লেটে। কিন্তু কর্মীদের পথ চলা থামছে না। একে অপরের উপর যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে!! এর পর নেতার কাছের এক ভাই (দ্বিতীয় কাতারের নেতা) বলে উঠলো, এই তোরা থাম! ভাই প্র¯্রাব করবে!! আরেক জন বলে উঠলো, দাড়া, দাড়া, ........ভাই মোত্তে যায়!!! এবার কথাটা প্রতিধ্বনির মত পিছনের দিকে যেতে শুরু করলো..........ভাই মোত্তে যায়........... ভাই মোত্তে যায়........... ভাই মোত্তে যায়........... ভাই মোত্তে যায়...........। 
এর পর কর্মীরা থেমে গেল। থামতে গিয়ে কেউ কেউ একে অপরের উপর ধাক্কাও খেল। কিছুক্ষণ পর ঐ নেতা টয়লেট থেকে বের হলো!! সবাই কড়িডোরের দুই পাশে সাড়িবদ্ধ হয়ে দাড়িয়ে গেল! নেতা এবার পূর্বের চেয়ে কিছুটা মন্থর গতিতে হেটে চললো। নেতার চোখে মুখে ত্যাগের প্রশান্তির ছাপ! ভোগে নয়, ত্যাগেই শান্তি তা নেতার মুখের প্রশান্তির ছাপ বলে দিচ্ছে!!! নেতার পিছু নিল আবার কর্মীরা। কি নেতা ভক্তি!!! এই দেশে নেতাদের মুক্তি নাই!!! মোত্তেও যেতে পারবে না কর্মীদের ছাড়া!! 
পরে বিষয়টা বন্ধুদের জানালে কেউ কেউ মন্তব্য করলো ঘটনার চেয়েও মজার কথা!! এক বন্ধু বললো, আমাদের দেশের কর্মীরা নেতাদের এতটাই ভালবাসে যে, নেতার মুত্র বিষর্জনের সময় যদি নেতার মুত্র নল ধরে দাড়িয়ে থাকতে পারতো!! প্রিয় নেতা মুত্র বিষর্জন করে যেমন শান্তি পেত তেমনি কর্মী স্বর্গীয় সুখ অনুভব করতো এবং নিজেকে ধন্য মনে করতো ঐ কর্মী। কিন্তু নেতা তো ওটা ধরতে দিতে পারে না, তাই না??


-----------------------------------------------------



কেন এমন হয়!! এই দেশেতে মৃত্যু ভাগ্য তাদের কেন নয়?

নিচে আমার প্রিয় লেখক ডি এল রায় বা দ্বিজেন্দ্র লাল রায় এর একটা অতি পরিচিত কবিতা বলুন আর গানেরই বলুন তার একটি লাইল দিলাম। আমার লেখার শেষে পুরো গানের কথাগুলো দিব বন্ধুদের পড়ার জন্য। নিচের কথাগুলো গানের সুরে না হোক একটু পড়ে দেখুন কি সুন্দর কথা। প্রতিটি শব্দ হৃদয় ছুয়ে যায়।
‘‘আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি’’
গানের এই লাইনটায় আমার কিছু কথা!! ‘আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি।’ আসলে সবার কপালে কি এই সৌভাগ্য হয়? এই দেশেতে জন্ম নেয়ার ভাগ্য অনেকেরই হয়। প্রতি বছর জ্যামিতিক হারে বাড়ে মানুষ। তারা আর কিছু পাক বা না পাক সুজলা, সুফলা, সশ্য শ্যামলা এই সোনার দেশে জন্ম নেয়ার ভাগ্য যে পেয়েছে সেটা নিশ্চিত। কিন্তু এই দেশেতে মরার সুযোগ কি পায়? আমার দেশের অনেক বড় বড়, ছোট ছোট, ছোট বড় লোক এই দেশেতে জন্মে এই দেশেতে মরতে পারে না। আমার কথাটা বিশ্বাস না হলে একটু মিলিয়ে দেখুন। আমাদের দেশের অনেক লোক কখনো ভারতে গিয়ে, কখনো হংকংয়ে গিয়ে, কখনো সিঙ্গাপুর গিয়ে, কখনো থাইল্যান্ড গিয়ে, কেউ কেউ আমেরিকা-লন্ডন-সুইজারল্যান্ডসহ নানা দেশে গিয়ে মৃত্যুবরণ করে!! দেশেই মারা যেতে পারতো। কিন্তু শেষ সময়ে চিকিৎসার ছুতোয় চলে যায় বিদেশে! সেখানে গিয়ে আর ফেরত আসেনা। পরে জোর করে লাশ নিয়ে আসা হয়! আমি মৃত্যু নিয়ে কোন রসিকতা করছি না। বা যারা বিদেশে চিকিৎসার জন্য যান তাদের হেয় করছি না। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হয় তাদের ভাগ্য বিধাতা এই বঙ্গ মাতার কোলে শান্তিতে মরতে দিতে চায় না। তাই ছল ছুতোয় দেশের বাইরে নিয়ে যায়। যদিও জোর জবরদস্তি করে আবার দেশে আনা হয়। কিন্তু এই দেশেতে মরিবার সাধ মিটে না।
কেন এমন হয়??
আধুনিক ফতোয়াঃ আসলে এমনওতো হতে পারে! দেশের সাথে তারা এমন কিছু কাজ করেছে যার শাস্তি হিসাবে বিধাতা তাদের এদেশে মৃত্যুভাগ্য হরণ করেছেন। কোটি কোটি মানুষ এই দেশের ডাক্তার, এই দেশের কবিরাজ, এই দেশের ফকির, এই দেশের ঝাড়ফুক নিয়ে বাঁচার আশায় বুক বাধে। যারা আমাদেরকে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, অন্ন, বস্ত্র, নিরাপত্তা দিবে তারা কি তা দেয় ঠিকমত? নিজের স্বাস্থ্যর চেকআপ করার জন্য দেশের বাইরে চলে যায়, নিজেদের আখের গোছাতে শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা সৃষ্টি করে নিজের সন্তানকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেন। লাখো মানুষের বাসস্থান থাকুক বা না থাকুক, নিশ্চিত করার দায়িত্ব যাদের তাদের থাকে একাধিক আলিশান বাড়ি, ফ্ল্যাট। আবার অনেকে দেশের গন্ডি পেরিয়ে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সেকেন্ড হোমল্যান্ড হিসাবে বেছে নেয় বিদেশ, বিদেশে গড়ে স্বপ্নের বাড়ি। ছেড়া কাপরে লজ্জা ঢাকতে পারেনা হাজারো মা। যারা নিশ্চিত করবে তাদের ছেলে-মেয়ে-বউ দেশি কোন পোষাকই গায়ে চড়াতে চায় না। প্রতিদিন হাজারো শিশু কাদে খিদের জালায়। তাদের মুখে অন্ন নিশ্চিত করার কথা যাদের তাদের বাবুটা কিছুই খেতে চায় না কিন্তু ফাষ্টফুডের দোকানে ঢুকলে হাজার হাজার টাকা বিল হয়, না খেয়ে সেই শুকিয়ে যাওয়া বার-পনের বছরের বাবুটার ওজন নব্বই থেকে একশত পাঁচ কেজি।
আমাদের অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব থাকে যে নেতার কাছে, যে অফিসারের কাছে, যে ব্যবসায়ীর কাছে, যে শিক্ষকের কাছে, যে সমাজ সেবকের কাছে সে তার দায়িত্ব পালন না করে দেশের সাথে বেইমানি করেছে বলেই আমার মনে হয় তাদের এই দেশে মৃত্যুভাগ্য হয় না! যারা আমাদের সাধারণ মানুষের ও দেশের হক নষ্ট করে। এই অপরাধ আমরা আপাত দৃষ্টিতে দেখিনা বা বুঝতে পারি না কিন্তু বিধাতা তো ঠিকই দেখে! সৃষ্টিকর্তাতো এক মহান বিচারক, সে ঠিকই বিচার করে! ফলে দেশের মাটিতে তার আর মরা হয় না। মরার পর দেশে আসে। তাই আমার মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খায়, 
কেন এমন হয়!! এই দেশেতে মৃত্যু ভাগ্য তাদের কেন নয়? 
ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা
ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে যে স্মৃতি দিয়ে ঘেরা
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি
সে যে আমার জন্মভূমি, সে যে আমার জন্মভূমি।।
পুষ্পে পুষ্পে ভরা শাখি কুঞ্জে কুঞ্জে গাহে পাখি
গুঞ্জরিয়া আসে অলি পুঞ্জে পুঞ্জে ধেয়ে
তারা ফুলের ওপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে।।
ভায়ের মায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ
ওমা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি
আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি।।



-----------------------------------------------------

চোখের বালি...

করিম সাহেব সরকারী চাকুরী করেন। বাড়ি তার জেলা সদরের বাইরে। উপজেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করে। এতে তার লাভ দুইটা। এক সে তার নিজের বাড়িতে থাকায় পরিবার পরিজনকে কাছ থেকে দেখভাল করে, নিজের বাড়ি পরিচর্যা করে, ফসল ফলায়, সবজি ফলায়, হাস মুরগি পালন করে, তাজা খাবার খায়, গ্রামের ফুরফুরে কার্বন বিহীন পরিস্কার অক্সিজেন সেবন করে সুস্থ্য থাকে, আর দুই শহর এলাকায় থাকতে গেলে যে মোটা অংকের বাড়ি ভাড়া লাগে তা বেচে যায়। স্বল্প বেতনের চাকুরী, উপরি কামাইয়ের দিকে নজর নেই। সৎ জীবন যাপনের চেষ্টা করে। ভাড়া বাড়িতে থাকতে গেলে যে টাকা খরচ যেত তা দিয়েই তার গ্রামের বাড়িতে যাতায়াত, দুপুরে আধপেটা খাবার খাওয়া, চা নাস্তার খরচ করে অনেকটাই বেচে যায়। বেচে যাওয়া টাকায় সে একপ্রকার রাজার হালেই গ্রামের বাড়িতে সংসার চালায়। করিম সাহেব একটি মোটর সাইকেল কিনে নিয়েছে সাধ্যের মধ্যে দাম দিয়ে। সেই মোটর সাইকেলটি চালিয়েই প্রতিদিন যাতায়াত করে। নিয়মের প্রতি করিম সাহেবের খুব যতœবান। সে আইন মান্য করে চলতে চেষ্টা করে সর্বদা। ড্রাইভিং লাইসেন্স করে নিয়েছে। কখনো হেলমেড ছাড়া গাড়ি চালায় না। গাড়িতে একটি রেইন কোট রেখে দেয় সবসময়। প্রতিদিনের মত সে বাড়ি থেকে অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে। পথি মধ্যে তার সামনে পড়লো একটি নসিমন। নসিমনটি তার যোগ্যতার চেয়ে বেশি বালু ভরাট করে প্লেনের গতিতে ছুটছে। চৈত্র মাস, প্রচন্ড খরতাপ। শুস্ক বালু বাতাসের তোড়ে উড়ছে সেদিকে সনিমন ড্রাইভারদের কোন খেয়াল নেই। হেলমেড মাথায় দিলেও সব সময় সামনের গ্লাসটা নামিয়ে রাখতে ভাল লাগে না। এমনিতে প্রচন্ড গরম। হেলমেড মাথায় দিয়ে চোখের সামনের ক্লাসটা উপরের দিকে উঠিয়ে রেখেছে যাতে একটু বাতাস পায় সেই চিন্তায়। দ্রুত গতির নসিমন, কাউকে সাইড দিতে অভ্যস্ত নয় তারা। করিম সাহেবকেও তারা সাইড দিচ্ছে না, আর করিম সাহেবও অতটা দ্রুত মোটর বাইক চালাতে অভ্যস্ত না। সে নিয়ন্ত্রনের ভিতরে থেকে সবসময় গাড়ি চালায়। দ্রুত গতির নসিমনের পিছনে পিছনে চলছে করিম সাহেব। হঠাৎ এক দমকা হাওয়া এসে লাগলো নসিমনের গায়ে। শুস্ক বালু উড়ে এসে করিম সাহেবের দুচোখ ভরে গেল। করিম সাহেব দুচোখে শুধু অন্ধকার দেখছে। কোন মতে গাড়ি থামিয়ে দিলো রাস্তার ধারে। চোখ খুলতে পারছে না করিম সাহেব। আস্তে আস্তে সে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। তারপর পাশের বাড়িতে গিয়ে একটি টিউবয়েলের নিচে মুখ দিয়ে চোখে পানির ঝাটকা দিলো। ভাল ভাবে চোখ ধোয়ার পরেও চোখের ভিতর বালুর ক্ষুদ্র কনা রয়ে গেছে। ভাল ভাবে তাকাতে পারছে না। তার চোখ আস্তে আস্তে লাল হয়ে গেল। বাসায় যাওয়ার পর রাতে দেখাগেলো করিম সাহেবের চোখ ফুলে ঢোল। চোখ অতি সুক্ষ আবরন দিয়ে তৈরী, সামান্য বালু কনায় টিস্যু কাটা ছেড়া হয়ে যায়। করিম সাহেবেরও তাই হলো। 
আফসার সাহেব একজন সিনিয়র সিটিজেন। বিকাল হলে একটু হাটাহাটি করে নিজেকে সচল রাখার জন্য। এমনিতে বয়স হয়েছে, তার উপর ডায়াবেটিসের নানা উপসর্গ দেখা দিয়েছে। তাই প্রতিদিনের ন্যায় ফুটপাত দিয়ে হাটাহাটি করেন আফসার সাহেব। বিকেল বেলা হাটতে হাটতে প্রধান সড়কে আসার পর হঠাৎ একটা ইটের সুড়কি ভর্তি ট্রাক তাকে পাস কাটিয়ে চলে গেলো ঝড়ের গতিতে। পাতাসের কারনে গাড়িতে রাখা সুড়কি থেকে লাল রংয়ের ধুলি ঝড় বয়ে চলেছে সেদিকে তাদের কোন খেয়ালই নেই। আফসার সাহেবের চোখে মুখে এসে লাগলো ধুলি ঝড়ের একাংশ। পরিস্কার চেহারার মানুষটা মুহুর্তের মধ্যে হলি খেলার নায়ক হয়ে গেল। সারাটা মুখ তার সুরকির লাল ছাইয়ে ভরে গেল। চোখ মেলতে পারছে না। সে দাড়িয়ে গেল। হাত দিয়ে মুখটা ঝেড়ে লাল ধুলা পরিস্কার করলেও ধুলার সাথে কিছু কনাও তার চোখে ঢুকে গেছে। চোখ ডলা দিলে সে অনুভব করছে চোখের ভিতর বড় বড় সুরকি যেন তার চোখের ভিতর ঘুরছে। রাস্তার পাশের এক চায়ের দোকানে গিয়ে মুখটা ধুয়ে নিলেন। মুখটা পরিস্কার হলেও তার চোখে পৃথিবী এখন লাল পৃথিবী। চোখের ভিতর সুরকির লাল বালু কনা ঢুকে আছে। প্রচন্ড যন্ত্রনা হচ্ছে। অনেক ক্ষণ পানির ঝাপটা দেয়ার পর একটু স্বাভাবিক হলেও চোখের ভিতর কুট কুট করছে, চুলকাচ্ছে। মনে হচ্ছে চোখের ভিতর কয়েকটা ইট ঢুকে আছে বের হচ্ছে না। 
করিম সাহেব আর আফসার সাহেবের মতই আরেক ভূক্তোভূগি রহমান দম্পত্তি। রিক্সা করে বেরিয়েছেন মার্কেটে শপিং করতে। নতুন দম্পত্তি। হুড খোলা রিক্সায় বাতাশ খেতে খেতে আর গল্প করতে করতে সস্ত্রীক যাচ্ছেন শপিংয়ে। ফুরফুরে মেজাজ। হঠাৎ পাশ দিয়ে বিশালাকার আজরাইলের মত ট্রাক গর্জন করতে করতে পাশ দিয়ে গেল। ট্রাকের উপর কালো কালো পাথরের টুকরো দেখেই বোঝা যাচ্ছে এগুলো ভাঙ্গা পাথরের টুকরো। বড় কোন ভবন বা পিচ ঢালা রাস্তার তৈরীতে ব্যবহারের জন্য কোন ঠিকাদার আমদানী করেছে। বাতাসে খোলা ট্রাক থেকে পাথরের গুড়া উড়ে উড়ে আসছে। চোখ মুখ ঢাকার আগেই তাদের কর্ম সারা। দুজনেরই চোখে ঢুকে গেল ভাঙ্গা পাথরের গুড়া। রহমান দম্পত্তি অনুভব করলো চোখের ভিতর পাথরের বোল্ডার। চোখ ডলতে ডলতে দুজনের চোখই লাল। যে কেউ দেখলেই ভাববে টাল হয়ে এসেছে শপিংয়ে। 
উপরের গল্প গুলো বাস্তবতার আলোকে কাল্পনিক ঘটনা। আসলে এমনটা কেন হয়? আমাদের দেশে ময়লার উদাম গাড়ি রাজ পথ দিয়ে সাই সাই করে ঘুরে বেড়ায়। পুতি গন্ধে নাগরিকরা নাক ঢাকে। যাদের সহ্য ক্ষমতা কম তারা রিক্সা-গাড়িতে বসেই বমি করে। ফুটপাতের মানুষগুলে বসে পড়ে বমি করতে করতে। নসিমন, ট্রলি, ট্রাক উন্মুক্ত অবস্থায় ইট, বালু, সুরকি পরিবহন করে। বাতাসে মানুষের চোখে মুখে লাগে সেই বালু কনা। একটু ঢেকে নিলেই হয়। কিন্তু ঢেকে নেওয়ার কোন প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করেনা এসব পরিবহনের ড্রাইভাররা। তাদের শিক্ষার জোর কম, সামাজিক দায়বদ্ধতা কি সেটা তাদের জানার কথাও না। ড্রাইভার-শ্রমিকরা তারা তাদের যে দায়িত্বগুলো জানে না, সে দায়িত্বগুলো কি তারা কোনদিনই জানবে না? তাদের তো জানানো উচিত!। যারা মালের মালিক তাদেরও তো দায়িত্ব আছে। তার মাল পরিবহনে অন্যের যাতে ক্ষতি না হয় সেই বিষয়টা কি কখনো আমরা তাদের মনে করিয়ে দেই? আর প্রশাসনের কথা যদি বলি, তবে প্রশাসনের কি এ বিষয়ে কোন দায়িত্ব নেই। ক্ষতিকর পণ্য পরিবহনে সতর্কতামূলক কিছু দায়িত্ব থাকে। আমাদের রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ ভাইয়েরা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করে। তারা কি কখনো কোন ট্রাক, নসিমন থামিয়ে বলে, যে তোমরা এভাবে পরিবহন করো না। একটা ত্রিপল দিয়ে ঢেকে নাও, বা পলেথিন দিয়ে ঢেকে পরিবহন কর। অবৈধ অনেক পরিবহন চলাচল করে রাস্তায়। অবৈধ পরিবহনকে বৈধতা দেয়া হয় আরেক অবৈধ উপায়ে। পরিবহনের সুবিধার জন্য যদি কিছু পরিবহনকে ছাড় দিয়েও থাকে তবে কিছুটা সামাজিক দায়িত্ববোধের শিক্ষা কি তাদের দেয়া যায় না? রাস্তায় চলতে গিয়ে এভাবে ইট বালু সুরকির ধুলায় কেন নাকাল হতে হবে আমাদের। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কি দায়িত্ব রাস্তায়? শুধুকি অবৈধ গাড়ি ধরা, রাস্তার জানজট পরিস্কার রাখাই তাদের কাজ হবে। বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রন, সুশৃঙ্খল ভাবে গাড়ি চালানো, ক্ষতিকর পন্য পরিবহনে সতর্কতা সহ বিভিন্ন বিষয়ে তারা যদি একটু নজরদারি বাড়াতো তবে রাস্তায় এমন ভোগান্তির শিকার হতে হতো না আমাদের। 
আমারা যারা আম জনতা আমাদের পক্ষে এটা নিয়ন্ত্রন বা তাদের ছবক শেখানো সম্ভব নয়। ট্রাফিক ভাইরা যদি এসব পরিবহন আটকে তাদের কিছু বিধি নিষেধ দিয়ে দেয় তবেই তারা কথা শুনবে। রাস্তায় বেরিয়ে আমরা কেউ চোখ ডলতে চাইনা, ধুলি কনার কারনে চোখের অপূরনীয় ক্ষতি করতে চাই না। ইট, বালু, সুরকি পরিবহনের সময় অবশ্যই ঢেকে নিয়ে পরিবহন করবে এটাই প্রত্যাশা করি পরিবহন শ্রমিক ভাইদের কাছে। আর প্রশাসনের কাছে প্রত্যাশা করি তারা এটা কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রন করবেন এবং করতে বাধ্য করবেন। তবেই ধুলি কনা বিহীন একটা সমাজে আমরা বসবাস করতে পারবো, যে সমাজে বসবাস করেন ঐ পরিবহন শ্রমিকরা, নিয়ন্ত্রন ক্ষমতার অধিকারী প্রশাসনের কর্তা-কর্মীরাও। নগরির আরেক উৎপাৎ যত্র তত্র ইট, বালু, সরকি, রড রাখা। সকলেই রাস্তার একটা অংশ জুরে এসব নির্মান সামগ্রী রাখতে অভ্যস্ত। এর ফলে রাস্তায় সবসময় ধুলা লেগেই থাকে। একটু বাতাসে বা দ্রুত গতিতে গাড়ি চললে চাকার ঘর্ষণে ধুলা উড়ে। রাস্তার উপর নির্মান সামগ্রী রেখে রাস্তা অপরিস্কার করে এবং রাস্তাকে সংকুচিত করার কারনে যান চলাচল এবং পায়ে হাটা মানুষের ভোগান্তি লেগেই থাকে। এ থেকেও পরিত্রান প্রয়োজন। আর চোখের বালি পরিস্কার করার দায়িত্ব যাদের তাদের একটু মনযোগ প্রয়োজন।   


-----------------------------------------------------


রামু বৌদ্ধ বিহার দর্শন, চুল্লবর্গ বিক্রয়ের নামে প্রতারনা!

শরীয়তপুর জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচন হয় প্রতি বছর। নতুন বছরের প্রথম মাসের শেষ সপ্তাহের শনিবার সাধারণত ভোট গ্রহণ করা হয়। এতটা সুন্দর ভাবে গণতন্ত্রের চর্চা অন্য কোন সমিতিতে দেখা যায় না যা দেখা যায় আইনজীবী সমিতিগুলোতে। সে মোতাবেক শরীয়তপুর জেলা আইনজীবী সমিতির ২০১৭ সালের নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহে। ভোটার তালিকা নিয়ে একটু জটিলতার কারনে নির্বাচন পিছিয়ে যায় দুই দফা। শরীয়তপুর জেলা আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী পরিষদের বছরের শেষ মিটিংয়ে আলোচনার ভিত্তিতে একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং তাকে সহযোগীতার জন্য দুইজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ নিয়ে আলাপ আলোচনা হলো। যথারীতি একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার সহ তিন জন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগও করা হলো। কয়েকজন সিনিয়র আইনজীবী ভোটার তালিকা নিয়ে অভিযোগ তোলায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচন স্থগিত করে পদত্যাগ করে বসলেন। শুরু হলো জটিলতা। সাধারণ সভা করে ভোটার তালিকা নিয়ে একটা সমাধানে গিয়ে পূর্বের প্রধান নির্বাচন কমিশনার সহ তিন কমিশনারকে আবার দায়িত্ব দেয়া হলো নির্বাচন করার জন্য। তফসিল অপরিবর্তিত রেখে নির্বাচনের প্রস্তুতিকালে আবারও ভোটার তালিকা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হলো। আবারও পদত্যাগ করে বসলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। এবার দীর্ঘ আলাপ আলোচনা শেষে সিনিয়র কয়েকজন আইনজীবী সমস্যার সমাধান করলেন। এবার আর সেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার নয়। নতুন করে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেয়া হলো। এবার নির্বাচন কমিশনার বেশ কলিজাওয়ালা। তৃতীয় দফায় নির্বাচন কলিজা ওয়ালা প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ফলে নির্বাচন সম্পন্ন করা হয়। নির্বাচনে আমিও দাড়িয়ে ছিলাম কার্যনির্বাহী পরিষদ সদস্য পদে। প্রত্যাশার চাইতে বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচনে পাস করলাম। চতুর্থ বারের মতে আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী পরিষদে স্থান পেলাম। নির্বাচনে বন্ধুদের মধ্যে আরো পাস করল এডভোকেট জামাল ভূইয়া, এডভোকেট মোঃ আমিনুল ইসলাম পলাশ, এডভোকেট সরদার আজিজুল রহমান রোকন। 
নির্বাচন শেষ, একটু রিক্রিয়েশন দরকার! যেই ভাবা সেই কাজ। ঘুরতে যাওয়া দরকার, তাই টিম গঠনের পালাা। একে একে টিমে যোগ হলো জামাল ভূইয়া, পলাশ, রোকন, তারা, মুরাদ, জাকির ভাই, রুহুল ভাই, জাহাঙ্গীর ভাই, এমদাদ ভাই। দশ জনের টিম, এগার জন হলে মাঠে নেমে পড়া যেত! রুহুল ভাইর কাধে পড়লো ট্যুর ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব। শরীয়তপুরে না পেয়ে মাদারীপুর থেকে একটা বড় এসি মাইক্রোবাস ভাড়া করা হলো। গুছিয়ে একদিন সকালে রওয়ানা দিলাম কক্সবাজারের পথে। মধু হই হই গাইতে গাইতে আমরা পৌছে গেলাম কক্সবাজার। সারা রাস্তায় আনন্দ আর আনন্দ। যখন মন চাইছে চা খেতে, দাড়িয়ে গেলাম গাড়ি নিয়ে। যখনই খুধা লেগেছে খুজে নিলাম হোটেল। এভাবেই চললো আমাদের যাত্রা। সময়ের কোন বালাই নেই। সময়টাকে থামিয়ে দিয়ে ইচ্ছা মত মজা করা আরকি। রুহুল ভাই আগেই হোটেল বুকিং দিয়ে রেখেছিলো। ডলফিন মোড়েরর কাছেই হোটেল বেষ্ট ওয়েষ্টার্ণ প্লাস হেরিটেজে উঠলাম আমরা। হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম খাবারের সন্ধানে। খাওয়া দাওয়া শেষে বীচের কাছে গিয়ে দোকন থেকে কিছু প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সেরে আবার হোটেল। শান্তির ঘুম চুমু দিলো সবার চোখে। সকালে ঘুম থেকে উঠে বীচে নেমে গোসল সেরে আবার হোটেলের সুইমিং পুলে চই ডুব খেলা! বেশ কাটছে আমাদের কক্সবাজার ভ্রমণ। 
বিভিন্ন স্পট দেখার যে পরিকল্পনা করেছি তার মধ্যে রামু বৌদ্ধ বিহার অন্যতম তালিকায় রইল। এক দুপুরে আমরা গেলাম রামু বৌদ্ধ বিহার। বিশাল প্রাসাদপম বৌদ্ধ মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার সাথে সাথে একজন দৌরে এসে বললো, জুতা খুলে প্রবেশ করুন। আমরা জুতা খুলে এক পাশে রেখে ভিতরে প্রবেশ করলাম। ভিতরে বিশালাকায় বৌদ্ধ মূর্তি নিরবে বসে আসে। ঘুরে ঘুরে সরকারের অর্থানুকুল্যে নির্মিত নতুন কমপ্লেক্স দেখছি। দ্বিতীয় তলায় বিশাল হল রুমের ভিতর ছোট ছোট ছেলেরা মাথা ন্যাড়া অবস্থায় বসে বসে দুষ্টামি করছে। এ বয়সটাই দুষ্টামির! কিন্তু ধর্মীয় বিধি নিষেধের কারনে তাদের আটকে রেখেছে মনে হলো। রুমের দেয়াল ঘেষা বোর্ডে বিভিন্ন ছবি। আছে সেলফে সাজানো বইয়ের সমারহো। একটা বই দেখে আমার আর তারার নজর কারলো। বইটির নাম চুল্লবর্গ। একজন ভিক্ষুকে ডাক দিলাম। কাছে আসতেই জানতে চাইলাম বইগুলো কি বিক্রর জন্য। আমাদের সে জানালো হ্যা, এগুলো বিক্রির জন্য। দাম জানতে চাইলে বললো এর মূল্য দুইশত পঞ্চাশ টাকা। আমি আর তারা দুজনে দুটি বই নিলাম। বইয়ের মূল্য বাবদ পাঁচশত টাকার একটি কচকচে নোট ভদ্রলোককে ধরিয়ে দিলাম। এর পর ওখান থেকে নেমে আমরা বাইরে আসলে আরেক ব্যক্তি আমাদের পাশের কিছু পুরাতন বৌদ্ধ নিদর্শন দেখানোর জন্য নিয়ে গেল। আমন্ত্রনের ভাব দেখে মনে হলো খুবই আন্তরিক। আমাদের বললো, এত দুর থেকে এসেছেন, আদী নিদর্শনগুলো দেখে যাবেন না? লোকটি আমাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বৌদ্ধের বিভিন্ন পুরাতন মুর্তি দেখালো। কোনটা কত সালের তা বলে দিচ্ছে আর একটা দেখা শেষ হলে আরেকটার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এভাবে দেখতে দেখতে যখন সব দেখা শেষ তখন আন্তরিক ব্যক্তিটির আসল রুপ বেরিয়ে পড়লো। সে এবার আমাদের কাছে বখশিস দাবী করলো। তার চাইতে লজ্জা না করলেও আমাদের লজ্জা লাগলো। আমরা তাকে বখশিস দিয়ে বের হয়ে এলাম। গেটের পাশেই আমাদের মাইক্রোবাস দাড়ানো ছিলো। স্বজতেœ বইটাকে নিয়ে আমরা গাড়িতে উঠে গেলাম। গাড়িতে উঠে বইটা নেড়ে চেরে দেখলাম, লেখা সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে বিতরনের জন্য। লেখাটা দেখে একটু অবাক লাগলো! যে বইটি বিনা মূল্যে বিক্রয়ের জন্য সেই বইটির দাম আড়াইশো টাকা কি করে হয়? বুদ্ধিষ্ট ব্যক্তিটি আমাদের বলতে পারতো, বইটি বিনা মূল্যে বিতরনের জন্য, আপনারা খুশি হয়ে মন্দিরের জন্য যদি কিছু দান করতে চান তবে করতে পারেন। আমরা দুটি বই হাতে নিয়ে ধরেই নিয়েছি এর মূল্য পাঁচশত টাকার কম হওয়ার কথা নয়। আমাদের সত্যি কথাটা বললে অনায়াসেই দুটি বই নিয়ে এক হাজার টাকা তার হাতে তুলে দিতাম। আমাদের কাছে ঐ ব্যক্তিটিকে প্রতারক বলেই মনে হলো! 
এবার আমাদের যাত্রা রামুর একশ ফুট লাম্বা বৌদ্ধ মূর্তি প্রদর্শন। একশ ফুট লম্বা মূর্তি সম্পর্কে কিছু কথা নেট থেকে খুজে পেয়েছি। বন্ধুদের জন্য তা তুলে ধরা হলো-
মহামানব গৌতম বুদ্ধ ধন্যবতীর রাজা চাঁদ সুরিয়ার সময় সেবক আনন্দকে নিয়ে আরাকানের রাজধানী ধন্যবতী আসেন। সেখানে এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সেবক আনন্দকে উদ্দেশ্য করে বুদ্ধ বলেন, ‘হে আনন্দ ভবিষ্যতে পশ্চিম সমুদ্রের পূর্ব পার্শ্বে পাহাড়ের উপর আমার বক্ষাস্থি স্থাপিত হইবে। তখন উহার নাম হইবে ‘রাংউ’। ধন্যবতী রাজবংশ গ্রন্থে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, ভাষাতাত্ত্বিক প্রকৃয়ায় রাংউ থেকে রামু শব্দটি এসেছে। রাংউ বার্মিজ শব্দ। রাং অর্থ বক্ষ, উ অর্থ অস্থি অর্থাৎ রাংউ শব্দের অর্থ হচ্ছে বক্ষাস্থি। বর্তমানেও রামুতে রয়েছে অনেকগুলো প্রাচীন বৌদ্ধ ঐতিহ্য ও প্রতœতাত্তিক নিদর্শন।
এই রামুতে বৌদ্ধ সভ্যতা বা বৌদ্ধ স্থাপত্যের গোড়াপত্তন কখন থেকে তা সঠিকভাবে বলা মুশকিল। তবে আরাকানের প্রাচীন ইতিহাস ‘রাজোয়াং’ থেকে জানা যায়, ‘খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের দিকে অর্থাৎ ১৪৬ খ্রিস্টাব্দে মগধ রাজ্যের চন্দ্র সূর্য নামক জনৈক সামন্ত যুবক তাঁর বহু অনুগামী সৈন্যসামন্ত নিয়ে চট্টগ্রাম ও আরাকান দখল করেন। একটি অখন্ড রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং আরকানের ধন্যবতীতে রাজধানী স্থাপন করেন। রাজা চন্দ্র সূর্য এবং তাঁর সঙ্গে আগত সৈন্যদের অধিকাংশ ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। তারা চট্টগ্রাম ও আরকানে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে কার্যকর ভূমিকা রাখেন। তাই মগদাগত বৌদ্ধ এবং এতদঅঞ্চলের বৌদ্ধদের মধ্যে নিবিড় ধর্মীয় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফলে রাজকীয় প্রষ্ঠপোষকতায় চট্টগ্রাম ও আরকানে বৌদ্ধ ধর্মের দ্রুত বিস্তার ঘটে’।
বিভিন্ন সূত্রে আরো জানাযায়, প্রাচীনকাল থেকে রামু আরাকানী এবং এদেশীয় রাখাইন (রাকখাইন) বৌদ্ধদের পদভারে মুখর ছিল। আরাকানী শাসনামলে কক্সবাজার বা রামুতে রাখাইন সম্প্রদায় ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। ইংরেজদের আগমনের আগ পর্যন্ত এই সংখ্যাধিক্য অটুট ছিল। বর্তমানে রামুতে যে সকল বৌদ্ধ পূরাকীর্তি বা প্রাচীন বৌদ্ধ স্থাপত্য শিল্প রয়েছে, বিশেষ করে দৃষ্টিনন্দন শিল্পঐশ্বর্যে কাঠের তৈরি বিহারগুলো রাখাইনদের স্বর্ণোজ্জ্বল যুগের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে এসব পূরাকীর্তির মধ্যে কোনটি সবচেয়ে প্রাচীন? সঠিক দিনক্ষন এভাবে নিরুপন করা যায়নি। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে (খ্রিস্টপূর্ব ৩০৮) রামকোটের পাহাড়ের উপর স¤্রাট অশোক রামকোট (রাংকুট) বনাশ্রম বৌদ্ধবিহারটি নির্মাণ করেন। এই বিহারের সংরক্ষিত বুড়া গোঁসাই মূর্তির মাঝেই গৌতম বুদ্ধের বক্ষাস্থি স্থাপিত হয়েছে। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এর ভ্রমণকাহিনীতে উল্লেখ আছে, বিহার নির্মাণের পরর্বতী সময়ে সেখানে সাত’শ ভিক্ষু বসবাস করতেন। কালের পরিক্রমায় অনেক ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে। কিছু কিছু হারিয়ে যাওয়ার পথে। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সাম্প্রদায়িক হামলায় এরকম বেশ কয়েকটি প্রাচীন পুরাকীর্তি ধ্বংস করা হয়েছে। মুছে ফেলা হয়েছে ইতিহাসের পাতা থেকে।
তবে পুরাকীর্তি ও প্রতœতাত্তিক নিদর্শনের ঐতিহ্য বহন করে এখনো স্বগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, এমন নিদর্শনের সংখ্যা রামুতে এখনো কম নয়।
শ্রীকুল গ্রামে কাঠের তৈরি শ্রীকুল রাখাইন বৌদ্ধ বিহার। এটি নির্মাণ করা হয়েছে ১৮৯৯ সালে। ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের লামার পাড়া গ্রামে অবস্থিত থোয়াইংগ্যা চৌধুরীর ক্যাং। তবে গ্রামের নামানুসারে এটি লামারপাড়া ক্যাং নামেই পরিচিত। ১৮০০ সালে তৎকালীন রাখাইন জমিদার উথোয়েন অংক্য রাখাইন এটি প্রতিষ্ঠা করেন। পাড়ার ভেতরের শান্ত নিথর কিছুটা পথ মাড়িয়ে এ ক্যাং-এ পৌঁছালে এখনো চোখে পড়ে, আশ্চর্য হবার মতো বড় বড় দুটি পিতলের ঘন্টা। পিতলের তৈরি এগুলো দেশের সবচেয়ে বড় ঘন্টা। এখানে আরও সংরক্ষিত আছে অষ্টধাতু নির্মিত দেশের সবচেয়ে বড় বুদ্ধমূর্তি এবং প্রাচীন শিলালিপিসহ ঐতিহাসিক স্মৃতি চিহ্ন।
রেংগুনী কারুকাজে তৈরি প্রায় দুইশ বছরের প্রাচীন এ বিহারের নির্মাণ শৈলীও দারুন চমৎকার। কিন্তু উপযুক্ত পরিচর্যা এবং রক্ষণা-বেক্ষণের অভাবে বর্তমানে এ বিহারটির ভগ্নদশা।
১৮৯৯ সালে তৈরি চেরাংঘাটা উসাইসেন বৌদ্ধ বিহার। স্থানীয়ভাবে বড় ক্যাং নামে পরিচিত। এ বিহারের নির্মাণ শৈলীও দারুন। রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে কাঠের তৈরি বিহারগুলোর মধ্যে প্রায় দেড়’শ বছরের পুরনো হাজারীকুল রাখাইন বৌদ্ধ বিহার ও দক্ষিণ শ্রীকুল গ্রামে অবস্থিত লাহ-পেঁ-বাঙ-রঙ ক্যাং বা সাংগ্রীমা ক্যাং বর্তমানে ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়েছে। 
রামু-নাইক্ষ্যংছড়ি সড়কের পাশ ঘেঁষে পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে বিশালাকার জাদী। এটি লাওয়ে জাদি নামে পরিচিত। এক সময় ওই জাদির সীমানা প্রাচীরের উপর দাঁড়ালে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত দেখা যেত। এখন পাহাড় ধ্বসের কারণে সেই সীমানা প্রাচীরও ভেঙ্গে গেছে। 
রামুর পোড়া মাটিতে আধুনিক স্থাপত্য শিল্পঃ ইতিহাস প্রসিদ্ধ রামুতে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেবর কাল রাতে ঘটে গেছে এক অবিশ্বাস্য ধ্বংসযজ্ঞ। যে ধ্বংসযজ্ঞে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে রামুর প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী এরকম বারটি নিদর্শন। পুড়ে গেছে মহামূল্যবান বুদ্ধের ধাতু, তাল পাতার উপর বিভিন্ন ভাষায় লেখা ত্রিপিটক, অনেকগুলো বুদ্ধমূর্তিসহ প্রাচীন প্রতœতাত্তিক নিদর্শন। পাশাপাশি ওই একরাতেই পুড়েছে এখানকার হাজার বছরের গর্বের ধন-সম্প্রীতি।
তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টায় মাত্র এক বছরে বদলে গেছে রামুর দৃশ্যপট। সেই ধ্বংসস্তুপের উপর গড়ে তোলা হয় দৃষ্টিনন্দন বৌদ্ধ বিহার। আধুনিক স্থাপত্য শৈলীতে তৈরি নব নির্মিত সেই বিহারগুলোই এখন নতুন ইতিহাস। একদিন এ ইতিহাসের বয়সও হবে হাজার বছর।
রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহার, উত্তর মিঠাছড়ি বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্র, রামু মৈত্রী বিহার, লাল চিং, সাদা চিং, অপর্ণাচরণ চিং, জাদী পাড়া আর্য্যবংশ বৌদ্ধ বিহার, উখিয়াঘোনা জেতবন বৌদ্ধ বিহার, উত্তর মিঠাছড়ি প্রজ্ঞামিত্র বন বিহার, চাকমারকুল অজান্তা বৌদ্ধ বিহারসহ নব নির্মিত এসব বৌদ্ধ বিহার যেন এখন নতুন ইতিহাস। এসব বিহারের ঐতিহ্য নিয়ে আবার নতুন করে সমৃদ্ধ এই রামু।
অন্য রকম আলোয় আলোকিত বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রঃ উঁচু নিচু পাহাড় টিলায় সবুজের সমারোহ। এ সবুজের মাঝে গড়ে ওঠেছে মানুষের বসতি। শান্ত কোমল পরিবেশে এখানকার প্রাকৃতিক সৌর্ন্দর্য মানুষকে অবিরাম কাছে টানার মত জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের উত্তর মিঠাছড়ি গ্রাম। সেই অসাধারণ সৌন্দর্য্যে ঘেরা পাহাড় চূড়ায় এক টুকরো সবুজের মাঝে ছিল বাঁশের তৈরি বিমুক্তি বির্দশন ভাবনা কেন্দ্র। এর সামনেই ছিল উত্তর-দক্ষিণ কাত হয়ে শোয়া গৌতম বুদ্ধ মূর্তি। সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় বিহারটি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মূর্তিটি প্রায় অক্ষত থেকে যায়। অন্যান্য বিহারগুলোর মত এটিও নতুনভাবে নির্মাণ করে সেনাবাহিনী।
তবে সেনাবাহিনী বারটি বিহার নির্মাণ করলেও সবকিছু মিলিয়ে অসাধারণ রূপ পেয়েছে এ বিহারটি। বর্তমানে যে কেউ বিহারটি দেখে অভিভূত হবেনই। বিহারের চমৎকার নির্মাণ শৈলীতো আছেই এ ছাড়াও বিহারের আঙ্গিনাকেও সাজানো দারুনভাবে। সেই অসাধারণ সৌন্দর্যের মাঝে নতুনভাবে শোভা পাচ্ছে একশ ফুট দীর্ঘ বিশালাকার আগের সেই মূর্তিটি। বর্তমানে এটি যেন অধারণের চেয়েও বেশি অসাধারণ। বলা যায়, রামুর বৌদ্ধ ঐতিহ্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্র।
‘অহিংসা, সাম্য ও মৈত্রীর বাণী নিয়ে বৌদ্ধ জাতিকে আলোর পথ দেখান মহামানব গৌতম বুদ্ধ। তিনি শান্তির প্রতীক, বৌদ্ধদের পথ প্রদর্শক। তাই এ মূর্তির নাম দেওয়া হয়েছে বিশ্বশান্তি সিংহশয্যা গৌতম বুদ্ধমূর্তি। বিহারকে নতুন করে সাজানোর পর এখন এ মূর্তিটিও নতুন রূপ পেয়েছে।
পাহাড় চূড়ায় নির্মিত বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রের দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার পাশাপাশি নতুন মাত্রা দিয়েছে এ মূর্তিটি। বর্তমানে এটিই দেশের সবচেয়ে বড় বুদ্ধমূর্তি। মিয়ানমারের ইয়াংগুন থেকে কারিগর এনে এটি তৈরি করা হয়। মিয়ানমারের কারিগর থোয়াইংছি রাখাইন দীর্ঘ সাড়ে তিনবছর কাজ করে মূর্তিটি তৈরি করেন। ‘এ মূর্তির মডেলও সংগ্রহ করা হয়েছে মিয়ানমারের ইয়াংগুনের ধাম্মাদূত বৌদ্ধ বিহার থেকে। ওই মন্দিরে সংরক্ষিত গৌতম বুদ্ধের মূর্তির আদলে এটি নির্মাণ করা হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এ মূর্তির নির্মাণ শৈলী দেশী বিদেশী সকল মানুষকে আকৃষ্ট করছে যেমনটি আকৃষ্ট হয়েছি আমরা।


-----------------------------------------------------


শরীয়তপুরের লিজা হত্যা ॥ হলুদ সাংবাদিকতায় আতঙ্ক ছড়ায় একদল জানোয়ার

শরীয়তপুর জেলার সখিপুর থানার সরদার কান্দি গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান লিজা আক্তার। লিজা আপনার আমার সন্তানের মতই তার পিতা-মাতার আদরের সন্তান। লিজা সখিপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। ভাবা যায়, তৃতীয় শ্রেণীতে পড়–য়া একটি মেয়ে কেমন ফুটফুটে, চঞ্চল, হৃদয়কারা হতে পারে? ঠিক তেমনি একটি মেয়ে লিজা। স্কুল পড়–য়া লিজা আক্তার সাইকেল চালাতে ভালবাসতো। স্কুল থেকে ফিরে প্রতিদিনের মত খাওয়া দাওয়া সেরে ছুটে গেছে খেলতে। খেলতে খেলেত নিশ্চই তার মনে পড়েছে প্রিয় কাজ সাইকেল চালানোর কথা। ছুটে গেছে সাইকেল ভাড়া দেয়ার দোকানে। পনের মিনিটের জন্য একটা সাইকেল ভাড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বিশ মিনিট সাইকেল চালিয়ে এসে দোকানির কাছে ফিরত দেয় সাইকেলটি। পাঁচ মিনিট বেশি হয়ে গেছে, তাতে কি, দোকানদার চাচ্চু কিচ্ছু বলবে না, কারন প্রতিদিনের কাষ্টমার যে লিজা! লিজার সেই সৎ সাহস ছিল। দোকানদারের কাছ থেকে সাইকেল ভাড়া নিয়ে চালিয়ে আবার ফেরতও দিয়ে গেছে কিন্তু দেরির জন্য দোকানি কিছু বলেনি, আর বলবেই বা কেন, এতটুকু বাচ্চা, পাঁচ মিনিট বেশি চালিয়েছে তাতে এমন কি ক্ষতি হয়ে যাবে তার? সাইকেল ফেরত দিয়ে যাওয়ার পর লিজা নিখোজ। ঘটনাটা ১৫ জুলাই শনিবার। অনেক খোজাখুজির পর থানায় সাধারণ ডায়রী করা হলো। অবশেষে আট দিন পর মিললো তার নিথর দেহ। লিজার মৃত্যু অত্যন্ত বেদনা দায়ক, আমরা মর্মাহত এবং শোকাহত পরিবারের জন্য গভীর সমবেদনা প্রকাশ ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই।
লিজার লাশ আট দিন পরে নিজ বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে এক ফসলী জমিতে পাওয়া গেছে। ছোট্ট বাচ্চা, মৃত্যুকালে কতটাই না ছটফট করেছে! কতটাই না কান্নাকাটি করেছে মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য, বাবার কাছে যাওয়ার জন্য। স্বজনরা কত জায়গায়ই না খোজাখুজি করেছে! আট দিন পরে শাক তুলতে যাওয়া মানুষ দূর্গন্ধ পেয়ে এগিয়ে দেখে একটি লাশ। খবর পেয়ে লিজার পরিবার ছুটে এসেছে। তারাই সনাক্ত করেছে আর কেউ নয় এটাই তাদের আদরের ধন লিজা।
লাশ পাওয়ার পর যা হয়! সেই পোষ্ট মর্টেম, কাটাছেড়া। লিজাকে আনা হলো শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে। সেখানে দুজন ডাক্তার লিজার মরদেহর ময়না তদন্ত করলো। আট দিনের পচা গলা লাশের ময়না তদন্ত করা খুবই কঠিন। চিকিৎসক লাশের ভিতরে লিভার, হৃদযন্ত্র, কিডনি, জরায়ু কিছুই পেল না। এ পর্যন্ত সবই চলেছে প্রকৃতির নিয়মে। লিজার মৃত্যু যেমন একটি ঘৃন্য কাজ এর পরের কাজগুলো করলো কিছু হলুদ সাংবাদিক। সংবাদটাকে রং মেখে হলুদ থেকে লাল করে দিলো। শরীয়তপুরে কিছু চিহ্নিত সাংবাদিক আছে যারা খবর বানায়। তাদের বানানো খবরে মানুষ বিভ্রান্ত হয়, এতেই ঐ সাংবাদিকরা মজা পায়।
ঘটনাটা নিয়ে কিছু সাংবাদিক ইঙ্গিত করলো অঙ্গ পাচারকারীর আনাগোনার দিকে। তাদের নিউজে উঠে এলো লিজার যেসব অঙ্গ নেই সেগুলো পাচারকারী চক্রের কাজও হতে পারে। আর সেই ভীত তৈরী করার জন্য কৌশলে চিকিৎসকদের দিয়ে এমন কিছু বক্তব্য বের করলো যা টানলে রাবারের মত বলে। সেই সাংবাদিকরা একবারও বিবেচনায় আনলো না যে অঙ্গগুলো যদি কোন পাচারকারী চক্র নিয়ে থাকে সেগুলো কোন কাজে লাগবে কিনা? আর এটা সম্ভব কিনা তাও তারা জানে কিনা আমি তা নিশ্চিত নই। আমি নিজেও অঙ্গ প্রতিস্থাপনের বিষয়ে জানিনা। তবে এটুকু ধারনা আছে যে, অঙ্গ কোন আলু পটলের তরকারী না যে নিয়ে গেলে রেধে খাওয়া যাবে বা কোন বয়ামে ভরে নিয়ে গেলে খোলা বাজারে চড়া দামে বেচা যাবে। তাই বন্ধু ডাক্তার মাহবুবুল হকের সাথে যোগাযোগ করলাম বিষয়টা জানার জন্য। জানতে তো কোন দোষ নেই, তাই আমার অজ্ঞতার কথা খুলে বললাম। বন্ধু আমায় জানালো, এধরনের সংবাদ প্রচারকারীরা শুধু হলুদ সাংবাদিকই না তারা দালাল চক্রও বটে। বন্ধু আমায় কিছু তথ্য দিলো অঙ্গ প্রতিস্থাপনের বিষয়ে। পাঠকের জন্য তা তুলে ধরা হলো।
‘কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হলে ডোনারের কাছ থেকে কিডনি নিয়ে মাত্র ত্রিশ মিনিটের মধ্যে অপারেশন শুরু করতে হয়। অপারেশন করতে লাগে ৬ ঘন্টা। পৃথিবীতে ত্রিশ মিনিটের বেশি সময় দেহের বাহিরে কিডনী সংরক্ষনের কোন উপায় আবিষ্কৃতই হয়নি। এর বেশী সময় অতিবাহিত হলে রক্তের কোষ মারা যায়, সেই কিডনী প্রতিস্থাপন করলে রোগী মারা যাবে। কিডনী প্রতিস্থাপন করতে ১০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিতসক লাগে, লাগে দুটি অপারেশন থিয়েটার। দাতা গ্রহীতা দুইজন থাকেন পাশাপাশি অপারেশন থিয়েটারে। যার তার কাছ থেকে কিডনি নেয়াও যায়না। রক্তের গ্রুপ মিলতে হয়, এইচএলএ টাইপিং এর মত আধুনিক আরও পরীক্ষা, দাতা এবং গ্রহীতা উভয়ের একরকম হলে তবেই একজন আরেকজনকে কিডনি দিতে পারে। নাহলে গ্রহীতার মৃত্যু নিশ্চিত। কোনভাবেই যা সম্ভব নয়, তা কী করে সেটা ফলাও করে নিউজ আকারে প্রচারিত হয়। কিংবা কেন? উত্তর পাবেন ২০১১ সালে ফিরে গেলে। বাংলাদেশে সবে মাত্র কিডনি ও লিভার প্রতিস্থাপন শুরু হল। সম্ভাবনা তৈরী হল এদেশেই এসব চিকিতসা শুরুর। মাথা খারাপ হয়ে গেল, বিদেশী হাসপাতালের এদেশীয় দালালদের, বিশেষ করে পাশের একটি দেশের কতিপয় হাসপাতাল ব্যাবসায়ীদের। আর তখনি প্রথম শুরু হল গত কয়েকদিনের মত করে, কিডনি পাচার বিষয়ক সংবাদ। যার জন্য সরকার নিষিদ্ধ করে দিল এদেশে কিডনি প্রতিস্থাপন অপারেশন। হাস্যকর ব্যাপার। মানুষ আবার বিদেশ যেতে লাগল, ভারতে গেলে খরচ হয় ১০-১৫ লাখ টাকা, সিংগাপুর গেলে প্রায় দেড় কোটি। দালাল চক্র শান্ত হল। তাদের ভাগেও যে ২-৪ লাখ করে জুটে। তাদের দালালি করে কোটি কোটি টাকার আয় চলতে লাগল। কিন্তু, সরকার তার ভুল বুঝতে পেরে দেশে আবার কিডনি প্রতিস্থাপনের অনুমতি দিল। যা এখন বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে ১ থেকে ১.৫ লাখ টাকায় করা যায়। বারডেমে ২ লাখ ৭৫ হাজারে, কিডনি ফাউন্ডেশনে ২ লাখ ৩০ হাজারে, আর জাতীয় কিডনি ইন্সটিটিউট এ বিনামুল্যে। আবারও মাথা খারাপ হয়ে গেল দালাল চক্রের, শুরু হল ২০১১ এর মত করে অপপ্রচার। অজ্ঞ মানুষেরা সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করল। যেটা চিকিতসা বিজ্ঞানে অসম্ভব বলে বিবেচিত। যেটা হওয়া সম্ভব সেটা হল, কিডনি নেয়ার জন্য একজন মানুষকেই ভারতে বা অন্য কোন দেশে পাচার করে দেয়া, যার ব্লাড গ্রুপ, এইচএলএ টাইপিং সহ সব কিছু মিলতে হবে গ্রহীতার সাথে, এর সম্ভাবনা খুব কম, সাধারনত এসব কিছু পরিবারের লোকজনের সাথে মেলার সম্ভাবনা থাকে, তাও সব সময় মেলেনা। কিন্তু কিডনি চুরি কাঁচি দিয়ে কেটে পাঠিয়ে দেয়া, চিকিতসা বিজ্ঞানে ইহা অসম্ভব। অসম্ভব। অসম্ভব। এটা সম্ভব কেবল এদেশের মিডিয়া আর বিদেশি হাসপাতালের এ দেশীয় দালালদের অজ্ঞতা, মূর্খতা উদ্ভট কল্পনা আর ষড়যন্ত্রে।’
এই ষড়যন্ত্রের মূল হোতা এলাকার হলুদ সাংবাদিকরা নয়। এরাতো সেই সব দালালদের পাচাটা বাচ্চা দালাল। শরীয়তপুরে হলুদ সাংবাদিকতা আজ নতুন নয়। এর আগেও হয়েছে। আমাদের এলাকা মঙ্গা কবলিত এলাকার মত অভাবি এলাকা নয়। তারপরেও কিছু হলুদ সাংবাদিক একবার বন্যার সময় লিখেছিলো ‘শুধু শাপলা খেয়ে বেঁচে আছে নছিমন!!’। আবার আরেকটি মেয়ে হত্যাকান্ডকে দোররা মেরে হত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার ঘটনাও আমরা দেখেছি। আসলে এসব নির্লজ্জ হলুদ সাংবাদিকদের লজ্জার কিছু অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না। আট দিনের পচা শিশুর শরীরের অঙ্গ না পাওয়ার সাথে অঙ্গ পাচারের গল্প জুড়ে দিয়ে এলাকায় আতঙ্ক তৈরী করার অধিকার কি তাদের আছে? তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের ব্যবস্থা নেয়া উচিত। কিন্তু ব্যবস্থা নেবে কিভাবে? তারা যে হলুদ সাংবাদিক! তাদের ক্ষমতা যে অনেক, তারা যখন তখন, যার তার ইজ্জত লুটে নিতে পারে মিথ্যা, বানোয়াট সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে!!
অবশেষে পুলিশ প্রশাসন ঘটনার মুল হোতাকে খুজে পেয়েছে। লিজার চাচাই ঘটনার মূল হোতা। প্রথমে সাইকেল চালাতে টাকা দিয়ে পরে আরো পাঁচশো টাকা দিয়ে লিজাকে প্রলুব্ধ করেছে। পরে একটা বাড়িতে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা কালে লিজা বলে ফেলেছে যে, মাকে বাবাকে বলে দিবে। তাতেই ক্ষিপ্ত হয়ে গেছে লিজার চাচা। গলা টিপে হত্যা করে রাতে ভ্যানে করে লাশ কৃষি জমিতে ফেলে দিয়ে নারায়নগঞ্জ চলে গেছে। আট দিন পর লিজার গলিত লাশ উদ্ধার হয়েছে। আট দিনে লাশ পচে যেতে পারে, দ্রুত পচনের জন্য কোন কেমিক্যাল ব্যবহার করতে পারে এমনটাই ধারনা করছে তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ। কিন্তু আমাদের হলুদ সাংবাদিকরা দেখলো অঙ্গ পাচারকারীদের পদচারনা!! এসব সাংবাদিক নামধারী হলুদ সাংবাদিকদের জন্য শুধুই ঘৃনা আর ঘৃনা!


-----------------------------------------------------


অতীত ঐতিহ্যের কাশ-পিতল শিল্প ঃ আজ শিল্পীও নেই শিল্পও নেই

এক সময় শরীয়তপুর জেলার বিশেষ করে সদর উপজেলার পালং, বিলাশখান, বাঘিয়া, দাসার্তা গ্রামে প্রবেশ করলে মানুষ কান হাত দিয়ে দু’কান বন্ধ করে হাটতো। কাশ-পিতল কারিগরদের পিতল পাতের উপর অবিরাম হাতুরির বাড়িতে হওয়া টুং-টাং শব্দ কানে তালা লাগাতো অনেকের। 
এটা আমাদের কাছে এখন কেবলই স্মৃতি। কারন সেই অতীত ঐতিহ্যের কাশ-পিতল শিল্পীও নেই, নেই শিল্পও। নানা সমস্যার কারনে, নানা সমস্যার অযুহাতে, নানা অভিযোগে দেড়শ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ এলাকার পিতল শিল্প আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এক সময় পাঁচ শতাধিক পরিবারে দুই হাজারের উপরে কর্মী কাজ করলেও এখন সাত-আটটি পরিবারে বিশ-পচিশ জন শিল্পী এ শিল্প ধরে রেখেছে। এ শিল্পের প্রকৃত শিল্পী যারা তারা চলে গেছেন ওপার বাংলায়। এপারে যারা এই শিল্পকে আকরে ধরে আছেন তারা জাত শিল্পী না। জাত শিল্পীদের কাছে একসময় রুটি-রুজির জন্য কাজ করেছে বা শিল্পকে ভালবেসে কাজ শিখেছে তারাই ধরে রেখেছে শিল্পকে। 
একেবারে গোড়ার কথাঃ জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা করেন এমন ব্যক্তি ও শিল্পের সাথে জড়িতদের সাথে আলাপ করে জানাযায়, অষ্টাদশ শতাব্দির শেষ দিকে কাশ-পিতল শিল্পের সাথে জড়িত কংসবণিক সম্প্রদায় প্রথমে ভারতের উত্তর প্রদেশ থেকে পশ্চিম বঙ্গের হুগলির চন্দন নগর এসে বসতি গড়ে। সেখান থেকে একটা অংশ বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জের লৌহজং গ্রামে এসে বসতি গড়ে। পদ্মা নদীর ভাঙ্গনের ফলে লৌহজং থেকে কংসবণিক সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ অংশ শরীয়তপুরের দাসার্তা, বাঘিয়া, পালং, বিলাশখান গ্রামে এসে বসতি গড়ে কারখানা স্থাপন করে। শরীয়তপুর সদরে তথা পালং ছাড়াও জেলার অন্যান্য উপজেলাতে বসতি গড়লেও সংখ্যায় তা কম। তবে পালং বাজারটাই ব্যবসার প্রধান কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠে। 
শিল্পের প্রসারঃ বাঘিয়া, দাসার্তা, বিলাশখান ও পালং গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে কারখানা গড়ে উঠলেও পালং বাজার প্রধান ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তৎকালীন সময়ে কাশ-পিতলের ধাতব মূল্য ও সৌন্দর্যের কারনে এ শিল্পের এতটাই প্রসার লাভ করে যে, বাংলাদেশের মধ্যে পালং হয়ে ওঠে কাশ পিতল শিল্পের প্রধান উৎপাদন ও ব্যবসা কেন্দ্র। এখান থেকে দেশের প্রধান বিভাগীয় শহর এবং বিভাগীয় শহর থেকে বিদেশে রপ্তানি হওয়া শুরু হয়। এই শিল্পের প্রসার প্রথমে হিন্দুদের হাতে শুরু হয়। পরবর্তীতে মুসলমানরাও জড়িয়ে পরে এ শিল্পের সাথে। 
পেশার সাথে যুক্ত পরিবারের অতীত ও বর্তমান সংখ্যাঃ গত বিশ-ত্রিশ বছর পূর্বেও এ শিল্পের সাথে চার শতাধিক পরিবার জড়িত ছিল। এখানে কাশ-পিতল শিল্পের প্রায় দুই থেকে তিন শতাধিক কারখানা গড়ে উঠেছিল। পর্যায়ক্রমে মুসলমানরা এ শিল্পে শ্রম দিতে দিতে কারিগর হয়ে ওঠে। নানাবিধ কারনে শিল্পের সাথে জড়িত হিন্দুরা ভারতের পশ্চিম বঙ্গে চলে যেতে থাকলে মুসলমান কারিগররা আস্তে আস্তে কারখানা স্থাপন করে শিল্পটা ধরে রাখে। বর্তমানে জেলায় সাত-আটটি পরিবার এ শিল্পকে ধরে রেখেছে। এক সময় শুধু পালং বাজারেই ত্রিশ থেকে চল্লিশটি কাশ-পিতল সামগ্রী বিক্রির দোকান থাকলেও এখন মাত্র চারটি দোকান আছে।
শিল্প সামগ্রীঃ একসময় এ জেলায় মালা, কলসি, জগ, বালতি, বদনা, চামচ, পানদান, ডাবর, পানি খাবার গ্লাস-মগ, ধান-চাল পরিমাপের পুড়, কুপি, বিভিন্ন প্রকার প্রদীপ, পাতিল, ঘন্টি, বিন্দাবনী, চারা, কড়াই, ধুপদানী, ছোট ঘটি (পুঁজার জন্য), মালসা, কোসা-কুসি, পুস্প পত্র, করাতথাল, বাস বেড়া, বগি থাল, পঞ্চপত্র সহ নিত্যব্যবহার্য ও নানান দর্শনীয় সামগ্রী তৈরী করা হতো। 
ওপারে (পশ্চিম বঙ্গে) চলে যাওয়ার কারনঃ নানা সময়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তণের কারনে বিনিয়োগের ও জীবনের নিরাপত্তাহীনতা, চাঁদাবাজি, সহজলভ্য সামগ্রী হাতে পেয়ে মানুষ পিতলের সামগ্রী ব্যবহার না করার কারনে এ শিল্পের সাথে জড়িত হিন্দুরা দেশ ছাড়তে থাকে। কাশ-পিতল শিল্পীরা সাধারণত অন্য কাজ করতে না পারায় পশ্চিম বঙ্গে এ শিল্পের চর্চা কিছুটা অব্যাহত থাকায় হিন্দুরা চলে যায়। আবার অনেকের মতে হিন্দুরা বাংলাদেশকে নিজের মত করে ভাবতে পারে না তাই তারা সর্বদা ওপার যাওয়ার চিন্তায় বিভোর থাকে। পশ্চিমবঙ্গে আপনজন থাকায় মনের টানে চলে যায় অনেকে। অনেকের মতে সংকট আছে থাকবেই। মুসলিম পরিবার গুলো তাদের পেশার সংকটের কারনে কি অন্যত্র চলে যাবে? সংকটের সাথে লড়াই করেই টিকে থাকতে হয়, টিকে থাকতে হবে। তাই শিল্প ধ্বংসের পিছনে শুধু সংকট, সন্ত্রাস, নিরাপত্তাহীনতা, বাজার মূল্য, সামাজিক প্রেক্ষাপটকে দায়ী করলে ঠিক হবে না।    
শিল্প বিলুপ্তর কারণঃ পালং বাজারের কাশ-পিতল ব্যবসায়ীরা জানান, একসময় কাশ-পিতল সামগ্রী তৈরীর কাঁচামাল ‘পাত’ কেজি ছিল একসময় আশি টাকা। আর এখন প্রতি কেজি পাতের দাম তিনশত টাকা। এতেই অনুমান করা যায় কাঁচামালের মূল্য কি হারে বেড়েছে। বাজারে প্লাস্টিক, সিরামিক, মেলামাইন, সিলভার, এমনকি লেহার তৈরী পারিবারিক কাজে ব্যবহৃত সামগ্রীর সহজ লভ্যতা, কম মূল্যর কারনে এবং কাশ-পিতলে তৈরী সামগ্রীর অধিক মূল্যের কারনে মানুষ কাশ-পিতল সামগ্রী ব্যবহারে অনিহা দেখায়। ফলে শিল্পীরা তাদের উৎপাদনের উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। কাশ-পিতলের ধাতব মূল্য, স্থায়ীত্ব বিবেচনা না করেই সহজলভ্য সামগ্রী ব্যবহারের কারনে এ শিল্প বিলুপ্তপ্রায়। তাছাড়া কাশ-পিতলের তৈরী সামগ্রীর চেয়ে সিলভার, প্লাস্টিক, সিরামিক, মেলামাইন, লোহার সামগ্রী দেখতে অনেক দৃষ্টিনন্দন। 
চাহিদাঃ এক সময় মানুষ আচার-অনুষ্ঠানে উপহার দিতে বা পারিবারিক কাজে ব্যবহার করতে প্রধান ও প্রথম পছন্দের তালিকায় ছিল কাশ-পিতল সামগ্রী। কাশ-পিতল সামগ্রী ছিল আভিজাত্যের প্রকাশও। বর্তমানে মেলামাইন গিফট বক্স জাতীয় জিনিসের ছড়াছরি ও সহজলভ্যতার কারনে মানুষ কাশ-পিতল সামগ্রী উপহার তালিকা থেকে বাদ দেয়। তাছাড়া এখন উপহারের তালিকায় নগদ টাকার প্রচলন বেড়ে যাওয়ায় এর কদর কমেছে। এখন একান্ত ব্যবহার্য কিছু সামগ্রী যেমন, বিন্দাবনী, বালতি, কলস, পানদান ছাড়া আর কোন সামগ্রীর চাহিদা নেই। 
বর্তমান পরিস্থিতিঃ বর্তমানে সাত-আটটি পরিবার এ শিল্পকে কোনমতে বাঁচিয়ে রেখেছে। সাত-আটটি পরিবারের মধ্যে হিন্দু পরিবারের সংখ্যা নেই বললেই চলে। পূর্বে যারা এ শিল্পে শ্রম দিতেন তারাই মূলত এ শিল্পকে ধরে রেখেছে। নতুন প্রজন্মের কেউ এই শিল্পে শ্রম দেয় না। ফলে এই সাত-আটটি পরিবার বিলুপ্ত হলে বা পেশা ছেড়ে দিলে নতুন প্রজন্ম এই শিল্পের হাল ধরবে না বলেই পর্যবেক মহলের এবং শিল্পের সাথে জড়িত ব্যবসায়ীদের ধারনা। 
মুসলমান শিল্পীদের আবির্ভাবঃ একটা সময়ে পাঁচশতাধিক পরিবার এ শিল্পের সাথে জড়িত ছিল। প্রচন্ড চাহিদার কারনে শ্রমিক সংকট মেটাতে কংসবণিক সম্প্রদায় স্থানীয় মুসলমান শ্রমিকদের এ কাজে নিয়োগ দেয়। কালক্রমে এখান থেকে হিন্দু ব্যবসায়ীরা চলে যাওয়ায় এখন মুসলমানরা যে চহিদা আছে তা মেটানোর চেষ্টা করছে। এ শিল্প ধরে রাখার কারণ হিসেবে জানা যায়, মুসলমান শিল্পীরা এ কাজ শিখার কারনে অন্য কাজ পারে না। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা পশ্চিম বঙ্গে চাহিদা থাকায় এবং সেখানে অধিকাংশের আত্মীয় পরিজন থাকায় চলে গেলেও মুসলমানরা যাবে কোথায়। তাই তারা এখানে এই পেশাকে ধরে রেখেছে। 
শিল্পীদের কথাঃ দাসার্তার শিবের বাড়ি চেনেন না এমন লোক শরীয়তপুরে খুব কমই পাওয়া যাবে। ঐ শিবের বাড়ি এক সময় দশটি পরিবার এ কাজের সাথে জড়িত ছিল। বর্তমানে একটি মাত্র পরিবার কাজ করে বাকি সবাই পশ্চিম বঙ্গে চলে গেছে। রঞ্জীত কুমার কংসবণিক, সিদাম কংসবণিক, বাসুদেব কংসবণিক ও স্যামসুন্দর কংসবণিক এ চার ভাই এখনও এ শিল্পকে ধরে রেখে এদেশে পরে আছে। রঞ্জিত কুমার কংসবণিক বলেন, ভোর রাত থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আমাদের বাড়িতে কাজ হতো। হাতুরি-পিতলের এতই সম্পর্ক ছিল যে টুং-টাং শব্দ সাধারণ মানুষের কাছে কানে তালা লাগার মত মনে হলেও আমাদের কাছে এটা গানের মতো। এখন আর এ শব্দ শোনা যায় না। আবুল কাশেম বেপারী বলেন, ছোট বেলায় এ শিল্পের চাহিদা এতই বেশি ছিল যে বাবা অন্য কাজে না দিয়ে কাশ-পিতলের কাজে দিলেন। এ কাজ শিখেছি, এখনতো আর অন্য কাজ পারি না। তাই ধরে রেখেছি। বর্তমান অবস্থা এতটাই খারাপ যে, আগে এখানকার আফিদ ট্রেড ইন্টারন্যাশনালে প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে তিন টন কাঁচামাল বিক্রি হতো আর এখন এক টন কাঁচামাল এক মাসেও শেষ হয় না। এতেই বোঝেন অবস্থাটা কি। 
শিল্পীদের দাবীঃ বর্তমান পিতল শিল্পের সাথে জড়িত শিল্পীরা দাবি করেন এ শিল্পের বিকাশের জন্য তাদের সহজ শর্তে ঋণ ও বাজারজাতকরণের পরামর্শ প্রদান করা দরকার। তাছাড়া সাধারণ মানুষের প্রতি তাদের দাবি ‘পিতল এমন একটি দ্রব্য এটা পুরাতন হলেও এর মূল্য খুব একটা কমে না। তাই পিতল ব্যবহার করার প্রতি মানুষকে উদ্ভুদ্ধ করতে হবে। পিতল স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশ বান্ধব। 
কাঁচামাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কথাঃ জেলার পিতল শিল্পের কাঁচামাল প্রকৃয়াজাত প্রতিষ্ঠানের পথিকৃত শরীয়তপুর ব্রাস ইন্ডাষ্ট্রি এর প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ্ব নুর মোহাম্মদ কোতোয়াল। বর্তমানে উৎপাদন ও সরবরাহকারী মেসার্স আফিদ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ সাদিকুর রহমান কোতোয়াল লিটন বলেন, কাঁচামালের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি, কাঁচামাল ভারতে পাচার হয়ে যাওয়া এবং শিল্পীরা ভারতে চলে যাওয়ায় মিলটি বন্ধপ্রায়। ১৯৮৭ সালেও এখানে কাঁচামালের চাহিদা এত বেশি ছিল যে এখানে কারখানা স্থাপন করতে আমার বাবা আগ্রহী হয়েছিলো। মাত্র পনের-ষোল বছরের ব্যবধানে দেখা গেল চাহিদা শুনের কোঠায়। শিল্প ও শিল্পী উভয়ই বিলুপ্তপ্রায়। 
বিসিকের ভাষ্যঃ বিসিক শিল্প নগরী শরীয়তপুর এর এক সম্প্রসারণ কর্মকর্তার সাথে কথা বললে তিনি জানান, দশ বছর আগে যখন এখানে একবার এসেছিলাম তখন টুংটাং শন্দে মুগ্ধ হয়েছিলাম। কুটির শিল্প হিসেবে (যেহেতু হাতের কাজ) উদ্যোক্তারা আমাদের কাছে আসলে তাদের ঋণদান, উৎপাদন, বাজারজাত, পরামর্শসহ তাদের জন্য কিছু করার সুযোগ ছিল। কিন্তু কেউই আমাদের কাছে আসে না। 
গবেষকের কথাঃ শরীয়তপুর জেলার ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে গবেষনা করেন এমনই একজন বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক অধ্যাপক এম এ আজিজ মিয়া। তিঁনি বলেন, কাশ পিতল শিল্পীরা নানান কারনে ধাপে ধাপে এদেশ ত্যাগ করেছে। শুধু জেলারই নয়, এই দেশের অন্যতম কাশ-পিতল শিল্পের উৎপাদন হতো এখানে। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক কারনে পর্যায়ক্রমে তারা দেশ ছাড়ে। পিতলের স্থায়ীত্ব অনেক বেশি, সংরক্ষণের সুবিধা, পুরাতন হলেও এর দাম কমে না এবং পরিবেশ বান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত। এসব দিক বিবেচনা করে আমাদের উচিত কাশ পিতলের সামগ্রী ব্যবহার করা।



-----------------------------------------------------


পাগল নিয়ে পাগলামী

অনেক দিন আগে একটা কথা শুনেছিলাম। শুদ্ধ ভাবে হয়তো বলতে পারবো না। তবে যতটুকু মনে পড়ে তা হলো এমন- ‘পাগল পাগল পাগলরে ভাই, পাগল সারা দেশটায়, পাগল ছাড়া ভালো মানুষ পাবে নাকো চেষ্টায়।’ অনেক দিন পরে হলেও আমার মনে হচ্ছে কথাটা সত্যিই ছিলো। আমরা কোন না কোন কারনে কোন না কোন বয়সে পাগল ছিলাম, পাগল আছি, পাগল হবো।
তবে কিছু পাগল আছে তাদের পাগলামির সাথে আমার এ লেখার কোন সম্পর্ক নাই। যারা মানসিক ভারসাম্যহীন তারাতো সত্যিকারের পাগল। তাদের জন্য আমার সমবেদনা আছে। মহান সৃষ্টিকর্তা তাদের মানুষ করে পৃথিবীতে পাঠিয়েও কেন মানসিক ভারসাম্যতা কেড়ে নিয়েছেন তা তিঁনি নিজেই ভালো জানেন। তবে আমার মনে হয়েছে মানুষ একেক বয়সে একেক রকম পাগল। এই পাগল মানেই মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ নয়। সম্পূর্ণ রক্ত মাংসের মানুষ হয়ে, মানসিক ভারসাম্য থাকা স্বত্বেও যে ধরনের পাগলামি করে আমি সেসব পাগলের পাগলামির নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।
ছোট শিশু। কিছুই বুঝে না। কোলে-বিছানায় মল মুত্র ত্যগ করে, বলতেও পারে না। খিদে লাগলেও বলতে পারে না। তবে কিছু না বুঝলেও খিদের জ্বালা বোঝে। কিছু বলতে না পারলেও খিদের কথা বলতে পারে তার নিজস্ব প্রকাশ ভঙ্গি দিয়ে। যখনই একটা শিশুর খিদে পায় তখনই সে কেদে উঠে। শিশুটি বুঝে না কানলে মায়ও দুধ দেয় না তাই খুধা অনুভব করলেই কান্না শুরু করে। কান্না তখনই থামে যখন তার মুখে খাবার তুলে দেয়। শিশুর খাবার হলো দুধ। তাই মুখে দুধ দিলেই সে শান্ত হয়ে যায়। আসলে সে দুধের পাগল। 
দুধের পাগল সন্তানটা যখন একটু বড় হয় তখন তাকে নিয়ে বাবা মায়ের কত চিন্তা। পড়াশুনা করাতে হবে, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানাতে হবে, বড় হয়ে জজ, ব্যরিষ্টার হতে হবে। কোন পিতা-মাতা অবশ্য ছোট থাকতে কখনো ভাবে না আমার সন্তান বড় হয়ে রাজনীতিবিদ হবে! তাই কোথায় ভর্তি করা যায়, কাকে টিউটর রাখলে রেজাল্ট ভালো হবে এ নিয়ে অভিভাবকের চিন্তার শেষ নাই। অবশেষে তাকে ভর্তি করা হলো স্কুলে। এতদিন ভালোই কেটেছিলো জীবন। খাওয়া দাওয়া, খেলাধুলা, দুষ্টমি করেই সময় চলে গেছে। ক্লান্ত হয়ে পড়লেই ঘুম। এক স্বর্গীয় জীবন শিশুকাল, যদিও শিশুরা সেটা বোঝে না, বড় হওয়ার পর যেমনটা আমরা বুঝতে পারছি। শিশুটির পড়াশুনা শুরু করার পরই হলো বিপত্তি। একগাদা বইপত্রের পাহাড় পিঠে বয়ে নিয়ে স্কুলে যাওয়া, ক্লাস শেষে বাসায় এসে টিউটরের কাছে পড়া, সুযোগ পেলে একটু খেলা। এর পরে সন্ধা হলেই পিতা-মাতার হাকডাক পড়তে বসো! পড়তে বসলেই ঘুম আসে। হয়ে গেলো ঘুমের পাগল। 
শিক্ষা জীবন শেষ হলো। এবার কিছু করতে হবে। প্রবল ইচ্ছা স্বত্বেও পছন্দের কোন কাজ করতে পারছে না। শিক্ষার জোর নেই, উদ্ভাবনী চিন্তা নেই সে কথা বলে না! তাই বলে বেড়ায়, মামুর জোর নেই, টাকার জোর নেই ইত্যাদি। মাথায় সবসময় চিন্তা কিছু একটা করতে হবে, কিছু একটা করতে হবে। যোগ্যতার ফাইলপত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ায় কাজের সন্ধানে। এখন সে কাজের পাগল।
যেভাবেই হোক কাজ একটা জুটে গেছে। গদবাধা জীবণ এখন। চাকুরী হলে ঘড়ি ধরা সময়ের বাইরে যেতে পারবে না। শ্রম দিলে, নিয়োগ কর্তার কড়া নজরদারী। নির্দিষ্ট কাজটা শেষ করতেই হবে। এখন আর কাজ ভালো লাগে না। মন চায় একটু ঘুরে বেরাতে, একটু এদিক ওদিক উকি ঝুকি দিতে। কিন্তু সে সুযোগ কই? এখন সে ফাঁকির পাগল। কখন কাজে ফাঁকি দেয়া যায়, কখন মুক্ত হওয়া যায় সেই আশায় তীর্থের কাকের মত তাকিয়ে থাকে, সুযোগ খোজে। অবশেষে সে এখন কাজ ফাকির পাগল।
জীবনে বেঁচে থাকার নিয়ামক হলো খাবার। আমরা এক বেলা, দু’বেলা না খেয়ে থাকতে পারি। কখনো কখনো তিন বেলাও খাওয়া হয় না। খুব বীরত্ব দেখাই যে, না খেয়ে ছিলাম। কিন্তু এর চেয়ে বেশি অভুক্ত থাকলে জীবণ যায় যায়। একজন অভুক্ত মানুষ তখন খাবার পাগল হয়ে যায়। তাই মানুষ কখনো কখনো খাবার পাগল। খুধার জ্বালায় তখন মানুষ কি না করে? যা পায় তাই খায়।  
জীবন জীবিকার সাথে আছে টাকার সম্পর্ক। মানুষ তার প্রয়োজন মিটাতে কোন না কোন ভাবে টাকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। টাকা ছাড়া জীবন চলে না। কথায় বলে, মহিলাদের বল তার স্বামী আর পুরুষের স্বামী টাকা। প্রতিটা মানুষ স্বপ্ন দেখে তার অনেক টাকা থাকবে। যার শত টাকা আছে সে ভাবে কবে হাজার টাকা হবে, যার হাজার টাকা আছে সে ভাবে কবে লাখ টাকা হবে আর যার লাখ টাকা আছে সে ভাবে কবে কোটি টাকা হবে। আর কোটি পতির কথা বলে লাভ নেই। সেও ভাবে, কবে কোটি কোটি টাকা হবে। যে করেই হোক টাকা রোজগার করতে হবে। আর এ চিন্তা থেকে মানুষ যে কোন পথ মাড়াতে পারে। বৈধ-অবৈধ সকল পথই বেছে নেয়। সাদা হোক আর কালো হোক টাকাটাই চায়। এক পর্যায়ে মানুষ টাকার পাগলও হয়ে যায়। তবে অর্থ অনর্থের মূল কথাটা মনে রাখতে হবে। কিন্তু টাকার পাগল সে কথাটা বেমালুম ভুলে যায়। 
শ্রমে-ঘামে, সুপথে-কুপথে টাকাতো অনেক হলো। টাকা যে মানুষকে শান্তি দিতে পারে না সেটাও বুঝা গেল। এখন একটু হাত খুলে খরচ করতে মন চায়। দান খয়রাত দিয়ে, মানুষের পিছনে খরচ করে একটু যদি নাম ফুটানো যায়! টাকা খরচ করে অনেকে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে। কেউ কেউ টাকা দিয়ে লেখক ভাড়া করে লিখিয়ে নিজের নামে তা ছেপে নাম ফুটায়। আবার কেউ কেউ টাকা খরচ করে দানবীর হিসাবে পরিচিতি পেতে ব্যস্ত থাকে। আসলে টাকাওয়ালা এবার নামের পাগল হয়ে যায়। যেভাবেই হোক টাকার বিনিময়ে নাম কামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।  
নানান ধরনের মানুষ আছে আমাদের এই সমাজে। কেউ টাকার পাগল, কেউ কাজের পাগল, কেউ খাবার পাগল। এছাড়া কেউ কেউ আছে ভাবের পাগল। তার নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে ধারনা থাকুক বা না থাকুক তবুও ভাব নেয়। পকেটে ফুটো কড়ি নেই তবুও ভাব নেয় সে ধনি মানুষ। মাথায় জ্ঞান নেই, ভাব নেয় সে খুব জ্ঞানী পন্ডিত। ছ্যাবলা-বাচাল ব্যক্তি কিন্তু ভাব নিবে সে খুব ব্যক্তিত্ববান মানুষ। এগুলো আসলে ভাবের পাগল। তবে সত্যিকারের ভাবের পাগল আবার অন্য জিনিষ। যেমন কেউ লালন ভক্ত, সে লালনের ভাব শিষ্য। সে লালনের ভাবের পাগল। এধরনের ভাবের পাগলের বিষয়ে আমার শ্রদ্ধা-ভক্তি আছে। তাদের বিষয়ে আমার কোন বিদ্বেষ নাই। 
জন্মের পর বাবা মা চায়নি কিন্তু জীবনের বাকে এসে ইচ্ছে হয় নেতা-নেত্রী হবো। অমনি নাম লিখিয়ে ফেলি রাজনীতির খাতায়। কেউ কেউ নৈতিক দাবী আদায়ের লক্ষে কথা বলতে বলতে রাজীতিতে নিজের অবস্থান করে নেয়, তাদের বিষয়ে আমার কথা নেই। তবে অনেকে টাকার জোরে বা বাহুর জোরে নেতা হয়, কেউবা উপরওয়ালার পা চেটে চেটে নেতা হয়ে যান। তবে যেভাবেই হন না কেন রাজীতিকদের একটাই চাহিদা থাকে তাহলো গদির চাহিদা। যে করেই হোক, পদ-পজিশন ধরতে হবে, আর বড় নেতা নেত্রীদের গদির দিকে। তাই নেতা নেত্রীরা গদির পাগল হয়ে থাকেন। 
শিক্ষা জীবন হোক আর সাধারণ জীবন একটা সময় মানুষ প্রেমিক হয়। কেউ বইয়ের প্রেমিক, কেউ সিনেমার প্রেমিক, আবার ঘরের বউ টিভির প্রেমিক। প্রেমিক পুরুষ প্রেমিকার জন্য পাগল, প্রেমিকা প্রেমিক পুরুষের জন্য পাগল। কেউ প্রেমের জন্য এতটাই পাগল হয় শেষ পর্যন্ত টিকতে না পারলে বলে, একসাথে বাঁচতে যদি না পারি, চলো একসাথে মরতে তো পারবো! আবার যাদের মরার সাহসও নেই তারা চুল, দাড়ি রেখে দেবদাস হয়ে যায়, তাদের আমরা প্রেমের পাগলও বলি। অনেক ভালো ভালো বিষয় আছে যার প্রতি আসক্তির কারনে ঐ বিষয়ে পাগল বললেও সেসব পাগল মন্দ নয়। 
পুত্র শুয়ে আছে পাশের রুমে। মাঝ রাতে ঠুক ঠাক শব্দে পিতা মাতার ঘুম ভেঙ্গে যায়। পিতা মাতা গিয়ে দেখে পোলা খাট কুপিয়ে কাটছে। জিজ্ঞেস করে, কিরে খাট কাটিস কেন? ছেলে উত্তর দেয়, এত বড় খাট লাগে নাকি। তাই কেটে ফেলছি। পিতা মাতার বুঝতে বাকি থাকে না ছেলেকে বিয়ে করাতে হবে। যুয়ান পোলা বিয়ার পাগল! মেয়েরাও কম যায় না। তবে নারীর প্রতি সম্মান দেখিয়ে তাদের বিষয়ে কিছু বললাম না। 
দেখতে কুৎসিত। গায়ের রং কালো। তবুও চেষ্টার কমতি নেই। বোটানিক এ্যারোমা থেকে শুরু করে ফেয়ার এন্ড লাভলী পর্যন্ত কি না ব্যবহার করেছে? কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। সৃষ্টিকর্তা যে রুপ লাবন্য দিয়ে পাঠিয়েছেন ঘষে মেজে তার চেয়ে ভালো হওয়া কখনেই সম্ভব হয় না জেনেও চেষ্টার ত্রুটি রাখে না। তারা আসলে রুপের পাগল। বাহ্যিক রুপটাকে প্রাধান্য দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যায়। রুপের পাগল ছেলেদের থেকে মেয়েরা একটু বেশিই হয়ে থাকে।  
অনেকের অনেক রকম নেশা আছে। কারো বই পড়ার নেশা, কারো স্কুল পালানো নেশা, কারো কাজের নেশা, কারো ঘুমের নেশা, কারো রাত জাগার নেশা, কারো মদের নেশা, কারো গাজার নেশা, কারো টাকার নেশা, কারো চুরির নেশা, কারো লুচ্চামির নেশা। তবে এখন নতুন এক নেশায় আসক্ত আমরা সেটা হলো ফেসবুকের নেশা, মোবাইলের নেশা। গাজাখোরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে গাজার নেশা ধরে, তখন সে পগলের মত হয়ে যায়। নেশার জন্য চুরি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধ করে অবলীলায়। মদখোর মদের জন্য পাগল। সময় হলেই পাগলামী শুরু করে দেয়। 
কেউ কেউ আছেন সংসারের পাগল। সবসময় সে তার সংসার নিয়ে ভাবেন। সংসার ছাড়া কিছু বোঝেন না। পরিবারের সবাইকে খুশি রাখতে তাদের প্রাণপণ চেষ্টা। তবে সংসারের পাগল ভালো পাগলই বলতে হয়। এই পাগলামিতে কারো কোন ক্ষতি হয় না। একজন সংসার পাগল মানুষ পরিবারের সবাইকে আষ্টেপিষ্টে রাখতে পারেন। 
অনেকেই আছে গান পছন্দ করে। গান শুনতে দূর দূরান্তে চলে যায়। আমাদের দেশে শীতের দিনে পালা গানের আসর বসে। সারা রাত গান চলে। শীতের দিনেই এই আয়োজনটা বেশি হয়। বিভিন্ন তরিকার পীর ফকির আছে যাদের আখড়ায় বাৎসরিক উরস উপলক্ষে গানের আসর বসায়। গ্রামের মাঠে প্রচন্ড শীত সহ্য করে গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে আউশ ধানের নারার উপর বসে রাত ভর গান শোনে। কোথাও গানের আয়োজন হয়েছে শুনলেই পাগলের মত ছুটে যায় গান শুনতে। এমন পাগলকে আমরা গানের পাগলই বলেথাকি। 
কেউ কেউ আছে নাচের পাগল। অবশ্য অনেকে নাচের চেয়ে নাচাতে ভালোবাসে। আবার কেউ কেউ নাচতে ভালোবাসে। নাচাতে বা নাচতে যাই করুক না কেন তাদের নাচের পাগল বলা চলে। 
একটু সময় পেলেই অনেকে বেড়িয়ে পড়ে। দেশে কিংবা বিদেশে সুযোগ পেলেই ঘুরতে চলে যায়। বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে বার বার ঘুরতে যায়। এমন ভ্রমন পিপাসুদের ভ্রমন পাগল বলা যেতে পারে। 
অনেকে ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়ি চালাতে পারে। বিরামহীন ভাবে গাড়ি চালানোর পরেও কোন ক্লান্তি আসে না। গাড়ির আরোহীরা ক্লান্ত হয় কিন্তু চালক পাগল হয় না। এমন পাগলও আছে নেহায়েত কম নয়। 
ধর্ম নিয়ে বরাবারি না করাই ভালো। তবে অনেকেই আছে পীর মুরশিদের পাগল। এমন পাগলের সংখ্যা আমাদের দেশে বেশি দেখা যায়। নানান নামে চতুর কিছু লোকজন আখড়া খুলে বসে। ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষগুলো তাদের টার্গেট। কিছু নীতিকথা শুনিয়ে এমন ভাবে মগজ ধোলাই করে যে বাবা মাকে ভাত দেয় না কিন্তু বছরের বিশেষ দিনে পীরের বাড়ি চলে যায়। বাড়িতে বিবি বাচ্চাদের বছরে একদিন ভালো ভাবে গোস্ত খাওয়াতে পারে না। কিন্তু পীর বাবার জন্য টাকা জমিয়ে গরু কিনে নিয়ে যায় গাড়ি ভরে। বাবারাও কম চতুর না! আমি এমন এক পীর বাবাকে চিনি যে কিনা ওড়সের তিন দিন আমিষ খায় না। গরু, ছাড়ল, হাস, মোড়গ রাখার জন্য বাবার আলাদা আলাদা খোয়ার আছে। সেই খোয়ারে প্রচুর পশু জমা পড়েছে। কিন্তু ওড়সের তিন দিন পশু জবাই করে না। জানতে চাইলে বাবা বলেন, তিন দিন আমরা নিরামিষ খাই। পরে চিন্তা করে দেখলাম, তিন দিন নিরামিষ খাওয়ার কারন কি। আসলে গরীব মুরিদরা পশু আনতে পারে না। তারা আনে নিজের খেতের ফসল, গাছের লাউ, কুমড়া, মুলা, গাজর, আলু, পিয়েচ। এগুলো হলো পচনশীল দ্রব্য। বেশি দিন রাখা যাবে না। তাই বুদ্ধি করে পচনশীল পন্যগুলো তিন দিনের ওড়সে চালিয়ে দেন। ওড়স মাহফিল শেষে পশুগুলো বিক্রি করে ঢাকায় চলে যায় আরাম আয়েশ করতে। 
অনেকে আছে স্মৃতির পাগল। তারা পুরাতন জিনিসপত্র ফেলতে চায় না। তাদের মায়া মমতা বেশি। সব কিছুই আকড়ে ধরে রাখতে পছন্দ করে। তারা স্মৃতির পাগল। এধরনের পাগলা খারাপ না। 
অনেকে আছে খেলাধুলার পাগল। আমি অবশ্য অন্য খেলার কথা বলছি না। জুয়া খেলার কথাই বলছি। জুয়া যারা খেলে তারা সর্বস্ব বাজি রেখে খেলতে পারে। শত চেষ্টায়ও জুয়ার পাগল ভালো করা যায় না। আজ পুলিশে ধরবে, ছাড়া পেয়ে কালই বসে পড়বে। সহায় সম্পদ বিক্রি করে হলেও জুয়া খেলবে এই পাগল। পয়সা না থাকলে জুয়ার কোটে আরেক জুয়ারীর পাশে বসব, পরামর্শ দিবে, তবুও বসতে হবে। এক মা তার ছেলেকে বললো বাবা জুয়া খেলা ভালো না, আজ জিতলে কাল হারতে হয়। ছেলে বললো, মা, আমি তাহলে একদিন পর পর খেলবো! তবে আসল জুয়ার পাগলরা প্রতিদিনই বসতে পছন্দ করে। 
অনেকে আছে খেলাধুলার পাগল। ছাত্র জীবনে সকাল বিকাল নেই। সবসময়ই খেলার মাঠে থাকতে পছন্দ করে। খাওয়া নেই, নাওয়া নেই খেলা আর খেলা। পত্রিকা পড়লে খেলার পাতা, টিভি দেখলে খেলার চ্যানেল। গায়ে দিবে পছন্দের খেলোয়ারের জার্সি। খেলতে খেলতে অনেকেই ভালো খেলোয়ার হয়ে যায়। আবার পড়া রেখে খেলতে খেলতে ভালো খেলোয়ার না হতে পেরে জীবনের বাকে হারিয়েও যায়। 
কেউ কেউ আছে বউয়ের পাগল। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা অটুট থাক এটা আমরা সবাই চাই। কিন্তু কেউ কেউ আছে বউয়ের প্রতি এতটাই আসক্ত যে পিতা-মাতা-ভাই-বোন, সংসারের সবাইকে ফেলে বউয়ের কথায় উঠে, বসে। বউ দিন বললে দিন, রাত বললে রাত। নিজের উপর নিজের কোন নিয়ন্ত্রন থাকে না। আমাদের দেশে বউ গাগলার অভাব নেই।   
কেউ চুল বড় রাখতে পছন্দ করে, কেউ দাড়ি বড় রাখতে পছন্দ করে। অনেকে ধর্মীয় কারনে চুল দাড়ি বড় রাখে তাদের বিষয়টা আলাদা। কেউ নখ বড় রাখে। এটা মেয়েদের ক্ষেত্রেই বেশি ঘটে। জুল দাড়ি না কেটে, নখ বড় রেখে অনেক ভালো মানুষ, সুস্থ্য মস্তিস্কের মানুষ পাগল পাগল ভাব নেয়। 
পুরান পাগলে ভাত পায় না নতুন পাগলের আমদানী। কথাটা আমরা মাঝে মাঝেই বলে থাকি। সমাজে অনেক পাগল আছে যাদের আমরা পুরান পাগল হিসেবেই চিহ্নিত করি। যখন নতুন কোন বিষয়ের নতুন কোন পাগলের আবির্ভাব হয় তখনই বলে উঠি পুরান পাগল ভাত পায় না নতুন পাগলের আমদানী। 
তবে সত্যিকারের পাগল হিসাবে আমরা যাদের চিহ্নিত করি তারা হলো মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ। কোন কোন মানুষের মুদ্রদোষ কিংবা ছোটখাট পাগলামি থাকে। কোন কোন মানুষের চরিত্রের ব্যক্তিত্বে এমন কোনো ঘাটতি বা খুঁত ছিল, যার কারণে মানুষজন তাকে সিরিয়াসলি নেয় না। তখন ‘পাগলে কি না বলে, ছাগলে কি না খায়’ বলে তার কথা উড়িয়ে দেওয়া হয়। ভবে মানসিক ভারসাম্যহীন পাগলের মধ্যে নানান রকম পাগল আছে। কেউ হার্মলেস পাগল, কেউ উদ্দাম পাগল, খিঁচুনি লাগা পাগল, মারধোর করা পাগল ইত্যাদি। তবে পাগল কথাটার মানে কী, আর পাগলামিই বা কী বস্তু? ওটা কি কোনো রোগ না বিকার? পাগলামি কি ভালো হয় এমন নানা প্রশ্ন আছে আমাদের মনে।  
মেয়ে ছেলের জন্য বর-কনে খুঁজতে গিয়ে আগের আমলে লোকে খোঁজ করত, বংশে কোনো ‘সুইসাইড' বা পাগল আছে কিনা। যেন পাগলামিটা বংশগত! যদি অভিনয় কিংবা গানের গলা বংশগত না হয়, তবে পাগলামিই বা বংশগত হতে যাবে কেন? আসলে একটা মানুষ তার পারিপার্শ্বিকের আর পাঁচটা মানুষের মতো ব্যবহার না করে, আচার-আচরণ না করে, একটু উদ্ভুটে ব্যবহার, আচার-আচরণ করছে। সেই উদ্ভুটে আচার-আচরণ বুঝতে গেলে তার ব্যক্তিগত ইতিহাস, আশা-আকাঙ্খা, আশাভঙ্গ ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে হয়। আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের বড় একটি অংশ মানসিক রোগীদের প্রতি এখনো সহানুভূতিশীল হয় না। তারা মানসিক রোগীদের ‘পাগল’ বলে অভিহিত করেন। মানসিক রোগীকে পাগল বলা সামাজিক অপরাধ হিসাবে গণ্য হওয়া উচিত। 
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে ২০১১ সালে একটা জরিপ হয়েছিলো। তাতে দেখা গেছে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৮ বছরের নীচে যাদের বয়স তাদের মধ্যে শতকরা ১৮.১ ভাগ এবং ১৮ বছরের উপরে যাদের বয়স তাদের মধ্যে ১৬.১ ভাগ কোনো না কোনোভাবে মানসিক রোগী। মোট জনসংখ্যার সাড়ে তিন কোটিরও বেশি মানসিক রোগী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, সারা বিশ্বের প্রতি ১০ জন মানুষের মধ্যে একজন মানসিক অসুস্থতায় ভোগেন। তবে গুরুতর মানসিক রোগ যদি বিবেচনা করা হয় তাহলে তা মোট জনসংখ্যার শতকরা ৭ ভাগ। আশার কথা হলো যে কোনো মানসিক রোগীই চিকিৎসা পেলে পুরোপুরি সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন। কিন্তু আমি উপরে যে পাগলের কথা বলেছি তারা সাধারণত ভালো হয় কম।
মানসিক রোগের অনেক কারন থাকতে পারে। তবে চিকিৎসকদের মতে বাংলাদেশে যারা মানসিক রোগে আক্রান্ত হন, তাদের একটি অংশ আক্রান্ত হন বায়োলজিক্যাল এবং জেনেটিক কারণে। কিন্তু বড় একটি অংশ আক্রান্ত হন পারিবারিক এবং সামাজিক কারণে। নানা চাপ, দারিদ্র্য, সামাজিক এবং পারিবারিক অসঙ্গতি এর অন্যতম কারণ। বলা বাহুল্য, মানসিক রোগীদের চিকিৎসার জন্য ওষুধের পাশাপাশি কাউন্সেলিং ও সঠিক সেবা যতœ জরুরি। সামাজিকভাবে মানসিক রোগীদের হেয় করে দেখা হয় এটা ঠিক নয়।
বাংলাদেশে সাড়ে তিন কোটির বেশি মানসিক রোগী আছে। দরিদ্রতা, পারিবারিক অশান্তি, কর্মসংস্থান ও ধর্মীয় শাসনের অভাবের মতো আরো বিষয়কে মনের অসুখ হওয়ার নানা কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই বিশ্বের সবাই নাকি পাগল, কেউ কম আর কেউ বেশি। পারিবারিক সচেতনতার অভাবেই মানসিক রোগের শুরু। পরিবারে মা-বাবারা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে শিশুদের সামনে ঝগড়া বিবাদ করে। অহেতুক গালাগাল, দোষারোপ, দুর্ব্যবহার করে, যা শিশুদের ছোট মনে ছোট ছোট বিষণ্যণতার জন্ম দেয়, আর শিশুরা বড় হবার সাথে সাথে এই বিষণ্যতা ধীরে ধীরে মানসিক চাপে পরিণত হয়। এই মানসিক চাপ কেউ সহ্য করতে পারে আর কেউ না পেরে হয়ে যায় রোগী। 
তবে শেষ কথা হলো সুস্থ্য সাভাবিক মানুষ যখন পাগলামি করে তাদের পাগল বলা ঠিক কি বেঠিক সেটা পাঠক নির্ধারণ করবে। কিন্তু প্রকৃত ভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিকে কেই পাগল না বলাই ভালো। প্রকৃত পাগলের প্রতি সহানুভূতিশীল হোন, তাদের মানসিক সাহস দিন, ভালো আচরন করুন। তারাও সমাজের কেউ। চাইলেও আমরা তাদের ফেলে দিতে পারবো না। তারা আমাদেরই সন্তান, ভাই, বোন, পিতা, মাতা, আত্মীয়। 




-----------------------------------------------------



আপা নিয়ে চাপাচাপি

কয়েকদিন যাবৎ আপা নিয়ে বেশ চাপাচাপি চলছে দেশে। এক সাংবাদিক ভাই এক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে আপা সম্বোধন করে কথা বলেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার তাতে আতে ঘা লেগেছে। সে উত্তেজিত হয়ে গেছে এবং বলেই ফেলেছে, আপা বললেন কেন, আপনি ইউএনওর সাথে কি বলে কথা বলতে হয় জানেন না, স্যার অথবা ম্যাডাম বলবেন। 
সাংবাদিক সাহেব তাকে আপা বলে কি খুব অপরাধ করে ফেলেছেন? আপা বলাটা কি তাকে যথাযথ সম্মান দেখানো হয় নি? উপজেলা নির্বাহী অফিসার কে বা কি? একজন মানুষ তার শিক্ষা জীবন শেষ করে একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়ে প্রশাসনের ক্যাডার হয়েছেন। সহকারী কমিশনার উপাধী নিয়ে কর্ম জীবন শুরু করে আস্তে আস্তে এ দপ্তর, ও দপ্তর পার হয়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি) হয়েছেন। পরে তার কর্মের বিভিন্ন ধাপে সে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদে আসীন হয়েছেন। দীর্ঘ কর্ম জীবনে সে অনেক ঘাত প্রতিঘাত দেখেছেন। কাজের ক্ষেত্রে অনেক নিয়ম মেনেছেন, অনেক অনিয়মও করেছেন। বাস্তবে আসলে সে কি? সাধারণ মানুষের কাছে প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী ছাড়া আর কিছুই নয়। সে হয়তো একটু বড় মাপের কর্মচারী, পিয়ন হয়তো ছোট মাপের কর্মচারী। এর বাইরে তো কিছু না। দুজনেই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী আর জনগণ প্রজাতন্ত্রের মালিক। প্রজাতন্ত্রের মালিক তাকে আপা বলেইতো অনেক সম্মান করে ফেলেছে, স্যার তো তারই বলা উচিত ছিলো। 
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিজের মধ্যে একটা অহংকার বোধ লালন করছেন। তিনি বেতন পান প্রজাতন্ত্রের আম জনতার দেয়া করের টাকায় সেটা তার খেয়াল ছিলো না। তিনি আপা বলায় এতটা ক্ষেপে যাবেন সেটা ভাবা যায়? তিনি তো কারো না কারো সন্তান, কারো না কারো বোন। তাকে আপা বলায় এতটা অপমানিত হওয়ার কিছু ছিলো না। তবুও সে অপমানিত বোধ করলেন। জোর করে কি সম্মান পাওয়া যায়? আপা মনে হচ্ছে জোর করে সম্মান আদায় করতে চায়। কিন্তু সম্মান ভূমি কর বা কোন ফি নয় যে আদায় করবেন। সম্মান আসে হৃদয়ের গহীন থেকে, কাজের মূল্যায়ন থেকে। এমন কি করে ফেলেছেন যে আপনাকে সম্মান করতেই হবে।   
একজন উপজেলা নির্বাহীর কাজ কি? তার কাজ তো উপজেলার জনগনের কাছ থেকে স্যার-ম্যাডাম শোনা না। উপজেলার সাধারণ জনগনের প্রশাসনিক কার্যকলাপ সমাধান করা, অধস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রন করা, শৃঙ্খলা বজায় রাখা, সিটিজেন চার্টার অনুযায় জনগনকে সেবা দেয়া। আর কাজগুলো করবে জনগনের জন্য। সেই জনগন কেউ এসে যদি মা বলে, কেউ যদি বোন বলে, কেউ আপা বলে তাতে ক্ষতি কি? একজন লোক কতটা আপন জেনে তাকে আপা বলেছে সেই দিকটা বিবেচনায় কি নেয়া উচিত ছিলো না? কজন অফিসার সাধারণ মানুষের আপন হতে পারে! অনেক অফিসার আছেন যারা বদলি হলে মানুষ কাদে। যাওয়ার সময় মানুষের কান্নাটাই আসল প্রাপ্তি, ঘুষ-দূর্নীতির টাকাটা কোন প্রাপ্তি নয়। 
একজন সাংবাদিক তাকে আপা বলেছে, এতে সে অপমানিত বোধ করেছেন। সাংবাদিকের অবস্থান কি সেটা হয়তো তার জানা নেই। অবশ্য এখন সমাজে অপসাংবাদিকতার ছড়াছড়ি চলছে। কোথাও গেলেই সেখানকার মানসিক ভাবে দুর্বল, অপরাধ প্রবন মানুষ, ঘুষখোর, সুবিধাবাদীদের কাছ থেকে তেলের টাকা চয়। হাত পেতে দেয়, চাটুকারী করে অনেক সাংবাদিক। ঘরে কন্যা আত্মহত্যা করেছে, পিতাকে নানা ভাবে ভয়ভীতি দেখায়, নিউজ করার কথা বলে টাকা হাতায় এমন সাংবাদিকও আছে যাদের আমরা হলুদ সাংবাদিক বলি। হলুদ সাংবাদিকদের প্রতি আমার ঘৃণা আছে। তবে নির্ভীক সাংবাদিকদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আমারই নয় সবারই আছে, থাকবে। আর সেই নির্ভীক সাংবাদ কর্মীরা আছে বলেই সমাজটা টিকে আছে। তারা সমাজকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রাণপণ কাজ করে যাচ্ছে। 
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা স্বীকৃত চারটি স্তম্ভের ওপর দাড়িয়ে থাকে। আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম। এ জন্য রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে সংবাদ মাধ্যমকে বিবেচনা করা হয় গুরুত্বের সাথে।
গণমাধ্যম শক্তিশালী হলে রাষ্ট্রযন্ত্র সঠিকভাবে পরিচালিত হতে বাধ্য হয়। সংবাদ মাধ্যম জনগণের প্রত্যাশা, অর্জন, চাহিদা, জনমত সৃষ্টি ও সমাজের ভালোমন্দ তুলে ধরে। তাইতো সাংবাদ মাধ্যমকে সমাজের দর্পন হিসাবে বিবেচনা করা হয়। গণমাধ্যমকে উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের প্রতিনিধিও বলা চলে। মানবজীবন ও সমাজ উন্নয়নের একমাত্র মাধ্যম হলো গণমাধ্যম। গণমাধ্যম দ্বারা সমাজের বাস্তব প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেন সাংবাদিক। 
আর তৃণমূল পর্যায়ে একজন সংবাদকর্মীর চোখ থাকে সমাজের ঘটে যাওয়া ছোট থেকে বড়, ভালোমন্দ, সমস্যা-সম্ভাবনা সবকিছুতে। একজন ভালো সাংবাদিক নিজের স্বার্থের কথা না ভেবে রাতদিন জীবনের সোনালী সময় ব্যয় করে গণমানুষের সমস্যা ও সম্ভাবনার খোঁজে কান পেতে থাকেন। 
একজন নির্ভিক সংবাদকর্মী হলেন সমাজের নির্মাতা। সে গণমানুষের চাহিদা ও স্বপ্নকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেন তার লেখনির মাধ্যমে। সংবাদ কর্মীর লেখালিখি সরকারের নজরে আসে, অতঃপর সরকার সেই আশা, আকাঙ্খা বাস্তবায়ন করে। একটি অবহেলিত জনপদের খরব লেখনির মাধ্যমে সভ্যতার উচ্চতায় নিতে সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের ভূমিকার বিকল্প নেই। নিজের স্বার্থ না দেখে গণমানুষের জন্য নিঃস্বার্থে কাজ করাই একজন নির্ভিক সংবাদকর্মীর কাজ। গণমাধ্যম সমাজে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটিয়ে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করে। সুবিধাবঞ্চিত জনপদের নাগরিকদের অধুনিক উন্নত সমৃদ্ধ মানুষে পরিণত করে। একমাত্র গণমাধ্যম পারে মানুষকে নতুন নতুন চিন্তা, ধারণা ও পদ্ধতি সম্পর্কে প্রতিনিয়ত তথ্য সরবরাহ করে উন্নত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে ভূমিকা রাখে।
আজকের যুগে গণমাধ্যম শিক্ষা, যোগাযেগ, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, লাইফ স্টাইল, রেসিপি, চিকিৎসা, প্রযুক্তি, আইসিটি, চাষাবাদ, ক্রয়-বিক্রয় থেকে শুরু করে নাগরিক জীবনের প্রয়োজনীয় সব চাহিদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করছে। নানা সীমাবদ্ধতা আর সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি সত্ত্বেও গণমাধ্যম সমাজের উন্নয়ন নিশ্চিত করছে। সাধারণ মানুষ ও গণমাধ্যমের কার্যকর অংশগ্রহণ ছাড়া রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমরা সবাই জানি-যে দেশে গণমাধ্যম স্বাধীন-শক্তিশালী সে দেশে গণতন্ত্র উন্নত এবং শক্তিশালী। 
এ ছাড়াও বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির স্বর্ণযুগে গণমাধ্যমের কল্যাণে এসিড সন্ত্রাস, ইভটিজিং, নারী ও শিশু নির্যাতন, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ, ভেজালের বিরুদ্ধে মানুষকে প্রতিনিয়ত সচেতন করে যাচ্ছে গণমাধ্যম। আর এর মাধ্যমে দেশ ও সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে সমাজ দেহে যে বোধের জায়গা তৈরি হচ্ছে এর পেছনে গণমাধ্যমের ভূমিকাই প্রধান। গণমাধ্যম সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করে থাকে। গণমাধ্যম ছাড়া কোনোভাবেই সরকার ও জনগণের মধ্যে জনগণ কি ভাবছে, সরকার কি করছে তা প্রকাশ পাওয়া সম্ভব না।
গণমাধ্যম সমাজের জন্য এত কিছু করে বলেই তাদের অবস্থানটা একটু ভিন্নধর্মী। সমাজ তাদের সমীহ করে ব্যক্তি হিসাবে নয় তাদের কাজের কারনে। রাজধানীতে যারা সংবাদ কর্মী হিসাবে কাজ করে, বিশেষ করে সম্পাদক থেকে প্রতিবেদক সবাইকে সকল সেক্টরের কর্তাব্যক্তিরা সমীহ করে তাদের কাজের কারনে। আমাদের দেশের প্রধাম মন্ত্রীকে মহিলা, বিরোধী দলীয় নেত্রী মহিলা। সংবাদকর্মীরা তাদের আপা সংম্বোধন করে কথা বললে তারা তো কিছু মনে করে না। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা যেখানে তাদের ম্যাডাম ম্যাডাম বলে মুখে ফেনা তোলেন সেখানে সংবাদ কর্মীরা আপা বলে কথা বলছে। তাদের যদি আতে ঘা না লাগে তাহলে একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এমন কি হয়ে গেছেন যে তাকে স্যার বা ম্যাডাম বলতে হবে। 
একসময় আমাদের দেশ তথা গোটা ভারত বর্ষ বিট্রিশদের শাসন কয়েম ছিলো। তখন ব্রিটিশ কর্তাব্যক্তিদের সমিহ করে চলতে হতো। ইউর এক্সিল্যান্সি, ইউর এক্সিল্যান্সি বলে মুখে ফেনা তুলতে হতো। শাসনের নামে তারা আমাদের যে শোষন করেছে তা আজও জাতি ভুলে নাই, হাজার বছর পার হলেও কোন প্রজন্মই ভুলবে না। তাদের এ অঞ্চল থেকে বিতারিত করা হয়েছিলো, সম্মানের সাথে যায়নি। কথাটা নিশ্চই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যারা তাদের অজানা নয়। বর্তমানেও যদি কেউ মনে করে তিনি বড় কর্মকর্তা, তাকে ইউর এক্সিল্যান্সি, ইউর এক্সিল্যান্সি করতে হবে তাহলে ভুল করবে। বর্তমান কর্তাব্যক্তিদের তো আর বিতারিত করার প্রয়োজন হবে না, কিন্তু তারা তাদের অবস্থানে থাকতে পারবে না। তাদের জন্য বিপ্লবীদের প্রয়োজন নেই, জাগ্রত সংবাদ কর্মীরাই যথেষ্ট। 
একটি গল্প বলি। একদা এক রাষ্ট্রপতি এক সম্পাদককে বলেছিলো রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের একটা স্তর তৈরী করতে। সম্পাদক মহোদয় রাষ্ট্রপতিকে প্রথম অবস্থানে রেখে বাকি পদের নাম অবস্থান অনুযায় লিখে রাষ্ট্রপতির হাতে দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি তালিকায় সম্পাদকের অবস্থান দেখতে না পেয়ে সম্পাদক মহোদয়কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার অবস্থান কোথায় লিখেননি কেন? প্রশ্নের জবাবে সম্পাদক মহোদয় বলেছিলেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি, আমার অবস্থান যদি লিখতে হয় তবে লিখতে হবে অনড়াব চৎবংরফবহঃ! তাই আমি আমার অবস্থানটা নিজ হাতে লিখিনি।
আমি সিনেমার ভক্ত। সুযোগ পেলেই সিনেমা দেখি। সিনেমার ম্যাডাম নিয়ে আরেকটা গল্প মনে পড়ে গেল। হঠাৎ বৃষ্টি চলচ্চিত্রটা হলে মুক্তি না পেয়ে টেলিভিশনে মুক্তি পায়। ছবিটা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। সেখানে অমল বোসের একটা চরিত্র ছিলো। অমল বোসের মিষ্টির দোকন যার নাম ছিলো ভোলার মিষ্টান্ন ভান্ডার! দোকানে একটা টেলিফোন সেট ছিলো। আশেপাশের সকলের কল আসতো, অনেকে কল করতো। ভোলা বাবুর দোকানে মালামাল ছিলো কম। তিনি তার টেলিফোন সেটটাকে পূজো দিয়ে বেচাকেনা শুরু করতো। একদিন একজন এসে তাকে ভোলা দা বলে ডাক দেয়ায় সে বেশ অপমানিত বোধ করেছিলো। তখন ভোলা বাবু বলেছিলো, আমাকে শ্যের অথবা মেডম বলতে পারিস না! ভোলা বাবুরও ইচ্ছে হয় স্যার অথবা মেডম ডাক শোনার। কিন্তু ইচ্ছে হলেই কি এমন মধুর ডাক শোনা যায়!!



-----------------------------------------------------


রাজীতিক ও আমাদের শিক্ষা

রাজনীতি করলেও কিছুটা পড়াশুনা যে করা উচিত সম্প্রতি হারে হারে টের পেলাম এবং গভীর ভাবে অনুভব করলাম! আমাদের শরীয়তপুর জেলা আইনজীবী সমিতির এক শ্রদ্ধাভাজন বিজ্ঞ সিনিয়র আইনজীবী ইন্তেকাল করলে তাঁর জানাজায় অংশ নিয়ে দাড়িয়েছি। এক নেতা মাইকে বক্তৃতায় ব্যস্ত। কোন এলাকা থেকে কে এসে উপস্থিত হলো, কোন নেতা কতটা সংগ্রামী। কোন নেতার বিশেষত্ব কি, রাজনৈতিক ভঙ্গিমায় জোরালো ও সংগ্রামী কন্ঠে প্রচার করে যাচ্ছে। এর ফাকে ফাকে বার বার বলে যাচ্ছে, শরীয়তপুর বার কাউন্সিলের বার বার বিনা পতিতায় নির্বাচিত সভাপতি! কথাটা বলার তার কাছাকাছি উপস্থিত অনেক সংগ্রামী নেতারাও দাড়িয়ে ছিলো কিন্তু কোন সংশোধনী দিচ্ছেন না। অনেকের মনেই প্রশ্নের জন্ম হলো, বিনা পতিতায় কথাটার মানে কি আমি নিজেও বার বার চেষ্টা করে ধরতে পারলাম না! আর শরীয়তপর বার কাউন্সিলই বা কবে গঠন হলো!! যারা কিছুটা জানে তারা সবাই বোঝে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় বার বার নির্বাচিত হওয়া যায়, কথাটা তাই হওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু তাকে এটা কে বোঝাবে? আর জেলায় জেলায় বার এসোসিয়েশন আছে। জেলা সদর ছাড়াও উপজেলা বা এর বাইরে চৌকি বার বলে একটা কথা আছে, এগুলো সবই বার এসোসিয়েশন বা সমিতি। 
বার কাউন্সিল বলতে বুঝি ১৯৭২ (রাষ্ট্রপতির ১৯৭২ সালের ৪৬ নং আদেশ)-এর অধীনে গঠিত একটি কেন্দ্রীয় সংগঠন যা ঞযব ইধহমষধফবংয খবমধষ চৎধপঃরঃরড়হবৎং ধহফ ইধৎ ঈড়ঁহপরষ ঙৎফবৎ ধহফ জঁষবং ১৯৭২ এর অনুচ্ছেদ ৩(১), অনুচ্ছেদ ৩(২) এবং অনুচ্ছেদ ১০ মতে আইনজীবিদের স্বার্থ রক্ষার্থে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল এই আইনের অধীন সকল কার্যাবলী সম্পাদন করে থাকে। এক কথায় বার কাউন্সিলকে আইনজীবি সম্প্রদাযের অভিভাবক বলা যায়। এটা সমগ্র বাংলাদেশ আইনজীবিদের পেশাগত কার্যক্রমের একমাত্র নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
আর বার এসোসিয়েশন বলতে বিভিন্ন জায়গায় আইনজীবীগণ পেশাগত কাজের সুবিধার্থে একত্রিত হয়ে যে সমিতি গঠন করে এবং এর সদস্য অর্ন্তভূক্ত হয়ে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করে সেটাই বার এসোসিয়েশন বা আইনজীবী সমিতি। 
এমনই আরেক নেতার জানাজা নামাজের অংশ নিতে গিয়েছেন এক বন্ধু। সেখানেও মাইকে এক নেতা বার বার ঘোষণা দিচ্ছে ‘আর মাত্র অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আপনারা এদিক সেদিক ঘোরাফিরা না করে মাঠে চলে আসুন, আমাদের জানাজা নামাজে অংশগ্রহণ করুন। 
এমন আরেক নেতা দেখেছি যে কিনা সারাজীবনেও একটা শব্দকে সঠিক ভাবে বলতে পারে নাই। শব্দটা হলো সাংবাদিক। সে সবসময় সাম্বাদিক ভাই বলেই সম্বোধন করেন। সেই নেতার স্কুল জীবনের শিক্ষক তাকে অনেক বার বুঝিয়েছে যে ওটা সাম্বাদিক না হবে সাংবাদিক। কিন্তু কে শোনে কার কথা? অনেকে পড়ে না, ক ল আকারে লা ক্যালা। অনেকটা সেই কিসিমের ছাত্র! 
পড়াশুনা নিয়ে একটা গল্প বলে শেষ করছি। এক পীর এসেছে এলাকায়। তাহার মুরিদগণ এসেছে পীর বাবার সাথে দেখা করতে। বাবার সাথে দেখা করবে আর তাকে নজরানা, সালামী দেবে না তা তো হয় না। কয়েকজনের হাত হতে পীর বাবা সালামী নেয়ার পর ক্লান্ত হয়ে গেলেন। অতঃপর সে একটা পথ বাতলে দিলেন। পীরের চ্যালাকে বললেলন, তুমি বলো, সবাই টাকার গায়ে যার যার নাম লিখে এই বাক্সে রাখুন। আমি পরে তাদের নাম ঘোষণা করবো। 
যথারীতি চ্যালা মাইকে ঘোষণা দিলো, আপনারা ভির করবেন না, টাকার গায়ে নাম লিখে এখানে জমা দিন। পরে নাম ঘোষণা করা হবে। 
এর কিছুক্ষণ পর শুরু হলো নাম বলা। একটা করে টাকা তুলছে আর নাম ঘোষণা করছে, 
-এই যে মোঃ করিম, বাবাকে সরমান করে এক হাজার টাকার নোট দিয়েছে, এই যে আবুল বাবাকে পাঁচশত টাকা দিয়ে সরমান করেছে। এই যে দেখেন, মরাবক বাবাকে পাঁচশত টাকা দিয়ে সরমান করেছেন, দেখছেন মরাবকও বাবাকে কতটা সম্মান করেন!
পীর বাবা আর টিকতে না পেরে চ্যালার কান টেনে বললেন,
-কইছিলাম ভালো ভাবে পড়াশোনাটা কর, তাতো শুনলি না! ওটা মরাবক না, মোবারক! বল মোবারক টাকা দিছে। 
আমাদের দেশে এখন এমন মরাবক পড়ার নেতাই বেশি। মাইক পাইলে আর ছাড়তে চায় না। যা মন চায় বলে যায়। লজ্জা শরমের বালাই নেই, শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। তাই ভয়ও নেই। 



-----------------------------------------------------


দাদুর নির্বাচনী গল্প

দাদুর কাছে নাতি নাতনীদের আবদার খুব একটা বেশি নয়। আগে গ্রাম গঞ্জে দুই মাথা বাকা অনেকটা ইংরেজী এস অক্ষরের মত দেখতে বিস্কুট পাওয়া যেত যার নাম ছিলো কুকিজ। তখনকার দিনে ছোট দোকানগুলোতে বয়ামে ভরে চানাচুর, নাবিস্কোর লজেন্স, সুপার বিস্কুট, বাতাশা বিক্রি করতো। নাতি নাতনীদের আবদারের মধ্যে দাদুর কাছে ঐ কুকিজ, চানাচুর বা লজেন্সই ছিলো। আর ছিলো গল্প যাকে গ্রামে কিচ্ছা বলে তা শোনার আবদার। 
একদিন দাদুকে নাতি নাতনীরা জোর ধরা ধরেছে, দাদু কিচ্ছা শুনবো, কিচ্ছা বলো।
দাদুও নাতি নাতনীদের প্রচন্ড ভালোবাসে। ওদের আবদার ফেলার ইচ্ছা তার কখনোই মনে আসেনি। আজও ফেলবে না চিন্তা করে শুরু করলেন-
-তবে শোন, সে অনেক কাল আগের কথা। তোমাদের বাবারা ছিলো তখন অনেক ছোট। তখন আমাদের হাটে একটা সমিতি ছিলো। 
ছোটদের সৎগুন আর বদগুন যাই বলিনা কেন একটা গুন আছে সেটা হলো প্রশ্ন করার গুন। অমনি প্রশ্ন শুরু হয়ে গেলো। একজন বললো-
-দাদু কোন হাটে?
দাদুরও ওদের প্রশ্নের উত্তর দিতে বেশ ভালোই লাগে। এতে একটা সুবিধা হলো কিচ্ছাটা দীর্ঘায়িত করা যায় এবং বেশি সময় ওদের ব্যাস্ত রাখা যায়। 
ওদের প্রশ্নের উত্তরে দাদু তখন বললো-
-আমাদের গ্রামের পাশে একটা খাল আছে না? 
অমনি প্রশ্ন শুরু হলো- 
-কোন খাল দাদু?
-আরে ঐযে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ডান দিকে যে সরু নদীটা আছে না? ঐ রাস্তা ধরে কিছুদূর গেলে একটা ছোট্ট সাকো পার হই না আমরা? সরু নদী থেকে একটা চিকন খাল বাম দিকে বেরিয়ে গেছে যার উপর সাকোটা। ঐ সরু খাল যাকে দামরার খাল বলে। ঐ খাল পার হয়ে কিছুদূর গেলেইতো হাট। কতবার নিয়ে গেছি তোদের মনে নাই?
নাতি নাতনীদের উত্তর- 
-হ্যা দাদু মনে পরেছে, মনে পরেছে। ঐ হাটে হারান দাদুর দোকান থেকে খাজুর আর রসগোল্লা কিনে দাও আমাদের ঐ হাট না?
দাদু বললো, 
-হ্যা, হ্যা, ঐ হাটই। ঐ হাটে একটা সমিতি আছে। সমিতির নাম। 
-নাম বলা লাগবে না দাদু, পরে কি তা বলো। 
-পরে ঐ সমিতি চালাতে হলে কমিটি গঠন করতে হয়। আর কমিটি গঠন করতে হলে সমিতির সদস্যদের ভোটে কমিটি নির্বাচিত হয়। সমিতির নির্বাচন হয় তিন বছর পর পর। তো, ঐ সমিতির একজন সদস্য আছে যে কিনা প্রতি নির্বাচনেই সম্পাদক পদে নির্বাচন করতো আর ফেল করতো। 
-তার নাম কি দাদু?
-বলছি, দাড়া। তো একবার হলো কি, সবাই দয়াপরবস হয়ে তাকে সাপোর্ট দিলো। কিন্তু বাদ সাধলো অন্য এক প্রার্থী তার মনোনয়ন উঠাইলো না। মনোনয়ন বোঝো তো? মনোনয়ন হলো নির্বাচনে দাড়াতে হলে একটা ফরম আছে তা ফিলাপ করে নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা লোক যাদের নির্বাচন কমিশনার বলে, তাদের কাছে জমা দিতে হয়। যদি কোন পদে একাধিক প্রার্থী না থাকে তাহলে ঐ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত হয়ে যায় আর যদি মনোনয়ন না উঠায় তাহলে ঐ পদে ভোট গ্রহণ ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। 
-দাদু, মনোনয়ন না উঠালে সমস্যা কি? ভোট হলেই বা সমস্যা কি? আর বার বার নির্বাচনে দাড়ানোর লোকটার নাম বললা নাতো দাদু?
-সমস্যা আছে, সবাই যাকে দাড় করিয়েছে সেই প্রার্থী ছিলো মাথাফুলা। তার নাম ছিলো জহরি লাল কুন্ডু। মাথাফুলা বোঝো? একটু আবাল কিসিমের আরকি। আমাদের গাবুর মোকলেছ আছে না? ওর মত মাথাফুলা। সবাই তাকে মাথাফুলা জহরি বলে ডাকতো।  
-পরে কি হলো দাদু?
-আর কি হবে? গোপনে ভোটাভুটি হলে জহরি লাল কুন্ডু যে পাস করবে না তা সবাই বুঝে গেছে। জহরি লাল কুন্ডুর হাটুর বয়সী প্রার্থীর সাথে প্রতিদ্বন্দিতা করেও চিন্তায় সবার মাথার ঘাম পায়ে পড়া শুরু হয়ে গেছে। তাই উপায়ন্ত না দেখে গায়ের জোরে সেই মাথাফুলারে প্রকাশ্যে ভোট দিয়া পাস করান লাগছে।
-তার পর দাদু। 
-তার পর আবার একবার নির্বাচনে সেই মাথাফুলায় দাড়াইছে। 
-সেইবারওকি প্রকাশ্যে ভোট দেওয়া লাগছে দাদু?
-না, সেই বার প্রতিদ্বন্দি প্রার্থী ছিলো বেশ জনপ্রিয় প্রার্থী। সারা মাস জহরি লাল ভোটারদের সাথে কথা বলে আর গুনে দেখে সে বিশাল ব্যবধানে পাস করবে। কিন্তু ভোটের দিন ভোট গণনার পর দেখা গেলো সেই প্রার্থীর সাথে মাথাফুলায় হেরে গেছে। পরের বারও যখন ভোট এলো আবার দাড়ালো। আবারও মাথাফুলা জহরি ফেল করলো!
-বলো কি দাদু? বার বার ফেল করার পর দাড়ায় কেন, লজ্জা নাই?
-লজ্জা? লজ্জা বলতে একটা জিনিস আছে সেটা জহরি জানেই না। আবার নিয়ম মতো নির্বাচন এলো। সেই নির্বাচনেও দাড়িয়ে গেলো। নির্বাচন এলেই জহরির পায়ের নিচে খোটায় তাই দাড়িয়ে যায় নির্বাচনে। 
-সেবার কি পাস করেছে? প্রকাশ্যে ভোট নেয়া লাগছে দাদু?  
-আরে না, প্রত্যেক বার কি এক পদ্ধতিতে আকাম করা যায়? এই বার ভিন্ন পদ্ধতি খাটান লাগছে।
-ভিন্ন পদ্ধতিটা কি দাদু?
-এই বার নির্বাচনের কাজে যারা দায়িত্বে ছিলো তাদেরকে হাত করে ব্যালট পেপার আগেই কয়েকটা সরাইয়া রাখছে। পরে সেগুলায় সিল মাইরা বাক্সে ভরছে। সেইবার ছল চাতুরি করে জয়লাভ করে নির্বাচন কমিশনারদের দিয়ে তরিঘরি করে ব্যালট পুরিয়ে ফেলছে। 
-তারপর দাদু?
-তারপর আবার নির্বাচন আইছে। সেইবারও মাথাফুলা জহরি লাল কুন্ডু দাড়াইছে। আগের বারের চালাকি এইবার আর করতে না পাইরা ফেল করছে। 
-প্রতি বারই নির্বাচনে দাড়ায় আর ফেল করে, মাত্র দুইবার পাস করলো তাও ছলচাতুরি করে, তাহলে দাড়ায় কেন নির্বাচনে? তার পরে কি হলো দাদু?
-এইবার ফেল কইরা মনে হয় একটু সরম লজ্জা জালাইছে। পরের বার নির্বাচনে আর দাড়াইতে গিয়া গিড়ায় বল পায়নাই। আগের বার যার কাছে হারছে এইবারের নির্বাচনে তারে নিয়া মাঠে নামছে। 
-বলো কি দাদু? আগের নির্বাচনে যার কাছে হারলো পরের নির্বাচনে তাকে নিয়েই মাঠে নামলো। কিভাবে সম্ভব এটা?
-সম্ভব রে দাদুরা সম্ভব। আগের বার প্রতারনা করে জিতছে। পরের বার প্রতারনা করতে ব্যার্থ হয়ে ফেল করায় চিন্তা করছে, যার কাছে হারলাম সে মনে হয় অনেক জনপ্রিয়। জনপ্রিয় লোকটা নিশ্চই এবারও জিতবে। তাই জিতা পার্টির সাথে থেকে কিছু টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়ার ধান্দা আরকি! মাথাফুলা জহরি লাল কুন্ডুর কিছু বদ অভ্যাস ছিলো। 
-কি বদ অভ্যাস দাদু?
-একটু পাগলা পানির অভ্যাস ছিলো। বাদ দে, ওটা তোরা বুঝবি না। 
-তার পর দাদু?
-তারপর আর কি? নির্বাচন শুরু হলো। সহজ সরল বেটার কাছ থেকে টাকা নেয় আর পাগলা পানি খাইয়া উল্টা পাল্টা কথা বলে। রাস্তা দিয়া হাটে আর সরল মানুষটাকে বুঝায়। সাহস দিয়ে বলে-‘বা....কাটতে কুড়াল লাগে নাকি।’ আবার কতক্ষণ বলে, ‘রাখ বেটা, কুড়াল কাটতে বা...... লাগে নাকি?’
-দাদু বা... কি?
-ওটা তোদের না জানলেও চলবে। ওটুকু সেন্সর করে দিলাম। বড় হলে একদিন বুঝবি কথাটার মানে কি? তো একদিন বাজারে ভোটারদের দাওয়াত দিয়ে নির্বাচনী মিটিং করলো। মিটিংয়ে পাগলা পানি খেয়ে জহরি লাল কুন্ডু বক্তৃতা দিতে দাড়িয়ে বলতে শুরু করলো, ‘আপনারা জানেন, পাগলা পানি ভালো না। অথচ খোজ নিলে দেখবেন আমাদের প্রতিপক্ষের লোকজন পাগলা পানি খাচ্ছে। ওরা ভালো না। (মনে মনে বলে, আমি এত অপকৌশল করি তার পরেও এবারের প্রার্থীর সাথে জিততে পারি না। দুইবার জিতছি তাও নানান অপকৌশল করে, পীর বাবার হাত পা ধরে।) ভাইসব, এবার আমরা একটা জবাব দিয়ে দেবো। কি বলেন আপনারা? সবাই ভদ্রতার খাতিরে তার সাথে সায় দিলো। কিন্তু মনে মনে ভোটের ব্যাপারে দিবে কচু! 
-তার পর কি হলো দাদু?
-সেবার জহরি লাল কুন্ডুর সমর্থকের বিরুদ্ধে যে প্রার্থী প্রতিদ্বন্দিতা করছিলো সে ভোটারদের সবসময় খেয়াল রাখতো। সারা বছর ভোটারদের সুখ দুঃখের খোজ খবর রাখায় তার প্রতি ভোটারদের ভালোবাসাটাও ছিলো গভীর। আর সেই প্রতিদ্বন্দি প্রার্থী ভোটের রাজনীতি করে সারা বছর। ভোটারদের সুখ-দুঃখে ছুটে যেত যখন তখন। ভোটারদের আপন ভাইয়ের মত ¯েœহ করতো, ভালোবাসতো। তা দেখে জহরি লাল কুন্ডুদের গা জ্বলতো। আর মাথাফুলা জহরি লাল কুন্ডু ও তার লোকজন ভোটারদের খোজখবর নিতো শুধু নির্বাচনের এক মাস আগে থেকে। ফলে তাকে কেউ মন থেকে ভোট দিতো না। ভোট নিতো জোর করে প্রকাশ্যে, অপকৌশলে। 
-তারপর দাদু?
-আগের বার যার কাছে হারলো এবার তাকে নিয়ে নানা অপকৌশল করেও আর জিততে পারলো না। ব্যালট পেপার নিয়ে অপকৌশল করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়, পীর বাবার দয়াও পায়নি। পীর বাবা বুঝে গেছে, মাথাফুলা আবালের জন্য নিজের ইমেজটাতো আর নষ্ট করা যায় না! আমাকে সবাই ভালোবাসে, মাথাফুলার জন্য কেন আমি সকলের কাছে ঘৃনার পাত্র হবো। তাই পীর বাবা এবার কোন সাপোর্ট না দিলো না। ফলে বিশাল ব্যবধানে হেরে গেলো। 
-বলো কি দাদু? 
-হ্যারে, বিশাল ব্যবধানে জহরি লালের দল হেরে গেলো। হেরেই ক্ষ্যান্ত দিলো না। এবার শুরু করলো আরেক ভন্ডামি। 
-নির্বাচনে হেরেছে। এর পর আর কোন ভন্ডামি বাকি রাখলো, লজ্জা সরম কি ধুইয়া খাইছে দাদু?
-বাকি ছিলোরে, বাকি ছিলো। নির্বাচনের পর হেরে গেলে বিজয়ী কমিটির হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে হয়। কিন্তু এবার দায়িত্ব দিচ্ছে না। হারার পরে নতুন ধুয়া তুলছে, নির্বাচন ঠিক মতো হয় নাই, মামলা করুম, দায়িত্ব দিমু না, সংবিধান ঠিক করতে হবে, টাকা খাইয়া ভোটাররা ভোট দিছে, আমাদের যারা ভোট দিছে তারা ভালো, ওদের যারা ভোট দিছে তারা হাজী হলেও পাজি, সব বিক্রি হয়ে গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। জহরি লাল কুন্ডু নিজে যে টাকা খাইছে তা ভুলেই গেছে! 
-বলো কি দাদু? ঝামেলা থাকলে নির্বাচনে গেলো কেন? মনোনয়ন দেয়ার আগে ঝামেলা আছে সেটা কি বুঝতে পারে নাই? আর হারার পরেই বা এমন আবোল তাবোল বকছে কেন?
-কারন আছে রে দাদুরা। তবে শোন। জহরি লাল কুন্ডু যাকে নিয়ে নির্বাচনে নেমেছে তার কিছুটা স্বচ্ছতা ছিলো, জনপ্রিয়তাও ছিলো। আগের বার যেই লোকটা তার নির্বাচন করেছে তার সাথে বেইমানী করে আগের বারের প্রতিদ্বন্দির সাথে আতাত করে নির্বাচন করেছে। আর জহরি লাল ওর সাথে যোগ দিয়েছে কেন জানিস? সেই লোকটাকে ভোটারদের কাছে স্থায়ী ভাবে খারাপ বানাতে পারলে জহরি লাল কুন্ডুর লাভ হয়। সরল লোকটার পাছায় সিরা ভরাইয়া দিলো। সিরা ভরান নিয়া আজ আর কোন প্রশ্ন করবি না, আরেক দিন সিরা ভরানির কিচ্ছা বলবো। জহরি লাল কুন্ডু ভবিষ্যতে যাতে চান্স নিতে পারে সেই অপকৌশল করে লোকটাকে পচানোর ধান্ধা শুরু করলো। আর ক্ষমতার লোভ হয়তো পেয়ে বসেছিলো ভালো লোকটাকে। তাই সেও ঐ উপদেষ্টাদের কথায় নাচতে শুরু করলো।
-উপদেষ্টাদের মানে? জহরি লাল কুন্ডু ছাড়াও কি আরো উপদেষ্টা ছিলো সরল লোকটার সাথে?
-হ্যা, ছিলো, এমন অনেক উপদেষ্টা ছিলো যারা নিজের দোকানে বসে গল্প করে না কারন আলো জ্বালালে তেল খরচ হবে, চা-পান খাওয়ানো লাগবে সেই খরচের ভয়ে। অন্যের দোকানে বসে গল্প চাটামি করতো। কারো মুখে কোনদিন চা-পান না দিলেও নির্বাচন এলে একটা পুরান কট কাপড়ের প্যান্ট পড়ে মুখে একটা পান পুরে দাত দিয়ে শুপারি কাটতে কাটতে ভোট চাইতে, পরে যখন ভোটাররা তার ভন্ডামি বুঝে ফেলেছে তখন সেই উপদেষ্টা আস্তের উপর সরে পড়েছে! এমন চাটা, কৃপন অনেক আছে ঐ হাটে। 
-আরও আছে এমন উপদেষ্টা দাদু? 
-হ্যা, আছে তো। এক উপদেষ্টা আছে এমন কৃপন যে আশি টাকা হাতে এলে বিশ টাকা ধার করে একশ টাকা বানিয়ে রেখে দিতো। ধার্মিক ভাব নিয়ে চলতো কিন্তু কুটনার হদ্দ ছিলো। আরেক উপদেষ্টা গজিয়েছে তাকে হালিম চাটা বলেই সবাই ডাকতো। জাতীয় ছাত্রলীগ বললেই সবাই চিনে। কথা শুরু করলেই গল্প শুরু করে দিতে সে জাতীয় ছাত্রলীগ করা নেতা, অমুক করেছে, তমুক করেছে। গ্রামের থেকে উঠে আসা ফহিন্নির পুত, ভাব ধরেছে জমিদারের। সব বাইনচোদের দল। বড় হলে ওদের সম্পর্কে জানতে পারবি, এখন কিচ্ছা শোন। 
-তার পর দাদু?
-তারপর আর কি? ভালো লোকটাকে গুয়ের মত পচিয়ে ছেড়ে দিলো। নিয়ম অনুসারে ক্ষমতা তো আর না দিয়ে পারলো না। কয়েকদিন ঘুরিয়ে পেচিয়ে পরে ক্ষমতা দিতে বাধ্য হলো। 
-তাহলে ঐ খারাপ জহরি লাল কুন্ডুদের কথা লোকটা শুনলো কেন দাদু?
-শোন, ভালো মানুষও মাঝে মাঝে শয়তানের ফাদে পা দেয়। লোভে পড়ে ভালো মানুষটা হয়তো শয়তানগুলোর ফাদে পা দিয়েছে। গল্পের ভিতরেই আরেকটা গল্প বলি শোন। এই গল্পে একটা শিক্ষনীয় বিষয় আছে। ধরতে পারলে তোদের কুকিজ কিনে খাওয়াবো, সাথে লজেন্সও দেব।
-বল দাদু, দেখি ধরতে পারি কি না?
-এক দেশে জহরি লাল কুন্ডুর মতো এক মাতাল ছিলো। সেই মাতাল পাগলা পানি একটু বেশিই পছন্দ করতো। একদিন পাগলা পানি খেতে খেতে একটু বেশিই মাতাল হয়ে পড়েছে। অন্ধকার রাতে, টলতে টলতে বাড়ি যাচ্ছিলো। হাতে ছিলো একটা বোতল। বাড়িতে গিয়ে আবারও খাওয়ার জন্য বোতলে করে কিছুটা পাগলা পানি নিয়ে বাড়ি ফিরছিলো। হঠাৎ হাত থেকে পাগলা পানির বোতল পড়ে গেলো। এখন অন্ধকারের মধ্যে বোতলতো খুজে পাচ্ছে না। তখন নিরুপায় হয়ে মা কালির সাহাহ্য চাইলো। বললো, মা কালি, তুমি যদি আমার বোতলটা খুজে দাও তবে তোমার নামে জোড়া পাঠা বলি দেব। মা কালি জহরি লাল কুন্ডুর কথায় প্রসন্ন হলেন। খুশি হয়ে মা কালি বোতলটা পায়ের একদম কাছে এনে বুড়ো আঙ্গুলে ছোয়ালেন। এবার মাতাল হাত দিয়ে বোতলটা তুললো। পরের দিন জোড়া পাঠা বলি না দেয়ায় মা কালি স্বপ্নে আবির্ভূত হলো। এসে বললো, কিরে জোড়া পাঠা দিবি বললি কই? তখন ঘুম থেকে উঠে জহরি বললো, মা হাতের অবস্থা ভালো না, দুইটা পাঠা দিতে পারবো না, যাও, একটা পাঠা দিব। পরের দিন সেই একটা পাঠা দিবে বলে তাও দিলো না। মা কালি এসে আবার বললো, কিরে একটা দিবি বললি দিলি নাতো। এবার বললো, মা, সত্যিই হাতের অবস্থা ভালো না, পাঠার যা দাম দিতে পারবো না, যাও, একটা মোড়গ দিব। পরের দিন সেই মোড়গও দিলো না জহরি। মা কালি এসে বললো, কিরে মোড়গ কই? এবার জহরি বললো, মা হাতের অবস্থা খুবই খারাপ, মোড়গ কেনার পয়সাও নেই, পাগলা পানি খাওয়ার পয়সা জোটানোই দায় হয়ে পড়েছে মোড়গ কিনবো কেমনে? যাও, একটা চড়–ই পাখি দিব। পরের দিন চড়–ই পাখি না দেয়ায় মা কালি এসে বললো, কিরে আর কত ঘুরাবি, কথা তো রাখলি না, চড়–ই পাখি কই? এবার বললো, মা বিশ্বাস করো, আমার হাতের অবস্থাতো ফিরছেই না, চড়–ই পাখি ধরতেও পারছি না, যাও, একটা ফরিং বলি দিবো, এবার কথার আর নরচর হবে না। পরের দিন সেই ফরিংও দিলো না। এবার মা কালি এসে বললো, কিরে ফরিং কই? তখন জহরি বললো, মা তুমি কি পাগল হইছো? তুমি একটা মাতালের কথাও বিশ্বাস করো? আর কত ফরিং ঘাসের আগায় উড়াউড়ি করে, একটা ধইরা খাইলেই পারো, এইটার জন্য আবার আসা লাগে?
-এবার বল, কি শিখলি?
দাদু, আসলে মাতালের কথা বিশ্বাস করতে নাই!
-একদম ঠিক কথা। ধরতে পেরেছিস। আমি কিন্তু আমার কথা রাখবো। আর যা বলেছি তাই হবে, কুকিজ আর লজেন্স সবই পাবি। বোনাস হিসাবে পাবি হাটের হারান দা’র দোকান থেকে খাজুর আর রসগোল্লা। 


-----------------------------------------------------


ডানপন্থীর চেয়ে বামপন্থীই ভালো

ডান এবং বাম কথাটা শুনলে আমাদের সামনে যে বিষয়টা ভেষে উঠে তা হলো ডানপন্থী আর বাম পন্থী। ডানপন্থী আর বামপন্থী শব্দ দুটি সম্পর্কে আমরা বেশ অবগত। ডান বা ডানপন্থী সম্পর্কে আমাদের সামনে পুজিবাদ, সা¤্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ, ধর্মান্ধ, শোষণ পিড়ন রাজনীতির অবয়ব চোখের সামনে চলে আসে। আর বাম বা বামপন্থী বলতে, সমাজতন্ত্রী, সাম্যবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ, পুজিবাদ বিরোধী রাজনীতির কথা মনে করিয়ে দেয়। যদিও বামেরা এখন আর বামে নেই, অনেকেই ডানে, সামনে, পিছনে চলে গেছে। সে বিষয়টা নিয়ে এখন চিন্তা না করাই ভালো। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি শব্দগুলোর সাথে একজন মানুষ যখনই পরিচিত হতে থাকে তখনই ডানপন্থী আর বামপন্থী শব্দ দুটি সম্পর্কে ধারনা জন্মাতে থাকে এবং জানার আগ্রহ বাড়তে থাকে। আমিও এর বাইরের কেউ নই। আমারও পন্থা দুটি সম্পর্কে ব্যাপক আগ্রহ আছে। যেহেতু শব্দ দুটি আমার লেখার আজকের শিরোনাম তাই পন্থা দুটি সম্পর্কে আমার কিছু ধারনা নেয়া প্রয়োজন। পাঠক বন্ধুরা হয়তো আগেই শব্দ বা পন্থা দুটি সম্পর্কে সম্যক ধারনা নিয়ে রেখেছেন, তবুও নিজের সাথে মিলিয়ে দেখার জন্য উল্লেখ করলাম।  
ডানপন্থী রাজনীতি সম্পর্কে একটু খোজ খবর নিলে জানাযায়, রাজনীতিতে ডানপন্থা বা ডানপন্থী বিশেষণগুলো ব্যবহৃত হয় এমন মতাদর্শের ক্ষেত্রে, যা মানুষের অর্থনৈতিক বা ঐতিহ্যগত বা সামাজিক শ্রেণীগত বিভেদ বা ধাপবিন্যাসকে সমর্থন করে। ভিন্ন ভিন্ন ডানপন্থী রাজনৈতিক দল বিভিন্ন মাত্রায় বামপন্থী রাজনীতি সমর্থিত সাম্যবাদের বিরোধিতা করে থাকে, এবং সার্বিক সাম্য চাপিয়ে দেওয়াকে সমাজের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করে থাকে।
ডানপন্থা এবং বামপন্থা শব্দগুলো রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রথম প্রচলিত হয় ফরাসি বিপ্লবের সময়। ফরাসি সংসদে ভিন্ন মতধারার মানুষেরা যেসব দিকে আসন গ্রহণ করতেন, সেই দিকের নামানুসারে মতগুলোকে নির্দেশ করতে এই শব্দগুলো ব্যবহার শুরু হয়। রাষ্ট্রপতির ডানপাশে উপবিষ্ট মানুষেরা সাধারণভাবে পূর্বতন অভিজাত শাসনব্যবস্থা, রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র এবং প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম তথা চার্চ প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির সমর্থক ছিলেন। ১৮১৫ সালে রাজতন্ত্রের পুর্নপ্রতিষ্ঠার পরে ডানপন্থা বলে উগ্র-রাজতন্ত্রীদের নির্দেশ করা হত। যদিও ফ্রান্সে ঐতিহ্যগত রক্ষণশীলদের নির্দেশ করতে 'ডানপন্থা' ব্যবহৃত হত, পরবর্তীতে ইংরেজীভাষী দেশগুলোতে এই বিশেষণের অর্থ আরও বিস্তৃত হয়ে উদারপন্থী রক্ষণশীল, ঐতিহ্যগত উদারপন্থী এবং উদারবাদী রক্ষণশীল দের, এবং পাশাপাশি খ্রিষ্টীয় গণতান্ত্রিক এবং কিছু জাতীয়তাবাদীদের নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হয়। ডানপন্থী সম্পর্কে এটুকুই ধারনা পেলাম বিশ্ব তথ্য ভান্ডার থেকে। 
আর বামপন্থী রাজনীতি সম্পর্কে ধারনা নিতে একটু হাত বাড়ালেই চলে আসবে নানান তথ্য। 
বামপন্থী রাজনীতিঃ বামপন্থী রাজনীতি (ইংরেজিঃ খবভঃ-রিহম ঢ়ড়ষরঃরপং) হচ্ছে সেই রাজনৈতিক অবস্থান বা কর্মকান্ড যা সামাজিক অসাম্য ও সামাজিক ক্রমাধিকারতন্ত্রের বিরুদ্ধে সামাজিক সাম্যকে গ্রহণ বা সমর্থন করে। এই রাজনীতি বিশেষভাবে জডিত থাকে সমাজে যারা অন্যের তুলনায় কম পায় বা সুযোগহীন থাকে তাদের ব্যাপারে এবং পূর্বধারনা করে যে অসাম্যের অবিচার কমানো বা বিলুপ্ত করা উচিত।
বামপন্থী রাজনীতির ব্যুৎপত্তি ও ইতিহাসঃ ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের সময় 'খবভঃ' শব্দটির উৎপত্তি হয়। তখন পার্লামেন্টের ডানদিকে বসতেন শাসকদল এবং সভাপতির বাঁ পাশের আসনগুলোয় বসতেন বিরোধীদল। বাঁ দিকে বসার জন্য তাদের বলা হতো বামপন্থী বা খবভঃরংঃ. সমাজতন্ত্রী ও প্রগতিশীলদেরই এখন সাধারণভাবে বামপন্থী বলা হয়। পরবর্তীকালে ফ্রান্সের অনুকরণে অন্যান্য দেশের আইনসভায়ও বিরোধী দলের সদস্যদের বামদিকে বসার রীতি চালু হয়।
বামপন্থী রাজনীতির কর্মসূচিঃ বিশ শতক পরবর্তীকালে বামপন্থী হতে হলে যে বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার তা হচ্ছে বামপন্থিদের সা¤্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদবিরোধী হতে হবে। এছাড়াও বামপন্থি হতে হলে তাদের অবশ্যই সামন্তবাদবিরোধী তথা সামন্ততন্ত্রের অবশেষ উচ্ছেদের কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে; সবরকম সম্ভাব্য আকার ও রূপে বিরাজমান ভূমিদাস প্রথার জেরগুলো, যেমন বর্গাপ্রথার উচ্ছেদ করে ভূমিসংস্কার করতে হবে। তৃতীয়ত রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল আইন বা বিধিবিধানকে তারা সমর্থন করবে না। চতুর্থত, তারা উগ্র-জাতীয়তাবাদের বিরোধী অবস্থানে সুদৃঢ় থাকবে।
বামপন্থী অর্থনীতিঃ বামপন্থী অর্থনীতি মুলত কেইন্সীয় অর্থনীতিতে বিশ্বাস করে এবং কারখানা গণতন্ত্র ও সামাজিক বাজারের মাধ্যমে কল্যাণ রাষ্ট্রে অর্থনীতির জাতীয়করণে এবং কেন্দ্রীয় পরিকল্পনায় একটি নৈরাজ্যবাদী/সিন্ডিক্যালবাদের পক্ষে স্বব্যবস্থাপনার নৈরাজ্যবাদী সাম্যবাদের পক্ষে দাঁড়ায়। শিল্প বিপ্লবের সময় বামপন্থীরা ট্রেড ইউনিয়নকে সমর্থন করত। বিশ শতকের শুরুতে, অনেক বামপন্থী অর্থনীতিতে সরকারের শক্তিশালী হস্তক্ষেপের পক্ষে দাঁড়ান।
এক কথায় ডানপন্থী আর বামপন্থী সম্পর্কে মূল যে ধারনা পাওয়া যায় তাতে স্পষ্টই বোঝা গেলো যে যারা ডান দিকে বসতো তারা ডানপন্থী আর যারা বাম দিকে বসতো তারাই বামপন্থী। আমার লেখার বিষয়টাও ঐ ডান দিকে বসা আর বাম দিকে বসা নিয়ে, আসন গ্রহণকারীর রাজনীতি নিয়ে নয়। 
আমাদের দেশে নি¤œ আয়ের মানুষগুলো যে যানবাহনে চড়ে তাতে আসন সংখ্যা কম, যত্রতত্র পাওয়া যায়, ভাড়াও কম। এই যানবাহনগুলো চালায়ও অজ্ঞ, অসিক্ষিত, কান্ডজ্ঞানহীন, সাধারণ নি¤œ আয়ের লোকেরাই। যেমন, রিক্সা, ভ্যান, বেবি, টেম্পু, সম্প্রতি যোগ হয়েছে বিদ্যুৎ চালিত ইজি বাইক বা অটোরিক্সা। এই যানবাহনগুলো সহজলভ্য হলেও রাস্তায় এরা বেশ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। এরা হরহামেশাই দূর্ঘটনায় পতিত হয় বা দুর্ঘটনার কারন হয়েদাড়ায়। 
এই যানবাহনগুলোতে বসার ক্ষেত্রে আসন বিন্যাসটা হচ্ছে চালকের ডান দিকে আর বাম দিকে। এখানে ডানপন্থী আর বামপন্থী হিসাবে কেউ না বসলেও যখন যে আসন পায় সেই আসনেই বসতে হয়। কখনো ডানপন্থী লোক চালকের বাম দিকটায় বসে বা চালকের পিছনের বাম দিকটায় আবার কখনো বামপন্থী লোক চালকের ডান দিকটায় বসে। যারা বাম দিকটায় বসে তারা বেশ ভাগ্যবান। অনিচ্ছা থাকলেও তারা নিয়ম মেনেই যানবাহন থেকে নামে। কিন্তু যারা চালকের ডান দিকটায় বসে তারা সাধারণত ডান দিক দিয়ে নামে। চালকের ডান দিক দিয়ে নামায় মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যয় এমনটি কিন্তু নয়। ছোট এই যানবাহনগুলোতে যারা চলাচল করে তারা সাধারণত ভাড়া পরিশোধ করে গাড়ি থেকে নেমে। আর বিপত্তিটা হয় ওখানেই। একজন যাত্রী ডান দিক দিয়ে নেমে যদি সে দ্রুত নিরাপদে বাম দিকে রাস্তার ফুটপাতে গিয়ে দাড়ায় তাতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তা না করে যাত্রীরা সাধারণত ডান দিক দিয়ে নেমে ব্যাস্ত রাস্তার উপর দাড়িয়ে কেউ বুক পকেট থেকে, কেউ সাইড পকেট থেকে আবার কেউ পিছনের পকেটে থাকা মানিব্যাগটা বের করে ডান দিকে দাড়িয়ে থেকে ভাড়া পরিশোধ করে। আর মহিলারা তাদের ভ্যানেটি ব্যাগ বা অন্য কোন ব্যাগ থেকে টাকা বের করে ভাড়াটা পরিশোধ করে। এতে যে সমস্যাটা হয় তা হলো, ব্যাস্ত রাস্তায় দ্রুতগামী যানবাহনগুলো চলাচলে বিঘœ ঘটে। কখনো কখনো দ্রুতগামী যানবাহন অনাকাঙ্খিত ভাবে রাস্তার উপর দাড়িয়ে ভাড়া প্রদানরত যাত্রী দেখে নিয়ন্ত্রণ হারায়, বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটায়। এতে ভাড়া প্রদানরত যাত্রী বা বড় গাড়ির যাত্রী উভয়েই ঝুকির মধ্যে পড়ে। 
আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারা ইচ্ছে করলেই এই দুর্ঘটনা এড়াতে পারি। আমরা যদি যানবাহন থেকে নেমে দ্রুত ফুটপাতে এসে দাড়াই এবং ভাড়া পরিশোধ করি তাতে নিজেদের যেমন লাভ তেমনি রাস্তার শৃঙ্খলাটাও ঠিক থাকে। এ কাজটা করার জন্য কারো রকেট সাইন্স জানার প্রয়োজন নেই। একটু জনসচেতনতা, সামাজিক মূল্যবোধ, দায়িত্বশীলতা এবং নিজের ইচ্ছেই পারে রাস্তার শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবং আমাদের মূল্যবান সম্পদ ও জীবণ বাঁচাতে। 
ছোট যানবাহনগুলো আরো একটা বিরক্তিকর কাজ করে। বিভিন্ন সংযোগ সড়কের সামনে দাড়িয়ে যাত্রী তোলার কাজটা করে। এ সময় সংযোগ সড়ক থেকে মূল সড়কে উঠার সময় মূল সড়কের দ্রুতগামী যানবাহনগুলো দেখা যায় না। এর ফলে অনেক সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটে। কিন্তু মূল সড়কের সাথে সংযোগ সড়কগুলোর মোড় থেকে তারা যদি তাদের যানবাহনগুলো একটু এগিয়ে পিছিয়ে রাখে তাহলেই সংযোগ সড়ক হতে মূল সড়কে উঠতে যাওয়া গাড়িগুলো সহজেই দেখতে পারে রাস্তা কতটা ব্যস্ত এবং উঠা কতটা নিরাপদ। 
এ কাজগুলো করার জন্য প্রয়োজন চালকদের নূন্যতম জ্ঞান। রিক্সা-ভ্যানের চালক বিভিন্ন সমিতির কাছ থেকে টাকা ধার করে সহজেই ইজিবাইক বা অটো রিক্সা কিনে রাস্তায় নেমে পড়ে। নেই কোন প্রশিক্ষণ, নেই তেমন শিক্ষা, দীক্ষা, নেই সামাজিক দায়িত্ববোধ। বিশেষ করে ইজি বাইক চালকদের জ্ঞান কান্ড এতটাই কম যে, কেউ রাস্তায় দাড়িয়ে যদি বগল চুলকায়, অমনি সামনে এসে দাড়িয়ে যায় তোলার জন্য। ছোট যানবাহনগুলো যেখানে সেখানে পার্কি করে, ব্যাস্ত রাস্তার মাঝ দিয়ে চলে, ক্ষমতার চাইতে বেশি দ্রুত চলাচল করে এমন আরো অনেক কারন আছে যার কারনে ইজিবাইক দুর্ঘটনা ঘটে বেশি বা দুর্ঘটনা ঘটায় বেশি। 
ছোট যানবাহনগুলোতে যারা বাম দিকে বসে, যারা বাম দিকে নামে, যে যানবাহনগুলো বাম দিকে চেপে পার্কিং করে, মোড়ে বাম দিকে চেপে দাড়ায় তাদের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা কম ঘটে। সেই ক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে বামপন্থীরা ডানপন্থীদের চাইতে অনেক ভালো।     
তাই রাজনীতিতে আমরা ডান পন্থা বা বাম পন্থা যে পন্থাই অনুসরণ করি না কেন, রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রে একটু বাম পন্থা অনুসরণ করার চেষ্টা করলে নিজের জন্য, অপরের জন্য ভালো হবে। তাতে সড়ক দুর্ঘটনা কমবে, মূল্যবান জীবন বাঁচবে, সম্পদ বাঁচবে। আমরা সবাই মিলে একটি বাসযোগ্য সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অনেক ভূমিকা রাখতে পারি। সরকার রাস্তায় আমাদের সবসময় নজরদারীতে রাখতে পারবে না। আমরা যদি নিজেরা সচেতন ও সতর্ক হই তাহলেই এটা সম্ভব। আমাদের মনে রাখা উচিত, সময়ের চেয়ে জীবণের মূল্য অনেক বেশি। আর একটা দুর্ঘটনা আপনার পরিবারের সারা জীবণের কান্না হয়ে বেঁচে থাকবে। দুর্ঘটনায় হয়তো আপনি মরে বেঁচে গেলেন কিন্তু পরিবার গুলোকে অথৈ সাগরে ভাসিয়ে রেখে গেলেন।   
পাঠের বন্ধুরা, লেখার শুরুতে যে কথাগুলো লিখেছি তা পড়ে হয়তো অনেকেই বলবেন যে আমি ধান ভানতে শীবের গীত গাইছি। তবে ধান ভানার ফাকে যদি একটু গীত শোনা যায় তাতে কি এমন ক্ষতি হবে বলেন? আর শীবের গীত নিয়ে নাহয় অন্য দিন লিখবো।



-----------------------------------------------------


দোষ আমারই!!

এক সপ্তাহ। পুরা এক সপ্তাহ বিছানায় কাটালাম। সম্পূর্ণ বিশ্রামে ছিলাম। বিশ্রাম নেয়াও যে ক্লান্তির বিষয় তা আগে বুঝিনি। একপর্যায়ে বিশ্রাম নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে গেছি, সেই ক্লান্তি দুর করতে আবার বিশ্রামের প্রয়োজন হয় কিনা বুঝতে পারছি না। সুস্থ্য শরীরে বিশ্রাম নেয়া যে এত কষ্টের তা আগে বুঝিনি!  
যা হোক, কেন এই অখন্ড বিশ্রাম তার কারন বলছি। গত ৩০ মার্চ বরিশাল যাওয়ার জন্য সকাল বেলা রওয়ানা দিলাম বাড়ি থেকে। কোর্ট মোড় থেকে একটা মটর সাইকেল নিয়ে চলে গেলাম মাদারীপুরের মোস্তফাপুর। সেখানে নেমে নাস্তা সেরে দাড়ালাম বাসের জন্য। ঢাকা টু বরিশালগামী বাসগুলো মোস্তফাপুর যাত্রী নামিয়ে কিছু যাত্রী তোলে। আমার সফর সঙ্গী এডভোকেট মুরাদ হোসেন মুন্সী। হাত ইশারায় ঢাকা টু বরিশালগামী বাস থামলো। মুরাদ মুন্সী উঠে পড়লো। এবার আমার উঠার পালা। আমি বাসের হাতল ধরে সবে মাত্র ডান পা তুলেছি, বাম পা এখনও ভূমিতে অবস্থান করছে। বাম পা উঠানোর আগেই একটা ঝটকা টান দিলো চালক। অমনি টের পেলাম আমার ভাঙ্গা পা আবারও খাদে পড়েছে! বাম পায়ে ব্যাথা পাওয়ার কারনে আমি আর উঠতে পারলাম না। উঠতে না পারলেও আমি বাসের হাতল ছাড়িনি। আমি নিজের চোখে দেখছি, যদি হাতল ছেড়ে দেই আমার পা সহ আমিই চাকার নিচে চলে যাবো। তাই হাতল না ছেড়েই ঝুলে রইলাম। কিছুদুর গিয়ে বাসটি থামালো চালক। এবার আমি উঠে পড়লাম। কিন্তু ততক্ষণে টের পেলাম যা হবার তা হয়ে গেছে। হাটুতে ব্যাথা অনুভব করছি। চিন চিন ব্যাথা। আস্তে আস্তে খুড়িয়ে খুড়িয়ে বাসের পিছনের দিকে সিটে গিয়ে বসলাম। বরিশাল বাস ষ্ট্যান্ডে গিয়ে সাবধানে নেমে কাজ শেষে চলে আসলাম শরীয়তপুর। বন্ধু ডাক্তার মাহবুবকে বললাম সবকিছু খুলে। সে পরামর্শ দিলো, কোন ঔষধ লাগবে না, শুধু বিশ্রাম নিতে হবে। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, পা প্লাস্টার করে দিবে কিনা। বলে রাখা ভালো, এই পায়ে কয়েক বছর আগে লিগামেন্ট সরে গিয়ে একমাস প্লাস্টার করে বিছানায় শুয়ে ছিলাম। যখন প্লাস্টার খুলেছে তখন মাটিতে পা রাখলে মনে হতো পায়ের পাতা যেন পাথর হয়ে গেছে। সেই ভয়ে বললাম প্লাস্টার না করে কি বিশ্রাম নেয়া সম্ভব? ডাক্তার আমায় বললো, সম্ভব, তবে নড়াচরা করা যাবে না। তিন চার দিন বিশ্রাম নিতে হবে। যেই বলা সেই কাজ। আমি বিছানায় চলে গেলাম। তিন চার দিন পর ডাক্তার আবার গিয়ে দেখে বললো, এক সপ্তাহ বিশ্রাম নিতে হবে, পুরোটা ভালো হয়নি। তিন চার দিনের সাথে যোগ দিয়ে দিলাম বাকী সময়টা। অখন্ড আট দিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাটিয়ে দিলাম। আটটি দিন আমার সাথে ছায়ার মত লেগেছিলো আমার মেয়ে যাকে আমি মা বলে ডাকি সেই প্রিয়ন্তী। আট দিনের মধ্যে সে একবারও ঘরের বাইরে যায়নি। আমার কি লাগবে, তা দেয়ার জন্য দ্রুত চেষ্টা করেছে। একেবারে মায়ের মত সেবা করেছে আমার মেয়ে। আট দিন বিশ্রাম শেষে ক্লান্ত হয়ে অবশেষে ফিরলাম নিজ কর্মস্থল আমার চেম্বারে। 
আমার এই আটদিনের বিশ্রামের জন্য আমিই দায়ী। পরিবহনের বাড়াবাড়ির জন্য যা হলো তাকে আর কি দোষ দেব বলেন? বাসটা একটু দাড়ালে আমি উঠতে পাড়তাম। আমি উঠার পর গাড়িটা টান দিলে কি চালকের খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেত? সময় কি খুব বেশি চলে যেত? এমন হাজারো প্রশ্ন মনে জাগে। উত্তর? কোন উত্তরই পাই না, আর উত্তর দেবেই বা কে? পরিবহন সেক্টরের নৈরাজ্য আজ নতুন কিছু নয়। আমার দুর্ঘটনার পর পরই ঢাকায় এক দুর্ঘটনায় হাত হারালো কলেজ ছাত্র। দুই বাসের রেশারেশি আর পাল্লাপাল্লিতে হাত কাটা পড়লো। হাতের সাথে ছিড়ে গেলো তার একরাশ ভবিষ্যত। তার পরপরই দুই বাসের চাপে এক গৃহবধুর কোমড় ভেঙ্গেছে। কেন এমন হয়? কি আমাদের করা উচিত? কোন উত্তর নেই। 
এই যে অসুস্থ্য প্রতিযোগিতা এর পেছনে কারা? এমন ভাবে গাড়ি চালায় যারা তারা কোথা থেকেই বা আসে? আসলে আমাদের দেশে সৎ বাবা-মায়ের অসৎ সন্তানগুলো, বখে যাওয়া সন্তানগুলো, নিকৃষ্ট সন্তানগুলো বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। পরে এরা বিভিন্ন বাস, টেম্পুতে হেলপারের কাজ করে অপরাধ জগতের সাথে মেলামেশায় লিপ্ত হয়। ছোট বয়সেই বাদুরের মত বা বানরের মত বাসের হাতল ধরে ঝুলে ঝুলে চলতে থাকে পথে। নানান অপরাধের সাথে যুক্ত হয়ে আর প্রমোশন পেতে পেতে একদিন হয়ে যায় ড্রাইভার! এক মন্ত্রীর মতানুসারে গরু-ছাগল, লাল নীল রং চিনে বলে তারা পেয়ে যায় ড্রাইভিং লাইসেন্সও! এর পর চালকের আসনে বসে বেপরোয়া ভাবে চালাতে থাকে যানবাহন। ওরা নিজের জীবন নিয়ে যেমন ভাবে না তেমনি অন্যের জীবন নিয়েও ভাবে না। যেমনটি ভাবেনি আমার জীবন নিয়ে!!
আমি চালককে কোন দোষ দিতে চাই না! চালক তার স্বভাবসুলভ কাজটিই করেছে। আমিতো বানরের মত ঝুলে বাসে উঠতে পারিনি সেটা কি চালকের দোষ? আমার ওজন আমি কমাতে পারিনি, ঝুলে ঝুলে বাসে উঠতে পারিনি সেটা কি চালকের দোষ? সব দোষ আমারই। বাসে যাত্রী উঠার পরে ছাড়তে হবে সেই শিক্ষা চালক পায়নি, আমার তো উচিত ছিলো বাদুর ঝোলা হয়ে বাসে উঠার অভ্যাস করার তাই মনে মনে ভাবছি দোষ আমারই। 


-----------------------------------------------------



শরীয়তপুর-চাঁদপুর সড়ক ও হরমুজ মিয়ার শেষ ইচ্ছা!

১॥
শরীয়তপুরের হরমুজ মিয়া। বর্ণাঢ্য জীবন কাহিনী তার। হরমুজ মিয়া, তার আবার বর্ণাঢ্য জীবণ! কিন্তু শুনলে আপনিও পুলকিত হবেন। রাস্তা নিয়ে তার আছে বিস্তর জীবনগাথা। রাস্তায় উঠে যেমন জীবনযাপনের রোজগার শুরু করেছিলো, বিয়ে করে রাস্তা দিয়ে বউ নিয়ে বাড়ি ফিরেছে, রাস্তায় দেখেছে সন্তানের মুখ আর রাস্তাই তাকে পথে বসিয়েছে। 
সুস্থ্য সবল হরমুজ মিয়া ভ্যান চালাতো। হাট থেকে মালামাল নিয়ে মানুষের আব্দার মতো গন্তব্যে পৌছে দিতো। হরমুজের বাড়ি শরীয়তপুর জেলার চাঁদপুর-শরীয়তপুর সড়কের ‘মাঝামাঝি কান্দি’ নামক গ্রামে। ‘লোয়ার মত হাত, ইডাইল্যা শইল আমার’ বলে হরমুজ একদিন গর্ভ করতো! জীবিকার টানে একদিন আটার বস্তা নিয়ে হরিনাঘাট থেকে ভেদরগঞ্জ বাজারের দিকে রওয়ানা দিয়েছে। ভাঙ্গাচোরা রাস্তা। পথে ভ্যান উল্টে পড়ে গেলো। ঘটনা চক্রে আটার বস্তা এসে পড়লো হরমুজের পায়ে। ব্যাস, পা ভেঙ্গে গেলো। অকেজো হয়ে গেলো মুহুর্তের মধ্যে। কয়েক মাস বিছানায় কাটিয়ে যখন সেরে উঠলো তখন টের পেলো, সেই ইডাইল্যা শরীর আর নাই। এখন আর হরমুজ ভ্যান টানতে পারে না। কি করা যায় চিন্তায় পরে গেলো হরমুজ।
২॥ 
ভ্যান দুর্ঘটনার পর হরমুজকে ভ্যান চালানো চেড়েই দিতে হলো। কিছু একটাতো করতে হবে! অনেক চিন্তা ভাবনা করে হরমুজ গরু পালন শুরু করলো। প্রতিদিন গরু নিয়ে মাঠে যায়। ঘাস খাওয়ায়, কিছু ঘাস কেটে নিয়ে আসে রাতে খাওয়ানোর জন্য। হরমুজ তখনও বিয়ে করেনি। গরু লালন পালন করে, দুধ বিক্রি করে ভালই আয় রোজগার হচ্ছিল।
হরমুজের গরুটা গাভিন হয়েছে। আগর মত এখন আর দুধ দেয় না, দুধ একদম কমে গেছে। যা দুধ হয় তা বিক্রি করার মত না। বাছুরটাও বড় হয়ে চালাক হয়ে গেছে। সুযোগ পেলেই দুধ খেয়ে ফেলে। সিয়ানা বাছুর, মুহুর্তের মধ্যে ওলান খালি করে ফেলে। তাতে হরমুজের মনে কষ্ট নেই। আরতো কয়েকটা মাস কষ্টে সিষ্টে চালিয়ে দিলেই হবে। আবার যখন বাচ্চা দিবে তখন দুধ হবে, দুধ বিক্রি করে সংসার ভালোই চলবে!
কিন্তু সময় কারোরই সমান যায় না। হরমুজের সময় এখন ভালো যাচ্ছে না। গরুটা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলো। হরমুজ একটা ভ্যান চালককে খবর দিলো। ভ্যানে করে গঞ্জের হাটে মজিদ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। মজিদ ডাক্তার হাটের সবচেয়ে বড় পশুর ডাক্তার! পশু হাসপাতালে চাকরি করেছে অনেক বছর। অবসরের পর গঞ্জের হাটে দোকান দিয়ে বসেছে। সবাই তাকে ডাক্তারই ডাকে।
ভ্যানে করে হরমুজ তার গর্ভবতী গরুটাকে গঞ্জের হাটে নিয়ে গেলো। মজিদ ডাক্তারকে দেখিয়ে ঔষধ কিনে বাড়ি ফিরছিলো। রাস্তার ঝাকুনিতে গরুর বেহাল দশা। পরের রাতেই গরুর গর্ভপাত হয়ে গেলো। আর মাত্র কয়েক মাস পরে বাচ্চা দিবে। অনাকাঙ্খিত সময়ে গরুটা মরে হরমুজের মাথায় বিনা মেঘে বাজ পড়লো। হরমুজ মনে মনে বললো, ‘খোদা, ঠাডা হালানের আর মানুষ পাইলা না! গরুটা আমার একমাত্র সম্বল তার উপরেই বিপদ দিলা!
হরমুজ চিন্তা করলো সময় এমনিতে ঘুরবে না। তার চেয়ে একটা বিয়া কইরা ফালাই। দুইজনের কপালের জোরে যদি ভাগ্যটা একটু খোলে! সাত পাঁচ ভেবে পাশের গ্রামের আরজিনা বেগমকে বিয়ে করে ফেললো হরমুজ মিয়া। বিয়ে করে নিরুপায় হয়ে শরীয়তপুর-চাঁদপুর রাস্তা দিয়েই বাড়ি ফিরতে হলো হরমুজকে!
৩॥ 
হরমুজ মিয়া বিয়ে করেছে। বিয়ের পর হরমুজ মিয়া সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলো! একদিন হরমুজ মিয়া বাজারে গিয়ে মিষ্টি বিলাচ্ছিল। অনেক পরিচিত-অপরিচিত লোক সেই মিষ্ট খেয়ে বেশ খুশি। হরমুজের স্ত্রী আরজিনা বেগমকে পাশের বাড়ির মর্জিনা ভাবি এসে জিজ্ঞেস করলো
-কিলো, কি হইছে তোগো? তোর সোয়ামি দেহি বাজারে মিষ্টি বিলাইতাছে! আমারে কিছু কলি না যে!
-আর কইওনা বইন, কাইল রাইতে আলুভত্তা আর হোরা ভত্তা দিয়া কাজির ভাত খাইছিলাম। হজম হয়নাই ঠিকমত তাই সকালে ওকাল করছি। হেইয়া দেইখ্যা গোলামে খুশিতে নাচতাছে আর মিষ্টি বিলাইতাছে!
-ওহ! ওই কতা? আমার সোয়ামীতো আইসা আমারে সুখবরটা দিলো, কইলো হরমুজের বউ পোয়াতি হইছে! আমি আরো মনে মনে বেজার হইছি যে, আরজিনা ভাবি আমারে খবরটা কইলো না, আমার সোয়ামির কাছ থেকে খবরটা শোনতে হইলো!
কয়েক মাস পর ঠিকই আরজিনা বেগম পোয়াতি হইছে! এবার হোরা ভত্তা আর কাজির ভাতের গুনে না সত্যিকারের বমি ভাব শুরু হয়েছে আরজিনার। এ অবস্থায় আরজিনাকে ডাক্তার দেখানো দরকার। কিন্তু হরমুজের আবার ডাক্তারদের প্রতি বেদম গোস্বা। ডাক্তাররা তার দু’চোখের বিশ। ডাক্তার দেখলেই সে দেখে ছুরি, চাপাতি নিয়া কষাই আসতেছে। আর হাসপাতাল ও ক্লিনিক তার কাছে কষাইখানা ছাড়া আর কিছুই নয়!
যাহোক, হরমুজের স্ত্রীর দিন ঘনিয়ে আসতেছে। না, মৃত্যুর নয়, ডেলিভারির দিন ঘনিয়ে আসতেছে। হরমুজ চিন্তা করলো, যে করেই হোক নরমাল ডেলিভারি করাতে হবে! ব্যাথা উঠলে যদি বাড়িতে রাখে তবে দাই বেটি কিছুক্ষণ নারাচারা করে কমিশন খাওয়ার লোভে হাসপাতালে নিয়া যাবে! হাসপাতালে নিলেও নরমাল হবে না, পরে হাসপাতাল থেকে পাঠাবে ক্লিনিকে। ক্লিনিকে নেয়ার পর কাটাকাটি করে ডেলিভারি করবে আর হরমুজের কাছ থেকে মোটা টাকা খসাবে। হরমুজ এটা হতে দিতে পারে না!
এদিকে ডেলিভারির দিন ঘনিয়ে আসছে। প্রস্তুতি হিসাবে হরমুজ একটা ইজিবাইক ঠিক করে রাখলো। ইজিবাইক চালককে বলে রাখলো, ডাক দিলেই যেন ইজিবাইক চলে আসে। কি করতে হবে বা কোথায় যেতে হবে তা পরে বলে দিবে।
এমনি এক সকালে হরমুজের স্ত্রীর পেট ব্যাথা শুরু হয়েছে। সাথে সাথে হরমুজ ইজিবাইক চালককে ডাক দিলো। ইজিবাইক চালক এমন বিপদের সময় দ্রুত হরমুজের বাড়ি চলে আসলো। জিজ্ঞেস করলো
-হরমুজ ভাই, কই নিবেন চিন্তা ভাবনা করছেন? হাসপাতালে না ক্লিনিকে?
হরমুজের সোজাসাপটা উত্তর
-আমারে কি পাগলা কুত্তায় কামড়াইছে যে হাসপাতালে বা ক্লিনিকে নিমু? তুই ধর, গাড়িতে তোল, আমিও ধরতাছি।
হরমুজ বাইক চালকের সহায়তায় স্ত্রীকে বাইকে তুললো। পাশের বাড়ির দাই চাচি ঘরে আরজিনা বেগমের পাশেই ছিলো। তাকে ডাক দিয়ে বাইকে তুললো হরমুজ। কয়েকটা কাপড়ও সাথে নিয়ে নিলো। এবার বাইক চালককে বললো
-চাঁদপুরের রাস্তায় ল!
-কন কি হরমুজ ভাই? ঐ রাস্তার যা অবস্থা তাতে ওই দিকে কই নিয়া যাইবেন?
-কতা কম ক, যেমনে বলি তেমনে কাজ করতে থাক।
হরমুজ বাইকের দরজার অংশ কাপর পেচিয়ে ঢেকে দিলো আর স্ত্রীর পাশে দাই চাচিকে বসিয়ে দিলো। চালকের পাশে বসে হরমুজ চালককে বললো
-এইবার চালাইতে থাক কাইশ্যা।
কাইশ্যা বাইক চালাতে শুরু করলো। আধা কিলোমিটার যেতে হলো না। আরজিনা বেগমের নরমাল ডেলিভারি হয়ে গেলো! ফুটফুটে পুত্র সন্তান হয়েছে হরমুজের বউর। দাই চাচি তো তাজ্জব, তাজ্জব বাইক চালক কাইশ্যাও!
হরমুজ বাইক চালককে এবার বললো,
-বাইত্তে চল কাইশ্যা। এবার বুঝতে পারলি কেন এই রাস্তায় আইছি! সিজার, অপারেশন কিছুরই দরকার নাই, এই রাস্তায় চললে, নারিভূরিসহ পেটের ভাতও বাইরে চইলা আসে, বাচ্চা কাচ্চাতো আরো চেঙ্গর! ওরা ভিতরে থাকবো না হেইডা আমি জানি!
৪॥ 
হরমুজের বিপদ যেন কাটছেই না। বিয়ে করলে বিপদ কাটবে চিন্তা করেছিলো, কিন্তু কই? বিপদ যে সঙ্গী হয়ে আছে। হাতে কোন কাজ কর্ম নাই, টাকা পয়সাও নাই। এভাবে অভাব অনটনের মধ্যে আর ভালো লাগে না। অগত্যা কোন কাজ কর্ম না পেয়ে হরমুজ চুরি চামারি শুরু করলো।
একদিন পাশের এলাকার কিনাই মিয়ার বাড়িতে চুরি করতে ঢুকছে। মালপত্র নিয়া বের হবে এমন সময় কিনাই মিয়া টের পেয়ে গেলো! চোর চোর বলে চিৎকার দিতেই হরমুজ মিয়া দিলো দৌড়। হরমুজ দৌড়ায় মালামাল নিয়ে আর কিনাই মিয়া দৌড়ায় হরমুজের পিছন পিছন। দৌড়াতে দৌড়াতে হরমুজ উঠলো শরীয়তপুর-চাঁদপুর সড়কে। সড়ক দিয়ে দৌড়ানোর সময় কিনাই মিয়া ভাঙ্গা রাস্তার খাদে পড়ে চরম ভাবে জখম হয়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করলো। কিনাই মিয়ার স্বজনরা হরমুজের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করলো। নিয়তির নির্মম পরিহাস, দীর্ঘ শুনানী শেষে হরমুজ মিয়ার ফাঁসির আদেশ হয়েছে। মৃত্যুদন্ড কার্যকরের আগে হরমুজ মিয়াকে জিজ্ঞেস করা হলো,
হরমুজ, তোমার শেষ ইচ্ছে কি?
হরমুজ জবাব দিলো, আমাকে শরীয়তপুর-চাঁদপুর রাস্তা দিয়ে ঘুরিয়ে আনা হোক!
উপস্থিত কর্তা ব্যক্তিরা জানতে চাইলো,
-হরমুজ, ঐ রাস্তায় কি তোমার অনেক স্মৃতি? শেষ বারের মত কি তুমি ঐ রাস্তা দিয়ে ঘুরতে চাও?
শান্ত গলায় হরমুজের উত্তর, 
-না, ঐ রাস্তা দিয়ে চললে এমনিতেই মইরা যাইতে ইচ্ছা করে! এতই খারাপ রাস্তা, হয় এ্যাকসিডেন্টে মইরা যাব যেমনটি মরছে কিনাই মিয়া! যার কারনে আমি আজ ফাঁসিতে ঝুলুম, নয়তো এমন বাজে রাস্তায় চলার কারনে নিজেরই ইচ্ছে হইবো মইরা যাইতে! তাতে মৃত্যুটা একটু সহজ হইবো আরকি!!




-----------------------------------------------------

মা আসে মা যায়। এ এক প্রকৃতির চক্র

মা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাঝে মাঝেই চলে মাতামাতি। জীবনে চলার পথে আমরা মায়ের কথা কখনো ভুলি না, ভোলার মতও না। মা তো মা’ই। এক জীবণে আমরা তো অনেককেই মা ডাকি। একেক মা একেক রকম আবেগ নিয়ে ডাকি। একেক মা একেক রকম সাড়া দেয়। গর্ভধারণী মায়ের মত কি কিছু হয়? আমার মনে হয় হয় না।
১॥ 
গর্ভধারণী মাতা। পরম যতনে দীর্ঘদিন গর্ভে রেখে মৃত্যু যন্ত্রনা ভোগ করে প্রসব করে আমাদের। আমরা তার কিছুই টের পাইনা। এর পর লালন পালন করে। মিনিটে মিনিটে পিসাব পায়খানা করি, কিন্তু সামান্য সময়ের জন্য কি ভিজা থেকেছি? না মুহুর্তের মধ্যে শুকনা ঝরঝরা। গরমের দিনে যেমন, শীতের দিনেও তেমন। মায়ের উষ্ণতা এমনই এক নিয়ন্ত্রণ যা কোন শীতাতপ নিয়ন্ত্রণকারী যন্ত্রও পারে না। খাওয়া নিয়ে যন্ত্রণা। কি খেতে হবে, কখন খেতে হবে একমাত্র মা’ই ভালো বোঝেন। সেই মা সন্তানের কারনে কত দুঃখ বেদনা সহ্য করে কিন্তু কোন দিন সন্তানের অমঙ্গল কামনা করে না।
অথচ আমরা কি সেই মায়ের যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারি। কত ছোট ছোট বিষয়ে মাকে কষ্ট দেই। মুহুর্তের মধ্যে চোখ উল্টে ফেলি। যা বলা উচিত নয় তাও বলে ফেলি। কেউ কেউ মাকে ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ি। কেউ কেউ মাকে বোঝা মনে করে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসি। দেখা করি শুধু মা দিবসের দিন। একটা ভালো এঙ্গেলে সেলফি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোষ্ট দেই। ভালো ভালো কথা লিখি মাকে নিয়ে। মা, তুমি কত ভালো, উম্মা, আই লাভ ইউ মা...।
২॥ 
মায়ের সেই শিশু সন্তানটি আস্তে আস্তে বড় হয়। কিশোর থেকে যুবক। এক দিন বিয়ে সাদি করে সেই সন্তান। বিয়ের পর পায় শাশুরি মা। সন্তানের সুখের জন্য মেয়ের জামাই কিংবা ছেলের বউকে নিজের করে নেয় এই মা। নিজের করে নিয়ে আবার বৃদ্ধ বয়সে মা হয় একজন মা। পরিবারের নতুন সদস্য বউ বা জামাই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কি খাবে, কি পছন্দ করে সেই নিয়ে কত চিন্তা। স্বামী সংসার একদিকে আর নতুন সদস্য বউ বা জামাই একদিকে। এতো কিছুর পরেও কি আমরা সেই মা শাশুরি মাকে তার যথাযথ সম্মানটুকু করি? বউ কেন শাশুরিকে মা ভাবতে পারে না? জামাই কেন শাশুরিকে মা ভাবতে পারে না। এমন প্রশ্ন ঘুরছে হয়তো অনেকের মনেই। কিন্তু বাস্তবতা এটাই যে আমরা এখানেও মাকে যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারি না।
৩॥ 
বিয়ে সাদি করেছে। কিছুদিন পরে সন্তানের মুখ দেখে সেই যুবক যুবতী। কন্যা সন্তান হলে পরম আদোরে মা মা ডাকে। আস্তে আস্তে ভুলতে থাকে মাকে, ভুলতে থাকে শাশুরি মাকে। এবার সকল মনোযোগ সন্তানের প্রতি যেভাবে মায়েরা বড় করেছে সেভাবেই বড় করার নানান প্রয়াস।
৪॥ 
সন্তান এবার বড় হতে থাকে। সঞ্চয় অনুযায় ফেরৎ পায় পিতা মাতা। যেমন আচরণ করে আসে মায়ের প্রতি তেমনই ফেরৎ আসে সন্তানের কাছ থেকে। এটা যেন প্রকৃতির এক সার্কেল। এর ভিতরেই আবর্তে সব কিছু। তাই, আসুন ভালোবাসি মাকে। ভালোবাসি সন্তানকে। ভালোবাসার প্রতিদান কেবল ভালোবাসাতেই পাওয়া যাবে। ভালো থাকুক মায়েরা।



-----------------------------------------------------


মাদক নিয়ে মাতামাতি ক্রস ফায়ারে হাতাহাতি!

চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে। স্লোগানটা দারুন! এমন স্লোগান সবসময় আসে না। সম্প্রতি স্লোগানটি আমাদের সামনে এসেছে। মাদকের বিরুদ্ধে দেরিতে হলেও সরকার বাহাদুর চরম ক্ষেপেছে। এবার মাদক নির্মূল করেই ছাড়বে। খুবই ভালো কথা। নির্মূল অভিযানের সহজ পথ নির্ধারণ করেছে ক্রস ফায়ারে মাদক ব্যবসায়ী হত্যা। এই নির্মূল কৌশল আর বিচার বহির্ভূত হত্যা নিয়ে চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা ও সমালোচনার ঝড়। কেউ সমর্থন দিচ্ছে নির্লজ্জ ভাবে, কেউবা আড়ালে আবডালে। আবার কেউ সমালোচনা করছে খোলামেলা, কেউবা কৌশলে। কেউ দোষ দিচ্ছে বিচার বিভাগকে, কেউ দোষ দিচ্ছে আইনজীবীদের, কেউ দোষ দেয় সরকারের, কেউ প্রশাসনকে, কেউ কেউ সমাজ ব্যবস্থাকে। আসলে এর জন্য কে প্রকৃত দায়ী? মাদক সমাজের জন্য এক ভয়াবহ ক্যান্সারসম। কেনইবা এমন একটি ক্যান্সার নির্মূল পদ্ধতি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে?
শুরুতেই একটু ঝালাই করে নেই মাদক দ্রব্য এবং মাদকাসক্তি কি? মাদক দ্রব্য হলো একটি রাসায়নিক দ্রব্য যা গ্রহণে মানুষের স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উপর প্রভাব পড়ে এবং যা আসক্তি সৃষ্টি করে। মাদক দ্রব্যে বেদনানাশক কর্মের সাথে যুক্ত থাকে তন্দ্রাচ্ছন্নতা, মেজাজ পরিবর্তন, মানসিক আচ্ছন্নতা, রক্তচাপ পরিবর্তন ইত্যাদি। মাদক দ্রব্য গ্রহণ করলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে এবং মাদক দ্রব্যের উপর নির্ভরশীলতা সৃষ্টির পাশাপাশি দ্রব্যটি গ্রহণের পরিমাণ ক্রমশ বাড়তে থাকে ব্যক্তির এই অবস্থাকে বলে মাদকাসক্তি এবং যে গ্রহণ করে তাকে বলে মাদকাসক্ত।
বিভিন্ন ধরণের মাদকদ্রব্যঃ মাদক দ্রব্য আসলে কি কি সেটার নির্দিষ্ট সংখ্যা বা নাম বলা সম্ভব নয়। মানুষ নেশার জন্য যা যা ব্যবহার করে তাই মাদক দ্রব্য। সেটি হতে পারে ইনজেকশন, ধূমপান বা অন্য যে কোন মাধ্যম।
বিভিন্ন ধরণের মাদক দ্রব্যের মধ্যে রয়েছে হিরোইন, কোকেন, সাম্প্রতিক কালের ইয়াবা, আফিম, মারিজুয়ানা, গাজা, ফেনসিডিল, বিয়ার, কেটামিন, স্পিড, বিভিন্ন রকমের ঘুমের ওষুধ থেকে শুরু করে জুতায় ব্যবহৃত আঠা পর্যন্ত। অনেকে বিভিন্ন ধরণের এনার্জি ড্রিংকসের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে নেশা করে থাকে। সাধারণ এনার্জি ড্রিংকস আর সাধারণ থাকে না যখন তার সাথে কিছু মিশিয়ে নেশা করা হয়। বিভিন্ন ধরণের মাদক গ্রহণের ফলে মানুষের শরীর ও মনের বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন হয়।
মাদক দেহে ও মস্তিষ্কে কীভাবে কাজ করে? নিওরো কেমিক্যাল পরীক্ষায় দেখা গেছে, মাদক সেবনের পরপরই ব্যক্তির মস্তিষ্কের কিছু কিছু জায়গায় অতি দ্রুত এবং বেশি পরিমাণে ডোপামিন নামক নিওরোট্রান্সমিটার বৃদ্ধি পায়, যা একজন ব্যক্তিকে মাদকের আনন্দ দেয় এবং পরবর্তী কালে ব্যবহারে উৎসাহিত করে। কিন্তু যারা দীর্ঘদিন ধরে মাদকে আসক্ত তাদের বেলায় আবার উল্টোটা দেখা যায়। অর্থাৎ দীর্ঘদিন মাদক নেয়ার ফলে যে ডোপামিন একজন মানুষকে নেশার আনন্দ দিত তা আস্তে আস্তে কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। প্রকৃতপক্ষে দেখা যাচ্ছে, মাদকাসক্ত ব্যক্তি আসলে একটা সময়ে আর আনন্দের জন্য নেশা নিচ্ছে না। এটা তার অভ্যাসে পরিণত হয় এবং এটা থেকে একসময় বের হয়ে আসা অসম্ভব হয়ে পড়ে। প্রথম পর্যায়ে মাদক মানুষকে এমন একটি আনন্দ দেয় যার কাছে মজাদার জিনিসগুলো যেমন খাদ্য, পানীয় এবং যৌন মিলনের আনন্দের মত আনন্দের জিনিসগুলো ম্লান হয়ে পড়ে। কারণ এই ছোট ছোট আনন্দগুলো মানুষ একই নিওরোট্রান্সমিটার অর্থাৎ ডোপামিন এর মাধ্যমে পেয়ে থাকে। মাদকের আনন্দের সাথে পাল্লা দিয়ে এই আনন্দগুলো কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে এবং মাদকই হয়ে পড়ে মাদকাসক্ত ব্যক্তির একমাত্র চিন্তা চেতনা। দীর্ঘদিন মাদক ব্যবহারকারীদের ডোপামিন এর কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে মস্তিষ্কের যে সমস্ত জায়গা ডোপামিন এর মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান প্রদান করে থাকে সেই জায়গাগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে। ফলে একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
মাদক গ্রহণের পরিমাণের ভিন্নতার কারণে দেহে ও মস্তিষ্কে এর প্রভাব ভিন্ন হয়। খুব অল্প পরিমাণে মাদক উদ্দীপক বস্তু হিসেবে কাজ করে। বেশি পরিমাণে মাদক গ্রহণ করা হলে তা যন্ত্রণাদায়ক হিসেবে কাজ করে। বেশি পরিমাণে গ্রহণ করা হলে শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে যার পরিণতি হয় মৃত্যু। 
কিছু কিছু মাদক দ্রব্য সরাসরি মনকে আক্রমণ করে। এতে করে মাদক গ্রহণকারী তার চারপাশে কি ঘটছে তার উপলব্ধি হারিয়ে ফেলে। মাদক একজন ব্যক্তির সকল ইন্দ্রীয় চেতনাকে সম্পূর্ণরুপে বন্ধ করে দেয়। যার ফলে ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করতে পারেনা। তার চিন্তাধারা নেতিবাচক হয়ে পড়ে। 
মাদক সম্পর্কে সংক্ষেপে দেয়া তথ্যই বলে দেয় এর প্রভাব ও ক্ষতিকর দিক। তাহলে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা অনিবার্য বটে। কিন্তু পদ্ধতির কারনে এবং পদক্ষেপ গ্রহণের হঠাৎ আগ্রহের কারনেই আজকের এই প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া। মাদক নেয়া শুরু করলে কাজ করে আস্তে আস্তে। একপর্যায়ে আর কোন কাজই করে না শুধু একটা কাজই করে তা হলো মাদক নিতে হবে এই চেতনাটা জাগ্রত থাকে। দেশে মাদকের প্রভাবের মত একদিনে মাদক বিস্তার ঘটেনি। আস্তে আস্তে ঘটেছে এবং আজকের এই পর্যায়ে এসেছে। হঠাৎ করে যেমন মাদক ত্যাগ করা যায় না। তেমনি হঠাৎ করে রাত শেষে মাদক নির্মূল হয়ে গেছে সেই ঘোষণাও দেয়া যায় না। তাই নির্মূল পদ্ধতিটা এত দেরিতে শুরু করাটাই হয়েছে প্রথম ও প্রধান প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া।
বাংলাদেশে র‌্যাব সৃষ্টির পিছনে রয়েছে সুবিশাল ইতিহাস যা আমাদের সবারই কম বেশি জানা আছে। একসময় দেশে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী এমন হারে বৃদ্ধি পেয়েছিলো যে মদদ দাতা, নিয়ন্ত্রনকারী সংস্থাই বিরক্ত হয়ে পড়েছিলো। সন্ত্রাস যখন ঘারের উপর নিঃস্বাস ছাড়তে শুরু করে তখনই সৃষ্টির তাগিদ অনুভব করেছিলো আমাদের নীতিনির্ধারক কর্তাব্যক্তিরা। এর পর সবই ইতিহাস। 
র‌্যাব কালো পোষাক পড়ে মাথায় কালো কাপড় বেধে কালো চশমায় চোখ আবৃত করে নেমে পড়ে সন্ত্রাস দমনে। প্রথম প্রথম নামী দামী দাগী সন্ত্রাসী ধরা শুরু করে এবং কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যাযজ্ঞ চালায়। হত্যার পর একটা নির্দিষ্ট ফরমেটে প্রেস রিলিজ দিয়ে জানান দেয় যে, অমুক সন্ত্রাসীকে ধরার পর কখনো ক্যাম্পে আনার সময় আবার কখনো অস্ত্র উদ্ধারের সময় তার সহযোগীরা বা প্রতিপক্ষরা হামলা চালায় এবং সন্ত্রাসীকে ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করে বা সন্ত্রাসী পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। পরে সন্ত্রাসীদের গুলিতেই সন্ত্রাসী নিহত হয়। নিহত হওয়ার সময় তার পাশেই পাওয়া যায় কখনো কেজো কখনোবা অকেজো দেশীয় বা বিদেশী অস্ত্র ও কিছু গুলি। সন্ত্রাসী নিহত হওয়ার সময় কখনো কখনো দুএকজন র‌্যাব সদস্য আহত হয়। 
র‌্যাব বাহীনি যখন সন্ত্রাসী মারতে শুরু করে তখনও অনেকেই বেশ উচ্ছাস প্রকাশ করেছিলো আবার অনেকে অসন্তোষ প্রকাশ করে। ঘটনাটা যেহেতু বিচার বহির্ভূত হত্যা তাই বেশিরভাগ মানুষই সেই হত্যাযজ্ঞ মেনে নিতে পারেনি। তবে ফলাফল যা হয়েছে তা হলো, দেশে নামী দামী সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ কমেছে, শান্তি ফিরেছে অনেকাংশে। আজ আর সেই কালা জাহাঙ্গীর, মুরগি মিলন, হাতকাটা মফিজ, গালকাটা কুদ্দুছ নাই। আর নতুন কোন পিচ্চি হান্নান, কষাই খালেক, বিচ্ছু বাহীনি সৃষ্টি হয়নি।
সন্ত্রাসী নির্মূল করতে করতে একসময় র‌্যাব খেই হারিয়ে ফেলে। সন্ত্রাসী নিধনের নামে নেমে পড়ে দমন নিপীড়নের দিকে। টাকার বিনিময়ে শুরু করে সাধারণ মানুষ হত্যা করে সন্ত্রাসী বলে চালিয়ে দেয়া এবং সেই একই প্রেসরিলিজ দেয়া। এর পর লাগাম টেনে ধরার জন্য সমাজের বিবেক আওয়াজ তুলতে থাকে। তার পর সরকারও র‌্যাবের লাগাম টানতে বাধ্য হয়। কোন কিছুই বেশি বাড়াবাড়ি ভালো নয়। সন্ত্রাসের বাড়াবাড়ি যেমন ভালো নয় তেমনি সন্ত্রাস নিধনের নামে সাধারণ নিরপরাধ মানুষ মারাও ভালো নয়।
দেশে মাদক ব্যবসা ও ব্যবহার বেড়েছে ভয়াবহ হারে। দীর্ঘ ডালপালা বৃদ্ধির পর মানুষ যখন অতিষ্ট তখনই রাষ্ট্রযন্ত্র নড়েচড়ে বসেছে। ঘোষণা করেছে যুদ্ধ। সপ্তাহের মধ্যে যখন অর্ধশত মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয় তার সাথে দুএকজন নিরপরাধ মানুষ মারা পরে তখন সবাই আবার নড়েচড়ে বসছেন। সভা সেমিনার করে প্রতিবাদ করছে এই হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে। আজকের এই মাদক বিরোধী অভিযান কয়েকদিনের মধ্যেই হয়ে যাবে অনেক অসহায় পরিবারের কান্নার কারন। যেভাবে সন্ত্রাস দমন অভিযান হয়েছিলো অনেক সাধারণ মানুষের কান্নার কারন। তাই মানবাধিকার কর্মী, বিরোধী মতের মানুষ সকলের কাছে এতটা উদ্ব্যেগের বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে আজকের মাদক বিরোধী অভিযান। শুরু হয়েছে মাদক নিয়ে মাতামাতি আর ধরপাকড়ের সময়, ক্রসফায়ারের সময় হাতাহাতি!
মাদক ব্যবসায়ী হত্যার কারনে আরো একটা প্রশ্ন উঠে এসেছে তা হলো, এভাবে ব্যবসায়ী নিধণ করলে মূল হোতাদের ধরা যাবে না। এসব ব্যবসায়ীদের যদি বাঁচিয়ে রেখে তাদের কাছ থেকে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে মাদক ব্যবসার মূলে পৌছানো যেতো তবেই মূল উৎপাটন সম্ভব হতো। প্রমান না থাকলেও আমরা যাদের প্রভাবশালী মাদক স¤্রাট বলে জানি তাদের তো ধরা সম্ভব হচ্ছে না বা হবেও না। তারা তো পৌঁছে গেছে সমাজ হতে সংসদে! তারা কেউ সিআইপি, কেউ ভিআইপি, কেউ নেতা, কেউ অভিনেতা, কেউ পরিচালক, কেউ প্রযোজক। মাদক ব্যবসায়ী ধরার পর আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উচু সারির কর্তা ব্যক্তিদের ফোনে ছেড়ে দেয়ার কথাও আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারি কিন্তু এর তো কোন প্রমান নেই। অনেক পুলিশের সদস্য মাদক পাচারের কাজ করে, প্রশাসনের অনেক লোক মাদক সেবন ও কেনা বেচার সাথে জড়িত, পুলিশ মাদক বিক্রেতাদের কাছ থেকে বখড়া তোলে এসবের কোন প্রমান নেই। প্রমানের অভাবে কর্তাদের যেমন ধরা যায় না তেমনি প্রমানের অভাবে কিছু লোক ধরার পরও তাদের আটক রাখা যায় না। প্রমান না থাকলেই কি তাদের অপরাধকে অস্বীকার করা যায়? তখন দোষ দেয়া হয় বিচার বিভাগকে, আর বিচার বিভাগসহ অন্যরা দোষ দেয় আইনজীবীদের। অথচ এমন ঘটনাও আছে যে, ইয়াবা তো দুরের কথা যে বৃদ্ধ পরিবার পরিকল্পনায় ব্যবহৃত মায়া বড়ি চিনে না তাকেও পুলিশ ইয়াবা দিয়ে চালান দেয়। এমন দোকনদার আছে যে কিনা মাদকের সাথে জড়িত নয় কিন্তু মামাতো ভাইয়ের সাথে তার মায়ের পৈত্রিক ওয়ারিশ হিসাবে পাওয়া জমি নিয়ে বিরোধের কারনে ডিবিকে ত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে ঐ যুবকের দোকানে ইয়াবা রেখে ধরার চেষ্টা করে এবং ধরিয়ে দেয়। এমন নিরপরাধ ব্যক্তির জন্য যদি সমাজের বিবেকবান মানুষ এবং আইনজীবীরা না দাড়ায় তবে কারা দাড়াবে? আর আইনজীবীরা তো আইনের চর্চা করে। কোন অপরাধির পক্ষে দাড়ানো যাবে না এমন তো কোন বিধান নেই। অপরাধি যাতে তার অপরাধের বেশি শাস্তি না পায় সেই চেষ্টাই আইনজীবী করেন। সেখানে রাষ্ট্র প্রণিত আইনের মধ্যে থেকেই আইনজীবী কাজটা করে থাকেন। প্রসিকিউশন কেন বার বার অপরাধ প্রমানে ব্যর্থ হন সেই কথা কেউ বলেন না। 
সব শেষে একটা কথা বলেই শেষ করবো তা হলো, মাদক নির্মূল যুদ্ধ ঘোষণা করে শেষ করা যাবে না। জনসচেতনতা, পারিবারিক বন্ধন, সামাজিকতার ও সাংস্কৃতির চর্চা, খেলাধুলার চর্চা, পাঠভ্যাস গড়ে তোলা, প্রসিকিউশনের যথাযথ পদক্ষেপ, পুলিশের সঠিক তদন্ত পূর্বক অপরাধের প্রতিবেদন তৈরী, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর যথাযথ ও আন্তরিক নজরদারীই পারে মাদক মুক্ত সমাজ গড়তে।


-----------------------------------------------------



কষ্ট করে ধরা আসামী বিচারক ছাড়ে আইনজীবীরা ছাড়ায়!

পুলিশ কত কষ্ট করে মাকদ সেবী ও মাদক ব্যবসায়ী ধরে। আর আদালতে সোপর্দ করার পর বিজ্ঞ বিচারক ছেড়ে দেয়-জামিন দিয়ে দেয় আর আইনজীবীরা ছাড়িয়ে আনে-জামিনে মুক্ত করে। পুলিশের এই অভিযোগ দীর্ঘদিনের! শুধু যে পুলিশের তা কিন্তু নয়! অনেক সময় সাধারণ মানুষেরও! আর বিচার বিভাগও মাঝেমাঝে মনে করে আইনজীবীরা ছাড়িয়ে নিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা কোথায় সেটা কেউ বিচার বিবেচনা করে না। 
আমি একজন আইনজীবী। অনেকেই হয়তো ভাববেন আমিতো আইনজীবীদের পক্ষেই যুক্তি দেব। জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা শরীয়তপুর জেলা শাখার একজন প্যানেল আইনজীবী হিসাবে দীর্ঘদিন যাবৎ কাজ করার কারনে কয়েকটা মাদক মামলা পরিচালনা করেছি। সবগুলো মামলাই গরীব দুঃখীর মামলা। মামলা করতে যেয়ে মোয়াক্কেলের কাছ থেকে কোন টাকা পাইনি, উপরন্তু সরকারের পক্ষ থেকে যে ফি দেয়া হয় তা তুলতেও চেষ্টা করিনি। তোলার ক্ষেত্রে মুলার চেয়ে ধেড়া বেশি মনে হয় তাই বিল করিনি। কয়েকটা কেস স্টাডি দেই। পড়ে বিবেচনা করবেন আসলে আইনজীবীদের দায় কতটুকু?
কেস স্টাডি-১॥ দুই মাদক সেবী কাম ব্যবসায়ী ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে। একজন পুরুষ আরেকজন নারী। একে অপরের স্বামী-স্ত্রী তারা। এ দুজন থাকে সরকারের আনুকুল্যে গড়া গুচ্ছ গ্রামে। স্বামী-স্ত্রী একসাথে গাজা খায় এবং বিক্রি করে। হতদরিদ্র পরিবার। ধরা খাওয়ার পর নিজেদের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ করে জামিন চাওয়া সম্ভব হয়নি। জেল কর্তৃপক্ষ বসিয়ে খাওয়াতে খাওয়াতে ক্লান্ত। তার উপর জেলা লিগ্যাল এইড কমিটি কারাগার পরিদর্শন করতে গেলে কান্নাকাটি করে। জেল কর্তৃপক্ষ মামলা লিগ্যাল এইডে পাঠালে মামলার আইনজীবী নিয়োগ করলো আমাকে। আমি জামিন চাইলাম। বিজ্ঞ বিচারক জামিন দিলেন। জামিন পাওয়ার পর হাজিরা দিতে আসলে বিজ্ঞ বিচারক জানতে চাইলেন, গাজা খান কেন? উত্তরে গাজাখোর দম্পতি জানালো, স্যার, ক্যানভাচারের কাম করি। খাইতে খাইতে নেশা হইয়া গেছে। এখন আর ছাড়তে পারি না। খাইতে খাইতে টুকটাক বিক্রিও করি। কথা শুনে বিজ্ঞ বিচারক শাষিয়ে দিলেন, আর খাবেন না এবং বিক্রির অপরাধও করবেন না। দম্পতি মাথা নেড়ে সায় জানালো। কিন্তু কে শোনে কার কথা? কদিন পরে আবার ধরা খেলো। কষ্টে ধরা আসামী গাজা খাওয়ার অপরাধে আর কদিনই বা জেলে রাখা যায়? ছেড়ে দিতে হলো!
কেস স্টাডি-২॥ গাজাখোর দম্পতির মতো আরেক গাজাখোরকে পুলিশ ধরে আনলো। একই পদ্ধতিতে মামলাটা আমার কাছে আসে। এবারের আসামীর বিশেষত্ব হলো সে কানা। একজন অন্ধ মানুষ গাজা খায় ভাবা যায়? তাকেও জামিনে মুক্ত করলাম। জামিন শুনানীর সময় বিজ্ঞ বিচারক জিজ্ঞেস করলেন, গাজা খান কেন? সহজ সরল উত্তর দিলো, স্যার, একটু গান বাজনা করিতো। গাজা না খাইলে গান গাইতে পারি না। অন্ধ গাজাখোর ছিলো বয়াতী টাইপের লোক। বিজ্ঞ বিচারক বললেন, গাজা খাওয়া ছেড়ে দিতে হবে। উত্তরে আসামী বলে, স্যার তাইলে গান বাজনা ছাইড়া দিতে হইবো। অনেক চেষ্টা করছি কিন্তু গানও ছাড়তে পারি না গাজাও ছাড়তে পারি না। সেই অন্ধ গাজাখোরও একাধিকবার ধরা খেয়েছে। হাজতে রেখে জেল কর্তৃপক্ষও বিরক্ত। এবারও পুলিশের কষ্টে ধরা আসামী ছাড়া পেয়ে গেলো।
কেস স্টাডি-৩॥ সরকারী চাকুরী করে এমন এক গাজাখোর ধরা পরলো। ছোট পদের চাকুরীজীবি। সারাদিন অফিসে কাজ কর্ম করে। বিকালে, ছুটির দিনে ছুটে যায় গাজার টানে। একা একা খায় না। তার গাজার সঙ্গী পুলিশের এক পুত্র। একদিন পুলিশ পুত্রের সাথে গাজা খেয়ে ফিরছিলো। মটর সাইকেল ড্রাইভ করছে পুলিশ পুত্র। পিছনে সঙ্গী গাজাখোর। টহল পুলিশ গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি করলো। গাজা পাওয়া গেলো কয়েক পুড়িয়া। আর পুলিশ পুত্রকে বাদ দিয়ে সেই ছোট সরকারী কর্মচারীকে দিলো জেলে পুড়িয়া! কয়েকদিন জেল খেটে জামিনে বেরিয়ে এলো। বেরিয়ে আবার সেই পুলিশ পুত্র বন্ধুটির সাথে গাজা খাওয়া। দুই গাজাখোরকে কষ্ট করে ধরে একজনকে দিলো জেলে!
কেস স্টাডি-৪॥ ছোট্র একটা ফটোকপির দোকান করে জীবীকা নির্বাহ করে এক যুবক। হঠাৎ এক দুপুরে ডিবি পুলিশের একটি টিম এসে দোকানের সামনের দিকে রাখা একটা নির্দিষ্ট ফাইল চাইলো। দোকানি বললো এই ফাইল বিক্রির জন্য নয়। একজন রেখে গেছে। ডিবির চৌকষ দল অন্য কোন ফাইল নয় ঐ ফাইলই চাইলো। এর পর ফাইল খুলে পাওয়া গেলো কয়েক পিস ইয়াবা ট্যাবলেট। ধরে নিয়ে যাবে ছেলেটিকে। এমন সময় স্থানীয় লোকজন ডিবির টিমকে আটকালো। জানতে চাইলো ঘটনা কি। অবশেষে বেরিয়ে এলো প্রকৃত ঘটনা। ছেলেটির মামাতো ভাইর সাথে ফরায়েজের জমি নিয়ে বিরোধ। ত্রিশ হাজার টাকায় দফারফা করে ঘটনার নক্সা আকা হয়। যে ছেলে ফাইলটি রেখেছিলো সেই ছেলেটি বাইরে ডিবির এক কনস্টেবলের সাথে কথা বলছে দেখে স্থানীয় লোকজন তাকে ধরে আনলো। পরে তার স্বীকারোক্তি অনুযায় ঘটনা বেরিয়ে এলে ডিবি পরিত্যাক্ত অবস্থায় ইয়াবাগুলো উদ্ধার দেখিয়ে ছেলেটিকে রেখে চলে যেতে বাধ্য হলো। কষ্ট করে ধরা আসামী আর নেয়া হলো না আদালত পর্যন্ত!
কেস স্টাডি-৫॥ এই মামলাটা আমার নয়। জজ কোর্টে এক আসামীর জামিন শুনানী চলছিলো। এক বৃদ্ধকে ডিবি পুলিশ ইয়াবা সহ আটক করে আইনের হাতে সোপর্দ করেছে। এমন বৃদ্ধ যে ঘটনা জানার জন্য বিজ্ঞ বিচারক তাকে নানাভাবে প্রশ্ন করে জানতে চাইলো প্রকৃত ঘটনা কি? বৃদ্ধের কথা শুনে বিজ্ঞ বিচারক সন্তুষ্ট হয়ে জামিন মঞ্জুর করে পুলিশকে ভৎসনা দিলো। আসামি এমনই বৃদ্ধ এবং সহজ সরল গ্রাম্য লোক যে কিনা মায়া বড়িও চিনে না, জীবনে একটা সিগারেটেও টান দেয়নি। অথচ এমন এক বৃদ্ধকে প্রতিপক্ষের দারা প্রভাবিত হয়ে ইয়াবা দিয়ে চালান দিয়েছে। এবারও পুলিশের কষ্টে ধরা আসামী ছাড়া পেয়ে গেলো!
একবার আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে সদস্য পদে নির্বাচিত হয়ে সপথ নেয়ার জন্য অনুষ্ঠানে বসে আছি। নির্বাচন পরবর্তী নবগঠিত কমিটিকে শপথ পাঠ করার বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রন পান জেলার জজশীপের অন্য বিচারকগণ, জেলা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি, পুলিশ সুপার সহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। উক্ত অনুষ্ঠানে স্বঘোষিত কবি এবং পুলিশ সুপার উপস্থিত হয়ে তার ভাষনে বিজ্ঞ বিচারকদের অনুরোধ করলেন মাদক ব্যবসায়ীদের জামিন না দিতে এবং আইনজীবীদের অনুরোধ করলেন মাদকের আসামি ধরা পরার পর অন্তত তিন মাস জামিন না চাওয়ার জন্য। তিনি বললেন, এত কষ্ট করে পুলিশ মাদকের আসামীদের ধরে আনে আর বিচারকরা যদি জামিন দিয়ে দেন এবং আইনজীবীরা যদি জামিন চান তবে তাদের কষ্ট বৃথা যায়!
তার কথামত যদি জামিন না চাই তবে যাদের সাথে অবিচারগুলো হয় তাদের কি অবস্থা হবে? পুলিশের ধারনা দেখে মনে হয় মাদক বিস্তারে যেন আইনজীবীরাই বড় নিয়ামক এবং মাদক বিস্তার রোধে আইনজীবীরাই বড় বাধা! অথচ কোথায় কোথায় মাদক বিক্রি হয়, কারা কারা মাদক সেবন ও বিক্রির সাথে জড়িত তা সমাজের সবাই জানে শুধু জানে না পুলিশ!
মাদক নির্মূলে পুলিশের ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে আমার কাছে মনে হয়। ক্রসফায়ার দিয়ে বা জামিন না দিয়েই মাদক প্রতিরোধ করা যাবে না। আসুন মাদক প্রতিরোধে সচ্ছতার সাথে আন্তরিক হয়ে চেষ্টা করি।


-----------------------------------------------------



মাদক মুক্ত সমাজ গড়ার সহজ পদ্ধতি ॥ প্রয়োজনে রেশন প্রথা চালু করুন!

বর্তমান সমাজে একটি বিষয় নিয়ে বেশ অস্থিরতা চলছে। সবাই মাদক নির্মূলে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বিষয়টা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। মাদক নির্মূলে যুদ্ধ বিগ্রহের কোন প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ ভাবেই এই সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব। শুধু প্রয়োজন প্রশাসনের আন্তরিকতা এবং জনগণের একান্ত আন্তরিক সহযোগীতা।
আমাদের দেশে বহুল পরিচিত মাদকের মধ্যে আছে গাজা, ইয়াবা, ফেন্সিডিল, হেরোইন, মদ, বিয়ার ইত্যাদি। তবে মদ বিয়ার একটু অভিজাত মাদক। কারন এটা যেহেতু লাইসেন্সধারী ব্যক্তিরা বিক্রি করতে পারে এবং লাইসেন্সধারীরা সেবনও করতে পারে তাই এটাকে মাদকের তালিকায় ফেলে লাভ কি? যাহোক, যে বিষয়ে কথা বলছিলাম সে বিষয়ে যাই।
আমরা যদি মাদক মুক্ত সমাজ গড়তে চাই তবে প্রশাসন বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা আন্তরিকতার সাথে স্বস্ব এলাকায় কারা মাদক সেবন করে তাদের খুজে বের করতে পারেন। মাদক সেবীদের সম্মানের সাথে ধরে এনে প্রয়োজনে মাদক খাইয়ে এবং বিশেষ প্রয়োজনে চাপ ও ভয় প্রয়োগ করে তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন যে, তারা কোথা থেকে মাদক সংগ্রহ করেন।
প্রাথমিক ভাবে পাওয়া যাবে তারা কোথা থেকে মাদক সংগ্রহ করেন। এর পর একটু আন্তরিকতার সাথে সেই মাদক বিক্রেতাদের ধরতে পারেন। তাদের ধরে তথ্য সংগ্রহ করুন তারা কোথা থেকে মাদক আনেন। এতে কর্মকর্তা বা কর্তৃপক্ষ খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে পেয়ে যাবেন তাদের কাছে কারা সরবরাহ করে সেই তথ্য। 
এবার খুচরা বিক্রেতাদের সরবরাহকারীদের ধরে তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে তাদের মূল ডিলার বা সরবরাহকারী কারা। এভাবে সেই মুল ডিলার ধরে খোজ নিতে হবে মূল ডিলাররা কোথা থেকে মাদক সংগ্রহ করেন। এভাবে পেয়ে যাবেন ডিলারদের কাছে সরবরাহকারী গডফাদারদের।
এবার গডফাদারদের ধরে খোজ নেন তারা কোন উৎস থেকে মাদক আনেন দেশে। কোন কোন রুট ব্যবহার করেন, কিভাবে আনে, সেই সম্পর্কে নানান তথ্য সংগ্রহ করে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ছিদ্রগুলো বন্ধে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করা।
প্রথমে গাছের পাতাগুলো ধরে নেমে পড়েন ডালপালায়। ডালপালা থেকে ধরুন মূল গাছকে। এর পর গাছ ধরে নেমে পড়–ন গাছের গোড়ায়। গোড়ায় গিয়ে খুড়ে ফেলুন। পেয়ে যাবেন শিকড়। শিকড় উপড়ে ফেলুন। দেখবেন গাছও নেই তার পাতাও নেই।
আমার এই পদ্ধতি হচ্ছে অহিংস পদ্ধতি। নির্লোভ কর্তাব্যক্তিরাই পারে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে সমূলে মাদক নির্মূল করতে। এই পদ্ধতিতে যারা থাকবে তারা হতে হবে ধোয়া তুলসি পাতার চেয়েও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। তবেই হবে দেশ মাদক মুক্ত। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি প্রশাসন আন্তরিক হলে দেশে একফোটা মাদকও থাকবে না।
কিন্তু আমার এ কথা অরণ্যে রোদন ছাড়া কিছুই না। আমি সেটা জানি। দেশে পুলিশ মাদক ব্যবসা হতে হপ্তা বা মাসোহারা তোলে, বর্ডারের দায়িত্বে থাকা কর্মীরা টাকার বিনিময়ে মাদকের চালান ছেড়ে দেয়। টাকার বিনিময়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল জেলখানায়ও মাদক সহজলভ্য। নিরপরাধ মানুষকেও টাকার বিনিময়ে মাদক দিয়ে ফাসিয়ে দেয়া হয়, ক্রসফায়ার দেয়া হয়।
যারা পুরাতন ইমারতের কোনায় বসে মাদক সেবন করে তাদের ধরতে ব্যস্ত হই। অথচ বড়বড় কর্তাব্যক্তিরা, সমাজের উচু স্তরের লোকেরা নিভু নিভু আলো জ্বালিয়ে টেবিলে টেবিলে চিয়ার্স ধ্বণি দিয়ে মদ বিয়ার পান করে তাদের কোন দোষ নেই। দু’পেগ গলায় ঢেলে যারা মাদক নির্মূল অভিযানে নামে তাদের দিয়ে কি মাদক নির্মূল হবে। স্বচ্ছ সমাজ গঠনে প্রয়োজন স্বচ্ছ নাগরিক, স্বচ্ছ দায়িত্বশীল কর্মকর্তা, প্রশাসন আমাদের তা আছে কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতু নয় কি?
মাদক নির্মূলে বিকল্প একটা পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। হাস্যকর ও ধর্মীয় বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হলেও এটাও একধরণের ব্যবস্থা হতে পারে। ইয়াবা, গাজা, ফেনসিডিল, হেরোইন সহ অন্য মাদকগুলো যেহেতু বেশি ভয়াবহ তাই মদ ও বিয়ার সহজলভ্য করা উচিত! মদ ও বিয়ার যেহেতু পান করলে কোন সমস্যা নাই তাই নির্দিষ্ট ক্যাটাগরির লোকদের জন্য যোগ্যতা অনুসারে এগুলো খাওয়ার অনুমতি প্রদান করলে আর লুকোচুরি থাকবে না। ঢাকায় যারা মদ ও বিয়ার খাচ্ছে তাদের কি কোন ক্ষতি হচ্ছে না? মদ ও বিয়ার নেশার দ্রব্য। নেশা খাবি খা, মইরা যাবি যা। 
যেমন সিগারেট ক্ষতিকর এ সত্য প্রতিষ্ঠিত জেনেও সরকার সারা দেশে সিগারেট বিক্রি অবাধ করেছে তেমনি মদ ও বিয়ার অবাধ করে দিক! এক্ষেত্রে বিপুল রাজস্ব আহরণের সুযোগ হবে। মোটা টাকা কর ধার্য করে বাজারে ছেড়ে দিলে যার টাকা আছে সেটা অবশ্যই বৈধ পথে রোজগার করা টাকা সেই টাকা দিয়ে সে কিনে খাবে। সরকার বিপুল রাজস্ব ঘাটতি পূরণ করবে এই খাত থেকে যেমনটা পুরণ হয় সিগারেট-তামাকজাত দ্রব্য থেকে। প্রয়োজনে রেশনের মাধ্যমে মদ-বিয়ার সরবরাহ শুরু করুক। আর যদি সিগারেট-মদ-বিয়ার এগুলোও ক্ষতিকর নেশা দ্রব্য বিবেচিত হয় তবে এগুলোও নিষিদ্ধ করা হোক। কোন নেশাদ্রব্যই থাকবে না সমাজে।
ক্রসফায়ার দিয়ে মাদক বন্ধ করা যাবে না। এটা আমি নিশ্চিত করে বলে দিতে পারি। নেশার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা মানে কোন কোন কর্তৃপক্ষকে টাকা কামানোর সুযোগ করে দেয়া ছাড়া আর কিছুই না। গ্রেফতারের পর কারো কারো কাছ থেকে টাকা নিয়েছে আবার কারো কারো কাছ থেকে টাকা নিয়েও ক্রসফায়ারে দিয়েছে এমন অভিযোগও পাচ্ছি। তাই আসুন মাদক নির্মূলে সক্রিয় কোন পদ্ধতি খুজে বের করি। সমাজকে মাদক মুক্ত করি।



-----------------------------------------------------


বিচার বহির্ভূত হত্যা ॥ ভয় হয়, প্রেস রিলিজের বিষয় হতে পারেন আপনিও!

বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড যুগে যুগে সংঘটিত হয়ে আসছে। এ ধরনের হত্যাকান্ড আজ নতুন কিছু নয়। তবে আগে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড নিয়ে মানুষ এত মাতামাতি করতো না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মিডিয়ার কারনে মানুষের হাতের মুঠোয় মূহুর্তের মধ্যেই চলে যায় তথ্য। আবেগী মন সেই তথ্য ঘাটাঘাটি করে, সমালোচনা করে, আলোচনা করে, বিশ্বাস করে, কেউবা অবিশ্বাস করে, করে তথ্যের পোষ্টমর্টেম। মানুষ এখন আগের থেকে অনেক বেশি সচেতন এবং শিক্ষিত। তাই ইচ্ছে করলেই মানুষকে যা-তা খাওয়ানো যায় না।
আমরা সবাই জানি, বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড হচ্ছে এক প্রকার বেআইনী হত্যাকান্ড যা সাধারণত রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক, সামাজিক ব্যক্তিত্ত্ব, বা অপরাধীকে রাষ্ট্রপ্রদত্ত আইনত বিচারের পূর্বেই হত্যা করা হয়। কিন্তু আমাদের সংবিধান এধরনের হত্যাকান্ড কখনোই অনুমোদন দেয়নি। সংবিধানের কিছু বিষয় বুঝতে রকেট সাইন্স বুঝার মত জ্ঞান প্রয়োজন নেই। সাধারণ কথাগুলো সাধারণভাবেই বুঝা যায়। কিন্তু সরকার কেন যে বুঝতে চায় না সেটাই মাথায় ধরে না। মৌলিক অধিকার পরিপন্থি আরো অনেক কাজ’ই সরকার করে থাকে সেটা যে দলই ক্ষমতায় থাক না কেন। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যখন সরকারের আসনে বসে তখন জনগণকে তুচ্ছ মনে করে কাজগুলো করে থাকে। আর অন্যান্য দল বিরোধী আসনে বসে নীতি নৈতিকতার বুলি ছোড়ে গোলার মত। তখন তাদের পূর্বের কৃত কর্মের কথা মনে থাকে না।
বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড একটা মৌলিক অধিকার পরিপন্থি কাজ। সংবিধানে মৌলিক অধিকার কি তা এখন গুগলে সার্চ দিলেই চলে আসে হাতের মুঠোয়। সংবিধানে মৌলিক অধিকারের কিছু বিষয় তুলে ধরছি যা আমাদের অনেকেরই হয়তো জানা আছে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে উল্লেখ আছে মৌলিক অধিকার সম্পর্কেঃ
আইনের দৃষ্টিতে সমতাঃ ২৭। সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।
আইনের আশ্রয়লাভের অধিকারঃ ৩১। আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহারলাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষতঃ আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।
জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকার রক্ষণঃ ৩২। আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।
গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচঃ ৩৩। (১) গ্রেপ্তারকৃত কোন ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাঁহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাঁহার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না। 
২) গ্রেপ্তারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে গ্রেপ্তারের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের স্থান হইতে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আনয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ব্যতিরেকে হাজির করা হইবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত তাঁহাকে তদতিরিক্তকাল প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না। 
৩) এই অনুচ্ছেদের (১) ও (২) দফার কোন কিছুই সেই ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হইবে না, 
ক) যিনি বর্তমান সময়ের জন্য বিদেশী শত্রু, অথবা 
খ) যাঁহাকে নিবর্তনমূলক আটকের বিধান-সংবলিত কোন আইনের অধীন গ্রেপ্তার করা হইয়াছে বা আটক করা হইয়াছে। 
৪) নিবর্তনমূলক আটকের বিধান-সংবলিত কোন আইন কোন ব্যক্তিকে ছয় মাসের অধিককাল আটক রাখিবার ক্ষমতা প্রদান করিবে না যদি সুপ্রীম কোর্টের বিচারক রহিয়াছেন বা ছিলেন কিংবা সুপ্রীম কোর্টের বিচারকপদে নিয়োগলাভের যোগ্যতা রাখেন, এইরূপ দুইজন এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত একজন প্রবীণ কর্মচারীর সমন্বয়ে গঠিত কোন উপদেষ্টা-পর্ষদ্ উক্ত ছয় মাস অতিবাহিত হইবার পূর্বে তাঁহাকে উপস্থিত হইয়া বক্তব্য পেশ করিবার সুযোগদানের পর রিপোর্ট প্রদান না করিয়া থাকেন যে, পর্ষদের মতে উক্ত ব্যক্তিকে তদতিরিক্তকাল আটক রাখিবার পর্যাপ্ত কারণ রহিয়াছে। 
৫) নির্বতনমূলক আটকের বিধান-সংবলিত কোন আইনের অধীন প্রদত্ত আদেশ অনুযায়ী কোন ব্যক্তিকে আটক করা হইলে আদেশদানকারী কর্তৃপক্ষ তাঁহাকে যথাসম্ভব শীঘ্র আদেশদানের কারণ জ্ঞাপন করিবেন এবং উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে বক্তব্য-প্রকাশের জন্য তাঁহাকে যত সত্বর সম্ভব সুযোগদান করিবেনঃ তবে শর্ত থাকে যে, আদেশদানকারী কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় তথ্যাদি-প্রকাশ জনস্বার্থবিরোধী বলিয়া মনে হইলে অনুরূপ কর্তৃপক্ষ তাহা প্রকাশে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করিতে পারিবেন। 
৬) উপদেষ্টা-পর্ষদ কর্তৃক এই অনুচ্ছেদের (৪) দফার অধীন তদন্তের জন্য অনুসরণীয় পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নির্ধারণ করিতে পারিবেন।
বিচার ও দন্ড সম্পর্কে রক্ষণঃ ৩৫। (১) অপরাধের দায়যুক্ত কার্যসংঘটনকালে বলবৎ ছিল, এইরূপ আইন ভঙ্গ করিবার অপরাধ ব্যতীত কোন ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাইবে না এবং অপরাধ-সংঘটনকালে বলবৎ সেই আইনবলে যে দন্ড দেওয়া যাইতে পারিত, তাঁহাকে তাহার অধিক বা তাহা হইতে ভিন্ন দন্ড দেওয়া যাইবে না। 
(২) এক অপরাধের জন্য কোন ব্যক্তিকে একাধিকবার ফৌজদারীতে সোপর্দ ও দন্ডিত করা যাইবে না। 
(৩) ফৌজদারী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচারলাভের অধিকারী হইবেন। 
(৪) কোন অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাইবে না। 
(৫) কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দন্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না। 
(৬) প্রচলিত আইনে নির্দিষ্ট কোন দন্ড বা বিচারপদ্ধতি সম্পর্কিত কোন বিধানের প্রয়োগকে এই অনুচ্ছেদের (৩) বা (৫) দফার কোন কিছুই প্রভাবিত করিবে না।
সমাবেশের স্বাধীনতাঃ ৩৭। জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।
চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্-স্বাধীনতাঃ ৩৯। (১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল। 
২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে 
(ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং 
(খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।
আমাদের সংবিধান আমাদের কতটা অধিকার দিয়েছে তা উপরের লেখাগুলো পড়লেই বুঝা যায়। অথচ আমাদের মৌলিক অধিকার এখন এক যৌগিক অধিকারে পরিনত হয়েছে বা করেছে সরকার বাহাদুর। ১৯৭৫ সালে যখন বিচার বহির্ভূত হত্যা হতো তখন যে ফরমেটে প্রেস রিলিজ দেয়া হতো এখনও তার কোন ব্যাত্যয় ঘটেনি। সেই পূর্বের ছাপাকৃত ফরমেই মনে হয় প্রেস রিলিজ দেয়া হচ্ছে। ১৯৭৫ সালের ৩ জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে এমনই এক প্রেস রিলিজ ছাপা হয়েছিলো। 
শরীয়তপুরের এক সোনার ছেলে সিরাজ সিকদার। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সিরাজ সিকদার ছিলেন অকুতোভয় এক মুক্তিযোদ্ধা। বুদ্ধিদীপ্ত এ গেরিলা যোদ্ধার অসাধারণ ভূমিকা তাঁকে অমর ও অনুসরণীয় করে রেখেছে। বিপ্লব পাগল এ বীর গেরিলা যেমন যুদ্ধের মাঠে ছিলেন ভয়হীন, তেমনি রাজনৈতিক তত্ত্ব অধ্যয়ন-গবেষণা পরিচালনা করা, শ্রমিক-কৃষকের মাঝে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলা এবং তাতে নেতৃত্ব দেয়া খুব অল্প বয়সেই তিনি রপ্ত করেছিলেন। সেই সিরাজ সিকদার ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামে গ্রেফতার হন এবং পরদিন ২ জানুয়ারি গভীর রাতে তাঁকে হত্যা করা হয়। যদিও হত্যাকান্ডের ১৭ বছর পর ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুন এই বিষয়ে আদালতে মামলা করা হয়। সেই মামলা এখনো বিচারাধীন। কিন্তু হত্যার পর প্রেস রিলিজে যা লেখা ছিলো তা দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশ পায়। দৈনিক ইত্তেফাকের সেই নিউজটি পড়লেই দেখবেন আজকের প্রেস রিলিজের সাথে কোন পার্থক্য নেই।
“গ্রেফতারের পর পলায়নকালে পুলিশের গুলিতে সিরাজ সিকদার নিহত
গতকাল (বৃহস্পতিবার) শেষ রাত্রিতে প্রাপ্ত পুলিশের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় যে, ‘পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি’ নামে পরিচিত একটি গুপ্ত চরমপন্থী দলের প্রধান সিরাজুল হক সিকদার ওরফে সিরাজ সিকদারকে পুলিশ ১লা জানুয়ারি চট্টগ্রামে গ্রেফতার করেন। একই দিন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাহাকে ঢাকা পাঠানো হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি স্বীকারোক্তিমূলক এক বিবৃতি দেন এবং তাহার পার্টি কর্মীদের কয়েকটি গোপন আস্তানা এবং তাহাদের বেআইনি অস্ত্র ও গোলাবারুদ রাখার স্থানে পুলিশকে লইয়া যাইতে রাজী হন। সেইভাবে ২রা জানুয়ারি রাত্রে একটি পুলিশ ভ্যানে করিয়া তাহাকে ওইসব আস্তানার দিকে পুলিশ দল কর্তৃক লইয়া যাইবার সময় তিনি সাভারের কাছে ভ্যান হইতে লাফাইয়া পড়িয়া পলায়ন করিতে চেষ্টা করেন। তাহার পলায়ন রোধ করার জন্য পুলিশ দল গুলিবর্ষণ করিলে তত্ক্ষণাত্ ঘটনাস্থলেই তাহার মৃত্যু হয়। এ ব্যাপারে সাভারে একটি মামলা দায়ের করা হইয়াছে। ‘এখানে উল্লেখ করা যায় যে, সিরাজ সিকদার তাহার গুপ্ত দলে একদল দুর্বৃত্ত সংগ্রহ করিয়া তাহাদের সাহায্যে হিং¯্র কার্যকলাপ, গুপ্তহত্যা, থানার উপর হামলা, বন অফিস, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ইত্যাদির উপর হামলা, ব্যাংক, হাটবাজার লুট, লঞ্চ ট্রেন ডাকাতি, রেল লাইন তুলিয়া ফেলার দরুন গুরুতর ট্রেন দুর্ঘটনা, লোকজনের কাছ হইতে জোর করিয়া অর্থ আদায়ের মতো কার্যকলাপের মাধ্যমে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করিয়া আসিতেছিলেন।’”
আমাদের দেশে বিগত প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ‘ক্রসফায়ারে মৃত্যু’ শব্দটি পরিচিতি লাভ করেছে। প্রতিটি ক্রসফায়ারে মৃত্যু পরবর্তী শৃঙ্খলা বাহিনী অথবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা থেকে একই ধরণের বক্তব্য দেয়া হয়। আর বক্তব্যটি হলো আটক পরবর্তী পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলির কারণে মৃত্যু ঘটেছে অথবা আটক ব্যক্তিকে নিয়ে তার দেখানো মতে অস্ত্র উদ্ধারে গেলে তার অনুগত বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হওয়া পরবর্তী আত্মরক্ষার্থে গুলি ছুড়লে মৃত্যু হয়েছে। এ নাটকের একটাই কাহিনী শুধু কুশিলবের পরিবর্তন ঘটেথাকে। এ ধরণের মৃত্যুকে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড বলা হয় এবং যে কোন সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশের জন্য এ ধরণের হত্যাকান্ড চালানো বিচার বহির্ভূত এবং আইনবিরুদ্ধ। নরহত্যা গুরুতর ও নিকৃষ্ট ধরণের অপরাধ। দেশভেদে নরহত্যার সাজা মৃত্যুদন্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদন্ড। মৃত্যু ঘটানোর অভিপ্রায়ে কোন কার্য দ্বারা মৃত্যু ঘটানোকে দন্ডার্হ (ঈঁষঢ়ধনষব ঐড়সরপরফব) নরহত্যা বলা হয়। দন্ডার্হ নরহত্যাকে খুন হিসেবে গণ্য করা হয়। বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড আইন দ্বারা স্বীকৃত নয় বিধায় এটি দন্ডার্হ নরহত্যা অথবা খুন।
বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের ক্ষেত্রে যতক্ষণ পর্যন্ত বিশ্বাস জন্মানো না যাবে যে, মৃত্যু ঘটানোর অভিপ্রায়ে হত্যাকান্ড সংগঠিত হয়নি ততক্ষণ পর্যন্ত বিশ্বাস করার সঙ্গত কারণ থাকে যে, প্রকৃতই হত্যাকান্ডটি মৃত্যু ঘটানোর অভিপ্রায়ে সংগঠিত হয়েছে। আমাদের দেশে কমিউনিষ্ট নেতা সিরাজ শিকদার পুলিশ কর্তৃক গ্রেপ্তার হওয়ার পরের দিন পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় আটকাবস্থা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাকে গুলি করা হলে তার মৃত্যু ঘটে। সে সময়কার পুলিশের বক্তব্যটি দেশবাসীর কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়নি, যদিও তদানিন্তন প্রধানমন্ত্রী সিরাজ শিকদারের মৃত্যু পরবর্তী জাতীয় সংসদে দম্ভভরে বলেছিলেন- ‘কোথায় সিরাজ শিকদার?’ সিরাজ শিকদার বা তার বাহিনী কর্তৃক হত্যাকান্ড বা অপরাধ সংগঠিত হয়ে থাকলেও এ জন্য বিচার বহির্ভূতভাবে তাকে হত্যা আইনের শাসনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট ক্ষমতসীন হলে কোন এক অজানা কারণে শৃঙ্খলা বাহিনীর অর্ন্তভূক্ত সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ অভিযান পরিচালনা করা হয়। ওই অভিযানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত এবং কথিত সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত এমন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তিকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়। এ হত্যা পরবর্তী অপারেশন ক্লিন হার্ট কার্যক্রমকে দায়মোচন দেয়া হয় যেমন দায়মোচন দেয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ হত্যাকান্ড সংগঠন পরবর্তী।
আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন অধ্যাদেশ, ১৯৭৯ তে সংশোধনীর মাধ্যমে ২০০৩ সালে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) গঠন করা হয়। র‌্যাবে পুলিশ, সেনা, নৌ, বিমান বাহিনীর সদস্যরা অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। র‌্যাবকে অপরাধ তদন্তের ক্ষমতা দেয়া হলেও মামলা রুজু ও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের ক্ষেত্রে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দ্বারস্থ হতে হয়। তাছাড়া সংবিধান ও দেশের প্রচলিত আইনে যে বিধান রয়েছে সে বিধান অনুযায়ী র‌্যাব কর্তৃক গ্রেপ্তারের পর কোনরূপ কালক্ষেপণ না করে অপরাধীকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করাই সংবিধান ও প্রচলিত আইন। কিন্তু কয়টি ক্ষেত্রে হস্তান্তর করা হয় সে বিষয়ে দেশবাসী সন্ধিহান। ক্রসফায়ারে মৃত্যু ঘটানোর ব্যাপারে র‌্যাবের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ অনুরূপ অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধেও রয়েছে।
আমরা আগেই জেনেছি সংবিধানের ৩৩(২) অনুচ্ছেদ এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৬১ তে সুষ্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে, গ্রেপ্তারকৃত একজন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের ২৪ ঘন্টার মধ্যে যাত্রার সময় ব্যতিরেকে ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে হাজির করতে হবে। কিন্তু র‌্যাব বা পুলিশ কর্তৃক গ্রেপ্তার পরবর্তী যে সব ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে সে বিষয়ে নিহত ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজন, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন এবং পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় সংবিধানের ৩৩(২) অনুচ্ছেদ এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৬১ এর বাধ্যবাধকতা অনুসরণ না করেই অপরাধীদের এ দু’টি বাহিনী গ্রেপ্তারের সঠিক দিন-তারিখ গোপন রেখে ক্রসফায়ারে মৃত্যুর ঘটনা সংগঠনের প্রয়াস নিয়েছে।
পুলিশ, র‌্যাব, শৃঙ্খলা বাহিনী অথবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যে কোন সদস্য কোন অপরাধী বা তার অনুগত বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষার্থে কতটুকু শক্তি বা বল প্রয়োগ করতে পারবে তাও আইন দ্বারা নির্ধারিত। এ বিষয়ে দন্ডবিধির ধারা ৯৭-এ মনুষ্য দেহ ক্ষুন্নকারী যে কোন অপরাধের বিরুদ্ধে তার স্বীয় দেহ ও অন্য যে কোন ব্যক্তির দেহের প্রতিরক্ষার অধিকার দেয়া থাকলেও সে অধিকারের ব্যাপ্তি এতটুকু বিস্তৃত নয় যে, এ যাবৎকাল ক্রসফায়ারের নামে যে অসংখ্য হত্যাকান্ড সংগঠিত হয়েছে তাতে একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তিতে ক্রসফায়ারের যৌক্তিকতা ও গ্রহণযোগ্যতার সৃষ্টি হয়। আমাদের সংবিধান অনুযায়ী সেনা, নৌ, বিমানবাহিনী শৃঙ্খলা বাহিনীর অন্তর্ভূক্ত এবং এ তিনটি বাহিনী ব্যতীত অন্য কোন বাহিনীকে আইনী ঘোষণার মাধ্যমে শৃঙ্খলা বাহিনীর অর্šÍভূক্ত করা হলে সে বাহিনীটিও আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী হবে। অপরদিকে বিভিন্ন আইনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বলতে পুলিশ বাহিনী, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, আনসার বাহিনী, ব্যাটালিয়ন আনসার, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, কোস্ট গার্ড বাহিনী ও শৃঙ্খলা বাহিনীসমূহকে বুঝানো হয়েছে। উপরোক্ত ব্যাখ্যা থেকে দেখা যায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অন্তর্ভূক্ত সেনা, নৌ, বিমানবাহিনীর সদস্যরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অন্তর্ভূক্ত হলেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে অপরাপর বাহিনী যতক্ষণ পর্যন্ত আইন দ্বারা শৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে ঘোষিত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত এ সকল বাহিনী বা এর কোন একটি শৃঙ্খলা বাহিনী নয়।
আমাদের দেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের ব্যাপারে দেশের সচেতন নাগরিকসহ সুশীল সমাজ দীর্ঘদিন যাবৎ এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নিজ বক্তব্য তুলে ধরছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাসমূহের অবস্থান একই। বিগত বছরগুলোর ক্রসফায়ারের ঘটনা পর্যবেক্ষণে দেখা যায় একই ধরণের ঘটনা বিএনপি, সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় সংগঠিত হয়েছে এবং হচ্ছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এ দু’টি দল বিরোধী দলে থাকাবস্থায় একে অপরের শাসনামলে সংগঠিত ক্রসফায়ারে মৃত্যুর ব্যাপারে সোচ্চার থাকলেও ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় এরা কেউ এ ধরণের ঘটনা থেকে নিজেদের নিবৃত্ত রাখতে পারেনি।
দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণসহ সন্ত্রাসী ও অপরাধমূলক কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পুলিশের ওপর ন্যাস্ত। পুলিশ ব্যর্থ হলে অন্যান্য বাহিনীর সহায়তা নেয়ার বিধান থাকলেও তা কখনও পুলিশের মামলা রুজু ও অভিযোগপত্র দায়েরের ক্ষমতাকে খর্ব করে না। পুলিশ বাহিনীর সদস্যের মতো শৃঙ্খলা বাহিনী এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বাহিনীসমূহের প্রতিটি সদস্যের নিজ সম্পাদিত যে কোন কর্মের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতা রয়েছে। সরকারের প্রশ্রয়ে জবাবদিহিতায় শিথিলতার কারণে একই ব্যাখ্যার পুনরাবৃত্তিতে ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটে চলছে। এতে করে সরকারে থাকাকালীন বিরোধীদের দমন করার উদ্দেশ্যে নেয়া হলেও তাতে কি পূর্ণ সফলতা পাওয়া যায়? আর সে প্রশ্নে না গিয়ে বরং প্রশ্ন হতে পারে কেন এ বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড? তাছাড়া এখনকার সরকারী দল ও দলের নেতাকর্মী ক্ষমতা থেকে বিদায় পরবর্তী একই ঘটনার শিকার যে হবে না সে নিশ্চয়তা কোথায়? বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড বিনা বিচারে হত্যাকান্ডের সাথে তুল্য।
পোশাকধারী বা পোশাকবিহীন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য কর্তৃক বাড়ি অথবা যে কোন স্থান থেকে তুলে নিয়ে হত্যা ও গুমের ঘটনা সাম্প্রতিককালে ক্রসফায়ারের সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে। এ ধরণের হত্যাকান্ডও বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের অন্তর্ভূক্ত। ক্রসফায়ারের সাথে এ হত্যাকান্ডের পার্থক্য হলো ক্রসফায়ারের ক্ষেত্রে নিহত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন লাশটি ফিরে পেয়ে সৎকারের ব্যবস্থা করতে পারে যেটি গুমের ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। এমনকি তুলে নেয়া পরবর্তী লাশ ফেরত না পাওয়া গেলে নিহত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনদের দীর্ঘকাল এ ধারণাটি বদ্ধমূল থাকে যে, হয়তোবা তুলে নেয়া ব্যক্তি জীবিত রয়েছে। এ ধরণের ঘটনা যে কতটুকু বেদনাদায়ক তা ভূক্তভোগী পরিবারের সদস্য ছাড়া কেউই অনুভব করতে পারবে না। কোনো ব্যক্তি অপরাধী হিসেবে পুলিশসহ আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হেফাজতে থাকাকালীন মৃত্যু হলে এই মৃত্যুর সন্তোষজনক কারণ দেখাতে হবে এবং তার না পারলে তার দায়দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সদস্য বা সদস্যদের উপরই বর্তাবে।
বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডর দায় থেকে অব্যাহতি পেতে অপারেশন ক্লিন হার্ট কার্যক্রমকে দায়মোচন দেয়া হয় যেমন দায়মোচন দেয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ হত্যাকান্ড সংগঠন পরবর্তী। ১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ হত্যাকান্ড থেকে দায় এড়াতে হত্যাকারীদের দায়মোচন দেয়া হয়েছিলো। দীর্ঘদিন পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে সেই দায়মোচন ভেদ করে হত্যাকারীদের আইনের আওতায় এনে ঠিকই বিচার করেছিলো। বিচার প্রকৃয়ার মধ্যদিয়ে হত্যাকারীদের ফাসিতে ঝুলিয়ে জঘন্য কর্মের শাস্তি দেয়া হয় যা সকলের কাছে একটি প্রশংসনীয় কাজ বলে বিবেচিত হয়েছে। আমরা কে বলতে পারি যে আজকের বিচার বিভাগীয় হত্যার বিচার একদিন নিহতের সন্তান বা প্রজন্ম করবে না? 
বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড বন্ধ ও জবাবদিহিতার আওতায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আনতে না পারলে একদিন আপনিও হতে পারেন প্রেস রিলিজের অংশ। আজ আপনি ক্ষমতাবান কাল নাও থাকতে পারেন। তাই সংবিধানের মৌলিক অধিকার পরিপন্থি কাজ বন্ধ না করলে একদিন আপসোস করা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না আজকের ক্ষমতাবানদের। তাইতো ভয় হয়, কখন যে কে প্রেসরিলিজ হয়ে যাবেন তা কেউ জানি না।



-----------------------------------------------------



বাবার কষ্ট ও বাবা হওয়ার তৃপ্তি ॥ বাবা সেকালে ও একালে

আজ বাবা দিবস। আমি আনুষ্ঠানিক ভাবে এসব দিবস পালনে যদিও বিশ্বাসী নাই। তবুও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিবসের মাতামাতিতে কিছু লিখতে মন চাইলো। বাবা হওয়া অনেক তৃপ্তির পাশাপাশি বাবা হওয়া অনেক কষ্টেরও। বাবা সেকালে ও বাবা একালে কেমন অনুভূতি তাই শেয়ার করতে আজকের এ লেখা। বাবাকে ভালোবাসুন। বাবা আপনার আরেক সন্তান।   
বাবার আবিধানিক সংজ্ঞা খুজলে যা পাওয়া যায় তা হলো, পিতা একজন পুরুষ অভিভাবক হিসেবে যে কোন ধরনের সন্তানের জনক হিসেবে সংজ্ঞায়িত হয়ে থাকেন। তিনি যে কোন সন্তানের পুরুষ জন্মদাতা। মাতা পিতার বিপরীত লিঙ্গ। পিতার বিভিন্ন প্রতিশব্দ হলো-জনক, আব্বা, আব্বু, বাবা, বাজান, জন্মদাতা ইত্যাদি। হাল আমলে ড্যাডি থেকে ড্যাড হয়ে গেছে পিতা। তিনি সন্তানের জন্মদানের লক্ষ্যে এক্স (স্ত্রীলিঙ্গ) অথবা ওয়াই (পুংলিঙ্গ) ক্রোমোজোম ধারণকারী বীর্য স্বীয় স্ত্রীর জননতন্ত্রে প্রবেশ করান।
সংজ্ঞায় যাই থাকুক না কেন বাবা হওয়া সহজ কাজ না। স্ত্রীর প্রজননতন্ত্রে বীর্য প্রবেশ না ঘটিয়েও অনেকে বাবা হয় আবার ডজন খানেক সন্তান জন্ম দিয়ে কেউ কেউ বাবা হতে পারেন না। একজন বাবা বা অভিভাবক কোন কোন সময় হয়ে ওঠে সন্তানদের বাবা, কখনো সমাজের বাবা, কখনো রাষ্ট্রের বাবা, কখনোবা সারা জাহানের। প্রকৃত বাবা হতে মাথার ঘাম পায়েই শুধু নয় হাজার ত্যাগের বিনিময়ে হতে হয় বাবা। সন্তানের সুখের জন্য, নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার জন্য যুগে যুগে বাবারা নিজ নিজ স্বাধ, আহ্লাদ ত্যাগ করে নিজের সর্বস্ব দিয়ে হয়ে ওঠেন বাবা। তাইতো বাবাদের তুলনা শুধু বাবাই। বাবারা সর্বদা নিরবে নিভৃতে কাজ করে যায়। বাবাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশটা এতই কম যে আমরা বাবা না হওয়া পর্যন্ত সেটা অনুভব করতে পারি না। যখন অনুভব করি তখন হয়তো অনেকের বাবাই আর থাকে না। আমরা তখনই বাবার অবদানের কথা বুঝতে পারি যখন নিজে বাবা হয়ে যাই। 
একজন বাবা যখন সমাজকে একটি সুসন্তান উপহার দেয় তখনই বাবার তৃপ্তি আসে। কুসন্তানের জন্য বাবার চেষ্টার ত্রুটি থাকে না কিন্তু বেপরোয়া সন্তান কখনো কখনো কুসন্তানে পরিনত হয়, তখন তৃপ্তির পরিবর্তে বাবাকে কষ্টের গ্লানি ভোগ করতে হয়। একটা প্রবাদ শুনেছিলাম, পৃথিবীতে অনেক খারাপ পুরুষ পাওয়া যায় কিন্তু কখনো খারাপ বাবা পাওয়া যায় না। আর যদি পাওয়া যায় তবে সে কখনো বাবাই হয়নি বা ছিলো না। একজন বাবা হারভাঙ্গা খাটুনি করে বাড়ি ফিরে তা কখনো প্রকাশ করে না। তাইতো যুগে যুগে সন্তানরা বাবার হাতটাকে শক্ত করে ধরে রাখে অবলম্বন হিসাবে।    
প্রতিটি পুত্র সন্তান জন্ম নেয়ার পর পরই বাবা হিসাবে আবির্ভূত হয়। পিতা পরম আদরে সন্তানকে বাবা বলেই ডাকে। বাবা কত প্রিয় ডাক, কতটা আদরের ডাক তা বাবার মুখে বাবা ডাক শুনলেই অনুভব করা যায়। পরম আদরে পরিবারের রাখা নামটা বাবার কাছে শুধু কাগজেই থেকে যায়, পুত্র সন্তানটিকে বাবা বলেই ডাক দেয় পিতা। যখনই বাইরে থেকে আসবে সন্তান দৌড়ে যায় বাবার কাছে। কোন দিকে না তাকিয়ে কোলে তুলে নেয়, বাবা বাবা বলে, খোজ নেয় খেয়েছে কিনা, নেয়েছে কিনা, খেলেছে কিনা এমন হাজারো প্রশ্ন। কখনো দেখে না সন্তানের গায়ে ময়লা আছে কিনা। আস্তে আস্তে সেই সন্তান বড় করার লড়াই করে একাই। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী বস্তুু টাকার যোগান দিতে হীমসিম খায় তবুও অপারগতা প্রকাশের চেষ্টা পারতপক্ষে করে না। বাবার আনন্দ মিশে যায় সন্তানের আনন্দের মাঝে। এভাবেই একজন বাবা হয়ে ওঠে বাবা।   
সন্তান বড় হয়ে বিয়ে করে, সংসারী হয়। তখনো বাবার চিন্তা কমে না। এরপর সন্তানও একদিন সন্তানের বাবা হয়। এবার সন্তান বাবার মর্ম বুঝতে শিখে। বাবা বৃদ্ধ হলেও সন্তানের জন্য চিন্তা কমে না। কখন সন্তান বাড়ি ফিরলো, বাইরে বাইরে ঘোরে, কাজ করে ঠিকমত খেয়েছে কিনা, শরীরের প্রতি যতœ নিচ্ছে কিনা সেই খোঁজ নেয়। সন্তান যত বড়ই হোক বাবার কাছে সে যেন ছোটই। বাবা হওয়ার পর মৃত্যু পর্যন্ত বাবার চেষ্টা, বাবার চিন্তা, বাবার ভালোবাসা, বাবার দোয়া কখনো পরিবর্তন হয় না। তাইতো বাবারা বাবা। 
কষ্ট হয় যখন দেখি বাবারা বৃদ্ধাশ্রমে থাকে। কষ্ট হয় যখন বাবারা সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় দু’চোখের কোন বেয়ে অশ্রু ফোটা ঝড়ে পড়ে। কষ্ট হয় যখন বাবারা সন্তানের হাতে শারীরিক নির্যাতনের স্বীকার হয়। বাবাতো তাদের সাধ্য মত চেষ্টা করেছে সন্তানের জন্য। কিন্তু সন্তান বড় হয়ে কেন বাবা হতে পারলো না এ প্রশ্ন মনের মাঝে ঘুরপাক খায়। জন্মের পর থেকে যে সন্তানকে বাবা বাবা ডাকে বৃদ্ধ বয়সে সে সন্তান কেন বাবার জন্য বাবা হয়ে উঠতে পারে না তা মাথায় ধরে না। 
বাবাকে ভালোবাসুন। বাবাকে ভালোবাসার প্রতিদান আপনার সন্তান দেবে নিশ্চিত থাকুন। নিজ সন্তানকে ভালোবেসে আজ বাবা ডাকছেন, ভালোবাসছেন, আদর, যতœ, ¯েœহ করছেন। আপনিও যখন ছোট ছিলেন আপনার বাবাও আপনাকে বাবা ডেকেছেন, ভালোবাসেছেন, আদর, যতœ, ¯েœহ করেছেন। তাই তুচ্ছ বিষয়কে বড় করে দেখে বাবার প্রতি অবহেলা করা কোন মানব সন্তানের ঠিক হবে না। মানুষ বৃদ্ধ হলে শিশুর মত হয়ে যায় একথা আমরা সকলেই বলি এবং বিশ্বাস করি। তাহলে আপনার সন্তানকে ভালোবাসার সাথে সাথে বৃদ্ধ সন্তানটাকে অবহেলা করবেন কেন? সন্তান হারালে সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় সন্তান পাবেন কিন্তু বাবা হারালে জীবনে আর বাবা পাবেন না। তাই বাবা দিবসে সকল সন্তানের প্রতি আকুল আবেদন, বাবাকে ভালোবাসুন। বাবাকে বুঝান, বাবা আমি তোমার পাশে আছি, আমি তোমাকে ভালোবাসি, তুমি আমার বাবা, তুমি আমার আরেক সন্তান। 


-----------------------------------------------------


বিচার বিভাগ ও চিকিৎসা দু’ই আস্থার জায়গা ॥ বিতর্ক করলে আমাদেরই ক্ষতি

গত ৩০ জুন ২০১৮ তারিখে দেশের জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম একটি সংবাদ প্রচার করে যার শিরনাম ‘চট্টগ্রামে ভুল চিকিৎসায় শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ’। সংবাদটি প্রকাশের আগেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকটা ভাইরাল হয়ে যায়। একটি মাসুম শিশুর সাথে তার বাবার ছবি এবং পরবর্তীতে বাবার কোলে কাফনে মোড়া সেই মাসুম শিশু, কি হৃদয় বিদারক চিত্র সেটা ভাবা যায়? প্রবাদেই আছে, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে ভাড়ি বস্তু পিতার কাধে সন্তানের লাশ।’ তাই ছবি দেখে সকলেরই হৃদয় ভেঙ্গে চৌচির। এ মৃত্যু নিয়ে প্রতিবাদ, মানব বন্ধন, চিকিৎসক আটক করে কি হয়েছে? শুধু আস্থার জায়গায় ভাঙ্গন ধরেছে মাত্র। আস্থার জায়গা নিয়ে বিতর্ক করলে ক্ষতি হবে আমাদেরই।
বিচার বিভাগ ও চিকিৎসা সেবা দুটি স্পর্শকাতর বিষয়। দুটির উপরই আমাদের আস্থা রাখতে হয়। আমরা আমাদের দৈনন্দিন কাজে কর্মে যদি ক্ষুব্ধ হই, ক্ষতিগ্রস্থ হই তবে ছুটে যাই বিচার বিভাগের কাছে। আদালতে গিয়ে মামলা করি, বিচার চাই এবং বিচার পাই। বিচার কখনো কখনো কারো পছন্দ হয় আবার কারো পছন্দ হয় না। যার পক্ষে যায় বা পছন্দ হয় সে বলে ন্যায় বিচার পেয়েছি আর যার বিপক্ষে যায় বা পছন্দ হয় না সে বলে আমি ন্যায় বিচার পাইনি। ন্যায় বিচার পাইনি মনে হলে আবার সেই বিচারকের দাড়ে কড়া নাড়ি, উচ্চ আদালতে যাই, আপীল করি, রিভিশন করি, রিভিউ করি। আস্থার জায়গা বলেই না বার বার যাই, বার বার যেতে হয়।
অপর দিকে আমরা শারীরিক কোন সমস্যা হলেই চিকিৎসকের কাছে ছুটে যাই। চিকিৎসকরা আমাদের চিকিৎসা করেন, কখনো ভালো হই, কখনো হই না। ভালো না হলে আমরা আরো অভিজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই। চিকিৎসকরা তাদের মেধা, জ্ঞান উজার করে দিয়েই আমাদের জন্য লড়ে। কোন চিকিৎসকই চায় না তার রোগি ‘ভালো না হোক’। এটাও আমাদের একটা আস্থার জায়গা। আমাদের এই আস্থার জায়গাগুলোতে বার বার যেতে হয়। আস্থা হারালে আর কারো ক্ষতি না হলেও ক্ষতি হবে আমাদেরই। তাই আস্থার জায়গাগুলোকে ঢালাওভাবে কালিমা লেপন করে নষ্ট করা ঠিক না। 
সংবাদটিতে লেখা ছিলো-‘চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসায় আড়াই বছর বয়েসী এক শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। ম্যাক্স হাসপাতালে শুক্রবার গভীর রাতে শিশুটি মারা যাওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সকে পুলিশ ধরে থানায় নিলেও পরে ছেড়ে দেয়। শিশুটির মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। মারা যাওয়া শিশু রাইফা দৈনিক সমকালের চট্টগ্রাম ব্যুরোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রুবেল খানের মেয়ে।
রুবেল খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ঠান্ডা লেগে গলা ব্যথা করায় রাইফা খাওয়া বন্ধ করে দিলে বৃহস্পতিবার বিকালে ম্যাক্স হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় তাকে। ওই রাতে রাইফাকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হলে সে অস্বস্তি বোধ করে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা শিশু বিশেষজ্ঞকে কল দেওয়ার পরামর্শ দেন। এরপর শিশু বিশেষজ্ঞ বিধান বড়ুয়াও একই ধরনের ওষুধ দেন জানিয়ে রুবেল বলেন, রাতে ওই ওষুধ দেওয়ার পর থেকে রাইফার খিঁচুনি শুরু হয়। দায়িত্বরত চিকিৎসককে জানালে তিনি ডা. বিধান বড়ুয়ার সাথে কথা বলে ‘সেডিল’ ইনজেকশন পুশ করেন। এরপর রাইফা নিস্তেজ হয়ে যায়।
রুবেল খানের মেয়ের মারা যাওয়ার খবর পেয়ে রাতেই ম্যক্স হাসপাতালে ছুটে যান সাংবাদিকরা। তাদের প্রতিবাদের মুখে পুলিশ গিয়ে কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। খবর পেয়ে রাতে কয়েকজন সহযোগী নিয়ে থানায় উপস্থিত হন চিকিৎসকদের সংগঠন বিএমএ’র চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল ইকবাল। এরপর ভোরে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের পর আটক চিকিৎসক ও নার্সকে থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় বলে জানান চকবাজার থানার ওসি আবুল কালাম। 
চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়েনের (সিইউজে) সাধারণ সম্পাদক হাসান ফেরদৌস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সাংবাদিক, বিএমএ ও পুলিশের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের পর একটি পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনকে প্রধান করে গঠিত কমিটিতে বিএমএ প্রতিনিধি, সিইউজে প্রতিনিধি, বিএমএ ও সিইউজে’র পক্ষ থেকে একজন করে শিশু বিশেষজ্ঞ থাকবেন। আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে জানিয়ে হাসান ফেরদৌস বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
শিশুটির মৃত্যুর বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এই ঘটনার প্রতিবাদে মানববন্ধন করে তদন্তের মাধ্যমে ‘দোষী’ ব্যক্তিদের শাস্তি চেয়েছে সাংবাদিক সংগঠনগুলোর নেতারা। বিএমএ নেতা ফয়সাল ইকবালের আচরণের নিন্দা জানিয়েছেন তারা।
আমার পরিবারে সাড়ে তিন বছরের একটি কন্যা শিশু আছে। ও আমার অত্যন্ত আদরের সন্তান। আমি জানি সন্তানের প্রতি প্রতিটি মানুষের মমত্ববোধ ও ভালোবাসা কতটা গভীর হয়। প্রধান মন্ত্রীর সন্তান হোক আর সাংবাদিক রুবেলের সন্তান, চিকিৎসকের সন্তান হোক আর দিন মজুরের সন্তান, আইনজীবীর সন্তান হোক আর বিচারকের সন্তান সকল পিতা-মাতার কাছেই যার যার সন্তানের গুরুত্ব সমান। যে কোন মানুষ মারা গেলেই মানুষের হৃদয় কাদে, তা যদি হয় ফুটফুটে শিশু তাহলে তো কথাই নেই। তাই সাংবাদিক রুবেলের কন্যা রাইফার মৃত্যু সকলকে কাদিয়েছে। সাংবাদিক রুবেলের কন্যার মৃত্যুতে আমাদের সমবেদনা আছে। কিন্তু সাংবাদিক রুবেলের কন্যা কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনায় মারা যায়নি। সে কোন সন্ত্রাসীর গুলিতে মারা যায়নি অথবা মারা যায়নি কোন দুর্ঘটনায়। সে মারা গেছে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। আর পৃথিবীর কোন চিকিৎসকই চায় না তার রোগি মারা যাক। চিকিৎসাবস্থায় রোগির মৃত্যু হতেই পারে। কিন্তু মুহুর্তের মধ্যে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ আনাটা কতটুকু যৌক্তিক হয়েছে আমার বোধগম্য নয়।  
আমি দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা পেশার সাথে জড়িত ছিলাম। দেশের প্রধান দুইটি জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো ও কালের কন্ঠ পত্রিকায় কাজ করার সুযোগ হয়েছে। সাংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে কি কি সতর্কতা অবলম্বন করতে হয় তা পত্রিকা কর্তৃপক্ষ বার বার শিখিয়েছে। কোন কাজকে ভুল বলতে চাইলে ঐ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়েই একমাত্র বলা যাবে যে কাজটা ভুল হয়েছে। কিন্তু সাংবাদিক রুবেলের কন্যা একজন শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন, ঐ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসা পদ্ধতি ভুল ছিলো এমন মতামত ঐ চিকিৎসকের চেয়ে বড় কোন বিশেষজ্ঞর মন্তব্য সংবাদে সন্নিবেশ করা হয়নি যা সাংবাদিকতার নীতি নৈতিকতার সাথে বেমানান। 
‘রুবেল খান বলেছেন, ঠান্ডা লেগে গলা ব্যথা করায় রাইফা খাওয়া বন্ধ করে দিলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ওই রাতে  রাইফাকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হলে সে অস্বস্তি বোধ করে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা শিশু বিশেষজ্ঞকে কল দেওয়ার পরামর্শ দেন। এরপর শিশু বিশেষজ্ঞ বিধান বড়ুয়াও একই ধরনের ওষুধ দেন জানিয়ে রুবেল বলেন, রাতে ওই ওষুধ দেওয়ার পর থেকে রাইফার খিঁচুনি শুরু হয়। দায়িত্বরত চিকিৎসককে জানালে তিনি ডা. বিধান বড়ুয়ার সাথে কথা বলে ‘সেডিল’ ইনজেকশন পুশ করেন। এরপর রাইফা নিস্তেজ হয়ে যায়।’ 
ঠান্ডা জনিত সমস্যার কারনে তাকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া এবং সেডিল ইনজেকশন দেওয়া ঠিক হয়েছে না ভুল হয়েছে সেটা সাংবাদিক বা উকিলের বা ব্যবসায়ীর পক্ষে কি নিরুপন করা সম্ভব। এটা ভুল না সঠিক হয়েছে তা বলার মত একমাত্র অথরিটি আরেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়া আর কেউ হতে পারে কি?
একটা ব্যক্তিগত বিষয় একটু শেয়ার করি। আমার বন্ধু শিশু বিশেষজ্ঞ। আমার মেয়ে জন্ম নেয়ার পূর্ব হইতে বর্তমান সময় পর্যন্ত তার কথার বাইরে একফোটা পানিও না খাওয়াতে চেষ্টা করি। কাল মেয়ের কানের ব্যাথার কারনে তাকে ফোন দিলে আমাকে একটা অ্যান্টিবায়োটিক আর নাকের ড্রপ নেয়ার পরামর্শ দেন আর যদি ব্যাথা বেশি মাত্রায় হয় তবে ব্যাথার সাপোজিটরি নিয়ে রাখতে বললো। 
আমরা সাধারণভাবে জানি, সর্দির কারনে নাক যদি বন্ধ হয়ে যায় এবং স্মাস প্রশ্বাস নিতে সমস্যা হয় তবে নাকে ড্রপ দিতে হয়। আর ঠান্ডা জনিত জর হলে যদি নাপা খাওয়ানোর পরেও সুস্থ না হলে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়। আমার মেয়ের হয়েছে কানের ব্যাথা। তাকে যে ঔষধ দেয়া হয়েছে আমি বিনা বাক্য ব্যায়ে বাজার থেকে কিনে নিয়ে ব্যবহার করা শুরু করছি এবং যথাযথ ফল পেয়েছি। নাকের ড্রপ দেওয়ার পর পরই মেয়েতো উপর্যুপরি বমি এবং কান্না করা শুরু করে দিয়েছে। এখন আমি কি আমার ডাক্তারকে বলবো যে সে ভুল চিকিৎসা দিয়েছে, কানে ব্যাথা হয়েছে, কানের তো কোন ঔষধ দিলো না! সর্দি হয় নাই, নাক বন্ধ হয় নাই অথচ নাকের ড্রপ দিলো কেন? আমাদের পক্ষে কি জানা সম্ভব যে চিকিৎসাটা ভুল না সঠিক? এটা হলো আস্থার জায়গা। ডাক্তারের উপর আস্থা রাখতে হবে, রেখেছি, রাখি এবং রাখবো। 
চিকিৎসকদের সংগঠন বিএমএর চট্রোগ্রামের এক নেতা নাকি হুমকি দিয়েছে যে ‘সাংবাদিকদের এবং তাদের ছেলে-মেয়েদের চিকিৎসা করবেন না’। পরবর্তীতে ঐ চিকিৎসকের ফেসবুক থেকে জেনেছি যে তিনি ঐ কথা বলেনি। তর্কের খাতিরে ধরেই নিলাম সে বলেছে। যদি বলে থাকে তবে কি দাড়ালো? আস্থার জায়গায় চির ধরানো হলো। এখন সাংবাদিকরা কোথায় যাবে? তারা কি উকিলদের কাছে চিকিৎসার জন্য যাবে না সাংবাদিকদের কাছে, তারা কি ব্যাংকারদের কাছে যাবে না ব্যবসায়ীদের কাছে? আমাদের চিকিৎসকদের কাছেই যেতে হবে। তদন্ত কমিটি হয়েছে, সেখানেও সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে শিশু বিশেষজ্ঞ দেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। তাহলে বিষয়টা কি হলো? সেই চিকিৎসকেরই স্মরনাপন্ন হতে হলো। তাই আস্থার জায়গা নষ্ট করতে নেই। 
রুবেলের প্রতি গভীর সমবেদনা ও রাইফার জন্য ভালোবাসা জানিয়েই একটা কথা বলছি। প্রতিদিন কতইনা শিশু মারা যাচ্ছে। কয়টা শিশু মৃত্যু নিয়ে সাংবাদিকগণ মানব বন্ধন করেন? কয়টা শিশু মৃত্যুর জন্য হাসপাতাল ঘেরাও করে চিকিৎসক আটক করান? কয়টা শিশু মৃত্যুর জন্য প্রতিবাদ সমাবেশ, মানব বন্ধন, মামলা হামলা, তদন্ত কমিটি গঠনে চাপ প্রয়োগ করেন? নিজ পেশার স্বজন মারা যাওয়ায় এসব করে আস্থার জায়গা নষ্ট করা কি ঠিক হবে? আমাদের কিন্তু ঐ জায়গাগুলোতেই যেতে হবে বার বার, তাই আস্থার জায়গাগুলো নষ্ট করা ঠিক হবে না।


-----------------------------------------------------


ইকবাল সোবহান চৌধুরী ও মাহমুদুর রহমানের উপর হামলা একই সূত্রে গাথা

২২ জুলাই ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ। কুষ্টিয়ার আদালতে একটি মানহানির মামলায় জামিন স্থায়ী করতে গিয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির চেয়ার পার্সন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। জামিন পাওয়ার পর আদালতে অবরুদ্ধ হয়ে পরেন। এক পর্যায়ে তার উপর হামলা হয়, তার গাড়ি ভাংচুর হয়, তিনি রক্তাক্ত আহত হন। মাহমুদুর রহমান মামলার স্বীকার হন তার চোপার জন্য। দলের হয়ে সবসময় বেফাস কথা বলে সর্বদা সংবাদ শিরোনাম হয়ে আসছেন তিনি। হামলার জন্য ছাত্রলীগকে দায়ী করেছেন মাহমুদুরের সঙ্গীরা। তবে পুলিশ হামলাকারীদের চিহ্নিত করতে পারেনি।
ফিরে যাই ২০০৬ সালে। ২৯ মে ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দ। কুষ্টিয়ায় আয়োজন করা হয়েছিলো সাংবাদিক নির্যাতন বিরোধী সমাবেশ। পালিয়ে ঢাকায় অবস্থান নেয়া চার সাংবাদিককে সঙ্গে নিয়ে আসেন সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী। সঙ্গে সিনিয়র সাংবাদিক ওমর ফারুক, ফরাজী আজমল হোসেনসহ ছোট্ট একটি দল। সমাবেশস্থল কুষ্টিয়া পাবলিক লাইব্রেরী মাঠে জড়ো হয়েছিলেন আশপাশের বিভিন্ন জেলার সাংবাদিক নেতারাও। ক্ষমতাসীন বিএনপি দলীয় সাংসদ ও নেতাকর্মীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এসেছিলেন জেলার সর্বস্তরের সাংবাদিকরা। দু’জন বক্তব্য দেবার পর শুরু করেছিলেন ফরিদপুরের সাংবাদিক নেতা লায়েকুজ্জামান। বিএনপির নেতা কর্মীদের উদ্দেশ্য করে তিনি যখন বলেছিলেন, ‘একটি রাজনৈতিক দল কতটা দেউলিয়া হলে সাংবাদিকদের নামে মিথ্যা মামলা করতে পারে।’ এই বক্তব্যের পরই পূর্ব প্রস্তুতি নেয়া ছাত্রদল ও যুবদলের ক্যাডাররা হামলে পড়েছিলো সমাবেশের উপর। অদূরে অবস্থিত জেলা বিএনপি অফিসের ভেতর থেকে বের হয়ে তারা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে করতে সমাবেশ স্থলে এসে মারপিট-ভাঙচুর শুরু করেছিলো। কপাল ফেটে রক্ত ঝড়েছিলো সাংবাদিক নেতা ও অবজারভার পত্রিকার সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরীর। আহত হয়েছিলেন ২৩ জন সাংবাদিক। বিএনপি সরকারের ঐ সময়টায় মামলা হামলার কারনে কুষ্টিয়ার সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালন কঠিন হয়ে পড়েছিলো। তারই প্রতিবাদে সমাবেশে যান ইকবাল সোবহান চৌধুরী।
উপরের দুটি ঘটনা মূলত একই সূত্রে গাথা। সেদিন হামলার মূল হোতা ছিলো কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির সভাপতি ও বিএনপি দলীয় সাংসদ এবং বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা কর্মীরা আর আজ অভিযোগ কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগ নেতা কর্মীদের উপর।
সে সময় মাহমুদুর রহমান ছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা। আর ২০০৬ সালে যে রক্তাক্ত হয়েছিলো সেই ইকবাল সোবহান চৌধুরী এখন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য বিষয়ক উপদেষ্টা।
দুটি ঘটনার কোনটাকেই আমি সমর্থন করি না। দুটি ঘটনাই ন্যাক্কারজনক। কিন্তু আজ মনে প্রশ্ন জাগে, ২০০৬ সালে মাহমুদুর রহমানের বিবেক কি কেদেছিলো? আর আজ কি ইকবাল সোবহান চৌধুরীর বিবেক কাদছে? আমি জানি, আমার এই প্রশ্ন কর্তাদের কানে পৌছাবে না। আর তারা বিষয়টাকে তুচ্ছ বলে এর জবাবও কোনদিন দিবেন না। যদিও তারা কোন জবাব দিতে অভ্যস্তও না।
আমাদের দেশে আজ শিক্ষকরা বিভক্ত। সাদা প্যানেল মার খায় নীল প্যানেলের কাছে আর নীল প্যানেল মার খায় সাদা প্যানেলের কাছে। উভয় প্যানেলই স্বস্ব দলের নেতাদের সামনে ল্যাজ নাড়ে। শিক্ষকতার মত মহান পেশার পেশাজীবীদের এমন কাজ দেখলে খুব কষ্ট হয়।
সাংবাদিকরা আজ অংশে অংশে বিভক্ত। এক অংশের নেতারা মার খায় অপর অংশের হাতে। এক অংশ মার খার আর অপর অংশ দুধের সর খায়। মামলা হামলা দিয়ে ক্ষমতাশীন অংশ ক্ষমতাহীন অংশকে দমিয়ে রাখে। পেশাদারিত্ব ভুলে সাংবাদিকতাকে নিয়ে গেছে দালালির সর্বোচ্চ শীখড়ে। সংবাদ মাধ্যম ও তার কর্মিরা এখন রাজনীতির হাতিয়ার। সংবাদ এখন শিল্প নয় ব্যবসায় পড়িনত হয়েছে আর সাংবাদিকরা হয়েছে ভাড়–য়া। খুবই দুঃখজনক এটা।
চিকিৎসকরা দু’ভাগে বিভক্ত। এক অংশ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী হলে অন্য অংশকে মনে করা হয় বিজাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী তাই ওদের নিপিড়ন কর, ওদের নিপিড়ন করা জায়েজ। ক্ষমতাশীন গ্রুপের হলে কাঙ্খীত ওএসডি, ঢাকাসহ ভালো জায়গায় পদায়ন আর ক্ষমতাহারাদের জন্য দূর্গম স্থানে পোষ্টিং।
ধর্মীয় নেতারা পর্যন্ত বিভক্ত হয়ে গেছে। তারাও লেজুর নাড়ে ধর্মের লেবাস ধরে। কে কার চেয়ে বেশি ভালো পা’চাটতে পারবে তার অসুভ প্রতিযোগীতায় ব্যস্ত। দল বুঝে ফতোয়া দেয়। সুযোগ সুবিধা পেলে ফতোয়া ফেলে ক্ষমতার দিকে ঢলে।
আর রাজনীতিবীদরাতো অনেক আগেই বিভক্ত হয়ে আছে। ক্ষমতায় থাকলে টিনের চশমা পড়ে থাকে। বিরোধী গ্রুপের নেতাদের রাস্তায় ফেলে পিটায়, বস্ত্র হরণ করে, অপহরণ করে, মামলা হামলা দেয়। আবার দীর্ঘ নির্যাতনের স্বীকার হয়ে ক্ষমতায় গেলে প্রতিশোধ নেয়, অপর গ্রুপকে হামলা করে, মামলা দেয়, রক্তাক্ত করে। যতটা পেয়েছিলো তার চেয়ে বহু গুন বাড়িয়ে ফেরত দেয়। ক্ষমতায় এলে ক্ষমতাহীনদের ধার দেনা শোধ দেয় বহু গুন মুনাফা বাড়িয়ে। এ যেন এক অশুভ প্রতিযোগিতা। শুধু প্রতিযোগীতা নেই মেধার, প্রতিযোগীতা নেই সেবার, প্রতিযোগীতা নেই কর্মের।
কিন্তু এভাবে আর কতদিন? একটি বাসযোগ্য সমাজ গড়তে চাইলে এখনই সবার সহনশীল হতে হবে। হতে হবে দেশ প্রেমিক। হতে হবে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ২০০৬ সালের হামলার ঘটনার দৃষ্টান্ত মূলক বিচার হলে হয়তো আজকের ঘটনা ঘটতো না। আবার আজকের ঘটনার যদি দৃষ্টান্ত মূলক বিচার না করা হয় তবে সামনে এর চেয়েও ভয়াবহ ঘটনা ঘটবে, সে জন্য অপেক্ষায় থাকুন সবাই।

No comments:

Post a Comment