ভালবাসি প্রকৃতি

ভালবাসি প্রকৃতি

Tuesday, September 10, 2019

নদীও কী কয়েন চেনে!

রথ দেখা ও কলা বেচার কথা আমরা সবাই জানি। এক শুক্রবার সমাজ পরিবর্তনে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও সুকান্ত’র সহিত্য শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করেছিলো বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ শরীয়তপুর জেলা শাখা। আমি যেহেতু সংগঠনের শরীয়তপুর জেলা শাখার সভাপতি তাই যথারীতি আমার সভাপতিত্বেই অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা। অপরদিকে ঐ শুক্রবারই আমার এক শ্যালিকার বিবাহোত্তর বরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে রাজধানী ঢাকায়। যেহেতু সংগঠন করি তাই আলোচনা সভায় উপস্থিত থাকার বিষয়টাই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ চলছিলো। হঠাৎ বিপত্তি বাঁধলো। আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধু শামীম সরদারের বাবা হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পরলো। তাকে নিয়ে বৃহস্পতিবার বিকালেই ঢাকা রওয়ানা দিতে হলো আমাদের। শরীয়তপুর থেকে কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাট দিয়ে ঢাকা পৌছানোর রাস্তার দূরত্ব কম হলেও এই রুটে সময় লাগে বেশি। সময় মত ফেরি পাওয়া যায় না, ফেরি পাওয়া গেলেও সিরিয়াল নিয়ে সমস্যা, তার উপরে মাওয়া থেকে ঢাকার রাস্তা নির্মানাধীন হওয়ায় প্রচুর জ্যামের কবলে পরতে হয়। বিশেষ করে এক ভিআইপির কারনে এক ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনায় এখন সিরিয়াল নিয়ে কোন মানবিকতাও দেখায় না ফেরি কর্তৃপক্ষ। আরিচা দিয়ে ঢাকা ঢুকতে চাইলে দূরত্ব বেশি হয়ে যায়, তবুও আমরা বিরতিহীনভাবে যাওয়ার জন্য শরীয়তপুর থেকে মাদারীপুর-ফরিদপুর-গোয়ালন্দ-আরিচাঘাট-মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকা ঢুকলাম। কোন প্রকার বিরতি ছাড়া গাড়ি চালিয়ে গাবতলি হয়ে পৌছে গেলাম জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট। রাত চারটা পর্যন্ত জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে দাড়িয়ে থেকে ভোরের দিকে একটি হোটেলে উঠে একটু গা এলিয়ে দেয়া ছাড়া কোন কাজ ছিলো না হাতে। ঢাকা যেহেতু এসেই পরেছি তাই শ্যালিকার বিয়ের অনুষ্ঠানে চলে গেলাম পরদিন সন্ধায়। রাতের অনুষ্ঠান শেষে তার পরদিন শনিবার সকালে শরীয়তপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে বিকাল নাগাদ মাওয়া ঘাটে এসে নদী পার হওয়ার জন্য লঞ্চে উঠেছি।
প্রমত্তা পদ্মার তেজ যে এখনও আছে তা সময় সময় বুঝিয়ে দেয়। ঘাট থেকে লঞ্চ ছারার পর একটু এগুতেই শুরু হলো লঞ্চের দোলানি। সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে লঞ্চ আর ডানে বামে দোলছে বিশাল হাতির পথ চলার মত। প্রমত্তা পদ্মার কাছে লঞ্চটা ছোটই মনে হলো। যারা লঞ্চের পিছনের দিকে আছে তারা সবাই সতর্ক হয়ে নড়ে চড়ে বসলো। যে যা পাচ্ছে তাই ধরে শক্ত হয়ে বসছে। ঝালমুড়ি, চিড়াভাজা বিক্রেতারাও লঞ্চের সাথে ঠেকনা দিয়ে নিরাপদে থাকার চেষ্টা করছে। আমি লঞ্চে উঠলে সাধারণত বসতে ভালো লাগে না। বেশিরভাগ সময়ই দাড়িয়ে নয়তো হেটে কাটিয়ে দেই। আমি লঞ্চের রেলিং ধরে দাড়িয়ে আছি। লঞ্চের দোলনিতে লঞ্চের ভেতরে বসা অনেককেই দেখলাম ভয়ের কারনে মুখ শুকিয়ে গেছে। বিশেষ করে মহিলারা বেশ ভয় পাচ্ছে ঢেউয়ের আঘাত দেখে। তবে সবাই যে ভয় পাচ্ছে তা কিন্তু নয়। যারা এ রুটে নিয়মিত যাতায়াত করেন তাদের কাছে এটা কোন বিষয়ই না। আমার কাছেও তেমন ভয়ের কিছু বলে মনে হয়নি।
লঞ্চের দোলনি দেখে ভিতর থেকে এক বৃদ্ধ মহিলা রেলিংয়ের কাছে এসে নদীতে পাঁচ টাকা মূল্যমানের চকচকে রুপালী কয়েন ফেলছে! কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে দিয়ে সে তিনটা কয়েন ফেললো। ভয়ার্ত মুখে দোয়া পড়ার ভাবও দেখা গেলো বৃদ্ধ মহিলার। কয়েন ফেলার কিছুক্ষণের মধ্যেই থেমে গেলো পদ্মার ঢেউ, লঞ্চের দোলনি! তাহলে কী নদী এবং নদীর ঢেউও কয়েন চেনে?
ভাবছেন, কয়েন ফেলার পরই প্রমত্তা পদ্মার ঢেউ থেমে গেলো! আসলে বিষয়টা তা নয়। কয়েন ফেলতে ফেলতে লঞ্চ চলে এসেছে মূল নদী থেকে মোহনায়। মূল নদী পেরিয়ে মোহনায় ঢোকার পরে নদী অত্যন্ত সরু খালের মত হয়ে গেছে। সরু খালের মধ্যে আসার সাথে সাথে ঢেউও কমে যায়, দোলনিও কমে যায়। আমার পাশে দাড়িয়েই বৃদ্ধ মহিলা কয়েন ফেলেছে কিন্তু আমি কিছুই জিজ্ঞেস করিনি। জিজ্ঞেস না করার কারনও আছে।
নদীতে কয়েন ফেলার দৃশ্যটা আমার কাছে অতি পরিচিত। আমরা একসময় রাজধানী ঢাকা যেতাম লঞ্চে করে। বর্ষার দিনে কোটাপাড়া লঞ্চ ঘাটেই লঞ্চ আসতো। আর শুষ্ক মৌসুমে লঞ্চ থাকতো নড়িয়া উপজেলার বাশতলা, চন্ডিপুর, সুরেশ্বর ঘাটে। তখন লঞ্চ প্রচুর ঢেউয়ের মুখে পড়তো। এখনতো পদ্মা অনেকটাই মরে গেছে! সেই মরা পদ্মাও মাঝে মাঝে যে খেল দেখায় তা নড়িয়ার মানচিত্রের দিকে তাকালেই অনুমেয়। নড়িয়ার মানচিত্র অবশ্য ঠিকই আছে। শুধু স্থল ভাগের পরিমান কমেছে। পদ্মার যৌবনে কেমন ঢেউ ছিলো তা সিনিয়র সিটিজেনরা হয়তো ভালো বলতে পারবে। লঞ্চে ঢাকা যাওয়ার সময় দেখতাম ঝড়ের কবলে পরলে বা ঢেউয়ের মুখে পরলে বৃদ্ধ মহিলা, পুরুষ সবাই নদীতে পয়সা ফেলতো। তখন দেশে পাঁচ পয়সা, দশ পয়শার কয়েন প্রচলিত ছিলো। এখন অবশ্য পাঁচ পয়সা বা দশ পয়সার দিন শেষ। পাঁচ-দশ পয়সাতো দূরের কথা এক টাকার একটা কয়েনে এখন একটা লজেন্স বা চকলেটও পাওয়া যায় না! তখন সাধারণ মানুষের মনে একটা বিশ্বাস ছিলো যে, পাঁচ-দশ পয়সা নদীতে ফেললে নাকি নদী শান্ত হয়।
আজ এতটা বছর পরেও অশান্ত নদীকে শান্ত করতে কয়েন ফেলা দেখে অবাক হইনি। মানুষ এখনও কত বোকা রয়ে গেছে। একবিংশ সতাব্দীতে এসেও ভয়ের কারনে নদীকে বা নদীর ঢেউকে টাকার লোভ দেখিয়ে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। যদিও এধরনের কাজ এখন অনেক কমে গেছে। তারা এখন বোঝে ঢেউ থামাতে বা ঝড় থমাতে পয়সা ফেলা মানে টাকাটা জলে ফেলারই নামান্তর। প্রকৃতি কখনো ঘুষ খায় না, ঘুষ খায় মানুষে। প্রকৃতিকে আমরাই ক্ষেপিয়ে তুলেছি। নির্বিচারে গাছ কেটে, নদীর তীরের মাটি কেটে, জীব বৈচিত্র ধ্বংস করে আমরা প্রকৃতির বারোটা বাজিয়ে ছেরেছি। এখন প্রকৃতি যদি দু’একটু খেলা দেখাতে চায় তবে তাকে পয়সা দিয়ে থামানো যাবে না। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়ে কোটি কোটি ডলার খরচ করে উন্নত দেশগুলো। জলবায়ু সম্মেলনের পরে ঘোষণা আসে কে কত ডলার দিবে। প্রকৃতি ধ্বংস করে ক্ষতিপূরণ দেয়ার নামে আসলে বড় বড় এনজিওগুলোকে, ছোট ক্ষমতাধর দেশগুলোকে ভিক্ষা দেয়। দুহাত ভরে সে ভিক্ষা নিয়ে আমরা দাতাদের গুনকির্তন করি। ধন্য ধন্য সাড়া ফেলি, মুখে ফেনা তুলি তাদের দানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে গিয়ে। প্রকৃতিকে শান্ত করতে হলে প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। প্রকৃতির প্রতি বিরুপ হলে প্রকৃতিও আমাদের উপর বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখাবে। যে কয়েন নদীতে ফেলা হলো এটাও প্রকৃতির প্রতি একটা বিরুপ আচরণ। নদী কয়েন দিয়ে কী করবে? নদীতো শপিং করে না, নদী কাউকে ঘুষও দেয় না। কয়েনটা নদীর বুকে জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে থাকবে নিঃশেষ হওয়া পর্যন্ত। কুসংস্কার থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। বিজ্ঞান ভিত্তিক চিন্তা চেতনা হৃদয়ে ধারণ করে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে এবং প্রকৃতিকে বাঁচাতে হবে। প্রকৃতি বাঁচলে আমরাও বাঁচবো। আসুন প্রকৃতির প্রতি সদয় হই।

asadjewel@gmail.com, www.asadjewel.com

No comments:

Post a Comment