ভালবাসি প্রকৃতি

ভালবাসি প্রকৃতি

Saturday, March 30, 2019

জাজিরা থেকে কেন চলে যাচ্ছে উনিশশো কোটি টাকার তাঁতপল্লী? আশা হতাশার গল্প

শুরুতেই আশার গল্প, আষাঢ়ে গল্প নয়! বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে আমরা জানতে পারি, মাদারীপুরের শিবচর ও শরীয়তপুরের জাজিরায় এক হাজার ৯১১ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ হতে যাওয়া তাঁতপল্লী ঘিরে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন বিলুপ্তপ্রায় তাঁতিরা। এ প্রকল্পটির জন্য শিবচর উপজেলার কুতুবপুরে ৬০ একর ও শরীয়তপুরের জাজিরায় ৪৮ একর জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। তাঁতপল্লীতে থাকবে কারখানা, আবাসন, শিক্ষা, প্রশিক্ষণসহ আধুনিক সব সুবিধা। মিরপুরের বেনারসি পল্লীর তাঁতিরাও এ পল্লীর অর্ন্তভূক্ত হবেন। প্রধানমন্ত্রী ১ নভেম্বর এ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পদ্মা সেতুর দ্রুত বাস্তবায়নের সঙ্গে এ এলাকায় তাঁতপল্লী স্থাপনের কাজ শুরু হওয়ায় নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন এ অঞ্চলের তাঁতিরা। ১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী তাঁতপল্লীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেও জায়গা নির্ধারণ হয়েছে আরও আগেই। দুই মাসের মধ্যে শুরু হবে মাটি ভরাটের কাজ। প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২৫৩ কোটি টাকা। এতে ৬ তলা বিশিষ্ট ভবনগুলোতে প্রত্যেক তাঁতির জন্য ৬০০ ফুটের কারখানা ও ৮০০ ফুটের মধ্যে আবাসন সুবিধা থাকবে। সরকারের পক্ষ থেকে সুতা-রঙসহ কাঁচামালের সুবিধা দেওয়া হবে। নির্মাণ হবে আর্ন্তজাতিক মানের শোরুম ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। তাঁতিদের ছেলেমেয়েদের জন্য থাকবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম জানান, প্রধানমন্ত্রী এই পদ্মাপাড়ে তাঁতপল্লী গড়ে তোলার যে উদ্যোগ নিয়েছেন তাতে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প আবার পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠবে। এখানে সয়েল টেস্ট শেষে বিভিন্ন ভবন নির্মাণ করা হবে। প্রথম পর্যায়ে ২৫৩ কোটি টাকার কাজ শেষ করব। মূল প্রকল্প ১ হাজার ৯১১ কোটি টাকার। এটি একটি মেগা প্রকল্প। এখানে ঢাকার মিরপুরের বেনারসি পল্লীর তাঁতি ও এই অঞ্চলের তাঁতিদের পুনর্বাসন করা হবে। তাদের প্রত্যকের জন্য আধুনিক অনেক ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকবে। তাঁতিদের বিনামূল্যে অথবা ন্যায্যমূল্যে সুতা, রঙসহ বিভিন্ন কাঁচামাল সরবরাহ করা হবে। রঙ করা, ফ্যাশন ডিজাইনসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।

এবার শুনাই হতাশার গল্প। অনিয়ম রোধে মাদারীপুরের শিবচর ও শরীয়তপুরের জাজিরায় ১৯শ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হতে যাওয়া শেখ হাসিনা তাঁতপল্লীর পূর্ব নির্ধারিত স্থান পরিবর্তন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই আলম চৌধুরী। প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনকালে একথা বলেন তিনি। এ সময় চিফ হুইপ বলেন, শেখ হাসিনা তাঁতপল্লীর নির্ধারিত স্থানে অবৈধ স্থাপনা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর ও তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে দেখা গেছে এখানে ভালো কিছু হচ্ছে না। আমাদের নির্দেশনায় মাদারীপুরের প্রশাসন অবৈধ সব স্থাপনা ভেঙে ফেলেছে। কিন্তু শরীয়তপুরের প্রশাসন কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করেনি। গত ২৪ মার্চ পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মীর্জা আজম, সংলগ্ন সংসদ সদস্য ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা সবাই একমত হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেসব এলাকায় অবৈধভাবে ঘরবাড়ি, গাছপালাসহ স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে সেসব এলাকা এই প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া হবে। তিনি বলেন, দুই জেলায় এমন একটি প্রকল্প করতে গেলে শুধু এই অনিয়মই নয় ভবিষ্যতে আরও কিছু সমস্যা হবে। তাই সংসদীয় কমিটি, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা সবাই একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, শেখ হাসিনা তাঁতপল্লী একই উপজেলায় করা হবে। আর এ জন্য মাদারীপুরের শিবচরের কুতুবপুর এলাকায় জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে।

এই যে আশা হতাশা কাদের জন্য? তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেবে সরকার? প্রশাসনের যে কর্তাব্যক্তিদের কারনে ও প্রশ্রয়ে অনিয়ম ঘটলো সেই প্রশাসনের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে কি? যে জনগন এ অনিয়ম ঘটিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে কি? এমন হাজারো প্রশ্ন ঘুরছে মনে। শুধু আমার নয়, সারা শরীয়তপুরবাসীর মনে এমন প্রশ্ন। অনিয়মের অভিযোগে মুখ ফিরিয়ে নিলেই কি দায় শেষ হয়ে যাবে। যদি কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয় তবে ভবিষ্যতেও এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে কুলাঙ্গাররা। এখানে তাঁতপল্লী হোক বা না হোক অনিয়মের যে অভিযোগ উঠেছে তার তদন্ত যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে করে উপযুক্ত বিচারের আওতায় আনা উচিত। পূর্বের অনিয়মের বিচার হলে আজকে অপবাদ মাথায় দিয়ে তাঁতপল্লী সরিয়ে নেয়া সম্ভব হতো না। 

জাজিরায় পদ্মা সেতুর জন্য অধিগ্রহণকৃত জমির মালিকরা, দালালরা, প্রশাসনের কর্তারা কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে সেই খবর আজ বাসি-পঁচা। এর পর সেনানিবাস তৈরীর জন্য যখন জমি প্রয়োজন হলো তখন সেই এলাকার জমির মালিক, দালাল, প্রশাসন আবার এক হলো। হাজার হাজার গাছের চারা রোপন করে, যেনতেন ভাবে ঘর তৈরী করে, পুকুর খনন করে ফাঁদ পাতলো টাকার জন্য। পাট কাঠির মত গাছের চারা আধা ফুট অন্তর অন্তর রোপন করেছিলো। সেই গাছের জন্য এবং জমি ও ঘরের জন্য ছাব্বিশ কোটির অধিক টাকার বিল তৈরী করেছিলো প্রশাসনের সহায়তায়। অতপর মিডিয়া কর্মীদের কারনে পাঁচজন বন কর্মকর্তার সম্বয়ে নতুন করে মূল্যায়ন করলে ১৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা কমে গিয়েছিলো। সুযোগ সন্ধানীরা আবার রিট করে সেই টাকা তুলে নিয়েছে। প্রশাসন তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে টাকা প্রদান আটকাতে আগ্রহী না হলেও রিটের কারনে টাকা দিতে বেশি আগ্রহী ছিলো। প্রশাসন আদালতকে যথাযথ ভাবে বুঝাতেই পারেনি না বুঝাতে চেষ্টা করেনি সেটাই প্রশ্ন। আর চেষ্টা করবেই বা কেন, টাকা কমলে কমিশনও কমে যাবে সেটা পাগলেও বুঝে। 

এর পরই ঘোষণা আসলো তাঁতপল্লীর। আবারও সেই ঘটনার পূনরাবৃত্তি। স্থানীয় লোকজন, দালালরা, প্রশাসনেরও অনেক লোক জায়গা কিনে, ভাড়া নিয়ে গাছ লাগালো, ঘর তুললো, পুকুর খনন করলো। বিচি বুনলে যেভাবে গাছের চারা হয় ঠিক সেভাবেই লাগানো হলো গাছের চারা। দুর থেকে দেখলে মনে হবে সবজির বাগান! কারন আর কিছুই নয়। একেকটা চারা কিনে আর লাগাতে খরচ হবে দশ থেকে পনের টাকা আর বিল পাবে দশ থেকে বিশ হাজার টাকা। এমন টাকার গাছ কেউ কি না লাগিয়ে পারে? ঘর তুলেছে দোচালা, সেই ঘর হয়ে যাবে কাগজে কলমে দোতলা। এমন আয়ের পথে কে না হাটে? পুকুরে পানি আর মাছতো দুরের কথা মাটিও নেই, শুধুই বালু আর বালু। সেই পুকুরের, মাছের, এমনকি পানিরও বিল হবে! একেই মনে হয় বলে পুকুর চুরি! এই যে কাজগুলোর কথা বললাম, এগুলো কারা করে? আমার দেশের চাষা ভূষা, খেটে খাওয়া মানুষ এসব কুটকৌশল জানেন না। শিক্ষিত ব্যক্তি, চতুর, দুর্নীতিবাজরাই এসব করতে জানে এবং করেছেও। দুর্নীতিবাজরা অতীত থেকে ঠিকই শিক্ষা নিয়েছে। কে বলেছে এ জাতি অতীত থেকে শিক্ষা নেয় না? অতীতে তারা দোচালা ঘরকে দোতলা, দুই মাস বয়সী গাছের চারাকে বিশাল বৃক্ষ, বালু ভর্তি পুকুরে মাছের সমারহ দেখি বিল করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সেই অতীত তারা ভুলে যায়নি। 

অনিয়মের অভিযোগ আর দুই জেলায় প্রকল্প হলে ভবিষ্যতেও সমস্যা হবে এমন অভিযোগ এনেছেন চিপ হুইফ মহোদয়। আসলে তার এ অভিযোগ কতটুকু যুক্তিযুক্ত? দুই জেলায় হবে প্রকল্প, দুই দেশেতো নয়। একই দেশের দুটি বা তিনটি জেলার জমিতে কোন প্রকল্প হলে সমস্যা কি? যদি সমস্যাই হতো তবে কেন শুরুতেই দুই জেলায় প্রকল্পের পরিকল্পনা করেছিলেন পরিকল্পনাবিদরা? আসলে আমাদের বঞ্চিত করার অযুহাত দরকার। অনিয়মের অযুহাতের সাথে যোগ করেছেন দুই জেলার কথা এর বাইরে কিছুই নয়। 

জাজিরার মানুষ আজ কোটিপতি। এটা খুবই আনন্দের বিষয়। বাস্তবে কতজন ব্যক্তি নিয়মতান্ত্রিকভাবে কোটিপতি হয়েছেন? কতজনকে সরকার কোটি টাকার চেক দিয়েছেন সেটা খতিয়ে দেখা উচিত। বেশিরভাগ মানুষই কোটিপতি হয়েছেন অনিয়মের মাধ্যমে, দালালির মাধ্যমে। যারা অনিয়মের মাধ্যমে কোটিপতি হয়েছেন তাদের বিষয়ে খোজ খবর নেয়া উচিত রাজস্ব বিভাগের। সেই সাথে দুদকের ভূমিকাও এড়িয়ে যাওয়ার মত নয়। একটু খোজ খবর নিলে অনেক দালালই বেরিয়ে আসবে জাতির সামনে। একটু খুজুন, একটু ধরুন। 

জাজিরায় তাঁতপল্লী হলে এ অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ উপকৃত হত। আর দুর্নীতির কানে কয়েকশ মানুষ হয়তো লাভবান হতো। হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হতো। এখানে নানান রকম ব্যবসা বাণিজ্য গড়ে উঠতো। মানুষ কাজ করে খাওয়ার সুযোগ পেতো। অতি লোভের কারনে সব বন্ধ হয়ে গেলো। যারা অতি লোভে এমন কাজগুলো করেছে তাদের খুব বেশি ক্ষতি হবে না। তাদের হয়তো লাভটা হবে না কিন্তু ক্ষতিগ্রস্থ হবে এলাকার মানুষ। একটি সমৃদ্ধ শরীয়তপুর হতে পারতো। কয়েকশ লোভী মানুষের কারনে ক্ষতিগ্রস্থ হলো সাধারণ হাজার হাজার মানুষ, ক্ষতিগ্রস্থ হলো শরীয়তপুর জেলা। কিন্তু সারা দেশের মানুষ, সারা বিশ্বের মানুষ চিনে নিলো শরীয়তপুরের জাজিরার মানুষকে। সবাই জানবে, সবাই ভাববে জাজিরার মানুষ কত খারাপ, কত নিকৃষ্ট, কত দুর্নীতিপরায়ন, আত্মহননকারী। এর দায় থেকে কিভাবে এড়িয়ে যাবে জাজিরার মানুষ, শরীয়তপুরের প্রশাসন? প্রশ্নটা রেখেই গেলাম। উত্তর আমার জানা নেই, যদি কারো জানা থাকে তবে আমারই মত জানিয়ে দিন। জাজিরাবাসী দায়মোচন হতে পারবে হয়তো। 

ছবিঃ মুরাদ হোসেন মুন্সী ও গুগল।

Tuesday, March 12, 2019

এ অঞ্চলের শিক্ষা বিস্তারে শরীয়তপুর সরকারি কলেজ ॥ শিক্ষার্থী হিসাবে আমার কিছু স্মৃতি


শরীয়তপুর সরকারি কলেজ। দেখতে দেখতে চল্লিশ বছর হয়ে গেলো প্রাণের কলেজটির। দীর্ঘ সময়ে এ কলেজ আমাদের উপহার দিয়েছে অনেক শিক্ষাবিদ, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, প্রজাতন্ত্রের সেবক, আইনজীবী, সমাজ সেবক, রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ব্যবসায়ী সহ কতই না ব্যক্তিত্ব। এই কলেজ থেকেই শিক্ষা নিয়ে স্বস্ব কর্মক্ষেত্রে নিজেকে নিয়োজিত করে সমৃদ্ধ করেছেন দেশকে এবং নিজেকেও। আগামী শুক্রবার চল্লিশ বৎসর পূর্তি উৎসবে মিলিত হবেন কলেজের সাবেক-বর্তমান শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ। আসবেন দেশ বরেণ্য ব্যক্তিত্বরা। সারাদিন চলবে আড্ডা, স্মৃতিচারণ, র‌্যালি, খাওয়া-দাওয়া, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রাণের সেই প্রিয় কলেজকে নিয়ে সকলের যেমন রয়েছে মধুর স্মৃতি, তেমনি আমারও রয়েছে। তারই কিছু কথা আজ তুলে ধরতে চাই।  
শরীয়তপুর সরকারি কলেজের যাত্রা শুরু সেই ৯ জুন ১৯৭৮ সাল থেকে। পরবর্তীতে ১ মার্চ, ১৯৮০ সালে কলেজটি জাতীয়করণ করা হয়। কলেজটি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই পশ্চাৎপদ শরীয়তপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীসহ আশ পাশের জেলার শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষা লাভে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। শরীয়তপুর সরকারি কলেজ শুধু শিক্ষাগ্রহণের উন্নত পরিবেশ তৈরীই নয় বরং কলেজটি শরীয়তপুর বাসির আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের কেন্দ্রস্থলে রূপান্তর করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। যার ধারাবাহিকতায় আমারমত হাজারো শিক্ষার্থী আজ শরীয়তপুর সরকারি কলেজ থেকে শিক্ষার আলো নিয়ে পথ চলছে।
প্রতিষ্ঠার ১৬ বছর পর ১৯৯৪ সালে এসএসসি পাশ করে আমি শরীয়তপুর সরকারি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম। একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে সান্নিধ্য পেয়েছিলাম পদার্থ বিদ্যার শিক্ষক বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক এম এ আজিজ মিয়া, রসায়ন বিদ্যার শিক্ষক শামসুল আলম খান, গণিত বিভাগের শিক্ষক কালিপদ স্যার, বাংলা বিভাগের শিক্ষক বর্তমান অধ্যক্ষ প্রফেসর মোঃ মনোয়ার হোসেন, প্রাণী বিজ্ঞানের তোফাজ্জল হোসেন স্যারের মত গুণী শিক্ষকদের। খন্ডকালীন সময়ের জন্য আমাদের পদার্থ বিদ্যা পড়িয়েছেন শাহনাজ পারভীন আপা যাকে আমরা ভুলে যাইনি। যাদের স্নেহ, ভালোবাসা, শিক্ষা, উৎসাহ ও প্রদর্শিত পথ ধরে আজও হাটার চেষ্টা করছি আমরা। 
কলেজ জীবনের প্রথম একটা ঘটনা আজও হৃদয়ে গেথে আছে। ঘটনা আমার হৃদয়ে যতটা দাগ কেটেছে তারচেয়ে বেশি দাগ কেটেছে বন্ধু মাহমুদুল হাসান মিলনের গালে। প্রধান সড়ক থেকে কলেজে প্রবেশের রাস্তার শেষ ভাগের ভবনের নিচ তলায় ছিলো আমাদের একটি শ্রেণীকক্ষ। ক্লাশের প্রথম দিনেই আমি, বন্ধু মাহমুদুল হাসান মিলন, মোল্লা আলিমুজ্জামান, শামীম আজিজ, সরদার আজিজুর রহমান রোকন, আনোয়ার হোসেন, সুশান্ত কুমার কংসবণিক সহ অন্য সহপাঠীরা বসেছিলাম জানালার কাছে। ভবনের সামনে ছিলো একটা খেজুর গাছ। হঠাৎ একটা মিছিল নিয়ে কিছু ছাত্র কলেজের ভিতরের দিকে যাওয়ার সময় আতংক সৃষ্টি করার জন্য খেজুর গাছ লক্ষ্য করে একটি ককটেল নিক্ষেপ করে। হাতের নিশানা ভালো না হওয়ায় ককটেল গিয়ে গাছের পরিবর্তে আঘাত করে ভবনের দেয়ালে। বিস্ফোরনের সাথে সাথে কিছু স্প্রিন্টার জানালা দিয়ে আঘাত করে মাহমুদুল হাসান মিলনের গালে। আজও সেই দাগ বয়ে বেরাচ্ছে মিলন। 
একদিন বাংলা পাঠদানের সময় ক্লাস নিচ্ছেন মোঃ মনোয়ার হোসেন স্যার। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার করছেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ওপার বাংলায়। আলোচনার এক পর্যায়ে আমি অজ্ঞতা বসত পিছন থেকে বলেছিলাম ‘তাহলে কাজী নজরুল ইসলাম হলো আমাদের দেশের ধার করা কবি’। কথাটা স্যারের কানে যাওয়ার সাথে সাথে ভীষণ ক্ষেপেগিয়েছিলেন। কথাটা কে বলেছে সেটা নির্ধারণ করে আমাকে লজ্জা দিতে পারতেন। কিন্তু স্যার সেদিন তার উদারতা দিয়ে তা না করে বরং আলোচনার মাধ্যমেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন। সেদিনের সেই অনাকাঙ্খিত কথাটা বলায় স্যার আমাকে সরাসরি লজ্জা না দিলেও মনে পড়লে এখনও আমি লজ্জাবোধ করি। 
কলেজ জীবনে সাইন্সের ছাত্র হিসাবে যদিও খুব বেশি অবসর সময় আমরা পেতাম না, তবুও যতটুকু সময় পেয়েছি তা কেটেছে জামরুল গাছের নিচে কংক্রিটের বেঞ্চে বসে, কখনো মাঠে খেলাধুলা করে। বেশিরভাগ সময়ই কাটতো আমাদের লাইব্রেরীতে, ল্যাবে অথবা ক্লাসরুমে। ছুটি পেলেই বেরিয়ে পড়তাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। সাইন্সের ছাত্ররা রাজনীতি করার সময় ও সুযোগ পেত কম। কিন্তু ক্লাসে বসে তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা কাজী নজরুল ইসলাম ভাইর দরাজ কন্ঠে স্লোগান, ভাষন আজও মনে আছে। আনন্দ ঘন সময় কাটতো বিজ্ঞান মেলায়, কলেজের বার্ষিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতায়, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে আর বন্ধু-বান্ধবিদের সাথে গল্প করে। কলেজের বান্ধবী লাবনী লুবনা রাজ যদিও অল্প কয়েকদিন আমাদের কলেজে ছিলো, তবুও তাকে আমরা ভুলতে পারিনি। রিমা, সাম্মী রহমান, মেবিন, সুমি, রানু, তানিয়া, রিনা, নাজমা, সোনালী দেবনাথ, মানিক দেবনাথ, দীপক কুমার কংসবণিক, বশির, জ্ঞান প্রকাশ সহ সকল বন্ধুরা আজ শরীয়তপুর সরকারি কলেজের দেয়া সু-শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন পদ অর্জন করে দেশের সেবা করে যাচ্ছে। সাইন্সের ছাত্র হলেও মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের সাথে আমাদের ছিলো সমান হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। ল্যাব সহকারী মনসুর ভাই, খালেক ভাইদের সহযোগীতাও ভুলে যাওয়া মত নয়।
শরীয়তপুর সরকারি কলেজ এখন কতটা সমৃদ্ধ সেটা বলে বোঝানো যাবে না। কলেজে এখন বিভিন্ন বিষয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর পড়ছে। কলেজে হোস্টেল হয়েছে। দূর দূরান্ত থেকে আর বাই সাইকেল চালিয়ে বা লজিং থেকে পড়তে হয় না শিক্ষার্থীদের। একাধিক একাডেমিক ভবন হয়েছে। সেই চিরচেনা পরিবেশ আর নেই। বদলে গেছে কলেজের পরিবেশ। অনেকটা উন্নত হয়েছে যা প্রত্যাশা করতাম আমরা। 
দেখতে দেখতে চল্লিশ বছরের পুরনো প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে শরীয়তপুর সরকারি কলেজ। এই কলেজের অনেক শিক্ষার্থী আজ প্রফেসর, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, আইনজীবী, কবি, লেখক, সাংবাদিক, রাজনীতিক হয়ে স্বস্ব পেশায় কৃতিত্বের সাক্ষর রাখছেন, ভবিষ্যতে নানান শাখায় কৃতিত্বের পরিচয় দিবেন।
শরীয়তপুর সরকারি কলেজ শরীয়তপুর জেলাই নয়, আশ পাশের জেলাগুলোর শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিয়ে সমৃদ্ধ করে চলেছে। একসময় স্নাতক পর্যন্ত পড়ানো হতো, পর্যায় ক্রমে তা স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর শ্রেণী যুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে পদ্মা পাড়ের জেলা শরীয়তপুরের উপর দিয়ে তৈরী হচ্ছে দেশের সবচেয়ে মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু কেবল দেশের দক্ষিণ আর পূর্বাঞ্চলের সেতুবন্ধনই হবে না, এই সেতু এশিয়ান হাইওয়ের রুট এর অংশ হিসেবেও ব্যবহার হবে। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। পদ্মা সেতুর দুই তীরে হংকংয়ের আদলে শহর গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। এখানে একটা ভালো কনভেনশন সেন্টার করা হবে, বাণিজ্য মেলাটাও ঢাকা থেকে স্থানান্তরের পরিকল্পনা চলছে। ফলে এখানে বিনোদনের জন্য চমৎকার ব্যবস্থা হবে। পদ্মা তীর ঢাকার জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার দূরে। কাজেই পদ্মা পাড়ে নতুন একটা আলাদা শহর গড়ে তুলতে নানান পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছে সরকার। পদ্মার এপাড়েই নতুন একটি বিমানবন্দর নির্মাণ করা হবে। অলিম্পিক ভিলেজ, তাত পল্লীসহ দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হলে হংকংয়ের মতো শহর হবে শরীয়তপুরের পদ্মা পাড়।
শিক্ষায় সমৃদ্ধ হলেই একটি জেলা পরিপূর্ণরূপে সমৃদ্ধ হয়। ঢাকার উপর চাপ কমাতে হলে পশ্চাৎপদ শরীয়তপুর জেলায় একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখন সবার প্রাণের ও যৌক্তিক দাবী হতে পারে। শরীয়তপুর সরকারি কলেজ একদিন বিশ্ববিদ্যালয় হবে, এতদাঞ্চলের মানুষ উন্নত ও মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ পাবে সেই প্রত্যাশা কলেজ প্রতিষ্ঠার চল্লিশ বছর পর আমরা করতেই পারি। সরকারের কাছে আমাদের দৃঢ় প্রত্যাশা, শরীয়তপুর সরকারি কলেজকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তর করুক। রাজধানী ঢাকার উপর চাপ কমাতে এবং পশ্চাৎপদ জেলাটিকে একটি সমৃদ্ধ জেলা হিসাবে রূপদানের জন্য এর চেয়ে ভালো পদক্ষেপ হতে পারে বলে আমরা মনে করি না। 
লেখকঃ আইনজীবী ও কলামিস্ট, এইচএসসি ৯৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী। 

Friday, March 8, 2019

নারীর রূপ

নারী তুমি দাদি, তুমিই আবার মা
নারী তুমি বউ, তুমিই আবার জা
নারী তুমি ভগ্নি, তুমিই আবার প্রেয়সী
একেক রুপে তুমিই, হও যে শ্রেয়ী।

নাতনী যখন, দাদির সাথে কতই সখ্যতা
মা হও যখন, প্রতিপালনে দেখাও দক্ষতা
বউ হলে বিরুপ হও, শাশুরির সব কাজে
শাশুরির সব কথাই, লাগে আজে-বাজে।

মা হলে মেয়ে তোমার, কত সুন্দর সাজে!
শাশুরী হলে ভাবে বউ, কলিজাটা ভাজে
বোন যখন তখন তুমি, বোনকে ভাবো মিত্র
ননদকে দেখে ভাবো তুমি, আজন্ম এক শত্রু।

মেয়ের কথায় জামাই যদি, উঠে এবং বসে
কথাটা শোনার পরেই, মন খুশিতে হাসে
বউয়ের কথায় ছেলে যদি, কোন কর্ম করে
গা জ্বলে যায় সেটা শুনে, কষ্টে মন মরে।

অধম জুয়েল বলে, ভেবে নাহি পাই
বহুরূপ থেকে কি, নারীর মুক্তি নাই?
বদ চিন্তা থেকে যতদিন, বের হবে না নারী
মুক্তি হবেনা, পড়েই থাকবে, পরে বারোহাত শাড়ী।

বিঃদ্রঃ আমি নারী বিদ্বেষী নই। কথাগুলো যদি কোন নারীর খারাপ লাগে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।

Friday, March 1, 2019

কিস্তি

রাতে ঘুম হচ্ছে না মকিমের। ঘুম আসবেই বা কি করে? হাতে একটাও টাকা নেই। টাকার চিন্তা বড় চিন্তা। মহিলাদের শক্তি তার স্বামী আর পুরুষ মানুষের স্বামী হলো টাকা। তাইতো টাকাকে সেকেন্ড গডও বলে কেউ কেউ।
মকিম অলস প্রকৃতির মানুষ। তার কাজ ভালো লাগে না। মকিমের বন্ধু জাবেদ একটা ছেচড়া চোর। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির পাশের চায়ের টং দোকানের সামনে গিয়ে দাড়াতেই দেখা জাবেদের সাথে। জাবেদের ডাকেই মকিম এগিয়ে গেলো দোকানের দিকে। দোকানের সামনে বাশের খুটি আর বাশের চটি দিয়ে তৈরী বেঞ্চের উপর বসা জাবেদ। জাবেদের ডাকে সাড়া দিয়ে কাছে যেতেই বললো
-কিরে, মুখটা হুটকির মত কইরা কই যাওন ধরছস?
-যাইনা, বাইর হইছি মাত্র। 
-আয়, বয়। চা খাবি?
-তুইতো জানোস, আমি শক্তের মধ্যে লোহা আর নরমের মধ্যে গু এই দুইডা জিনিস ছাড়া সব খাই! ক, চা দিতে ক খাই।
-মোকলেস ভাই, চা দাও দুইডা। লগে কুকিজও দিও। 
দোকানি মোকলেস জাবেদ ও মকিম দুজনকেই ভালো ভাবে চেনে। হারে মাংসে বজ্জাত দুইটা। বাকি খাওয়ার সময় হুস থাকে না! টাকা চাইলে উল্টো ঝাড়ি মারবে। তাই দোকানি মোকলেস সতর্ক করতে বললো
-চা-বিস্কুট কিন্তু বাকি হইবো না! 
-তোমার কাছে বাকিতে চাইছে কেডা?
-না, সতর্ক করলাম আরকি!
-বাকি খাইছি, আর টাকা দেইনাই এমন হইছেনি কোন সময়?
-দুই একবার যে হয়নাই সেইডা কইতে পারবা বুকে হাত দিয়া?
-হেই কবে একবার না দুইবার দিতে একটু দেরি হইছিলো, সেই খোডা কি জীবন ভইরা দিবানি মিয়া? দেরি করছি, মাইরা তো খাই নাই না?
-খোডা দেই নাই ভাই, মনে করাইয়া দিছি আরকি! পাইছি তয় জানের কিছু থাকে নাই!
-হইছে, হইছে। চা দাও এহন। টাহা কি আগে দেহান লাগবো নি?
-দেহান লাগবো না, যাওনের সময় খালি দিয়া গেলেই হইবো।
-দিমু, দিমু, এহন চা-কুকিজ দাও।
দোকানি মোকলেস মিয়া দুইটা কুকিজ দিলো দুজনকে। কুকিজ একটা আজব বিস্কুট। দুই মাথা ইংরেজী এস অক্ষরের মত বাকানো থাকে। কেন যে সোজা করে না বুঝতে পারে না মোকলেস। মনে মনে ভাবে, সোজা করলে এমন কি ক্ষতি হইতো? জায়গা বেশি লাগতো না ময়দা বেশি লাগতো না বানাইতে কয়লা বেশি লাগতো কি জানি! জাবেদ আর মকিমকে কুকিজ ধরিয়ে দিয়ে চা বানানো শুরু করলো মোকলেস। জাবেদ তাড়া দিলো
-চা হইতে হইতেতো কুকিজ শেষ হইয়া যাইবো। চা দিয়া কুকিজ ভিজাইয়া ভিজাইয়া খাইমু চিন্তা করছি! আর চা বানাইতে কি দুধ বাড়ি থিকা গরু দোয়াইয়া আইন্না তারপর বানাইবা নাকি?
-আমিতো যন্তর না যে টিপ দিলেই চা পড়বো! বানাইতে আছি। এত তারাহুড়া করতাছো যে? লঞ্চ ছাইড়া দিবো নাকি?
-লঞ্চ ছাড়বো কেন? খিদা লাগছে, সকালে কিছুই প্যাডে পড়ে নাই, কতা কম কইয়া চাডা দেও।
মোকলেস দুই কাপ চা নিয়ে মকিম আর জাবেদের সামনে রাখলো। জাবেদ চায়ের কাপে মুখ দিয়েই নাক কুচকে ফেললো। বিরক্তি নিয়ে মোকলেসকে বললো
-কি মোকলেস ভাই, দুধ আর চিনি কি এখন সোনারুর দোকানের সোনা মাপার নিক্তি দিয়া মাপা শুরু করছো নি?
-ক্যান কি হইছে?
-কি হইছে বোঝো না? না হইছে মিডা, না দিছো দুধ!
-চা খাইবা না সরবত খাইবা? সরবত খাইলে দাও বানাইয়া দেই।
মোকলেস চায়ের কাপ দুটি নিয়ে বেশি চিনি আর দুধ দিয়ে আবার দিলো। জাবেদ আর মকিম এবার কুকিজ খায় আর চায়ে চুমুক দেয়। মুখের ভাব দেখেই বুঝাযায় চা এবার পছন্দ হয়েছে। চা খেতে খেতে জাবেদ মকিমকে বললো
-এই বার ক কি হইছে? ভাবিসাবের লগে ঝগড়া করছোস নাকি?
-ঝগড়া করুম কি করতে? হাতে টাহা পয়সা না থাকলে মন খারাপ হইতে ঝগড়া লাগে? কোন কাম কাইজ নাই, আর কামকাইজ করতেও ভালো লাগে না। কিযে করি? 
-আমার লগে কাম করবি? হেই কবে একবার করছিলি। এরপর তো আর গেলি না। 
-তোর কি মনে নাই? একবার গেছিলাম তোর লগে! পরদিনইতো কিস্তিতে জুতার পিডান খাইছি। এক কিস্তি না, তিন জনে তিন কিস্তি পিডাইছে। আবারও জুতার পিডান খাওয়াইতে চাস নাকি? চা-কুকিজ খাওয়াইতে চাস খাই, কিন্তু জুতার পিডান আর খাইতে চাই না।
-প্রত্যেকবারই কি একরকম হয়? ঐডাতো একটা একসিডেন্ট আছিলো। একসিডেন্টতো একসিডেন্টই! 
-নারে ভাই, আমারে এসব কামে সয় না। মাদবর সাবের জুতাযে সারাই করা আছিলো আমি কি জানি? আর যে মুচি জুতা সারাইছে ওরে পাইলে আমি নিজেই জুতা দিয়া পিডাইতাম। শালায় জুতায় তারকাটা মারছে, ঠিকমত মাতা বোতা করবো না! জুতার পিডানে যা ব্যাতা পাইছি তারচেয়ে বেশি ব্যাতা পাইছি তারকাটায়। এখনও দাগ আছে পিডে। 
-পিডানতো আমিও খাইছি। একবার জুতার পিডান খাইলেই কি থামতে হইবো? কামডা আন্তরিকতার সাথে করতে হইবো না? এইযে কাইল সাতটা বড়ি থেকে বদনা চুরি করছি। কুত্তার কারনে অন্তত দুই মাইল দৌডান লাগছে! অল্পের জন্য কামড়াইতে পারে নাই! হেই বদনা বেচা টাহায়ইতো কুকিজ হান্দাও!
জাবেদের কথায় মকিমের মন কিছুটা গলে গেলো। একটু দ্বিধা দন্ধের মধ্যে আছে। কিন্তু পাতলা কাম ছাড়া মকিমের কোন কাজ ভালো লাগে না। চিন্তা করলো আবার শুরু করবে। বউকে কথাটা জানানো যাবে না। আগের বার জুতার বাড়ি খাওয়ার পর অনেক কাদছে। সেবা করছে ঠিকই, তবে কড়াল করাইয়া ছাড়ছে যেন আর ওপথে না যাই। মকিম বললো
-ঠিক আছে যামু আমি। কি করবি চিন্তা করছোস?
-সময় মত কইমুহানে! সন্ধায় বাজারের উত্তর মাতায় দেহা করিস।
চা খাওয়া শেষে জাবেদ চকচকে নতুন একটা একশ টাকার নোট মোকলেসের মুখের সামনে ধরে বললো ‘দাম রাখো’। এর পর মকিম আর জাবেদ যার যার পথে চলে গেলো। জাবেদের বাড়ি পশ্চিম পাড়ায়। যাওয়ার সময় দেখা জমিলা চাচির সাথে। জমিলা চাচির সাথে জাবেদ একটু খাতির করার চেষ্টা করে। কুশলাদি জানতে চায়, বড় মেয়েটা কেমন আছে এসব আরকি!
জামিলা চাচির তিনটা মেয়ে, কোন ছেলে নাই। জামিলার স্বামী রিক্সা চালায়। তিন চাকার উপর রিক্সা দাড়িয়ে থাকলেও ঐ আয়ের উপর সংসার ঠিকমত দাড়িয়ে থাকতে চায় না। রিক্সার ভারাসাম্য তিন চাকায় ধরে রাখে কিন্তু সংসারের ভারাসাম্য রাখা কঠিন। বাজারে ভ্যান বেরিয়েছে। একটি ভ্যানে ছয়জন যাত্রী টানতে পারে। রিক্সায় দুইজনের বেশি টানা যায় না। ভ্যানে মালামালও টানা যায় বেশি, রিক্সায় মালামাল বেশি নিতে পারে না। ফলে রিক্সার চেয়ে ভ্যানে ভাড়া খরচ কম হওয়ায় এখন মানুষ রিক্সায় খুব একটা উঠতেই চায় না। রিক্সা চালিয়ে আয় এতটাই কমেছে যে সংসার চালিয়ে মেয়েদের পড়াশুনা করানতো দুরের কথা তিন বেলার জায়গায় দুই বেলা ভরপেট খাবার তুলে দেয়াই কঠিন হয়ে পড়েছে। একটু বাড়তি আয়ের আশায় জমিলা স্থানীয় এক এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়েছে।
স্বামীর কাছ থেকে প্রতিদিন কিছু টাকা নিয়ে কয়েকদিন সমিতিতে চাঁদা দিয়েছে। এর পর ঘুরে ঘুরে ঋণ পাওয়ার সুযোগ এসেছে জমিলার। মাত্র পাঁচ হাজার টাকা ঋণ তুলে একটা ছাগল কিনেছিলো। একটা বাচ্চা সহ ছাগল কিনেছিলো। এখন বেড়ে তিনটা হয়েছে। একটা খাশির বাচ্চা বেশ বড় হয়েছে। বাচ্চাটা আরেকটু বড় হলে সামনের কোরবানির ঈদে বিক্রি করে ভালো টাকা পাবে বলেই জমিলার আশা। খাশিটা বিক্রি করে টাকাটা খরচ করবে না চিন্তা করেছে। বড় মেয়েটা বড় হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। ওর জন্য দুটি কানের দুল বানাবে। বিয়ে দিতে হবে মেয়েটাকে। হঠাৎ করে গয়না কিনতে পারবে না, আর রিক্সার আয় দিয়েযে করবে তারও সম্ভাবনা দেখছে না।
জমিলাকে দেখে দাড়িয়ে গেলো জাবেদ। জমিলার চেয়ে ছাগলের দিকে বেশি মনোযোগ জাবেদের। জাবেদ জিজ্ঞেস করে
-কয়ডা ছাগল চাচি?
-তিনডা। বুড়াডা আবার বিয়াইবো। 
-ভালো। কয়ডা দিয়া শুরু করছিলা পালা?
-বুড়াডা বাচ্চা সহ কিনছিলাম।
-সাবধানে রাইখো। দিনকাল ভালা না।
-হ, বাইত্তে কুত্তা আছে। বাড়ির বাইরের কুত্তাকাত্তা আইলে খেদায়। গ্রামে কুত্তা কাত্তা বাইরা গেছে। কিছুই আর ঠিকঠাক রাহা যায় না!
-হ চাচি, তাইতো সাবধানে রাখতে কইলাম। 
জমিলায় মনে মনে ভাবে, তুইতো বড় কুত্তা। গ্রামে তোর জন্যইতো কোন কিছু ঠিক থাকে না! আবার হাউকারি করে। জাবেদ আর কথা না বাড়িয়ে চলে যায়। জমিলা ছাগলগুলোকে বেধে রেখে কিছু লতা পাতা তুলে। রাতে সামনে দিলে চাবাবে। গরমের রাত। দীর্ঘ রাত ছাগলগুলো যাতে খুধা পেটে না থাকে সেই ভেবে প্রতিদিনই কিছু লতাপাতা তুলে সামনে দেয়। 
সন্ধা লাগার সাথে সাথে বাজারের উত্তর মাথায় গিয়ে হাজির হয় মকিম। জাবেদের এখনও কোন খবর নাই। একটা বিড়ি ধরিয়ে কয়েকটা টান দিতে দিতেই জাবেদ এসে হাজির। দেখেই জাবেদ বলে
-কিরে, আইয়া পড়ছোস?
-হ, কইলি, তাই আইয়া পড়লাম। কি করবি চিন্তা করছো? ধরা খাওয়াবিনি আবার!
-আরে না না। ধরা খাইলে কি তুই একলা খাবি? আমি খাইমু না? 
-তুইতো চালনের ফুডা দিয়া বাইর হইয়া যাস প্রতিবার। 
-আমি চালনের ফুডা দিয়া বাইর হইতে পারলে কি হইবো? তুই ধরা খাইয়া প্রতিবারইতো আমার নাম কইয়া দেস। এর পরতো দুইজনে একসাথেই জুতার পিডান খাই!
-কি করুম? যেই মাইর দেয়, না কইয়া উপায় থাকে?
সুনসান নিরব বাজার। দুজনে বাজারের উত্তর মাথার একটা বেঞ্চে বসে। মকিম পরিকল্পনা জানতে চায়। সে খুবই উদগ্রিব। কি করবে সেই প্লান জানতে তার আগ্রহের শেষ নাই। জাবেদকে বলে
-আজ ধান্দাডা কি?
-জমিলা চাচিরেতো চিনস না?
-হ, চিনি। হের বাড়িতে কি পাবি, তিনডা মাইয়া ছাড়া?
-আরে দুর বেডা, মাইয়া দিয়া কি করুম? চাচি তিনডা ছাগল পালে। কিস্তি উঠাইয়া বাচ্চাসহ কিনছিলো। এহন তিনডা হইছে। খাশির বাচ্চাডা বেশ বড় হইছে। এখন আর বাচ্চা কইয়া লাভ নাই, পুরাই খাশি হইয়া গেছে। খাশিডাই চুরি করতে হইবো।
-কামডা কি ঠিক হইবো? কিস্তি উঠাইয়া কিনছে। চুরি করলে কিস্তি পরিশোধ করবো কেমনে?
-এইযে, তোর বিবেক আবার খাড়াইয়া গেছে! আমরা কি সবগুলা একসাথে নিমুনি? কিস্তিতে কেনা ছাগল আমরা কিস্তিতে চুরি করুম! আজকে একটা নিমু, বুড়াডা আবার বাচ্চা দিবো, চাচির বেশি সমস্যা হইবো না!
-তবুও চিন্তা কইরা দেখ! কামডা কি ঠিক হইবো?
-কোন চিন্তা করিস না, ধর খাসিডা হের জামাইরে দিছে! তুইতো বিয়া করছোস, আমি কি করছি? আমারে হের জামাই ভাবলেই হইলো!
-আইছি যহন, তহন এত চিন্তা ভাবনা কইরা লাভ নাই। কি করবি আর কখন করবি বল?
-বয়, বিড়ি টান। সময় হইলেই কইমু।
জাবেদ আর মকিম কিছুক্ষণ পায়চাড়ি আর বিড়ি টানাটানির পর রাত একটু গভীর হলে আস্তে আস্তে জমিলার বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলো। গ্রামের মানুষ সন্ধার পর পরই ঘুমিয়ে পড়ে। শুধু ঘুম নয় গভীর ঘুমে নিমজ্জিত হয়। সারা দিন প্রচুর খাটাখাটুনির পর কার মনে চায় রাত জাগতে?
জাবেদ আর মকিম জমিলার উঠানে পা রাখতেই জমিলা চাচির কুকুর কিভাবে যেন টের পেয়ে গেলো। জাবেদ ওস্তাদ চোর। পকেটে করে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে বনরুটি নিয়ে এসেছে। দুর থেকেই একটা ছুড়ে মারলো। কুকুরটা নিয়ে অমনি খাওয়া শুরু করলো। প্রথমটা খাওয়া শেষ হলে আরেকটা দিলো। সেটাও খেলো কুকুরটা। মকিম বললো
-কি করস? আমরা কি কুত্তারে রুডি খাওয়াইতে আইছি?
-কতা কইস না, দেখতে থাক। এবার চল একটু সইরা থাকি। বিশ মিনিট পর দেখবি কুত্তায় কোন জ্বালাতন করবো না। 
-হেইডা আবার ক্যামনে? আবার গেলে আবারওতো রুডি দেওয়া লাগবো, রাইত ভইরা কি ওরে রুডিই খাওয়াইমু?
-আর লাগবো না। দুইডায়ই ও কাইল দুপুরের আগে ঘুম থেকে উঠতে পারবো না। গ্যারান্টি!!
-কস কি? কি করছস? তুইতো বেশ শিয়ানা!
-খালি রুডি খাওয়াইমু আমি কি এত খারাপ লোক?
-না না! তুইতো বায়তুল মোকারমের জুতা চোরা হাজি!
-বাজে কতা কইস না! চুপচাপ অপেক্ষা কর। 
-মশায় তো চুমায়!
-জমিলা চাচির মাইয়্যায় তোর লাইগা কি কয়েল জ্বালাইয়া রাখবো? মশায় তো কামড়াইবোই। হাত নাড়, যাইবো গা। 
মিনিট বিশেক পরে জাবেদ আর মকিম হাটা দিল জমিলার ঘরের দিকে। ছোট্ট ঘরের পাশেই একচালা দিয়ে ছাগল রাখার ঘর করছে। ঘরের ঝাপ দড়ি দিয়ে বাধা। বাধন খুলে ভিতরে প্রবেশ করে দেখে ছাগল শুয়ে শুয়ে পান চিবোনের মত ঘাষ চিবুচ্ছে। খুটির সাথে বাধা খাশির গলার দড়িয়া খুলে মকিমের হাতে ধরিয়ে দিলো জাবেদ। এবার যখন আরেকটা খুলতে যাবে তখন মকিম বাধা দিলো। চোর হলেও ইমান মজবুত। জাবেদকে থামিয়ে বললো
-এমন কতাতো ছিলো না! খাসিটা নেওয়ার কথা, লইছি, এখন ভালোয় ভালোয় চল। এমন ভাবে মাথার মাঝে বাড়ি মারার দরকার নাই। অভিষাপে ছারখার হইয়া যামু। 
-তোর ইমান তো দেহি টনটনা! আচ্ছা যা, খাসিডা লইয়াই যাই। আরেকদিন আরেকটা নিমুনে। রাইখ্যা খাইতে হইবো। একদিনই সব খাইলে পরে খাইমু কি? তোর বুদ্ধিটা খারাপ না! এইবার চল।
মকিম খাশির মাথা ঢেকে কোলে নিয়ে হাটা শুরু করেছে! পিছন পিছন জাবেদ হাটতে শুরু করলো। এমন সময়ই কুকুর ঘেউ ঘেউ করা শুরু করলো। জাবেদ তো তাজ্জব! এ কেমন করে সম্ভব! ঘুমের ওষুদ মিশানো দুইটা বনরুটি খাওয়াইছে। এরপরও কিভাবে ঘুম ভাঙ্গে। ঔষধ কোম্পানির উপর আসলে ভরসা করা যায় না। ভেজালে দেশটা ছেয়ে গেছে। সব কিছুতে ভেজাল দেয় দিক আছে, তাই বলে ওষুধেও? অবাক হয়ে যায় জাবেদ। কুকুরের ডাকাডাকিতে ছাগল এবার সাহস পেয়েছে। সেও মেতাতে শুরু করলো। কুকুরের ঘেউ ঘেউ আর ছাগলের মেতানিতে জমিলার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। জমিলা বুঝতে পারলো ঘটনা কি। তারাতারি স্বামীকে ডেকে তুললো। জমিলা ও তার স্বামী দরজা খুলে চেচাতে থাকলো। চোর চোর বলে শোর দিতেই আশেপাশের প্রতিবেশিরাও ঘুম থেকে উঠে টর্চ লাইড নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। মকিম বললো 
-কাম শেষ। ধরাই মনে হয় পইরা গেলাম। 
-তুই আসলে একটা কুফা। আমার আগেই বুঝা উচিত আছিলো। তোরে লইয়া কামে বাইর হইলেই ধরা খাই। বদনা চুরি করলাম তাতে ধরা খাইলাম না, তোরে নিয়া আইয়া আজ ধরা খাইয়া যামু! দৌর দে।
-ছাগল কি করুম। ছাইরা দিমু?
-জানে বাঁচলে অনেক ছাগল চুরি করতে পারবি। এখন ফালাইয়া দৌর মার। আগে জান বাঁচা। 
মকিম ছাগল ফেলে দৌর দেয়ার আগেই লোকজন লাইট নিয়ে বের হয়ে গেছে। জাবেদ আর মকিমের দিকে সবাই লাইট মেরে রাখছে। মকিম ছাগল ছেড়ে দিয়েছে হাত থেকে। ছাগল মেতাচ্ছে। দৌর দেয়ার সুযোগ আর নেই। সবার হাতেই দেশীয় অস্ত্র। কেউ টেঁটা, কেউ সড়কি, কেউ হুনকোচ, কেউ লাঠি, কেউ কাফলার ডাল ভেঙ্গে নিয়ে আসছে। দৌর দিলে যদি টেঁটা মারে তবে কাম শেষ চিন্তা করে ওরা দুজনেই দাড়িয়ে রইলো।
সবাই কাছে আসলে প্রথমেই জাবেদ মুখ খুললো। এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো
-কি হইছে? এমনে চাইয়া রইছেন ক্যান? আমরা কি করছি?
‘কি করছ বুঝ নাই এহনও? কাউফলা দিয়া পাছায় কয়েকটা মারলেই টেরপাইবা।’ জমিলার স্বামী বললো। জমিলা দৌড়ে গিয়ে খাশিটা কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে থাকলো। কাদছে আর খাশির গায়ে হাত বুলাচ্ছে। দুজন এসে জাবেদ আর মকিমের হাত দুটি পিছনের দিকে নিয়ে ছাগলের দড়ি দিয়েই বেধে ফেললো। জাবেদ ও মকিমকে নিয়ে জমিলার বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলো সবাই। জমিলার বাড়িতে নিয়ে উঠানের পেয়ারা গাছটার সাথে বেধে রাখলো। উৎসাহি যুবকেরা কয়েক ঘা মাইর দিতেই চেচানি শুরু করলো দুজন। এলাকার মুরুব্বিরা যুবকদের থামিয়ে দিয়ে বললো
-থাম, মারার দরকার নাই। বেতালে বাড়ি পরলে মইরাও যাইতে পারে। চোর মাইরা মাডার কেসের আসামী হওয়া লাগবো। মারার দরকার নাই। যা করার কালকে সকালে চেয়ারম্যান সাবের কাছে নিয়াই করবো। কয়েকজন ওদের পাহারার জন্য থাক। সকালে চেয়ারম্যানের বাড়ির উঠানে নিয়া আসিস। সবাই থাকুম আমরা।
এই বলে আস্তে আস্তে সবাই চলে গেলো যার যার বাড়ি। সকালে চেয়ারম্যান কোলাহালের কারনে উঠে গেলো। বাইরে এসে দেখে দুই চোর সহ এলাকার মানুষ এসেছে। জানতে চাইলে সবাই একসাথে বলতে শুরু করলো। চেয়ারম্যান সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললো
-একজন একজন করে বলো।
এক মুরুব্বি উঠে বললো 
-চেয়ারম্যান সাব। ওদের কারনে কেউ শান্তিতে থাকতে পারে না। পরশু রাতে কারো বাড়ির সিলভারের আর পেতলের বদনা রাখে নাই। প্লাস্টিক আর মাটির বদনা বাদে সব সাফ কইরা ফালাইছে। কাল রাতে জমিলার খাসিটা নিয়ে রওয়ানা দিয়েছে। আমরা সবাই হাতে নাতে ধরছি। একটা উপযুক্ত বিচার করোন লাগবো। 
-খালি কি তোমাগোডাই নিছে! আমার বদনা, আমার মায় যেইডায় কইরা রাইতে মোতে সেই পিতলের পিসপটও নিয়া গেছে। তোমরা কইছো, আমিতো কই নাই সরমে! কত বড় সাহস চিন্তা করা যায়?
-তাইলে আপনিই ওদের বিচার করেন। 
চেয়ারম্যান ওদের কাছে ডাকলেন। জিজ্ঞেস করলেন এমন কাজ আর করবে কিনা? ওরা দুজনেই মাইরের ভয়ে জানালো আর করবে না। তখন চেয়ারম্যান ঘোষনা করলো যে ওরা এই এলাকায় থাকতে পারবে না। সেই শর্তে ওদের ছেড়ে দেয়া হবে। নয়তো পুলিশে দেয়া হবে। সাথে দশটা করে জুতার বাড়ি দেয়া হবে। উপস্থিত সবাই এক বাক্যে চেয়ারম্যানের সাথে সায় দিলো। উপস্থিত দুজন করে ষন্ডা মার্কা যুবক দুই কিস্তিতে জুতাপেটা করলো। জুতা পেটা করার পর জাবেদ ও মকিমকে চেয়ারম্যান বলে দিলো,
-তোদের যদি এই এলাকায় আর দেখি তবে কি শাস্তি অপেক্ষা করতাছে তা তোরা চিন্তাও করতে পারছিস না। এলাকা ছেড়ে চলে যাবি এবং নতুন জায়গায় নতুন ভাবে মাথা উচু করে বাঁচবি। এসব আকাম ছাকাম ছেড়ে দিবি, ঠিক মনে থাকবে।
-জি চেয়ারম্যান সাব, মনে থাকবে।
বিচারের পরে জাবেদ আর মকিম শরীরে প্রচন্ড জুতা পেটার ব্যথা নিয়ে যার যার বাড়ি চলে গেলো। বাড়ি গিয়ে মকিম তার স্ত্রীকে বললো, 
-সব গুছাও। এই এলাকায় আর থাকা যাবে না। 
-তোমারে কতবার কইছি ভালো হইয়া যাও! আমার কথা শুনলা না। আজ আবার মাইর খাইলা। এখন আমি সমাজে মুখ দেখাবো কেমন করে, সেইটা একবার চিন্তা কইরা দেখলা না!
-আমি এই এলাকায় আর থাকবো না। আর তোরে আজ কথা দিলাম, আমি ভালো হইয়া যাইমু। এমন কাম আর কোনদিন করুম না। এই এলাকায় থাকলে আমি ভালো হইতে পারুম না। সবাই আমায় খোটা দিবো। চাইলেও ভালো থাকতে পারুম না। চল এই এলাকা থেকে যাইগা।
-তুমি কি কতা রাখবা? আবার যদি কর?
-না, তোর মাথা ছুইয়া কথা দিলাম। আমি কষ্ট কইরা খামু, তবুও আর এই পতে যামু না। আমারে বিশ্বাস কর।
-বিশ্বাস কইরা কইরাইতো এতদিন ধইরা সংসার করতাছি। আইজও করলাম। চলো, যাইগা। নতুন কোন জায়গায় বাসা নেই। তয়, কই যাইবা?
-ঢাকা যামুগা। বিশাল জায়গা, কোটি মানুষ। একটা না একটা কাম কাইজ জুটবোই। কাম কইরা খাইমু। 
মকিম ঢাকায় এক বস্তিতে ছোট্ট একটা ঘর নিলো। পরিচিত এক লোকের মাধ্যমে একটা রিক্সা নিলো। প্রতিদিন রিক্সা চালিয়ে যে আয় করে তার থেকে খরচের টাকাটা বাদ দিয়ে বাকি টাকা বউয়ের হাতে তুলে দেয়। সংসারে দুজন মানুষ। খরচ খুব একটা বেশি করে না মকিমের বউ। মকিম সারাদিন পরিশ্রম করে যা আয় করে তার বড় একটা অংশ চলে যায় রিক্সা মালিককে ভাড়া বাবদ দিতে। মকিমের বউ পাশের ঘরের ভাবিদের সাথে একটা সমিতি করেছে। ভাসমান সমবায় সমিতি। স্থানীয় একটি এনজিওর এক আপা এসে প্রতিদিন সমিতির চাঁদা নিয়ে যায়। সঞ্চয় বেশ ভালোই জমেছে। অন্য সদস্যরা ঋণ নিয়েছে আগেই। এবার মকিমের বউয়ের পালা। মকিম রাতে বাড়ি আসলে বউ বলে,
-তুমিতো অনেক কষ্ট কর। যা আয় করো তার বড় একটা অংশ চইলা যায় মালিকের ভাড়া দিতে। নিজে যদি একটা রিক্সা কিন তাইলে যা আয় করবা তার পুরাটাই তোমার থাকতো। তখন পরিশ্রম আরেকটু কম করলেও চলতো। তুমি একটা রিক্সা কিনো।
-রিক্সা কিনুম টাকা পাইমু কই। প্রতিদিন যা একটু একটু কইরা জমাইছো তাতে কি রিক্সা কিনা যাইবো, একটা চাক্কাও কিনা যাইবো না। 
-তুমি চিন্তা কইরো না। আমি কিছু সঞ্চয় করছি। এখন ঋণ নেওয়ার পালা আইছে। আমি ঋণ নেই। তুমি একটা রিক্সা কিনো!
সমিতির থেকে ঋণ নিয়ে মকিম একটা রিক্সা কিনলো। আয় রোজগার ভালোই হয় এখন। তবে রিক্সা মালিকের জমার মতই বড় অংকের একটা টাকা চলে যায় ঋণের কিস্তি বাবদ। কিস্তির কথা মনে পরলে মকিমের ঘুম আসতে চায় না। এ এক নতুন আপদ ঘরে এসেছে। মাঝে মাঝে ভাবে, এর চেয়ে ভাড়ার রিক্সাই ভালো ছিলো। এতটা চাপ ছিলো না। এখন ঋণের কিস্তি দিতে দেরি হলে বা দিতে না পারলে সমিতির লোকজন এসে বউকে বকাঝকা করে, খারাপ ব্যবহার করে। মকিম সকল লাঞ্চনা-বঞ্চনা নিজে সহ্য করতে রাজি কিন্তু বউকে সে কোন কটু কথা শুনাতে চায় না। 
মকিম বউকে খুবই ভালোবাসে। শত কষ্ট হলেও সে বউকে কষ্ট দিতে চায় না। পূর্বে এদিক ওদিক করলেও এখন সে বউয়ের প্রতি খুবই আন্তরিক। বউ ছাড়া অন্য কোন মেয়ের সাথে সম্পর্ক করার কথা চিন্তাও করে না। এত ভালোবাসার বউকে যদি সমিতির লোকজন এসে দুর্ব্যাবহার করে যায় তা কি সহ্য করার মত? সম্প্রতি রিক্সা চালিয়ে আয়ও অনেক কমে গেছে। সপ্তাহে দু এক কিস্তি মিস হয়ে যাচ্ছে। এটা মকিম ইচ্ছাকৃত করে না। রাস্তায় নামলে প্রতিদিন যে একই রকম আয় হবে তাও কিন্তু নয়। 
চৌদ্দ ফেব্রুয়ারি। রিক্সা নিয়ে নেমেছে মকিম। সারাদিন রিক্সা চালিয়েছে। জোড়ায় জোড়ায় ছেলে মেয়ে ঘুরছে। সারাদিন জোড়ায় জোড়ায় যাত্রী টেনেছে মকিম। সন্ধা হওয়ার সাথে সাথে চিন্তা করলো আজ আর কাজ করবে না। বাসায় চলে যাবে। বউকে একটু আদর করবে, ভালোবাসবে। চাইলে বউকে নিয়ে রিক্সায় ঘুরবে। বউ যদিও মকিমের রিক্সায় চড়তে চায় না। মকিম কষ্ট করে চালাবে আর সে বসে থাকবে সেটা সহ্য করতে পারে না। মকিম বাসায় গিয়ে দেখে বউ বসে আছে। মকিম বললো
-চলো আজ বাইরে ঘুরতে যাবো।
-আজ হঠাৎ ঘুরতে যাওনের কি হইছে।
-আজকে নাকি ভালোবাসোনের দিবস। গরিবের কি ভালোবাসা নাই? আমরাও চলো ঘুরতে যাই।
-না, না। আমার সরম লাগতাছে। তুমি কি যে কও! 
-চলোই না। যাই।
-আমার কাম আছে। রান্দোন লাগবো।
-লাগবো না। রাইতে ঘুইরা ঘাইরা বাইরেই খাইয়া লইমু।
মকিম তার বউকে নিয়ে বেরিয়ে পরলো। একটা রিক্সা ভাড়া করলো। ঘন্টা চুক্তিতে রিক্সা নিলো। দুই ঘন্টা শহর দিয়ে ঘুরিয়ে আবার এই বস্তিতেই নামিয়ে দেবে। মকিম ঘুরাঘুরি ফাকে ফাকে বউকে চটপটি, ফুচকা খাওয়ালো, ফুটপাত থেকে আলু পুরি কিনে রিক্সায় বসে খেলো। দারুন সময় কাটলো দুজনের। বাসায় ফিরে এসে অনেক রাত হওয়ায় শুয়ে পড়লো। সারাদিন যুবক যুবতিদের ভালোবাসাবাসির কর্মকান্ড দেখে বউকে একটু আদর করতে মন চাইলো। হাতটা ধরে কাছে টেনে নিয়ে গল্প করলো। আদরের এক পর্যায়ে বউ বললো
-কালকে কিন্তু কিস্তি দিতে হইবো, মনে আছে?
মকিম এবার বউয়ের হাতটি ছেড়ে দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। মকিমের বউ মকিমের নিরবতা দেখে বললো
-কি হইলো! ঘুমাইয়া পরলা নাকি? আদর গেলো কই? চুপ হইয়া গেলা যে?
-না, এমনিই!
-কি হইছে বলো, একটু আগেতো কতা বার্তা কইলা। হঠাৎ কইরা চুপচাপ হইয়া গেলা, কারন কি?
-কোন কারন নাইরে বউ!
-কারনতো একটা আছেই। নইলে হঠাৎ কথা বন্ধ কইরা দিলা যে। কি হইছে বলো। আমার কোন অপরাধ?
-কিছু না। আসলে কিস্তির কতা উডাইলা পরে সব কিছু মাটি হইয়া গেলো। এখন আর কিছুই ভালো লাগতাছে না। সব যেন ভিতরে ঢুইক্কা গেলো। বউ, কিসের লাইগা যে কিস্তির কতা মনে কইরা দিলা! আরেকটু পরে কইলে কি হইতো বলো? কিস্তি এমন একটা জিনিস, এই কথা মাতায় আসার সাথে সাথে সব সুখ উইড়া যায়। তোমার কোন দোষ নাই বউ! হায়রে কিস্তি............দিতে না পারলে বউও নিয়া যাইতে চায়! কেন যে কিস্তি উঠাইয়া রিক্সা কিনতে গেছিলাম!