ভালবাসি প্রকৃতি

ভালবাসি প্রকৃতি

Saturday, July 28, 2018

পথের পদ্য-১॥ ভারত ভ্রমন ॥কলকাতা॥ জীবনে প্রথম কিছু (দ্বিতীয় গ্রন্থের পান্ডুলিপি)

পথের পদ্য-১
ভারত ভ্রমন॥ কলকাতা॥ জীবনে প্রথম কিছু





উৎসর্গ

বাংলাদেশের সাধারণ সহজ-সরল মানুষের উদ্দেশ্যে
যারা ঘুরতে পছন্দ করেন 
এবং 
আমার প্রয়াত মা রওশনারা বেগম 
ও 
পিতা আবদুর রশিদ খান




কিছু কথা
ঘুরতে কার না ভাল লাগে। আমার তো বেশ ভাল লাগে। সেটা দেশেই হোক আর বিদেশেই হোক। ঘুরতে ঘুরতে রাস্তায়, ফুটপাতে, অলিতে, গলিতে, শহরে, বন্দরে যেখানেই যা দেখি তাই আমার হৃদয় কারে। পথে ঘুরতে ঘুরতে যে বিষয় গুলো আমার হৃদয় কারে সেই বিষয়গুলো নিয়ে লিখতে পছন্দ করি, লিখতে চেষ্টা করি। আর সেই পথের বিষয় নিয়ে লেখাই আমার পথের পদ্য। 
জীবনের প্রথম সব কিছুই একটু আলাদা আমেজের। প্রথম পাসপোর্ট, প্রথম বিদেশ ভ্রমন, প্রথম রেলে চড়া ইত্যাদি সবকিছুতেই নতুনত্বের স্বাদ। আর তাই নিয়েই আমার এই লেখা। প্রথম বিদেশ ভ্রমনে কলকাতা গিয়েছিলাম। বাংলাদেশ এর বর্ডার লাইন ক্রস করে অপর প্রান্তে ভিন্ন কোন দেশে প্রবেশের স্মৃতি কখনো কি ভোলা যায়? তাই প্রথম ভ্রমনের কিছু স্মৃতি নিজের জন্য এবং আমার পাঠক বন্ধুদের জন্য তুলে ধরেছি। আমি কোন লেখক নই। লেখাটা প্রথমে খন্ড খন্ড আকারে আমার ফেসবুক ওয়ালে পোষ্ট করেছি। লেখাটা ফেসবুকে পোষ্ট করার পর যে সারা পেয়েছি তা কল্পনাতিত। আমি আমার মনের ভাব প্রকাশ করেছি মাত্র, কোন সাহিত্য রচনা করিনি। আমার লেখাটা পড়ে যদি কেউ আনন্দ পায় বা কিছু তথ্য জানতে পারে বা আমার চোখে সে ঘুরতে পারে সেটাই আমার স্বার্থকতা। 
লেখায় নানা বিষয়ে সহযোগীতা প্রয়োজন। আমিও নিয়েছি। উন্মুক্ত বিশ্বে এখন তথ্য প্রাপ্তি কোন কঠিন বিষয় নয়। গুগলে সার্চ দিলে কোটি কোটি তথ্য চলে আসে চোখের নিমিষে। আমি তাই গুগলের প্রতি কৃতার্থ। উইকিপিডিয়া, উইকিমিডিয়া, কলকাতার বিভিন্ন ওয়েবসাইট, বিভিন্ন ব্লগারদের ব্লগ ঘেটে আমি অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছি। ঘুরে যেমন অভিজ্ঞতা হয়েছে তেমনি না ঘুরে গুগোল ঘেটে অনেক তথ্য জেনেছি ও স্থানগুলো দেখেছি। আমি কৃতার্থ আমার পাঠক বন্ধুদের কাছে যারা ফেসবুকে আমার লেখাটা গ্রহণ করেছে এবং আমায় একের পর এক লিখতে উৎসাহ দিয়ে সহযোগীতা করেছে। আমি কৃতার্থ আমার বন্ধু আইনজীবী ভাইদের কাছে যারা আমার ভ্রমনের সহযাত্রী হয়েছে। আমি কৃতার্থ আমার সহধর্মীনি মুনমুন সুলতানা লুনার কাছে যে আমাকে ভ্রমনে উৎসাহ দেয় সর্বদা এবং আমার ঘুরতে যাওয়ায় একাকিত্ব সহ্য করে। বিশেষ করে যাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেই দায় শেষ হয় না তারা হলেন, বিশিষ্ট শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মাহবুবুল হক, জাপানের সিমানী বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিরত ভূতত্ববিদ শামীম আজিজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিষ্ট্রার মোঃ ফরিদ হোসেন, শরীয়তপুর জেলা আইনজীবী সমিতির বার বার নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট মোঃ আবু সাঈদ, বন্ধু এডভোকেট জামাল ভূইয়া, এডভোকেট মুরাদ হোসেন মুন্সী, শামীম সরদার, আমার বোন কোহিনুর আক্তার শিখা। 
আমি আগেই বলেছি, আমি কোন লেখক নই। তাই আমার লেখায় শব্দ গঠনে, বানানে অনেক ভুল থাকে। অনেক তথ্য যেহেতু ধার করা তাই ভুল তথ্যেরও সন্নিবেশ ঘটতে পারে বা ঘটেছে। আমি আমার অযোগ্যতাকে লুকাতে চাই না। অনিচ্ছাকৃত ভুলগুলো আমার অজ্ঞতা, অযোগ্যতা ছাড়া আর কিছুই না। তাই আমার ভুল গুলো বন্ধুরা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে লেখাটা গ্রহণ করবেন বলেই আমার আশা। 
আসাদুজ্জামান জুয়েল
আইনজীবী
শরীয়তপুর।





॥ ১ ॥
প্রথম পাসপোর্ট

৩৭ বছর পেরিয়ে গেছে অথচ পাসপোর্ট নেই আমার। আর এর আগে পাসপোর্টের প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করিনি। ১৯৯৪ সালে এসএসসি পাস করি। আমি ভাল ছাত্র ছিলাম না। পড়াশুনায় আমার মনোযোগও ছিলো কম। পড়তে বসলে টেবিলে ঘুমিয়ে পড়তাম। পড়ার টেবিলে বসে ঝিমুনির সময় আমার বড় ভাই রুহুল আমিন খান আজাদ আমায় টেবিলের সাথে মাথা টাক দিয়েছে অনেক দিন। তবে পরিবারে সবসময়ই ছিলো পড়াশুনার চাপ। বড় ভাই ছিলো ভালো ছাত্র, বোন কোহিনুর আক্তার শিখাও ছিলো ভালো ছাত্রী। তাই আমার পড়াশুনা না করে কোন উপায়ই ছিলো না। আর পড়াশুনা ছাড়া অন্য কোন কিছু করতে দেয়ার মানসিকতাও ছিলো না পরিবারের। আমার মা আমাদের জন্য যে কষ্ট করেছে তা বলতে চাই না। তবে তার সারাজীবনের কষ্ট ছিলো সন্তানদের মানুষ করা-শিক্ষিত করে গড়ে তোলার সংগ্রামে। তৎকালীন সময়ের তুলনায় রেজাল্ট খুব ভাল না হলেও খুব যে খারাপ তাও বলবো না। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে বিষয় প্রতি সত্তর পার্সেন্টের উপরে মার্কসসহ প্রথম বিভাগেই উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। তারপরেও পরিবার এবং নিজে খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারিনি। আমি কখনোই ভাল স্টুডেন্ট ছিলাম না। এভারেজ স্টুডেন্ট হিসাবে যা রেজাল্ট হয়েছে তাতে ভবিষ্যতে যে খুব ভাল কিছু করে কেটে খেতে পারবো সেই ভরসা আমার মধ্যে পরিবারের লোকজন দেখতে পাচ্ছিল না। তাই পরিবার থেকে সিদ্ধান্ত নিল বিদেশ পাঠিয়ে দেবে। আমার ছোট খালু বিল্লাল হোসেন খান তখন সৌদি প্রবাসী ছিলেন। ঐ সময় তার প্রবাস জীবনের ব্যাপ্তি বিশ-বাইশ বছরের অধিক। তাই খালুর ওখানে পাঠালে আমি ভাল থাকবো এবং আমার কোন সমস্যা হবে না এই ভেবে আমাকে প্রস্তাব দিলো যে,
-তুই সৌদি চলে যা।
আমার বিদেশের প্রতি কোন কালেই মোহ ছিল না। প্রবাসীদের আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি। তারা নিজেদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, শরীরের তাজা রক্ত পানি করে টাকা রোজগার করে দেশে পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখে এবং দেশের বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ পাহাড়সম করে যা নিয়ে আমরা গর্ভ করি। প্রবাসীদের কারনেই আজ আমাদের দেশ এতোটা সমৃদ্ধ হয়েছে। যার বাড়িতে টিনের ঘর ছিলো, তার বাড়িতে আজ সুরম্য অট্টালিকা শোভা পাচ্ছে। যার ছোট ভাই কিংবা সন্তান এক থেকে দুই হাজার টাকা মূল্যের একটা বাই সাইকেল কেনার জন্য স্বপ্ন দেখতো দিন রাত্রি। একটা বাই সাইকেল কেনার বায়নায় দু’একদিন ভাত খায়নি রাগ করে তার পাছার নিচে আজ দুই থেকে চার লাখ টাকার মটোর বাইক শোভা পায়। যার স্ত্রীর-কন্যার নাকে ছিলো শুধু নাক ফুল, কানে সুতোর মত চিকন রিং তার স্ত্রী-কন্যার গলায় আজ শোভা পায় সিতাহার, হাতে মোটা চুড়ি, কানে ভারি দুল। গহনার ভারে এখন শরীর হেলে যায়। সবার হাতে হাতে আজ যে দামী স্মার্ট ফোন শোভা পায় তার পুরো কৃতিত্ব প্রবাসী ভাইদের। নতুবা দেশের রোজগারে যেখানে দিন চালানোই কঠিন ছিলো, সেখানে আজ কত বিলাসিতার বাহার।
যা হোক, আমি যেতে চাইলাম না কেন এর যুক্তি হিসাবে যা চিন্তা করেছিলাম তা আজও আমার মনে আছে এবং মনে থাকবে। কারন যুক্তিটাযে আমি মনে প্রাণে লালন করি। প্রথমত আমি আমার মাকে ছেড়ে দূরে থাকতে পারতাম না। আমি যখনই বাড়ি যেতাম, স্কুল থেকে হোক, বা বাজার থেকে বা বেড়িয়ে এসে, যদি দেখতাম মা বাসায় নেই, তখনই বেড়িয়ে পড়তাম মা যেখানে গেছে সেখানটার উদ্দেশ্যে। মানুষের সামনে মা আমাকে পরিচয় দিতে ‘কোলের পোলা’ হিসাবে। যারা চিনতো জানতো তারা দেখে রশিকতা করতো, ঐযে আইছে কোলের পোলা, দুধ খাইবো!
আমি তুলাসার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে পালং তুলাসার গুরুদাস সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। স্কুল জীবনের মধুর দিনগুলি কাটিয়ে ফেললাম চোখের নিমিশেই। এসএসসি পাস করার পর আমার ঘনিষ্ট বন্ধুরা সবাই চলে গেলো সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজে। আমিও চাইলাম সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজে পড়তে। আমার ইচ্ছা ছিলো আমি আর সাইন্স নিয়ে পড়বো না। সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজে গিয়ে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হবো। কিন্তু পরিবার থেকে আমাকে আর যেতে দিলো না। মনে গভীর হতাশা নিয়ে আমি শরীয়তপুর সরকারী মহাবিদ্যালয়ে আবার সেই সাইন্স বিভাগে ভর্তি হলাম। ঐযে এভারেজ স্টুডেন্ট আমি! কোনরকম রেজাল্ট হলো। আমি শিক্ষা জীবনের এক পর্যায়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে অনার্স শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলাম। বছর দুয়ের মধ্যে যত ছুটিছাটা পেয়েছি বাড়ি চলে এসেছি। ছুটি না থাকলেও মাঝে মাঝেই বাড়ি চলে এসেছি। তাতে পড়ার বারোটা বেজেছে। হুটহাট বাড়ি চলে আসলে আর গেলে পড়াটা হবেই বা কিভাবে। অবশেষে আমি বুঝতে পেরেছি আমার দ্বারা অনার্স শেষ করা হবে না, বাড়িই চলে যাই। যেই সিদ্ধান্ত, সেই কাজ। ঢাকার তল্পি তল্পা গুটিয়ে বাড়ি চলে এলাম এবং বি,কম শ্রেণীতে ভর্তি হলাম। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রিয় সাইন্স পড়া ছেড়েই দিতে হলো। শেষ পর্যন্ত প্রিয় সাইন্স ছেড়ে অপ্রিয় হলেও ডেবিট-ক্রেডিট পড়া শুরু করলাম সাইন্সকে চির বিদায় দিয়ে।
মূল বিষয় থেকে একটু দুরে চলে এসেছি, আমাকে যখন বিদেশ যেতে প্রস্তাব করা হলো, আমি তখন বলেছিলাম-
-বিদেশ যাব ঘুরতে, কখনো কাজ করতে নয়।
এই উত্তর দেয়ার পিছনে একটা কারনও ছিলো। যদি কাজ করতে যাই তবে ইচ্ছে হলেই ফিরে আসতে পারবো না। মাকে দেখতে ইচ্ছে হলে বা মায়ের অসুস্থতায় ইচ্ছে করলেই আসা যাবে না। ছুটি পাওয়া, প্লেনের টিকিট পাওয়া নানা বিষয় জড়িয়ে থাকবে। আর যদি দেশে থাকি তবে ইচ্ছে হলেই তা সম্ভব হবে। দেশের যে জেলাতেই যাই, যে কোন মূহুর্তে যে কোন খবরে ছুটে চলে আসতে পারবো। ঘুরতে গেলে ঘুরে চলে আসবো। এসেই মায়ের মুখ দেখবো। মাকে যে বড় ভালোবাসি।
মা’ই আমার কাছে ছিল একটি পৃথিবীর সমান। শেষ পর্যন্ত বিদায় বেলায়ও আমি মায়ের পাশেই ছিলাম। এটাই আমার তৃপ্তি। প্রবাসে গেলে হয়তো অনেক অর্থ বিত্তের মালিক হতে পারতাম কিন্তু মায়ের শেষ নিঃস্বাসের সময় পর্যন্ত পাশে থাকতে পারতাম না। আমার মা এখন আর নেই। মানে জীবিত নেই। কিন্তু আমি এখনও মায়ের কাছেই আছি। প্রতিদিন ঘর থেকে বেরিয়ে মায়ের পাশ দিয়ে বাইরে যাই কাজের উদ্দেশ্যে। কাজ শেষে ফিরে আসি মায়ের পাশ দিয়ে। আমার মাকে শায়িত করা হয়েছে বাড়ি থেকে বের হওয়ার রাস্তার পাশে। যাওয়া আসার সময় মাকে বলে যাই, মা যাই।
আমি বাড়ি থেকে যখনই বের হতাম, তখনই বলতাম, মা যাই। যতক্ষণ পর্যন্ত মা না বলতো যে, যাও, সাবধানে যাইও, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি বলতেই থাকতাম, মা যাই। আজো বলি, মা যাই, তবে আমার মা আজ আর বলে না, যাও, সাবধানে যাইও। কিন্তু আমি আমার বলাটা বলেই যাই এবং যতদিন বাচবো বলেই যাবো মা যাই, মা উত্তর দিক বা না দিক। তবে এখনও যাও, সাবধানে যাইও কথাটা বলে, সেটা আমার আরেক ছোট্ট মা প্রিয়ন্তী। আমি খুব সখ করে আমার মেয়ের নাম মায়ের নামের সাথে মিলিয়ে রেখেছি, রওশন আসাদ প্রিয়ন্তী। আমার মেয়েও কেমন করে যেন শিখে গেছে, যাওয়ার সময় বলে যাও, সাবধানে যাইও। অবিকল আমার মায়ের ভাষায়। ওর কথায় আমি অভিভূত হই, পূলকিত হই। 
এসব কারনেই আমার আর পাসপোর্টের প্রয়োজন হয়নি। পরবর্তীতে শরীয়তপুর আসার পর বি,কম পড়ার পাশাপাশি প্রথম আলোয় সাংবাদিকতা শুরু করি। একটানা প্রায় আট বছর শরীয়তপুর জেলার জেলা প্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছি। পাশাপাশি শুরু করেছিলাম ঔষধের ব্যবসা। তৎকালীন সময়ে খুলনা আর যশোরে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক হত্যার ঘটনা ঘটে। আমার মা বেশ ভয় পেয়ে যায়। আমি যদি কোন কিছু নাও করি তবুও সাংবাদিকতা করতে দেবে না। কি আর করা, মায়ের কথায় প্রিয় পেশা সাংবাদিকতা ছেড়ে চলে গেলাম ঢাকায়। ঢাকায় আসার সময় একই রকম দুটি মোবাইল সেট কিনলাম সিটিসেল কোম্পানির। সিটিসেল বিশেষ একটা প্যাকেজ ছেড়েছিলো যার কল রেট ছিলো নাম মাত্র। দুটি সেট কিনে একটা দিলাম মাকে আরেকটা নিলাম আমি। ঢাকায় এসে মার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা হতো সেই ফোন দিয়ে। মায়ের কাছে না থাকলেও পৃথিবী যেহেতু ছোট হয়ে গেছে তাই মন চাইলেই মার সাথে ফোনের মাধ্যমে থাকতে পারতাম।
ঢাকায় এসে এলএল,বি ভর্তি হলাম প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয়ে। মিরপুর প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। ক্লাশ হয় বিকাল থেকে রাতে। এর ফাঁকে একটা চাকুরী ধরিয়ে দিলো আমাদের প্রিয় আলমগীর মামা। আলমগীর মামা আমাদের সকলের এতটা প্রিয় যা বলে বুঝানো যাবে না। মামা আমাদের অনেক স্নেহ করতো, কিন্তু চলতো বন্ধুর মত। পড়াশোনার ফাঁকে যেহেতু অফুরন্ত সময় হাতে তাই মামা একটা চাকুরি দিলো বাংলাদেশ ব্যাটল লিফ এক্সপোর্টার এসোসিয়েশনে। আমার কাজ ছিলো বাংলাদেশ বিমানের কার্গো ভিলেজে পান রপ্তানি তদারকি করা। চাকুরীর ফাকে ফাকে দিনের বেলা করি শেয়ার ব্যাবসা। মতিঝিলে শেয়ার ব্যবসা নিয়ে দুপুর পর্যন্ত ব্যস্ত থাকতাম। তখন শেয়ার ব্যাবসা বেশ রমরমা। কেনা-বেচা, লাভ-লস সবই হতো। শেয়ার বাজার থেকে টাকা তুলে, চাকুরি করে পড়াশুনাটা শেষ হলো। 
অতঃপর এলএল,বি শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে তালিকাভূক্তির যুদ্ধ। সবসময় শুনে এসেছি, তালিকা ভূক্তি বেশ কঠিন কাজ। যাদের সাথেই কথা বলি সেই বলে এক-দুইবার পরীক্ষা দিয়ে, ভাইবা দিয়ে পার পাওয়া কঠিন। দুরু দুরু বুকে লিখিত পরীক্ষায় বসলাম। আমার আসন পড়লো ঢাকা কলেজে। পরীক্ষা ভালোই হলো। প্রথমবার লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়েই কৃতকার্য হলাম। মনের আত্মবিশ্বাসটা বেড়ে গেলো। এর পর ভাইভা পরীক্ষা এক চান্সেই পার করে হয়ে গেলাম মায়ের চির আকাঙ্খিত এডভোকেট। রেজাল্ট পেয়ে রাতেই মাকে ফোন করে খবরটা জানালাম, কাদলাম আমি, কাদলো মা’ও।
যেহেতু ঢাকায়ই ছিলাম তাই ঢাকা বার এসোসিয়েশনে সদস্য হওয়ার জন্য ইনটিমেশন জমা দিয়েছিলাম। ঢাকা বারে আবার ভাইবা দিয়ে সদস্য হলাম। আমার যেহেতু কোন রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল না, আবার আমি চটপটেও না তাই কয়েক দিনেই বুঝে গেলাম ঢাকায় আমার ওকালতি হবে না। একেতো মায়ের টান তার উপর কেউই আমাকে মামলা দিয়ে সহযোগীতা করবে না তাই চলে এলাম নিজের এলাকা শরীয়তপুরে। শরীয়তপুর জেলা আইনজীবী সমিতিতে সদস্য হয়ে শুরু করলাম আইন পেশা। আমি এলএল.বি পাস করেই ভর্তি হয়ে যাই এলএল.এম এ। বার কাউন্সিলের সনদ হওয়ার পাশাপাশি মাষ্টার্স কম্পিলিট হয়ে গেলো।
এই সময় বসুন্ধরা গ্র“প কালের কন্ঠ পত্রিকা বের করবে। একদিন সন্ধায় ডাক পেলাম কালের কন্ঠ পত্রিকা থেকে। শুরু হলো কালের কন্ঠের সাথে পথ চলা। বছর তিনেক কালের কন্ঠের সাথে কাজ করতে করতে আমি বুঝে গেলাম একই সাথে আইন পেশা আর সাংবাদিকতা আমার পক্ষে হবে না। তাই কর্মজীবণের বিভিন্ন চড়াই উতরাই পার হয়ে আমার কর্মজীবনের তরী স্থায়ী ভাবে ভিড়লো আইন-আদালত-উকিল পাড়ায়।
আমি আমার মায়ের একান্ত ইচ্ছায় ও দোয়ায় আইনজীবী হিসেবে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে সনদ লাভ করলাম। প্রথমে ঢাকা বারে যোগদান করলেও ঐ মায়ের টানেই শরীয়তপুর বারে সদস্যপদ গ্রহণ করে আইন পেশায় যুক্ত হলাম। প্রথম প্রথম পেশার ব্যস্ততা আর আয় রোজগার দেখে চিন্তায় পড়ে গেলাম, কি ভাবে চলবো, কি করে বাঁচবো! আস্তে আস্তে পেশার ব্যস্ততা ও রোজগার বারলো। পেশায় ব্যস্ততা ও আয় রোজগারের সাথে সমন্বয় রেখে এবার মনে হলো বিদেশ ঘোরার সময় এসেছে। তাই পাসপোর্ট করা দরকার। এরই মধ্যে বড় ভাই মোহাম্মদ রুহুল আমিন খান আজাদ ইটালী প্রবাসী হয়ে তার পরিবারের অপর দুই সদস্য ভাবি লাভলী আক্তার ও ভাতিজা নাজমুল আমিন খান পাপনকে নেয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকলো। তাদের দুজনের জন্য পাসপোর্ট করার দ্বায়িত্ব পড়লো আমার উপর। ভাবলাম দুজনের জন্য যেহেতু আমাকেই দৌড়ঝাপ করতে হবে তাহলে আমার পাসপোর্টও করে ফেলি। যেই ভাবা সেই কাজ। তিন জনের পাসপোর্ট করার জন্য শরীয়তপুরে স্থাপিত আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে গেলাম এবং ফরম নিলাম।
পাসপোর্ট অফিসের দুর্নীতির বিষয় সবাই জানে, শুধু জানে না সরকার! পাসপোর্ট প্রতি বারশ টাকা ঘুষ লাগে, আমি নিজে গিয়ে উপ-পরিচালককে আমার পরিচয় দিলাম, তাতে আমাদের পাসপোর্টে আর বারশ টাকা ঘুষ বা উৎকোচ লাগলো না, আমাদের কাজ করে দিলো নিয়মের মধ্যে থেকে। আমাদের ফরমের কোনে বিশেষ একটা মন্তব্য লিখে দিলো যাতে অন্য কোন টেবিলে কোন ঝামেলা না করে, কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ হলাম ঐ কর্মকর্তার নিকট। কিন্তু পুলিশ ভেরিভিকেশন বলে একটা ব্যাপার থাকে, সেখানে আর মাফ পেলাম না! যথারীতি আমাদের পুলিশ ভাইরা (জনগণের বন্ধু) বন্ধুর কাছ থেকে ঠিকই চা খাওয়ার কথা বলে কিছু নিয়ে গেল। পুলিশ ভাইদের চায়ে যে চিনি এত বেশি লাগে আগে শুনেছি কিন্তু নিজে পাসপোর্ট করতে গিয়ে তা হারে হারে টের পেলাম! অতঃপর ১০ মার্চ ২০১৫ ইস্যুকৃত জীবনের প্রথম পাসপোর্টটি হাতে পেয়ে গেলাম কিন্তু কোন দেশের ভিসা তো নেই!
ভাবি লাভলী আক্তার ও ভাতিজা নাজমুল আমিন খান এর পাসপোর্ট পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সহ ইটালী ভিসা সেন্টারে জমা দেয়ার দীর্ঘদিন পর ভিসা সহ পাসপোর্ট ফেরত দিলো। এর কিছুদিন পর তাদের হযরত শাহ জালাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে বিদায় দিতে গেলাম। ভাবি ভাতিজা চলে গেলো বিদেশ, যাওয়ার সময় হৃদয় কাদলো। তারপরও একধরনের ভালো লাগলো যে, স্ত্রী তার স্বামীর কাছে যাচ্ছে, সন্তান তার পিতার কাছে যাচ্ছে। সন্তানের জন্য পিতা মাতার আদর স্নেহের বিকল্প কিছু নেই। ভাতিজা এতদিন মায়ের আদর-শাসন পেয়েছে কিন্তু পিতার স্নেহ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এখন আর সেই অভাবটা থাকবে না, এই ভেবে ভালোও লাগছিলো। ওদের বিদায় দিলাম আর আমি পরে রইলাম দেশেই! সেই মায়ের কাছে, পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে যাদের ভালোবাসা আমায় দূরে যেতে দেয় না।








॥ ২ ॥
প্রথম আবেদনে প্রথম ভিসাঃ

আমাদের নিকটতম প্রতিবেশি ও পরম মিত্র দেশ ভারত। ভ্রমণের জন্য বিদেশ হিসেবে ভারতের তুলনা নেই। কে যেন বলেছিল, ভারতে সবই আছে শুধু লন্ডন নেই! ভ্রমণের উদ্দেশ্যেই যেহেতু পাসপোর্ট করেছি তাই প্রথম ভারতের ভিসা চাইবো মনস্থির করলাম। ভারত ভ্রমণের ইচ্ছার পিছনে আরো কারনও আছে। ভারত যেতে বিমান লাগে না। বাসেই যাওয়া যায়। বিমান ভাড়া খরচ করে বিদেশ ভ্রমণের মত টাকাওয়ালা যেহেতু এখনও হইনি তাই ভারত যাওয়ার জন্যই চিন্তা করলাম। সবাই সতর্ক করে দিলো যে, ভারতের ভিসা পাওয়া আমেরিকার ভিসা পাওয়ার চাইতেও কঠিন! যেমন বলা তেমনই ফল পেলাম! ভারতের ভিসা চাইতে হলে সাক্ষাতের জন্য ই-টোকেন লাগে। ই-টোকেন করতেই দীর্ঘ সময় চলে গেলো, সাথে গেল টাকা। ভ্রমণ ফি যা নিলো তার কয়েক গুন টাকা ই-টোকেন নামের যে কাটাতার তার কাটায় লেগে বেরিয়ে গেল। অবশেষে ই-টোকেন নিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সহ ভারতীয় ভিসা সেন্টার মতিঝিলের দিলকুশায় স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার অফিস সংলগ্ন সেন্টারে গেলাম।
ঢাকায় পড়াশুনাকালে আমি থাকতাম আমার ছোট খালা কামরুন নাহার খুশির কাছে। আমার ছোট খালা আমার আরেক মা। দীর্ঘদিন ঢাকায় তার কাছে বিনেপয়সায় থেকেছি, খেয়েছি, জ্বালাতন করেছি। সব কিছু সহ্য করেছে মায়ের মতই। মায়ের হোটেলের মত খালার হোটেলও একদম ফ্রি। এখন শরীয়তপুর থাকি। কিন্তু ঢাকায় গেলে নিজের বাড়িতে উঠার মত খালার আশ্রয়েই যেতে হয়।
সকাল বেলা খালার বাসা থেকেই গেলাম মতিঝিল। শীত চলে গেছে, হালকা গরমের দিন। সকাল সকাল কোট-টাই পড়ে একদম স্যুটেড-বুটেড বাবু সেজে লাইনে দাড়িয়ে আছি। দূর থেকে এক সুন্দরী রমনী দেখি আমার দিকে আঙ্গুল দিয়ে এক ভদ্রলোককে দেখাচ্ছে! তাকিয়ে দেখি আর কেউ নয়, আমার বন্ধু মোস্তাফিজুর রহমান নয়নের বউ। ভাবি নয়নকে দেখাচ্ছে যে, জুয়েল ভাইর মত দেখা যাচ্ছে। দুঃখজনক বিষয়, ভাবি দীর্ঘদিন পরেও আমাকে দূর থেকে দেখে চিনলেও বন্ধু চিনতে পারেনি। এ বিষয়টি কাছে আসার পর জেনেছি। কাছাকাছি আসলে বন্ধু বলে,
-তোরে তো আমি চিনতেই পারছিলাম না। টুসি দেখালো যে তুই দাড়ানো। তয়, এই গরমে কোট পরে এখানে কি করছিস?
আমি বন্ধুকে বললাম,
-বন্ধু, প্রচন্ড গরমের মধ্যে যদি কখনো দেখিস কোন লোক কোট পরে দাঁড়িয়ে আছে বা হেটে যাচ্ছে, তাহলে ভাববি ঐ লোকটা হয় পাগল নয় উকিল। আর আমি যেহেতু উকিল তাই কোট পড়েই তো দাঁড়িয়ে থাকবো।
টুসি ভাবি আমাদের সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে চলে গেলে তার কর্মস্থল দিলকুশায় এনআরবি ব্যাংকে। নয়নকে নিয়ে লাইনে ইট রাখার মত একজনকে বলে রাস্তার পাশের এক দোকানে গেলাম চা খেতে। চা খাওয়া শেষে বন্ধু নয়ন আমায় আরো কিছুক্ষণ সময় দিলো। আমার সিরিয়াল পেতে আরো সময় লাগবে আর ওর অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে দেখে আমিই ওকে বললাম,
-তুই অফিসে চলে যা।
ওর অফিস ভিসা সেন্টারের বিপরীত বিল্ডিং বিসিআইসি ভবনে। উচু তলায় বসে কাজ করে আমার বন্ধু নয়ন! আমার হাতে ছিল একটা ব্যাগ। ওজন নেহায়েত খারাপ না। কোট-টাই পরে দাঁড়িয়ে আছি, নিজের ওজনও মাত্রাতিরিক্ত। সব মিলিয়ে একটু হাপিয়েও উঠেছিলাম। ব্যাগটা এখন অতিরিক্ত মনে হচ্ছিলো। ওর হাতে আমার ব্যাগটা ধরিয়ে দিলাম। বললাম,
-তুই অফিসে যা, আমি পাসপোর্ট সহ কাগজপত্র জমা দিয়ে তোর অফিসে এক কাপ চা খেয়েই যাব। এত দিন পরে দেখা, চা না খেয়ে গেলে তুই নিশ্চই মনে কষ্ট পাবি, আর তোর সাথে এক কাপ চা খেতে পারলে নিজেকেও ধন্য মনে হবে এবং তুইও ধন্য হবি নিশ্চই!
মনে হচ্ছে ব্যাগ না দুটি বউ নিয়ে দুটি সংসারের ঘানি টানছি এতক্ষণ। নয়ন আমার হাতের ব্যাগটা নিয়ে চলে গেলো ওর অফিসে। ব্যাগটা নেয়ায় মনে হলো মাথা থেকে একটা পাহাড়সম বোঝা নামলো। স্থুল শরীরটাই আমার কাছে একটা বোঝা, তার উপর যদি একটা ব্যাগ থাকে কাধে বা হাতে তবে অবস্থাটা কি বোঝেন!
দীর্ঘ লাইন পেরিয়ে ভিসা সেন্টারে ভিসা ফি ও কাগজপত্র সহ পাসপোর্ট জমা দিলাম। পুরা মাখনের মত নরম অমায়িক ব্যবহারের মাধ্যমে আমার কাগজপত্রগুলো গ্রহণ করে হাসিমুখে আমাকে একটা স্লিপ ধরিয়ে দিলো। আমিও মুচকি হেসে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে গেলাম।
আমি নয়নের অফিসে গিয়ে আর চা পেলাম না! পেলাম স্পেশাল এক মগ ধুমায়িত কফি। বন্ধু বন্ধুর অফিসে এসেছে, চা কিরে, কফিই খা বলে বেয়ারাকে আদেশ দিলো,
-যা ভাল করে এক মগ কফি নিয়ে আয়! স্পেশাল হবে!
অফিসের অন্য সহকর্মীদের কাছে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো এমন ভাবে যে শুনে আমি নিজেই একটু লজ্জা লজ্জা পাচ্ছিলাম। প্রশংসায় আমাকে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের ছাদ পেড়িয়ে হিমালয়ের চুড়ায় তুলে দিলো। আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো,
-আমার বন্ধু বিশাল উকিল, বিশাল সাংবাদিক, প্রথম আলো, কালের কন্ঠের সাংবাদিক, দৈনিক ঝিরিঝিরি, আকাশ বাতাশ ঐ সব পত্রিকার সাংবাদিক না, আইনজীবী সমিতির নেতা, বার বার নির্বাচিত, আবার কবি, লেখকও কিন্তু! বুদ্ধিজীবী টাইপের মানুষ ইত্যাদি ইত্যাদি....।
চিন্তা করলাম, বেশিক্ষণ সময় হিমালয়ের চুড়ায় থাকা যাবে না, পশ্চাৎদেশে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে! তাই কফি শেষ করে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আবার আসবো বলে।
ভিসার জন্য কাগজপত্র জমা তো দিলাম। এবার আনতে যাওয়ার পালা। শরীয়তপুর থেকে ঢাকায় কোথাও সময় মত পৌছানো ভাগ্যের ব্যাপার। ঢাকায় যে জ্যাম পড়ে তাতে এক স্টেশনেই দুই-তিন ঘন্টা গাড়িতে বসে থাকা লাগতে পারে। চিন্তায় পড়ে গেলাম। সবাই পরামর্শ দিলো, মাওয়া থেকে যাত্রাবাড়ির বাসে উঠে ধোলাইর পাড় নেমে একটা সিএনজি নিয়ে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার এর উপর দিয়ে যাবি। তাতে তারাতারি যেতে পারবি এবং কোন জ্যাম পাবি না। বন্ধুদের কথামত নির্ধারিত দিনে কোর্টের কাজ সেরে দুপুরে রওয়ানা দিলাম। কথা মত কাজ। ফ্লাইওভার এর উপর দিয়ে সিএনজি নিয়ে চলে গেলাম যথাসময়ের আগেই। ভিসা সেন্টারের দেয়া স্লিপের নির্ধারিত তারিখের নির্ধারিত সময়ে গিয়ে দেখি আমার পাসপোর্টে আমার জন্য ভারত সরকার এক বছরের ভিসা দিয়ে বসে আছে। যাওয়া মাত্রই পাসপোর্টটা ধরিয়ে দিলো। খুলে দেখি এক বছরের ভিসা, প্রতি ভিজিটে সর্বোচ্চ নব্বই দিন অবস্থান করা যাবে শর্ত জুড়ে দিয়েছে। চিন্তা করলাম, নব্বই দিন কিরে? নয় দিনই তো থাকা দুষ্কর হয়ে যাবে! অনেকেই দেখি আফসোস করছে, তাদের পাসপোর্ট খালি ফেরৎ দিয়েছে! যাহোক, ২০ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে হাতে পেয়ে গেলাম জীবনের প্রথম আবেদনে প্রথম বিদেশের ভিসা।













॥ ৩ ॥
প্রথম বিদেশ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়াঃ

পাসপোর্ট হলো, ভিসাও পেলাম এবার বিদেশ ভ্রমণ!! কিন্তু আজ যাই, কাল যাই করে বেরিয়ে পড়া হচ্ছে না। আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু কাম খালাতো ভাই আমির হোসেন নয়ন ভিসা পেয়ে জানালো কলকাতা যাবে, ওখানে কয়েকদিন থেকে পরে দিল্লি ঘুরে আবার কলকাতা দিয়ে বাংলাদেশে ফিরবে। দিল্লিতে ওর সাবেক এক কলিগ থাকে। বাংলাদেশে একসময় মার্চেন্ডাইজিং ম্যানেজার ছিলো। চাকরি ছেড়ে দিয়ে সে এখন দিল্লিতে রিয়েল স্টেটের ব্যবসা করে। খুবই আন্তরিক সম্পর্ক ছিলো নয়নের সাথে। নয়ন এখন বায়িং হাউস খুলেছে ছোট পরিসরে। দীর্ঘদিন বায়িং হাউসে কাজ করেছে। অবশেষে নিজেই গার্মেন্টস ব্যবসায় নেমে পড়েছে। প্রতিষ্ঠানের নাম রেখেছে বি-ফিট ফ্যাশন। দেশে টুকটুক করে হেটে এখন বিদেশেও কিছু কিছু বায়ার ধরেছে। দিল্লির কলিগ বন্ধু যেহেতু আগে এ ব্যবসায় ছিলো এবং নয়নকে যেহেতু খুব ভালোবাসে তাই সে নয়নকে দিল্লি যেতে বলেছে। ওখানে তার ব্যবসার সাথে নয়নকেও সহায়তা করবে। সেই কারনেই ও কলকাতা-দিল্লি ভ্রমণে যাবে। আমি বললাম যাব তোর সাথে।
নয়ন ঢাকা হতে বাসে বা ট্রেনের টিকিট কাটবে। আমি ওকে আমার পাসপোর্টের ভিসাসহ পাতার স্ক্যান কপি, আমার জাতীয় পরিচয় পত্র, জন্ম নিবন্ধন, ছবি মেইল করে দিলাম। কারন টিকিট করার সময় ওগুলো প্রয়োজন হতে পারে সেই ভেবে। এক বৃহস্পতিবার যাব বলেও আর ওর যাওয়া হলো না। গার্মেন্টস ব্যবসায়ী মানুষ, বায়ারের সাথে সিডিউল এলোমেলো হওয়ায় সে এখন ঈদের পর যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু আমি যে মনস্থির করে ফেলেছি! খালাতোর সিডিউল বিপর্যয়ে আমার মানসিক বিপর্যয় আরো বেড়ে গেলো। যাব বলার সাথে সাথেই আমার মন কলকাতার দিকে রওয়ানা দিয়ে দিয়েছে। মন এখন কলকাতার অলিতে গলিতে হেটে বেরাচ্ছে, দর্শনীয় স্থান দেখছে, মাটির পেয়ালায় বা মাটির ভারে চা খাচ্ছে, আরো কত কি!
ভিসা পাওয়ার পরই অবশ্য কলকাতায় কি কি আছে দেখার মত তা ইন্টারনেটের কল্যাণে খুজে খুজে দেখছি, বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করছি। কিভাবে যেতে হবে, কি দেখতে হবে মোটামুটি ধরণা নিচ্ছি। অবশেষে খালাতো ভাইর সাথে আর আমার যাওয়া হলো না। এবার বিকল্প খোজার পালা। আমাকে যে যেতেই হবে!   
শরীয়তপুর জেলা আইনজীবী সমিতির আইনজীবী বন্ধু রুহুল আমীন বিদেশ ভ্রমণে পটু। একাধিকবার মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ঘুরে এসেছে। আর কলকাতাতে যায় ঢাকা যাওয়ার মত। কলকাতা শহর তার কাছে গুলিস্থানের মত পানি ভাত। রুহুল ভাই হঠাৎ জানালো কলকাতা যাবে। দুই দিন থাকবে, জরুরী কাজ আছে। আমি চিন্তা করলাম ভালইতো, দুই দিন হলেই তো ভাল হয়। দুদিন ঘুরে আবার চলে আসবো, ঘোরাও হবে আবার দেশের কাজও স্থবির হবে না। এসব ভেবে আমি রুহুল ভাইকে বললাম,
-একা যাবেন তো আমি সাথে যাই, নতুন যেহেতু তাই আপনার সাথে গেলে একটু ভরসা পাব, একাকিত্ব বোধ ঘুচবে।
রুহুল ভাই বললো,
-ঠিক আছে, আমরা বৃহস্পতিবার বিকালের শরীয়তপুর থেকে মাদারীপুরের মোস্তফাপুর চলে যাব। মোস্তফাপুর থেকে বেনাপোলের বাসের টিকিট আগেই কনফার্ম করে রাখবো। মোস্তফাপুর থেকে রাতের বাসে রওয়ানা দেব। রাত ভর গাড়িতে চড়ে বেনাপোল বর্ডারে সকালে পৌছে যাব। সকাল সকাল ইমিগ্রেশন পার হব। সকাল সকাল আমরা কলকাতা পৌছে যাব, ঝামেলাও কম হবে আর পরিবেশও ভালো থাকে সকালের দিকে।
আমিও চিন্তা করলাম, মন্দ কি? রাতটা কাজে লাগবে। রাতে বাড়িতে না ঘুমিয়ে বাসে ঘুমালাম। সকালে চোখ খুললেই কলকাতা বাংলাদেশ বর্ডার দেখবো। দু’দেশের মিশ্র হাওয়া খেয়ে সকালে কলকাতা ঢুকে যাব। কিন্তু রুহুল ভাইও তার সিডিউল পরিবর্তন করলো অজানা কারনে! আমায় জানিয়ে দিলো রাতের বেলা। বৃহস্পতিবার যাওয়া হবে না, পরবর্তী বৃহস্পতিবার যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। দ্বিতীয়বার সিডিউল বিপর্যয়ে আমার হৃদয় ভেঙ্গে গুরা গুরা। ভাবতেই পারছি না যে বৃহস্পতিবার যাওয়া হবে না! 
দ্বিতীয় দফা পদক্ষেপ নিয়েও যেতে পারলাম না। মনটা আরো খারাপ হয়ে গেলো। আমার পাশের চেম্বারের বিজ্ঞ বন্ধু এডভোকেট জামাল ভূইয়া ইতিমধ্যে পাসপোর্টে ভারতীয় ভিসা লাগিয়ে এনেছে। আগেও দু’বার কলকাতা ঘুরে এসেছে। খালাতো ভাই নয়ন ও রুহুল ভাই যাওয়া বাতিল করায় আমি তার চেম্বারে চা খেতে খেতে আক্ষেপ নিয়ে গল্প করছি। এসময় জামাল ভূইয়াকে প্রস্তাব দিলাম,
-চলেন দুদিনের ট্যুর দিয়ে আসি, যাব, ঘুরবো, চলে আসবো।
জামাল ভূইয়া অমনি রাজি হয়ে গেল। সিদ্ধান্ত হলো, বড় কোন সমস্যা না হলে বা আর কেউ না গেলেও আমরা দুজনই যাব। দুজনে ঘুরে ফিরে আসবো। এরই মধ্যে সাথে আরো একজন পেয়ে গেলাম। এডভোকেট মুরাদ মুন্সীরও ভিসা হয়েছে। আমরা যাব শুনে সেও বললো,
-চলেন আমিও যাব আপনাদের সাথে, একসাথে ঘুরে আসি সবাই। একসাথে গেলে সবারই ভালো লাগবে।
জামাল ভূইয়া এর আগে দুবার কলকাতা ঘুরে এসেছে। আমি আর মুরাদ মুন্সী এই প্রথম যাব তাই একসাথে তিন বন্ধু গেলে ভাল লাগবে। তাহলে আর বিলম্ব নয়। এবার তিনজনই একমত হলাম যে, বৃহস্পতিবার কলকাতা ঢুকবো। বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার রাত কাটিয়ে রবিবার সকালে দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেব। যেই ভাবা সেই কাজ।
শরীয়তপুর থেকে বেনাপোলগামী দুটি বাস সার্ভিস আছে। ফেম পরিবহন দীর্ঘদিন যাবত শরীয়তপুর-বেনাপোল বাস সার্ভিস চালাচ্ছে। সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে কনক পরিবহন। আমরা বুধবার কনক পরিবহনের তিনটি টিকিট কেটে রাখলাম। বৃহস্পতিবার সকালে শরীয়তপুর বাস স্ট্যান্ড থেকে আমাদের নিয়ে বাস রওয়ানা দিলো বেনাপোলের উদ্দেশ্যে। শরীয়তপুর থেকে রওয়ানা দেওয়ার সময় ফেসবুকে একটি পোষ্ট দিলাম-
-কলকাতা আসছি বন্ধুরা। কলকাতার বন্ধুরা তৈরী থেকো, দেখা হয়ে যেতেও পারে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কলকাতার বন্ধু সুশান্ত কুমার কংশবণিক এর কমেন্টস,
-কলকাতায় স্বাগতম! চলে আসো, দেখা হবে নিশ্চই।
আমাদের বহনকারী কনক পরিবহনের গাড়ি ছুটে চলেছে বেনাপোলের দিকে। গাড়িতে উঠলে ঝুলে ঝুলে আমার একটু নিদ্রা ভাব হয়। কিন্তু আজ হচ্ছে না। ভ্রমণের আনন্দে হয়তো এমনটা হয়ে থাকতে পারে। যশোর রোডে গাড়ি ঢোকার পর রাস্তার দুপাশের বিশালাকায় গাছগুলো দেখে নয়ন জুড়িয়ে গেল।
যশোর রোডের বিশাল গাছগুলোর কিছু ইতিহাস আছে। ইন্টারনেটের কল্যাণে তথ্যগুলো একটু দেখে নিলাম। ১৮৪০ সালে জমিদার কালি পোদ্দার বাবু তার মায়ের গঙ্গাস্নানের জন্য যশোর থেকে কলকাতা পর্যন্ত সড়কটি নির্মাণ করেন। আর মায়ের নির্দেশ অনুযায়ী পথচারীদের সুবিধার জন্য রাস্তার দুই পাশে রোপণ করেন অসংখ্য গাছ। যশোর-বেনাপোল সড়কের শতবর্ষী গাছগুলো মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৭১ সালে হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশু শরণার্থী হয়েছিলেন এই সড়ক দিয়েই। মিত্র বাহিনীও এসেছিলেন এই পথ ধরেই। ইতিহাস মাখা সেই পথ ধরে চলছে বাস। সেদিনের শরণার্থীদের অসহায়ত্বের কথা মনে করে একটু খারাপও লাগছিলো আবার মিত্র বন্ধুরা এসে আমাদের সহযোগীতা করেছে ভেবে ভালোও লাগছিলো। শরীয়তপুর থেকে বেনাপোলে যাওয়ার পথে গাড়িতে হালকা ঝিমুনি ভাব আসলেও ঘুম তো আজ আসছে না। বাইরের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে দেখে চোখের ঘুম কেটে যাচ্ছে।
বাস খুলনায় গিয়ে যাত্রা বিরতি দিয়েছিলো কিছু সময়ের জন্য। সেখানে সবাই নেমে এদিক ওদিক ছুটে যাচ্ছে মুত্র বিসর্জনের জন্য। শরীয়তপুর থেকে বেনাপোল দীর্ঘ যাত্রা। আমরাও সবার সাথে যোগ দিলাম। রাস্তার পাশেই শরম লজ্জার মাথা খেয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। মুত্র বিসর্জন শেষে একটা চায়ের দোকানে গেলাম। দোকানে কবরি কলা ঝুলে আছে। কলাগুলো আমাদের এলাকার কবরি কলার মত নয়। জানতে চাইলে দোকানি জানায় এগুলো দুধ সাগর। অবশেষে কবরি কলা ওরফে বাংলা কলা ওরফে দুধ সাগর কলা আর গরুর দুধের চা খেয়ে যাত্রা বিরতী শেষ করে গাড়িতে উঠলাম। আবার ছুটে চলা বেনাপেলের দিকে।
শরীয়তপুর থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বেনাপোল পৌছতে পৌছতে দুপুর গড়িয়ে বিকাল প্রায়। রাস্তার দুধারে যা দেখি তাতেই চোখ জুড়িয়ে যায়। সবই ভাল লাগছে। গাছ পালা, গরু ছাগল, প্রকৃতি সবই আছে শরীয়তপুরে। তবুও কেন যেন এক অজানা ভালোলাগা। বেনাপোল সম্পর্কে কিছু তথ্য না দিলেই নয়।
বেনাপোলঃ বেনাপোল বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম যেখানে একটি সীমান্ত তল্লাশী ঘাঁটি ও আন্তর্জাতিক স্থল বন্দর অবস্থিত। এই স্থলবন্দরের শুল্ক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রয়েছে বেনাপোল কাস্টম হাইজ। স্থল বন্দরের কার্যক্রম পরিচালনা করে বাংলাদেশ স্থল বন্দর কর্তৃপক্ষ। বেনাপোল রেলস্টেশনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত রেল চলাচল অনুষ্ঠিত হয়।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী বেনাপোল গ্রামটি বাংলাদেশের যশোর জেলার শার্শা উপজেলার অন্তর্গত। বেনাপোলের বিপরীতে ভারতের দিকের অংশটি পেট্রাপোল নামে পরিচিত। এটি পশ্চিম বাংলার বনগাঁও মহকুমার অর্ন্তভূক্ত।

গুরুত্ব ঃ
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার স্থল বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র হিসাবে বেনাপোল স্থল বন্দর ব্যবহৃত হয়। বেনাপোল হতে কলকাতা মাত্র ৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। মোট স্থলবাণিজ্যের ৯০% এই বেনাপোলের মাধ্যমে সংঘটিত হয়ে থাকে। ১৯৯৬-১৯৯৭ অর্থবছরে এখানে ৫০০ কোটি টাকার পণ্য বাণিজ্য সংঘটিত হয়। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে স্থল পথে গমণের প্রধান পথ যশোর-বেনাপোল-বনগাঁও-কলকাতা গ্র্যান্ডট্রাঙ্ক রোড। এই পথে প্রতিদিন শত শত ভ্রমণকারী চলাচল করে থাকে।
আমরা বেনাপোল পোর্টে নেমেই বাংলাদেশ অংশে একটি হোটেলে ঢুকে ভাত খেলাম পেট পূরে। ভেতো বাঙ্গালীর পেট ঠিক তো সব ঠিক। খাওয়া দাওয়া সেরে বাংলাদেশ ইমিগ্রেশনের সোনালী ব্যাংক কাউন্টারে ছয়শত টাকা ভ্রমণ ট্যাক্স জমা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে ব্যাগ স্ক্যানে দিলাম। ভিতরের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা একটা ফরম ধরিয়ে দিলো। পাশে থেকে একজন আমাকে জিজ্ঞেস করছে কিভাবে ফিলাপ করবে। কারণ হলো ফরমটা ছাপা ইংরেজী হরফে। আমি নিজেও নতুন। এর আগে কখনো এই ফরম ফিলাপ করিনি। আমি একজন আইনজীবী, আমিতো অন্য মানুষকে জিজ্ঞেস করতে পারি না, বা করলেও ভালো দেখায় না। নিজেই পড়ে পড়ে ফরমটা ফিলাপ করলাম। ফরমটা ফিলাপ করে বুঝলাম এটা কারো জন্যই কঠিন কোন কাজ না। আর ফরমটা ফিলাপ করার জন্য রকেট সাইন্স জানা প্রয়োজন নেই। ভীতির কারনে মানুষ ফরম পুরন করতে পারে না বা চায় না। ফরমটা ফিলাপ করে লাইনে দাড়ানোর পর ওয়েপ ক্যামে ছবি তোলা হলো। কিছু তথ্য আদান প্রদান, কথাবার্তা বলার পর বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন খুবই সাদামাটা ভাবে সম্মানের সাথে দ্রুত আমাদের ছেড়ে দিলো। ইমিগ্রেশন ভবন থেকে বের হয়ে খোলা জায়গা। এই জায়গাটা মনে হয় নো ম্যান্স ল্যান্ড! না বাংলাদেশ না ইন্ডিয়া!
নো-ম্যান্স ল্যান্ড পেরিয়ে ভারতীয় অংশে প্রবেশ করেই দেখি দীর্ঘ লাইন। লান্স ব্রেকের জন্য মনে হয় লোক ঢুকানো-আনুষ্ঠানিকতা বন্ধ ছিল। তাই দীর্ঘ লাইন জমে গেছে। বিকাল হলেও রোদের তীব্রতা টের পাওয়ার মত। প্রচন্ড রোদের মধ্যে মানুষ বিক্ষিপ্ত ভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। এক গ্র“পে একাধিক ভ্রমণকারী হলে একজন লাইনে আর বাকীরা গাছের ছায়ায় ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষার প্রহর গুণছে। আকা বাকা সাপের মত লাইন পেরিয়ে ভারতীয় ইমিগ্রেশনে প্রবেশ করার পর ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা অযাচিত প্রশ্ন করা শুরু করলো। তাদের কথার উত্তর দিয়ে বললাম,
-ভাই, আইনজীবী আমি, আপনাদের দেশে ঘুরতে যাব!
একথা বলার পর ছেড়ে দিলো। আমার কথায় মনে হলো সন্তুষ্ট হয়েছে। আমার সাথে কোন ডলার এনডোর্স করা ছিল না। আমাকে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা জিজ্ঞেস করলো কত টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। আমি পরিমানটা বললাম এবং বললাম ওপারে গিয়ে টাকা ভাংগাবো। আমার পিছনেই ছিল মুরাদ মুন্সী। ওর পাসপোর্টে ডলার এনডোর্স করা ছিল কিন্তু ডলার না নিয়ে ও বাংলাদেশী টাকা নিয়ে প্রবেশ করায় ঐ কর্মকর্তা ধরে বসলো, বললো,
-এনডোর্স করেছেন, ডলার কই?
নাই বলার পর লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে বলে বসলো পাঁচশত টাকা দিন। অযথা ঝামেলা এড়ানোর জন্য ফহিন্নির পুতেরে মুরাদ মুন্সী পাঁচশত টাকাই ভিক্ষা দিয়ে দিলো। গালি দিতে চাইনি, তার ব্যবহারে ও দুর্নীতির কারণে তাকে গালি দিলাম। ইমিগ্রেশনে ভালো কর্মকর্তারাও আছে। অনেকেই আমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করছে। টাকাটা দেয়ার পর অমনি সব জায়েজ হয়ে গেল! ইমিগ্রেশনের ঝামেলা শেষ করে ভারত ভূমিতে পা রেখে খুজে বের করলাম দেশি মানুষ সমির ঘোষকে।
ভারতের এই অংশটা হলো পেট্রাপোল এলাকা। মুক্ত বিশ্বকোষের তথ্য অনুযায় পেট্রাপোলের যে তথ্য পাওয়া যায় তা হলো-
পেট্রাপোল স্থলবন্দরঃ পেট্রাপোল স্থলবন্দর হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে অবস্থিত একটি স্থল বন্দর। এই স্থল বন্দরটি ভারত তথা এশিয়া এর মধ্যে বৃহত্তম। এই বন্দরটি বনগাঁও শহর থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে পেট্রাপোল এলাকায় বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত। বর্তমানে এই বন্দরে একটি সু-সংহত চেকপোষ্ট গড়ে উঠেছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রায় ৭০ শতাংশের বেশি এই স্থলবন্দর দ্বারা সংঘঠিত হয়।

আমদানি রপ্তানি ঃ
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বেশির ভাগ বাণিজ্য এই বন্দরের দ্বারা হয়। এই বন্দর থেকে প্রতি দিন প্রায় ৪০০ টি ট্রাক বাংলাদেশ যায় এবং প্রায় ২৫০-৩০০ টি ট্রাক প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে পেট্রাপোল স্থলবন্দর এর দ্বারা ভারতে প্রবেশ করে। এই স্থলবন্দরের প্রধান আমদানি পণ্য হল পাট ও ইলিশ মাছ। রপ্তানি দ্রব্য হল যন্ত্রপাতি, গাড়ি, রাসায়নিক দ্রব্য, খনিজ তেল প্রভৃতি। বন্দরটি দিয়ে প্রায় ভারতীয় ৫০০ কোটি রুপি (৯৯.৭৫ মিলিয়ন) টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য হয়।

সু-সংহত চেকপোষ্ট :
পেট্রাপোল স্থলবন্দরের পণ্য ও পণ্যবাহী যানবাহনের চাপ দিন দিন বাড়ছিল। ফলে সুষ্ঠ ভাবে বন্দর পরিচালোনার জন্য একটি নতুন সু-সংহত চেকপোষ্ট নির্মাণের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। ফলে পেট্রাপোল বন্দরে একটি সু-সংহত চেকপোষ্ট গড়া হয়েছে। এই চেকপোষ্টটি চালু করা হয় ২০১৬ সালে। এখানে মোট ৯০০ টি ট্রাক পণ্য দ্রব্য নিয়ে দাঁড়াতে পাড়বে। এটি নির্মাণে মোট ৪২ একর জমির প্রয়োজন হয়েছে। চেক পোষ্টটিতে ৩০০ জন বিএসএফ নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে আছে। সু-সংহত চেকপোষ্ট এর ফলে ভারত ও বাংলাদেশ এর মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
শরীয়তপুরের আঙ্গারিয়ার সমির ঘোষ বেনাপোল বর্ডারের কাছে ভারতীয় অংশে মিস্টির দোকান চালায়। তার বাড়ি আঙ্গারিয়া বাজারের কাছে। আঙ্গারিয়া বাজারে সমিরদের একসময় সবচেয়ে বড় মিষ্টির দোকান ছিলো। সমিরের এক স্বজনকে দীর্ঘ দিন আগে আঙ্গারিয়া বাজার থেকে বাড়ি যাওয়ার সময় মাথায় বোমা মেরে মাথা গুড়িয়ে দেয় সন্ত্রাসীরা। ভয় পেয়ে বাড়ি, ব্যবসা ছেড়ে ভারত চলে যায়। ভারত গেলেও বাংলাদেশ ঘেষে বেনাপোলে ব্যবসা বাণিজ্য করে এবং বসবাস করে।
আমরা দীর্ঘ লাইন ও ইমিগ্রেশনের ঝামেলা পার হয়ে ওপার যাওয়ার পর টের পেলাম বেশ খুধা পেয়ে গেছে। ইমিগ্রেশন পার হতে হতে আর দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দুপুরের খাবার এখন আর পেটে নাই। সমির’দা আমাদের চিরা ও দধি দিল বিট লবণ ছিটিয়ে। অবশ্য মাগনা নয়, ভারতীয় রুপির বিনিময়ে! খেয়ে বের হলাম আরেক শরীয়তপুরের লোক বর্তমান ভারতের বাসিন্দা বলরাম ঘোষ এর দোকান মিতা র্স্টোরসে। সেখানে গিয়ে বাংলাদেশী টাকাকে ভারতীয় রুপিতে কনভার্ট করলাম। দেশি মানুষ হিসাবে দাম ভালই দিয়েছে! অন্য সব দোকান থেকে দশ পয়শা কমই দিল! ঠকলেও নিজের জেলার সাবেক দাদার কাছে ঠকেছি তাই মুখ বুজেই সহ্য করলাম। মুখে প্লাস্টিকের হাসি লাগিয়ে বিদায় নিলাম।
বাংলাদেশের সিম কাজ করা পুরাপুরি বন্ধ হয়নি। কিছুদূর যাওয়ার পর আর কাজ করবে না। তাই একটা সিম নেয়া দরকার পরিবারের সাথে যোগাযোগের জন্য। বলরামদার ছেলেই একটা ভোডা ফোনের সিম এনে দিলো, দাম নিলো আড়াইশো রুপি। সিমটা মোবাইলে ভরে দিলো। কাজ শেষে বলরাম দাদা আমাদের এক কাপ করে চা খাওয়ালো। সেখানেও বিট লবণ দিয়ে লেমন টি খাওয়ালো। এমন স্বাদের চা আমরা জীবনেও খাইনি। অসাধারণ লাগলো চা’টা। খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বিদায় নিলাম দোকান থেকে।
টাকা রুপান্তর করে, সিম নিয়ে দোকান থেকে রাস্তায় বের হওয়ার পর বিশাল বিশাল ভলবো বাস ডাকাডাকি করছে কলকাতা যাওয়ার জন্য। আমরা আগেই খোজ নিয়েছি যে, বাই রোডে কলকাতা গেলে সময় লাগবে অনেক বেশি। দীর্ঘ পথ। ট্রেনে গেলে ভালো হবে। তাই আমরা ট্রেন স্টেশন বনগাঁ যাওয়ার জন্য একটা অটো ভাড়া করলাম। ওখানকার অটোগুলো আমাদের দেশের ব্যাটারী চালিত অটোর মত মন্থর গতিতে চলে না। গ্যাস বা পেট্রোল চালিত। জনপ্রতি পঞ্চাশ রুপি ভাড়া বনগাঁ স্টেশনে। পাঁচ জন করে টানে গাড়িগুলো।
আমরা তিনজন অটোয়ালাকে বললাম,
-চলো, আমরা তিনজনই পাঁচজনের ভাড়া দিবো। 
কলকাতার মানুষের কাছে পাঁচজনের ভাড়া তিনজনে দিয়ে যাওয়া একটা অপচয়। কিন্তু আমাদের কাছে এটা কোন বিষয়ই না। দুজন প্যাসেঞ্জারের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের কাছে সময়ের অপচয়। সময়ের অপচয় এবং দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করাটা আমাদের কাছে বড় অপচয় মনে হয়েছে। তিনজনে যেতে চাওয়ায় অটো ড্রাইভার এবার বেশ খুশি, আমরাও খুশি হয়ে উঠে পড়লাম গাড়িতে। বনগাঁ স্টেশনের উদ্দেশ্যে।
বেনাপোল থেকে বনগাঁ যাওয়ার পথটা খুব বেশি প্রসস্ত না হলেও রাস্তার দু’পাশের বিশালাকার কড়ই গাছ, মেহগুনি গাছ নয়ন জুড়িয়ে দিলো। রাস্তার কুল ঘেষে সুঠাম দেহী নারীরা বাইসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে যা আমাদের দেশে সাধারণত দেখা যায় না। চোখ জুড়ানো দৃশ্যের তালিকায় প্রকৃতির সাথে পরিবেশটাও আমলে নেয়ার মত। শুধু যে নারীরা তা কিন্তু নয়, পুরুষের সাথে সমান তালে মধ্য বয়সী নারী, স্কুল-কলেজ পড়–য়া ছাত্র-ছাত্রীরাও বাইসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে রাস্তার ধার ঘেষে। এভাবে দেখতে দেখতে বনগাঁ পৌছে গেলাম। স্টেশনে নেমেই জামাল ভূইয়া চলে গেল কাউন্টারে ট্রেনের টিকিটের জন্য। তিন জনের জন্য ৬০ রুপির বিনিময়ে শিয়ালদহ পর্যন্ত টিকিট কিনলো। এবার ট্রেনের জন্য অপেক্ষা। আমরা এখন ভারতের কলকাতার মাটিতে অবস্থান করছি। ভিন দেশে দাঁড়িয়ে নিজেকে ইবনে বতুতার মত মনে হচ্ছে! আমরা যেহেতু ভারতের কলকাতা ভ্রমণ করছি তাই কলকাতা সম্পর্কে কিছু তথ্য বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতেই হয়।
ইন্টারনেটের কল্যাণে বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। কোন তথ্যই এখন আর দুর্লভ নয়। কলকাতা ঘুরতে যাব তাই কলকাতা সম্পর্কে কিছু তথ্য নিজের জানা উচিত। পাঠক বন্ধুদেরও সেই তথ্য থেকে বঞ্চিত করার ইচ্ছা নাই। তথ্যগুলো ইতিহাস ঘেটে আমি সংগ্রহ করিনি। মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে তথ্য গুলো সংগৃহীত। এখানে কোন ভুল তথ্য সন্নিবেষিত হয়ে থাকলে তা আমার অযোগ্যতার কারনে হয়েছে। আর তথ্যগুলো উপস্থাপনের জন্য আমি কোন কৃতিত্বেরও দাবীদার নই। ভুলত্র“টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে পাঠক তথ্যগুলো গ্রহণ করবে বলেই আমি আশা করি। নি¤েœ কলকাতা সম্পর্কে কিছু তথ্য উপস্থাপন করা হলো।

কলকাতা :
কলকাতা (ইংরেজিঃ Kolkata; আদি নামঃ কলিকাতা; পুরনো ইংরেজি নামঃ Calcutta) হল ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর এবং ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী। কলকাতা শহরটি হুগলি নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থিত। এই শহর পূর্ব ভারতের শিক্ষা, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্র। কলকাতা বন্দর ভারতের প্রাচীনতম সচল বন্দর তথা দেশের প্রধান নদী বন্দর। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে, কলকাতার জনসংখ্যা ৪,৪৯৬,৬৯৪। জনসংখ্যার হিসেবে এটি ভারতের সপ্তম সর্বাধিক জনবহুল পৌর-এলাকা। অন্যদিকে বৃহত্তর কলকাতার জনসংখ্যা ১৪,১১২,৫৩৬। জনসংখ্যার হিসেবে বৃহত্তর কলকাতা ভারতের তৃতীয় সর্বাধিক জনবহুল মহানগরীয় অঞ্চল। বৃহত্তর কলকাতার সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সূচক (আনুমানিক) ৬০ থেকে ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যবর্তী (ক্রয়ক্ষমতা সমতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ জিডিপি অনুযায়ী)। এই সূচক অনুযায়ী ভারতে কলকাতার স্থান মুম্বই ও দিল্লির ঠিক পরেই।
সুতানুটি, ডিহি কলকাতা ও গোবিন্দপুর নামে তিনটি গ্রাম নিয়ে মূল কলকাতা শহরটি গড়ে ওঠে। ১৭শ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত এই গ্রামগুলির শাসনকর্তা ছিলেন মুঘল স¤্রাটের অধীনস্থ বাংলার নবাবেরা। ১৬৯০ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাবের কাছ থেকে বাংলায় বাণিজ্য সনদ লাভ করে। এরপর কোম্পানি কলকাতায় একটি দূর্গবেষ্টিত বাণিজ্যকুঠি গড়ে তোলে। ১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজদ্দৌলা কলকাতা জয় করেছিলেন। কিন্তু পরের বছরই কোম্পানি আবার শহরটি দখল করে নেয়। এর কয়েক দশকের মধ্যেই কোম্পানি বাংলায় যথেষ্ট প্রতিপত্তি অর্জন করে এবং ১৭৯৩ সালে ‘নিজামৎ’ বা স্থানীয় শাসনের অবলুপ্তি ঘটিয়ে এই অঞ্চলে পূর্ণ সার্বভৌমত্ব কায়েম করে। কোম্পানির শাসনকালে এবং ব্রিটিশ রাজশক্তির প্রত্যক্ষ শাসনকালের প্রথমার্ধ্বে কলকাতা ছিল ভারতের ব্রিটিশ-অধিকৃত অঞ্চলগুলির রাজধানী। ১৯শ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকেই কলকাতা ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র। ১৯১১ সালে ভারতের মতো একটি বৃহৎ রাষ্ট্র শাসনে ভৌগোলিক অসুবিধার কথা চিন্তা করে এবং বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের রাজধানী স্থানান্তরিত হয় নতুন দিল্লিতে। স্বাধীনতার পর কলকাতা পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। ব্রিটিশ আমলে কলকাতা ছিল আধুনিক ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা, বিজ্ঞানচর্চা এবং সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র। কিন্তু স্বাধীনতার পরবর্তী দশকগুলিতে কলকাতা এক অর্থনৈতিক স্থবিরতার সম্মুখীন হয়।
১৯শ শতাব্দী ও ২০শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বাংলার নবজাগরণের কেন্দ্রস্থল ছিল কলকাতা। এই শহর বাংলা তথা ভারতের ধর্মীয় ও জাতিগত বৈচিত্রপূর্ণ এক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রও বটে। সাহিত্য, থিয়েটার, শিল্পকলা ও চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এই শহর এক স্বতন্ত্র ঐতিহ্য বহন করে আসছে। কলকাতার অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি সাহিত্য, সংগীত, নাটক, চলচ্চিত্র, শিল্পকলা, বিজ্ঞান ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী হয়েছেন। এঁদের মধ্যে কয়েকজন নোবেল পুরস্কার ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারে সম্মানিতও হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের কেন্দ্রও কলকাতা শহর। এখানে জাতীয় গুরুত্বসম্পন্ন বেশ কয়েকটি খ্যাতনামা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলির মধ্যে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যাল হল, এশিয়াটিক সোসাইটি, ভারতীয় সংগ্রহালয় ও জাতীয় গ্রন্থাগারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এগ্রি-হর্টিকালচারাল সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া, জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, ভারতীয় উদ্ভিদ সর্বেক্ষণ, ক্যালকাটা ম্যাথেমেটিক্যাল সোসাইটি, ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস সংস্থা, জুওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, ইনস্টিটিউশন অফ ইঞ্জিনিয়ার্স, অ্যানথ্রোপোলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া ও ইন্ডিয়ান পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশনের মতো কয়েকটি পেশাদার বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান কলকাতাতেই অবস্থিত। এই শহরে একাধিক ক্রিকেট মাঠ ও ফ্র্যাঞ্জাইজি আছে। কিন্তু ভারতের অন্যান্য শহরে ক্রিকেট বেশি গুরুত্ব পেলেও, কলকাতার অধিবাসীরা ফুটবল ও অন্যান্য খেলার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।

কলকাতার নাম-ব্যুৎপত্তি ঃ
১৭শ শতাব্দীর শেষভাগে সুতানুটি, ডিহি কলিকাতা ও গোবিন্দপুর নামে তিনটি গ্রাম নিয়ে কলকাতা শহরটি গড়ে ওঠে। এর মধ্যে ডিহি কলিকাতা নামটি থেকে কলকাতা নামটির উৎপত্তি।
“কলিকাতা” বা “কলকাতা” নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে গবেষকদের মধ্যে মতান্তর রয়েছেঃ একটি মতে, “কালীক্ষেত্র” (হিন্দু দেবী কালীর ক্ষেত্র) নামটি থেকে “কলিকাতা” বা “কলকাতা” নামটির উৎপত্তি। মতান্তরে, বাংলা “কিলকিলা” (অর্থাৎ, “চ্যাপ্টা এলাকা”) কথাটি থেকে “কলিকাতা” নামটির উৎপত্তি হয়। অন্য এক মতে বাংলা খাল ও কাটা শব্দ দু’টির বিকৃতির ফলে কলকাতা নামটির উৎপত্তি ঘটে। অপর মতে, এই অঞ্চলটি কলিচুন ও কাতা (নারকেল ছোবড়ার আঁশ) উৎপাদনের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত ছিল। সেই থেকেই কলিকাতা নামটির উৎপত্তি ঘটে।
বাংলায় কলিকাতা বা কলকাতা নামটি প্রচলিত হলেও ইংরেজি ভাষায় এই শহর আগে ক্যালকাটা (ইংরেজিঃ Calcutta) নামে পরিচিত ছিল। ২০০১ সালে নামের বাংলা উচ্চারণের সঙ্গে সমতা রেখে ইংরেজিতেও শহরের নাম কলকাতা (ইংরেজিঃ Kolkata) রাখা হয়।

কলকাতার ইতিহাসঃ প্রাক-ব্রিটিশ যুগ :
কলকাতার নিকটবর্তী চন্দ্রকেতুগড়ে প্রতœতাত্ত্বিক খননকার্য চালিয়ে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে, এই অঞ্চলটি বিগত দুই হাজার বছরেরও বেশি সময়কাল ধরে জনবসতিপূর্ণ। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের একাধিক গ্রন্থে হুগলি নদীর তীরবর্তী কলিকাতা গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বিপ্রদাস পিপলাইয়ের মনসাবিজয় কাব্য (১৪৯৫ খ্রি.), মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কবিকঙ্কণ চন্ডী (১৫৯৪-১৬০৬ খ্রি.), সৈয়দ আলাওলের পদ্মাবতী (১৬৪৫-১৬৫২ খ্রি.), কৃষ্ণরাম দাসের কালিকামঙ্গল (১৬৭৬-১৬৭৭ খ্রি.), সনাতন ঘোষালের ভাষা-ভাগবত (১৬৭৯-১৬৮০ খ্রি.) ও কৃষ্ণদাসের নারদপুরাণ (১৬৯২ খ্রি.)। ১৫৮২ সালে রাজা টোডরমলের নির্দেশে সমগ্র বাংলা সুবা (প্রদেশ) জরিপ করে ওয়ালিশ-ই-জমা তুমার নামে একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়। আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরি (১৫৯০ খ্রি.) গ্রন্থে উদ্ধৃত এই তালিকাটিতে “কলিকাতা” গ্রামটির উল্লেখ রয়েছে। এছাড়াও গোলাম হোসেন সেলিম রচিত রিয়াজ-উস-সালাতিন (১৭৮৬ খ্রি.) নামক একটি ফার্সি গ্রন্থেও “কলিকাতা” গ্রামের উল্লেখ রয়েছে। ১৬৯০ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় বাণিজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে এই অঞ্চলে পদার্পন করে। এই সময় থেকেই শহর কলকাতার লিখিত ইতিহাসের সূচনা।
জব চার্নক নামে কোম্পানির এক প্রশাসককে সা¤্রাজ্যবাদী ঐতিহাসিকগণ কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা মনে করতেন। যদিও আধুনিক গবেষকগণ এই মত খন্ডন করেছেন। ২০০৩ সালে একটি জনস্বার্থ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা হাইকোর্ট জানিয়ে দেন যে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা অভিধায় অভিহিত করা যাবে না।

সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দী :
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে বর্তমান কলকাতা অঞ্চলটি সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও ডিহি কলিকাতা নামে তিনটি গ্রামে বিভক্ত ছিল। গ্রাম তিনটি ছিল বাংলার নবাবের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে। এই সময় প্রবল প্রতিদ্বন্ধী ওলন্দাজ, পর্তুগিজ ও ফরাসি শক্তিগুলিকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ গোবিন্দপুরে একটি দুর্গ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। ১৭০২ সালে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের নির্মাণকার্য সমাপ্ত হয়। এই দুর্গটি ছিল একাধারে একটি সেনানিবাস ও আঞ্চলিক সেনা কার্যালয়। কলকাতা “প্রেসিডেন্সি সিটি” ঘোষিত হয় এবং পরে বাংলা প্রেসিডেন্সির সদরে পরিণত হয়। এই সময় ফরাসি বাহিনীর সঙ্গে কোম্পানির ছোটোখাটো সংঘর্ষ লেগেই থাকত। ফরাসিদের ঠেকাতে ১৭৫৬ সালে কোম্পানি ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের সংস্কার শুরু করে। বাংলার তদনীন্তন নবাব সিরাজদ্দৌলা এই সামরিক আয়োজনের প্রতিবাদ জানালেও ইংরেজ কর্তৃপক্ষ তাতে কর্ণপাত করেননি। ক্ষুব্ধ সিরাজ এরপর কলকাতা আক্রমণ করে দুর্গ দখল করে নেন এবং ইংরেজদের কলকাতা থেকে বিতাড়িত করেন। এরপরই ইংরেজরা কুখ্যাত অন্ধকূপ হত্যার গল্প রটনা করে। অবশ্য এক বছর পরে রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে কোম্পানির বাহিনী কলকাতা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিল। ১৭৭২ সালে কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ঘোষিত হয়। পরবর্তীকালে ১৮৬৪ সাল থেকে ভারতের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী অধুনা উত্তরাখন্ড রাজ্যের শৈলশহর সিমলায় সাময়িকভাবে স্থানান্তরিত করার রেওয়াাজ শুরু হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে কলকাতার চারপাশের জলাভূমিগুলি বুজিয়ে ফেলা হয়। হুগলি নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে গড়ে ওঠে গভর্নমেন্ট প্লেস বা অফিসপাড়া। লর্ড ওয়েলেসলির (গভর্নর-জেনারেল ১৭৯৭-১৮০৫) শাসনকালে শহরের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটেছিল। তাঁর আমলেই কলকাতার অধিকাংশ সরকারি ভবনের নির্মাণকার্য শুরু হয়। এই ভবনগুলির বিশালতা ও স্থাপত্যসৌন্দর্যই কলকাতাকে “প্রাসাদ নগরী” বা “সিটি অফ প্যালেসেস” সম্মান প্রদান করেছিল। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আফিম ব্যবসার অন্যতম কেন্দ্রও ছিল কলকাতা। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত আফিম কলকাতায় নিলামে উঠত এবং তারপর জাহাজবন্দী করে তা চীনে পাঠানো হত।

বাংলার নবজাগরণ :
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে কলকাতা শহর দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। শহরের দক্ষিণে যে অংশে ব্রিটিশরা বাস করতেন সেটিকে বলা হত হোয়াইট টাউন এবং উত্তরে যে অংশে ভারতীয়েরা বাস করত সেটিকে বলা হত ব্ল্যাক টাউন। ১৮৫০-এর দশক থেকে কলকাতা শহর বস্ত্রবয়ন ও পাটশিল্পে বিশেষ সমৃদ্ধি অর্জন করতে শুরু করে। এর ফলে ব্রিটিশ সরকার এখানে রেলপথ ও টেলিগ্রাফ প্রকল্পের মতো পরিকাঠামো উন্নয়নমূলক প্রকল্পে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেন। ব্রিটিশ ও ভারতীয় সংস্কৃতির মিশ্রণে শহুরে বাঙালিদের মধ্যে এক নব্য বাবু শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছিল। এই বাবুরা ছিলেন সাধারণত উচ্চবর্ণীয় হিন্দু, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ও সংবাদপত্রের পাঠক। পেশাগতভাবে এঁরা ছিলেন জমিদার, সরকারি কর্মচারী বা শিক্ষক। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নবজাগরণ নামে পরিচিত যে যুগান্তকারী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্কার আন্দোলন বাঙালি সমাজের চিন্তাধারা ও রুচির আমূল পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল তার পটভূমিও ছিল এই কলকাতা শহর। বাংলার নবজাগরণ শুধু বাংলা নয়, সমগ্র ভারতের পথপ্রদর্শক হয়েছিল। এই আন্দোলনের পুরোধাপুরুষেরা ছিলেন রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩), হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১), রামতনু লাহিড়ী (১৮১৩-১৮৯৮), মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০–-৮৯১), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪), রামকৃষ্ণ পরমহংস (১৮৩৬-১৮৮৬), কেশবচন্দ্র সেন (১৮৩৮-১৮৮৪), স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২) প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ঃ
১৮৮৩ সালে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় জাতীয় সম্মেলনের আয়োজন করেন। এটিই ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতের প্রথম রাজনৈতিক সম্মেলন। এরপর ধীরে ধীরে কলকাতা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। বিশেষত বিপ্লবী সংগঠনগুলির অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয় কলকাতা শহর। ১৯০৫ সালে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে কলকাতায় ব্যাপক গণবিক্ষোভ ও ব্রিটিশ দ্রব্য বয়কট (স্বদেশী আন্দোলন) শুরু হয়। এই সব গণআন্দোলনের তীব্রতা এবং দেশের পূর্বভাগে অবস্থিত কলকাতা থেকে দেশ শাসনের প্রশাসনিক অসুবিধার কারণে ১৯১১ সালে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯২৩ সালে ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্টের অধীনে কলকাতার স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন কর্তৃপক্ষ কলকাতা পৌরসংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২৪ সালে এই পৌরসংস্থার প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। পরবর্তীকালে সুভাষচন্দ্র বসু, বিধানচন্দ্র রায়, আবুল কাশেম ফজলুল হক প্রমুখ বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামীরা এই পদ অলংকৃত করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জাপানি সেনাবাহিনী একাধিকবার কলকাতা শহর ও বন্দরে বোমা নিক্ষেপ করেছিল। কলকাতায় জাপানি বোমাবর্ষণের প্রথম ও শেষ ঘটনাটি ঘটে যথাক্রমে ১৯৪২ সালের ২০ ডিসেম্বর এবং ১৯৪৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর। যুদ্ধের সময় কলকাতায় পঞ্চাশের মতান্তরে লক্ষাধিক মানুষ অনাহারে মারা যান। এই মতান্তরের কারণ ছিল সামরিক তান্ডব, প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ১৯৪৬ সালে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের দাবিতে এক ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কলকাতায় চার হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারান। ভারত বিভাগের সময়ও বহু মানুষ সাম্প্রদায়িকতার শিকার হন। দেশভাগের পর বহুসংখ্যক মুসলমান পূর্ব পাকিস্তানে পাড়ি জমান এবং সেই দেশের লক্ষ লক্ষ হিন্দু কলকাতায় চলে আসেন। এর ফলে শহরের জনপরিসংখ্যানে একটি বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়।

স্বাধীনোত্তর যুগ ঃ
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করলে ব্রিটিশ বাংলা প্রেসিডেন্সির হিন্দুপ্রধান পশ্চিমাঞ্চল পশ্চিমবঙ্গ নামে ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়। কলকাতা এই রাজ্যের রাজধানীর মর্যাদা পায়। এই সময় দেশভাগ-জনিত তীব্র অর্থনৈতিক সংকট ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে হিন্দু শরণার্থীদের ব্যাপক হারে পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ রাজ্যের তথা শহরের অর্থনীতির উপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করে। এই সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় একাধিক কার্যকরী উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেন। কলকাতার জনসংখ্যার চাপ কমাতে শহরের উপকণ্ঠে চব্বিশ পরগনায় (অধুনা উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা), লবনহ্রদ (অধুনা বিধাননগর) ও নদিয়া জেলায় কল্যাণী নামে দুটি পরিকল্পিত উপনগরী গড়ে তোলা হয়। কলকাতা বন্দরের সাহায্যার্থে সহযোগী হলদিয়া বন্দর নির্মিত হয়। হুগলি নদীর নাব্যতা রক্ষার জন্য ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনাও গৃহীত হয়। তা সত্ত্বেও বিধানচন্দ্রের মৃত্যুর পর ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে ব্যাপক বিদ্যুৎ বিভ্রাট, ধর্মঘট ও জঙ্গী নকশাল আন্দোলনের ফলে শহরের পরিকাঠামো ব্যবস্থা গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফলে শহরের অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের সূত্রপাত ঘটে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের বহুসংখ্যক মানুষ শরণার্থী হিসাবে কলকাতায় আশ্রয় নিলে শহরের অর্থনীতির উপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি হয়।
স্বাধীনতার পর ১৯৫১ ও ১৯৫৬ সালে কর্পোরেশন আইন সংশোধন করা হয়। ১৯৮০ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার শেষবার এই আইন সংশোধন করেন। সংশোধিত নতুন আইন কার্যকর হয় ১৯৮৪ সালে। ১৯৯২ সালে ভারতীয় সংবিধানের ৭৪তম সংশোধনী বিল পাস হলে কলকাতা পৌরসংস্থা সামাজিক ন্যায় ও আর্থিক উন্নয়নের স্বার্থে পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষমতা পায়। ২০০১ সালে কলকাতার ইংরেজি নাম “ক্যালকাটা” বদলে “কলকাতা” করা হলে “কলিকাতা পৌরসংস্থা” নামের পরিবর্তে “কলকাতা পৌরসংস্থা” নামটি চালু হয়।
১৯৮০-এর দশকের মধ্যভাগে কলকাতাকে ছাপিয়ে মুম্বই (তৎকালীন নাম বোম্বাই) ভারতের সর্বাধিক জনবহুল শহরের শিরোপা অর্জন করে। ১৯৯০-এর দশকে ভারত সরকারের অর্থনৈতিক উদারীকরণের নীতি শহরের অর্থনৈতিক হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে অনেকাংশে সহায়ক হয়। ২০০০ সাল থেকে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প কলকাতার অর্থনীতিতে নতুন গতির সঞ্চার করেছে। শহরের উৎপাদন ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে কলকাতা শহর ছিল ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। পশ্চিমবঙ্গের ৩৪ বছরের সিপিআই(এম)-নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট শাসন বিশ্বের দীর্ঘতম মেয়াদের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি নির্বাচিত কমিউনিস্ট সরকারের একটি উদাহরণ।

ভৌগলিক বর্ণনা ঃ
কলকাতা শহর ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের পূর্বদিকে ২২ক্ক৩৩′ উত্তর অক্ষাংশ ও ৮৮ক্ক২০′ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলে অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে শহরের গড় উচ্চতা ১.৫ মিটার (৫ ফুট) থেকে ৯ মিটারের (৩০ ফুট) মধ্যে। উত্তর-দক্ষিণে শহরের বিস্তার হুগলি নদীর পাড় বরাবর। শহরের বেশিরভাগ এলাকাই আদতে ছিল জলাজমি। শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই সব জলাজমি ভরাট করে বসতযোগ্য করে তোলা হয়। অবশিষ্ট জলাভূমি এখন “পূর্ব কলকাতা জলাভূমি” নামে পরিচিত। এই জলাভূমিটি রামসার কনভেনশন অনুযায়ী একটি “আন্তর্জাতিক গুরুত্বসম্পন্ন জলাভূমি”।
সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমভূমির বেশিরভাগ এলাকার মতো, কলকাতার মাটি ও জল মূলত পলিজ (alluvial) প্রকৃতির। শহরের মাটির তলায় কাদা, পলি, বিভিন্ন ক্রমের বালি ও নুড়ি নিয়ে গঠিত কোয়্যাটারনারি যুগের পললস্তর দেখা যায়। পললস্তরগুলি দুটির কাদার স্তরের মধ্যে বদ্ধ রয়েছে। নিচের কাদার স্তরটির গভীরতা ২৫০ মিটার (৮২০ ফুট) থেকে ৬৫০ মিটার (২,১৩৩ ফুট) এবং উপরের কাদার স্তরটির গভীরতা ১০ মিটার (৩৩ ফুট) থেকে ৪০ মিটার (১৩১ ফুট)। ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডসের হিসেব অনুযায়ী, কলকাতা শহর তৃতীয় ভূ-কম্পী ক্ষেত্রের অন্তর্গত, যার মাত্রা ১ (I) থেকে ৫ (V) (ভূমিকম্পের বৃদ্ধিপ্রবণতা অনুসারে)। আবার রাষ্ট্রসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির রিপোর্ট অনুযায়ী বায়ুপ্রবাহ ও ঘূর্ণিঝড় ক্ষেত্র হিসেবে কলকাতা “অতি উচ্চ ক্ষয়ক্ষতি-প্রবণ” এলাকা।

নগরাঞ্চলের গঠন ঃ
কলকাতা পৌরসংস্থার এক্তিয়ারভুক্ত নগরাঞ্চলের মোট আয়তন ১৮৫ বর্গকিলোমিটার। অন্যদিকে, ২০০৬ সালের হিসেব অনুযায়ী বৃহত্তর কলকাতা নামে পরিচিত শহরের নগরাঞ্চলীয় বিস্তারের মোট আয়তন ১৭৫০ বর্গকিলোমিটার। এই অঞ্চলের মধ্যে ডাকবিভাগের ১৫৭টি অঞ্চল রয়েছে। বৃহত্তর কলকাতার শাসনকর্তৃত্ব ৩৮টি পুরসভা সহ একাধিক কর্তৃপক্ষের হাতে ন্যস্ত। বৃহত্তর কলকাতায় মোট ৭২টি শহর এবং ৫২৭টি ছোটো শহর ও গ্রাম রয়েছে। কলকাতা মহানগরীয় জেলার শহরতলি অঞ্চলটি উত্তর চব্বিশ পরগনা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, হুগলি ও নদিয়া জেলা পর্যন্ত প্রসারিত।
মূল শহরের পূর্ব থেকে পশ্চিমের বিস্তার অত্যন্ত সংকীর্ণ। পশ্চিমে হুগলি নদী থেকে পূর্বে ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস পর্যন্ত শহরের প্রস্থ মাত্র ৫-৬ কিলোমিটার। উত্তর থেকে দক্ষিণে শহরের প্রসার মোটামুটিভাবে তিন ভাগে বিভক্ত-উত্তর কলকাতা, মধ্য কলকাতা ও দক্ষিণ কলকাতা। শ্যামপুকুর, হাতিবাগান, শ্যামবাজার, বাগবাজার, কুমোরটুলি, জোড়াসাঁকো প্রভৃতি কলকাতার পুরনো এলাকাগুলি উত্তর কলকাতায় অবস্থিত। দক্ষিণ কলকাতার বিস্তার স্বাধীনতার পর। টালিগঞ্জ, ভবানীপুর, আলিপুর, নিউ আলিপুর, ঢাকুরিয়া প্রভৃতি শহরের বিলাসবহুল অঞ্চল এই দক্ষিণ কলকাতায় অবস্থিত। শহরের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত বিধাননগর (অন্যনামে সল্টলেক বা লবণহ্রদ) কলকাতার একটি পরিকল্পিত স্যাটেলাইট টাউনশিপ। জ্যোতি বসু নগর নামে আরও একটি পরিকল্পিত টাউনশিপও কলকাতার উত্তর-পূর্ব দিকে গড়ে উঠছে। কলকাতার পশ্চিমে হাওড়া শহরের প্রান্তে গড়ে উঠছে কলকাতা পশ্চিম আন্তর্জাতিক মহানগরী নামে আর একটি শহরও। ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাসের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেও দ্রুত জনবসতির বিস্তার ঘটছে।
মধ্য কলকাতা শহরের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ বা বিবাদীবাগকে কেন্দ্র করে এখানেই গড়ে উঠেছে কলকাতার কেন্দ্রীয় বাণিজ্য অঞ্চল। মহাকরণ, জিপিও, হাইকোর্ট, লালবাজার পুলিশ সদর, কলকাতা পৌরসংস্থা সহ একাধিক সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার কার্যালয় এখানে অবস্থিত। শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ময়দান নামক এক সুবৃহৎ মাঠে বিভিন্ন ক্রীড়ানুষ্ঠান ও রাজনৈতিক সমাবেশের আয়োজন হয়ে থাকে। কলকাতার দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় বাণিজ্য অঞ্চলটি গড়ে উঠেছে মাদার টেরিজা সরণির দক্ষিণে। এখানেও বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার কার্যালয় রয়েছে।

জলবায়ু ঃ
কলকাতার জলবায়ু “ক্রান্তীয় সাভানা” প্রকৃতির (“কোপেন জলবায়ু শ্রেণিবিভাগ” অনুসারে)। বার্ষিক সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২৬.৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং মাসিক সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৯ ডিগ্রি-৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে থাকে। এখানে গ্রীষ্মকাল উষ্ণ ও আর্র্দ্র। এই সময় সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের কাছাকাছি থাকলেও মে-জুন মাসে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা প্রায়শই ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ছাড়িয়ে যায়। শীতকাল সাধারণত মাত্র আড়াই মাস স্থায়ী হয়। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রি-১১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের কাছাকাছি থাকে। শহরের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড যথাক্রমে ৪৩.৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ও ৩.২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। সাধারণভাবে মে মাস শহরের উষ্ণতম মাস। এই সময় শহরের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা থাকে যথাক্রমে ৩৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ও ২৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। অন্যদিকে জানুয়ারি শীতলতম মাস। জানুয়ারির সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা যথাক্রমে ২৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ও ১২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। গ্রীষ্মের শুরুতে প্রায়শই শিলাবৃষ্টি, ঝড় ও বজ্রবিদ্যুৎ সহ বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। এই ধরনের ঝড়বৃষ্টি প্রকৃতিগতভাবে পরিচলন। এর স্থানীয় নাম কালবৈশাখী।
দক্ষিণ-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর বঙ্গোপসাগরীয় শাখাটি শহরে বৃষ্টিপাত ঘটানোর জন্য দায়ী। বর্ষাকাল সাধারণত স্থায়ী হয় জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত। শহরের বার্ষিক ১৫৮২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের অধিকাংশই এই সময়ে ঘটে থাকে। অগস্ট মাসে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সর্বোচ্চ থাকে। এই সময় গড়ে ৩০৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। কলকাতা বার্ষিক ২,৫২৮ ঘণ্টার সূর্যালোক পেয়ে থাকে। অধিকাংশ সূর্যালোক প্রাপ্তির সময় মার্চ মাস। দূষণ কলকাতার অন্যতম প্রধান সমস্যা। ভারতের অন্যান্য প্রধান শহরের তুলনায় কলকাতার সাসপেন্ডেড পার্টিকুলেট ম্যাটার বা এসপিএম-এর হার এতটাই বেশি যে এর ফলে প্রায়শই ধোঁয়া ও কুয়াশা সৃষ্টি হয়। মারাত্মক বায়ুদূষণের ফলে শহরে ফুসফুসের ক্যান্সার সহ দূষণসৃষ্ট অসুখবিসুখ বৃদ্ধি পেয়েছে।

কলকাতার অর্থনীতি ঃ
কলকাতা পূর্ব ভারত ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ব্যবসাবাণিজ্য ও অর্থনীতির প্রধান কেন্দ্র। কলকাতায় অবস্থিত কলকাতা শেয়ার বাজার ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম শেয়ার বাজার। এটি একটি প্রধান বাণিজ্যিক ও সামরিক বন্দরও বটে। পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি কলকাতাতেই অবস্থিত। একদা ভারতের রাজধানী ও অগ্রণী শিল্পনগরী কলকাতা স্বাধীনোত্তর কালে অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও জঙ্গি ট্রেড-ইউনিয়ন আন্দোলনের শিকার হয়ে দ্রুত আর্থিক অবনতির পথে এগিয়ে যায়। ১৯৬০-এর দশক থেকে ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত একদিকে যেমন মূলধন বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসে, তেমনি অন্যদিকে বন্ধ হয়ে যেতে থাকে বৃহৎ কলকারখানাগুলি। অধিকাংশ কলকারখানাগুলির উৎপাদন কমে আসে। অনেকেই ব্যবসা অন্যত্র সরিয়ে নেন। মূলধন ও সম্পদের এই হ্রাসের সঙ্গে যুক্ত হয় বিশ্ববাজারে এই অঞ্চলে উৎপাদিত ঐতিহ্যবাহী দ্রব্যগুলির (যেমন পাট ইত্যাদি) চাহিদা হ্রাস। ফলে শহরের আর্থিক অবস্থায় গুরুতর সংকট দেখা দেয়।
১৯৯০-এর দশকে ভারতীয় অর্থনীতির উদারীকরণ কলকাতার ভাগ্যোন্নয়নে বিশেষ সহায়ক হয়। আজও নমনীয় উৎপাদন কলকাতার অর্থব্যবস্থার একটি বৈশিষ্ট্য। ঘরোয়া সেক্টরগুলি তাই এখানে মোট শ্রমশক্তির ৪০% অধিকার করে আছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৫ সালের হিসাব অনুযায়ী ফুটপাথের হকারদের মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৮,৭৭২ কোটি ভারতীয় টাকা (প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। শহরের অন্যতম বৃহৎ কর্মশক্তি হল রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীগণ। এছাড়াও বিভিন্ন কায়িক ও বৌদ্ধিক শ্রমিকসহ শহরে একটি বৃহৎ সংখ্যক অদক্ষ ও অর্ধদক্ষ শ্রমিক জনসংখ্যাও পরিলক্ষিত হয়। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প কলকাতার অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনে একটি বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এই শহরে আইটি সেক্টরের বৃদ্ধির হার বছরে ৭০%, যা জাতীয় গড়ের দ্বিগুণ। বিগত কয়েক বছরে আবাসন পরিকাঠামো সেক্টরে উল্লেখযোগ্য হারে বিনিয়োগ হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে গৃহীত হয়েছে বেশ কয়েকটি নতুন প্রকল্পও।
বড় বড় ভারতীয় কর্পোরেশনগুলি দ্বারা পরিচালিত অনেকগুলি শিল্প ইউনিট কলকাতায় অবস্থিত। আইটিসি লিমিটেড, ভারত সরকার টাঁকশাল, এক্সাইড ইন্ডাস্ট্রিজ, হিন্দুস্তান মোটরস, ব্রিটানিয়া ইন্ডাস্ট্রিজ, বাটা ইন্ডিয়া, বিড়লা কর্পোরেশন, কোল ইন্ডিয়া লিমিটেড, দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন, ইউনাইটেড ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, ইউকো ব্যাংক ও এলাহাবাদ ব্যাংক ইত্যাদি বেশ কয়েকটি স্বনামধন্য সংস্থার প্রধান কার্যালয় কলকাতায় অবস্থিত। সাম্প্রতিককালে, কেন্দ্রীয় সরকারের “পুবে তাকাও” (“লুক ইস্ট”) নীতির মতো বিভিন্ন কর্মসূচি সিক্কিমের নাথুলা গিরিপথ খুলে দেওয়ায় চীনের সঙ্গে সীমান্ত বাণিজ্যের নতুন সম্ভাবনার দিক খুলে দিয়েছে। তাছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলি ভারতীয় বাজারে প্রবেশে ইচ্ছুক হওয়ায় কলকাতার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখন অনেকটাই সুবিধাজনক।

প্রশাসন :
কলকাতা পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা, রাজ্য সচিবালয় মহাকরণ ও মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয়, কলকাতা হাইকোর্ট সহ একাধিক রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থার প্রধান কার্যালয় বা আঞ্চলিক কার্যালয় কলকাতায় অবস্থিত।
কলকাতার নগর প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা ও নাগরিক পরিষেবাগুলির দায়িত্ব একাধিক সরকারি সংস্থার হাতে ন্যস্ত। এই সকল সংস্থার এক্তিয়ারভুক্ত এলাকা অনেক ক্ষেত্রেই পরস্পরের সঙ্গে প্রাবৃত। কলকাতা এই জাতীয় অন্তত চারটি এক্তিয়ার এলাকার অন্তর্গত। এগুলি হলঃ ১. কলকাতা জেলা, ২. কলকাতা পুলিশের এক্তিয়ারভুক্ত এলাকা, ৩. কলকাতা পৌরসংস্থার এক্তিয়ারভুক্ত এলাকা, ৪. বৃহত্তর কলকাতা বা কেএমডিএ এলাকা।

কলকাতা পৌরসংস্থা :
কলকাতার স্থানীয় স্বায়ত্ত্বশাসন কর্তৃপক্ষ হল কলকাতা পৌরসংস্থা। ১৯২৩ সালে আধুনিক স্বায়ত্বশাসনমূলক সংস্থা হিসেবে এই পৌরসংস্থা গঠিত হয়। ১৯৮০ সালে কলকাতা পৌরসংস্থা আইন সংশোধনের মাধ্যমে এই পৌরসংস্থা তার বর্তমান চেহারাটি লাভ করে। বর্তমানে কলকাতার সমগ্র এলাকাটি ১৫টি বরো ও মোট ১৪১টি ওয়ার্ডে বিভক্ত। ১৯৮০ সালের পৌর আইনের ভিত্তিতে কলকাতা পৌরসংস্থায় প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৫ সালে। এই নির্বাচনে বামফ্রন্ট জয়লাভ করেছিল। এরপর ১৯৯০ ও ১৯৯৫ সালের নির্বাচনেও বামফ্রন্টই ক্ষমতা দখল করে। ২০০০ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে তৃণমূল কংগ্রেস। ২০০৫ সালে পুনরায় বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে। ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিকতম নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস পুনরায় জয়লাভ করেছে। কলকাতা পৌরসংস্থায় বর্তমানে তিনটি কর্তৃপক্ষ রয়েছেঃ পৌরনিগম, মহানাগরিক (মেয়র) ও সপরিষদ-মহানাগরিক। পৌরসংস্থার ১৪১ জন পৌরপিতা/পৌরমাতা (কাউন্সিলর) শহরের এক একটি ওয়ার্ড থেকে নাগরিকদের ভোটে প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হন। নির্বাচিত পৌরপিতা/পৌরমাতাগণ নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে মহানাগরিক নির্বাচিত করেন। মহানাগরিক, উপমহানাগরিক ও ১০ জন পৌরপিতা/পৌরমাতাকে নিয়ে গঠিত হয় সপরিষদ-মহানাগরিক। পৌরসংস্থার প্রধান কাজ হল জল সরবরাহ, শহরের রাস্তাঘাট ও প্রকাশ্য স্থানসমূহের রক্ষণাবেক্ষণ, রাস্তার আলোকদান, বাড়িনির্মাণ নিবন্ধীকরণ ও নিয়ন্ত্রণ, পয়ঃপ্রণালী রক্ষণাবেক্ষণ ও কঠিন বর্জ্য পদার্থের অপসারণ ইত্যাদি।

জেলা প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা :
কলকাতার অন্যান্য শাসনবিভাগীয় ও আরক্ষা-সংক্রান্ত কর্তৃপক্ষগুলি হলঃ কলকাতা জেলার সমাহর্তা (কালেকটর), কলকাতা পুলিশ, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সমাহর্তা তথা জেলাশাসক এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার পুলিশ সুপার (এসপি)। কলকাতায় শেরিফ নামে একটি নামসর্বস্ব সাম্মানিক পদও রয়েছে।
বিভিন্ন ধরনের মামলা নিষ্পত্তির জন্য কলকাতায় একাধিক নিম্ন আদালত, দেওয়ানি মামলার জন্য ছোটো আদালত ও ফৌজদারি মামলার জন্য দায়রা আদালত অবস্থিত। নগরপালের (পুলিশ কমিশনার) নেতৃত্বাধীন কলকাতা পুলিশ সরাসরি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগের অন্তর্গত।

সংসদীয় ক্ষেত্র :
কলকাতা শহরের অধিকাংশ অঞ্চল ভারতীয় সংসদের কলকাতা উত্তর ও কলকাতা দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্রদুটির অন্তর্গত। দক্ষিণ-পূর্ব কলকাতার কয়েকটি অঞ্চল যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রের বর্তমান সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ সুব্রত বক্সী এবং যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ সুগত বসু। তিনটি আসনই বর্তমানে সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের দখলে রয়েছে। কলকাতা মোট ১৬টি বিধানসভা কেন্দ্রে বিভক্ত। এগুলি হলঃ কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্র, চৌরঙ্গী বিধানসভা কেন্দ্র, এন্টালি বিধানসভা কেন্দ্র, বেলেঘাটা বিধানসভা কেন্দ্র, জোড়াসাঁকো বিধানসভা কেন্দ্র, শ্যামপুকুর বিধানসভা কেন্দ্র, মানিকতলা বিধানসভা কেন্দ্র, কাশীপুর-বেলগাছিয়া বিধানসভা কেন্দ্র, কলকাতা দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্র , কসবা বিধানসভা কেন্দ্র, বেহালা পূর্ব বিধানসভা কেন্দ্র, বেহালা পশ্চিম বিধানসভা কেন্দ্র, কলকাতা বন্দর বিধানসভা কেন্দ্র, ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্র, রাসবিহারী বিধানসভা কেন্দ্র, বালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্র, যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্র , যাদবপুর বিধানসভা কেন্দ্র, টালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্র।

জনপরিসংখ্যান :
২০১১ সালের হিসেব অনুযায়ী, কলকাতার পৌর এলাকার জনসংখ্যা ৪৪৮৬৬৭৯ এবং কলকাতা মহানগরীয় অঞ্চলের মোট জনসংখ্যা ১,৪১,১২,৫৩৬। লিঙ্গানুপাত প্রতি ১০০০ জন পুরুষে ৯১৯ জন নারী। এই হার জাতীয় লিঙ্গানুপাত হারের তুলনায় কম; তার কারণ, অনেক উপার্জনশীল পুরুষ তাদের পরিবারের মহিলা সদস্যদের গ্রামে রেখে শহরে কাজ করতে আসেন। কলকাতার সাক্ষরতার হার ৮৮.৩৩ শতাংশ; যা জাতীয় সাক্ষরতার হার ৭৪.০৪ শতাংশের তুলনায় বেশি। নথিভুক্ত হিসেব অনুযায়ী কলকাতা পৌরসংস্থা অধিভুক্ত এলাকার বৃদ্ধির হার ৪.১ শতাংশ; যা ভারতের দশ লক্ষাধিক জনসংখ্যাবিশিষ্ট মহানগরগুলির মধ্যে সর্বনিম্ন।

ভাষা :
বাঙালিরা কলকাতার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী; মারোয়াড়ি ও বিহারি সম্প্রদায় শহরের উল্লেখযোগ্য জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় (২০ শতাংশ)। এছাড়াও কলকাতা প্রবাসী চীনা, তামিল, নেপালি, ওড়িয়া, তেলুগু, অসমীয়া, গুজরাটি, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, আর্মেনিয়ান, তিব্বতি, মহারাষ্ট্রীয়, পাঞ্জাবি, পারসি প্রভৃতি জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাসভূমি। কলকাতার প্রধান ভাষা হল বাংলা ও ইংরেজি; এছাড়াও হিন্দি, উর্দু, ওড়িয়া ও ভোজপুরি ভাষাও শহরের একাংশের বাসিন্দাদের দ্বারা কথিত হয়ে থাকে।

ধর্ম :
জনগণনা অনুসারে, কলকাতার জনসংখ্যার ৭৭.৬৮ শতাংশ হিন্দু, ২০.২৭ শতাংশ মুসলিম, ০.৮৮ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং ০.৪৬ শতাংশ জৈন; অবশিষ্ট শিখ, বৌদ্ধ, ইহুদি ও জরথুস্ট্রীয় সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা অত্যন্ত অল্প যা সব মিলে ০.৭১ শতাংশ। শহরের প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ ২,০১১টি নথিভুক্ত এবং ৩,৫০০টি অনথিভুক্ত (মূলত দখলদার) বস্তিতে বাস করেন।

অপরাধ ও আইনশৃঙ্খলা :
২০০৪ সালে দেশের ৩৫টি মহানগরের মধ্যে কলকাতায় সংঘটিত বিশেষ ও স্থানীয় আইনের আওতাভুক্ত অপরাধের হার ৬৭.৬ শতাংশ। ২০০৪ সালে কলকাতা পুলিশ ১০,৭৫৭টি ভারতীয় দন্ডবিধির আওতাভুক্ত মামলা নথিভুক্ত করে; যা সারা দেশে দশম স্থানের অধিকারী। ২০০৬ সালে জাতীয় স্তরে যখন অপরাধ হার ছিল প্রতি এক লক্ষে ১৬৭.৭, তখন কলকাতায় এই হার ছিল ৭১; যা ভারতীয় মহানগরগুলির মধ্যে ছিল সর্বনিম্ন হার। কলকাতার সোনাগাছি অঞ্চল এশিয়ার বৃহত্তম নিষিদ্ধ পল্লিগুলির অন্যতম; এখানে প্রায় ১০,০০০ যৌনকর্মী কাজ করেন।

কলকাতার সংস্কৃতি :
কলকাতা মহানগরী তার সাহিত্যিক, শৈল্পিক ও বৈপ্লবিক ঐতিহ্যগুলির জন্য বিশ্ববিদিত। এই শহর কেবলমাত্র ভারতের পূর্বতন রাজধানীই ছিল না, বরং আধুনিক ভারতের শিল্প ও সাহিত্য চেতনার জন্মস্থানও ছিল। শিল্প ও সাহিত্যের প্রতি কলকাতাবাসীদের বিশেষ আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে; নতুন প্রতিভাকে গ্রহণ করার ঐতিহ্য কলকাতাকে তাই পরিণত করেছে “প্রচন্ড সৃজনীশক্তিধর এক শহরে”। এই সকল কারণে কলকাতাকে অনেক সময় “ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী” বলে উল্লেখ করা হয়।
কলকাতার অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হল শহরের ছোটো ছোটো অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পাড়া সংস্কৃতি। সাধারণত প্রত্যেক পাড়ায় একটি করে ক্লাবঘর সহ নিজস্ব সংঘ বা ক্লাব থাকে। অনেক সময় ক্লাবগুলির নিজস্ব খেলার মাঠও থাকে। পাড়ার বাসিন্দারা অভ্যাসগতভাবে এখানে এই সব ক্লাবঘরে আড্ডা দিতে আসেন; মাঝেমধ্যে এই সব আড্ডা হয়ে ওঠে মুক্তছন্দের বৌদ্ধিক আলাপআলোচনা। এই শহরে রাজনৈতিক দেওয়াললিখনেরও এক ঐতিহ্য লক্ষিত হয়; এই সব দেওয়াললিখনে কুরুচিপূর্ণ কেচ্ছাকেলেংকারির বর্ণনা থেকে শ্লেষাত্মক রঙ্গব্যঙ্গ, লিমেরিক, কার্টুন, ইস্তহার- সবই বিধৃত হয়।

সাহিত্য :
ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে কলকাতাকেন্দ্রিক সাহিত্যিকদের হাত ধরে বাংলা সাহিত্যের আধুনিকীকরণ সম্পন্ন হয়। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪), মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৮-১৯৭৬) ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮) প্রমুখ। এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহন করে চলেন শহরের পরবর্তী প্রজন্মের খ্যাতিমান সাহিত্যিকেরা। এঁদের মধ্যে উল্লেখনীয় হলেন জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪), বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪), আশাপূর্ণা দেবী (১৯০৯-১৯৯৫) প্রমুখ। বর্তমান প্রজন্মের সাহিত্যিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় (জন্ম ১৯৩৫), বুদ্ধদেব গুহ (জন্ম ১৯৩৬), মহাশ্বেতা দেবী (জন্ম ১৯২৬), সমরেশ মজুমদার (জন্ম ১৯৪৪), সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় (জন্ম ১৯৩৬), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (জন্ম ১৯৩৪) এবং জয় গোস্বামী (জন্ম ১৯৫৪) প্রমুখ।

সংগীত :
কলকাতা শহরের সাংগীতিক ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকেই বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত এমনকি বহির্বঙ্গ থেকেও বহু বিশিষ্ট সংগীত¯্রষ্টা ও গায়ক কলকাতায় এসে বসতি স্থাপন করেন। এর ফলে অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা গানে একটি বিশেষ কলকাতা-কেন্দ্রিক ধারার সৃষ্টি হয়, যা অধুনা “পুরাতনী” নামে পরিচিত। এই সময়কার সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় এবং উল্লেখযোগ্য সংগীত¯্রষ্টা-গায়ক হলেন বাংলা টপ্পাসংগীতের জনক রামনিধি গুপ্ত (নিধুবাবু); তাঁর রচিত টপ্পাগান আজও জনপ্রিয়। নিধুবাবুই বাংলায় প্রথম দেশাত্মবোধক গান “নানান দেশে নানান ভাষা, বিনে স্বদেশীয় ভাষা মিটে কি আশা”-র রচয়িতা। সেযুগের অন্যান্য বিশিষ্ট সংগীত¯্রষ্টা-গায়কেরা হলেন রাম বসু, হরু ঠাকুর, গোপাল উড়ে, রূপচাঁদ পক্ষী, শ্রীধর কথক প্রমুখ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলা গানে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ও ব্রহ্মসংগীতের অবদানও অনস্বীকার্য। কলকাতার জনসমাজে কবিগান, তরজা, আখড়াই-হাফ আখড়াই, টপ্পা প্রভৃতি গানের বিশেষ জনপ্রিয়তা ছিল।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে কলকাতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন ও কাজী নজরুল ইসলাম রচিত গানের চর্চা শুরু হয়। রবীন্দ্রসংগীত চর্চা ও শিক্ষার ক্ষেত্রে কলকাতা এক বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। এই শহরের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং “গীতবিতান”, “রবিতীর্থ”, “দক্ষিণী” প্রভৃতি রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষায়তন বিশেষ খ্যাতিসম্পন্ন। কলকাতা-কেন্দ্রিক উল্লেখযোগ্য রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীরা হলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক, কুন্দনলাল সায়গল, দেবব্রত বিশ্বাস, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, সাগর সেন, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, সুমিত্রা সেন প্রমুখ; এবং একালের বিশিষ্ট শিল্পীদের মধ্যে প্রমিতা মল্লিক, স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত, শ্রাবণী সেন, ইন্দ্রাণী সেন, শ্রীকান্ত আচার্যের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নজরুলগীতির ক্ষেত্রে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ধীরেন বসু, অঞ্জলি মুখোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পীরা। দ্বিজেন্দ্রগীতি-অতুলপ্রসাদী-রজনীকান্তের গানে উল্লেখযোগ্য শিল্পীরা হলেন কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়, মঞ্জু গুপ্ত, শর্বাণী সেন, নূপুরছন্দা ঘোষ প্রমুখ। বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্বে কলকাতা-কেন্দ্রিক গীতিকার-সুরকার ও গায়ক-গায়িকারা বাংলা আধুনিক গানে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। এই সময়কার বিশিষ্ট গীতিকার-সুরকারেরা হলেন সলিল চৌধুরী, হিমাংশু দত্ত, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, নচিকেতা ঘোষ, মোহিনী চৌধুরী, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, কমল দাশগুপ্ত প্রমুখ। জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কৃষ্ণচন্দ্র দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শচীন দেববর্মণ, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মান্না দে, কিশোরকুমার, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
১৯৯০-এর দশকের প্রথম ভাগ থেকে বাংলা সঙ্গীতের জগতে এক নতুন ধারার সূচনা ঘটে। এই ধারার বৈশিষ্ট্য লক্ষিত হয় বিভিন্ন বাংলা ব্যান্ডের গানে। কোনো কোনো ব্যান্ড আবার বাংলা লোকসঙ্গীতের সঙ্গে জ্যাজ ও অন্যান্য পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ফিউশনও ঘটায়। তবে এই ধারায় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কবীর সুমন, নচিকেতা, অঞ্জন দত্ত এবং বাংলা ব্যান্ড চন্দ্রবিন্দু ও ক্যাকটাসের “জীবনমুখী গান”। এছাড়া কলকাতায় হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীত ও বাউল-ভাটিয়ালি ইত্যাদি বাংলা লোকসংগীতও বিশেষ জনপ্রিয়। কলকাতার দুটি প্রধান সংগীত-উৎসব হল বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত “বাংলা সংগীত মেলা” ও ডোভার লেন সংগীত সম্মেলন।

নাটক :
কলকাতার যাত্রাপালা, নাটক ও গ্র“প থিয়েটারের ঐতিহ্য সুবিদিত। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩), দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০-১৮৭৩), গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৪৪-১৯১২), দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ (১৮৬৩-১৯২৭) প্রমুখ কলকাতাকেন্দ্রিক নট ও নাট্যকারগণের হাত ধরে বাংলা নাট্যসাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাত হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পশ্চিমবঙ্গের বাংলা নাটকে যা বাস্তবমুখী গণনাট্য ও নবনাট্য ধারার সূচনা হয় তার পুরোধা ব্যক্তিত্বরা ছিলেন তুলসী লাহিড়ী (১৮৯৭-১৯৫৯), বিজন ভট্টাচার্য (১৯১৫-১৯৭৮), উৎপল দত্ত (১৯২৯-১৯৯৩), শম্ভু মিত্র (১৯১৫-১৯৯৭), তৃপ্তি মিত্র (১৯২৪-১৯৮৯) প্রমুখ নাট্যব্যক্তিত্বেরা। বাংলা নাটকের এই ঐতিহ্য বর্তমানে বহন করছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (জন্ম ১৯৩৫), মনোজ মিত্র (জন্ম ১৯৩৮), শাঁওলি মিত্র, ব্রাত্য বসু প্রমুখেরা। নাট্য গবেষণার উন্নতিকল্পে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি স্থাপন করেছে। কলকাতার উল্লেখযোগ্য নাট্যমঞ্চগুলি হল স্টার থিয়েটার, মিনার্ভা থিয়েটার, মহাজাতি সদন, রবীন্দ্রসদন, শিশির মঞ্চ, মধুসূদন মঞ্চ ও গিরিশ মঞ্চ।
১৯৮৪ সালে নান্দীকার জাতীয় নাট্যোৎসব শুরু হয়। এটি একটি বার্ষিক নাট্যোৎসব। নান্দীকার নাট্যদল অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের মঞ্চে এই উৎসব আয়োজন করে।

চলচ্চিত্র :
বাংলা চলচ্চিত্র ও মূলধারার হিন্দি চলচ্চিত্র কলকাতায় সমান জনপ্রিয়। শহরের ফিল্ম স্টুডিও টালিগঞ্জে অবস্থিত; এই কারণে বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পকে “টলিউড” নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। সত্যজিৎ রায় (১৯২১-১৯৯২) কলকাতার একজন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক। ১৯৯১ সালে তিনি তাঁর সারা জীবনের কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ অস্কার পুরস্কার পেয়েছিলেন। তাঁর জন্ম ও কর্মস্থল ছিল কলকাতা। সেই জন্য তাঁর বহু ছবিতে কলকাতার জীবনযাত্রার ছবি ধরা পড়েছে। ১৯৭০-এর দশকে সত্যজিৎ রায় সমকালীন কলকাতাকে আর্থ-সামাজিক সমস্যাগুলিকে কেন্দ্র করে নির্মিত তিনটি ছবি পরিচালনা করেছিলেন। এগুলি হল প্রতিদ্বন্ধী (১৯৭০), সীমাবদ্ধ (১৯৭১) ও জন অরণ্য (১৯৭৫)। এই তিনটি ছবি “কলকাতা ট্রিলজি” নামে পরিচিত। সত্যজিৎ রায় ছাড়াও একাধিক কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালকের কর্মজীবন গড়ে উঠেছে এই শহরকে কেন্দ্র করেই। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মৃণাল সেন (জন্ম ১৯২৩), তপন সিংহ (১৯২৪-২০০৯), ঋত্বিক ঘটক (১৯২৫-১৯৭৬) এবং আধুনিক চিত্র পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (জন্ম ১৯৪৪), অপর্ণা সেন (জন্ম ১৯৪৫), গৌতম ঘোষ (জন্ম ১৯৫০) ও ঋতুপর্ণ ঘোষ (৩১ শে আগস্ট, ১৯৬৩-৩০ শে মে, ২০১৩)। কলকাতার বিশিষ্ট চলচ্চিত্র অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উত্তম কুমার (১৯২৬-১৯৮০), সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (জন্ম ১৯৩৫), সুচিত্রা সেন (১৯২৯-২০১৪), ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯২০-১৯৮৩), অপর্ণা সেন (জন্ম ১৯৪৫), প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় (জন্ম ১৯৬২) প্রমুখ।
কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি ভারতের দ্বিতীয় ফিল্ম সোসাইটি। ১৯৪৭ সালে সত্যজিৎ রায় ও চলচ্চিত্র জগতের অন্যান্য ব্যক্তিত্বেরা এই সোসাইটি স্থাপন করেন। ১৯৮৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার নন্দনে “পশ্চিমবঙ্গ চলচ্চিত্র কেন্দ্র” স্থাপন করে। এরপর ১৯৯৫ সালে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব শুরু হয়।

স্থাপত্য :
কলকাতার অনেক ভবন ও স্থাপনা গথিক, ব্যারোক, রোমান, প্রাচ্য, ও মুঘল স্থাপত্য সহ অন্যান্য ইন্দো-ইসলামীয় শৈলীর মোটিফ দ্বারা সজ্জিত। ঔপনিবেশিক যুগের অনেক উল্লেখযোগ্য ভবনই সুসংরক্ষিত এবং “ঐতিহ্যবাহী ভবন” হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। আবার অনেক ভবনই আজ কালের গহ্বরে বিলীয়মান।
গোর্খা যুদ্ধের (১৮১৪-১৮১৬) স্মৃতিতে নির্মিত অক্টারলোনি মনুমেন্ট (১৮৪৮) মিশরীয়, সিরীয় ও তুর্কি স্থাপত্যরীতির সংমিশ্রণ দেখা যায়। ১৯৬৯ সালে এই স্মৃতিস্তম্ভটি স্বাধীনতা আন্দোলনের শহীদদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত হয়। তাই এখন এটি “শহীদ মিনার” নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সচিবালয় মহাকরণ গ্রিকো-রোমান স্থাপত্যের একটি নিদর্শন। কলকাতায় অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গের রাজভবন ইংল্যান্ডের ডার্বিশায়ারের কেডলস্টন হলের আদলে নির্মিত। কলকাতা হাইকোর্টের মূল ভবনটি বেলজিয়ামের ইপ্রেসের ক্লথ হলের আদলে নির্মিত।
কলকাতায় অবস্থিত ভারতের জাতীয় গ্রন্থাগার দেশের অগ্রণী পাবলিক লাইব্রেরি। অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস ও অন্যান্য শিল্প প্রদর্শশালায় নিয়মিত শিল্প প্রদর্শনী আয়োজিত হয়ে থাকে।

জাদুঘর :
কলকাতার ভারতীয় সংগ্রহালয় হল এশিয়ার সবচেয়ে পুরনো জাদুঘর। ১৮১৪ সালে এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে ভারতের প্রাকৃতিক ইতিহাস ও ভারতীয় শিল্পকলার এক বিরাট সংগ্রহ সংরক্ষিত আছে। কলকাতার আর একটি উল্লেখযোগ্য দ্রষ্টব্য স্থল হল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যাল হল। এটি ১৯২১ সালে যুক্তরাজ্যের স¤্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিসৌধ হিসেবে স্থাপিত হয়েছিল। সৌধটি বেলফাস্ট সিটি হলের আদলে নির্মিত। এর মধ্যে ইতালীয় রেনেসাঁ, ইন্দো-সারাসেনীয় ও মুঘল স্থাপত্যশৈলীর সংমিশ্রণ দেখা যায়। বর্তমানে এটি একটি জাদুঘর ও প্রদর্শশালা। কলকাতার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জাদুঘরগুলি হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আশুতোষ সংগ্রহশালা, স্বামী বিবেকানন্দের পৈতৃক বাসভবন, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, নেতাজি ভবন ইত্যাদি।

শিল্পকলা :
কলকাতার কালীঘাটের পট চিত্রকলা ভারতীয় শিল্পের একটি স্বতন্ত্র ঘরানা। কালীঘাট মন্দিরের কাছে উনিশ শতকে এই চিত্রশিল্প বিকাশ লাভ করেছিল। সেই সময় তীর্থযাত্রীরা স্মারক হিসেবে এই ছবিগুলি কিনে নিয়ে যেত। হিন্দু দেবদেবী, পৌরাণিক ঘটনাবলি ও সমসাময়িক নানা ঘটনাকে এক বিশেষ ধরনের ছবির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলাই ছিল এই ঘরানার বৈশিষ্ট্য।
বিশ শতকের গোড়ার দিকে কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করে “বেঙ্গল স্কুল অফ আর্ট” চিত্রশিল্পের বিশেষ এক ঘরানার জন্ম হয়। এই শিল্পকলার পুরোধাপুরুষ ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ক্যালকাটা স্কুল অফ আর্টের প্রভাবে মুঘল চিত্রকলা ও পাশ্চাত্য শিল্পীরীতির মিশ্রণ ঘটিয়ে বাংলা চিত্রকলার এই নিজস্ব ঘরানাটির জন্ম দেন। পরবর্তীকালে গণেশ পাইন, বিকাশ ভট্টাচার্য প্রমুখ শিল্পীরা এই ঘরানার দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন।

কলকাতার উৎসব :
কলকাতার উৎসবগুলি প্রকৃতিগতভাবে দুই প্রকার। যথাঃ ধর্মীয় উৎসব ও ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব। কলকাতার জনসংখ্যার শতকরা ৮০ ভাগ হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ায় হিন্দু উৎসবগুলি এই শহরে সর্বাধিক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয়ে থাকে। দুর্গাপূজা কলকাতার বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। প্রতিবছর বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে আশ্বিন-কার্তিক মাসে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। কলকাতার দুর্গাপূজা শহরের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণও বটে। হিন্দুদের অন্যান্য উৎসবগুলির মধ্যে লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা, পৌষ সংক্রান্তি, সরস্বতী পূজা, শিবরাত্রি, দোলযাত্রা, পয়লা বৈশাখ, রথযাত্রা, জন্মাষ্টমী ও বিশ্বকর্মা পূজা; এবং অবাঙালি হিন্দুদের উৎসবগুলির মধ্যে দীপাবলি, ধনতেরস ও ছটপূজা সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয়। ইসলামি উৎসবগুলির মধ্যে ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, মহরম, শবেবরাত ইত্যাদি; খ্রিষ্টান উৎসবগুলির মধ্যে বড়দিন ও গুড ফ্রাইডে; বৌদ্ধ উৎসব বুদ্ধ পূর্ণিমা; জৈন উৎসব মহাবীর জয়ন্তী এবং শিখ উৎসব গুরু নানক জয়ন্তীও মহাসমারোহে পালিত হয়।
কলকাতার ধর্মনিরপেক্ষ উৎসবগুলির মধ্যে সর্বপ্রধান হল আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলা ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তী পঁচিশে বৈশাখ। এছাড়া কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব, নান্দীকারের জাতীয় নাট্যমেলা, বিভিন্ন আঞ্চলিক ও ছোটো বইমেলা ইত্যাদিও উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয়। কলকাতার চায়নাটাউনে প্রবাসী চীনাদের চৈনিক নববর্ষ উৎসবও কলকাতার অন্যতম দ্রষ্টব্য উৎসব। প্রতি বছর জুন মাসে কলকাতায় সমকামীদের গৌরব পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়; কলকাতার এই পদযাত্রা ভারতের প্রথম গৌরব পদযাত্রা।

খাদ্যাভ্যাস :
কলকাতার বাঙালিদের প্রধান খাদ্য ভাত ও মাছের ঝোল। এর সঙ্গে রসগোল্লা ও সন্দেশ নামে দুই ধরনের মিষ্টি ও মিষ্টি দই বাঙালিরা বিশেষ পছন্দ করে। চিংড়ি ও সামুদ্রিক মাছ ইলিশ দিয়ে রান্না করা বিভিন্ন রকম পদও বাঙালিদের মধ্যে বিশেষ জনপ্রিয়। পথখাদ্যের মধ্যে বেগুনি, রোল (চিকেন, মাটন, এগ বা সবজি), ফুচকা বিশেষ জনপ্রিয়। চায়নাটাউনের চীনা খাবারও বেশ জনপ্রিয়। কলকাতার অধিবাসীদের মধ্যে মিষ্টি খাবার চল বেশি। বিশেষত সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠানে মিষ্টির বিশেষ চাহিদা দেখা যায়।

পোষাক-পরিচ্ছদ :
কলকাতার পুরুষদের মধ্যে পাশ্চাত্য পোশাক পরার চল থাকলেও মহিলাদের মধ্যে সাধারণত ঐতিহ্যবাহী পোষাক পরার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। পুরুষেরা শার্ট, টি-শার্ট, ট্রাউজার্স, জিনস প্রভৃতি পরতে অভ্যস্ত। তবে উৎসবে অনুষ্ঠানে ধুতি-পাঞ্জাবি অথবা পাজামা-পাঞ্জাবি পরার চলই বেশি। অন্যদিকে মহিলারা শাড়ি অথবা সালোয়ার-কামিজ পরেন। ধর্মপ্রাণ মুসলিম মহিলাদের বোরকা পরতেও দেখা যায়। অবশ্য তরুণীদের মধ্যে পাশ্চাত্য পোষাকও সমান জনপ্রিয়।

কলকাতার শিক্ষাব্যবস্থা :
কলকাতার বিদ্যায়তনগুলি প্রধানত রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত অথবা বেসরকারি সংস্থাগুলির মালিকানাধীন। বেসরকারি বিদ্যালয়গুলির মধ্যে অনেক ধর্মীয় সংগঠন পরিচালিত বিদ্যালয়ও রয়েছে। বাংলা ও ইংরেজি ভাষা শিক্ষার প্রধান মাধ্যম হলেও হিন্দি ও উর্দুও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলি পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ, ইন্ডিয়ান সার্টিফিকেট অফ সেকেন্ডারি এডুকেশন (আইসিএসই), কেন্দ্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড (সিবিএসই), জাতীয় মুক্ত বিদ্যালয় সংস্থা অথবা ব্রিটিশ ক্যারিকুলামের এ-লেভেল কর্তৃক অনুমোদিত। ১০+২+৩ পরিকল্পনার অধীনে মাধ্যমিক বা সমতুল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ছাত্রছাত্রীদের “জুনিয়র কলেজ” (যা প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় নামেও পরিচিত) অথবা উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার সুবিধাযুক্ত পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ, সিবিএসই বা আইসিএসই অনুমোদিত বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয়। উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ছাত্রছাত্রী কলা, বিজ্ঞান অথবা বাণিজ্য- এই তিন ধারার মধ্যে থেকে একটিকে বেছে নিতে হয়; যদিও অন্যান্য বৃত্তিমূলক ধারারও ব্যবস্থা রয়েছে। প্রয়োজনীয় পাঠক্রম সমাপ্ত করার পর ছাত্ররা সাধারণ বা পেশাগত ডিগ্রি শিক্ষাক্রমে ভর্তি হতে পারে।
কলকাতার স্বনামধন্য বিদ্যালয়গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হেয়ার স্কুল, সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল, লোরেটো স্কুল, সেন্ট জেমস স্কুল, কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়, সাউথ সাবার্বান স্কুল, বিধাননগর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, লা মার্টিনিয়ার ক্যালকাটা, ক্যালকাটা বয়েজ স্কুল, সাউথ পয়েন্ট হাই স্কুল, হিন্দু স্কুল, ডন বসকো স্কুল, নব নালন্দা হাই স্কুল, সেন্ট টমাস স্কুল ইত্যাদি।
কলকাতায় মোট ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এগুলি হলঃ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৫৭) , আশুতোষ শিক্ষাপ্রাঙ্গন, কলেজ স্ট্রিট, রাসবিহারী শিক্ষাপ্রাঙ্গন, রাজাবাজার, তারকনাথ শিক্ষাপ্রাঙ্গন, বালিগঞ্জ, শহিদ ক্ষুদিরাম শিক্ষাপ্রাঙ্গন, আলিপুর, হাজরা রোড শিক্ষাপ্রাঙ্গন, হাজরা, ইউনিভার্সিটি প্রেস ও বুক ডিপো, ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড শিক্ষাপ্রাঙ্গন, বিহারীলাল কলেজ অফ হোম সায়েন্স শিক্ষাপ্রাঙ্গন, ইউনিভার্সিটি হেলথ সার্ভিস, ইউনিভার্সিটি রোয়িং ক্লাব, রবীন্দ্র সরোবর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠ ও তাঁবু, ময়দান, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় (১৯০৬ঃ জাতীয় শিক্ষা পর্ষৎ; ১৯৫৫ঃ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়), যাদবপুর শিক্ষাপ্রাঙ্গন, যাদবপুর, বিধাননগর শিক্ষাপ্রাঙ্গন, বিধাননগর, ন্যাশানাল ইনস্ট্রমেন্টস লিমিটেড শিক্ষাপ্রাঙ্গন, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬২) , জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি শিক্ষাপ্রাঙ্গন, জোড়াসাঁকো, ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড (মরকত কুঞ্জ) শিক্ষাপ্রাঙ্গন, কাশীপুর, পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯৫), নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯৭), পশ্চিমবঙ্গ জাতীয় আইনবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯৯), পশ্চিমবঙ্গ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (২০০০), পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয় (২০০৩), আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় (১৭৮১ঃ মাদ্রাসা আলিয়া; ২০০৮ঃ আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়), হাজি মহম্মদ মহসিন স্কোয়ার শিক্ষাপ্রাঙ্গন, বিধাননগর সেক্টর ফাইভ শিক্ষাপ্রাঙ্গন, পার্কসার্কাস শিক্ষাপ্রাঙ্গন, নিউ টাউন শিক্ষাপ্রাঙ্গন, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় (১৮১৭ঃ হিন্দু কলেজ; ১৮৫৫ঃ প্রেসিডেন্সি কলেজ; ২০১০ঃ প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়)।, টেকনো ইন্ডিয়া ইউনিভার্সিটি (২০১২) , বিধাননগর শিক্ষাপ্রাঙ্গন, জোকা শিক্ষাপ্রাঙ্গন (নির্মীয়মান)।
এছাড়া হাওড়ার বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি (শিবপুর, হাওড়া), রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয় (বেলুড়, হাওড়া) ও পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় (বারাসাত) কলকাতার নিকটস্থ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়। বিধাননগরে ইন্দিরা গান্ধী রাষ্ট্রীয় মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আঞ্চলিক শাখাও রয়েছে। কলকাতার কলেজগুলি মূলত এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি দ্বারা অনুমোদিত; অবশ্য বহিঃস্থ কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত কলেজও কলকাতায় আছে। ১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজের সংখ্যাই দুই শতাধিক। বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলকাতার উল্লেখযোগ্য ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হল সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, বেথুন কলেজ (ভারতের প্রথম মহিলা কলেজ) ও স্কটিশ চার্চ কলেজ। কলকাতায় অবস্থিত এশিয়াটিক সোসাইটি, বসু বিজ্ঞান মন্দির, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অফ সায়েন্স, ভ্যারিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার, সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ, সত্যেন্দ্রনাথ বসু ন্যাশানাল সেন্টার ফর বেসিক সায়েন্সেস, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট, ন্যাশানাল ইনস্টিটিউট অফ ফ্যাশন টেকনোলজি, ইনস্টিটিউট অফ কস্ট অ্যান্ড ওয়ার্কস অ্যাকাউন্টেন্টস অফ ইন্ডিয়া এবং ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ কেমিক্যাল বায়োলজি জাতীয় গুরুত্বসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
কলকাতায় এমবিবিএস/এমডি স্তরের পাঁচটি এবং এমডি ও উচ্চতর স্তরের নয়টি মেডিক্যাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এমবিবিএস/এমডি স্তরের প্রতিষ্ঠানগুলি হল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, কলকাতা ন্যাশানাল মেডিক্যাল কলেজ, ইনস্টিটিউট অফ পোস্ট গ্রাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (এসএসকেএম হাসপাতাল), নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল ও আর. জি. কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। এমডি বা উচ্চতর স্তরের প্রতিষ্ঠানগুলি হল বাঙ্গুর ইনস্টিটিউট অফ নিউরোলজি, স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন, রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অফ অফথ্যালামোলজি, চিত্তরঞ্জন সেবাসদন ও শিশুসদন, অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ, বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস, ড. বিধানচন্দ্র রায় স্মৃতি শিশু হাসপাতাল ও কম্যান্ড হাসপাতাল। হোমিওপ্যাথি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে ন্যাশানাল ইনস্টিটিউট অফ হোমিওপ্যাথি, ক্যালকাটা হোমিওপ্যাথি মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল, মেট্রোপলিটান হোমিওপ্যাথি মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ এশিয়ার প্রথম আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

কলকাতার গণমাধ্যমঃ সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র :
ভারতের প্রথম সংবাদপত্র হিকির গেজেট ১৭৮০ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। কলকাতার জনপ্রিয় বাংলা সংবাদপত্রগুলি হল আনন্দবাজার পত্রিকা, বর্তমান, সংবাদ প্রতিদিন, আজকাল, দৈনিক স্টেটসম্যান ও গণশক্তি। দ্য স্টেটসম্যান ও দ্য টেলিগ্রাফ হল দুটি ইংরেজি সংবাদপত্র যা কলকাতা থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। এছাড়া দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান টাইমস, দ্য হিন্দু, দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ও এশিয়ান এজ কলকাতার অপর কয়েকটি জনপ্রিয় ইংরেজি সংবাদপত্র। পূর্ব ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যকেন্দ্র কলকাতা থেকে বেশ কয়েকটি ব্যবসা-বিষয়ক দৈনিকও প্রকাশিত হয়। এগুলির মধ্যে দি ইকোনমিক টাইমস, দ্য ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেস, বিজনেস লাইন ও বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। হিন্দি, উর্দু, গুজরাতি, ওড়িয়া, পাঞ্জাবি ও চীনা প্রভৃতি ভাষাতেও সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। সাময়য়িক পত্রগুলির মধ্যে দেশ, সানন্দা, সাপ্তাহিক বর্তমান, উনিশ কুড়ি, আনন্দলোক ও আনন্দমেলা জনপ্রিয়। দীর্ঘকাল ধরে কলকাতা বাংলা লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের একটি কেন্দ্র।

কলকাতার বেতার ও টেলিভিশন :
কলকাতার রাষ্ট্রায়ত্ত্ব বেতার সম্প্রচার সংস্থাটি হল আকাশবাণী। শহরে আকাশবাণীর বেশ কয়েকটি এএম রেডিও স্টেশন আছে। কলকাতায় ১২টি স্থানীয় রেডিও স্টেশন আছে, যেগুলি এফএম-এ বেতার সম্প্রচার করে থাকে। এগুলির মধ্যে দুটি আকাশবাণীর স্টেশন। ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব টেলিভিশন সম্প্রচার সংস্থা হল দূরদর্শন। দূরদর্শন দুটি ফ্রি-টু-এয়ার টেরেস্ট্রিয়াল চ্যানেল চালায়। এছাড়া কেবল টেলিভিশন, ডাইরেক্ট-ব্রডকাস্ট স্যাটেলাইট সার্ভিস বা ইন্টারনেট-ভিত্তিক টেলিভিশনের মাধ্যমে একাধিক বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি ও অন্যান্য আঞ্চলিক চ্যানেল দেখা যায়। বাংলা ২৪ ঘণ্টার টেলিভিশন নিউজ চ্যানেলগুলির মধ্যে এবিপি আনন্দ, তারা নিউজ, কলকাতা টিভি, ২৪ ঘণ্টা, এনই বাংলা, নিউজ টাইম ও চ্যানেল ১০ উল্লেখযোগ্য।

কলকাতার পরিবহন ব্যবস্থা :
কলকাতায় গণ-পরিবহণ পরিষেবা দেয় কলকাতা শহরতলি রেল, কলকাতা মেট্রো, ট্রাম ও বাস। শহরতলি রেল কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী জেলাগুলির শহরগুলিকে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। হুগলি নদীর উপর অবস্থিত রবীন্দ্র সেতু (হাওড়া সেতু) ও বিদ্যাসাগর সেতু (দ্বিতীয় হুগলি সেতু) কলকাতার সঙ্গে হাওড়া শহরের যোগাযোগ রক্ষা করছে।

কলকাতা মেট্রো : ভারতীয় রেলের সপ্তদশ ক্ষেত্র কলকাতা মেট্রো ভারতের প্রথম মেট্রো রেল পরিষেবা। হুগলি নদীর সমান্তরাল ২৮.১৪ কিলোমিটার পথে শহরের উত্তরে নোয়াপাড়া থেকে দক্ষিণে নিউ গড়িয়া পর্যন্ত মেট্রো পরিষেবা চালু আছে। এই লাইনটির (কলকাতা মেট্রো লাইন ১) পাশাপাশি হাওড়ার রামরাজাতলা থেকে বিধাননগর সেক্টর ফাইভ পর্যন্ত পূর্ব-পশ্চিম মেট্রো লাইনের কাজ চলছে। এই লাইনটি হুগলি নদীর তলায় সুড়ঙ্গ পথে হাওড়া ও কলকাতা শহরদুটির মধ্যে রেল-যোগাযোগ স্থাপন করবে। ২০১০ সালে ভারত সরকারের রেল মন্ত্রক আরও কয়েকটি নতুন মেট্রো লাইন স্থাপনের কাজ শুরু করেছে। এগুলি হলঃ জোকা-বিবাদীবাগ লাইন, নোয়াপাড়া-বারাসাত লাইন, কবি সুভাষ-নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর লাইন, বরানগর-দক্ষিণেশ্বর-ব্যারাকপুর লাইন।
এছাড়া যাত্রীসাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তার জন্য লাইন ১-এও আধুনিকীকরণ করা হচ্ছে। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত রেক চালু করা হয়েছে, স্বয়ংক্রিয় সিগনালিং ব্যবস্থা, স্বচালিত সিঁড়ি, আধুনিক টোকেন ও ফ্লিপগেট পদ্ধতিতে ভাড়া নেওয়াও শুরু হয়েছে। কলকাতা মেট্রোর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন হলঃ কবি সুভাষ (নিউ গড়িয়া), মহানায়ক উত্তমকুমার (টালিগঞ্জ), কালীঘাট, রবীন্দ্র সদন, এসপ্ল্যানেড, সেন্ট্রাল, মহাত্মা গান্ধী রোড, শ্যামবাজার, দমদম ও নোয়াপাড়া।

সড়ক পরিবহণ :
কলকাতায় বাস পরিষেবা সরকারি ও বেসরকারে উদ্যোগে পরিচালিত হয়ে থাকে। কলকাতার সরকারি বাস পরিবহন সংস্থাগুলি হল কলকাতা রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থা, দক্ষিণবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থা, পশ্চিমবঙ্গ ভূতল পরিবহন নিগম, ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি ইত্যাদি। কলকাতার ট্রাম পরিষেবার দায়িত্ব ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানির উপর ন্যস্ত রয়েছে। উল্লেখ্য, কলকাতা ভারতের একমাত্র শহর যেখানে ট্রাম পরিষেবা অদ্যাবধি বিদ্যমান। তবে শহরের কয়েকটি অঞ্চলে শ্লথগতির ট্রাম চলাচলের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয়েছে। বর্ষাকালে অত্যধিক বৃষ্টিতে জল জমে মাঝে মাঝেই শহরের পরিবহন ব্যবস্থায় বিঘœ সৃষ্টি করে থাকে।
কলকাতার পরিবহন ব্যবস্থার অপর এক বিশিষ্ট মাধ্যম হল ট্যাক্সি। কলকাতার ট্যাক্সিগুলি হলুদ রঙের হয়ে থাকে। অন্যান্য শহরে যখন টাটা ইন্ডিকা বা ফিয়েট গাড়ি ট্যাক্সি হিসেবে ব্যবহার করা হয়, সেখানে কলকাতার অধিকাংশ ট্যাক্সিই হিন্দুস্তান অ্যাম্বাস্যাডার মডেলের। কোনো কোনো নির্দিষ্ট রুটে অটোরিকশাও চলাচল করে। স্বল্পদুরত্বের যাত্রীরা অনেক সময় সাইকেল রিকশা ও হস্তচালিত রিকশাও ব্যবহার করে থাকেন। কলকাতায় বিভিন্ন রকমের গণ পরিবহন মাধ্যম সুলভ বলে ব্যক্তিগত যানবাহনের সংখ্যা অন্যান্য শহরের তুলনায় অল্পই। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলিতে শহরে নথিভুক্ত যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে; ২০০২ সালের একটি তথ্যের ভিত্তিতে পূর্ববর্তী সাত বছরে এই বৃদ্ধির হার ছিল ৪৪ শতাংশ। জনঘনত্বের তুলনায় শহরে রাস্তার পরিমাণ মাত্র ৬ শতাংশ। এর ফলে তীব্র যানজট শহরে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। উল্লেখ্য, এই হার দিল্লিতে ২৩ শতাংশ ও মুম্বইতে ১৭ শতাংশ। কলকাতা মেট্রোরেল এবং একাধিক নতুন রাস্তা ও উড়ালপুল শহরের যানজট সমস্যার সমাধানে অনেকটাই সাহায্য করছে।

রেলপথ :
কলকাতা শহরকে রেল পরিষেবা দেয় ভারতীয় রেলের চারটি টার্মিনাল স্টেশন হাওড়া স্টেশন, শিয়ালদহ স্টেশন, শালিমার স্টেশন ও কলকাতা স্টেশন। এর মধ্যে শিয়ালদহ ও কলকাতা স্টেশন কলকাতা শহরে ও হাওড়া ও শালিমার স্টেশন হাওড়া শহরে অবস্থিত। এগুলি ছাড়াও কলকাতায় আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য রেল স্টেশন আছে। এগুলি হলঃ বিধাননগর রোড, দমদম, গড়িয়া ও ইডেন গার্ডেনস ইত্যাদি। ভারতীয় রেলের দুটি অঞ্চলের সদর কার্যালয় কলকাতায় অবস্থিত। এগুলি হলঃ পূর্ব রেল ও দক্ষিণ পূর্ব রেল।

বিমান :
কলকাতা মহানগরীয় অঞ্চলে মোট চারটি বিমানবন্দর রয়েছে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এই শহরের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এটি শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে ১৭ কিলোমিটার উত্তরে উত্তর চব্বিশ পরগনার দমদমে অবস্থিত। এই বিমানবন্দর থেকে আভ্যন্তরিণ ও আন্তর্জাতিক দুই ধরনের উড়ানই চালু আছে। বেহালা বিমানবন্দর ও ফ্লাইং ক্লাব কলকাতার একটি আভ্যন্তরিণ বিমানবন্দর। এটি কলকাতার বেহালা অঞ্চলে অবস্থিত। ব্যারাকপুর এয়ার ফোর্স স্টেশন কলকাতা মহানগরীয় অঞ্চলে অবস্থিত ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি সামরিক ঘাঁটি। কাঁচড়াপাড়া এয়ারফিল্ড ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি প্রাক্তন সামরিক ঘাঁটি। এই বিমানবন্দরটি বর্তমানে বন্ধ।

জলপথ :
কলকাতা পূর্ব ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর। কলকাতা ও কলকাতার সহকারী হলদিয়া বন্দরের দায়িত্ব কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষের উপর ন্যস্ত। এই বন্দর থেকে শিপিং কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ারে যাত্রী পরিষেবা এবং ভারতের অন্যান্য বন্দর ও বিদেশে পণ্য পরিবহন নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এছাড়া কলকাতা ও হাওড়া শহরের মধ্যে একটি ফেরি পরিষেবাও চালু আছে।

নাগরিক পরিষেবা :
কলকাতা পৌরসংস্থা শহরের পানীয় জলের প্রধান সরবরাহকারী। হুগলি নদী থেকে সংগৃহীত জল উত্তর চব্বিশ পরগনার পলতার পাম্পিং স্টেশনে পরিশোধিত করে সমগ্র শহরে পানীয় জল হিসেবে সরবরাহ করে হয়। প্রতিদিন প্রায় ২৫০০ টন কঠিন বর্জ্য কলকাতার পূর্ব দিকে অবস্থিত ধাপায় ফেলা হয়ে থাকে। এই বর্জ্য ভূমিতে বর্জ্য পদার্থ ও নোংরা জলের প্রাকৃতিক পুনর্নবীকরণের জন্য চাষাবাদও করা হয়ে থাকে। শহরের অনেক অঞ্চলেই অনুন্নত পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থার কারণে অস্বাস্থ্যকর উপায়ে বর্জ্য নিঃসরণ করা হয়ে থাকে। শহরাঞ্চলে ও শহরতলিতে বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে যথাক্রমে ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশন ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ নামে দুই সরকারি সংস্থা। ১৯৯০-এর দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত কলকাতাবাসীদের উপর্যুপরি লোডশেডিং-এর যন্ত্রণা ভোগ করতে হত। যদিও বর্তমানে অবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে, তবে এখনও মাঝে মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে থাকে। পশ্চিমবঙ্গ দমকল পরিষেবার অধীনে কলকাতায় ২০টি দমকল কেন্দ্র রয়েছে। এগুলি বছরে গড়ে ৭,৫০০টি অগ্নিসংযোগ ও উদ্ধারকার্যের জন্য ডাক পায়।
কলকাতার প্রধান টেলিফোন ও মোবাইল ফোন পরিষেবা সরবরাহকারী হল সরকারি সংস্থা ভারত সঞ্চার নিগম লিমিটেড (বিএসএনএল) এবং ভোদাফোন, ভারতী এয়ারটেল, রিলায়েন্স কমিউনিকেশনস, আইডিয়া সেলুলার, এয়ারসেল, টাটা ডোকোমো, টাটা ইন্ডিকম, ইউনিনর, ভার্জিন মোবাইল ও এমটিএস ইন্ডিয়া সহ একাধিক বেসরকারি সংস্থা। শহরে জিএসএম ও সিডিএমএ সহ সুপ্রসারিত সেলুলার কভারেজ সুলভ। বিএসএনএল, টাটা ইন্ডিকম, সাইফি, এয়ারটেল, রিলায়েন্স ও এলিয়ান্স প্রভৃতি সংস্থা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবা সরবরাহ করে থাকে।

স্বাস্থ্য পরিষেবা : ২০১১ সালের হিসেব অনুসারে, কলকাতায় ৪৮টি সরকারি হাসপাতাল ও ৩৬৬টি বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র আছে। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালগুলি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের অধীনস্থ। কলকাতার হাসপাতালগুলির মোট শয্যাসংখ্যা ২৭,৬৮৭। প্রতি ১০,০০০ মানুষে কলকাতায় হাসপাতাল শয্যাসংখ্যার অনুপাত ৬১.৭। জাতীয় স্তরে এই অনুপাত প্রতি ১০,০০০ নাগরিকে ৯ জন। সেই হিসেবে এটি জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেক বেশি। কলকাতায় দশটি মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজ আছে। এগুলি কলকাতা মহানগরীয় এলাকার মধ্যে রাজ্যের টার্টিয়ারি রেফারাল হাসপাতাল হিসেবে কাজ করে। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপিত হয়েছিল ১৮৩৫ সালে। এটিই এশিয়ার প্রথম আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে কলকাতার স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থাকে যথেষ্ট মনে করা হয় না। কলকাতার অধিবাসীদের ৭৫% বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রগুলিকে বেশি পছন্দ করেন। জন্য সরকারি হাসপাতালের স্বাস্থ্য পরিষেবার নিম্নমান, অপ্রতুলতা ও দীর্ঘসূত্রিতাকে দায়ী করা হয়।
২০০৫ সালের জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা অনুসারে, কলকাতার অধিবাসীদের একটি ছোটো অংশই কোনোরকম স্বাস্থ্য স্কিম বা স্বাস্থ্য বিমা পরিষেবার আওতাভূক্ত। কলকাতার শিশু জন্ম হার ১.৪। এই হার সমীক্ষার অর্š—গত আটটি মহানগরের মধ্যে সর্বনিম্ন। কলকাতার ৭৭% বিবাহিত মহিলা জন্মনিরোধক ব্যবহার করেন। এই হার সমীক্ষার অন্তর্গত শহরগুলির মধ্যে সর্বাধিক। তবে কলকাতায় আধুনিক জন্মনিরোধকের ব্যবহারের হার সর্বনিম্ন (৪৬%)। কলকাতায় প্রসবকালীন শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে একচল্লিশ। পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে উনপঞ্চাশ।
২০০৫ সালের একটি সমীক্ষার অন্তর্গত শহরগুলির মধ্যে শিশুদের বিশ্বজনীন টীকাকরণ কর্মসূচির অধীনে টীকা না পাওয়া শিশুদের হারে কলকাতার স্থান দ্বিতীয় (৫%)। সুসংহত শিশু উন্নয়ন পরিষেবা কর্মসূচিতে “অঙ্গনওয়াড়ি” কেন্দ্রে যোগাযোগের ব্যাপারে কলকাতার স্থান দ্বিতীয়। কলকাতা ০ থেকে ৭১ মাস বয়সী শিশুদের ৫৭% অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে যুক্ত হয়। অপুষ্টি, অ্যানিমিয়া ও কম ওজনজনিত সমস্যায় ভোগা শিশুদের অনুপাত কলকাতায় সমীক্ষার অন্যান্য শহরের তুলনায় কম।
কলকাতার প্রায় ৩০% নারী ও ১৮% পুরুষ অতিরিক্ত মেদজনিত সমস্যায় ভোগেন। এদের একটি বড় অংশ সমাজের সচ্ছল অংশের মানুষ। ২০০৫ সালের হিসেব অনুসারে, সমীক্ষাকৃত শহরগুলির মধ্যে কলকাতায় অ্যানিমিয়াগ্রস্থ নারীর শতাংশ হার সর্বাধিক (৫৫%)। পুরুষদের মধ্যে এই হার ২০%। ডায়াবেটিস, হাঁপানি, বাত ও অন্যান্য থাইরয়েড-সংক্রান্ত অসুখে ভোগা মানুষও অনেক আছেন। কলকাতায় ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি, চিকনগুনিয়া ইত্যাদি অসুখ বেশি দেখা যায়। তবে এই জাতীয় অসুখে অসুস্থ হয়ে পড়া মানুষের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে। কলকাতা ভারতের সেই জেলাগুলির মধ্যে অন্যতম যেখানে এইডস-আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা সর্বাধিক। কলকাতা জেলাকে এইডস রোগের ক্ষেত্রে চুড়ান্ত বিপজ্জনক অঞ্চল মনে করা হয়।

খেলাধূলা:
ফুটবল, ক্রিকেট ও ফিল্ড হকি কলকাতার জনপ্রিয় খেলা। কলকাতা ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম প্রধান কর্মকেন্দ্র। ভারতের অন্যান্য শহরের তুলনায় এখানে মানুষদের মধ্যে ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা খুব বেশি বরাবরই। এই শহর “ভারতীয় ফুটবলের মক্কা” নামেও পরিচিত। ১৮৯৮ সালে চালু হওয়া কলকাতা ফুটবল লিগ এশিয়ার প্রাচীনতম ফুটবল লিগ। ভারতের অন্যতম প্রধান তিন জাতীয় দল মোহনবাগান, মহমেডান ও ইস্টবেঙ্গল কলকাতারই তিন ঐতিহ্যবাহী ফুটবল ক্লাব। এছাড়াও ইউনাইটেড স্পোর্টিং ক্লাব এই শহরেরই আই-লিগে অংশগ্রহণকারী স্বনামধন্য ফুটবল ক্লাব। মোহনবাগান শুধুমাত্র এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন ফুটবল ক্লাবই নয়, এটি “ভারতের জাতীয় ক্লাব” আখ্যাপ্রাপ্ত একমাত্র ক্লাব। মোহনবাগান ও ইষ্টবেঙ্গলের মধ্যে ফুটবল ম্যাচ কলকাতায় কলকাতা ডার্বি নামে পরিচিত। ম্যাচগুলোতে দর্শকদের উৎসাহ উত্তেজনা দেখবার মতন থাকে।
ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো কলকাতাতে ক্রিকেট অত্যন্ত জনপ্রিয়। শহরের মাঠেঘাটে ও রাস্তায় ক্রিকেট খেলার রেওয়াজ রয়েছে। ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন প্রভৃতি বহির্দ্বার এবং ক্যারাম প্রভৃতি অন্তর্দ্বার ক্রীড়া প্রতিযোগিতা কলকাতায় নিয়মিত আন্তঃঅঞ্চল ও আন্তঃক্লাব পর্যায়ে আয়োজিত হয়ে থাকে। কলকাতা ময়দানে একাধিক ছোটোখাটো ফুটবল ও ক্রিকেট ক্লাব এবং প্রশিক্ষণ সংস্থা অবস্থিত। কলকাতার উল্লেখযোগ্য ক্রীড়া ব্যক্তিত্বগণ হলেন প্রাক্তন ভারতীয় জাতীয় ক্রিকেট অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ও পঙ্কজ রায় এবং অলিম্পিক টেনিস ব্রোঞ্জ পদকজয়ী লিয়েন্ডার পেজ। কলকাতার ফুটবল তারকাদের মধ্যে উল্লেখনীয় হলেন প্রাক্তন অলিম্পিক পদকজয়ী শৈলেন মান্না, চুনী গোস্বামী, পি. কে. বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ এবং বর্তমান কালের ভারতীয় জাতীয় ফুটবল তারকা বাইচুং ভুটিয়া। শাহরুখ খানের মালিকানাধীন “ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ” (আইপিএল) ক্রিকেট দল কলকাতা নাইট রাইডার্সের কেন্দ্রও কলকাতায় অবস্থিত।
কলকাতা একাধিক বৃহদাকার স্টেডিয়ামের জন্য সুবিখ্যাত। ইডেন গার্ডেনস বহুকাল পর্যন্ত বিশ্বের দুটিমাত্র ১০০,০০০-আসনবিশিষ্ট ক্রিকেট স্টেডিয়ামের একটি বলে গন্য হত। ২০১১ ক্রিকেট বিশ্বকাপের জন্য সংস্কারের পর বর্তমানে আসনসংখ্যা ১,০০,০০০ র থেকে কমে গেছে। বর্তমানে এটি ভারতের বৃহত্তম ও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্টেডিয়াম। বহুমুখী-ব্যবহারোপযোগী স্টেডিয়াম যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন (বা সল্টলেক স্টেডিয়াম) বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ফুটবল স্টেডিয়াম। ক্যালকাটা ক্রিকেট অ্যান্ড ফুটবল ক্লাব বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীনতম ক্রিকেট ক্লাব। রয়্যাল ক্যালকাটা গলফ ক্লাব, টালিগঞ্জ ক্লাব ও ফোর্ট উইলিয়ামে কলকাতার তিনটি ১৮-হোলবিশিষ্ট গলফ কোর্স অবস্থিত। রয়্যাল ক্যালকাটা গলফ ক্লাব ব্রিটেনের বাইরে বিশ্বের প্রথম গলফ ক্লাব। রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব শহরে নিয়মিত ঘোড়দৌড় ও পোলো ম্যাচ আয়োজন করে থাকে। ক্যালকাটা পোলো ক্লাব বর্তমানে বিশ্বের প্রাচীনতম পোলো ক্লাব হিসেবে পরিগণিত হয়। অন্যদিকে ক্যালকাটা সাউথ ক্লাব কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক টেনিস প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠানস্থল। এখানে ১৯৪৬ সালে প্রথম গ্লাস-কোর্ট ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচ খেলা হয়েছিল। ২০০৫-২০০৭ সাল নাগাদ উইমেনস টেনিস অ্যাসোসিয়েশন ট্যুরের টায়ার-থ্রি টুর্নামেন্ট সানফিস্ট ওপেন নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে আয়োজিত হয়েছিল। তাঁর পর থেকে সেটি আর চালু হয়নি।
ক্যালকাটা রোয়িং ক্লাব নিয়মিত নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা ও প্রশিক্ষণের আয়োজন করে থাকে। রাগবি কলকাতার একটি অপ্রধান খেলা হলেও এই শহরকে ভারতের রাগবি ইউনিয়নের “রাজধানী” আখ্যা দেওয়া হয়, যা ক্যালকাটা কাপ নামে পরিচিত। রাগবি ইউনিয়নের প্রাচীনতম আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ক্যালকাটা কাপের নাম এই শহরের নামানুসারেই উদ্ভূত। কাপটি ভারতে নির্মিত হয়ে থাকে। কলকাতার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য স্টেডিয়ামগুলি হল রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়াম, ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্র, গীতাঞ্জলি স্টেডিয়াম এবং বেহালার প্রস্তাবিত সত্যজিৎ রায় ইন্ডোর ও আউটডোর স্টেডিয়াম। পূর্ব ভারতের অটোমোবাইল অ্যাশোসিয়েশন, যে ১৯০৪ সালে তৈরি হয়েছিল এবং বেঙ্গল মোটর স্পোর্টস ক্লাব কলকাতায় মোটর স্পোর্টস এবং রয়ালি করায় কলকাতায় তাদের প্রোমোশনের জন্য। বেইটন কাপ, আরেকটি ইভেন্ট যা বেঙ্গল হকি অ্যাসোসিয়েশনের দ্বারা পরিচালনা করা হয় এবং যা প্রথম খেলা হয়েছিল ১৮৯৫ সালে, হল ভারতের সবথেকে প্রাচীন ফিল্ড হকি প্রতিযোগিতা, যা প্রধানত ময়দানের মোহনবাগান মাঠ-এ পরিচালনা করা হয়।






॥ ৪ ॥
প্রথম রেলে চড়াঃ

টিকিট কাটার পর স্টেশনে ঢুকলাম। এদিক ওদিক একটু দেখে নিলাম। এই ফাকে সেলফি তুলতে আর ভুল হলো না। বনগাঁও লেখা সাইনবোর্ড যেন ছবির ফ্রেমে থাকে সেই দিকে কড়া নজর রেখে কয়েকটা ছবি তুললাম। জার্নি বেশ কম হয়নি। একটু ক্লান্ত বোধ করছি। স্টেশনে বসার আসন আছে। আমাদের দেশের স্টেশনের মত আসনের রড কেউ খুলে নেয়নি। কিন্তু আসন থাকলে কি হবে, খালি থাকতে হবেতো! কোন আসন খালি না পেয়ে দাঁড়ালাম খোলা জায়গায়। আমি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলেও আমার চোখ দুটি কিন্তু এক জায়গায় স্থির হয়ে নেই। সে নতুন জায়গার নতুন নতুন সব কিছু দেখে নিচ্ছে। এরই মধ্যে জামাল ভূইয়ার ডাক। দ্রুত তাকে অনুসরণ করলাম। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে সেটা সঠিক জায়গা নয়। আমরা একটা ফুটওভার ব্রিজ পার হয়ে অন্য একটা প্লাটফর্মে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখানেও একই অবস্থা। কোন আসন খালি নাই।
স্টেশনে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বনগাঁও টু শিয়ালদহ লোকাল ট্রেন প্লাটফর্মে চলে এলো। জামাল ভূইয়া আগেও দুবার কলকাতা ভ্রমন করেছে। তাই ভ্রমণে লিড দেয়ার দায়িত্বটা তার ঘারেই পড়লো। আমাদের আগেই সতর্ক করে দিলো যে,
-ট্রেন আসা মাত্র হুরমুরিয়ে লোক নামবে, ঠিক হুরমুরিয়েই উঠতে হবে। বেশি সময় ট্রেন স্টেশনে থাকবে না। তাই দেরি করা যাবে না। সবাই যেভাবে উঠে, আমাদেরও সেভাবেই উঠতে হবে।

পাঠক বন্ধুদের জন্য বনগাঁও রেলওয়ে স্টেশন এর কিছু তথ্য :
বনগাঁও শহরের একমাত্র রেল স্টেশন। এটি একটি জংশন স্টেশন। স্টেশনটি বনগাঁও-রানাঘাট ও শিয়ালদহ-বনগাঁও লাইনের প্রান্তিক স্টেশন। এই স্টেশন থেকে একটি লাইন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশ-এ প্রবেশ করেছে। এই স্টেশন থেকে প্রতিদিন ৪০ জোড়ার বেশি ট্রেন চলাচল করে। শিয়ালদহ রেল স্টেশন থেকে স্টেশনটি ৭৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এবং রানাঘাট স্টেশন থেকে বনগাঁও স্টেশনের দূরত্ব ৩৪ কিলোমিটার। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে স্টেশনটির দূরত্ব মাত্র ৫ কিলোমিটার। এই পথে বহু পণ্যবাহী রেল চলাচল করে বাংলাদেশে। এই স্টেশনের সঙ্গে এক সময় খুলনা ও যশোর শহরের সরাসরি রেল যোগাযোগ ছিল। বর্তমানে স্টেশনটি বনগাঁও শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকার রেল পরিসেবা প্রদান করে থাকে। স্টেশনটি যশোর রোড থেকে ১.৫ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত।
ইতিহাসঃ বনগাঁ স্টেশনটি প্রথম ১৮৮২-১৮৮৪ থেকে চালু হয়। প্রথমে এখানে কয়লা চালিত ট্রেন চলাচল করত। ১৮৮১ সালে সেন্টাল বেঙ্গল রেলওয়ে নামে এক রেল কম্পানি দমদম-খুলনা ও খুলনা-রানাঘাট রেল পথ তৈরি শুরু করে। ১৯০৩ সালে এই রেল পথ এর দায়িত্ব পায় ইস্টর্নার বেঙ্গল রেল।

বিদ্যুতায়ন :
এরপর ১৯৬৩-১৯৬৪ শিয়ালদহ-বারাসাত-অশকনগর-বনগাঁও বিভাগে বিদ্যুৎ চালিত ট্রেন চালিত হয়।

পরিকাঠাম :
এই স্টেশনটি রানাঘাট-বনগাঁও ও শিয়ালদহ-বনগাঁও লাইনের শেষ স্টেশন। স্টেশনটিতে ৩ টি রেল ট্রাক ও ৩ টি প্লাটফর্ম রয়েছে। এখানে সংরক্ষিত ও অসংরক্ষিত দুই প্রকার রেল টিকিট সংগ্রহের ব্যবস্থা রয়েছে। এই স্টেশনটি যাত্রী পরিসেবার পাশাপাশি পণ্য-দ্রব্য বহনকরী রেল গুলির পণ্য-দ্রব্য পরিবহনের পরিসেবা দিয়ে থাকে। এই স্টেশন থেকে বনগাঁও-শিয়াালদহ, বনগাঁও-রানাঘাট, বনগাঁও-বারাসাত, বনগাঁও-ক্যানিং, বনগাঁও-মাঝেরহাট প্রভৃতি লোকাল ট্রেন চলাচল করে।
জামাল ভূইয়ার কথা মত কাজ হলো। ট্রেন থামা মাত্রই জামাল ভূইয়ার কথা মতো উঠে পড়লাম। উঠতে বেশি কষ্ট হয়নি। দরজার কাছে দাড়াতেই উঠে গেলাম। আমার পিছনে যে পরিমান যাত্রী তাতে চলতে হয় না, দাঁড়ালেই পা চলে। বলেছিলো সিট পাওয়া যাবে না কিন্তু ভাগ্যগুণে সিট পেয়ে গেলাম, তাও আবার ফ্যানের নিচে, জানালার ধারে। আমাদের ভাগ্য ভাল বলতে হবে। প্রায় শত কিলোমিটার রেল পথ পাড়ি দিয়ে সন্ধ্যা নাগাদ পৌছে গেলাম শিয়ালদহ স্টেশনে।
জীবনে প্রথম রেল ভ্রমণ বেশ উপভোগ্য ছিল আমার জন্য। জানালার পাশে সিট নিয়ে বসে স্টেশন গুনতে গুনতে আর দেখতে দেখতে রেল ভ্রমণ। রেল লাইনের পাশে স্বল্প আয়ের মানুষগুলোর ছোট ছোট রান্নাঘরের মত থাকার ঘর। প্রচন্ড তাপদাহ চলছিল বাংলাদেশে। কলকাতা প্রবেশ করে দেখি তাপমাত্রা আরো চেতা। ছোট ছোট ঘরগুলো থেকে গরম সহ্য করতে না পেরে মানুষগুলো রেল লাইনের ধারে হাতপাখা নিয়ে সামান্য বস্ত্রে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স্ক মানুষগুলো রেল লাইনের পাশে বসে তাস খেলা নিয়ে ব্যস্ত। মহিলারাও দাঁড়িয়ে-বসে গল্পে মগ্ন। একটার পর একটা স্টেশনে থামছে রেল। অল্প সময়ের মধ্যে আবার ছেড়েও দিচ্ছে। মাঝে মাঝে শো শো করে আমাদের রেলের ডান পাশ-বাম পাশ দিয়ে রেল ছুটে যাছে। প্রথম প্রথম একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, এই বুঝি লেগে গেল। কিন্তু সারাজীবন শুনেছি, হাজাম বেটা তার মাপ মতই কাটে। প্রকৌশলীরা তাদের মাপ মতই লাইন বসিয়েছে। একটু ব্যাত্যয় ঘটার সুযোগ নেই, হাজার হাজার মানুষের জীবন সমান্তরাল দুটি লাইনের উপর। স্টেশনগুলিতে থামার সাথে সাথে যেমন যাত্রী উঠছে তেমনি উঠছে হকার।
এখানকার হকারদের ভাষা একটু অন্য রকম। কেউ কাচা আমের জুস, কেউ আইসক্রীম, কেই খোসা ছাড়ানো বাদাম, কেউ আম, আবার কেউ গ্লুকোন-ডি এর পানি নিয়ে উঠেই এক ভিন্ন সুরে ডাকাডাকি করছে। আবার যাত্রী নামার সাথে সাথে হকারদের কেউ কেউ নেমে যাচ্ছে।
রেলে ভিক্ষার ধরনও আলাদা। আমাদের দেশে ভিক্ষা করে শুধু মুখে বলে বলে। আর কলকাতার ভিক্ষুকদের প্রযুক্তি জ্ঞান বেশ ভাল। তারা একটা সাউন্ড বক্স বুকে ঝুলিয়ে মুখে মাইক্রোফোন দিয়ে গান গায়। গলায় ঝুলানো সাউন্ডবক্সে জনপ্রিয় গান বাজতে থাকে, ভিক্ষুক শুধু গানের সাথে মুখ মিলায়। গানগুলো আবার যেন তেন গান নয়, কিশোর কুমারের গান অথবা ভক্তিমূলক গান বাজায় আর ভিক্ষা করে। এটাও আমার কাছে নুতন দেখা কিছু। এত কিছু দেখার ফাকে ফাকে ক্লান্ত শরীর ঝিমুনি দিচ্ছে। জানালার পাশে রাখা হাত ঝিমুনিতে পড়ে যাচ্ছে! আবার জেগে উঠে রেল ভ্রমণ উপভোগ করছি। কু-ঝিক ঝিক করতে করতে এক অন্য রকম রিদমে চলছিল রেলের যান্ত্রিক সঙ্গীত। অন্য রকম অনুভূতি পেলাম জীবনের প্রথম রেল ভ্রমণে। বনগাঁও থেকে পৌছে গেলাম শিয়ালদহ স্টেশনে।   

শিয়ালদহ স্টেশন:
শিয়ালদহ বা শিয়ালদা কলকাতা শহরের অন্যতম প্রধান রেলস্টেশন। শিয়ালদহ ভারতের ব্যস্ততম রেলস্টেশনগুলির একটি। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শহরতলি রেল টার্মিনাল। কলকাতা মেট্রোর নির্মীয়মান দ্বিতীয় লাইনটি (ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো) শিয়ালদহ স্টেশনের পাশ দিয়ে যাবে। শুধুমাত্র শহরতলির ট্রেন ও যাত্রীসংখ্যা ধরলে এটি ভারতের ব্যাস্ততম।

ইতিহাস:
শিয়ালদহ ষ্টেশন ১৮৬৯ খ্রীস্টাব্দে চালু হয়। এখান থেকে তৎকালীন পূর্ব বঙ্গীয় রেল বিভাগ এর আওতায় ছিল। দেশভাগ এর আগে দার্জিলিং মেল শিয়ালদহ হতে রাণাঘাট, গেদে-দর্শনা পথ ধরে বর্তমান বাংলাদেশ এর মধ্যে দিয়ে শিলিগুড়ি যেত। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ এর সময় পূর্ব বঙ্গীয় রেল এর শিয়ালদহ বিভাগ ভারতের পূর্ব রেল এর আওতাভূক্ত হয় এবং অবশিষ্ট অংশ তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান এর অন্তর্গত হয়।
শিয়ালদহ স্টেশনে পৌছে যার যার ব্যাগ নিয়ে রেল থেকে বেরিয়ে গেলাম, কোন টানা হেচরা নেই। আমাদের দেশে হলে স্টেশনে আমি দাঁড়িয়ে থাকতাম কিন্তু আমার ব্যাগ আমাকে ছেড়ে চলে যেতো অন্যের হাতে সেটা আমি না চাইলেও। এখানে কোন টানা হেচরা না দেখে ভালো লাগলো। আমাদের সাথে করে আনা পানির বোতল শেষ! শিয়ালদহ স্টেশনের মধ্যে হাত মুখ ধোয়ার, সুপেয় পানি পানের অনন্য ব্যবস্থা। একে একে তিনজনই হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। এমন শীতল পানির সরবরাহ আমি কোথাও দেখিনি। সবাই হাত মুখ ধুয়ে বোতলে করে পানি নিয়ে যাচ্ছে। আমরা শুধু হাত মুখ ধুয়ে সতেজতা উপভোগ করে হাটা দিলাম স্টেশনের বাইরে। স্টেশনের বাইরে এসে ছোট একটি চায়ের দোকানে চা-কেক খেয়ে সামান্য বিশ্রাম সেই সাথে বাইরে থেকে স্টেশনের সৌন্দর্য উপভোগ করা। বাইরে থেকে স্টেশনটি খুবই সুন্দর। আলো ঝলমলে স্টেশন, কারুকাজ সবই মুগ্ধ করার মত। শুধু যে স্টেশনের সৌন্দর্য উপভোগ তা নয়, এখানকার মানুষগুলোর হাটা চলা, ব্যস্ততা, আড্ডাও উপভোগের বিষয়। যা দেখছি তাই ভাল লাগছে। চা চাইতেই আমাদের ওয়ান টাইম কাগুজে কাপে চা দিলো।
চা খাওয়া শেষে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করলাম। একটু দরদাম করে উঠে পড়লাম। ছিমছাম গড়নের ড্রাইভার। খুব মিশুক প্রকৃতির। ড্রাইভারের সাথে চুক্তি হলো সে কয়েকটা হোটেল ঘুরিয়ে আমাদের একটা হোটেলে নামিয়ে দিয়ে যাবে। কথা মত কাজ। কলকাতা সিটিতে ঢুকে মারকুইজ স্ট্রিটে গেলাম। বাংলাদেশ থেকে যারাই কলকাতা যায় সবাই মারকুইজ স্ট্রিটে বা এর আশে পাশে নিউমার্কেট এলাকার কাছাকাছি হোটেলে ওঠে। আমরাও গেলাম সেখানে। কিন্তু বাঙ্গালীদের এত ভিড় যে সেখানে কোন হোটেল খালি পেলাম না। কলকাতায় আসলাম তাও হাটবার দিন!!
ছয়-সাতটি হোটেল ঘুরে সিট না পেয়ে হতাশ হয়ে ড্রাইভার চলে এলো মাওলা আলী বা মৌলালি এলাকায়। মৌলালি এসে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড বা সংক্ষেপে এজেসি বোস রোডের সেন্ট তেরেসা চার্চের বিপরীতে প্লানেট ইন্টারন্যাশনাল গেষ্ট হাউসে একটা ডাবল সিটের এসি রুম পেলাম।
আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোডের আছে দীর্ঘ ইতিহাস। সংক্ষেপে না বললেই নয়। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড বা এ জে সি বোস রোড (পূর্বনাম লোয়ার সার্কুলার রোড) কলকাতার একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা। ১৭৯৯ সালে মারহাট্টা খাত বুজিয়ে সারকুলার রোড নামে এই রাস্তাটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এই রাস্তাটিই কলকাতা দ্বিতীয় রাস্তা যেটি রোড নামে অভিহিত হয়। লৌকিক নামে সারকুলার রোড পরিচিত ছিল বাহার সড়ক নামে। স্বাধীনতার পর দুই বিশিষ্ট বাঙালি বৈজ্ঞানিক আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ও আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর নামে রাস্তাটির উত্তর ও দক্ষিণভাগ নামাঙ্কিত হয়। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড ও আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোড একত্রে কলকাতার দীর্ঘ রাস্তাগুলির মধ্যে অন্যতম।
শিয়ালদহে বিদ্যাপতি সেতু পার হওয়ার পর থেকে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোডকে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড নামে অভিহিত করা হয়েছে। বিদ্যাপতি সেতু থেকে মৌলালি মোড়, রিপন স্ট্রিট মোড়, এলিয়ট রোড মোড়, মাদার তেরেসা সরণি মোড়, শেকসপিয়র সরণি মোড় হয়ে এটি সার্কাস অ্যাভিনিউয়ে পড়েছে। এইখান থেকে রাস্তাটির মাথার উপর দিয়ে গেছে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ এবং কলকাতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উড়ালপুল আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড উড়ালপুল। সার্কাস অ্যাভিনিউ মোড় থেকে রাস্তাটি বালিগঞ্জ মোড় (বালিগঞ্জ সার্কুলার মোড়), ল্যান্সডাউন মোড়, চৌরঙ্গি মোড় বা এক্সাইড মোড়, নন্দন-রবীন্দ্রসদন-বাংলা আকাদেমি সাংস্কৃতিক চত্বর, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যাল হল, এসএসকেএম হাসপাতাল, কলকাতা রেসকোর্স হয়ে ইন্দিরা গান্ধী সরণি (রেড রোড)-আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড মোড়ে এসে সমাপ্ত হয়েছে।
আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোডে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ ভবন, স্থাপনা ও দ্রষ্টব্যগুলি হল নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, ডক্টর আর আহমেদ ডেন্টাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল, মাদার তেরেসার শিশু ভবন, সেন্ট জেমস স্কুল, প্র্যাট মেমোরিয়্যাল, মাদার তেরেসার সমাধিস্থল মাদার হাউস, রোম্যান ক্যাথলিক কবরখানা, গণশক্তি ভবন, অ্যাসেম্বলি অফ গড চার্চ স্কুল, স্কটিশ চার্চ কবরখানা, লা মার্টিনিয়ার কলকাতা, শহিদ ভগৎ সিং উদ্যান (মিন্টো পার্ক), হোটেল হিন্দুস্তান ইন্টারন্যাশানাল (এইচএইচআই) কলকাতা, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু কলেজ, নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়াম, ক্যালকাটা ক্লাব, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি, কলকাতা তথ্যকেন্দ্র, নন্দন, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, রবীন্দ্রসদন, এসএসকেএম হাসপাতাল, ডক্টর বিধানচন্দ্র রায় পোস্ট গ্রাজুয়েট ইনস্টিটিউট অফ বেসিক মেডিক্যাল সায়েন্সেস ও কলকাতা রেসকোর্স।
এজেসি বোস রোডের হোটেল প্লানেট ইন্টারন্যাশনালে ঢোকার সময় দাড়োয়ান বিশালদেহী একটা কুকুর নিয়ে বসে আছে। হালকা লালচে বর্ণের কুকুরটির স্বাস্থ্য বেশ ভাল। দাড়োয়ান একটি টেনিস বল নিয়ে কুকুরটার সাথে খেলা করছে। বলটা ছুড়ে মারছে দূরে, আর মুহুর্তেই কুকুরটি বলটা কামড়ে নিয়ে আবার দারোয়ানের কাছে আসছে। আমাদের দেখে কুকুরটি কোন সাড়াশব্দ করলো না কিন্তু ওর দিকে তাকালে ভয়ে শীরদাড়া শীতল হয়ে যাওয়ার উপক্রম। দাড়োয়ান আমাদের অভয় দিলো, কিছু করবে না স্যার।
আমরা সফর সঙ্গী যেহেতু তিনজন। আমাদের প্রয়োজন তিন বেডের রুম। তাই হোটেল রিসিপশনে দেন দরবার করে ঠিক করা হলো দুটা বেড এক করে দিবে আর একটা বালিশ বাড়িয়ে দিবে। আমাদের প্রস্তাবে হোটেল কর্তৃপক্ষ রাজি হলো। তিনজনের থাকার বন্দোবস্ত হলো। রিসিপশনে আমিই আমাদের নাম এন্ট্রি করলাম। তিনজনের পাসপোর্ট রেখে দিলো স্ক্যান করার জন্য। সাথে তিনজনের বিজনেস কার্ড দিলাম। ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে হোটেলে উঠে শরীর ছেড়ে দিলো। একটু ফ্রেশ হয়ে অনুভব করলাম পেটের কৃমি বেশিক্ষণ আর বাঁচবে না। কিন্তু ওদের এভাবে মরতে দেয়া যায় না। এখনই কিছু একটা খেতে হবে।
হোটেল রিসিপশন থেকে পাসপোর্ট তিনটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম খাবারের সন্ধানে। আমরা যেহেতু ফরেইনার তাই আমাদের পাসপোর্ট সাথে রাখা জরুরী মনে করলাম। আর বিদেশ আসছি অথচ পাসপোর্ট সাথে থাকবে না সেটা কি হয়! আমাদের পরিচয় তো আমাদের পাসপোর্টেই না? হোটেলের পাশেই একটা মাজার। মাজারের পাশে একটা বিরিয়ানির দোকান দেখে আর অন্য খাবার হোটেল খোজার ধৈর্য রইল না। দোকানের নাম লাজিজ বিরিয়ানি হাউস। বসে পড়লাম বিরিয়ানি খেতে। খাসির মাংসের বিরিয়ানি শসার স্লাইসের মত মোটা পিয়াজের সালাদ, কাচা লংকা দিয়ে খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম ফুটপাতে। ফুটপাত ধরে হোটেলের দিকে হাটতে হাটতে দেখি পুলিশ বক্সের ধারে ছোট টং দোকান। মাটির পেয়ালায় যাকে এখানে ভার বলে সেই ভারে করে চা বিক্রি করছে। আমরা তিনজন তিন ভার চা নিলাম। প্রতিটি চুমুকেই নতুনত্বের স্বাদ। মাটির ভারে চা পান এটাও জীবনে প্রথম। অনেক শুনেছি, কলকাতায় মানুষ একটা কাপ দুবার ব্যবহার করে না। চা খেয়ে কাপ ফেলে দেয়, মাটির ভারে চা খায় ইত্যাদি ইত্যাদি। বাস্তবে তাই তাই ঘটছে। মাটির ভারে চা খেয়ে আমরাও নির্দিষ্ট স্থানে টুংটাং শব্দে ভার ফেলে দিয়ে হোটেলের দিকে রওয়ানা দিলাম।
বৃহস্পতিবার রাতে ঘুমানো ছাড়া আর কোন কাজ নেই। আর রাতও হয়েছে অনেক। এমনিতেই ক্লান্ত শরীর, তার উপর কোথায় যাব ধারনা নেই। রাতের কলকাতা দেখার ইচ্ছা ছিলো মনে। নতুন আসায় মন চাইলেও বের হওয়ার সাহস পেলাম না। তাই হোটেলে ঢুকে কিছু ফোন কল করে সবার পরিবারকে জানিয়ে দেয়া হলো আমরা ভাল ভাবে পৌচেছি এবং হোটেলে উঠেছি। হোটেল বয়কে ডেকে ওয়াইফাইর পাসওয়ার্ড নিয়ে নিলাম। ফ্রি ওয়াইফাই সংযোগ। এবার কিছুক্ষণ চলতে থাকলো নেট ব্রাউজিং। কেউ ফেসবুকে পথে পথে তোলা ছবি পোষ্ট দিচ্ছে, কেউ কেউ দেশের খবর নিচ্ছে, একই সাথে চলছে টিভি। আধ্যাতিক টাইপের একটা হিন্দি মুভি পেয়ে জামাল ভূইয়ার চোখ আটকে গেলো টিভি স্ক্রিনে। আমি নেটে ঘাটাঘাটি করছি কোথায় যাওয়া যায়, কি দেখা যায় এসব। মুরাদ মুন্সী ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণ পড়ে সবাই নিদ্রা দেবীর কোলে মাথা ঠেকালো। ঘুমের সমুদ্রে ডুবে গেলাম সবাই! এর পর কি হয়েছিলো জানতে পারিনি! কারন সবাই ঘুমে যে!










॥ ৫ ॥
প্রথম ভিক্টোরিয়া দর্শনঃ

ঘুম থেকে উঠেই দেখি শুক্রবারের সকাল। আমরা সবাই যার যার ব্রাশ ব্যাগে করে নিয়ে এসেছি ঠিকই কিন্তু পেষ্ট কই? কেউ পেষ্ট আনিনি। আর নিচে গিয়ে পেষ্ট আনার ধৈর্যও কারো নেই। অতঃপর জামাল ভূইয়া তার ব্যাগ হাতিয়ে বের করলো একটা পেষ্টের বাচ্চা টিউব। তিনজন একবার ব্রাশ করতেই পেষ্ট শেষ হয়ে গেলো।
জামাল ভূইয়ার বাচ্চা টিউবের রয়েছে এক ইতিহাস। আমরা তিনজনই মাস খানেক পূর্বে আরো সাতজনসহ মোট দশজন গিয়েছিলাম কক্সবাজারে। সেখানে গিয়ে ফাইভ স্টার হোটেলে উঠেছিলাম। সেই হোটেলে আমাদের ব্রাশ, পেষ্ট সহ আরো নানা উপকরণ দিয়েছিলো। জামাল ভূইয়া ওখান থেকে তার ব্যবহারের জন্য দেয়া পেষ্ট ব্যাগে করে নিয়ে এসেছিলো। সেই ব্যাগ নিয়ে কলকাতায় আসায় পেষ্টের টিউবটি ব্যাগেই ছিলো। সেই পেষ্টই আজ আমাদের সম্বল, তিনজন ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম নাস্তার খোঁজে।
হোটেল থেকে বেড়িয়ে মাজারের বিপরীতে রাস্তা পাড় হয়ে মোড়ের কাছে ফুটপাতে দেখি বিশাল সাইজের পরোটা ভাজছে। খুধার রাজ্যে পৃথিবী আর পৃথিবীর জায়গায় নাই। ফুটপাতে বসেই নাস্তা দিতে বলায় বিক্রেতা জিজ্ঞেস করলো,
-দাদা একছো না দেড়ছো দেব?
আমরা বুঝতে পারিনি বিষয়টা দোকানদার বুঝে গেলো। পরক্ষণেই আবার বললো
-পনের টাকার দিবো?
আমরা বললাম দেন। বিশাল সাইজের পরোটা। আধা কেজি ওজনের এক একটা ময়দার গোলা টেবিলে রেখে বেলছে। বিশাল তাওয়ায় এক মহিলা ভাজছে উল্টেপাল্টে। ভাজা হলেই ধরিয়ে দিচ্ছে পাশের আরেকজনকে। তিনজন লোক ছোট এই হোটেলটিতে কাজ করছে, সবাই এ্যাপ্রোন পড়ে কাজ করছে। ফুটপাতে দোকান হলেও বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা মেনে চলছে। মহিলা রুটি ভেজে দিলে তৃতীয় সেই ছেলে রুটিটাকে কিছুক্ষণ থাপড়াথাপড়ি করে ঢেকে রাখছে একটা সিলভারের পাতিলে। এবার পাতিল থেকে ছিড়ে ছিড়ে একটা নিক্তিতে তুলে ওজন করে করে প্লেটে রাখছে। প্লেটগুলো আলাদা আলাদা চেম্বার বিশিষ্ট। আমাদের একশ গ্রাম ভাজা পরোটা দিলো প্লেটের এক চেম্বারে, প্লেটের অপর চেম্বারে মটরসুটির ঝোল ঝোল ডাল, এক চেম্বারে কিছুটা সালাদ, পিয়াজ কুচি। দেখতে প্রথমে খুব একটা ভাল মনে না হলেও একটু মুখে দিয়ে বুঝলাম মন্দ নয়। একশ গ্রাম পরোটা পুরোটাই খেয়ে ফেললাম দাদা। পাশের দোকান থেকে পানির বোতল কিনে খেয়ে আবার মাটির পেয়ালায় যা স্থানীয় ভাষায় মাটির ভার হিসাবে পরিচিত তাতে চা দিল। নাস্তা চা পান সেরে এবার একটা ট্যাক্সি ক্যাব নিলাম ভিক্টোরিয়ার উদ্দেশ্যে।
ভিক্টোরিয়ার গেটে পৌছে চোখ জুড়িয়ে গেল নয়নাভীরাম দৃশ্য দেখে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, গাছ গাছালি আর পাখ পাখালির কলরব ঘিরে এক অপূর্ব স্থাপনা। জামাল ভূইয়া টিকিট কিনে আনলো তিনজনের জন্য। আমি আর মুরাদ মুন্সী ব্যস্ত বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ছবি তোলা নিয়ে। ভারতীয়দের জন্য বিশ টাকা হলেও বিদেশীদের জন্য টিকিট মূল্য দুইশ টাকা। আমাদের দেখে যদিও বোঝার উপায় নাই আমরা ভারতীয় নয়। কলকাতার লোকজনের চেহারা, ভাষা, সাইজের সাথে আমাদের কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু আমরা প্রতারক নই, বাংলাদেশ থেকে এসেছি, আমাদের পাসপোর্ট লেগেছে, ভিসা লেগেছে, আমরা বিদেশী তাই দুইশ টাকা দিয়েই টিকিট নিলাম। ভিক্টোরিয়ার মূল ফকট দিয়ে প্রবেশ করে ভিতরে চলতে থাকলো ফটোসেসন। নানান ভঙ্গিমায় ছবি তুলে গেলাম ভিক্টরিয়া হাউসের দোড় গোড়ায়। ভিতরে প্রবেশ দার এখনও খোলেনি। দশটায় খুলবে বিষয়টা আমাদের জানা ছিলো না। আমরা যেহেতু একটু আগে আগেই চলে এসেছি তাই এখনতো আর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। আর দাঁড়িয়ে থাকার প্রয়োজনও নেই। বিশাল সা¤্রাজ্য ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যাল। এখানে শুধু ভবনটাই দেখার বিষয় নয়, রয়েছে সুসজ্জিত বাগান, লেক। আমরা চিকন বাতাসে ঢেউ খেলায় রত লেকের পারে গিয়ে বসলাম। পার বাধানো ঘাটে একটা বকুল গাছের নিচে বসে অপেক্ষা, কখন দশটা বাজে। বিশাল লেকের পাশে ভিক্টরিয়ার বাগান বাড়িতে অন্য দশটা পার্কের মতই কিছু বদ লোক মাইনর বান্ধবী নিয়ে এসে বেহায়াপনা করছে। অপরুপ দৃশ্য থেকে আমাদের নজর অবশ্য ওদিকে যায় না, আমরা লেকের বাতাশ, মাছের খেলা, গাছের ঝির ঝির শব্দ উপভোগ করছি, দুষ্ট লোকের বেহায়াপনা নয়।
দশটা বাজার সাথে সাথে ভিক্টরিয়া হাউসে প্রবেশ করেই প্রথমে ভিক্টোরিয়ার কিছু পুরাতন স্মৃতি দেখলাম। সেখানে দেয়ালে টাঙ্গিয়ে রাখা হয়েছে ভিক্টোরিয়ার নক্সা, নির্মান পর্যায়ের কিছু ছবি, স্থপতিদের ছবি ও কর্মযজ্ঞ, নির্মাণ কাজ তদারকি কাজের ছবি। দেখতে দেখতে ঢুকে পড়লাম বাম পাশের বিশাল হল রুমে। সেখানে দেয়ালে রয়েছে বিশালাকায় বিভিন্ন চিত্রকর্ম। দীর্ঘকাল আগের হলেও এখনও যেন জীবন্ত কর্মগুলো। দেশি বিদেশী বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক ছবি। নবাবদের, ব্রিটিশদের, কলকাতার কালজয়ী বাঙ্গালির জীবনচিত্র সহ নানা বিষয় ফুটিয়ে তুলেছে ভিক্টরিয়া মেমোরিয়্যাল এর বর্তমান মিউজিয়ামটি।
পাঠক বন্ধুদের সুবিধার জন্য ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যাল সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরা হলোঃ পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় জওহরলাল নেহেরু রাস্তার নিকটে অবস্থিত ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যাল। ভারতে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যের সাফল্যকে চিহ্নিতকরণ এবং রানী ভিক্টোরিয়ার একটি স্মারক-এই দ্বৈত উদ্দেশ্যের পরিবেশন হিসেবে এই স্মৃতি সৌধটি নির্মিত হয়েছিল। বর্তমানে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যাল একটি মিউজিয়ামে পরিণত হয়েছে যা ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় দ্বারা পরিচালিত হয়। এই মিউজিয়ামে নকশা, অনুচিত্রকলা, চিত্রাঙ্কন, বই, মূর্তি ইত্যাদি তুলে ধরা হয়, পাশাপাশি তৎকালীন ভারতীয় ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ের অস্ত্রাদির উপরও দৃষ্টি প্রদান করা হয়।

রাণী ভিক্টোরিয়া সম্পর্কে:
ভারতের স¤্রাজ্ঞী, রাণী ভিক্টোরিয়া ৬৩ বছরেরও অধিক সময়ের জন্য রাজকীয়ভাবে গ্রেট ব্রিটেনের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি তাঁর কাকা চতুর্থ উইলিয়াম এর মৃত্যুর পর ১৮৩৭ সালে যুক্তরাজ্যের রাণী হিসাবে নিযুক্ত হন। ১৯০১ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড শাসনভার গ্রহণ করেন। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যাল রাণী ভিক্টোরিয়ার সম্মানে ১৯০৬ এবং ১৯২১ সালের মধ্যে নির্মিত হয়। ১৯০১ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জন রাণী ভিক্টোরিয়ার সম্মানে একটি স্মৃতি সৌধ নির্মাণের প্রস্তাব করেন। এই স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর ১৯০৬ সালের ৪ জানুয়ারি ওয়েলস্-এর রাজকুমার (রাজা পঞ্চম জর্জ) স্থাপন করেন। ১৫ বছর ধরে নির্মিত এই স্মৃতিসৌধ ১৯২১ সালে জনসাধারণের পরিদর্শনের জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। এই স্মৃতিসৌধের নির্মাণ কাজটি মেসার্স মার্টিন অ্যান্ড কোং, কলকাতাকে দেওয়া হয়েছিল। প্রায় ১ কোটি টাকা ব্যয়ে এই স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছিল, যা ভারতীয় দেশীয় রাজ্যগুলির দ্বারা প্রদেয়। এই স্মৃতিসৌধ ইন্দো-স্যারাসেনিক পুনর্জাগরণ স্থাপত্য শৈলীকে অনুসরণ করে সাদা মাকরানা মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরী হয়েছিল। মুঘল, ডেক্কানি, ব্রিটিশ, মিশরীয়, ভেনিশীয় এবং পাশাপাশি ইসলামী পরিকল্পনার সমন্বয়ে এই সাদা স্মৃতিসৌধ রয়্যাল ইনস্টিটিউট অফ ব্রিটিশ আর্কিটেক্ট এর স্থপতি উইলিয়াম এমারসনের তত্ত্বাবধানে তৈরী হয়েছিল। উত্তরের সেতু এবং বাগানের দরজা দুটিই উইলিয়াম এমারসন এর সহকারী ভিনসেন্ট জে এস দ্বারা পরিকল্পিত। কেন্দ্রিয় গম্বুজের শীর্ষে ৪.৯ মিটার লম্বা ও পাঁচ টন ওজনের “এঞ্জেল অফ ভিক্টরি”র একটি মূর্তি রয়েছে।

রয়্যাল গ্যালারি :
গ্যালারিতে জ্যানসেন এবং উইন্টারহলটার এর অসংখ্য চিত্রকর্ম রয়েছে যেগুলিতে রাণী ভিক্টোরিয়ার এবং রাজকুমার আলবার্ট এর জীবনের দৃশ্য চিত্রিত রয়েছে।

এই গ্যালারির অর্ন্তভূক্ত নিদর্শন ভান্ডারগুলি হল :
একটি পিয়ানো যা রাণী ভিক্টোরিয়া ১৮২৯ সালে তার ১০ বছর বয়সে উপহার পেয়েছিলেন। এই পিয়ানো একটি চমৎকার পিয়ানো হিসাবে বিখ্যাত। সম্প্রতি পিয়ানোটি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যাল এর কেন্দ্রীয় গ্যালারিতে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। উইন্ডসর দুর্গে অবস্থিত একটি লেখার টেবিল রয়েছে যেটি রাণী ভিক্টোরিয়া দ্বারা ব্যবহৃত হত। জয়পুর মিছিল এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তৈল চিত্র। এটি রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড এর ১৮৭৬ সালে রাজ্য পরিদর্শন বিষয়ে রচিত।
কিছু চিত্রকলার বর্ণনাঃ ১৮৩৮ সালের জুন মাসে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে ভিক্টোরিয়ার রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান, ১৮৪০ সালে সেন্ট জেমস প্যালেসে আলবার্টের সাথে ভিক্টোরিয়ার বিবাহ, ১৮৪২ সালে উইন্ডসর ক্যাসেলের সেন্ট জর্জ চ্যাপেলে ওয়েলসের রাজকুমার (সপ্তম এডওয়ার্ড) এর নামকরণ, ১৮৬৩ সালে রাজকুমারী আলেকজান্দ্রার সাথে ওয়েলসের রাজকুমারের বিবাহ, ১৮৮৭ সালে ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবেতে প্রথম জয়ন্তী সেবা, ১৮৯৭ সালে সেন্ট পল এর গির্জায় দ্বিতীয় জয়ন্তী সেবা এর মনোরম চিত্রকর্ম।

কলকাতা গ্যালারি:
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যাল এর ক্যালকাটা গ্যালারি ভারতের সর্বপ্রথম শহুরে গ্যালারি। বিশ্বের বুদ্ধিজীবীদের এই স্মৃতিসৌধের প্রতি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে এই গ্যালারি প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেন ভারতের তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রী অধ্যাপক এস নুরুল হাসান।

এই গ্যালারির চিত্রাঙ্কনগুলি হল:
আর. বি. দত্তর দ্বারা বিপিন বিহারী দত্ত, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রামমোহন রায়, কলকাতা ও হাওড়ার মধ্যে পন্টুন সেতু (হাওড়া ব্রিজ হিসেবে সুপরিচিত), ভবানীচরণ লাহা দ্বারা কার্ড খেলোয়ার, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মিসেস বেলনোস দ্বারা ফেরিওয়ালা, বেনি মাধব ভট্টাচার্য দ্বারা দেবী কালী। এই স্মৃতিসৌধের অন্যান্য কিছু গ্যালারী যেমনঃ জাতীয় নেতাদের গ্যালারি, পোর্ট্রেট গ্যালারি, সেন্ট্রাল হল, ভাস্কর্য গ্যালারি, অস্ত্র ও অস্ত্রাগার গ্যালারি।
বাগানঃ ৬৪ একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই স্মৃতিসৌধের পার্শ্ববর্তী বাগান ডেভিড প্রেন এবং রেডেসডেল দ্বারা পরিকল্পিত। ২১ জন সদস্যবিশিষ্ট মালিরা এই বাগানটির দেখাশোনা করেন। বাগানের বিশালাকার গাছগুলোর কোটরে কাঠবিড়ালির আনাগোনা দেখার মত দৃশ্য। এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে চঞ্চল কাঠবিড়ালিগুলো। এছাড়া ভিক্টোরিয়ার উত্তর দ্বারের দিকে রাণী ভিক্টোরিয়ার একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি আছে যা স্যার জর্জ ফ্র্যামটনের সৃষ্টি এবং এটি সিংহাসনে উপবিষ্ট রাণীকে নিয়ে বর্ণিত। ভবনের দক্ষিণ অংশে এডওয়ার্ড লনে স্মৃতিসৌধ খিলানের নীচে রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড এর একটি ব্রোঞ্জ মূর্তি দর্শকরা দেখতে পাবেন। এটি স্যার বারট্রাম ম্যাকেনাল দ্বারা পরিকল্পিত। ফ্রেডরিক উইলিয়াম পোমেরয় দ্বারা নির্মিত কার্জন স্থাপত্যের ধাঁচে কার্জন লন নামে অন্য আরেকটি অঙ্গন রয়েছে। এই বাগানে আরও বহু মূর্তি রয়েছে, সেগুলি হলঃ কর্নওয়ালিস, হেস্টিংস, ক্লাইভ, ডালহৌসি, বেন্টিঙ্ক, ওয়েলেসলি, রিপন, অ্যান্ড্রু.এইচ.এল ফ্রেজার ও রাজেন্দ্রনাথ মুখার্জী।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যাল দেখা শেষে পিছন গেইট দিয়ে বেরিয়ে মিউজিয়াম পরিচালনা অফিসের কাছে গেলাম। সেখানে সতেজতার বেশ বন্দোবস্ত করে রেখেছে তারা। পরিস্কার পরিচ্ছণ ঠান্ডা পানিতে হাত মুখ ধুয়ে পাশেই পানি শীতলীকরণ যন্ত্রের মাধ্যমে শীতল পানি সরবরাহ হচ্ছে। আমরাও বোতল ভরে ঠান্ডা পানি পান করলাম। পানি পান শেষে পিছন গেইট দিয়ে বেরিয়ে যাব। বেরিয়ে যাওয়ার আগে খালাতো ভাই আমির হোসেন নয়নকে ইমোতে ভিডিও কল দিয়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যাল দেখালাম বিনা পয়সায়। যাব বলে না আসায় ভিক্টোরিয়া দেখিয়ে প্রতিশোধ নিলাম। লেকের পার ঘেষে বিশালাকার দেবদারু গাছ, তার নিচে সেই পুরানো আমলের লোহার ফ্রেমে কাঠের তৈরী আরাম করার জন্য বেঞ্চ পাতা। আমরা বসলাম কিছুক্ষণ। পুরাতন দেবদারু গাছ থেকে কাঠ বিড়ালি নেমে ছোটাছুটি করছে। আমরা ছবি তুলতে অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু এত দুষ্টু যে ফ্রেমবন্দি করতে পারলাম না, দুচোখ দিয়ে হৃদয়ে বন্দি করে রাখলাম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে গেলাম মূল রাস্তায়। রাস্তার পাশেই দুহাতের তালুতে উড়ন্ত ধবল কবুতর। যার নাম দিয়েছে পিস পার্ক। পিস পার্কের পাদদেশে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ফটোসেসন করে ফুটপাতে বসে ক্ষুধার্ত অবস্থায় চা, বিস্কিট, কেক, পানি খেয়ে সামান্য বিশ্রাম আর বসে বসে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পর্যটকদের দেখা। নানা দেশের নানা রঙ্গের মানুষ, নানা পোষাক, নানা ভঙ্গিমায় হেলে দুলে হাটছে, এদিক ওদিক দেখছে। 
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যাল দেখে আমরা চলে গেলাম নিউ মার্কেটে। এই ফাকে মুরাদ মুন্সী ভিক্টোরিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে তোলা একটি ছবি ফেসবুকে পোষ্ট করে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই শরীয়তপুরের এক সাংবাদিক মন্তব্য লিখে জানতে চাইলো, মুন্সী এই মসজিদটা কোথায়?
ভিক্টোরিয়াকেও মানুষ মসজিদ ভাবে, কোন দুনিয়ায় আছি আমরা! তথ্যের ভান্ডার হলো সাংবাদিকগণ, তারাই যদি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যালকে মসজিদ ভাবে তবে উচু স্থান দেখলে অনেকেই কবর ভেবে জিয়ারত শুরু করে দিবে!
নিউ মার্কেটের সামনে নেমে ভিতর দিকে প্রবেশ করলাম। মজার ব্যাপার নিউ মার্কেট যে কোনটা ঠিক করতে পারলাম না। সব মার্কেটই নিউ আর সব মার্কেটই পুরাতন। অনেক ঘুরাঘুরির পর আমি কিনলাম একটা বেল্ট। মুরাদ মুন্সী আর জামাল ভূইয়া কিনবে বাঘের খাচা! অনেক দোকান ঘুরাঘুরির পর বেশ প্রকট রংয়ের বাঘের খাচা দেখাচ্ছে দোকানদার। অবশেষে কালো রংয়ের বাঘের খাচা (আন্ডার ওয়ার) কিনলো দুজনেই। মুরাদ মুন্সী শর্ট প্যান্ট, কালো গেঞ্জি নিলো। প্রচন্ড রোদ। তাপমাত্র এতোটা বেড়েছে মনে হচ্ছে সূর্য মামা মাথার হাতখানে উপরে এসে পড়েছে। হাটতে হাটতে ক্লান্ত, আবার প্রচন্ড ক্ষুধার্ত। পেট খালি হলে আমাদের মাথাও খালি হয়ে যায়। খুধা নিবৃত্ত না করা পর্যন্ত আর কোন কিছুই ভালো লাগবে না। তাই এখন খাবার খোজা ছাড়া আর কোন কিছুই ভালো লাগছে না। তার উপর ক্লান্তির জন্য পাও চলছে না। এখনই ট্যাংকিতে ফুয়েল না দিলে যেকোন সময় গাড়ি দাঁড়িয়ে যাবে।
বাঙ্গালী মানুষ, বাংলা খাবার ছাড়া মুখে কিছু রোচে না। খাবার হোটেল খুঁজতে খুঁজতে আরেক দফা ক্লান্তি! অবশেষে গলির ভিতরে একটা হোটেল পেলাম বেশ সাদামাটা। ভিতরে গিয়ে দেখি এটা পাঞ্জাবী শীখদের। দোকানের নাম কি যেন পুরোটা মনে নাই তবে শেষে লেখা ধাবা কথাটা মনে আছে। ভিতরে ঢুকে জিজ্ঞাস করলাম
-খাবার কি আছে?
আমাদের বললো,
-ভাত, মাছ, ডাল, সবজি, থালি।
আমরা একটা থালি অর্ডার দিলাম দেখার জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যে নিয়ে এলো এক বিশাল ট্রের মত সাজানো থালি। থালিতে এক চেম্বারে আছে ভাত, আরেক চেম্বারে দুটি রুটি, এক চেম্বারে আলুর দম, সবজি, ডাল, রুটি কড়কড়া ভাজা দিলে যেমন তেমনি একটা দোসা জাতীয় কিছু, এক চেম্বারে দুধের তৈরী দেখতে মিষ্টান্ন বা পায়েসের মত হলেও জামাল ভূইয়া খেয়ে বললো টক টক লাগে। থালি থেকে সবাই একটু একটু করে খেয়ে বললাম ভাত, ডাল, মাছ, সবজি আনেন। আমরা বুঝতে পারলাম না, দুপুরের খাবারে থালিতে একই সাথে ভাত ও রুটি কি কারনে দিলো? রুটি হলে শুধু রুটিই খাব, ভাত দিলে শুধু ভাতই, কিন্তু ভাত আর রুটি কি একসাথে খাওয়ার জিনিস? আমরা বুঝে গেলাম, এটা আমাদের খাবার না, আমাদের খাবার হলো ডাল-ভাত। অর্ডার করতেই পাগরিতে মাথা আবৃত এমন এক ব্যক্তি আমাদের মাছ ভাত এনে দিলো।
মাছ কাটার কথা আর কি বলবো। আরেকটু পাতলা করে কাটতে পারলে আশি গ্রামের অফসেট পেপার বলে চালিয়ে দেয়া যেত। ক্ষুধার্ত অবস্থায় যা পেলাম তাই খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুললাম। হাত মোছার অবস্থা দেখে মনে হলো একদম কব্জি ডুবিয়ে খেয়েছি আরকি! ধাবা থেকে বেরিয়ে রাস্তার কোল ঘেষে হাটছি ট্যাক্সি ক্যাবের আশায়। প্রধান সড়ক পর্যন্ত হেটে যাওয়ার পর ক্যাব পেলাম অনায়াসে। সরাসরি হোটেলে চলে এলাম ক্যাবে চরে। কলকাতা প্রবেশের পর থেকেই বন্ধু সুশান্ত কুমার কংসবণিক বার বার ফোন করে আমাদের অবস্থান জানছে এবং টুকি টাকি বিষয়গুলো সতর্ক করে দিচ্ছে। কোথা থেকে কোথায় যেতে হবে, সেখানে কোন কোন বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, টাকা পয়সা লেনদেনে কি কি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। শুক্রবার সকালে সুশান্ত আমাকে ফোন করে জানালো সে দুপুরের দিকে আসছে দেখা করতে। আমরা নিউ মার্কেট এলাকায় থাকাবস্থায় একাধিক বার ফোন করে জানলো কি করছি এবং জানালো সে রওয়ানা দিয়েছে, দুপুরে হোটেলে এসে দেখা করবে। আমরা নিউ মার্কেট থেকে হোটেলে এসে দেখি রিসিপশনে বসে আছে বন্ধু সুশান্ত। দেখেই দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো, কত দিন পরে দেখা বন্ধু.....। এর পর আমরা সুশান্তকে নিয়ে চলে গেলাম আমাদের রুমে। খাটের উপর গা এলিয়ে দিয়ে চললো কুশলাদী বিনিময়। পরিবারের সবাই কেমন আছে, ওর ব্যবসা বাণিজ্য কেমন চলছে বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের জানালো। আমরা এসেছি শুনে দত্তপুকুর থেকে কলকাতা এসেছে দেখা করতে। কলকাতার ব্যস্ত জীবনে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে দেখা করতে আসাটা একটু বিরল ঘটনাই। আর আসবেই না কেন। ওতো বাংলাদেশের ছেলে। বাংলাদেশের মাটি পানিতে বেড়ে উঠা সুশান্ত মনে প্রাণে বাঙ্গালী। আতিথেয়তা, আপ্যায়নে বাঙ্গালীর তুলনা মিলা ভার। হোটেলে কিছুটা সময় দিয়ে সুশান্ত চলে গেল। ওর কিছু কাজও আছে, সেগুলো সেরে বাড়ি ফিরবে। আমরা আর ওকে আটকালাম না। বিদায় দিয়ে হোটেলে কিছুটা বিশ্রাম নেয়া এবং আবার বেরিয়ে পড়ার পরিকল্পনা চলতে থাকলো।







॥ ৬ ॥
হাওড়া ব্রিজ ভ্রমণঃ

বিকালের ভ্রমণ পরিকল্পনার প্রথমেই চিন্তায় এলো হাওড়া ব্রিজ দেখতে যাব। হাওড়া ব্রিজ দুইটা। হুগলী নদীর উপর দুটি একই মডেলের ব্রিজ হয়েছে। ক্যাব ড্রাইভারকে বলে নিলাম যে, আমাদের হাওড়া ব্রিজ ঘুরিয়ে ইডেন গার্ডেন স্টেডিয়ামে নামিয়ে দিবেন। ড্রাইভার চলতে শুরু করলো। ফ্লাইওভার দিয়ে যেতে যেতে প্রথমেই হুগলী নদীর উপর নতুন তৈরী হাওড়া ব্রিজ। এই ব্রিজটি নতুন। এর নামকরণ করা হয়েছে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর এর নামে।
ট্রাফিক সিগনালে দাঁড়ালে মাঝে মাঝেই ড্রাইভার হাতের তালুতে কি যেন নিয়ে তার সাথে একটু চুন মিশিয়ে গাজা তৈরীর মত করে ঘষে ঘষে মুখে নেয়। প্রতিটি ড্রাইভারকেই দেখলাম এমনটি করে। ড্রাইভারকে জিজ্ঞাস করতেই বললো,
-এটাকে খৈনি বলে দাদা, আপনাদের দেশে এটা ব্যবহার করে না দাদা?
আমরা বললাম না। আমাদের দেশে কেউ কেউ গুল ব্যবহার করে, এটা ব্যবহার করে না। ড্রাইভার বললো,
-আমাদের দেশে এটা বেশ চলে দাদা।
নতুন হাওড়া ব্রিজ অর্থাৎ বিদ্যাসাগর ব্রিজ ঘুরে হুগলী নদীর তীর ঘেষে একটা ছোট টং দোকানের কাছে ট্যাক্সি থামালো। বিদ্যাসাগর ব্রিজে উঠতেই ড্রাইভার আমাদের সতর্ক করে দিলো,
-দাদা ছবি তুলবেন না কিন্তু। পুলিশ দেখলে অহেতুক ঝামেলায় পড়বেন। আর সিসি টিভি ক্যামেরাও আছে। তাই দেখুন, ছবি তোলার দরকার নাই।
বিদ্যাসাগর সেতু সম্পর্কে পাঠকদের জন্য সংগ্রহ করা কিছু তথ্য বিনিময় করছি।

বিদ্যাসাগর সেতু :
“বিদ্যাসাগর সেতু” বা “দ্বিতীয় হুগলি সেতু”, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে হুগলি নদীর ওপর অবস্থিত একটি সেতু। এর মাধ্যমে হাওড়া ও কলকাতা শহর দুটির মধ্যে যোগাযোগ রক্ষিত হচ্ছে। সেতুটি সব রকম যানবাহনের ক্ষেত্রেই টোল সেতু হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর মোট দৈর্ঘ্য ৮২২.৯৬ মিটার। এটি ভারতের দীর্ঘতম ঝুলন্ত (কেবল-স্টেইড) সেতু এবং এশিয়ার দীর্ঘতম ঝুলন্ত সেতুগুলির মধ্যে একটি। সেতুটি নির্মাণ করতে মোট ৩৮৮ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর সেতুটির উদ্বোধন করা হয়। হুগলি রিভার ব্রিজ কমিশনের অধীনে সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে এই সেতুটি নির্মিত হয়েছিল।
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত রবীন্দ্র সেতুর (হাওড়া ব্রিজ) ১২ কিলোমিটার (৭.৫ মাইল) দক্ষিণে অবস্থিত বিদ্যাসাগর সেতু হুগলি নদীর ওপর নির্মিত দ্বিতীয় সেতু। উনিশ শতকের বাঙালি শিক্ষাবিদ ও সমাজ সংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নামানুসারে সেতুটির নামকরণ করা হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে এই সেতু কলকাতা-সন্নিকটস্থ হুগলিবক্ষে স্থিত অপর দুই সেতু রবীন্দ্র সেতু ও বিবেকানন্দ সেতুর সহযোগী সেতু হিসাবে নির্মিত হয়েছিল। বিদ্যাসাগর সেতু একটি কেবল-স্টেইড বা ঝুলন্ত সেতু। এর প্রধান বিস্তার ৪৫৭ মিটারের কিছু বেশি এবং ডেকের প্রস্থ ৩৫ মিটার। এই সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ১৯৭৮ সালে এবং সেতুটির উদ্বোধন হয় ১০ অক্টোবর, ১৯৯২, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রয়াণ শতবর্ষে। সেতুর তদারককারী সংস্থা হুগলি রিভার ব্রিজ কমিশন (এইচআরবিসি)। তবে সেতু নির্মাণ করেছিল বিবিজে নামে ব্রেথওয়েট, বার্ন ও জেশপ নামে তিনটি সংস্থার একটি যৌথ গোষ্ঠী।

ইতিহাস :
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকে দেশের বাণিজ্যিক কার্যকলাপ ও জনসংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। হাওড়া ও কলকাতা শহর দুটির মধ্যে হুগলি নদীর ওপর সেই সময় একটি মাত্র সেতুই ছিল রবীন্দ্র সেতু বা হাওড়া ব্রিজ। এই সেতুর ওপর যানবাহনের চাপ ক্রমাগত বাড়তে থাকলে, নদীর ওপর একটি নতুন সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা হয়। এমন একটি সেতুর পরিকল্পনা করা হয়, যে সেতুটি নিকটস্থ জাতীয় সড়কের মাধ্যমে মুম্বই, দিল্লি ও চেন্নাই শহর তিনটিকে সরাসরি সড়কপথে যুক্ত করতে পারবে।
১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ২০ মে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি এই সেতুর শিলান্যাস করেন। যদিও এই ঝুলন্ত সেতু (সেই সময়ে এই সেতুটি একই ধরনের সেতুগুলির মধ্যে বিশ্বের দীর্ঘতম স্প্যান ব্রিজ ছিল) নির্মাণের কাজ শুরু হয় ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ জুলাই কলকাতার নদীতীরে একটি কূপ খননের মাধ্যমে। সেতুটি সম্পূর্ণ হতে মোট ২০ বছর (অবশ্য তার মধ্যে সাত বছর কোনো নির্মাণকাজই হয়নি) সময় লেগেছিল। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সভাপতিত্বে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমহা রাও সেতুটির উদ্বোধন করেন।

বৈশিষ্ট্য :
বিদ্যাসাগর সেতু একটি মাল্টি-কেবল স্টেইড [১৪৪টি (৩৮ী৪) কেবল] সেতু। ১২৭.৬২ মিটার (৪১৮.৭ ফুট) লম্বা দুটি ইস্পাত-নির্মিত পাইলন কেবলগুলিকে ধরে আছে। সেতুটিতে দুটি ইস্পাতের কাঠামোযুক্ত কংক্রিট ডেক রয়েছে। ডেকের দুটি ক্যারেজওয়ের মোট প্রস্থ ৩৫ মিটার (১১৫ ফুট)। সেতুটিতে মোট তিনটি লেন এবং দু-পাশে ১.২ মিটার (৩ ফুট ১১ ইঞ্চি) প্রস্থবিশিষ্ট ফুটপাত রয়েছে। কিন্তু উদ্বোধনের পর থেকেই মানুষের নিরাপত্তার কারণে বিদ্যাসাগর সেতুর ফুটপাত দিয়ে পায়ে হেঁটে যাতায়াত নিষিদ্ধ আছে। রক্ষণাবেক্ষণের সুবিধার্থে কলকাতার দিকে উত্তরের ইস্পাত পাইলনের ধার ঘেঁষে একটি স্বয়ংক্রিয় উন্নায়ক বা লিফট প্রথম থেকেই তৈরি করা হয়েছে। এদিকে পশ্চিমবঙ্গের প্রধান প্রশাসনিক ভবনের কার্যালয় কলকাতার “মহাকরণ” থেকে হাওড়া শিবপুরের “নবান্ন”তে স্থানান্তরিত হওয়ায় বিদ্যাসাগর সেতুর গুরুত্ব আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে। ডেকটি মূল ৪৫৭.২০ মিটার (১,৫০০.০ ফুট) দীর্ঘ বিস্তার এবং দু-পাশের প্রতিপাশের ১৮২.৮৮ মিটার (৬০০.০ ফুট) বিস্তারের ওপর রয়েছে। এটিকে ধরে আছে সমান্তরাল তারের কেবল। সেতুটির নকশা করেছিল শ্লেইচ বার্গারম্যান অ্যান্ড পার্টনার, নকশা পরীক্ষা করে ফ্রিম্যান ফক্স অ্যান্ড পার্টনার ও বৃহৎ শিল্প নিগম লিমিটেড। সেতুটি নির্মাণ করে গ্যামন ইন্ডিয়া লিমিটেড।
বিদ্যাসাগর সেতু পার হয়ে আমরা হুগলী নদীর তীর ঘেষে চলছি। নদীর তীরে বড় বড় মিল কারখানা। দেখে বুঝা গেলো এখানে বহু পূর্ব কাল থেকেই বিভিন্ন শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে হুগলী নদীকে ঘিরে।  নদীর তীর এতটা সুন্দর করে শাসন করেছে যে ভাঙ্গার উপায় নাই। পুরো তীরটা যেন সান বাঁধানো ঘাটের মত। পায়ে হাটা পথ, বসার সুবন্দোবস্ত, তীরে বিশালাকায় বটগাছ নিঃস্বার্থ ভাবে ছায়া ও অক্সিজেন দিয়ে যাচ্ছে। তীর ঘেষে যেতে যেতে হঠাৎ ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে আমাদের গাড়িতে বসতে বলে বেরিয়ে গেল।
আমরা এক জায়গায় বেশি সময় বসে থাকার লোক না, তাই নেমে পড়লাম। নেমে দেখি ড্রাইভার ছোট একটা দোকান থেকে কিছু কিনছে। আমরাও এগিয়ে গেলাম। অনেক ক্ষণ যাবৎ চা খাওয়া হয় না, তাই ভাবলাম চা খেয়ে নেই। দোকানে গিয়ে দেখি ড্রাইভার কিছু ভাজা-পোড়া কিনছে। আমরা দোকানিকে বললাম আমাদেরও কিছু দেন। দোকানী আমাদের একটা পাতার তৈরী বাটিতে করে কিছু পাকুড়া দিল। ছোট ছোট করে তৈরী পাকুড়া বেশ সুস্বাদু। তার চেয়ে অবাক করা বিষয় পাতার তৈরী বাটিটা দেখে প্রথমে আচ করতে পারিনি যে এটা পাতা দিয়ে তৈরী। পাতা দিয়ে এত সুন্দর করে বাটি তৈরী করা যায় এই প্রথম দেখলাম। দুতিনটা পাতা সলাকা দিয়ে শেলাই করে তার পরে সাচে ফেলে প্রচন্ড প্রেসার দিয়ে বাটিটা তৈরী করা হয়েছে। দেখতে খুবই সুন্দর। পাকুড়া খাওয়ার পর শুরু হলো পাতার বাটির ময়না তদন্ত। বাটিটা পরতে পরতে খুলে দেখলাম কিভাবে তৈরী করেছে। পাকুড়া খেয়ে চা নিলাম। সেই মাটির ভাড়ে চা। মুরাদ মুন্সীর জন্য একটু স্পেশাল! চিনি ছাড়া চা। এখানে চা তৈরী করার সময়ই চিনি দেয়। চা পাতা, চিনি, দুধ, এলাচি, লবঙ্গ, দারুচিনি ভেঙ্গে একসাথে দিয়ে দীর্ঘক্ষণ ফুটায়। হাতল ওয়ালা সিলভারের পাত্রে চা উননে রেখে বার বার নাড়তে থাকে। মজার ব্যাপার হলো সব দোকানের চা’ই আমার কাছে এক রকম মনে হলো। অনেকটা পায়েসের নিংড়ানো ঝোলের মত স্বাদ!! একটা লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো ছোট দোকানগুলো পাথর কয়লার আগুনে সব করে। কয়লার আগুন বেশ টাটকা। দেখে মনে হয় আগুনের এক একটা খন্ড। চা খেয়ে এর পর উঠে গেলাম ক্যাবে। ড্রাইভার আমাদের পুরাতন হাওড়া ব্রিজ অর্থাৎ রবীন্দ্র সেতু ঘুরিয়ে ইডেন গার্ডেন স্টেডিয়ামের পাশে নেতাজি সুবাস চন্দ্র বসুর নামে তৈরী নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো। প্রথম হাওড়া ব্রিজ অর্থাৎ বিদ্যাসাগর ব্রিজের চাইতে শতগুন সুন্দর মূল হাওড়া ব্রিজ বা রবীন্দ্র সেতুটি। ১৯৪৩ সালে কাজ সম্পন্ন হওয়া ব্রিজটা এখনও নতুনের মত লাগছে। পাঠক বন্ধুদের জন্য রবীন্দ্র সেতুর কিছ তথ্য তুলে ধরা হলো। বলে রাখা ভালো, তথ্যগুলো উন্মুক্ত বিশ্বকোষ থেকেই নেয়া হয়েছে।

রবীন্দ্র সেতু :
রবীন্দ্র সেতু (পূর্বনাম হাওড়া ব্রিজ) হুগলি নদীর উপর অবস্থিত কলকাতা ও হাওড়া শহরের মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী সেতুগুলির মধ্যে অন্যতম। ১৮৭৪ সালে প্রথম হাওড়া সেতু নির্মিত হয়। পরে ১৯৪৫ সালে পুরনো সেতুটির বদলে বর্তমান ক্যান্টিলিভার সেতুটির উদ্বোধন হয়। ১৯৬৫ সালের ১৪ জুন সেতুটির নাম পরিবর্তন করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে রবীন্দ্র সেতু রাখা হয়।
রবীন্দ্র সেতু বঙ্গোপসাগরীয় প্রবল ঝড়ঝঞ্জাগুলি সহ্য করতে সক্ষম। এই সেতু দিয়ে দৈনিক ৮০,০০০ যানবাহনও প্রায় ১০ লক্ষ পথচারী চলাচল করে। এই জাতীয় সেতুগুলির মধ্যে রবীন্দ্র সেতু বিশ্বে ষষ্ঠ বৃহত্তম।
হাওড়া ব্রিজ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি নদীর উপর অবস্থিত বড় খিলানযুক্ত একটি ঝুলন্ত সেতু। সেতুটি ১৯৪৩ সালে অনুমোদিত হয়। প্রকৃতপক্ষে সেতুটির নামকরণ করা হয় নিউ হাওড়া ব্রিজ হিসাবে, কেননা একইস্থানে অবস্থিত কলকাতা এবং হাওড়া জেলার মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী একটি ভাসমান সেতুর পরিবর্তে এই সেতুটি নির্মাণ করা হয়। ১৯৬৫ সালে সেতুটির নাম ভারত এবং এশিয়ার প্রথম নোবেল বিজয়ী বিখ্যাত বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে পুনঃ নামকরণ করা হয়।

ইতিহাস :
১৮৬২ সালে বাংলার সরকার ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানির চীফ ইঞ্জিনিয়ার জর্জ টার্নবুলকে হুগলি নদীর উপর একটি ব্রিজ নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের উপর পরিক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বলেন। ২৯ এ মার্চ তিনি প্রয়োজনীয় নকশা এবং উপাত্তসমূহ উপস্থাপন করেন। কিন্তু সে সমযয়ে ব্রিজটি নির্মাণ করা হয়নি।
পন্টুন ব্রিজ :
হুগলি নদীর উপর জন-চলাচল বৃদ্ধির ব্যাপকতার উপর লক্ষ্য করে ১৮৫৫-১৮৫৬ সালের মাঝামাঝি পুনরায় নদীটির উপর ব্রিজ নির্মাণকল্পে একটি কমিটি গঠন করা হয়।

নতুন সেতুর জন্য পরিকল্পনা :
১৯০৬ সালে বন্দর কর্তৃপক্ষ ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের চীফ ইঞ্জিনিয়ার আর এস হায়েট এবং কলকাতা কর্পোরেশন এর চীফ ইঞ্জিনিয়ার ডাব্লিউ বি ম্যাকাবে এর নেতৃত্বে একটি কমিটি নিয়োগ করে। চীফ ইঞ্জিনিয়ারদের নেতৃত্বাধীন কমিটি প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে। সকল তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে নদীটির উপর একটি ভাসমান সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এ উদ্দেশ্যে ২৩ টি প্রতিষ্ঠান হতে ব্রিজ এর ডিজাইন এবং কনস্ট্রাকশন এর উপর দরপত্র আহ্বান করা হয়। ১৯৩৫ সালে নতুন হাওড়া ব্রিজের আইন সংশোধিত হয় এবং পরের বছর ব্রিজটি নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়।
হাওড়া ব্রিজ পশ্চিমবঙ্গে রবীন্দ্র সেতু নামেও সুপরিচিত। কলকাতায় হাওড়া ব্রিজ হুগলী নদীর উপর প্রসারিত এবং ব্রিটিশদের একটি বিস্ময়কর প্রযুক্তি কর্ম বলে মনে করা হয়। বিশ্বের ব্যস্ততম প্রসারিত খিলান সেতুর মধ্যে হাওড়া ব্রিজ অন্যতম। হাওড়া ব্রিজ কলকাতা মহানগরী ও হাওড়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে অর্থাৎ কলকাতার অন্যতম হাওড়া রেল স্টেশন থেকে মহত্মা গান্ধী রোড বা এমজি রোড এর সাথে সংযোগ স্থাপন করে অত্র অঞ্চলের মানুষের লাইফ লাইন হিসাবে সমাদৃত। তাই হাওড়া ব্রিজ এই মহানগরীর জীবনরেখা স্বরূপ। হাওড়া ব্রিজ কলকাতার হুগলী নদীর উপর অবস্থিত তিনটি ব্রিজের মধ্যে একটি। বস্তুত এটি ঔপনিবেশিক শহরের সবচেয়ে ভাবপ্রণ বৈশিষ্ট্য এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় হিসেবে খ্যাত। হাওড়া সেতু নির্মাণ করতে দীর্ঘ ৭ বছর সময় লেগেছে। হাওড়ার এই প্রসারিত খিলান সেতুর কাজ সম্পন্ন হয় ১৯৪৩ সালে। কলকাতায় হাওড়া ব্রিজ এই একই বছরের মধ্যে যানবাহন চলাচল এবং জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয়। এই সেতুর নির্মাণে খরচ হয়েছিল প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা। হাওড়া ব্রিজ এর পুরো কাঠামোটি রিভেট দ্বারা নির্মিত যেখানে আপনি কোথাও নাট ও বোল্ট এর ব্যবহার দেখতে পাবেন না। বর্তমানে হাওড়া ব্রিজ কলকাতার প্রবেশদ্বার স্বরূপ, যেটি এই শহরকে হাওড়া স্টেশনের সাথে সংযুক্ত করে, যা হল কলকাতার মূল রেলওয়ে স্টেশন ও ভারতের সবথেকে ব্যস্ততম স্টেশন। হাওড়া ব্রিজ ৭০৫ মিটার দীর্ঘ এবং ৯৭ ফুট চওড়া। হাওড়া ব্রিজের পরিকাঠামো ২৬,৫০০ টন প্রসারন সাধ্য ইস্পাত দ্বারা নির্মিত, যা দুটি স্তম্ভ দ্বারা সাহায্যপ্রাপ্ত। প্রতিটি স্তম্ভ রাস্তার ঊর্ধ্বভাগে ৯০ মিটার জুড়ে অবস্থিত।

চলাচল :
কলকাতা ও হাওড়া জেলার মধ্যে চলাচলের ক্ষেত্রে হাওড়া ব্রিজ একটি অন্যতম ভূমিকা পালন করে। প্রতিদিন ব্রিজটির উপর দিয়ে প্রায় ১,৫০,০০০ জন পথযাত্রী এবং ১,০০,০০০ গাড়ি চলাচল করে থাকে।






॥ ৭ ॥
নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামঃ

আমরা হুগলী নদী হাওড়া ব্রিজ দিয়ে পার হয়ে ক্যাব থেকে নেমে নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামে প্রবেশ করলাম। প্রবেশ দ্বার থেকে একটু অদুরে নেতাজীর দাঁড়ানো বিশাল ভাস্কর্য। এমন একটি ভাস্কর্য সামনে পেয়ে ছবি না তুলে পারা যায়? আমরা নেতাজীর ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু ছবি তুললাম। ছবি তোলা শেষে এদিক ওদিকটা একটু ঘুরে দেখতে দেখতে স্টেডিয়ামের ভিতর থেকে গানের আওয়াজ কানে ভেষে আসলো। নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামটি বার হাজার আসন বিশিষ্ট সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। গেটের নিরাপত্তা কর্মীকে জিজ্ঞেস করতেই বললো,
-হ্যা, গান হচ্ছে। জি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলের জন্য সা-রে-গা-মা-পা অনুষ্ঠানের সুটিং চলছে। গ্র্যান্ড ফিনালের চিত্রায়ন চলছে আজ।
-প্রবেশাধিকার কি টিকিটের বিনিময়ে? জানতে চাইলে নিরাপত্তা কর্মীরা বললো,
-না, টিকিট সিস্টেম নয়, আমন্ত্রীতরাই কেবল ঢুকতে পারে।
আমরা দেখতে যেত চাইলে সাফ জানিয়ে দিলো,
-ভিতরে যাওয়া যাবে না।
আমরা নিজেদের পরিচয় দিয়ে বললাম,
-আমরা সবাই আইনজীবী, এডভোকেট, বাংলাদেশ থেকে এসেছি আপনাদের দেশে ঘুরতে।
বাংলাদেশ থেকে এসেছি এবং আইনজীবী কথাটা শুনে নিরাপত্তা কর্মীদের একজনের মন গলে গেল। সে বললো
-এত দূর থেকে এসেছে যখন, যান ভিতরে যান।
অপর নিরাপত্তা কর্মী বললো,
-না না যেতে দেয়া যাবে না, কর্তৃপক্ষের নিষেধ আছে।
তবে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশী হিসাবে আমাদের সম্মান করলো এবং ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দিলো। আমরা তিনজন ভিতরে প্রবেশ করে কিছুক্ষণ অনুষ্ঠানের রেকর্ডীং পর্ব দেখলাম। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র ইনডোর স্টেডিয়ামটি সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। বাইরে প্রচন্ড গরমে শরীর সিদ্ধ প্রায়! ভিতরে প্রবেশ করার সাথে সাথে মনে হলো সাইবেরিয়ায় ঢুকে গেছি। তিনজনে দ্বিতীয় সারিতে গিয়ে চেয়ারে বসলাম। গান চলছে। আমরা ভিতরে বসে গানের অনুষ্ঠানের ছবি তুললাম। জামাল ভূইয়া গানটা ভিডিও করে ফেসবুকে ছেড়ে দিলো বিশাল স্টাটাস দিয়ে।
একটা গান শেষ হওয়ার পর পরিচালকের গলা, আমরা আবার যাব, আবার যাব, রেডি হও, এক দুই এক দুই তিন... শুরু হয়ে গেল গান। মন মাঝি রে.... আয় ফিরে আয়.... গানটি গাইলো। দরদ দিয়ে গাওয়া গানটি শুনে অন্যরকম শীতলতা অনুভব করলাম। সা-রে-গা-মা-পা অনুষ্ঠানটি খুব বেশি দেখিনি। বিছানায় শুয়ে টিভি দেখার সময় রিমোট টিপে টিভির চ্যানেল পরিবর্তন করার সময় অল্প বিস্তর দেখেছি। রেকর্ডীং করা অনুষ্ঠানটা যখন অল্প বিস্তর দেখেছি তখন ভালই লেগেছিলো। আজ লাইভ দেখলাম। সত্যিই ওদের গানের গলা বেশ ভালো। দর্শকদের আগ্রহ আছে অনুষ্ঠানটিতে আর শিল্পীরা গায়ও চমৎকার, তাইতো এই শিল্পীরা নানা চড়াই উৎরাই পার হয়ে এমন একটি প্রতিযোগীতায় গ্রান্ড ফিনালে পর্যন্ত আসতে পেরেছে।
গানটি শেষ হওয়ার পর পরিচালক প্রতিযোগীদের একে একে ডাকলো মঞ্চে। প্রতিযোগীরা কিভাবে আসবে, এসে কি বলবে, কিভাবে সম্ভাষণ জানাবে ইত্যাদি দেখিয়ে দিচ্ছে। স্টেডিয়ামের গ্যালারীতেও প্রচুর দর্শনার্থীদের ভির। ছোট ছোট অনেক ছেলে মেয়ে একই রকম সাজে। মনে হলো, আগে গ্র“প নৃত্য হয়েছে বা হবে। আমরা কিছুক্ষণ ওখানে থেকে বেরিয়ে গেলাম। একজায়গা থেকে বেরোবার আগেই পরিকল্পনা চলতে থাকে, এখান থেকে কোথায় যাওয়া যায়! এবারও আমরা পরিকল্পনা করলাম, এবার গন্তব্য কফি হাউসে।







॥ ৮ ॥
কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজও আছেঃ

স্টেডিয়ামের বাইরে এসে ক্যাবের জন্য অপেক্ষা। কয়েকটা ক্যাব পেলাম যারা কফি হাউস চেনে না। আর আমরাও চিনি না কোথায় বা কোন স্ট্রিটে কফি হাউস। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ক্যাব ডাকার সময় দেখি স্মার্ট এক লোক দাঁড়িয়ে আছে ক্যাবের অপেক্ষায়। তার নাম অভিরুপ দেওয়ান। অভিরুপ দেওয়ান ক্যামেলিয়া স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজির ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একজন সহকারী অধ্যাপক। তিনি আমাদের একটি ক্যাব ধরিয়ে দিতে সহযোগীতা করলো। ওখানে ড্রাইভাররা কলস্ট্রিট বললে বেশ ভাল চেনে। কলস্ট্রিট প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির সামনে বলে এক ড্রাইভারকে ধরিয়ে দিলো। এবার ড্রাইভার আমাদের নিয়ে ছুটে চললো কলস্ট্রিট ওরফে কলেজ স্ট্রিট এর দিকে। আকা বাকা রাস্তা ধরে পৌছে গেলাম সেই ঐতিহাসিক কফি হাউসের রাস্তায়।
ক্যাব থেকে নেমেই চোখ কপালে উঠে গেল। এত বড় বইয়ের বাজার আমি আগে দেখিনি। রাস্তার দুধার ঘেষে সবই বইয়ের দোকান। বইয়ের জন্য এক সমৃদ্ধ জায়গা বলেই মনে হলো। নতুন বই, পুরাতন বইয়ের গন্ধে এক অপূর্ব মাদকতা। আধুনিক সুন্দরী এক রমনীকে জিজ্ঞেস করতেই আঙ্গুল উচিয়ে দেখিয়ে দিলো কফি হাউস। 

কফি হাউস, ইন্ডিয়ান কফি হাউস বা এ্যালবার্ট হল সম্পর্কে কিছু তথ্য না দিলেই নয় :
উত্তর কলকাতার বইপাড়া, কলেজ স্ট্রিট চত্বরে এটি অবস্থিত ও বাঙালির-আড্ডাস্থল, কলকাতার কফি হাউসগুলির মধ্যে সেন্ট্রাল এ্যাভিনিউ এবং কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউস-দুটিই প্রাচীনতম। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায় রাধাপ্রসাদ গুপ্তের দেওয়া স্মৃতিনির্ভর তথ্য অনুযায় ইন্ডিয়ান কফি বোর্ডের উদ্যোগে বাঙালি কফি সেবীদের জন্য সেন্ট্রাল এ্যাভিনিউর কফি হাউস খোলা হয় ১৯৪১-১৯৪২ সাল নাগাদ আর তার কিছুদিন পরেই খোলা হয় কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসটি। পরে, ১৯৫৭ সাল নাগাদ অ্যালবার্ট হল কফি হাউস ইন্ডিয়ান কফি বোর্ডের আওতা থেকে বেরিয়ে এসে শ্রমিক সমবায়ের আওতায় আসে। এই দুই কফি হাউসই ছিল এক কালের বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের প্রধান আড্ডাস্থল। নিকটতম বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলির ছাত্রছাত্রীদের ভিড় করা ছাড়াও নামিদামী বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাহিত্যিক, গায়ক, রাজনীতিবিদ, পেশাদার, ব্যবসায়ী ও বিদেশি পর্যটকদের আড্ডা দেওয়ার অবারিত জায়গা হিসাবে এটি খ্যাত। বিশ্বের সবচেয়ে বড় পুরানো বইয়ের বাজার ও নতুন বইয়ের বাজার সামনে আছে বলে হাউসটিতে সব সময়ই ভিড় থাকে। চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়, বাঙালি অভিনেতা রূদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তর মত প্রমুখ ব্যক্তিরাও কোননা কোন সময়ে এই কফি হাউসটিতে আড্ডা দিয়ে গেছেন। সংক্ষেপে এই কফি হাউসটি কলেজ স্ট্রিটের মর্মস্থলে অবস্থিত যেখানে প্রখ্যাত সব বুদ্ধিজীবীরা ঘন্টার পর ঘন্টা এক কাপ কফি নিয়ে আড্ডা জমান। পূর্বে অ্যালবার্ট হল নামে পরিচিত এই হলঘর বহু ঐতিহাসিক সভা বা জমায়েতের সাক্ষী।
আর্ন্তজাল ঘেটে পাওয়া যায় কফি হাউসের সেই আড্ডাটা... গানের সৃষ্টি ইতিহাস। ইতিহাস সমতুল্য গানের সৃষ্টির ইতিহাস জানলে পাঠক বন্ধুদেরও ভাল লাগবে।
প্রয়াত কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পী মান্না দে’র কথা উঠলেই সবার মাথায় যে গানের সুর গুনগুন করে ওঠে সেটি নিঃসন্দেহে ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই। কফি হাউস গানটি নিয়ে মান্না দে সব সময় নিজের চেয়েও বেশি কৃতিত্ব দেন গীতিকার সুরকারকে। বিনয়ী মান্না দে’র মতে... তিনি শুধু গানটা গেয়েছিলেন মাত্র। হেমন্ত গাইলে গানটা সুপারহিট হতো আর শ্যামল মিত্র গাইলে তো হিট। তবে মান্নার কণ্ঠে যে গানটি চিরকালীন পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে সেকথা স্বীকার করে নিয়েছেন গানটির সুরকার সুপর্ণকান্তি।
কফি হাউসের সেই আড্ডাটা গানটির গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের কথায় সুর দিয়েছিলেন নচিকেতা ঘোষের পুত্র সুপর্ণকান্তি ঘোষ। মান্না দের মতে, গৌরীবাবু লিখেছিলেন দুর্দান্ত। সুরকার সুপর্ণকান্তি অসাধারণ কাজ করেছিলেন। এই গানটির সৃষ্টিও হয়েছিলো বেশ নাটকীয় ভাবে।
১৯৮৩ সালের কথা, গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার তখন আশা ভোঁসলেকে নিয়ে প্রচুর হিট প্রেমের গান লিখে চলেছেন। কিন্তু পূজার গান মান্না দের জন্য তিনি লিখতে পারছেন না। সবই লিখছেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। এ নিয়ে আক্ষেপ ছিল গৌরী প্রসন্নের মনে। এ সময় একদিন নচিকেতা ঘোষের নিউ আলিপুরের বাড়িতে গিয়েছিলেন গৌরী প্রসন্ন। উদ্দেশ্য ছিল শক্তি ঠাকুরকে দিয়ে একটি গান তোলা। সেই সময় সেরা জুটি ছিলেন নচিকেতা ও গৌরী প্রসন্ন। সেই সূত্রে নচিকেতা ঘোষের ছেলে সুপর্ণকান্তির সঙ্গেও বেশ ভাল সম্পর্ক। তবে বাড়িতে আসার অনেকক্ষণ পরে সুপর্ণকান্তিকে দেখতে পেয়ে গৌরী প্রসন্ন মজা করেই বলেন, “কী, বাইরে আড্ডা মেরে সময় কাটাচ্ছ?” এর উত্তরে সুপর্ণকান্তি তার গৌরী কাকাকে বলেন, “কী সব গদগদে প্রেমের গান লিখছো। একটা অন্যরকম গান লিখে দেখাও না। এই আড্ডা নিয়েও তো গান লিখতে পারো।”
এবার গৌরী প্রসন্ন বলেন, “তুমি তো অক্সফোর্ডের এমএ হয়ে গিয়েছো। আড্ডা নিয়ে বাংলা গান গাইবে?” সুপর্ণ তখন বলেন, “কেন নয়। কফি হাউসের আড্ডা নিয়েও তো একটা গান লিখতে পারো।” এই তর্কের মাঝেই গৌরী প্রসন্ন মনে মনে দুই লাইন গান সৃষ্টি করে ফেলেন।
এরপরেই সুপর্ণকান্তিকে বললেন, লিখে নাও- ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই/ কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেলগুলো সেই।” সুপর্ণও সঙ্গে সঙ্গে দুটো লাইনেই সুর দিয়ে শুনিয়ে দেন। উপস্থিত শক্তি ঠাকুর সেবার পূজায় গানটা গাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেও সুপর্ণ রাজি হননি। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক করে নিয়েছিলেন মান্না দের কথা।
পরদিন সকালেই গৌরী প্রসন্নের স্ত্রী সুপর্ণকান্তিকে ফোন দিলেন। সারা রাত জেগে বহুদিন পরে গান লিখেছেন অসুস্থ গৌরী প্রসন্ন। তখন তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত। দু’দিন পরে গানটা নিয়ে হাজির। কিন্তু শেষ স্তবক যোগ করার পক্ষপাতী ছিলেন না গৌরী প্রসন্ন। সুপর্ণকান্তি চান যোগ করুন একটি স্তবক। শেষ পর্যন্ত রাজি হন। লেখেন দুর্দান্ত সেই লাইন- ‘সেই সাতজন নেই, তবুও টেবিলটা আজও আছে।’ কিন্তু শেষ তিনটি লাইন তিনি লিখেছিলেন চেন্নাইয়ে চিকিৎসা করাতে যাওয়ার পথে হাওড়া স্টেশনে বসে একটি সিগারেটের প্যাকেটের উল্টো পিঠে। এক চেনা লোকের মাধ্যমে তা পাঠিয়ে দেন সুপর্ণকান্তির কাছে। তারপর সুপর্ণকান্তির সুরে মুম্বাইয়ে গানটি রেকর্ড করেন মান্না দে। তৈরি হয়ে যায় একটা ইতিহাস।
“সেই সাতজন নেই আজ টেবিলটা তবু আছে সাতটা পেয়ালা আজো খালি নেই,
একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি শুধু সেই সেদিনের মালী নেই,
কত স্বপ্নের রোদ ওঠে এই কফি হাউসে কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়,
কতজন এলো গেলো কতজনই আসবে, কফি হাউসটা শুধু থেকে যায়।”
হাল জামানায় এই কফি হাউসটিকে আরো হৃদয়ের কাছা কাছি নিয়ে আসে প্রখ্যাত সঙ্গিত শিল্পী মান্না দে। তার গাওয়া গান-‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই... আজ আর নেই..............কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেলগুলো সেই, আজ আর নেই...’ যখন থেকে গান ভাল লাগে তখন থেকেই শুনছি গানটা। গানের সুরে মাদকতাতো আছেই, সেই সাথে আছে ইতিহাস, গল্প। গানের চরিত্র বন্ধু নিখিলেশ সন্যাল, সুজাতা, মইদুল, গোয়ানিস ডি সুজা, অমল, রমা রায় নামের কিংবদন্তিরা আজ আর নেই। মান্না দে’ও চলে গেছেন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবরে। গানের অপর এক কিংবদন্তী মইদুল ৭৮ বছর বয়সে ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যান। ইতিহাসের ঐতিহাসিক ব্যক্তিগণ মারা গেলেও ইতিহাস তো মরে না। এখনো ইতিহাসের সাক্ষী হয়েই স্বগৌরবে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে মান্না দে’র বিখ্যাত সেই কফি হাউস।
দোতলায় উঠতে প্রথমে চোখে পড়লো সামনে টানানো ‘কফি হাউস’ সাইনবোর্ডটা। আর দশটা বাঙালি ধাঁচের হোটেল রেস্টুরেন্টের মতোই কলকাতা কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসটি। বিশাল পুরাতন এক হল রুম। পঞ্চাশ-ষাটটার মতো টেবিল সারি সারি সাজানো। বিশেসত্ব হলো টেবিল গুলো খুবই ছোট। ছড়ানো ছিটানো চেয়ার। দেয়ালে সারি সারি সাজানো ভারত বর্ষের বিখ্যাত সব শিল্পীর চিত্রকর্ম তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রকর্মটিই মনে হলো সবচেয়ে বড়। ভিতরে ঢুকে এদিক ওদিক দেখে নিলাম। সব টেবিলই পরিপূর্ণ। ডান কোনের দিকে একটি টেবিল খালি পড়ে আছে। আমাদের দেশে এ ধরনের হোটেলে সাধারণত কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড়ই থাকে বেশি। সেখানে নবীন-প্রবীণদের মিশ্রণে জমজমাট আড্ডা দেখে বেশ ভালোই লাগলো।
ইন্টারনেট ঘাটলে কফি হাউস সম্পর্কে আরো যে তথ্য পাওয়া যায় তা হলো, বাঙালির প্রাণের এ আড্ডাস্থলটির নাম এক সময় কফি হাউস ছিল না। অ্যালবার্ট হল ছিল এর পূর্বনাম। ১৮৭৮ সালের এপ্রিলে তৎকালীন ব্রিটিশ রানী ভিক্টোরিয়ার স্বামী অ্যালবার্টের নামকরণে এটির নাম করণ করা হয়। এরপর কেটে গেছে প্রায় ১৪০ বছর। উপমহাদেশে বৃটিশবিরোধী নানা আন্দোলন-সংগ্রামের অনেক ইতিহাসে জড়িয়ে আছে কফি হাউসটির কোনায় কোনায়। ব্রিটিশ-ভারত বর্ষে এ অঞ্চলের রাজনীতি, শিক্ষা, সাহিত্য ও সাংবাদিকতার আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল ছিল এ কফি হাউস। নকশাল আন্দোলন থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের সূত্রপাতও হয়েছিল এ কফি হাউস থেকেই। মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ বসু, কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায়, সমরেশ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, বাঙালি অভিনেতা রূদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতো কত বিখ্যাত ব্যক্তিরা আড্ডা দিয়েছেন এই কফি হাউসে!
সেই বিখ্যাতদের কাতারে ক্ষণিকের জন্য নিজেদেরকে ভেবে কিঞ্চিত পুলকিতও বোধ করলাম। আমিও আজ সেই কফি হাউসে! চোখের সামনেই যেন এক এক করে ভেসে উঠছিল বিখ্যাত মুখগুলো। হাউসটির চারদিকে সাজানো রয়েছে সেই বিখ্যাত মানুষগুলোর চিত্র। চারদিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গিয়েছিলাম। বিখ্যাত ব্যক্তি সহ সেই সাত জন নেই আজ টেবিলটা পড়ে আছে সাতটি পেয়ালা আজো খালি নেই। একি সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি শুধু সেই সেদিনের মালি নেই!!
আমরা তিন বন্ধু ভিতরে ডান দিকের কোনে একটা টেবিল নিয়ে বসে পড়লাম। হুগলী নদীর তীরে সেই কবে পাকুড়া খেয়েছি তা কি এখনও আছে? হজম হয়ে তা এখন নির্গমনের অপেক্ষায়। চিন্তা করলাম খালি কফিতে হবে না। টেবিলের সামনে মাথায় পাগরী পড়া কোন এক নতুন মালি এসে জানতে চাইলো
-কি নেবেন? সাথে ধরিয়ে দিলেন একটা চার্ট।
চার্টের তালিকার উপরের দিকে পড়ে দেখলাম মাটন হাক্কা চাওমিন, চিকেন হাক্কা চাওমিন সহ আরো অনেক কিছু। ভারী খাবার খাব সিদ্ধান্ত নেয়ায় মাটন হাক্কা চাওমিন অর্ডার দিলাম দুই প্লেট সাথে একটি খালি প্লেট। ওয়েটার ঘুরে এসে জানালো
-শেষ, চাওমিন পাওয়া যাবে না।
এবার পাকুরা বা অন্য কিছু আনতে বলায় ওয়েটার কাউন্টার থেকে ফিরে এসে বলছে,
-স্যার, মাটন হাক্কা চাউমিন হবে, করে দিতে পারবো।
আমরা আর অন্য কোন আইটেম না চিন্তা করে অর্ডার ফাইনাল করলাম। কিছুক্ষণ বসে গল্প আর ছবি তোলার ফাকে চার দিকে চোখ বুলাচ্ছিলাম। যাকে দেখি তাকেই মনে হয় কবি কবি চেহারা। কে যে কবি লেখক আর কে যে পাঠক বা আমাদের মত আগন্তুক দর্শক বোঝা বড় দায়। আমাদের টেবিলের সামনে একটা টেবিল পরে তিন জন মেয়ে ও একজন ছেলে বসে আড্ডা দিচ্ছে। মেয়ে তিনজন দেদারছে সিগারেট টানছে খুব ভাব নিয়ে। ডান পাশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশাল ছবিটার কাছে বসা মেয়েগুলো সিগারেট টানছে তাতেও কোন দোষ নেই, কিন্তু নাক দিয়ে ধুয়াও ছাড়ছে এটাই যা দোষ! মুরাদ মুন্সী দেখে বলে বসলো,
-দেখেন ভাই মেয়েগুলো করছে কি, সিগারেট টানছিস টান, নাক দিয়ে ধুয়া ছেড়ে রং চো... দরকার কি!
বেশিরভাগ টেবিলেই এক বা একাধিক মেয়ে মানুষ বসে আড্ডা দিচ্ছে আর সিগারেটের ধোয়া ছাড়ছে। কফি হাউসের পুরো রুমটা ধুয়ায় ঘোলাটে হয়ে গেছে। চোখ জ্বালা করছে। ওয়েটার আমাদের জন্য মাটন হাক্কা চাওমিন আর খালি প্লেট নিয়ে এসে হাজির। জামাল ভূইয়া খালি প্লেটটা টেনে নিয়ে প্রথমে মুরাদ মুন্সীর সামনে দেওয়া প্লেট থেকে কিছুটা নিয়ে খাওয়া শুরু করে দিলো। আমি আমার প্লেট থেকে কিছুটা তুলে দিলাম। সাথে অর্ডার দিলাম কফি। ওয়েটার ঠান্ডা কফি নিয়ে এলো। খাবারের ফাকে ফাকে কফি খাচ্ছি। ঠান্ডা কফিতো তাই আমার বন্ধুরা জুসের মত স্ট্র দিয়ে এক টানেই মনে হয় শেষ করে দিয়েছে। আমি বললাম,
-অল্প কফি খেতে হয় আর বেশি সময় কাটাতে হয়! তোমরা তো এক টানেই শেষ করে দিলে।
আমি ঠান্ডা কফি শেষ করে বললাম,
-আমি ধুমায়িত কফি খাব।
ঠান্ডা কফিতে কফি হাউসের আড্ডা জমার কথা নয়। আমার ধুমায়িত কফি চাই। ওয়েটারকে ধুমায়িত কফির জন্য বলা হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই টেবিলে চলে এলো এক কাপ ধুমায়িত কফি। জামাল ভূইয়া ও মুরাদ মুন্সী হট কফি নিলো না। অগত্যা আমার ধুমায়িত কফির কাপ হাতে নিয়ে মুরাদ মুন্সী বেশ কয়েকটা ছবি তুললো। জামাল ভূইয়াও বাদ গেলো না।
বেশ কিছুটা সময় কফি হাউসে কাটিয়ে বিল পরিশোধ করে ওয়েটারকে কিছু টিপস দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বেরোতে বেরোতে চিন্তা করলাম ‘কফি হাউসের আড্ডাটা আজও আছে, শুধু মানুষ গুলো বদলে গেছে। হাউসটা ঠিকই আছে বদলায়নি, বদলায় মানুষ, আড্ডায়, চরিত্রে, স্বভাবে, রুচিতে, বয়সে.......











॥ ৯ ॥
তুমি হারিয়ে যাওয়ার সময় আমায় সঙ্গে নিও....
মিলন মামার হারিয়ে যাওয়া

কফি হাউস থেকে বেরোলেই রাস্তার অপর পাশে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির গেইট। গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে ক্যাব ডাকছি কিন্তু খালি ক্যাবগুলি যেতে রাজি হচ্ছে না আবার যাওয়ার মত কোন খালি ক্যাবও পাচ্ছি না। আমরা এখন যাব নিউ মার্কেটে। শরীয়তপুর থেকে বৃহস্পতিবার সকালে রওয়ানা দিয়ে আমি, মুরাদ মুন্সী ও জামাল ভূইয়া আসছি কলকাতা ভ্রমণে। বৃহস্পতিবার রাতের বাসে বেনাপোল এসেছে শরীয়তপুর বারের সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট আসাদ খান মিলন ও এডভোকেট রুহুল আমিন ভাই। সারা রাত বাস জার্নি শেষে সকালে ইমিগ্রেশন পার হয়ে কলকাতায় প্রবেশ করেছে। আসাদ খান মিলন মামা ও রুহুল ভাই শুক্রবার সকালে এসে উঠেছে হোটেল প্যারাডাইস ইন্টারন্যাশনাল গেষ্ট হাউসে। প্যারাডাইস ইন গেষ্ট হাউস নিউ মার্কেট এলাকার মারকুইজ স্ট্রিটে। তারা শরীয়তপুর বসেই রুম বুক করে এসেছিল। ফলে তাদের আর হোটেল খোঁজার ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়নি। রুহুল ভাই বিদেশ ভ্রমণে বেশ অভিজ্ঞ, তাই অভিজ্ঞতার একটা দাম আছে না! কফি হাউসে আসার পথে মিলন মামার ফোন।
-মামা, তোমাদের সাথে কি রুহুল আছে?
আমি বললাম, নাতো মামা, কোন সমস্যা? মামা জানালো,
-আরে রুহুল আমায় নিউমার্কেটের রাস্তায় রেখে কোথায় যেন গেছে, এখন আমি হোটেলের নাম ভুলে গেছি, রাস্তাও ভুলে গেছি। রুহুলকে বার বার ফোন করছি ও ফোনও ধরছে না। তুমি একটা ফোন দিয়ে রুহুলকে বলো আমাকে ফোন করতে।
আমি সাথে সাথে রুহুল ভাইকে ফোন দিলাম কিন্তু রুহুল ভাই আমার ফোনও ধরছে না। রুহুল ভাই হোটেলে ওঠার পর আমার ফেসবুকের স্টেটাসে দেওয়া একটা ছবিতে কমেন্টসে গিয়ে লিখেছিলো যে তারা মারকুইজ স্ট্রিটের প্যারাডাইস ইন হোটেলে উঠেছে। যেহেতু মামা হোটেলের নাম ও রাস্তার নাম ভুলে গেছে তাই আমি তাকে ফোন করে বললাম,
-মামা আপনার হোটেলের নাম প্যারাডাইস ইন, এটা মারকুইজ স্ট্রিটে।
নাম বলায় এবার মামার সব মনে পড়ছে। আমাদের জানালো,
-ওকে, ওকে! আমি এবার যেতে পারবো।
আমি মামাকে বললাম, আমরা কফি হাউসে যাচ্ছি। কফি হাউসের কাছাকাছি চলে এসেছি। আপনি যদি সমস্যা মনে করেন তবে একটা ক্যাব নিয়ে ড্রাইভারকে কলেজ স্ট্রিটের কথা বলে কফি হাউসে চলে আসেন। আমরা পরে আপনাকে পৌছে দেব। মামা আমাদের জানালো,
-কোন সমস্যা নাই। আমি যেতে পারবো।
অভিজ্ঞ রুহুল ভাইয়ের এহেন আচরণে মামা ভীষণ ক্ষুব্ধ! মামা রেগে গিয়ে পরদিনের বাস ধরে বাড়ি চলে যাবে সিদ্ধান্ত নিল! পরে অবশ্য মাথা ঠান্ডা হয়েছে! ভ্রমণ শেষেই কলকাতা ছেড়েছে।
কফি হাউসের আড্ডার ফাকে আবার মামাকে ফোন দিলাম,
-মামা কোন সমস্যা? হোটেল খুজে পেয়েছেন? মামা উত্তরে জানালো,
-কোন সমস্যা নেই, আমি হোটেল খুজে পেয়েছি, এখন হোটেলে এসে বিশ্রাম নিচ্ছি, কোন চিন্তা করো না।
কফি হাউস থেকে বেরিয়ে আমরা চিন্তা করলাম, অপরিচিত জায়গায় এসে মামা হয়তো বিপদেই পড়েছে। হয়তো একাকিত্ব বোধ করছে। আমরা বরং মামার হোটেলে যাই, আমরা গেলে তার হয়তো ভাল লাগবে। কিন্তু প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির সামনের রাস্তায় কোন ক্যাব পাচ্ছি না। আমরা একটু হেটে এগিয়ে মোড়ের দিকে গেলাম। মোড়ে শ্রী নিকেতনের বিশাল দুটি শোরুম। সেই মোড় থেকে একটা ক্যাব নিয়ে রওয়ানা দিলাম নিউমার্কেট এলাকায় মারকুইজ স্ট্রিটের প্যারাডাইস হোটেলে। হোটেলে গিয়ে রিসিপশনে গিয়ে খোঁজ নেব এডভোকেট আসাদ খান মিলন সাহেব কত নাম্বার রুমে আছে? এমন সময় হোটেলের দরজায় এসে দাঁড়ালো বিশাল কার্টন হাতে রুহুল ভাই। আমাদের দেখে বললো,
-আসো, আমাদের রুমতো দোতলায়!
আমরা তার সাথে দোতলায় গিয়ে দরজা নক করলাম। কিন্তু দরজা ভিতর থেকে আটকানো অথচ নক করার পরেও খুলছে না। ভাবলাম মামা কি আবার নিচে গেল? অনেক ক্ষণ দরজায় নক করে অবশেষে ফোন দিলাম আমি। ভিতর থেকে ফোন রিসিভ করে মামা বলছে,
-হোটেলের দোতলায় আসো।
আমরা তার কথা দরজার এপাশ থেকে শুনতে পাচ্ছি কিন্তু মামা বলেই যাচ্ছে,
-আমি রুমে আছি, তোমরা দোতলায় চলে আসো।
আবার দরজা নক করে বললাম আমরা আপনার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে। মামা এবার বললো,
-ওহ! দাঁড়াও, খুলছি।
আমরা ভিতরে প্রবেশ করে বুঝলাম, ক্লান্ত শরীরে মামার হালকা নিদ্রা ভাব চলে এসেছিল। তাই সে দরজা নকের শব্দ শুনতে পায়নি। আমাদের বসতে দিয়ে মামা পাকা আম দিয়ে আপ্যায়ন করলো। আম খেয়ে পাঁচ জনই বেরিয়ে পড়লাম রাতের খাবার খেতে। মারকুইজ স্ট্রিটের রাস্তায় হাটতে হাটতে রাস্তার শেষের দিকে একটা হোটেলে ঢুকে দোতলায় গিয়ে কোনের সিটে সবাই বসলাম। বেয়ারাকে আমাদের জন্য ভাত, ভর্তা, ভাজি, মাছ অর্ডার দিয়ে মামা নিলো দুটি রুটি ও সবজি। রাতের খাবারটা আমাদের সিনিয়রই খাওয়ালো। আমরা বিল দিতে চাইলে একটা ধমক দিয়ে মামা বিল পরিশোধ করলো। হোটেল থেকে বেরিয়ে আমরা একটি ক্যাব ধরে আবার ফিরে এলাম মৌলালি স্ট্রিটে আমাদের হোটেলে। হোটেলের সামনে নেমে ভিতরে না ঢুকে চলে গেলাম পুলিশ বক্সের কাছে। আমাদের রুম যেহেতু চার তলায় তাই একবার হোটেলে উঠলে আর বের হওয়া হবে না। তাই চা খেয়ে উপরে উঠবো সিদ্ধান্ত নিলাম। যেই ভাবা সেই কাজ, আগের সেই দোকানটায় গিয়ে আমি আর জামাল ভূইয়া চা খেয়ে হোটেলে চলে এলাম। মুরাদ অবশ্য চা খেলনা, একে তো চিনি ছাড়া চা দিতে পারবে না তার উপরে চা খায়ও কম। আমাদের আবার অক্সিজেন গ্রহণের মত কিছুক্ষণ পর পর চা’টা না হলে হয় না।
হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে সবাই লেগে গেলাম ফেসবুকে দিনের কর্মসূচী বর্ণনায়, আগের কর্মসূচীর প্রতিক্রিয়া দেখতে নোটিফিকেশন চেক করায়। আমাদের হোটেলে ছিল ফ্রি ওয়াইফাই সার্ভিস। হোটেলে ঢুকেই আমার নজরে পরেছে বিষয়টা। হোটেলের ম্যানেজারকে বলার সাথে সাথে আমাদের পাসওয়ার্ড বলে দিলো। আমরা যার যার মোবাইলে ওয়াইফাই কানেক্ট করে নিয়েছি। কিছুক্ষণ এক রুমে তিন জন তিনজনের কাজে লেগে গেলাম। এক রুমে থেকেও মনে হলো ভিন্ন ভিন্ন রুমে আমরা! কেউ কারো সাথে কোন কথা নেই! ভ্রমণের আনন্দ, ত্র“টি বিচ্যুতি, সুবিধা, অসুবিধা নানা বিষয় থাকলেও কারো সাথে কোন বিষয় নিয়ে কোন আলোচনা নাই।
কিছুক্ষণ ফেসবুক নিয়ে ঘাটাঘাটি করার পর আগামী সকাল শনিবার নিয়ে আলোচনায় বসলাম। আমার আর মুরাদ মুন্সীর আগ্রহ শান্তি নিকেতনে যাওয়ার, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখার। কিন্তু জামাল ভূইয়া বাধ সাধলো। দুরত্ব বিবেচনায় জামাল ভূইয়া বললো, সকালে গিয়ে আমরা বিকালে আসতে পারবো না, তার পর কেনাকাটা আছে, তাই আমি শান্তি নিকেতনে যাওয়ার পক্ষে নাই। জামাল ভূইয়া ভাবির জন্য কেনাকাটা করবে, ছেলে মেয়ের জন্য কেনাকাটা করবে। গৃহে শান্তি বজায় রাখাটা তার কাছে বেশি গুরুত্ব পেল, শান্তি নিকেতন ভ্রমণ নয়। শান্তি নিকেতন শিল্প সাহিত্য প্রেমি বাঙ্গালীর জন্য এক তীর্থ স্থান। কিন্তু জামাল ভূইয়ার কাছে শিল্পর চাইতে শিল্পী বেগমই বেশি আগ্রহের মনে হল!
তিন জন এক সাথে এসেছি, একজন যাবে না দুজন যাবে সেটা হতে পারে না। তাতে ভ্রমণের আনন্দে ব্যত্যয় ঘটবে। অবশেষে শান্তি নিকেতন যাওয়ার পরিকল্পনা বিরস বদনে বাতিল করা হলো। সবকিছু বাদ দিয়ে ঘুমের মধ্যে শান্তি খোজার চেষ্টায় ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম আমরা। 








॥ ১০ ॥
কলকাতা হাইকোর্ট, কলকাতা সিটি বার
ভ্রমণ ও নিউ মার্কেটে কেনাকাটাঃ

শনিবার সকাল। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে পরিকল্পনা শুরু কোথায় যাওয়া যায়। সিদ্ধান্ত হলো আজ প্রথমেই যাব ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গে, তারপর ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে, তারপর কলকাতা হইকোর্ট ঘুরে নিউ মার্কেটে কেনাকাটা সারা। কারন, রবিবার সকালে দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেব। তাই কোন কাজ বাকি রাখা যাবে না। আজকের দিনটাই শুধু আমাদের হাতে আছে। সকাল থেকে রাত অবধি যা কিছু করার করতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ, সকাল সকাল রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলাম রুম থেকে। নিচে নেমে হোটেলের ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলাম
-ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গে যাব কিভাবে?
ম্যানেজার জানালো, ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গে যেতে পারবেন না। ওটা আর্মি এড়িয়া। সাধারণ কাউকে যেতে দেয়া হয় না। আপনারা যদি আর্মি পারসন হন বা কেউ পরিচিত থাকে তবে ঢুকতে পারবেন। আমরা যেহেতু আর্মি পারসন নই বা আমাদের কোন আর্মি পারসন পরিচিত নেই সেহেতু ফোর্ট ইউলিয়াম দূর্গে যাওয়া হবে না তাই জানতে চাইলাম আর কি কি দর্শনীয় স্থান আছে। আমাদের জানালো কলকাতা মিউজিয়াম দেখতে পারেন। আমাদের পরিকল্পনায় কলকাতা মিউজিয়াম ছিল না। আমরা যেহেতু উকিল মানুষ তাই আমাদের অপর তীর্থস্থান কলকাতা হাইকোর্ট, বার এসোসিয়েশন ঘুরবো। তাই সিদ্ধান্ত হলো আগে নাস্তা করবো। গতকাল সকালের মতই আমরা সেই ফুটপাতের সেই দোকানেই গেলাম। আজ আর বলতে হলো না দাদা একছো না দেড়ছো দেব? আজ দোকানি বেশ সমাদর করে বসতে দিলো এবং বললো,
-দাদা দেড়ছো করে দেই?
আমরা দেড়ছোর সাথে ডিম চাইলাম। আমাদের ডিম অমলেট করে দিলো। অর্ধেকটা নয় পুরোটা ডিমের পুরোটাই খেয়ে আগের দিনের মত পাশের দোকান থেকে পানি কিনে চায়ের দোকানে গেলাম। আমাদের জিজ্ঞেস করলো
-দাদা ছোট না বড়।
আমরা বড় বলায় মাটির তিন পেয়ালা বড় চা দিলো। খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ট্যাক্সির খোঁজে রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ালাম। একটু দাড়াতেই একাধিক ক্যাব পেয়ে গেলাম। দরদাম করে রিক্সা ভাড়ার পরিমান টাকার বিনিময়ে ক্যাব নিলাম যাদুঘরে যাওয়ার জন্য। গল্প করতে করতে ক্যাব পৌছে গেল যাদুঘরের সামনে। ভাড়া মিটিয়ে ভারতীয় সংগ্রাহালয়ের সামনে আমরা কিছু ফটো সেসন করে জামাল ভূইয়া গেল প্রবেশের টিকিট কিনতে। গিয়ে দেখে ভারতীয়দের জন্য টিকিট মাত্র পঞ্চাশ টাকা আর ফরেইনারদের জন্য পাঁচশত টাকা অর্থাৎ পাঁচশত রুপি। বিষয়টা আমাদের কাছে একটু বৈষম্য মনে হলো। এতটা গলাকাটা দাম দিতে হবে? আমরা পর্যটক, ভারতীয়দের জন্য যদি টিকিট হয় পঞ্চাশ টাকা তবে আমাদের জন্য হওয়া উচিত ত্রিশ টাকা। আমরা অতিথি, অতিথির সাথে এতটা বৈষম্য দেখে অবাক হলাম। চিন্তা করলাম, একটা মিউজিয়াম প্রদর্শন করতে সারা দিন লেগে যাবে যদি ভাল ভাবে দেখতে চাই। আমাদের যেহেতু অনেক কাজ, আর আজকের দিনটাই হাতে আছে, সেক্ষেত্রে এতটা সময় সংগ্রাহালয়ে দেয়া যাবে না। তাই পনেরশ টাকা খরচ করে মিউজিয়ামে সময় কাটানো ঠিক হবে না। তিনজনই সিদ্ধান্ত নিলাম সংগ্রাহালয় পরিদর্শন বাতিল।
তাহলে এবার পরের প্রজেক্ট! আবার ক্যাব নিলাম কলকাতা হাইকোর্ট যাওয়ার জন্য। কলকাতা হাইকোর্ট যাওয়ার পথে ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গের গেটের সামনে সিগনালে আমাদের ক্যাব থামলো। আমরা দূরথেকে ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ অনুভব করে ছুটতে থাকলাম কলকাতা হইকোর্টের দিকে। পথিমধ্যে অনেক কিছু দেখলাম যার ভিতর হৃদয়ে দাগ কাটলো গান্ধীজীর স্বল্প বসনা ভাস্কর্য। গান্ধীজী লাঠি হাতে হাটার ভঙ্গিমায় ভাস্কর্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লক্ষনীয় বিষয় কোন ভাস্কর্যের পাদদেশ বা স্থাপনার দেয়ালে কোন পোষ্টার লাগানো নেই। আমাদের দেশে হলে প্রতিটা ভাস্কর্যের বা শিল্প কর্মের পাদদেশে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের পোষ্টার, নেতাকে তেলিয়ে পাতি নেতার পোষ্টার বা কোন হারবাল চিকিৎসালয়ের রগরগে পোষ্টারে মোড়ানো থাকতো। সান্ডার তেল বিক্রি বা মোটাকে চিকন, চিকনকে মোটা, বাকাকে সোজা করার শতভাগ নিশ্চয়তা সহ বিজ্ঞাপনের পোষ্টারে ঢাকা থাকতো। এখানে সেটা চোখে পড়লো না। সারা শহরে কোথাও ব্যানার বা ফেস্টুন দেখলাম না। আমাদের দেশে নেতার ছোট একটি ছবি দিয়ে চামচার বিশাল ছবিওয়ালা ব্যানার ফেস্টুন থাকে রাস্তার মোড়ে মোড়ে। ব্যানারে নেতাকে গুরুত্ব কম দিলেও নেতার তা বোঝার মত জ্ঞান খুব কমই আছে। তাছাড়া গাছে উঠতে না পারলে আমাদের দেশে কেউ নেতা হতে পারে না। পাতি নেতারা গাছের সাথে নিজেকে পেরেক মেরে দেখায় তারা কত বড় যিশু। এখানে হাতে গোনা দু’একটা ব্যানার দেখলাম তাও শুধু মমতা ব্যানার্জীর ছবিওয়ালা। শহরটা গাছে ভরা, কিন্তু কোন গাছে কোন পেরেক মারা নাই, সুতলি দিয়ে কোন ব্যানার টানানো নাই। গাছগুলো স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে অক্সিজেন ছাড়ছে মানুষের জন্য। দেখতে দেখতে আমরা পৌছে গেলাম কলকাতা হাইকোর্টে।

কলকাতা হাইকোর্ট :
কলকাতা উচ্চাদালত বা কলকাতা হাইকোর্ট ভারতের প্রাচীনতম হাইকোর্ট। ১৮৬১ সালের হাইকোর্ট আইন বলে ১৮৬২ সালের ১ জুলাই কলকাতা হাইকোর্ট স্থাপিত হয়। সেই সময় এই হাইকোর্টের নাম ছিল হাই কোর্ট অফ জুডিকেচার অ্যাট ফোর্ট উইলিয়াম। বর্তমানে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ কলকাতা হাইকোর্টের অধিক্ষেত্রের অন্তর্গত। আন্দামান ও নিকোবরের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ারে কলকাতা হাইকোর্টের একটি সার্কিট বেঞ্চ আছে। কলকাতা শহরের সাম্মানিক নাগরিক শেরিফের ঐতিহ্যশালী দপ্তরটি এই আদালতের ভেতরে অবস্থিত।
স্থাপত্য শৈলীঃ হাইকোর্ট ভবনটি ইউরোপীয় গঠন শৈলীর গথিক স্থাপত্যবিশিষ্ট বেলজিয়ামের ইপ্রেস ক্লথ হলের আদলে নির্মিত। উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ক্লথ হল ক্ষতিগ্রস্থ হলে সেটি পুনর্নিমানের জন্য ওই শহরের মেয়র কলকাতা থেকে এক সেট প্ল্যান চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। ১৮৬৪ সালের মার্চ মাসে ভবনটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। নির্মাণকার্য শেষ হতে সময় লেগেছিল আট বছর। এই ভবনে একটি ১৮০ ফুট উঁচু টাওয়ার আছে। হাইকোর্ট ভবনের নঁকশাটি বেশ জটিল। এই প্রসঙ্গে রথীন মিত্র লিখেছেন, ‘একটা চতুষ্কোণীর চারধারে অবস্থিত একটি আয়তাকার স্থাপত্য। ভেতরে অনেকগুলি বিচার কক্ষ, অন্যান্য ঘর। ছাদের সঙ্গে লোহার একটি সুন্দর গম্বুজ আছে, যা ভেতরের গরম হাওয়া টেনে বের করে নিয়ে বাহিরে পাঠিয়ে দিতে পারে। বাড়ির ভেতরের বাতাস হয়ে যায় নির্মল ঠান্ডা। চারিদিকে সুন্দর বাগান, ফোয়ারা।
পরবর্তী পর্যায়ে স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে উত্তর দিকে নতুন করে এর সংলগ্ন আরও একটি ভবন নির্মাণ করা হয় এবং পরবর্তী ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ দিকে হাইকোর্ট ভবনের বর্তমান স্থাপত্যের সঙ্গে সমতা রেখে আর একটি নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। চতুর্ভুজাকার এই হাইকোর্ট ভবন দৈর্ঘ্যে ৪২০ ফুট এবং প্রস্থে ৩০০ ফুট।
বিচারপতিগণঃ ১৮৭২ সালে স্যার বার্নেস পিকক কলকাতা হাইকোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন। হাইকোর্টের প্রথম ভারতীয় বিচারক ছিলেন শম্ভুনাথ পন্ডিত। হাইকোর্টের প্রথম ভারতীয় প্রধান বিচারপতি ছিলেন রমেশচন্দ্র মিত্র এবং প্রথম পূর্ণ মেয়াদের ভারতীয় প্রধান বিচারপতি ছিলেন ফণীভূষণ চক্রবর্তী। হাইকোর্টের দীর্ঘতম মেয়াদের প্রধান বিচারপতি ছিলেন শংকরপ্রসাদ মিত্র।
কলকাতা হাইকোর্টের বাম দিকের সড়কে গাড়ি থামিয়ে দিলে আমরা নেমে এদিক ওদিক দেখতে লাগলাম। শনিবার বন্ধ ছিল কোর্ট। ফলে কোন মক্কেলের আনাগোনা তেমন চোখে পড়লো না। আর আইনজীবীদের চেম্বারও তেমন একটা দেখলাম না। রাস্তার পাশের বিল্ডিংয়ে নোটারী পাবলিকের দু’একটা অফিস চোখে পড়লো। আমরা বার এসোসিয়েশন কোথায় জানতে চাইলে সিটি বার দেখিয়ে দিলো একজন। হাটতে হাটতে কলকাতা সিটি বার এসোসিয়েশন এর সামনে গেলাম। একটা ভবনের নিচতলায় এক রুমের বার এসোসিয়েশন রুম। ভিতরে প্রবেশ করে দেখা হলো এক শুকনা ভদ্রলোকের সাথে। জামাল ভূইয়া পরিচয় দিলো, আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি, আমরা সবাই এডভোকেট। আমাদের পরিচয় পেয়েও তার মধ্যে তেমন কোন ভাবলেশ নেই। ভিতরে রুমের পিছন দিকে আরো কয়েকজন আইনজীবী বসে গল্প করছে। আমাদের সাথে দায়সারা কিছু কথা বলার পর মনে হচ্ছে এই লোক সামাজিকতা বুঝে না। আমরা বার থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক একটু ঘুরে কলকাতা হাইকোর্টের সামনের দিকে চলে এলাম। সিনেমায় হাইকোর্টের যে চিত্র দেখায় সেই সামনের অংশের বর্ণনা আমার ভাষায় আসে না। হাইকোর্টের সামনে আসার আগে আমরা রাস্তার ধারে মাটির ভারে চা খেলাম। রাস্তার ধারে ধারে আমাদের দেশে যেমন লাল সালু কাপড় মোড়ানো তামারি থাকে, মাজারের নামে টাকা তোলার জন্য, এখানেও ছোট ছোট মন্দির আছে। এক লোক কালো লেংটি পড়ে ফুটপাতের পানির কল থেকে একটা বালতি ভরে গোসল সারলো। তারপর একবালতি পানি নিয়ে ছোট একটা বটগাছের নিচে স্থাপিত ছোট মন্দিরে পানি ছিটিয়ে প্রণাম করলো। লোকটি যে লেংটি পরেছে আমার মনে হলো ওটা পরা আর না পরা একই কথা। তারপরও তার ভক্তি দেখে আমার দেশের সাথে কিছু মিল পেলাম। ঢাকা হইকোর্টের মাজারে এমন ভক্ত অনেক দেখা যায়, সারা সপ্তাহ গোসল করে না, সারাদিন গাঁজা টানে তারপরও তাদের মধ্যে পীরের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা অঢেল।
আমরা ফুটপাত ধরে একটু এগিয়ে গেলেই কলকাতা হাইকোর্টের সামনের অংশ। হাইকোর্টের সামনে বিশাল বিশাল বটবৃক্ষ। পাখির কলকাকলিতে মুখরিত এলাকাটা। বটগাছগুলোর মধ্যে কয়েকটার গোড়ায় পাকা করে বসার স্থান করে দিয়েছে সরকার। আমরা বসতে চাইলেও উপরের পাখিগুলোর আচরণ ভাল মনে হলো না। টুপ টাপ ঝরাচ্ছে। নিচের ফুটপাত সাদা করে ফেলেছে, কলকাতা হাইকোর্ট এলাকার পাখিরা কি চুন খায়!
আমরা হাইকোর্টের সামনে স্থাপিত বিপ্লবী সূর্য্য সেন (মাষ্টারদা) এর বিশাল এক ভাস্কর্য দেখে দাঁড়ালাম। আমাদের দেশ হলে এই মূর্তি এতদিন দাঁড়িয়ে থাকতো না। হেফাজত সরকারের সাথে আলাপ আলোচনা করে মূর্তির হেফাজত করে ফেলতো। কিন্তু কলকাতায় সমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে সূর্য্য সেনের ভাস্কর্য। আমরা মাষ্টারদা সূর্য্য সেনের সাথে বেশ কিছু ছবি তুললাম। কলকাতা হাইকোর্টকে পিছনে রেখে ফটো সেসনে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমি তুলি মুরাদ মুন্সীর ছবি আবার মুরাদ মুন্সী তোলে আমার ছবি। বলে রাখা ভাল, মুরাদ মুন্সী আবার ফটোগ্রাফির উপর বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। তাই মুরাদ মুন্সীকে দিয়ে ছবি তোলার আগ্রহটা আমার একটু বেশি। জামাল ভূইয়া একাই সেল্ফি তুলে যাচ্ছে। সেখানে আরেক বিদেশী এসে কিছু ছবি তুললো। সে যে বিদেশী তা বোঝার জন্য তার পাসপোর্ট দেখতে হয়নি! সাদা চামরার লোক। আমাদের দেখে সে একটু মুচকি হেসে হাই হ্যালো করলো। আমরাও স্বভাব সুলভ ভাবে তার সাথে হাই হ্যালো বিনিময় করলাম।
জামাল ভূইয়া যেহেতু আমাদের কলকাতা ভ্রমণের টিম লিডার তাই এরই মধ্যে সে একটা ট্যাক্সী ক্যাব ঠিক করে ফেলেছে। আমরা ক্যাবে উঠে নিউ মার্কেটের দিকে রওয়ানা দিলাম। কলকাতা ভ্রমণে একমাত্র মুসলিম ক্যাব ড্রাইভার পেলাম। ড্রাইভার বুঝতে পারলো আমরা বাঙ্গালী এবং মুসলমান। সে আমাদের সাথে গল্প জমিয়ে দিলো। কিভাবে ভারতে ইসলাম প্রচার শুরু হয়, কত কন্টকময় পথ ছিল এখানে ইসলাম প্রচার করা এবং প্রসার ঘটানো। বহু মানুষের প্রাণের বিনিময়ে ভারতবর্ষে ইসলাম টিকে আছে সেই বয়ান করছে আর গাড়ি চালাচ্ছে। ড্রাইভার সাহেব আবার পীর মুরশিদের ভক্ত। আমাদের সাথেও এক ভক্ত আছে। এডভোকেট জামাল ভূইয়া মাইজ ভান্ডারীর মুরিদ। পীরের আরেক ভক্ত পেয়ে জামাল ভূইয়া তো বেশ পুলকিত! জমিয়ে দিলো দুজনে। আমি আর মুরাদ মুন্সী তাদের দুজনের কথার ফাকে ফাকে সুর মিলিয়ে আবার নজর ফিরিয়ে নিচ্ছি বাইরের দিকে। আমাদের আগ্রহ সৌন্দর্যের দিকে। দুজনেই কলকাতা শহরের ফুটপাতে সৌন্দর্য খুঁজে বেরাই। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ফুটপাত, গাছপালা, ভাস্কর্য, ফুটপাতে পশু-পাখি, দাড়ানো নর-নারী কিছুই বাদ যাচ্ছে না। যা দেখছি তাতেই মুগ্ধ হচ্ছি। চলতে চলতে জামাল ভূইয়া ড্রাইভারকে একটা গানও শুনিয়ে দিলো। ‘একদিন আমার বড় পীরে ডাকিয়া কয় খাজারে... আমার পিছে নামাজ পরবে যেইজনা যেইজনা ॥ ফজরেরও নামাজ যেইজন, আদায় করিবে সেইজন, বিনা হিসাবে বেহেশত বাসি বলছে রব্বানা।’ সাথে যেহেতু আছি, আমরাও বাদ পড়লাম না, শুনে ফেললাম গানটা। জামাল ভূইয়ার গানের গলা প্রশংসা পাবার মত না হলেও বেশ ভালই গাইলো। গান শেষ হতে না হতেই আমরা পৌছে গেলাম নিউ মার্কেটের সামনে। আবারও সেই একই অবস্থা, নিউ মার্কেট যে কোনটা বোঝা বড় দায়, সবগুলোই কি নিউ মার্কেট!
একটা মার্কেটের সামনে নেমে ড্রাইভারকে বকসিস সহ ভাড়া মিটিয়ে ঢুকলাম মার্কেটের ভিতরে। অনেকক্ষণ হাটাহাটি করলাম মার্কেটের ভিতরে। কলকাতা এসেছি, কিছু কিনে নিয়ে যাব না এটা কি হয়। যদিও আমি ভ্রমণে বের হলে কেনাকাটার পক্ষে নাই। ভ্রমণ করতে এসেছি শপিং করতে নয়। কেনাকাটা করে যদি সময় ও পয়সা নষ্ট করি তবে ভ্রমণের আনন্দ থাকে না। তার উপর আমার স্থুলকায় দেহ। নিজের শরীর নিয়েই নিজে চলতে পারি না, তার উপর যদি কেনাকাটা করি তবে ব্যাগের ওজন বাড়বে। ব্যাগের ওজন বাড়া মানে শরীরের ওজন বাড়া। আমি ব্যাগ টানাটানির পক্ষে নাই। তবুও সবাই দেখি কেনাকাটা নিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে গেল। আমিও ওদের সাথে কয়েকটা জয়পুরি থ্রিপিছ কিনলাম। বাড়িতে নিজের বউ আছে, ভাইয়ের বউ, দুটি বোন। তাদের জন্যই শুধু কিনলাম। নিজের কন্যার জন্য ও বাবার জন্য কিনলাম শুধু চকলেট আর পঙ্গু বা প্রতিবন্ধী আম মানে ল্যাংড়া আম। আমি অবশ্য মেয়ের জন্য একটা ড্রেস পছন্দ করেছিলাম। কিন্তু মেয়ের সাইজে পেলাম না। দামও ছিলো ভালো, কিন্তু আমার কলিজার টুকরা মেয়ের জন্য পছন্দের জামাটার কাছে দাম কোন বিষয়ই না। জামাল ভূইয়া ঈদের কেনাকাটা সেরে ফেললো। বউয়ের জন্য, পুত্র-কন্যার জন্য নিজের জন্য, মা-শাশুরির জন্য কেনাকাটা করলো। কারো জন্যই বাদ রাখলো না। মুরাদ মুন্সীও বউয়ের জন্য কিছু কেনাকাটা করলো। তবে নিজেদের জন্য সবাই কিনলাম।
আমি শ্রী লেদার থেকে নিজের জন্য জুতা, স্যান্ডেল, ভ্রমণের সময় পাসপোর্ট, মোবাইল, টাকা পয়সা রাখার মত লেদারের সাইট ব্যাগ কিনলাম। মেয়ের জন্য একটা সুন্দর জামা পছন্দ হলেও সাইজের জন্য কিনতে পারলাম না। আমার মেয়ের বয়স মাত্র আড়াই বছর, কিন্তু যা পছন্দ হয়েছে তা চার থেকে পাঁচ বছরের মেয়েদের জন্য। তাই মনটা একটু খারাপই হল।
আমার আর মুরাদ মুন্সীর কেনাকাটা সহজেই শেষ হলো কিন্তু জামাল ভূইয়ার কেনাকাটা তো আর শেষ হয় না। আমরা দুজন জামাল ভূইয়াকে মার্কেটের ভেতরে রেখে বাইরে চলে এলাম। মার্কেটের ভিতরে বেশ গরম। বাইরে একটু হাওয়া বাতাশ চলাচল করে তাই বাইরে এসে অপেক্ষা করছি আর কেনাকাটার চাইতে মার্কেট ও মার্কেটে আগতদের দেখাটাই বেশ উপভোগ্য মনে হলো। তাই আমি আর মুরাদ মুন্সী মার্কেটের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে মানুষ দেখছি!
জামাল ভূইয়ারও কেনাকাটা শেষ হলো। বেরিয়ে এলে এবার পেটের কামড়ানি অনুভব করলাম। অনেকক্ষণ হাটাহাটির পর ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত বোধ করছিলাম। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম বাংলা খাবারের হোটেল কোথায় আছে। সবাই গলি দেখিয়ে দিলো। আমরা গলি দিয়ে হাটতে হাটতে কোনের দিকে একটা হোটেল দেখতে পেলাম। শো-কেসে খাবার সাজিয়ে রেখেছে। ভেন্ডি ভাজি বা ডেঢ়স ভাজি, কড়লা ভাজি, বিভিন্ন ভর্তা, মোড়গের মাংস, মাছ দেখে খিদেটা ঝিলিক মেরে উঠলো। ভর্তা-ভাজি দেখে আমরা ঢুকে গেলাম হোটেলে। মুসলিম হোটেল। ছোট পরিসরে হোটেলটি। ঢোকার দরজার কাছেই বেসিন দেয়া। আমরা ব্যাগগুলো চেয়ারে রেখে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। এরপর খাবার অর্ডার দিলাম। আমাদের সাদা ভাত আর বিভিন্ন ভর্তা, মাছ, মোড়গের মাংস দিল। খাওয়া শেষে হাত মুখ ধুয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুললাম। এখানকার ভাতগুলো বেশ ভাল। বাশমতি চালের ভাত। দেখতে মনে হয় নুডুলস ছোট ছোট করে ভেঙ্গে শিদ্ধ করা। ভাতের ঘ্রাণটাও বেশ মম করে। খাওয়া দাওয়া শেষে বেরিয়ে দেখি রাস্তার ধারে চকোলেটসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করছে। আমরা দোকানটা থেকে চকলেট নিলাম। জামাল ভূইয়া জিরা কিনলো এক কেজি। এখানে জিরার কেজি মাত্র দুইশ টাকা। তাকে দেখে আমিও নিলাম। আমাদের দেশে জিরার দাম আকাশ ছোয়া। এখানে পানির দামে বিক্রি হচ্ছে। কেনাকাটা শেষে রাস্তায় দাঁড়াতেই একটা ক্যাব পেলাম। বেশি দরদাম করতে হলো না। এখানে একটা কথা না বললেই নয়, কলকাতায় কিছু ক্যাবের গায়ে লেখা রয়েছে নো রিফিউজাল। কিন্তু বেশিরভাগ ক্যাবই আপনাকে রিফিউজ করবে। আবার মিটারে যেতেও অনিহা দেখায়। একটু বাড়িয়ে দিলেই যেতে রাজি হয়। তবে বাড়িয়ে দেয়ার পরিমানটা খুব একটা বেশি নয়। গা সওয়া বলে আমরা বাড়িয়ে দিতে কার্পণ্য করিনি কখনো। ক্যাব নিয়ে ছুটে চললাম মৌলালি এজেসি বোস রোড হোটেল প্লানেট ইন্টারন্যাশনাল গেষ্ট হাউস। হোটেলে উঠেই ফ্রেশ হওয়ার পালা। পালাক্রমে তিনজন বাথরুমে ফ্রেশ হয়ে একটু বিশ্রাম। সেই ফাকে চলতে থাকে সারাদিনের ছবি আদান প্রদান। শেয়ারইট নামে একটা এ্যাপস আছে যা যাদুকরী কাজ করে। ছবি শেয়ারের পর চলতে থাকে ফেসবুকে পোষ্ট দেয়া। কিছুক্ষণ এভাবে চলতে থাকলো। এর পর একে একে রেডি হয়ে গেলাম বেরিয়ে পড়ার জন্য। আজ শনিবার। আজকের দিনটিই আছে হাতে। যা করার, যা ঘোরার আজকেই সারতে হবে।



















॥ ১১ ॥
বেগম রোকেয়া স্মৃতি স্তম্ভ, সাইন্স সিটি,
হলে গিয়ে সিনেমা দেখা

বিকালে হোটেল থেকে বেরিয়ে ক্যাবের জন্য অপেক্ষা। কোন ক্যাব আসছে না দেখে হোটেলের সামনের রাস্তা দিয়ে পশ্চিম দিকে কিছুটা হেটে গেলাম ক্যাবের আশায়। সামনে কিছু ক্যাব দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভাবলাম দাঁড়িয়ে না থেকে এগিয়ে গিয়ে ক্যাব নেই। কিছুদূর হাটতে হাটতে পা থমকে গেল। কারন আর কিছুই না, একটা স্মৃতি স্তম্ভ দেখে আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম। একটা ভবনের পাশে ফুটপাতে বিশাল এক মিনার। রোকেয়া মিনার। মিনারে লেখা আছে
‘নারীমুক্তি আন্দোলনের দিশারী সাহিত্যিক শিক্ষাব্রতী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। ১৬২/১ আচার্য জগদীশ চন্দ্র রোড (সাবেক ১৬২ লোয়ার সারকুলার রোড) স্থিত বাসভবনে প্রয়াত হন ৯ ডিসেম্বর ১৯৩২ সনে।
তিনি বঙ্গ বাসীকে ডাক দিয়েছিলেন
‘জাগো বঙ্গবাসী, দেখ কে দুয়ারে, অতি ধীরে ধীরে করো করাঘাত।’
আমরা দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দেখলাম বেগম রোকেয়ার স্মৃতি স্তম্ভ-‘রোকেয়া মিনার’। বাঙ্গালী নারী জাগরণের পথিকৃত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত এই বাড়িতে শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করেছেন, তাঁর সম্মানে এখানে স্মৃতি স্তম্ভ করা হয়েছে অথচ তা চোখে পড়লো বিদায় বেলায়। আমরা কয়েকটা ছবি তুললাম মিনার নিয়ে। কলকাতায় বাঙ্গালী নারীর প্রতি সম্মান দেখিয়ে, শ্রদ্ধা দেখিয়ে স্মৃতি স্তম্ভ করেছে, বাংলাদেশ থেকে এসে, দেখার পর দু’দন্ড দাড়াবো না তা কি হয়! এর পর আমরা একটা ক্যাব নিলাম সাইন্স সিটি যাওয়ার জন্য। কলকাতায় দর্শনীয় স্থান লিখে গুগলে সার্চ দিলে যে কয়টা স্থানের নাম আসে তার মধ্যে সাইন্স সিটি অন্যতম। আমাদের নিয়ে ক্যাব ছুটে চলছে। অবাক করার বিষয় একটার পর একটা ফ্লাই ওভার পার হচ্ছি কিন্তু কোন পয়সা নিচ্ছে না। টোল ফ্রি ফ্লাই ওভার, এটা ভাবা যায়? অথচ বাংলাদেশে একটা ফ্লাই ওভার পার হলে ইজারাদার পারলে দুইবার টোল নিতে চায় আর এখানে কোন টোল লাগলো না। আমরা কিছুক্ষণ পর পৌছে গেলাম সাইন্স সিটিতে। সাইন্স সিটির গেটে নেমে ভাবলাম কতক্ষণ লাগে সাইন্স সিটি ঘুরতে তাই একটু চা খেয়ে নেই। গেটের পাশে অল্প কয়েকটা খাবারের ভ্রাম্যমান দোকান। কিন্তু কোন দোকানেই চা পেলাম না। অবশেষে আমরা লেবু স্তুপ করা একটা দোকানের সামনে গিয়ে লেবুর সরবত দিতে বললাম দোকানিকে।
এখানে লেবুর সরবত নিয়েও কিছু বলার মত বিষয় আছে। সরবত বানাচ্ছে সেটাও যেন একটা শিল্প। লেবু কেটে হাত মেশিনে চেপে রস বের করে রাখলো গ্লাসে। এর পর কিছু বিট লবন, অল্প চিনি, কিছু মসলা, ঠান্ডা সোডা ওয়াটার মিশিয়ে দিলো। চুমুক দিয়েই অন্য এক জগতে প্রবেশ করলাম। ঠান্ডা শীতলতায় হৃদয় জুড়িয়ে গেল। কলকাতায় প্রচন্ড গরম অনুভব করছিলাম। এক গ্লাস লেবু সরবত এতটা প্রশান্তি এনে দিলো যা ভাবার নয়। সরবত শেষ হতে না হতে মুরাদ মুন্সীর নজরে পড়লো কাচা ছোলা। কাচা ছোলা অর্ডার দিতেই দোকানদার বানানো শুরু করলো। কিছু কাচা ছোলা, পিয়াচ কুচি, কাচা লঙ্কা, সিদ্ধ আলু, কিছু মসলা আর তেতুলের টক মিশিয়ে কাগজে দিলো। তিনজনেই বেশ আয়েশ করে ছোলা খেয়ে সাইন্স সিটির প্রবেশ দ্বার পার হলাম। মনোরম পরিবেশে সুন্দর সাজানো গুছানো। ছোট ছোট বাহারি গাছ এমন ভাবে ছেটে রেখেছে মনে হচ্ছে সবুজ কার্পেটের নিপুন কারুকাজ। পায়ে হাটা রাস্তার পাশে বড় বড় গাছ থাকলেও রাস্তায় একটা ঝড়া পাতাও পাওয়া যাবে না। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন পায়ে হাটা রাস্তা দিয়ে মূল গেটের কাছে গেলাম। দেশিয় প্রযুক্তির মাধ্যমে সুন্দর ফোয়ারা করেছে দেখার মত।
জামাল ভূইয়া তিনটি টিকিট কিনলো। আমরা ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখা হয়ে গেল কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের থ্রিডি ভাস্কর্যের সাথে। বিভিন্ন এঙ্গেলে দেখলে ভিন্ন ভিন্ন কবি গুরুকে দেখা যায়। এক অনবদ্য কারুকাজ। এরপর পায়ে হাটা রাস্তার ধার ঘেষে সুসজ্জিত বাগানের ভিতর ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভারত বর্ষের বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের ভাস্কর্য। এর মধ্যে একজন বিজ্ঞানীর ভাস্কর্য দেখে বেশ আপন মনে হলো। সত্যেন্দ্র নাথ বোস। যে বোসের থিওরি নিয়ে গবেষনা করে আজ বিজ্ঞানীরা নোবেল পাচ্ছে। ভাস্কর্যটির সামনে দাঁড়িয়ে কিছু ছবি তুললাম। ভাস্কর্যের নিচের দিকে সত্যেন্দ্র নাথ বোস এর জীবন কর্ম নিয়ে লেখা আছে ‘জন্মঃ ১৮৯৪, মৃত্যুঃ ১৯৭৪, শিক্ষাঃ এম,এসসি, ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি ১৯১৫, প্রোফেশনাল প্রোফাইঃ লেকচারার, ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি, রিডার, ঢাক্কা ইউনিভার্সিটি, প্রোফেসর, ঢাক্কা ইউনিভার্সিটি, ভাইস চ্যান্সেলর, বিশ্ব ভারতী ইউনিভার্সিটি, ন্যাশনাল প্রফেসর অফ ফিজিক্স, প্রেসিডেন্ট, ইন্ডিয়া সাইন্স কংগ্রেস, ফেলো, রয়েল সোসাইটি, লন্ডন, সম্মাননাঃ মেম্বার অফ পার্লামেন্ট, রাজ্য সভা, পদ্ম বিভূষণ, অনারারী ডীন ফ্রম সেভারেল ইউনিভার্সিটি, ইত্যাদি ইত্যাদি।
সত্যেন্দ্র নাথ বোস এর ভাস্কর্য দেখে একটু এগিয়ে গেলেই ছোট লেক। লেকের ভিতর প্লাস্টিকের বালতি দিয়ে সুন্দর একটি বৈজ্ঞানিক শিল্পকর্ম। লেকে বিভিন্ন প্রকার মাছ সাঁতার কাটছে। বিশেষ করে তেলাপিয়া মাছ, বড় সাইজের পাঙ্গাস মাছ চোখে পড়ার মত। আমরা লেকের পাড় ধরে এগিয়ে যাওয়ার পর সামনে পড়লো বিশাল এক ডাইনোসর হা করে আছে। আসলে ওটা একটা গুহা বা টানেল তৈরী করা হয়েছে। এ প্রান্তে হা করা মাথা, আর পিছন দিকে বিশাল লেজ। ডাইনোসরের সামনে অনেক গুলো বেঞ্চ পাতা আছে। বসতে গিয়ে হাত দিয়ে সিটে একটু টান দিয়ে দেখে নিলাম, ময়লা আছে কিনা। হাত উঠিয়ে দেখি যেমন হাত তেমনই আছে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন বেঞ্চ, একটুও ধুলা ময়লা নেই। আমাদের দেশে হলে পা উঠিয়ে টোকাইরা-ভবঘুরে-বখাটেরা শুয়ে থাকতো। অথচ মনে হয় কিছুক্ষণ আগে ঝাড়া মোছা দেয়া। পরিচ্ছন্ন কর্মীরা হেটে হেটে পাতা কুড়িয়ে পরিস্কার করছে। লেকের পানিতে, ফোয়ারার পানিতে পাতা পড়ছে আর কিছুক্ষণ পর পর পরিচ্ছন্ন কর্মীরা নেট দিয়ে তুলে নিচ্ছে। অন্য কিছু দেখার চাইতে এগুলোই বেশি নজরে আসছে। সাইন্স সিটির ভিতর দিয়ে রাস্তায় সিটির নিজস্ব যন্ত্র চালিত গাড়িতে চড়ে ঘোরা যায়। আস্তে আস্তে চলছে গাড়িটি, একাধিক বগি নিয়ে তৈরী গাড়িটি হর্ণ বাজিয়ে বাজিয়ে চলছে। আমরা সিটির ভিতরের বেঞ্চে বসে বিশ্রাম নিতে নিতে পরিকল্পনা করছি এবার কি করা যায়? সিটির ভিতরে ক্যাবল কার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে, জীবন রহস্য নিয়ে চলচ্ছিত্র প্রদর্শনসহ আরো নানা ইভেন্ট আছে।

কলকাতার সায়েন্স সিটি :
বিজ্ঞানের জটিল বিষয় সন্তানকে বুঝিয়ে উঠতে গিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হই আমরা। তাই সন্তানকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সবচেয়ে আশ্চর্যজনক স্থানে নিয়ে যান, যা হল-কলকাতার সায়েন্স সিটি। কলকাতার একটি বিজ্ঞান সংগ্রহালয় ও বিজ্ঞান কেন্দ্রিক বিনোদন উদ্যান। এটি ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের অধীনস্থ জাতীয় বিজ্ঞান সংগ্রহালয় পরিষদের অধিভূক্ত একটি বিজ্ঞানকেন্দ্র। পূর্ব কলকাতার ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস ও জে বি এস হ্যালডেন অ্যাভেনিউ-এর সংযোগস্থলে ৫০ একর জমির উপর সায়েন্স সিটি অবস্থিত। কলকাতার জনপ্রিয় পর্যটক আকর্ষণের মধ্যে আধুনিক সংকলন, সায়েন্স সিটি ভারতীয় উপমহাদেশের বৃহত্তম বিজ্ঞান কেন্দ্র। মজা এবং স্বচ্ছন্দের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান প্রচার করার উদ্দেশ্যে, সায়েন্স মিউজিয়ামের জাতীয় পরিষদের মস্তিস্কপ্রসুত এই অনন্য বিজ্ঞান চিত্তবিনোদন পার্ক ১৯৯৭ সালে স্থাপন করা হয়। এটা শুধুমাত্র তার স্বাতন্ত্র্যসূচক স্থাপত্য নয় বরং বিজ্ঞানের ক্ষমতা উপলব্ধি করার জন্য দর্শকদের উদ্দ্যেশে তৈরি।
এই স্থানের সুবুদ্ধিসম্পন্ন উদ্ভাবন, প্রবেশদ্বার থেকেই আপনাকে আশ্চর্য করবে, সেখানে একটি রোপওয়ে আছে যেখান থেকে পুরো মিউজিয়ামের এক ঝলক দৃশ্য উপলব্ধ করা যায়। এই মিউজিয়ামের পুরো চত্বরটি অনেক রকমের বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত। এগুলি হল-স্পেস অডিসি, মেরিটাইম কেন্দ্র, সায়েন্স পার্ক, ডায়নামোশন এবং ইভোলিউশন থিম পার্ক। এখানের কিছু জনপ্রিয় আকর্ষণ হল- দৃষ্টিভ্রম, একটি বিস্ময়কর সময় যন্ত্র, থ্রিডি থিয়েটার, একটি বিশেষ প্রজাপতি কর্নার, একটি মাছের চৌবাচ্চা এবং ডাইনোসর চত্বর।
এছাড়াও এখানে বিশেষ করে শিশুদের জন্য দোলনা, স্লাইড, ট্রেন রাইড, মিউজিক্যাল ফোয়ারা এবং অন্যান্য বহু বিনোদনমূলক সুবিধা রয়েছে। সায়েন্স সিটির প্রচল কেন্দ্রে ২০০০ জনের অধিক আসনবিন্যাস ক্ষমতা সহ একটি বিশাল থিয়েটার, একটি ছোট রঙ্গশালা এবং একটি খোলামেলা প্রদর্শন শালা রয়েছে। নানা ধরনের সুযোগ সুবিধাসহ সায়েন্স সিটি আপনার শিশুদের নিয়ে সময় কাটানোর একটি সম্পূর্ণ আনন্দদায়ক চিত্তবিনোদন বিকল্প। ভেবে দেখুন আপনি এখানে নিজস্ব ইচ্ছায় ভূমিকম্প উৎপন্ন হওয়া দেখতে পারেন বা ডাইনোসরের যুগের একটি ভ্রমণে যেতে পারেন! এই সকল অবাস্তব কার্যকলাপ শুধুমাত্র কলকাতার সায়েন্স সিটিই বাস্তব করতে পারে।
সায়েন্স সিটির বিভিন্ন ইভেন্ট দেখতে এক বিকাল লেগে যাবে। তাই সাইন্স সিটি এখানেই সংক্ষেপে দেখা শেষ করলে কেমন হয়? আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, কলকাতায় এলাম আর সিনেমা হলে এক শো সিনেমা দেখবো না এটা কি হয়! সাথে সাথে শরীয়তপুর বাসীর জন্য কলকাতায় পরম মিত্র অতনু ঘটক চৌধুরীকে ফোন দিলাম। এখানে অতনু ঘটক চৌধুরী সম্পর্কে একটু না বললেই নয়। শরীয়তপুর জেলার পালং ইউনিয়নের দীর্ঘ কালের চেয়ারম্যান শরীয়তপুর জেলা গঠনের অন্যতম সংগঠক কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছাত্র কবি রথীন্দ্র কান্ত ঘটক চৌধুরী। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার এক চিঠিতে লিখেছিলেন আমার রথীন বাংলা জানে। সেই রথীন্দ্র কান্ত ঘটক চৌধুরীর নাতি অতনু ঘটক চৌধুরী। অতনু কলকাতায়ই থাকে। শরীয়তপুর থেকে যত লোকই কলকাতা আসে সে চিকিৎসার জন্য হোক আর ভ্রমণের জন্যই হোক তাদের অতনু সহযোগীতা করেনি এমনটি হয়নি। আমরা যাওয়ার পর শত ব্যাস্ততায়ও সে বার বার ফোন করে আমাদের খোঁজ খবর নিয়েছে এবং পরামর্শ দিয়েছে।
যেহেতু সিনেমা দেখবো তাই প্রথম পছন্দের ছবি হলো সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া বহুল আলোচিত বিগ বাজেটের ছবি বাহুবলী টু। অতনুকে ফোন দিলাম বাহুবলী টু কোথায় চলে, কয়টায় শো, কিভাবে যাব আমাদের একটু জানানোর জন্য। অতনু আমাকে একটু পরে যানাচ্ছি বলে ফোন রাখলো। কিছুক্ষণ পরেই ফোন বেজে উঠলো। ধরতেই আমাদের জানালো প্যারাডাইস হলে বাহুবলি টু চলে, সিনেমা হলটি বড় বাজারে। পরবর্তী শো সন্ধা ছয়টায়। আপনারা সাইন্স সিটি থেকে একটা ক্যাব নিয়ে সোজা চলে যান সিনেমা হলে। কথামতো আমরা একটা ক্যাব নিলাম। যেতে যেতে দেখা হলো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে করা সড়কের সাইন বোর্ড। বঙ্গবন্ধু সড়ক দিয়ে যেতে যেতে নিজেদের মধ্যে বেশ উচ্ছসিত ভাব দেখা গেল। আমরা যে দেশ থেকে এসেছি সেই দেশের স্থপতির নামে ভিন্ন কোন দেশে সড়ক এটা একটা গর্বের বিষয়। বঙ্গবন্ধু সড়ক দিয়ে যেতে যেতে আবার ফ্লাই ওভার। সাইন্স সিটি থেকে বড় বাজার দীর্ঘ পথ সামান্য সময়ে চলে আসলাম। কোন ট্রাফিক জ্যাম নেই। শুধু আছে ট্রাফিক সিগনাল। সামনে রাস্তা ফাকা, রাস্তার ধারে কোন ট্রাফিক পুলিশও দাঁড়িয়ে নেই, কোন সিসি ক্যামেরাও নেই। তারপরও ড্রাইভাররা এখানে এক ইঞ্চি আগায় না। নিয়ম মানে বলেই কোন জ্যাম নেই। কলকাতার রাস্তাগুলো ওয়ান ওয়ে। প্যারাডাইস হলের সামনে নামালে ড্রাইভারের অনেক দূর ঘুরতে হবে তাই আমাদের নামিয়ে দিলো কেসি দাসের মিষ্টির দোকানের কাছে। কেসি দাসের মিষ্টির দোকানের বিপরীতেই টিপু সুলতান মসজিদ। অনেক গুলো গম্ভুজ দিয়ে তৈরী টিপু সুলতান মসজিদটি দেখতে অনেক সুন্দর। রাস্তার এপার থেকেই আমরা মসজিদটি দেখতে দেখতে প্যারাডাইস হলের সামনে চলে গেলাম। হাতে বেশ সময় আছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম একটু চা খেয়ে নেই। জামাল ভূইয়া তিনটা টিকিট কেটে নিয়ে এলো। হলের সামনে কিছু দোকান আছে। মুরাদ মুন্সীর খিদে পেয়েছে। বললো, আগে কিছু খেয়ে নেই তারপর চা খাব। হলের সামনে ভাপা পিঠার মত দেখতে গোল গোল কিছু পিঠা নিয়ে বসে আছে একজন। আমরা জানতে চাইলে জানালো,
-এগুলোকে ইটলি বলে।
আমরা জিজ্ঞেস করলাম কেমন খেতে,
-কিভাবে খায়। দোকানি বললো,
-এগুলো টমেটো সস, চাটনি, টক দিয়ে খেতে হয়। এগুলো সাউথ ইন্ডিয়ান খাবার। তিন পিস বিশ টাকা।
আমরা লোকও আছি তিনজন। বললাম এক প্লেট দেন। দোকানি আমাদের একটি প্লেটে তিনটি ইটলি দিল। ইটলির উপরে কিছু টমেটো সস, শরিষা বাটা, তেতুলের টক, লবন দিয়ে দিলো। তিনজনে তিনটি ইটলি পুরোটাই খেলাম। বিল মিটিয়ে রাস্তার ওপারে সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ অব কলকাতা বিল্ডিং এর পাশে ফুটপাতের দোকানে চায়ের অর্ডার দিলাম। মাটির ভাড়ে তিনটা চা দিলো। টগবগে গরম চা হাতে নিয়ে বেশিক্ষণ রাখতে পারলাম না। বিস্কিটের বয়ামের উপর রেখে হাত কচলাতে শুরু করলাম। চা খেয়ে চলে গেলাম হলের গেইটে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গেইট খুলে দিলো। আমরা সুশৃঙ্খল ভাবে হলের ভেতরে প্রবেশ করলাম। একটা শো শেষ হয়েছে মাত্র। প্রবেশ দ্বার দিয়ে কোন লোক বের হলো না। সিনেমা শেষে হল থেকে বাহিরের রাস্তা আলাদা। আমরা ভিতরে প্রবেশ করে ওয়াশ রুমে গিয়ে একটু হালকা হয়ে নিলাম। দীর্ঘক্ষণ ছবি দেখবো, তাই কেউ রিক্স না নিয়ে ফ্রেশ হয়ে দোতলায় ডিসি রুমে চলে গেলাম। টিকিট চেকার আমাদের সিট দেখিয়ে দিলো। আমরা হলের বাম কোনের দিকে তিনটা সিট পেলাম। বসে পড়লাম তিনজন। কোন সময় ক্ষেপণ না করে যথাসময়ে শুরু হয়ে গেল বাহুবলি টু।
বাহুবলীর পরিচালক এস এস রাজামৌলীর নির্মাণ শৈলীর প্রশংসা না করে পারা যায়না। ইতিহাস নির্ভর চলচ্ছিত্রটিতে প্রতিটি পদে পদে রয়েছে রোমাঞ্চ। ভালবাসা ও যুদ্ধ বিগ্রহের সংবিশ্রণে তৈরী ছবিটি দেখে বেশ তৃপ্তি পেলাম। ছবিটিতে মানবিকতার পাশাপাশি আছে মিরজাফরি। পুত্র মায়ের সাথে যে প্রতারণার দৃশ্য দেখলাম তা যুগে যুগে ঘটেছে। বাংলার শেষ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার সাথেওতো প্রতারণা হয়েছিল, মনে পরে গেল সেই সব ইতিহাসের কথা। ছবি দেখে তৃপ্তির ঢেকুর তুললেও হল থেকে বেরিয়ে আরেক বিপদ। জামাল ভূইয়ার ভিতরে প্রচন্ড নি¤œচাপ আন্দোলিত হচ্ছে। আমরা যেহেতু হল থেকে বেরিয়ে গেছি তাই আর ভিতরে প্রবেশ করতে পারছি না। আমরা বের হওয়ার সাথে সাথে পরবর্তী শো চালু হবে তাই লোক প্রবেশ করছে। হলে থাকাবস্থায় চাপ এলে সারতে পারতো। কিন্তু এখন কি করা যায়। সিদ্ধান্ত হলো হোটেলে চলে যাই, ভূইয়ার নি¤œচাপ কমিয়ে তার পরে নিচে নেমে খাওয়া দাওয়া সারবো। কিন্তু জামাল ভূইয়া জানালো, চাপ কিছুটা কমেছে। হোটেলে যাওয়া অতটা জরুরী নয়। বর্তমানে সহনশীল অবস্থায় আছে। আমরা এবার একটু স্বস্তির নিঃস্বাশ ছাড়লাম। এর পর শুরু হলো ক্যাব ডাকা। মোড়টায় ক্যাব পাচ্ছিলাম না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর একটা ক্যাব পেলাম। দরদাম করে উঠে বসলাম। ড্রাইভার আমাদের হোটেলের সামনে নামিয়ে দিলো। সময় ঘনিয়ে আসছে। রাত পোহালেই চলে যাব দেশে। আনন্দ ও বেদনার এক সংমিশ্রণে মিশেল অনুভূমি। থাকতেও মন চাইছে না, আবার যেতেও ইচ্ছে করছে না। যাহোক, আমরা হোটেলের সামনে নেমে আর উপরে উঠলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম একবারে খেয়ে হোটেলে উঠবো।
কলকাতা এসে প্রথম যে হোটেলটায় রাতের খাবার খেয়েছিলাম, সেই লাজিজ বিরিয়ানিতে শেষবারের মত রাতের খাবার খেলে কেমন হয়? সবাই একমত হলাম আজও বিরিয়ানিই খাব। লাজিজ হোটেলে যাওয়ার পর হোটেল মালিক আমাদের চিনতে পারলো। দেখেই বেশ সমাদর করে বসিয়ে হিন্দি-বাংলা মিশিয়ে বললো, কি দেব দাদা। আমরা বিরিয়ানি দিতে বললাম। ওদের এখানে চায়ে ছোট বড়, সিগারেটে ছোট বড়, বিরিয়ানিতে ছোট বড়, সব কিছুতেই ছোট বড় আছে। আমরা বাঙ্গালী, বাংলাদেশী। আমাদের সব কিছু বড়, হৃদয় বড়, হাত বড়, আত্মা বড়, পেট বড়, খাওয়ার চাহিদাও বড়। আমরা বড় দিতে বললাম। মুরাদ মুন্সী আলু দিতে বললো দুই টুকরা। খাসির বিরিয়ানি, সাথে আলু, পিয়াজের সালাদ, কাচা লঙ্কা, লেবু। বেশ আয়েশ করে রাতের খাবার খেয়ে প্রথম দিনের খাওয়া সেই পুলিশ বক্সের পিছনের চা। মুরাদ মুন্সী আর চা নিলো না, আমি আর জামাল ভূইয়া মাটির ভারে চা খেলাম। এরপর হোটেলে গিয়ে প্রতিদিনের মত ফ্রেশ হয়ে ফেসবুকিং, ছবি আদান প্রদান। কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ব্যাগ গুলো গুছিয়ে ছোট করে ফেললাম কিন্তু সেই বড়ই হয়ে গেল, বাঙ্গালি যে! সকালে পরার কাপড় চোপর রেখে বাকি সব গুছিয়ে শুয়ে পড়লাম সবাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই শান্তির ঘুম এসে চুমু দিলো দুচোখে।












॥ ১২ ॥
কলকাতার জীবন যাত্রাঃ
রিক্সা বিহীন সড়ক, ওয়ান ওয়ে, যত্র তত্র ট্যাক্সি ক্যাব, পোশাক পরিচ্ছদ, ওড়না বিহীন চলাচল, সুপেয় পানির সু ব্যবস্থা, কর্পোরেট দায়িত্ববোধঃ

স্বল্প সময় কলকাতা ভ্রমণে কিছু বিষয় হৃদয়ে দাগ কেটেছে। কিছু বিষয় ভাল লেগেছে, কিছু বিষয় খারাপ লেগেছে। সব বিষয় ভাল লাগবে এমন কোন কথা নেই। কথায় আছে না? এক দেশের গালি আরেক দেশে বুলি। আমাদের দেশের চুল এখানে এসে দেখি বাল। ভিন্ন দেশ ভিন্ন পরিবেশ। ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, পরিবেশ কিছু মেলে কিছু মেলে না। তারই কিছু বিষয় তুলে ধরতে চাই এখানে।

রিক্সা বিহীন সড়ক
রাস্তায় নামলে মনে হবে একদম ফাকা রাস্তা। চলতি পথে ট্রাফিক সিগনাল ছাড়া গাড়ির কোন জ্যাম নেই, সিগনাল গুলোতেও যে জ্যাম আছে তা কিন্তু নয়। এর অন্যতম কারণ হলো রিক্সা বিহীন সড়ক। মূল সড়কগুলোতে কোন রিক্সা চোখে পড়বে না। রিক্সা যে নেই তাও নয়। কিছু রিক্সা আছে প্যাডেল চালিত, কিছু রিক্সা মানব চালিত। মানব চালিত রিক্সা গুলো আমার কাছে অমানবিক লেগেছে। মানুষ বসে আছে আর একজন লোক তার বুক দিয়ে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে বাহনটি। একবিংশ শতাব্দিতে এমন কষ্টকর কাজ আর হতে পারে না। অনেকটা ঠেলাগাড়ির মত করে চালাচ্ছে। বাবুদের মত করে আরোহী বসে আছে আর একজন ভৃত্য টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তবে রিক্সা আর আদম টানা রিক্সা যাই হোক না কেন সবই চলে গলির ভিতর দিয়ে। তারা কখনো ব্যস্ত সড়কে ওঠে না। আর এ কারনেই রাস্তায় কোন জ্যাম নেই। মানবিকতার দোহাই দিয়ে আমাদের দেশের প্রধান সড়কে রিক্সা চলাচল বাতিল করা যায় না। এতে আমাদের ক্ষতিই হচ্ছে। আমাদের দেশের রাস্তায় নিয়ম নীতিহীন ভাবে নেমেছে রিক্সার পাশাপাশি নতুন জঞ্জাল অটোবাইক। বিদ্যুতের বারোটা বাজিয়ে রাস্তায় অযথা জঞ্জাল তৈরী করেছে। রিক্সা, অটোবাইক উঠিয়ে দিয়ে অধিক পরিমানে গণ পরিবহন নামিয়ে দেয়া উচিত। রিক্সা আর অটো চালকরা কি করবে সেটা তারাই ঠিক করে নেবে। যার যার যোগ্যতা অনুযায় কাজ খুঁজে নেবে। অযোগ্য লোক রাস্তায় বেরিয়ে জীবণের চাকা স্লত করে দেবে এটা কোন মানবিকতা হতে পারে না। রাষ্ট্র বিভিন্ন কারিগরি বিষয়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলে অযোগ্য লোকগুলোকে দক্ষ জনশক্তিতে রুপান্তর করলেই সমাধান হতে পারে। মানবিকতার দোহাই দিয়ে অর্থনীতির চাকা মন্থর করার কোন যুক্তি নেই।

ওয়ান ওয়ে রোড, যত্র তত্র ট্যাক্সি ক্যাব
রাস্তায় দাঁড়িয়ে আপনাকে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে না। আপনি যদি হাত উচু করে বগল চুলকান তবেও দুচারটা ক্যাব দাঁড়িয়ে যাবে, বলবে দাদা কোথায় যাবেন? আছে আধুনিক ব্যবস্থাও। উবার বা ওলে অ্যাপস মোবাইলে ডাউনলোড করে নিলে আপনি যেখানে যাবেন, কোথায় আছেন লিখে সার্চ দিলেই বিভিন্ন ক্যাটাগরির ক্যাব চলে আসবে। এত আধুনিক ব্যবস্থা যা মানুষকে আরো স্বস্তি দিয়েছে। কলকাতার রাস্তাগুলো সবই ওয়ান ওয়ে। সকালে যে রাস্তা দিয়ে যাবেন বিকালে সে রাস্তা দিয়ে যেতে পারবেন না। ওয়ান ওয়ে হওয়ার কারণে কোন জ্যাম থাকে না রাস্তায়। আর ট্রাফিক আইন সহ আইন মানার প্রবণতা গড়ে উঠেছে কলকাতাবাসির মধ্যে। রাস্তা ফাকা পেলেও কেউ আইন ভাঙ্গছে না। একারণে কলকাতার ড্রাইভারদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধটাও বেড়ে গেছে। আমাদের দেশে ক্যাব কালচারটা সিন্ডিকেটের হাতে না রেখে সেটা সার্বজনীন করা উচিত। ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী একজন দক্ষ ড্রাইভার যদি ক্যাব নামাতে চায় তবে তাকে সহযোগীতা করা উচিত বলে আমার কাছে মনে হয়। যোগ্য লোক ক্যাব চালালে রাস্তায় কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। আমাদের দেশে পঞ্চাশ টাকায় রিক্সাও যেতে চায় না আর কলকাতায় ত্রিশ-চল্লিশ টাকার বিনিময়ে ক্যাবে চড়ে রাজকীয় হালে ঘুরতে পারবেন। কোন গন্তব্যই ছোট করে দেখে না এখানকার ড্রাইভাররা। আমাদের দেশে দূরপাল্লায় যাওয়ার আশায় মোড়ে মোড়ে রিক্সা, অটো, ক্যাব সবাই দাঁড়িয়ে থাকে। অল্প দূরত্ব যেতে চাইলে তাদের গাল ওঠে না। প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে থাকবে, রিক্সার সিটে বসে বসে বিশ্রাম নেবে, আর ফুটপাত নিজের বাপের জায়গা মনে করে জ্যাম তৈরী করবে। নীতি নির্ধারকদের এসব ক্ষুদ্র বিষয়ে বৃহৎ চিন্তা করা উচিত।   

পোশাক পরিচ্ছদ, ওড়না বিহীন চলাচল
এখানকার মানুষের পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে খুব একটা মাথা ব্যথা নেই। বৃদ্ধ বয়সের মানুষজন একটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর একটা শর্ট প্যান্ট পরে বাড়ির সামনে বসে আছে বা দোকানে গিয়ে কেনাকাটা করছে। তবে মেয়েরা এখানে বেশ আধুনিক। মেয়েরা এখানে ওড়না খুব একটা পরে না বললেই চলে। আধুনিকতার শ্রোতে গা ভাষিয়ে দিয়েছে সবাই। জিন্স প্যান্ট সাথে টিশার্ট জাতীয় পোশাকই বেশি ব্যবহার করে। কামিজের ক্ষেত্রে শর্ট কামিজ কিন্তু কেউই ওড়না ব্যবহার করে না। কালে ভদ্রে ওড়না দেখা যায়, তা গণায় ধরার মত নয়। একশত তাল গাছের বাগানে একটা চন্দন গাছ থাকলে তাকে যেমন কেউ চন্দন বাগান বলবে না তেমনই আরকি। এখানকার মেয়েরা বেশ সাহসি। ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে কাজ করছে, পড়াশুনা করছে, ঘুরছে ফিরছে, কোন জড়তা দেখলাম না। মার্কেটগুলোতে গেলে মনে হবে স্ফীত বক্ষ প্রদর্শনী চলছে। পাঠক হয়তো ভাববেন আমার নজর খারাপ। আসলে আমার নজর খারাপ না, আমি যা দেখেছি, তাই উপস্থাপন করলাম মাত্র। ভাল-খারাপের সংমিশ্রণে এক অনন্য অনুভূতি।

সুপেয় পানির সুব্যবস্থা, কর্পোরেট দায়িত্ববোধঃ
রাস্তার মোড়ে মোড়ে সুপেয় পানির সুব্যবস্থা করা আছে। তাও ঠান্ডা পানীয় জলের সু ব্যবস্থা। সরকার নয়, বিভিন্ন কর্পোরেট কোম্পানি তাদের দায়িত্ববোধ থেকে পানীয় জলের ব্যবস্থা করেছে, সরকার তাদের সহায়তা করেছে মাত্র। যেমন আমাদের হোটেলের পাশেই সেন্ডো গেঞ্জি-আন্ডার ওয়ার কোম্পানি রুপা একটা প্লান্ট করেছে। ঠান্ডা ও শোধন করার মেশিন বসিয়ে দিয়েছে। মানুষ পানি নিয়ে যাচ্ছে। তবে কেউ পানি নেয়ার পর কল খুলে রাখে না বা সুযোগ পেলে কল চুরিও করে না। আমাদের দেশে যেভাবে পানি বিক্রি হয় সেখানে এতটা হয় না। আমরা পানির বোতল কিনে খেয়ে যত্রতত্র খালি বোতল ফেলে আবর্জনার স্তুপ তৈরী করছি। তাদের কর্পোরেট দায়িত্ববোধ দেখে বেশ ভাল লাগলো, আফসোস হলো, আমাদের দেশের কোম্পানিগুলোর মধ্যে এ দায়িত্ববোধটা কি জাগ্রত হলে খুব বেশি ক্ষতি হতো?

সূরার সুব্যবস্থাঃ
শহরের মোড়ে মোড়ে আছে মদের দোকান। এখানে মদ-বিয়ার এতটা সহজলভ্য যে পেপসি সেভেন আপ পেতে কষ্ট হবে কিন্তু মদ-বিয়ার পেতে কোন কষ্ট হবে না। কিংফিসার বিয়ার এখানে সবচেয়ে সহজলভ্য। কিংফিশারের প্লান্ট আছে এদেশে। মদ নিয়ে কোন লুকোচুরি নেই। উন্মুক্ত পরিবেশে বিক্রি হওয়ায় দামও কম। পুলিশকে কোন মাসোহারা দেওয়া লাগে না তাই দাম হাতের নাগালেই। মানুষ কাজ করছে, সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে বা সময় সুযোগ মত বারে গিয়ে মদ-বিয়ার খাচ্ছে। তবে কাউকে মাতলামি করতে দেখিনি রাস্তা ঘাটে। এখানে সিগারেট পাওয়া যায় বিভিন্ন সাইজের। ছোট, বড় যে সাইজ চান সেই সাইজই পাবেন। আছে সস্তার পাতার বিড়ি। এখানকার অভিজাত সিগারেট হলো গোল্ডফ্ল্যাগ। গোল্ডফ্ল্যাগও আছে দুই ধরনের ছোট, আর বড়। আপনার অল্প নেশা তাই ছোট নিবেন, বেশিক্ষণ টানতে চান তো বড় নিবেন।
ছিনতাই-ঠ্যাকবাজ মুক্ত শহরঃ 
তিন দিনের কলকাতা ভ্রমণে সকাল থেকে রাত অবধি ঘুরেছি। মোড়ে মোড়ে বা অলিতে গলিতে কোন ছিনতাইকারী ঠ্যাকবাজ চোখে পড়েনি। শুনসান নিরব রাস্তা ঘাট নিরাপদই মনে হয়েছে। রাতবিরাতে কোন ভয় কাজ করেনি। রাস্তায় পুলিশ বক্স আছে অনেক। সাদা পোশাক পরা পুলিশ বন্ধুদের সাদা মন নিয়েই ডিউটিরত অবস্থায় বসে বসে পেপার পড়া ছাড়া খুব একটা কাজ নেই মনে হয়েছে। রাতের ট্রাক থামিয়ে চাদাবাজি করার ধান্দা নেই তাদের। আমাদের দেশে রাতে পণ্যের ট্রাক, মোড়গবাহী ট্রাক থামিয়ে টাকা আদায়ে ব্যস্ত থাকে পুলিশ ভাইয়েরা। এখানে সেটা চোখে পড়েনা।






॥ ১৩ ॥
ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশনে ভোগান্তি

রবিবার সকাল। ঘুম থেকে চোখ মেলেই দেখি জামাল ভূইয়া ফ্লোরে দাঁড়িয়ে জামা কাপড় পরছে। মাঝে মাঝে তাগিদ দিচ্ছে ওঠার জন্য। বুঝলাম বিদায় ঘন্টা বেজে গেছে। বেড়িয়ে পড়তে হবে মাটির টানে, আপন ঘরে। আস্তে আস্তে বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে কাপড় চোপর পরে নিলাম। রুমে কিছু ফেলে গেলাম কিনা চেক করে বেরিয়ে পড়লাম। নিচে নেমে কাউন্টারে চাবি জমা দেয়ার পর ম্যানেজার লোক পাঠালো রুম চেকের জন্য। সবকিছু ঠিকঠাক আছে। হোটেলের ম্যানেজার আমাদের তিনজনকে হোটেলের লোগো লাগানো তিনটা চাবির রিং উপহার দিয়ে আবার আসার জন্য আমন্ত্রণ জানালো। বিদায় নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়। বেরোবার আগে হোটেল বয়দের ও দাড়োয়ানকে বকসিস দিতে ভুল হলো না। আমরা বাঙ্গালি। আমাদের শরীরের চাইতে কলিজা বড় দেখিয়ে দিলাম আরকি!
রাস্তায় বেরিয়ে একটা প্রাইভেট কার চালক আমাদের ডাকলো। দরদাম করে উঠে গেলাম শিয়ালদহ স্টেশনে যাওয়ার জন্য। বাড়তি ইনকামের জন্য সকালে গাড়ি চালায় লোকটা। হয়তো নিজের গাড়ি অথবা বসের গাড়ি ফুয়েল লোড করতে এসে একটু নাস্তার পয়সা জোগার করছে। সকাল বেলা রাস্তা ঘাট একদম ফাকা। আমরা অল্প সময়ের মধ্যে চলে এলাম শিয়ালদহ স্টেশনে। যথারীতি কোন টানা হ্যাচরা ছাড়া নিজেদের ব্যাগ নিজেরা নিয়ে স্টেশনের বারান্দায় দাঁড়ালাম। জামাল ভূইয়া টিকিট কিনে নিয়ে এলো। সকালে যেহেতু আগে আগে ঘুম থেকে উঠেছি তাই খুধাও আগে আগেই লেগে গেছে তা পেটের মোচরামুচরিতে টের পেলাম। স্টেশনের একটি দোকান থেকে কেক, পানি কিনে নিয়ে বনগাঁও স্টেশনমুখী প্লাটফর্মের দিকে রওয়ানা দিলাম। প্লাটফর্ম খুঁজে নিয়ে কিছুটা অপেক্ষা করতেই চলে এলো ট্রেন। আমরা আবারও জানালার পাশে সিট নিয়ে বসে পড়লাম। আমাদের যাওয়া আসায় বসা নিয়ে কোন ঝক্কি পোহাতে হলো না। সঠিক সময়ে সঠিক গন্তব্যর উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিলো ট্রেন। আস্তে আস্তে বারছে গতি, একে একে পিছনে ফেলছে একেকটা স্টেশন, আর দুরত্ব বারাচ্ছে কলকাতার সাথে আমাদের। একসময় কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে ছিলাম। এখন একটা দুটা করে স্টেশন পার হচ্ছি। হৃদয়ে ফেলে আসা স্মৃতিগুলো নাড়া দিচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে কলকাতার জন্য। বাংলাদেশে যাচ্ছি, নিজের মাতৃভূমিতে। নিজের স্বজনদের কাছে পাবো, সেই আনন্দে বুকটা ভরে উঠছে। এ যেন মুদ্রার দুটি পিঠ।
আমি তাকিয়ে আছি কখন আসবে দত্তপুকুর স্টেশন। যেখানে থাকে আমার বন্ধু সুশান্ত কুমার কংসবণিক, দীপক কুমার কংসবণিক। দত্তপুকুর স্টেশনটার কথা হৃদয়ে গেথে আছে সেই সুদীর্ঘ কাল থেকে। বন্ধু তো অনেক থাকে। কিন্তু হৃদয়ের কাছাকাছি অবস্থান করে আর কয়জন! সুশান্ত হৃদয়ের খুব কাছে থাকা বন্ধু। তাইতো হৃদয়ের টানে ছুটে গেছে কলকাতা। যখন শুনেছে আমি কলকাতা আসছি। বাড়িতে কেন গেলাম না, হোটেলে কেন উঠেছি নানান অনুযোগ, অভিযোগ। ‘দাদা খেয়ে এসেছেন না যেয়ে খাবেন, পরের বার আসলে খেয়ে যাবেন কিন্তু’ কলকাতা নিয়ে এমন নানান গাল গল্প শুনেছি অনেক। কিন্তু সুশান্তর ভালবাসা, আতিথেয়তা, আগ্রহ ও আবেগের মধ্যে তেমনটা পাইনি। বন্ধু যেখানেই থাকে বন্ধুকে ভুলতে পারে না। আমরা দেখতে দেখতে দত্তপুকুর স্টেশনে এসে থামলাম। পৌছামাত্রই মনে হলো আপন জায়গা, যেখানে আমার বন্ধু থাকে। সামান্য সময় থেমে কিছু লোক নামিয়ে কিছু লোক উঠিয়ে আবার ছুটে চললো ট্রেন তার গন্তব্যের দিকে। দত্তপুকুর থেকে ট্রেন যতই দূরে যাচ্ছে হৃদয়ে বন্ধুর জন্য কষ্টটা ততই বারছে। একসময় ছোখের আড়ালে চলে গেল স্টেশনটি।
আমরা চলে এলাম বনগাঁও স্টেশন। যার যার ব্যাগ নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের মূল গেইট দিয়ে না বের হয়ে বের হলাম পাশের রাস্তা দিয়ে। বড় একটা তেতুল গাছের কাছে বেবি টেম্পো স্টেশন। লোক হবে দুইশ আর বেবি নাই একটাও! একটা আসে তো দীর্ঘ লাইন থেকে পাঁচজন তুলে দেয় সিরিয়াল ম্যান এক দাদা। প্রচন্ড রোদে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়! আমরা লাইন ছেড়ে দিয়ে চলে আসলাম সামনের প্রধান সড়কে বেবি রিজার্ভ করে নেব সেই চিন্তা করে। কিন্তু কোন বেবি রিজার্ভ যাবে না লাইন ছেড়ে, কারণ পরে এসে আর লাইনে ঢুকতে পারবে না। আবার লাইনে এসে দেখি লাইন আরো দীর্ঘ হয়েছে। আমাদের পিছনে দাঁড়াতে হবে। সকালে একটুকরা কেক আর পানি খেয়ে কি আর পেট ভরে? আমরা পাশের একটা দোকানে গেলাম নাস্তা করতে। ছোট দোকান যাকে বলে কমদামি হোটেল। আমাদের দেশের হোটেল ছালাদিয়া এর চেয়ে অনেক ভাল। তবে দোকানের বিশেষত্ব হলো এর পরিচালকরা সবাই মধ্য বয়সি মহিলা। আমরা ভাত চাইলাম। আমাদের ভাত, আলু ভর্তা, আলুর ফ্রেঞ্চফ্রাই এর মত দেখতে আলু ভাজি, কাচা লঙ্কা, পিয়াজ দিল, সাথে পাতলা ডাল। আমরা তিনজনের জন্য তিনটা ডিম দিতে বললাম। সকাল বেলার ভাত, ভাজি, ডাল, ডিম ভাজা দিয়ে খেতে যে কত মধুর লাগে তা টের পেলাম। মোটা মোটা কাচা মরিচ আমার মত সাস্থ্য। কচকচিয়ে খেয়ে আবার চাইলাম। মরিচ নামেই, কামে না। একটুও ঝাল নেই। তবুও তৃপ্তি সহ খেয়ে পেট ঠান্ডা করে নিলাম। কারণ মাথা তো ঠান্ডা হবে না। উপরে প্রচন্ড গরম, তার উপরে গাড়ি পাচ্ছি না। তাই মাথা প্রচন্ড গরম। হোটেলের মহিলারা ভিতর থেকে বোতলজাত বিয়ার বিক্রি করছে মজুর-শ্রমিক টাইপের লোকদের কাছে। একটু গোপনে গোপনে বের করে দিচ্ছে আর মজুর-শ্রমিক শ্রেণীর লোকগুলো গামছা দিয়ে ঢেকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। গোপনে বিক্রি করলেও আমাদের চোখ এড়াতে পারলো না। খাবার বিক্রির সাথে মহিলারা বিয়ারও বিক্রি করে! খাওয়া শেষে হোটেল থেকে বেরিয়ে লাইন ম্যানকে ঝারি দিলাম, দাদা আমরা নাস্তা খেতে গিয়েছিলাম, আমাদের সিরিয়ালটা দিয়ে দিন, আমাদের একটা বেবি রিজার্ভ দিন। লোকটা আমাদের ছায়ায় দাঁড়াতে বললে আমরা একটু আস্বস্ত হলাম। কিছুক্ষণ পরে একটা বেবি আসার সাথে সাথে আমরা তাকে মনে করিয়ে দিলাম যে আমরা অনেক ক্ষণ যাবৎ দাঁড়িয়ে আছি। লোকটি আমাদের বেবিটি দিয়ে দিলো। উঠে পড়লাম তিনজন। বেবি চলতে থাকলো বেনাপোলের দিকে। কিছুক্ষণ পর বেনাপোল বর্ডারে নেমে আমরা লাইনে না দাঁড়িয়ে ভিতরে ঢোকার ফন্দি আটতে থাকলাম। কিন্তু কাউকে পেলাম না। এরই মধ্যে অনেক লোককে ভিতরে প্রবেশ করতে দিলো। আমরা ভাবলাম এই বুঝি ইমিগ্রেশন ফেস করবো। কিন্তু আমাদের ভিতরে নিয়ে গেল একটি সেডের নিচে। যেখানে লোক দাঁড়িয়ে আছে কম হলেও তিন হাজার। একবার যেহেতু ফাইলে ঢুকে পড়েছি আর বেরোবার উপায় নেই। আমি যেহেতু একটু বেশি ভারি তাই আমার দায়িত্ব হলো ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। আর জামাল ভূইয়া ও মুরাদ মুন্সী লাইনে দাঁড়িয়ে সাপের মত পেচিয়ে পেচিয়ে মূল সিরিয়ালে আসার জন্য দাঁড়িয়ে থাকলো। আমি ব্যাগগুলো একজায়গায় রেখে বসে পড়লাম। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যাথা করছে। দীর্ঘ সময় পার হয়ে যাচ্ছে আমাদের সিরিয়াল আসে না। মাঝে মধ্যে লাইনে কে আগে ছিল কে পিছে ছিল তা নিয়ে মারামারি করছে যাত্রীরা। ইন্ডিয়ান পুলিশ এসে চর থাপ্পর দিয়ে আবার সোজা করছে। তিনজন বিএসএফ জওয়ান ভারি অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, দেখে মনে হচ্ছে শরনার্থীরা যেন দাঙ্গা না বাধায় তার জন্য রেডি তারা! লাইনের শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা ইমিগ্রেশন অফিসার মাঝে মাঝে কিছু লোক যেতে দিচ্ছে। লাল জামা গায়ে জড়ানো কুলিরা যখনই সুন্দর বেটে করে অফিসারটার সাথে কানে কানে কথা বলে তার কিছুক্ষণ পরই এমন দলছুট লোক যেতে পারছে। বুঝলাম সুন্দর লোকটার মাঝে লুকিয়ে আছে এক অসুন্দর দুর্নীতিবাজ চরিত্র। দীর্ঘ তিন ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে সবাই ক্লান্ত আর বিরক্ত। সিদ্ধান্ত নিলাম আর ইন্ডিয়া আসবো না, যদি আসি তবে বাই এয়ারে আসবো, ল্যান্ড পোর্ট দিয়ে নয়। এবার আমাদের সিরিয়াল আসবে দেখে আমি ব্যাগ নিয়ে লাইনের মাথার কাছে দাঁড়ালাম। সিরিয়াল ডাক পড়ার সাথে সাথে যার যার ব্যাগ নিয়ে ছুটে চললাম ইমিগ্রেশন বিল্ডিংয়ের দিকে। ইমিগ্রেশন বিল্ডিংয়ের ভিতর এসি চলছে। কিন্তু সবাই ঘামছে। সেডে দাঁড়িয়ে সবাই বেশ গরম হয়ে গেছে, এখানকার এসিও ঠান্ডা করতে পারছে না। ভিতরে গিয়ে সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে পাসপোর্ট দিলাম। ছবি তুলে, নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করে পাসপোর্টে সিল মেরে ছেড়ে দিলো কাস্টমসের হাতে। পরের রুমে যাওয়ার সাথে সাথে শুরু হলো ব্যাগ তল্লাশির ভান। এক পুলিশ বলেই ফেললো, তিনছ টাকা দিন। আমি আর মুরাদ মুন্সী একসাথেই আছি। জামাল ভূইয়া আমাদের পিছনে ফেলে আগে চলে গেছে। মুরাদ মুন্সী ও আমার কাছে টাকা চাওয়ার পর বললাম সব টাকাতো আপনাদের দেশে খরচ করে এসেছি, এখন বাড়ি যাওয়ার ভাড়াটাও নেই, আপনাকে দিব কোথা থেকে? নাছোর বান্দা ছোটলোক তা বুঝে গেলাম, তাই মুরাদ মুন্সী একশত টাকা বের করে দিলো। অমনি আমাদের দুজনকে ছেড়ে দিলো। ছোটলোকের চাহিদাও ছোট থাকে। ওদের চাহিদাও ছোট তাই অল্প প্রাপ্তিতেই খুশি। আমরা দুজন এগিয়ে গেলাম ইন্ডিয়ার প্রবেশদ্বারে। গেট পার হতেই নো-ম্যান্স ল্যান্ড। ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশনের ভোগান্তি শেষে শান্তির এক সুবাতাশ বইছে। প্রাণ ভরে নিঃস্বাস নিলাম। আহ! কি শান্তি। এবার ঢুকে গেলাম বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন এলাকায়।




॥ ১৪ ॥
বাংলাদেশ ইমিগ্রেশনে শান্তি

বাংলাদেশ ইমিগ্রেশনে তেমন একটা ভিড় নেই। বিশ পচিশ জনের সিরিয়াল। লাইনে দাঁড়াতেই আমাদের পাসপোর্টে সিল দিয়ে দিলো। ব্যাগ চেক করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো না কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। কাস্টমস এরিয়া পার হয়ে বেরিয়ে গেলাম। আমাদের পরিচিত এক সহযাত্রী শরীয়তপুর গামী ফেম গাড়ীর কাউন্টারে পৌছে গেছে। সেখানে গিয়ে মুরাদ মুন্সীকে ফোন দিল, আপনারা কি ফেম গাড়িতে যাবেন? মুরাদ মুন্সী জানালো, আমাদের জন্য তিনটা সিট রাখেন। আমরা বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন পার হয়ে বের হতেই এক যুবক এসে জানতে চাইলো আপনারা তিনজন কি ফেম গাড়িতে যাবেন বলেছেন? আমরা জানতে চাইলাম, আপনি কে? সে জানালো, আমি ফেম গাড়ির স্টাফ। আমার কাছে ব্যাগ দেন। প্রথমে আমরা একটু অবিশ্বাস করলেও পরে মনে হয়েছে, লোকটা কাউন্টারে জানানোর পর কাউন্টার থেকে যুবককে পাঠিয়েছে। যুবকটি জামাল ভূইয়ার ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে গেল। আমি আর মুরাদ মুন্সী আস্তে আস্তে কাউন্টারে গিয়ে দেখি এডভোকেট আসাদ খান মামা কাউন্টারের সামনে বসে বেশ আয়েশ করে সিগারেট টানছে। আমরা গিয়ে ফ্রেশ হয়ে কাউন্টারের পাশে একটা হোটেলে দেশি মাছ দিয়ে ভাত খেলাম। ভাত খেয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ফেম গাড়ির তিনটি টিকিট নিয়ে বাসে উঠে পড়লাম।
এবার প্রাণের টানে বাড়ি ছুটে চলা। দুপুরের সময় বেনাপোল থেকে ফেম গাড়ি ছেড়ে রাত নয়টার দিকে শরীয়তপুর এসে পৌছালাম। পালং বাজারে নেমে আমি আর আসাদ খান মামা দুটি রিক্সা নিয়ে চলে গেলাম নিজ ঠিকানায়। বাসায় গিয়ে দেখি আমার অর্ধপ্রাণ মা রওশন আসাদ প্রিয়ন্তী এখনও জেগে আছে। আমাকে দেখে ঝাপিয়ে পড়লো আমার কোলে। আমি আমার প্রাণ ফিরে পেলাম, মাকে পেলাম, মাটির পরশ পেলাম। এক অপূর্ব অনুভূতির সংমিশ্রণে দ্রভিভূত হয়ে রাতের খাবার সেরে শান্তির ঘুমে নিমজ্জিত হলাম। আসলেই সত্যি, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি...সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্ম ভূমি... সে যে আমার জন্ম ভূমি...

No comments:

Post a Comment