ভালবাসি প্রকৃতি

ভালবাসি প্রকৃতি

Thursday, May 21, 2015

অতীত ঐতিহ্যের কাশ-পিতল শিল্প: আজ শিল্পীও নেই শিল্পও নেই

এক সময় শরীয়তপুর জেলার বিশেষ করে সদর উপজেলার পালং, বিলাশখান, বাঘিয়া, দাসার্তা গ্রামে প্রবেশ করলে মানুষ কান হাত দিয়ে দু’কান বন্ধ করে হাটতো। কাশ-পিতল কারিগরদের পিতল পাতের উপর অবিরাম হাতুরির বাড়িতে হওয়া টুং-টাং শব্দ কানে তালা লাগাতো অনেকের।

এটা আমাদের কাছে এখন কেবলই স্মৃতি। কারন সেই অতীত ঐতিহ্যের কাশ-পিতল শিল্পীও নেই, নেই শিল্পও। নানা সমস্যার কারনে, নানা সমস্যার অযুহাতে, নানা অভিযোগে দেড়শ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ এলাকার পিতল শিল্প আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এক সময় ৫ শতাধিক পরিবারে ২ হাজারের উপরে কর্মী কাজ করলেও এখন ৭/৮টি পরিবারে ২০/২৫ জন শিল্পী এ শিল্প ধরে রেখেছে। এ শিল্পের প্রকৃত শিল্পী যারা তারা চলে গেছেন ওপার বাংলায়। এপারে যারা এই শিল্পকে আকরে ধরে আছেন তারা জাত শিল্পী না। জাত শিল্পীদের কাছে একসময় রুটি-রুজির জন্য কাজ করেছে বা শিল্পকে ভালবেসে কাজ শিখেছে তারাই ধরে রেখেছে শিল্পকে।
একেবারে গোড়ার কথা: জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা করেন এমন ব্যক্তি ও শিল্পের সাথে জড়িতদের সাথে আলাপ করে জানাযায়, অষ্টাদশ শতাব্দির শেষ দিকে কাশ-পিতল শিল্পের সাথে জড়িত কংসবণিক সম্প্রদায় প্রথমে ভারতের উত্তর প্রদেশ থেকে পশ্চিম বঙ্গের হুগলির চন্দন নগর এসে বসতি গড়ে। সেখান থেকে একটা অংশ বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জের লৌহজং গ্রামে এসে বসতি গড়ে। পদ্মা নদীর ভাঙ্গনের ফলে লৌহজং থেকে কংসবণিক সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ অংশ শরীয়তপুরের দাসার্তা, বাঘিয়া, পালং, বিলাশখান গ্রামে এসে বসতি গড়ে কারখানা স্থাপন করে। শরীয়তপুর সদরে তথা পালং ছাড়াও জেলার অন্যান্য উপজেলাতে বসতি গড়লেও সংখ্যায় তা কম। তবে পালং বাজারটাই ব্যবসার প্রধান কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠে।
শিল্পের প্রসার: বাঘিয়া, দাসার্তা, বিলাশখান ও পালং গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে কারখানা গড়ে উঠলেও পালং বাজার প্রধান ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তৎকালীন সময়ে কাশ-পিতলের ধাতব মূল্য ও সৌন্দর্যের কারনে এ শিল্পের এতটাই প্রসার লাভ করে যে, বাংলাদেশের মধ্যে পালং হয়ে ওঠে কাশ পিতল শিল্পের প্রধান উৎপাদন ও ব্যবসা কেন্দ্র। এখান থেকে দেশের প্রধান বিভাগীয় শহর এবং বিভাগীয় শহর থেকে বিদেশে রপ্তানি হওয়া শুরু হয়। এই শিল্পের প্রসার প্রথমে হিন্দুদের হাতে শুরু হয়। পরবর্তীতে মুসলমানরাও জড়িয়ে পরে এ শিল্পের সাথে।
পেশার সাথে যুক্ত পরিবারের অতীত ও বর্তমান সংখ্যা: গত ২০/৩০ বছর পূর্বেও এ শিল্পের সাথে ৪ শতাধিক পরিবার জড়িত ছিল। এখানে কাশ-পিতল শিল্পের প্রায় ২ থেকে ৩ শতাধিক কারখানা গড়ে উঠেছিল। পর্যায়ক্রমে মুসলমানরা এ শিল্পে শ্রম দিতে দিতে কারিগর হয়ে ওঠে। নানাবিধ কারনে শিল্পের সাথে জড়িত হিন্দুরা ভারতের পশ্চিম বঙ্গে চলে যেতে থাকলে মুসলমান কারিগররা আস্তে আস্তে কারখানা স্থাপন করে শিল্পটা ধরে রাখে। বর্তমানে জেলায় ৭/৮টি পরিবার এ শিল্পকে ধরে রেখেছে। এক সময় শুধু পালং বাজারেই ৩০ থেকে ৪০টি কাশ-পিতল সামগ্রী বিক্রির দোকান থাকলেও এখন মাত্র ৪টি দোকান আছে।

শিল্প সামগ্রী: একসময় এ জেলায় মালা, কলসি, জগ, বালতি, বদনা, চামচ, পানদান, ডাবর, পানি খাবার গ্লাস-মগ, ধান-চাল পরিমাপের পুড়, কুপি, বিভিন্ন প্রকার প্রদীপ, পাতিল, ঘন্টি, বিন্দাবনী, চারা, কড়াই, ধুপদানী, ছোট ঘটি (পুঁজার জন্য), মালসা, কোসা-কুসি, পুস্প পত্র, করাতথাল, বাস বেড়া, বগি থাল, পঞ্চপত্র সহ নিত্যব্যবহার্য ও নানান দর্শনীয় সামগ্রী তৈরী করা হতো।
ওপারে (পশ্চিম বঙ্গে) চলে যাওয়ার কারন: নানা সময়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তণের কারনে বিনিয়োগের ও জীবনের নিরাপত্তাহীনতা, চাঁদাবাজি, সহজলভ্য সামগ্রী হাতে পেয়ে মানুষ পিতলের সামগ্রী ব্যবহার না করার কারনে এ শিল্পের সাথে জড়িত হিন্দুরা দেশ ছাড়তে থাকে। কাশ-পিতল শিল্পীরা সাধারণত অন্য কাজ করতে না পারায় পশ্চিম বঙ্গে এ শিল্পের চর্চা কিছুটা অব্যাহত থাকায় হিন্দুরা চলে যায়। আবার অনেকের মতে হিন্দুরা বাংলাদেশকে নিজের মত করে ভাবতে পারে না তাই তারা সর্বদা ওপার যাওয়ার চিন্তায় বিভোর থাকে। পশ্চিমবঙ্গে আপনজন থাকায় মনের টানে চলে যায় অনেকে। অনেকের মতে সংকট আছে থাকবেই। মুসলিম পরিবার গুলো তাদের পেশার সংকটের কারনে কি অন্যত্র চলে যাবে? সংকটের সাথে লড়াই করেই টিকে থাকতে হয়, টিকে থাকতে হবে। তাই শিল্প ধ্বংসের পিছনে শুধু সংকট, সন্ত্রাস, নিরাপত্তাহীনতা, বাজার মূল্য, সামাজিক প্রোপটকে দায়ী করলে ঠিক হবে না।    
শিল্প বিলুপ্তর কারণ: পালং বাজারের কাশ-পিতল ব্যবসায়ীরা জানান, একসময় কাশ-পিতল সামগ্রী তৈরীর কাঁচামাল ‘পাত’ কেজি ছিল ৮০ টাকা। আর এখন প্রতি কেজি পাতের দাম ৩০০ টাকা। এতেই অনুমান করা যায় কাঁচামালের মূল্য কি হারে বেড়েছে। বাজারে প্লাস্টিক, সিরামিক, মেলামাইন, সিলভার, এমনকি লেহার তৈরী পারিবারিক কাজে ব্যবহৃত সামগ্রীর সহজ লভ্যতা, কম মূল্যর কারনে এবং কাশ-পিতলে তৈরী সামগ্রীর অধিক মূল্যের কারনে মানুষ কাশ-পিতল সামগ্রী ব্যবহারে অনিহা দেখায়। ফলে শিল্পীরা তাদের উৎপাদনের উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। কাশ-পিতলের ধাতব মূল্য, স্থায়ীত্ব বিবেচনা না করেই সহজলভ্য সামগ্রী ব্যবহারের কারনে এ শিল্প বিলূপ্তপ্রায়। তাছাড়া কাশ-পিতলের তৈরী সামগ্রীর চেয়ে সিলভার, প্লাস্টিক, সিরামিক, মেলামাইন, লোহার সামগ্রী দেখতে অনেক দৃষ্টিনন্দন।
চাহিদা: এক সময় মানুষ আচার-অনুষ্ঠানে উপহার দিতে বা পারিবারিক কাজে ব্যবহার করতে প্রধান ও প্রথম পছন্দের তালিকায় ছিল কাশ-পিতল সামগ্রী। কাশ-পিতল সামগ্রী ছিল আভিজাত্যের প্রকাশও। বর্তমানে মেলামাইন গিফট বক্স জাতীয় জিনিসের ছড়াছরি ও সহজলভ্যতার কারনে মানুষ কাশ-পিতল সামগ্রী উপহার তালিকা থেকে বাদ দেয়। এখন একান্ত ব্যবহার্য কিছু সামগ্রী যেমন, বিন্দাবনী, বালতি, কলস, পানদান ছাড়া আর কোন সামগ্রীর চাহিদা নেই।
বর্তমান পরিস্থিতি: বর্তমানে ৭/৮ পরিবার এ শিল্পকে কোনমতে বাঁচিয়ে রেখেছে। ৭/৮ টি পরিবারের মধ্যে হিন্দু পরিবারের সংখ্যা নেই বললেই চলে। পূর্বে যারা এ শিল্পে শ্রম দিতেন তারাই মূলত এ শিল্পকে ধরে রেখেছে। নতুন প্রজন্মের কেউ এই শিল্পে শ্রম দেয় না। ফলে এই ৭/৮ পরিবার বিলুপ্ত হলে বা পেশা ছেড়ে দিলে নতুন প্রজন্ম এই শিল্পের হাল ধরবে না বলেই পর্যবেক মহলের এবং শিল্পের সাথে জড়িত ব্যবসায়ীদের ধারনা।
মুসলমান শিল্পীদের আবির্ভাব: একটা সময়ে পাঁচশতাধিক পরিবার এ শিল্পের সাথে জড়িত ছিল। প্রচন্ড চাহিদার কারনে শ্রমিক সংকট মেটাতে কংসবণিক সম্প্রদায় স্থানীয় মুসলমান শ্রমিকদের এ কাজে নিয়োগ দেয়। কালক্রমে এখান থেকে হিন্দু ব্যবসায়ীরা চলে যাওয়ায় এখন মুসলমানরা যে চহিদা আছে তা মেটানোর চেষ্টা করছে। এ শিল্প ধরে রাখার কারণ হিসেবে জানা যায়, মুসলমান শিল্পীরা এ কাজ শিখার কারনে অন্য কাজ পারে না। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা পশ্চিম বঙ্গে চাহিদা থাকায় এবং সেখানে অধিকাংশের আত্মীয় পরিজন থাকায় চলে গেলেও মুসলমানরা যাবে কোথায়। তাই তারা এখানে এই পেশাকে ধরে রেখেছে।

শিল্পীদের কথা: দাসার্তার শিবের বাড়ি চেনেন না এমন লোক শরীয়তপুরে খুব কমই পাওয়া যাবে। ঐ শিবের বাড়ি এক সময় ১০টি পরিবার এ কাজের সাথে জড়িত ছিল। বর্তমানে একটি মাত্র পরিবার কাজ করে বাকি সবাই পশ্চিম বঙ্গে চলে গেছে। রঞ্জীত কুমার কংসবণিক, সিদাম কংসবণিক, বাসুদেব কংসবণিক ও স্যামসুন্দর কংসবণিক এ চার ভাই এখনও এ শিল্পকে ধরে রেখে এদেশে পরে আছে। রঞ্জিত কুমার কংসবণিক বলেন, ভোর রাত থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আমাদের বাড়িতে কাজ হতো। হাতুরি-পিতলের এতই সম্পর্ক ছিল যে টুং-টাং শব্দ সাধারণ মানুষের কাছে কানে তালা লাগার মত মনে হলেও আমাদের কাছে এটা গানের মতো। এখন আর এ শব্দ শোনা যায় না। আবুল কাশেম বেপারী বলেন, ছোট বেলায় এ শিল্পের চাহিদা এতই বেশি ছিল যে বাবা অন্য কাজে না দিয়ে কাশ-পিতলের কাজে দিলেন। এ কাজ শিখেছি এখনতো আর অন্য কাজ পারি না। তাই ধরে রেখেছি। বর্তমান অবস্থা এতটাই খারাপ যে, আগে এখানকার আফিদ ট্রেড ইন্টারন্যাশনালে প্রতি সপ্তাহে ২ থেকে ৩ টন কাঁচামাল বিক্রি হতো আর এখন ১ টন মাল ১ মাসেও শেষ হয় না। এতেই বোঝেন অবস্থাটা কি।

শিল্পীদের দাবী: বর্তমান পিতল শিল্পের সাথে জড়িত শিল্পীরা দাবি করেন এ শিল্পের বিকাশের জন্য তাদের সহজ শর্তে ঋণ ও বাজারজাতকরণের পরামর্শ প্রদান করা দরকার। তাছাড়া সাধারণ মানুষের প্রতি তাদের দাবি ‘পিতল এমন একটি দ্রব্য এটা পুরাতন হলেও এর মূল্য খুব একটা কমে না। তাই পিতল ব্যবহার করুন। পিতল স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশ বান্ধব।’

কাঁচামাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কথা: জেলার পিতল শিল্পের কাঁচামাল প্রকৃয়াজাত প্রতিষ্ঠানের পথিকৃত শরীয়তপুর ব্রাস ইন্ডাষ্ট্রি এর প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ্ব নুর মোহাম্মদ কোতোয়াল। বর্তমানে উৎপাদন ও সরবরাহকারী মেসার্স আফিদ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ সাদিকুর রহমান কোতোয়াল লিটন বলেন, কাঁচামালের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি, কাঁচামাল ভারতে পাচার হয়ে যাওয়া এবং শিল্পীরা ভারতে চলে যাওয়ায় মিলটি বন্ধপ্রায়। ১৯৮৭ সালেও এখানে কাঁচামালের চাহিদা এত বেশি ছিল যে এখানে কারখানা স্থাপন করতে আগ্রহী হয়েছিলাম। মাত্র ১৫/১৬ বছরের ব্যবধানে দেখা গেল চাহিদা শুনের কোঠায়। শিল্প ও শিল্পী উভয়ই বিলুপ্তপ্রায়।

বিসিকের ভাষ্য: বিসিক শিল্প নগরী শরীয়তপুর এর এক সম্প্রসারণ কর্মকর্তার সাথে কথা বল্লে তিনি জানান, দশ বছর আগে যখন এখানে একবার এসেছিলাম তখন টুংটাং শন্দে মুগ্ধ হয়েছিলাম। কুটির শিল্প হিসেবে (যেহেতু হাতের কাজ) উদ্যোক্তারা আসলে ঋণদান, পরামর্শসহ তাদের জন্য কিছু করার সুযোগ ছিল। কিন্তু কেউই আমাদের কাছে আসে না। গবেষকের কথা: শরীয়তপুর জেলার ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে গবেষনা করেন বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক অধ্যাপক এম এ আজিজ মিয়া। তিঁনি বলেন, কাশ পিতল শিল্পীরা নানান কারনে ধাপে ধাপে এদেশ ত্যাগ করেছে। শুধু জেলারই নয়, এই দেশের অন্যতম কাশ-পিতল শিল্পের উৎপাদন হতো এখানে। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক কারনে পর্যায়ক্রমে তারা দেশ ছাড়ে। পিতলের স্থায়ীত্ব অনেক বেশি, সংরণে সুবিধা, পুরাতন হলেও এর দাম কমে না এবং পরিবেশ বান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত। এসব দিক বিবেচনা করে আমাদের উচিত কাশ পিতলের সামগ্রী ব্যবহার করা।

আসাদুজ্জামান জুয়েল 
আইনজীবী ও সাংবাদিক

Tuesday, May 19, 2015

সাগরে ভাসছে মানবতা : কোথায় এখন মানবাধিকার?

সম্প্রতি সময়ে দেশে সবচেয়ে আলোচিত খবর অবৈধ ভাবে মানব পাচার। জীবিকার তাগিদে ছোট নৌকাযোগে উত্তাল সাগর পারি দিয়ে কর্মের সন্ধানে ছোটা মানুষগুলো পড়ছে বিপদে। অতপর গ্রেফতার, মৃত্যু, গণকবর! ভূখা নাঙ্গা হাড্ডিসার কিছু মানুষের প্রতিচ্ছবি বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই ঘটনা যখন চরম অবস্থায় পৌচেছে তখন সরকার সহ বিশ্ব বিবেকের গায়ে সামান্য সুরসুরি লাগছে। আসলে এমন কেন হচ্ছে?

আজ থেকে দশ-পনের বৎসর আগেও লোক মুখে শুনেছি, মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছি মানুষ ইটালী যাচ্ছে মাছের ফ্রিজিং গাড়িতে করে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পৌছাতে না পারলে মানুষ হিমায়িত অবস্থায় গিয়ে পৌছায়। হিমায়িত মাছের মূল্য আছে কিন্তু হিমায়িত মানুষের মূল্য নাই দুই পয়সাও! আবার দিনের পর দিন পায়ে হেটে, বন জঙ্গল পার হয়ে বরফের চাদরের উপর দিয়ে হেটে যায়, স্থানীয় ভাবে তাকে বলে ডাংকিমারি!! প্রকৃত শব্দটা কি হবে আমি নিজেও জানি না। ভুক্তভোগীদের জিজ্ঞেস করলে বলে ঐ এলাকায় বরফের খাল, নদী পায়ে হেটে পার হওয়াকে ডাংকিমারি বলে।

এই মানুষগুলো কি আর কোমড় সোজা করে দাড়াতে পারবে??
সেই সময়কার ডাংকিমারি করে যারা দেশে খালি হাতে শুধু জীবন নিয়ে ফিরে আসছে তাদের অনেকের সাথে আমার কথা হয়েছে পেশার কারনে। একসময় আমি সাংবাদিক ছিলাম। প্রথম আলো, কালেরকন্ঠ পত্রিকায় কাজ করেছি দীর্ঘদিন। পেশার কারনে মানুষের সাথে কথা বলেছি, মিশেছি, তাদের হৃদয় ভাঙ্গার গল্প শুনেছি। এই ঘটনায় আমার পরিচিত জন, আত্মীয় স্বজন, কন্ধু বান্ধবও ছিল। আমার এক বিয়াই এভাবে অবৈধ পথে ইটালী যাওয়ার চেষ্টা করে জীবন নিয়ে দেশে ফিরত এসেছে। দেশ থেকে পাকিস্তান হয়ে যাওয়ার চেষ্টাকালে প্রথমেই পড়ে মাফিয়াদের হাতে। সেখানে মাফিয়ারা আটকে রেখে মুক্তিপণ দাবী করে। মুক্তিপণ দিয়ে আবার পাড়ি দেয়। বরফের নদী পায়ে হয়ে যখন আলোর সন্ধান পাবে সেই মুহুর্তে গ্রেফতার। অতঃপর দেশে ফেরত।

আরেক পরিচিতজন এভাবেই দিন রাত বরফের উপর দিয়ে পায়ে হেটে এক স্টেশনে পৌছার পর দেখে পায়ে আর জোর নেই। পাটাই যেন বরফ হয়ে গেছে। আগুনে ছেকার জন্য পা রাখে আগুনের উপর। আস্তে আস্তে পা একটু গরম হয় ঠিকই কিন্তু আগুনের তীব্রতা অনুভব করতে পারে না। অনুভবের সেই বোধ শক্তি হারিয়ে গেছে। পরবর্তীতে দেখা গেল তার পায়ে পচন ধরেছে। যতটা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় পা গরম করা উচিত ছিল ততটা দ্রুত পা গরম করায় তার পায়ে পচন ধরে। পরবর্তীতে তাকে দেশে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হলো। চিকিৎসা শেষে তার দুই পায়ের অর্ধেকটা করে কেটে ফেলতে হলো। জীবন জীবিকার টানে সুস্থ্য অবস্থায় বিদেশের পথে পাড়ি জমালেও পঙ্গু হয়ে গেল সে। এখন আর স্বাভাবিক অন্য দশজনের মত হাটতে পারে না, পছন্দ মত জুতা পড়তে পারে না। এভাবেই মানুষগুলো পণ্যের মত বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে কেউ জীবন নিয়ে পালায় আবার কেউ জীবন দেয়। পিছনে ফেলে যায় অনেক স্মৃতি, পরিবার, ভালবাসার মানুষগুলো আর একরাশ স্বপ্ন।

জীবন্ত কঙ্কাল হেটে যাচ্ছে। এদের জন্য কি কারে মায়া হয় না??
আমাদের সকলের মনে একটাই প্রশ্ন, কেন মানুষগুলো এভাবে জীবনের ঝুকি নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে? বন জঙ্গল বরফের উপর দিয়ে জীবনকে সংকটে ফেলছে? এর অনেক কারন আছে যা বোধ্যারা ভাল বলতে পারবেন। তবে আমার কাছে যে কারনগুলো মনে হয় তা আমি আপনাদের সাথে একটু শেয়ার করে নিতে পারি।

অশিক্ষাঃ যারা জীবনের ঝুকি নিয়ে সমুদ্র, বন জঙ্গল বাড়ি দিচ্ছে তাদের বেশির ভাগ মানুষই অত্যন্ত অশিক্ষিত। অশিক্ষিত মানুষগুলো দেশে তেমন ভাল কোন কাজ করতে পারে না। তাদের ধারনা দেশে যেহেতু কিছু করতে পারলাম না তাই বিদেশ গিয়ে নিজের ভাগ্যটা পরিবর্তন করে ফেলবো দ্রুত সময়ে। বিদেশে গিয়ে যে কোন কাজই করবো কেউ দেখবে না। বিদেশের ঐ কাজই দেশে করলে একটু শরম লাগে!! তাই বিদেশে গিয়ে নিম্নমানের কাজই হোক আর উচ্চমানের কাজই হোক করে মোটা টাকা নিয়ে দেশে এসে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকিব!!

অগ্যতাঃ অশিক্ষিত এই মানুষগুলো জ্ঞান গরিমায়ও ছোট, কাজের অভিজ্ঞতাও কম, অনেকেই একদম অযোগ্য। বিদেশ বিভূইয়ে কি করতে পারবো, কি করতে হবে, কিভাবে যাওয়া যায়, কোন পথ বৈধ কিছুই জানা নেই। আর অগ্য-অনভিজ্ঞ এই মানুষগুলো বিদেশ পাড়ি দিয়ে বিপদে পরে নিজে, বিপদে ফেলে পরিবারকে, বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেশ ও জাতিকে।

কাজের অভাবঃ দেশে জনসংখ্যা অনুপাতে কাজের অভাব। এক্ষেত্রে সরকারের বিশাল গাফিলতি আছে নিঃসন্দেহে। সরকার উদ্যোগি হয়ে নাগরিকদের পর্যাপ্ত কাজের ক্ষেত্র, সুযোগ করে দিতে ব্যার্থ হওয়ায় মানুষগুলো পিপিলিকার মত দল বেধে বিপদের মুখে ঝাপ দিচ্ছে।

এভাবেই ক্যাম্পে ঠাই হয় মানবতার
উচ্চাভিলাশী মনঃ আমাদের দেশের সাধারণ মানুষগুলোর উচ্চাভিলাশী মন আজকের এই পরিস্থিতির জন্য অনেকটা দায়ী। দেশে কাজ করতে মন চায় না। দেশের কাজকে ছোট করে দেখে। একই কাজ ক্ষেত্রবিশেষ নিম্নমানের কাজ বিদেশে করতে মন্দ লাগে না। দেশে নিজের উদ্যোগে, নিজের মেধা খাটিয়ে, অল্প পূজি দিয়ে কাজ করতে উদ্যোগি হয় না এই মানুষগুলো। সবসময় চেয়ে থাকে উচু তলার মানুষের দিকে। তাকিয়ে তাকিয়ে মনের ভিতরে হিংসা পয়দা করে আর বলে আমারও এমন বাড়ি হতে হবে, আমারও এমন গাড়ি থাকতে হবে, আমিও দুহাত খুলে টাকা খরচ করবো!!! কিন্তু সবসময় যদি উপর দিকে না তাকিয়ে নিচের দিকে তাকাই তবে আজকের পরিস্থিতির মত উষ্ঠা খাওয়ার সম্ভাবনা থাকতো না। দ্রুত বড়লোক হওয়া যায় না। আস্তে আস্তে হলে সেটা মজবুত হয় এবং বেশিদিন টিকে থাকে। অন্যের অর্থবিত্তের দিকে না তাকিয়ে নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী চলার মানসিকতা থাকলে কেউ বিপদে ঝাপ দিত না। তাই উচ্চাভিলাসী মনকে সংযত করতে হবে।
সরকারের ব্যর্থতাঃ সবচেয়ে বড় সমস্যা সরকারের উদাসীনতা ও ব্যর্থতা। সরকারের কাজ প্রতিটি নাগরিকের জীবন জীবিকার খেয়াল রাখা। প্রতিটি নাগরিককে যথাযথ ভাবে শিক্ষিত করে, কর্মদক্ষ করে গড়ে তোলা। শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনের পর যার যার যোগ্যতা অনুযায় কাজের ব্যবস্থা করা। আমাদের সরকার কি সেটা নিশ্চিত করতে পেরেছে? আমাদের সরকার কখনোই সেটা করতে পারেনি। পারলে আজকের এ দৃশ্য দেখতে হতো না। লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার পড়ে আছে কাজের সুযোগ পাচ্ছে না। লাখ লাখ বেকার কর্মী পরে আছে কাজে লাগছে না। কাজের সুযোগ করে দিলে এভাবে কেউ বিপথগামী হতো না। সরকারের উদাসীনতা চরম পর্যায়ে পৌছে গেছে। ঘুষ, দুর্নিতি এমন রূপ ধারণ করেছে যার কারনে রাতের আধারে, দিনের আলোয় মানুষ ছোট্ট নৌকায় করে সাগর পাড়ি দিতে যাচ্ছে। দেশের অভ্যন্তর থেকে অবৈধ ভাবে মানুষ বাইরে যাবে আর বাইরে থেকে ভিতরে ঢুকবে এটা কি করে সম্ভব হয়? তাহলে দেশে নিরাপত্তার জন্য হাজার কোটি টাকা খরচ করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন পোষা হয়? দেশের ভিতর প্রতারক চক্র ঘুরে ঘুরে মুরগি কেনার মত করে বোকা-অগ্য মানুষগুলোকে কিভাবে বিদেশে পাচার করে? দালালরা কিভাবে পার পেয়ে যায়। দালালদের টাকার ভাগ কি প্রশাসনের লোকজন পায় না? না পেলে কেনই বা তাদের বাধা দেয় না? সাধারণ মানুষ তার শেষ সম্বল ভিটে মাটি বিক্রি করে, স্থানীয় এনজিওর কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে পাড়ি দিচ্ছে বিদেশে। প্রতারিত হয়ে কি শুধু অর্থ বিত্তই হারায়, হারায় তার স্বপ্নও। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে চোখে শরষে ফুল দেখে গৃহকত্রী। পিতা-ভাই হারিয়ে নিঃশ্ব হয় সন্তান-স্বজন। সামান্য রোজগারের জন্য বিদেশে পারি দিয়ে কত মায়ের বুক খালি হলো, কত স্ত্রী স্বামী হারা হলো, কত সন্তান পিতা হারা হলো, গভীর সমুদ্রে মাছের খাবারে পরিনত হল আপনজন।

অবৈধ অভিবাসী হিসাবে সাগর পারি দিতে গিয়ে লাশ হয়
ঝুকিপূর্ণ বিদেশ পাড়ি দেয়ার ক্ষেত্রে শুধুকি পুরুষই নারী-শিশুরাও সামিল হয়েছে। নারীরা হয়ে যাচ্ছে ভোগের পন্য। নির্যাতন স্বীকার করে উজ্জল ভবিষ্যতের আশায় ছুটে যাচ্ছে সমুদ্র পাড়ি দিতে। ভবিষ্যতের উজ্জলতা ম্লান হয়ে যাচ্ছে মুহুর্তেই। দালালের ক্ষপ্পরে পরে জিম্মি হয়ে দেশে কিছু থাকলে তা বিক্রি করে টাকা তুলে দিচ্ছে মাফিয়ার হাতে। সেই টাকাও যাচ্ছে অবৈধ পথে। দীর্ঘদিন যাবৎ এমনটা হচ্ছে সরকার কি কিছুই জানে না? আর কত না জানার ভান করে থাকবে সরকার। আর কত??

দেশে একজন মানুষ ক্রসফায়ার হলে বা অবহেলায় মৃত্যু হলে বা অপঘাতে মৃত্যু হলে আমরা জেগে উঠি। জেগে ওঠাই স্বাভাবিক। আমাদের সাথে বিশ্ব বিবেকও জেগে ওঠে। আজ হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে, গণকবর আবিস্কার হচ্ছে, সমুদ্রে অনাহারে থাকা মানুষগুলোকে তীরে ভিরতে দিচ্ছে না।

এভাবেই সবাই পায়ে ঠেলে দেয় মানবতা।
কেন এখন বিশ্ব বিবেক জেগে উঠছে না। কেন কঠর ভাবে নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা হচ্ছে না? সাগরে ভাসমান মানুষগুলো হোক বাংলাদেশ বা মিয়ানমারের। তারাওতো মানুষ। বিশ্ব বিবেক কেন প্রচন্ন চাপ সৃষ্টি করছে না আজ। এক পৃষ্ঠা প্রেস রিলিজ বা একটু চোখ রাঙ্গানি দিয়েই কি তাদের দায়িত্ব শেষ? হাড্ডিসার কঙ্কালের মত মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকালে বড় মায়া হয়। এই মানুষগুলো যেখানে যেতে চাইছিল সেখানে গিয়েও কোন কাজ করতে পারবে বলে আমার মনে হয়না। আর এ মানুষগুলো দেশে এসেও কোন কাজ করতে পারবে কিনা আমি জানি না।

অসহায় মানুষগুলো দেখে বড় মায়া হয়। নিজের বিবেকের কাছে কেন যেন প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, কোথায় আজ মানবতা? মানুষ হিসাবে আমাদের কি এ ঘটনা চেয়ে চেয়ে দেখতেই হবে? কিছুই কি করার নেই? ঠুটো জগন্নাথরা কি বিবৃতি দিয়ে পেয়ালায় পেয়ালায় চিয়ার্স করবে? দালালরা কি বহাল তবিয়তেই তাদের কাজ চালিয়ে যাবে আর আমাদের রাষ্ট্রীয় জানোয়াররা কি দালালদের টাকায় শরীরের মেদ বারাবে?

আসাদুজ্জামান জুয়েল
আইনজীবী
১৯ মে ২০১৫

Sunday, May 10, 2015

মা...


মায়ের ভাষা শুনেও আমি বুঝিনি মায়ের কথা
মা হারিয়ে বুঝি এখন মা হারানোর ব্যাথা।

মায়ের অভাব হয়নি পূরন পেয়েছি আমি যতই
মায়ের অভাব হয় না পূরন পেলাম ভবে কতই!

মা থাকতে মা’যে আমার চাইলো নাতো কিছু
দিতে না পারার কষ্ট যে আজ ছারছে না মোর পিছু।

শত কষ্ট, অভাব-অনটন বুঝতে দেয়নি মা!
না শোনা কথার জন্য মাফ চাইতাম ধরে পা!

ইচ্ছা হলেও আজকে আমার চাওয়ার জায়গা নাই
শত ব্যস্ততা কাজের মাঝেও মায়ের পরশ পাই

আমার মায়ের হাসি মাখা মুখ পৃথিবীর চেয়েও সেরা
বুঝতে পারি যখন তখন আমি যে এক মা হারা।

মাগো তোমায় ভুলবো আমি সেই সাধ্য কি আছে
চেষ্টা করি মাকে যেন ভুলে না যাই পাছে.....
10.05.2015