ভালবাসি প্রকৃতি

ভালবাসি প্রকৃতি

Sunday, August 18, 2019

রাজশাহীর পথে পথে একদিন... স্বাধীনতার এতটা বছর পরেও কেন রাত বারোটায় শিশু দুই ভাইয়ের দুই দোকানে কাজ করতে হয়!

মানুষ আমি আমার কেন পাখির মত মন...তাইরে নাইরে করে গেলো সারাটা জীবন.....। আসলেই মানুষের মন পাখির মত। এক ডালে বসে থাকতে কারোরই ভালো লাগে না। যেমনটা আমার ভালো লাগে না। বিভিন্ন ছল-ছুতায় বেরিয়ে পরতে চায় মন। ঈদ পরবর্তী সবাই কোন না কোন জায়গায় ঘুরতে যাচ্ছে। জামাই, ওবিডিয়েন্ট জামাই, মোষ্ট ওবিডিয়েন্ট জামাই, ডোমেস্টিক জামাইদেরতো কথাই নাই। বন্ধু-বান্ধব কয়েকজন একসাথে হলেই সুর ওঠে চল বেরিয়ে পড়ি। মুক্ত ভাবে ঘুরার বাসনা সবার মধ্যেই থাকে যেমনটা আমার মধ্যেও আছে। তাইতো ঈদ পরবর্তী ছুটিটা কিভাবে কাটানো যায় সে নিয়ে চিন্তা করতে করতে বন্ধু শামীম সরদার বললো-চলো রাজশাহী ঘুরে আসি। সোনামসজিদ, পদ্মা নদী দেখে আসলে মন্দ হয় না। যদিও আমরা পদ্মা পাড়ের মানুষ। পদ্মার শান্ত-ভয়ানক রুপ দেখে দেখে বড় হয়েছি। তবুও আমাদের পদ্মা আর রাজশাহীর পদ্মা কেমন তা দেখা যেতেই পারে। যেমন কথা তেমন কাজ। বন্ধু শামীম সরদারের গাড়ি নিয়ে রাত বারোটায় বেরিয়ে পরলাম রাজশাহীর উদ্দেশ্যে।
বন্ধু শামীম সরদারের অফিস থেকে শাক-খিচুরি খেয়ে রওয়ানা দিলাম আমরা। পতে পথে গল্প, রাতের দৃশ্য হৃদয়ে ধারণ করতে করতে চলছে গাড়ি দূর্বার গতিতে। রাতের ভ্রমনে কিছুক্ষণ পর পর চা না হলে চলে না। মাদারীপুরের পথে আর চায়ের জন্য থামলাম না আমরা। গাড়ি গিয়ে থামলো ফরিদপুরের মুন্সির বাজার বাইপাসের মোড়ে। ফরিদপুর মুন্সির বাজার বাইপাসে বিশাল এক স্মৃতিস্তম্ভ আছে। এটা নুরু মিয়ার স্মৃতির উদ্দেশ্যে তৈরী। নুরু মিয়া বাইপাসে নেমে সদরপুরের দিকে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেদিকে একটা চায়ের দোকান খোলা। দোকানটি কদম গাছের নিচে। দোকানি ধুয়ে মুছে বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গভীর রাতের চায়ের অনুভূতির একটা দাম আছে, তাই চায়েরও আলাদা দাম থাকে। সচরাচর যে চা আমরা ৫ টাকায় পাই সেই একই চা খেতে হলো দশ টাকা করে। দশ টাকা নিলেও আমাদের কোন আক্ষেপ নেই, আমরা চা নিলাম। দোকানির সাথে গল্পের ফাঁকে ফাঁকে চলছে চা পান। বাইপাসের গুরুত্ব শুনালেন আমাদের। আগে ফরিদপুরের এই রাস্তায় অনেক দূর্ঘটনা ঘটতো। রাস্তার একটা মোড় আছে যেখানে গাড়ি আসার সাথে সাথে চালকরা নাকি সাত আটটি রাস্তা দেখতো চোখের সামনে। দ্বিধাদন্দে ভূগে সবসময় মাঝের রাস্তা দিয়েই গাড়ি ঢুকিয়ে দিতো আর তাতেই ব্যাস! গাড়ি গিয়ে পড়তো লডা ক্ষেতে! পরবর্তীতে এই বাইপাস করায় অনেক দূর্ঘটনা কমে গেছে শুনালো দোকানি।
চা খেয়ে রাস্তা পাড় হয়ে বাইপাসের পাসের একটি দোকানের সামনে স্টিলের বেঞ্চিতে বসলাম। গভীর রাতের শুনসান নিরবতা ভাঙ্গছে অচেনা গাড়ির সাই সাই শব্দ। আপন শহর থেকে বহু দূরের কোন জায়গার নিরবতা অন্যরকম অনুভব হয়। যেখানে আমি কাউকে চিনিনা, কেউ চেনেনা আমাকেও! বসে বসে অনুভব করলাম, গভীর রাতের গাভীর দুধের এক কাপ ধূমায়ীত চা হৃদয়ে কতটা প্রশান্তি বয়ে আনতে পারে তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়! আমিও প্রকাশ করতে পারছি না সেই অনুভূতির কথা। সুযোগ হলে নিজেই কখনো চেখে দেখবেন কেমন অনুভূতি।
এখানে বসে বসে গভীর রাতের সৌন্দর্য অনুভব করলে হবে না, যেতে হবে বহু দূর! তাই চালক তারা দিলো, ওঠেন আগাই আমরা। আবার চলতে থাকলাম আমরা। মুন্সির বাজার থেকে বাইপাস দিয়ে রাজবাড়ীর মোড় পার হয়ে আমরা রাজবাড়ীর উপর দিয়ে কুষ্টিয়ার দিকে চলছি। কুষ্টিয়া আর রাজবাড়ীর মাঝামাঝি জায়গায় বেশ লোক সমাগম দেখে ভাবলাম কোন ডাকাতির ঘটনা। পরক্ষণেই দেখি একাধিক পুলিশের গাড়ি, কিছু মাইক্রোবাস দাড় করা। পুলিশের গাড়ি দেখে বুঝলাম কোন একটা ঝামেলা হয়েছে নিশ্চই! কাছে যেতেই দেখি একটা বড় বাস রাস্তা থেকে ছিটকে পাশের খালে পড়ে আছে। একই বয়সের কিছু যুবক ভেজা অবস্থায়। কেউ রাস্তার পাশে বসে আছে, কেউ পুলিশের কাছে জবানবন্দী বা স্বজনের বা আহত সঙ্গীর তালিকা দিচ্ছে, পুলিশ গাড়ির বনেটের উপর ডায়রি রেখে লিখছে। রাস্তার পাশে অসংখ্য স্কুল ব্যাগের মত ভারি ব্যাগ রাখা আছে। কেউ কেউ ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। দূর দূরান্ত থেকে লোকজন হাতে লাইট নিয়ে এগিয়ে আসছে। পরবর্তীতে শুনেছি ওটা একটা টুরিস্ট বাস ছিলো। স্কুল-কলেজের ছাত্রদের নিয়ে কোন জায়গায় বেরাতে যাচ্ছিলো। এমন ফাঁকা রাস্তায় দূর্ঘটনায় পড়া মানে চালক হয় ঘুমিয়ে পড়েছিলো নয়তো নেশা করেছিলো। যাহোক, আমরা আর ঝামেলায় না জড়িয়ে চলতে থাকলাম। আমরা অমানবিক নই কিন্তু! এখানে পুলিশের গাড়ি আছে, একাধিক মাইক্রোবাস হয়তো পুলিশই এনেছে, তাই আমাদের দর্শক হয়ে ভীর বাড়ানো ছাড়া কোন কাজ হতোনা। আর আমরাও যেহেতু অনেক দূর যাবো, এমন পরিস্থিতি দেখলে হয়তো আমাদেরও খারাপ লাগতে পারে, যার ফল হিসাবে আমাদেরও কোন সমস্যা হতে পারে, সেই ভেবে আমরা চলতে থাকলাম।   
আমরা কুষ্টিয়া হয়ে পাবনার দিকে যাচ্ছি। লালন সেতু পার হতেই বিশাল বিশাল ইমারত চোখে পড়লো। আলো ঝলমলে ইমারত দেখে বন্ধু শামীম বললো, এগুলো কি? আমি মুহুর্তেই বুঝেগিয়ে বললাম, এগুলোই বাশি কান্ড! শামীম সরদার বললো, বালিশ কান্ড মানে কী? বালিশ কান্ড মানে হলো একটা বালিশের মূল্য সাত-আট হাজার আর তা এই ভবনে উঠাতে বলদ বাবদ লাগছে ছয়-সাত হাজার, সেই রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র! চলতে চলতে আমরা পাবনা থেকো নাটোরের দিগের রাস্তার মোড়ে গিয়ে আবার যাত্রা বিরতি দিলাম। মোড়েরর চায়ের দোকানে আমাদের মত আরো অনেকেই চা খাচ্ছে দেখলাম। শ্রমিক যারা আছে তারা হয়তো পেটের দায়ে আর আমরা মনের দায়ে গভীর রাতে রাস্তায়। আমরা চা খেয়ে আবার চলতে শুরু করলাম। গাড়িতে উচ্চ ভলিউমে গান চলছে বিরতিহীন ভাবে। বাংলা-হিন্দী কোনটাই বাদ যাচ্ছে না। শুধু ইংরেজী গান শুনিনি! মনির খানের কলিজা কাটা বিচ্ছেদ, গুরু জেমসের, ইন্দ্রানীর গান, নতুন শিল্পীদের, সবার গানই ভালো লাগবেছ। গভীর রাতের গান বলে কথা। রাস্তার ধারের দোকানগুলো সবই বন্ধ। মাঝে মাঝে নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা হাটাহাটি করছে। এছাড়াও আছে কিছু বেওয়ারীশ কুকুর। নাটোরের বুকচিরে চলছে আমাদের গাড়ি। নাটোর পার হতে হতে আমাদের সূর্যমামা উকি দিতে শুরু করেছে। রাস্তায় প্রচুর গাড়ি চলছে। বড় বড় বাস, আমাদের মত অনেকেই প্রাইভেট কার, জীপ, মাইক্রো নিয়ে ছুটেছে। উদ্দেশ্য হয়তো একেক জনের একেক ধরনের। কখনো আমরা গাড়িকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছি আবার কখনো আমাদের পাশ কাটিয়ে সাইসাই করে চলে যাচ্ছে কেউ কেউ। রাজশাহী পৌছাতে পৌছাতে আমাদের ভোর হয়ে গেলো। রাজশাহী ঢুকে দেখি রাস্তায় সবজি বিক্রেতারা কেনাবেচা করছে। আমরা একটা হোটেলে উঠলাম। সারা রাতের জার্ণি! শরীর আর মানতে চাইছে না। একটু বিশ্রাম না নিলে হবে না। ঘুম হয়তো আসবে না, তবুও শরীরটাকে টান টান করা আরকি!
একটু বিশ্রাম নিয়ে উঠে পড়লাম আমরা। হেটেল থেকে বেরিয়ে আগে নাস্তা সারলাম। সকাল সকাল ভাত-ডাল মেরে দিলাম! এবার একটু ঘুরাঘুরি করা দরকার। প্রথমেই গাড়ি নিয়ে দর্শনীয় কিছু স্থান দেখে নিলাম কিন্তু নামলাম না। শুক্রবার হওয়ায় কোন কিছুই তেমন খোলা নেই। বরেন্দ্র যাদুঘর বন্ধ। সবকিছুই দেখলাম কিন্তু নেমে দেখলাম না। গাড়িতে বসেই মুখটা দেখলাম। মুখচ্ছবিতে যদিও সকল সৌন্দর্য বিরাজ করে না, তবে মুখচ্ছবি দেখলে অনেক সময় দেখার বড় একটা অংশ পূর্ণ হয়, আমরাও তেমনি করছি। ঘুরতে ঘুরতে গেলাম পদ্মা পাড়ে।
পদ্মা পাড়ের মানুষ আমরা। তবুও রাজশাহী গিয়ে পদ্মার নাম শুনে চলে গেলাম দেখা করতে পদ্মার সাথে! রাজশাহী ঈদগা মাঠের পাশে গাড়ি রেখে তীরে নামলাম। বিশাল শহর রক্ষা বাধ পাড় হয়ে নিচে নামতেই চোখে পড়লো মুক্তমঞ্চ। চমৎকার করে সাজানো মুক্তমঞ্চ। জেলাটি শিল্প সংস্কৃতিতে অনেক আগানো একটি শহর। অনেক পুরাতন স্থাপনা নজরে আসলো। মুক্তমঞ্চটি দেখলেই বুঝাযায় এখানে মানুষ শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা করে। কারন এখানে রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করার মত স্পেস নয়। শিল্প-সংস্কৃতি চর্চায় যে পরিমান মানুষ হওয়ার কথা তার চেয়ে একটু বেশি জায়গা নিয়ে করা। খুবই শৌল্পিক নকশায় করা হয়েছে যা অনেকটা রাজধানীর ধানমন্ডি রবীন্দ্র সরোবরের আদলে তৈরী। মুক্তমঞ্চের পাশ দিয়ে হাটার মত রাস্তা করা। মানুষের শরীর স্বাস্থের কথা চিন্তা করেই হয়তো এই ওয়াকওয়েটা তৈরী করেছে। এর পর নদীর বিশাল অংশের শুরু। শুরুটা কাশবনে বা কাইয়া বন দিয়ে আবৃত। একটু দূরেই বিশাল পদ্মা নদী। কাশবনে বেশ ‍কিছু দোকান গড়ে উঠেছে। প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে দিয়েছে ফুচকা-চটপটির দোকানিরা। স্কুলে কলেজে পড়ুয়া অনেককে দেখা গেলো। আছে মধ্য বয়সীসহ অনেক মানুষ। আমরা যেদিন গিয়েছি সেদিন শরতের প্রথম দিন। আমরা যেমন বলি ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত তেমনি কাশফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ শরৎ। কাশবন এখন ঘণ সবুজ। কিছুদিন পরই হয়তো সফেদ সাদা কাশফুল শোভা পাবে ঘাসের চুড়ায়। কাশবনের পরেই পদ্মার শুরু। এর পর দিগন্ত জোরা আকাশ। অপর প্রান্ত পর্যন্ত যতদূর চোখ যায় শুধু পদ্মাই। শরীয়তপুরের উপর দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মা, মেঘনা, কীর্তিনাশা নদী। পদ্মার একই রুপ, একই জল, প্রবাহও একই রকম। শুধু দৃশ্য একেক জায়গায় একেক রকম। অনুভবও একেক জায়গায় একেক রকম। পদ্মাপাড়ের মানুষ হয়ে পদ্মা দেখছি নয়ন ভরে শুধু আমাদের পদ্মা থেকে অনেক দূরে গিয়ে। 
পদ্মার পাড় দিয়ে হাটতে হাটতে একটা দোকানের সামনে গাছের নিচে পাতা চেয়ার-টেবিলে গিয়ে বসলাম। চেয়ারে বসতেই এক সেবক আসলো আমাদের সামনে। আমরা যেখানে বসেছি তার পাশ দিয়েই ছোট একটি পদ্মা বয়ে চলেছে। এর পর চরের বুকে কাশবন তারপর প্রমত্তা মূল পদ্মা নদী। পদ্মার শাখাটা দিয়ে ট্রলারে করে মানুষ ঘুরছে। সেখানে বসে বসে সৌন্দর্য খালি মুখে দেখলে কেমন হয়! তাই শামীম সরদার আর আমি কোল্ড কফি নিলাম। অল্প অল্প কফি খাচ্ছি আর বেশি সময় পার করে বেশি বেশি সৌন্দর্য দেখছি।পদ্মাকে ঘিরে এখানে তীর জুড়ে বিশাল ব্যবসা বাণিজ্য গড়ে উঠেছে। দোকানের সংখ্যা ও সাজ সজ্জা দেখলেই বুঝাযায় এখানে বিশাল এক বাণিজ্য গড়ে ইঠেছে যা দেশের মূল অর্থনীতিতে স্পর্শ করে। পদ্মা আমাদেরও আছে। কিন্তু আমাদের নেই সিদ্ধান্ত নেয়ার নেতা, নেই আন্তরিক আমলা। আমাদের পদ্মাকে ঘিরে শুধুই হাহাকার। ভাঙ্গছে ভাঙ্গছে বলে আমরা গলা ফাটাই। অথচ এখানে পরিকল্পিতভাবে পদ্মাকে নিয়ন্ত্রণ করে গড়ে উঠেছে ব্যবসা বাণিজ্য। আমরা যদি আমাদের পদ্মাপাড়কে এমন সুন্দর করে শাসন করে পর্যটন কেন্দ্র করে দিতাম তবে কক্সবাজার থেকে মানুষ আসতো পদ্মার রূপ দেখতে। পর্যটন এমন একটা শিল্প যা করে বহু দেশ এগিয়ে গেছে। বহু জেলার চিত্রই বদলে গেছে পর্যটনের কারনে। আমাদের দেশে সেই ছেলে কবে হবে, যে কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে? প্রশ্নটা বার বার মনে দোলা দিলো। উত্তর কেউ দিবে না সেটাও হৃদয় বলে দিলো আমাকে। তাইতো বিশ্বের সবচেয়ে বড় সৈকত কক্সবাজার থেকে আমরা কাঙ্খিত অর্থ উপার্যন করতে অক্ষম, তেমনি পদ্মার বড় একটা অংশ আমাদের থাকতেও সেটার সদব্যবহার করতে পারিনি।
দুপুর হয়ে গেছে। পেট জানান দিচ্ছে কৃমি মরে যাচ্ছে তোর! এবার কিছু খেতে হবে। নদীর পাড় থেকে চলে গেলাম হোটেলে। পদ্মাপাড়ের জেলায় এসে পদ্মার ইলিশ খাবো না সেকি হয়? তাই ইলিশ মাছ দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রামে গেলাম। সারা রাত জেগে সকালে বিশ্রামের নামে শরীর যতটুকু চার্য দিয়েছি তাতে আবার একটু ক্লান্ত অনুভব হচ্ছে। তাই দুপুরের খাবার খেয়ে বিশ্রামে গেলাম। সন্ধায় উঠে বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়। গাড়িতে করেই এদিক সেদিক ঘুরছি আর দেখছি। মাঝে মাঝে থেকে থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। প্রবল বর্ষণ বলা যাবে না। গুরিগুরি টাইপ বৃষ্টি। তাই কোথাও নামার চেয়ে গাড়িতে বসেই রুপ দেখা ভালো বলে মনে হলো।
রাত বারোটা বেজে গেছে। গভীর রাতই বলাযায়! রাজশাহী একটা মহানগর। মহানগরে রাত বারোটা তেমন গভীর রাত মনে হয়নি। মূল শহরে এখনও কিছুটা মানুষের চলাচল চোখে পড়ে। ঘুরতে গেলে এতটা আগে আমরা কখনোই বিশ্রামে যাই না। রাতের খাবার খাওয়া দরকার কথাটা মনে পড়তেই মনে হলো এখানে কালাইর রুটির খুব সুনাম আছে। কিছুদিন আগে আমাদের কয়েকজন আইনজীবী ভাই বেড়াতে এসেছিলো। তারাও কালাইর রুটি খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছে। সাথে সাথে ফোন দিলাম রোকনকে। রোকন বললো এটা উপ-শহরে পাওয়া যায়। এত রাতে উপ-শহর কোনদিকে খুজতে খুজতে শামীম সরদারের চোখে পড়লো একটা ঝুপড়ি ঘর। সেখানে এক মহিলা কি যেন ভাজছে। গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করতে করতে নিজেদের চোখেই ধরা পড়লো যে, মহিলা মোটা মোটা কালচে বর্ণের রুটি ভাজছে। রেল লাইনের পাশে রেল কর্তৃপক্ষের জায়গায় বসেছে দোকান। আমরা রুটি চাইলে আমাদের জানায় আজ আর হবে না। দুজন যুবক বসা। তাদের দশটা রুটির অর্ডার আছে। এর পর আর খামির করা নাই তাই দেয়া যাবে না। আমরা অনেক দূর থেকে এসেছি শুনে এবং আমাদের আগ্রহ দেখে চেয়ার দিলো বসতে। কারিগর বা দোকানি একজন হিলা, সেবক হিসাবে মহিলাকে সহায়তা করছে ছোট্ট শিশু এই সেই কালাইর রুটি! আমরা যখন গেছি তখন বেচাবিক্রি শেষ তবুও আমাদের অনুরোধে নতুন করে আটার খামির করে তিনটি রুটি তৈরী রে দিলো খাওয়ার মত উপাদানও তেমন নেই! শুধু পিয়াচ কুচি আগ্রহ দেখে আমাদের কিছু বেগুন ভর্তা রে দিলোদোকানি জানালো, বিভিন্ন প্রকার ভর্তা, হাসের মাংস, গরুর বট, গরুর মাংস দিয়ে খেতে হয়। সব বেচা হয়ে গেছে। পিয়াচকুচিটা ফ্রি দেয়া হয়, আমাদের কাছ থেকেও পেয়াজকুচির দাম নিলো না। শামীম সরদার সাথে পেলো গরুর বট বা ভুরি! আমি ওটা কোন কালেই খাইনি, আজও খেলাম না ত্রিশ টাকা রে প্রতিটি রুটির দাম। রুটির চেহারা দেখে মনে হলো খাদ্যাভাব লে হয়তো ত্রিশ পয়সায়ও কিনতাম না, কিন্তু নাম ডাকের কারনে তা ত্রিশ টাকায়ই কিনে খেলাম, তাও চেটেপুটে! মোটা, কালচে রুটিগুলো আমাদের এলাকার চডা পিঠা বা চাপটির মত যা আধুনিক মানুষেরা দোসা বলে তেমন দেখতে রুটিগুলো। স্বাদের কথা বললে বলবো-একেবারে মন্দ নয়, তবে প্রতিদিনের জন্য নয়।
আমাদের যে রুটি-পানি এগিয়ে দিয়ে সেবা করলো সেই সেবক ছেলেটা দেখতে খুবই ছোট। আমাদের চা-পানি এনে দিলো, এগিয়ে দিলো। আমাদের তিনটা রুটি দেয়ার পর একটা রুটি ছেলেটাকে খেতে দিলো দোকানি মহিলা। শামীম সরদার বটের প্লেট থেকে এক টুকরো মুখে দিয়ে ভালো না লাগায় রেখে দিয়েছিলো। সাথে তার চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায় প্রায় অর্ধেকটা রুটিও রেখে দিলো। সেবক ছেলেটা একটু দূরে বসে খাচ্ছে। আমি ওকে ডাক দিয়ে বললাম, বটটা নষ্ট হয়নি, আর খাবেও না। তুমি চাইলে খেতে পারো। শামীম বললো রুটিটাও নিয়ে যাও আমি আর খাবো না। ছেলেটা হাসি মুখে নিয়ে খেতে বসলো। এরই মাঝে পাশের চায়ের দোকানের আরেক সেবককে ডাক দিলো। ছেলেটা আসার পর তার অর্ধেকটা খাবার খেতে দিলো। দোকানি মহিলা তখন বললো, এটা ওর ভাই। ওরা দুই ভাই এই দুই দোকানে কাজ করে। দেখে খুব কষ্ট লাগলো আবার গর্বও হলো যে কাজ করে খায়। সবচেয়ে বেশি অবাক লাগলো ছোট ভাইয়ের প্রতি মমত্ববোধ দেখে। ভাইর জন্য বটের বেশিরভাগ অংশ রেখে খেয়েছে। আমাদের পাশের বেঞ্চে বসেই যখন ছোট্ট ছেলেটি খেতে শুরু করলো প্রথম লোকমা মুখে নিয়ে কিছুটা চিবুনোর পরে গিলার সময় গলায় আটকে গেলো। 
আমি দোকানের একটু বাইরের অংশে খোলা আকাশের নিচে ছেলেটার দিকে মুখ করে চেয়ারে বসে চা খাচ্ছিলাম। শামীম সরদার ছেলেটাকে পিছনে রেখে আমার দিকে মুখ করে চা খাচ্ছে। ছেলেটার ভাই গেছে পানি আনতে। ওর গলায় খাবার আটকে গেছে, চোখগুলো বড় বড় হয়ে মনে হচ্ছে বেরিয়ে যাচ্ছে এবং নিঃস্বাস নিতে পারছে না দেখে আমি দূর থেকে শামীমকে বললাম আমাদের পানির বোতলটা ওকে এগিয়ে দিতে। আমাদের পানির বোতলের মুখ খোলাই ছিলো। শামীম তারাতারি ঘুরে বোতলটা ছেলেটার হাতে দিয়ে বললো পানি খাও। ছেলেটা প্রচন্ড জোড়ে পানির বোতলের মুখ খোলার জন্য বোতলের মুখ মোচরাচ্ছে। আমি তখন ঐ দৃশ্যটা দেখে ওকে বললাম, বোতলের মুখ খোলাই আছে, তুমি পানি খাও তারাতারি। পরে পানি খেয়ে গলা থেকে নামালো। কালাইর রুটি একটু শক্ত শক্ত। বাচ্চা ছেলে, তারাহুরা করে খেতে গিয়ে গলায় আটগে গিয়েছে। পানিটা খাওয়ার পরে ওর চোখ দিয়ে পানি ঝড়ে পড়লো। এটা কোন কান্নার বা আবেগের অশ্রু নয়, ছোট ছেলেটার জন্য কষ্টের অশ্রু। ওর খাবার নেয়া দেখে এবং চোখের অশ্রু দেখে আমার হৃদয় নিংড়েও অশ্রুক্ষরণ হলো কিন্তু প্রকাশ করলাম না। ওকে বললাম, তুমি আস্তে আস্তে খাও, পানিটা তোমার কাছেই রাখো। পরদিন চলে আসলাম নিজ জেলায়। কিন্তু ছেলে দুটির মায়াভরা মুখ আর ছোট ছেলেটার গলায় খাবার আটকে যাওয়ার ও অশ্রু ঝড়ার দৃশ্যটা হৃদয় থেকে মুছতে পারছি না। আমরা কবে দারিদ্রতা গলা থেকে নামাতে পারবো? দারিদ্রতা আমাদের গলায় আটকে পানির অভাবে দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমরা কিছুই করতে পারছি না। আর কবে পারবো। স্বাধীনতার এতটা বছর পরেও কেন রাত বারোটার পরে শিশু দুই ভাইর দুই দোকানে কাজ করতে হয়!

2 comments: