ভালবাসি প্রকৃতি

ভালবাসি প্রকৃতি

Saturday, July 28, 2018

যেমন আছি লন্ডনে (প্রথম গ্রন্থ-উপন্যাসের পান্ডুলিপি)



যেমন আছি লন্ডনে
আসাদুজ্জামান জুয়েল










উৎসর্গ

প্রবাসী বাংলাদেশীদের উদ্দেশ্যে











ভূমিকা

প্রবাসী বাংলাদেশীরা বৈদেশীক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে বড় একটা ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। উন্নত হচ্ছে প্রতিটি মানুষের জীবনযাত্রা। এই এগিয়ে যাওয়ার পিছনে রয়েছে বিপ্লবদের ঘাম ঝড়ানো শ্রম। ঘরে ঘরে মোবাইল ফোন ব্যবহারের জনপ্রিয়তার পিছনেও রয়েছে বিপ্লবের মতো খেটে খাওয়া হাজারো মানুষের ছোঁয়া। যারা জীবন বাজি রেখে সমুদ্র পাড়ি দেয়, শুধুমাত্র তাদের প্রিয়জনদের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য। 

বিপ্লবরাও স্বপ্ন দেখে সুন্দর একটা ঘর বাঁধার। তাদের মাঝে কেউ কেউ সফল হয় কেউ কেউ হারিয়ে যায়, সময় ও বাস্তবতার অতল গহ্বরে। কেউ কেউ আবার হয়ে উঠে পরিবার, গ্রাম, সমাজ ও দেশ ছাপিয়ে বিশ্ব বরেণ্য। এমনই অতি সাধারণ এক স্বপ্নদ্রষ্টা বিপ্লব সংগ্রাম করে অসাধারণ কিছু করার। প্রতিনিয়ত ঘাত-প্রতিঘাত, বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে সে-ও একদিন খুঁজে পায় তার গন্তব্য। কিন্তু হারিয়ে ফেলে তারচেয়েও বেশি কিছু!! 










কেণ্ট ইংল্যান্ডের চমৎকার একটা কাউন্টি। প্রচুর আপেল বাগান আছে এই কাউন্টিটিতে। তাই কেন্টের চারদিকেই সবুজের সমারোহ। খুব বেশি বিদেশি মানুষ নেই এখানে। বেশিরভাগই মানুষই ইংলিশ। যদিও ইউরোপের বাকি দেশগুলো থেকে  প্রতিদিনই এখানে ভ্রমণ করতে প্রচুর মানুষ আসে। কিন্তু বিকেলেই আবার সবাই চলে যায়। কেণ্ট লন্ডন থেকেও খুব দূরে নয়। লন্ডন থেকে ট্রেনে কেণ্ট পৌঁছাতে দেড় ঘণ্টার মত লাগে।
পড়ন্ত বিকেল। ফুরফুরে হাওয়া বইছে। পার্কের বেঞ্চে বসে আছে ছেলেটি। হাতে একটি নকিয়া এন-৯৫ মডেলের মোবাইল ফোন। বয়স কত হবে? ত্রিশ কি বত্রিশ। মোটামুটি সুদর্শন, লম্বায় প্রায় ৬ ফুটের এর কাছাকাছি। নীল রঙের টি-শার্টে তাকে খুব মানায়। অবশ্য আজ পড়েছে  কালো রঙের শার্ট। 
মোবাইল সেটটি হাতে নিয়ে ভাবছে, এই মুহূর্তে কাকে ফোন করা যায়।  মা-বাবাকে তো রোজই ফোন করা হয়। শেষে মাকেই ফোন করে ছেলেটি। কিন্তুবাবা-মার সাথে আর কতক্ষণ কথা চালানো যায়! প্রতিদিনই এক কথা। প্রতিটি মানুষের জীবনেই কিছু বিষয় থাকে। যে বিষয় কারও সাথে শেয়ার করা যায় না। কিছু কিছু কথা আছে, যা বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে হয়। কথাগুলো বলে মনটা একটু হালকা করতে হয়, হালকা মন নিয়ে পথ চলা সহজ হয়। 
এসব ভেবে ও এখন ফোন বুকে বন্ধুদের লিস্ট খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার বন্ধুরাও এখন যে যার কাজে ব্যস্ত, সকালে ঘুম থেকে উঠে চাকরি কিংবা ব্যবসার কাজে দৌড়াতে হয়। আর এ কারণেই ওরা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে যাদের অফিস আছে তাদের ফোন করা ঠিক হবে না। কেননা বাংলাদেশে রাত এখন প্রায় ১১ টার মত বাজে।
তাহলে কাকে ফোন করবে বিপ্লব?
এই ভেবে সে ফোন করল তার সেই প্রিয় বন্ধু তিমিরকে। যার সাথে বিপ্লব ছোট বেলায় পড়েছে একই স্কূলে। ইংল্যান্ডে আসার পর থেকে বিপ্লবের যত বারই মন খারাপ হয়েছে তত বারই সে তিমিরের সাথে ফোনে কথা বলেছে। তার মনের মাঝে যত কথা আছে সবই সে শেয়ার করে তিমিরের সাথে। তিমির তার কথা সবসময় খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে। আগে জাতীয় দৈনিকে লেখালিখি করত তিমির। লেখালেখির কারণেই হোক কিংরা ওর স্বভাবের কারণেই হোক, মানুষকে খুব সহজে আপন করে নিতে পারে ও। এ কারণেও হয়ত বিপ্লবকে সে ভালভাবে বুঝতে পারে। তিমির বিপ্লবকে নানা কাজে সাহস যোগায়, উৎসাহ দেয়। যা বিপ্লবকে নতুন করে বেঁচে থাকার শক্তি জোগায়।
বিকেলের আলো মরে এসেছে। পার্কের চারিদিকে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। এখনও দু’চারটা কিশোর-কিশোরী এলোমেলো ছুটাছুটি করছে। একশ বছরের পুরনো বেঞ্চে হেলান দিয়ে বিপ্লব ভাবে বাংলাদেশের কথা যাতে গাঁথা আছে। হরেক রকম স্মৃতি! চাওয়া-না পাওয়া তার এই জীবনের হাজারও যোগ বিয়োগ।
বাংলাদেশ ছাড়ার পূর্বে বিপ্লব একটি নামকরা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে আইটি বিভাগে এক্সিকিউটিভ হিসেবে চাকরি করত। ভার্সিটিতে যখন সে পড়ত তখন তার প্রোগ্রামিংএ খুব ভাল দখল ছিল। স্বপ্ন ছিল একদিন একটা বড় কোম্পানিতে সিস্টেম এডমিন হিসাবে কাজ করবে। কিন্তু পরিবারের আর্থিক সামর্থের কথা ভেবে তাকে বেছে নিতে হয়েছিল এই প্রবাস জীবনের মত শর্টকাট রাস্তা। তার পরও তার ইচ্ছে ছিল একদিন ইংল্যান্ড থেকে বড় একটা ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরে সবাইকে চমকে দিবে। কিন্তু কীভাবে পার করেছে এই চারটা বছর! কেমন করেই বা সময়গুলো চলে গেল তার জীবন থেকে!
পেছন ফিরে তাকাতেই মনে পরে তার সব কথা। 
যেদিন যখন ও হিথ্রো এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছেছিল, তখন বিকেল তিনটা।
হিথ্রো থেকে তার ইষ্ট লন্ডন যেতে হবে একাই। জামসেদ নামের এক ছেলের বাসায় উঠবে বলে স্থির করেছে বিপ্লব। জামসেদের বাড়ি বিপ্লবের দাদার বাড়ির  এলাকায়। জামসেদের বাসায় থাকবার ব্যাপারটা বাংলাদেশ থেকেই ফোনে সব কিছু কনফার্ম করে এসেছে। জামসেদও তাই বিপ্লবকে ইমেইল করে জানিয়ে দিয়েছিল কীভাবে তার বাসায় যেতে হবে। আর ইমেইলটাও বেশ ইন্টারেস্টিং ছিল। বিপ্লব ইমেইলটা প্রিন্ট করে সাথে নিয়ে এসেছিল বাংলাদেশ থেকে। প্রিন্টেড কপিটা সে আবার দেখে নিল যেটা তার বুক পকেটে অতি যতনে অপেক্ষা করছিল হিথ্রো বিমান বন্দরের জন্য। 

Hi Biplob,
Welcome 2 Heathrow Airport, London. U may require a medical check-up. U will then be directed to counter 7, whr u will be able 2 collect ur baggage. There r signs 2 direct you 2 different airport facilities such as toilets, information stations and exits. If u require any help or advice, please consult the Police or a member of the Airport Assistance. Please make your way towards the London Underground Station via Heathrow. Once at the station, purchase a ticket from London Heathow to Stepheny Green Station. The ticket can be purchased by £5-6. It is advised u carry a London Undergound Tube map 4 help. Aboard the East-bound Picadilly line via Hammersmith, then continue on the East-bound District line via Stepheney Green. When u arrive at the station, find the nearest exit, cross the street. Continue 4 only 10 meters until u arrive on Ernest Street. 4 safety, please look left and right when u cross the roads. Continue 100 metres and find house number 22 on Ernest street.This is ur final destination. Please call 02077912413 via the nearby phone booths. Normal charges of 30 pence per session will apply. Or call Roney on 07780689306. I am sorry again and have a nice journey. Tc , Bye. Hi5

Jamsed


এই গাইড অনুযায়ী সে ইষ্ট লন্ডনের স্টেপনি গ্রিণ টিউব স্টেশনে ঠিকই চলে এল। কিন্তু এখানে আসার পর আর সে জামসেদের নির্দেশনা বুঝতে পারল না। কারণ এই স্টেশন থেকে ডানে বামে অনেক রাস্তা বের হয়ে গেছে। তাই সে ঠিক করলো জামসেদ যে ফোন নাম্বারগুলো দিয়েছিল তাতে ট্রাই করবে। কাছেই ফোন বুথ ছিল। যার থেকে পাবলিক ফোন করা যায়। বিপ্লব ফোন বুথের কাছে গেল। কাছে গিয়ে দেখে সেখানে লেখাÑ “ইনসার্ট ৩০ পেন্স টু কল।” কিন্তু ফোন করতে এসে সমস্যা দেখা দিল। ফোন বুথ থেকে ফোন করার জন্য ভাংতি পয়সা চাই। কিন্তু ওর কাছে আছেতো সব পাউন্ড কয়েন। ত্রিশ পেন্সের কয়েন কোথায় পাওয়া যাবে! এখন সে কি করবে ভেবে পায়না। কিন্তু ত্রিশ পেন্স যে মিনিমাম কল চার্য তা সে বুঝতে পারে না। ফোন বুথ থেকে বের হয়ে বিপ্লব একটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করলো, তার কাছে পাউন্ড কয়েন ভাংতি হবে কিনা? ছেলেটি বিপ্লবকে ৪০ পেন্স দিয়ে চলে গেল। লন্ডনে এমন অনেকে আছে যারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে পয়সা চায়। ছেলেটি বিপ্লবকে দেখে মনে করেছিল এমনই একজন হবে হয়ত। সাহায্যর জন্য হাত পেতেছে! 
বিপ্লব ফোন বুথে ত্রিশ পেন্স ফেলে জসিমের দেয়া ফোন নাম্বারে ফোন করে। কিন্তু কেউ ফোন রিসিভ করে না।
ফোন করার চেষ্টা বাদ দিয়ে সে বাসা খোঁজার চেষ্টা করতে শুরু করে। কয়েক জনকে জিজ্ঞেস করে সে আরনেস্ট স্ট্রীটটাও খুঁজে পেল। কিন্তু বাসাতো আর খুঁজে পাচ্ছে না। কারণ লন্ডনের বাসা নাম্বারগুলো জোড় আর বিজোড় সিরিয়ালে রাস্তার এপার ওপারে থাকে। যার ফলে সে ২১ এর পরে দেখে ২৩। তার মানে সে মনে করে এই রোডে তার বাসা না! তখনো তার ধারণা ছিল ঢাকার মত মনে হয় এই নাম্বারগুলোও এলামেলো ভাবে আছে।  
হঠাৎ একটি গাড়ি এসে থামলো বিপ্লবের গা ঘেঁষে। গাড়িতে একজন মাত্র লোক। বিপ্লবকে জিজ্ঞেস করলো, 
কোথায় যাবেন?
বিপ্লব উত্তর দিল, আরনেস্ট স্ট্রীট এর ২২ নাম্বার বাসায় যাব। 
বিপ্লবকে সে বলল, আরনেস্ট স্ট্রীটতো এখানে না। 
তুমি আমার সাথে গাড়িতে উঠো। আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিব। লোকটি এশিয়ান। লোকটিকে দেখে বিপ্লবের কেন যেন সন্দেহ হলো। তাছাড়া সে নিজেও দেখেছে এটাই আরনেস্ট স্ট্রীট।
এভাবে হাঁটতে হাঁটতে খুব ক্লান্ত হয়ে গেল সে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে বিপ্লব ২২ নাম্বার বাসাটা খুঁজে পেল কিন্তু ততক্ষণে প্রায় ২ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। লাগেজের অবস্থাটাও খুব খারাপ হয়ে গেছে। চাকার অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। লাগেজের অবস্থা যাই হোক বাসা খুঁজে পেয়ে বিপ্লবের খুব আনন্দ হলো। 
বাসায় নক করতেই রনি নামের চব্বিশ পঁচিশ বছরের একটা ছেলে বেরিয়ে এলো।
রনি বলল, কাকে চান?
বিপ্লব বলল, আমি জামসেদের বন্ধু। আজই বাংলাদেশ থেকে এসেছি। ও আমাকে এই বাসার ঠিকানা দিয়ে এখানে আসতে বলেছে। আমার সম্বন্ধে জামসেদ কি আপনাকে কিছু বলেছে?
জামসেদ ভাইতো এখানে থাকে না। কিন্তু আপনি যখন এসেছেন আমি ওনাকে ফোন করে জেনে নেব। আপনি ভিতরে আসুন। 
রনি ছেলেটা খুব ভাল। ঢাকা নটরডেম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ইউকেতে একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। কথায় কথায় রনির সাথে পরিচয় পর্বটা সেরে ফেলল বিপ্লব।  
ফ্রেস হয়ে বিপ্লব রনির সাথে বাইরে বের হয়। দুজনে মিলে এক প্যাক সিগারেট আর একটা কলিং কার্ড কিনে। অনেকক্ষণ সিগারেট খাওয়া হয় না। প্রায়ই ২০ ঘন্টা হয়ে গেছে। লন্ডনের রাস্তায় ধুমপান করা যায় কিনা বিপ্লব তা জানতে চায় রনির কাছে। 
রনি বলল, কোন সমস্যা নাই। আসুন আমরা সিগারেট খাই। 
অনেকক্ষণ পর বিপ্লবের মনে হল সে স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস নিচ্ছে।  
বাসায় এসে যখন সে ফোন করার সিস্টেমটা রনির কাছ থেকে শিখলো তখন বাংলাদেশে রাত প্রায়ই ২ টা বাজে। তার পরেও বিপ্লবের বাবা মা ছেলের ফোনের জন্য অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। বিপ্লব বাসার সবাইকে ফোন করে জানালো, আমি ভাল মত এসে পৌঁছেছি। তোমরা আমার জন্য কোন  চিন্তা কোরো না। আমি ভাল আছি। 
রাতে বাকি সবাই যখন বাসায় ফিরে আসে তখন সবাই বিপ্লবের সাথে পরিচিত হয়। এই বাসায় মাত্র ছ’জন ছেলে থাকে। সকলেই বাংলাদেশি। বিপ্লবের সাথে নানা বিষয় নিয়ে আলাপ হয় ওদের। ওরা সবাই ভিসার ব্যাপারেও জিজ্ঞেস করে তাকে। 
বিপ্লব উত্তর দেয় সে ওয়ার্কিং হলিডে ম্যাকার ভিসাতে এসেছে। দুই বছরের ভিসা। কাজ করার অনুমতি আছে এতে। 


এখানে মোটা মত একটা ছেলে আছে। ওজন প্রায় ৯০ কেজি হবে তার। নাম হুমায়ুন। ছেলেটা নিজেকে খুব স্মার্ট মনে করে। কিন্তু তার শরীরের যে অবস্থা তার পরেও সে বীয়ার খায়। 
বীয়ার খেতে খেতেই সে বিপ্লবকে জিজ্ঞেস করে, আপনি কবে এসেছেন লন্ডনে? 
বিপ্লব উত্তর দেয় আজকেই। 
হুমায়ুন হাসতে হাসতে বলে এই কথা, তা এখানে এলেন কীভাবে? 
বিপ্লব বলল, জামসেদ আমাকে এই বাসার ঠিকানা দিয়েছে।
হুমায়ুন বলল, ও আচ্ছা, আপনি জামসেদ ভাইয়ের গেস্ট।
সেদিন ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল খেলা হচ্ছিল। ব্রাজিলের মুখোমুখি ফ্রান্স। বিপ্লব উপরের তলায় যে রুমটায় টিভি আছে সেই রুমে গেল। এই রুমে থাকে হুমায়ূন। গিয়ে দেখে ঘর ভর্তি অগণিত বীয়ারের ক্যান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বীয়ারে যে এ্যালকোহল আছে তা বিপ্লব জানতো না। কিন্তু বিয়ার তো বাংলাদেশে বিক্রি হয় না বৈধভাবে। তাহলে হুমায়ূন বিয়ার খাওয়া শিখল কীভাবে।   
হুমায়ূন বলল, ভাইজান বীয়ার খাবেন?
বিপ্লব বলল, নো থ্যাঙ্কস। আমি বীয়ার খাই না। 
হুমায়ূন তখন বলল, নতুন এসেছেন তো তাই খান না। এক সময় দেখবেন ঠিকই বীয়ার ছাড়া চলবে না আপনার। বুঝলেন, এটাই লন্ডনের লাইফ। বীয়ার না খেলে লন্ডনে থাকার মজাই নাই। 
বিপ্লব বলে, আমি সিগারেট ছাড়া আর কিছু খাই না। 
ঘর ভর্তি মানুষ। রনি, আরিফ, তারেক আরো আনেক গেষ্ট ছিল তাদের সামনে বিপ্লবকে নিয়ে হুমায়ূনসহ আরও অনেকে নানা রকম তামাশা শুরু করতে লাগল। খেলায় ব্রাজিলের অবস্থা খুব খারাপ। হেরে যাবে মনে হচ্ছে। হেরে গেলে আর খেলতে পারবে না এই বিশ্বকাপে ব্রাজিল। বিপ্লব আবার ব্রাজিলের সাপোর্টার। সেই ছোটবেলায় যখন সে ব্রাজিলে বিখ্যাত ফুটবলার পেলের জীবনী পড়েছে বইতে, সেই তখন থেকেই সে ব্রাজিলের সমর্থন করে। কিন্তু ওর বন্ধুরা বেশির ভাগই আর্জেন্টিনার সাপোর্টার। আর এর বড় কারণ ম্যারাডোনা। শেষ তিনটা ওয়ার্ল্ডকাপে ব্রাজিল খুব ভাল খেলেছে। কিন্তু এইবার আর পারবে বলে মনে হচ্ছে না। বিপ্লব কাউকেই বুঝতে দিচ্ছেনা যে সে ব্রাজিলের সমর্থক। কারণ তাতে যদি সবাই তাকে নিয়ে আরো বেশি হাসাহাসি করে। শেষ পর্যন্ত ব্রাজিল হেরেই গেল। বিপ্লব তখন দেখলো তারেক এবং রনিও ব্রাজিলের সমর্থক ছিল। ব্রাজিল হেরে যাওয়ায় ওদেরও খুব মন খারাপ হল। 
ইংল্যান্ডের সামারে রাত ৯টা ৪৫ পর্যন্ত চাঁদের আলো থাকে। বিকালে সবাই ৪টার মধ্যে বাসায় চলে আসে। ওয়ার্ল্ড কাপের জোয়ারে বাসার সব ছেলেগুলো ফুটবল খেলতো পাশের মাঠেই। বিপ্লবও গেল ফুটবল খেলতে ওদের সাথে। 
অনেক দিন ফুটবল খেলা হয় না তার। ছেলেবেলায় তাদের গ্রামের বাড়ির সামনে, যে মাঠ ছিল তাতে গ্রামের সব ছেলেরা আসতো ফুটবল খেলতে। পাড়ার বৃদ্ধরা এবং ছোটরা তাদের সে খেলা দেখতো। মাঝে মাঝে এ পাড়ার সাথে ও পাড়ার ম্যাচ খেলতো তারা। পুরস্কার হিসাবে থাকতো চিরুনী এবং আয়না। চিরুনীগুলো নানান রঙের হতো। ভারি সুন্দর লাগতো দেখতে। তাছাড়া চিরুনী দামেও খুব সস্তা ছিল। খেলা শেষে যে দল বিজয়ী হতো তারা মিছিল করে ঘুরে বেড়াতো সমস্ত গ্রাম।
আজ লন্ডনের মাটিতে এতো বছর পর বিপ্লবের ফুটবল খেলতে গিয়ে সে দিনগুলোর কথা মনে পরে যায়। এখানে কোন দর্শক নেই। কয়েকটি ছেলে ব্যস্ত জীবনের একটু অবসরে নিজেদের মধ্যে দুই ভাগে ভাগ হয়ে ফুটবল খেলে কিছুটা বিনোদনের চেষ্টা করছে আর কি। 
দেখতে দেখতে তিন দিন চলে যায়। এরই মাঝে একদিন সে বিখ্যাত লন্ডন ব্রীজেও ঘুরতে যায়। রনি বলেছিল, টিউব দিয়ে গেলে টাওয়ার হিল স্টেশনে নামতে হবে। টাওয়ার হিল স্টেশন থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটা পথের দূরত্ব। গেলেই চোখে পড়বে টাওয়ার ব্রীজ। 
সেদিন বিপ্লব বিকাল ৪ টার সময় বের হল বাসা থেকে। টাওয়ার ব্রীজ যখন এসে পৌঁছল তখন পৌনে পাঁচটার মত বাজে। খুব সুন্দর একটা বিকেল। সূর্যটা যেন আড়াআড়ি ভাবে লন্ডন ব্রীজের উপর এসে পড়েছে। বিকেলের নরম আলো এসে পড়ে পাথরগুলোকে যেন আরো আলোকিত করে তুলেছে। এ এক অপার্থিব দৃশ্য। মন জুড়িয়ে যায়। এমন সুন্দর দৃশ্য সে আগে কখনো দেখেনি। দেখেছে শুধু নাটক-সিনেমাতে। হাজার হাজার পর্যটক প্রতিদিন আসে এই ব্রীজে ঘুরতে। ছবি তোলে এখানে দাঁড়িয়ে। প্রায় সবার হাতেই ক্যামেরা। কেউ ছবি তুলছে, কেউ তাকিয়ে আছে টেমসের দিকে। টেমস নদীটাই মনে হয় লন্ডনের সৌন্দর্যকে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। চারদিক অনেক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কোথাও এক টুকরো কাগজ নেই। দেখে খুব ভাল লাগে বিপ্লবের। পৃথিবীর হাজারো রকমের মানুষ আসে এখানে। এই জায়গাটাকে বলতে হয় রূপবতী ক্যাপিটাল অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড এর একটি অলংকার। 
ক্ষণিকের জন্য বিপ্লবের বাংলাদেশকে মনে পড়ে যায়। মানুষের এই একটা স্বভাব। সব কিছুর মধ্যে সে নিজের মিল খুঁজে বেড়ায়। অথচ এই লন্ডন ব্রীজের সাথে ঢাকার ধানমন্ডি লেকের কোন মিল নাই। এখানে বিশ্বের সব রকমের মানুষ আসে, আর ধানমন্ডি লেকে আসে শুধু বাংলাদেশের মানুষ। কিন্তু তারপরেও একটা অন্ত মিল যেন রয়ে গেছে। দুইটাই চিত্ত বিনোদনের জায়াগা। সবাই প্রাণ খুলে আনন্দ করে সেখানে। বসে বসে গল্প করে দুই জায়গাতেই। 



ব্রীজের ঠিক উঠার শুরুতেই বিপ্লবের চোখে পড়ে সতের আঠার বছর বয়সের একটি ছেলে একটি বিজ্ঞাপন বোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিজ্ঞাপনটা একটা রেস্টুরেন্টের। সে দেখে অবাক হয়। এইভাবে এত বড় একটা বোর্ড নিয়ে এতটুকু ছেলে কীভাবে দাঁড়িয়ে আছে! ছেলেটির কাছে এগিয়ে  যায় সে। তার সাথে পরিচিত হয়। প্রায় ত্রিশ মিনিটের মত ছেলেটির সাথে কথা বলে বিপ্লব। ছেলেটি এসেছে পোল্যান্ড থেকে। এই সামারে সে ইংল্যান্ডে এসেছে বাড়তি কিছু ইনকাম করার জন্য। ওকে ৫ পাউন্ড প্রতি ঘন্টা হিসাবে দেয় রেস্টুরেন্টটি। ছেলেটির কাজের প্রতি আগ্রহ দেখে বিপ্লবও যেন নতুন করে নিজেকে ফিরে পায়। ও মনে মনে স্থির করে তাকেও কাজ খুঁজতে হবে। এভাবে ঘুরে ফিরে খেলে তো অল্প দিনেই তার সব টাকা শেষ হয়ে যাবে। 
রাত দশটার সময় বিপ্লব যখন বাসায় আসে, দেখে বাসা ভর্তি দশ থেকে বারোজন ছেলে মেয়ে। বাসায় আজ পার্টির আয়োজন করেছে। রনির বন্ধুদের মধ্যে যারা বিয়ে করেছে তাদের বউসহ এসেছে পার্টিতে। রান্না করছে আরিফ। চুলগুলো বেশ লম্বা ছেলেটার। ও নাকি এখানকার মধ্যে সবচেয়ে জিনিয়াস। কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে আইটিতে। এখন এম.এস করছে। খুব ভাল রেজাল্ট তার। আরিফের আরো একটা গুণ আছে। সে খুব ভাল গীটার বাজাতে পারে। রাতে তাই খাওয়া দাওয়ার পর সবাই মিলে সঙ্গীত সন্ধ্যার আয়োজন করে। গীটারের সাথে গলা ছেড়ে একাকার হয়ে গান গায় বিদেশ বিভূইয়ে কয়েকজন তরুণ তরুনী। বিপ্লবের গলায়ও জেমসের গান খুব ভাল মানায়। সেও গান ধরে, সুন্দুরীতমা আমার, তুমি নীলিমার দিকে তাকিয়ে বলতে পার, এই আকাশ আমার।
অতিথিদের মধ্যে একজন ছিল যার নাম তুষার। ও জামসেদের বন্ধু। নিজে থেকেই বিপ্লবের সাথে কথা বলল।
কি খবর বিপ্লব?
বিপ্লব উত্তর দেয়, এইতো। ভাল আছি। 
তুষার বলে, তুমি কি কোথাও জবের জন্য যোগাযোগ করেছো?
সে বলে, না। এখনও তেমন ভাবে চেষ্টা করিনি। 
তুষার তখন বলল,
কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে হোয়াইটচ্যাপেলের কাছে কমার্শিয়াল রোডের জব সেন্টার প্লাসে যাবে। ওখানে কম্পানিগুলোর জব অফার থাকে। তুমি ফরমগুলো নিয়ে আসবে এবং পুরণ করে এ্যাপ্লাই করবে। জব পাও আর না পাও সবগুলোতেই এ্যাপ্লাই করবে। ঠিক আছে?
বিপ্লব মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে।
তুষার বলল, জব সেন্টারপ্লাস থেকে ন্যাশনাল ইন্সুরেন্স নাম্বারের জন্য ইন্টারভিউর বুকিং দেয়া যায়। ন্যাশনাল ইন্সুরেন্স নাম্বার ছাড়া তোমার ইংলিশ কাজ পেতে অনেক কষ্ট হবে। একটু খোঁজ নিবে ওখানেও।  আর যদি বাংলা জব করতে চাও তাহলে ব্রিকলেনে চলে যাবে। হোয়াইটচ্যাপেল থেকে সোজা গেলে আলতাফ আলী পার্কের ঠিক অপজিটে ব্রিকলেন। ওখানে অনেক বাঙালি জব সেন্টার আছে। তাদের কাছে গেলে রেস্টুরেন্টের জব পাওয়া যায়। তোমাকে জব দেয়ার জন্য তারা বিশ পাউন্ড চার্য করবে। তবে রেস্টুরেন্টে জব করা খবই কষ্টের। তাই তুমি যদি ইংলিশ কোন জব না পাও তবেই শুধু রেস্টুরেন্টের জবে যাবে। আমি বলব আগে ইংলিশ জবের ট্রাই কর।
   

পরের দিন সকাল ৯টায় ঘুম থেকে উঠে বিপ্লব। গোসল করে বের হয়ে যায় জব খোঁজার চেষ্টায়। যেতে যেতে কমার্শিয়াল রোডের জব সেন্টারপ্লাসও পেয়ে গেল। ও দেখে জব সেন্টারপ্লাসে অনেক মানুষ। সবাই জব খুঁজছে। অনেকগুলো মেশিন আছে। টাচ স্ক্রিন মেশিন। কম্পিউটারের মত অনেকটা। তাতে জব লিষ্ট আছে এবং এখান থেকে সরাসরি জব প্রিন্ট করা যায়। যা বিভিন্ন কোম্পানি বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। বিপ্লব দশ পনেরটা জব বিজ্ঞপ্তি প্রিন্ট করে আনে সেখান থেকে। 
কমার্শিয়াল রোডের অফিস থেকে বের হয়ে সে আবার হোয়াইটচ্যাপেলে চলে এলো। হোয়াইটচ্যাপেল যা কিনা দেখতে পুরো বাংলাদেশ। পুরো হোয়াইটচ্যাপেল জুরে সব বাংলাদেশিদের দোকান। শাড়ি, লুঙ্গি থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সব কিছু এখানে পাওয়া যায়। ঢাকার ফুটপাথে যেমন দোকানিরা দোকানের পসরা নিয়ে বসে এখানেও তেমন করে বসেছে। ফুটপাতে বাহারি পণ্য নিয়ে বসে গেছে তারা। তাজা শাক সবজি, জামাকাপড়, পুরোনো মোবাইল সেট, কলিং কার্ড, ডিভিডি, জুতা, স্যান্ডেলের দোকানে সাজানো এই হোয়াইটচ্যাপল। ঢাকার মতই তারা কাস্টমারদের শব্দ করে ডাকছে।
ফুটপাতের এ অবস্থা দেখে খুব মজা পেল বিপ্লব। বাংলাদেশের ঢাকা শহরের চিত্র ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। এ যেন নিউ মার্কেটের ফুটপাত! সবখানেই শুধু বাঙালি। এত বাঙালি যে লন্ডনে থাকতে পারে তা জীবনেও ভাবেনি বিপ্লব। 
এই হকার্স মার্কেট থেকেই সে টি-মোবাইলের একটি পে.এন.গো মানে প্রিপেইড সিম কার্ড এবং নকিয়া ৩৩১০ মডেলের একটি মোবাইল ফোনসেট কিনলো। সব মিলে খরচ পড়লো তার ত্রিশ পাউন্ড।
লন্ডনে এসে এই প্রথম বিপ্লবের নিজস্ব একটা নাম্বার হলো। একান্তই নিজের নাম্বার। খুশিতে তার নাচতে ইচ্ছে করল। কারণ সে এখন সবখানে তার এই নাম্বারটা ব্যবহার করতে পারবে।   
হাঁটতে হাঁটতে সে ব্রিকলেন খুঁজতে লাগলো। তুষার ভাই বলেছে ব্রিকলেনে গেলে নাকি রেস্টুরেন্টের জব পাওয়া যায়। তারই কথামত আলতাফ আলী পার্কও পেয়ে যায় কয়েক মিনিটের মধ্যে। সেখানে মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির একটা ক্যাম্পাস আছে। ইষ্ট লন্ডনে যে একটা শহীদ মিনার আর এত বড় একটা মসজিদ পাওয়া যাবে এটা চিন্তাও করেনি ও। শহীদ মিনারটি আলতাফ আলী পার্কেই। আর এই পার্কটিই ক্যাম্পাসের চিত্রটি অনেক খানি পাল্টে দিয়েছে। শহীদ মিনারের আশে পাশে নানান দেশের ছাত্র-ছাত্রীরা গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে। দেখতে আমাদের ঢাকা ইউনিভার্সিটির টিএসসির মত লাগলো তার কাছে। 
এখানে এসে বিপ্লব একটা ব্রিটিশ মেয়েকে জিজ্ঞেস করল, ব্রিকলেনটা কোন দিকে?
মেয়েটা উত্তর দিলো, তুমি রাস্তাটা ক্রস করলেই ব্রিকলেন পাবে। 
বিপ্লব তাকে ধন্যবাদ দিল এবং রাস্তা ক্রস করে ব্রিকলেনে চলে গেল। 

ব্রিকলেন হচ্ছে বাংলাদেশি মানুষের ব্যবসা বাণিজ্যের অন্যতম প্রাণ কেন্দ্র। রাস্তার দুই পাশে অগণিত ছোট বড় রেস্টুরেন্ট। ইন্ডিয়ান কারি স্ট্রীট নামে এই ব্রিকলেন পরিচিত সবার কাছে। এগুলো আসলে বাংলাদেশি মানুষেরাই চালায়।
রেস্টুরেন্ট যেমন আছে এখানে তেমনি আছে ট্রাভেল হাউস মানি ট্রান্সফার সার্ভিস এবং বাংলাদেশি জব সেন্টার। আসলে জব সেন্টারগুলোর কাজ হচ্ছে সারা ইউকেতে যে মোট সাত আট হাজার রেস্টুরেন্ট আছে তাতে লোক পাঠানো। জব সেন্টারগুলো আসলে রেস্টুরেন্ট মালিকদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। যদি কোন রেস্টুরেন্টে লোকের দরকার হয় তারা এই জব সেন্টারগুলোতে লোক চেয়ে ফোন করে। আবার যারা কাজে যেতে চায় তারাও এখানে আসে কাজ খুঁজতে। ইউকের প্রায় সব ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টই বাঙালিদের। তাই তারা বাঙালিদের কাজে নিতেই বেশি পছন্দ করে। যেন ভাষাগত সমস্যা  না হয়।   
প্রথম অবস্থায় কাজে গেলে সবাইকে হয় কিচেন পোর্টার অথবা এ্যাসিসটেন্ট ওয়েটার হিসাবেই কাজ করতে হয়। বেতন সপ্তাহে একশ থেকে একশ বিশ পাউন্ড সাথে থাকা খাওয়া ফ্রি। 

বিপ্লব একটা জব সেন্টারে গেল। সেখানে এক ভদ্র মহিলাকে পেল। মহিলা টেলিফোন নিয়ে খুব ব্যস্ত। 
অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বিপ্লব তার কাছে জানতে চাইল,
আপা, আপনাদের এখানে কি কোন জব আছে?
ভদ্র মহিলা তার ডায়েরী উল্টিয়ে দেখে বললেন, তুমি বাংলাদেশ থেকে কবে এসেছো?
বিপ্লব জবাব দিল, এই তো তিন চারদিন হল এসেছি। ওয়ার্কিং হলিডে মেকার ভিসা আমার। 
ভদ্রমহিলা তখন বললেন, একটা জব আছে লিডসে, কিচেন পোর্টারের। কিন্তু তোমাকে দেখেতো মনে হচ্ছে তুমি কিচেন পোর্টারের কাজ করতে পারবে না। তুমি যদি মোটামুটি ইংরেজিতে কথা বলতে পারো তাহলে এ্যাসিসটেন্ট ওয়েটার হিসেবে কাজে গেলে তোমার জন্য সুবিধা হবে। কেননা কিচেন পোর্টারের জব অনেক কঠিন। থালা বাটি ধুতে হয়। তাছাড়া মাঝে মাঝে গরম পানি থাকে না। তখন খুব কষ্ট হয় এই কাজে। ঠান্ডা পানি দিয়ে কাজ করে অনেকের হাতেই ইনফেকশন হয় প্রথমে। 
তাছাড়া তোমাকে তো দেখে মনে হচ্ছে তুমি পড়াশুনা জানা মানুষ। তুমি এক কাজ কর। দুই-একটা দিন দেরি কর আমি দেখি তোমার জন্য এ্যাসিসটেন্ট ওয়েটারের একটা জব ম্যানেজ করতে পারি কিনা। তোমার নাম্বারটা রেখে যাও। জব পেলে আমি তোমাকে ফোন করবো। 
বিপ্লব সাথে সাথে তার নাম্বারটা দিয়ে দিল। সিম কার্ডটাতো সে আজই কিনেছে। খুব কাজে লাগলো। মনে মনে খুশি হল মোবাইল কিনে বড় একটা উপকার হয়েছে। 
জব সেন্টার থেকে বের হয়ে বিপ্লব টের পেল তার খুব খিদে পেয়েছে। এখানে সবই বাংলাদেশি খাবার তাই চলে গেল একটা রেস্টুরেন্টে। একটা কোল্ড ড্রিংকস দুইটা পরোটা এবং চানা ডাল নিয়ে বসল ও। এ দিয়েই সে তার লাঞ্চটা সেরে ফেললো। দুপুরের খাবার খেতে তার খরচা হলো ৭ পাউন্ডের মত। সাথে সাথে হিসাব করলো ৭ পাউন্ডে বাংলাদেশের কত টাকা হয়? একটু চিন্তা করেই বের করে ফেললো প্রায়ই ১০০০ টাকার মত! 
কি বলে! একবেলা হালকা নাস্তাতেই যদি ১০০০ টাকা শেষ হয়ে যায় তাহলে তার কাছে যত টাকা আছে তা দিয়েতো ১৫ দিনের বেশি চলতে পারবে না, যদি কাজ না পায়। এদিকে তার ধুমপানের অভ্যাস আগে থেকেই। ধুমপায়ীদের জন্য ইউকেতে সব থেকে বড় সমস্যা হচ্ছে এখানে আবার প্যাকেট ছাড়া সিগারেট বিক্রি হয় না। মন চাইলেই বাংলাদেশের মত এক শলা সিগারেট কেনা সম্ভব নয়। পুরো প্যাকেট ধরে কিনতে হয়। এক প্যাকেট ব্যানসন এন্ড হেজেস সিগারেটের দাম সাড়ে পাঁচ পাউন্ডের মত। মনে মনে ঠিক করে জব তাকে পেতেই হবে দু’একদিনের মধ্যে। দরকার হলে কিচেন পোর্টারের কাজেই যাবে। সমস্যা কি, যত কষ্টই হোক তাকে যে কাজ করতেই হবে। 
হাঁটতে হাঁটতে সে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে গেল। সামনেই আলতাফ আলী পার্ক। এই পার্কে নানান রঙের ছেলে মেয়েরা আড্ডা দিচ্ছে। সে ভাবে, আহ্ স্টুডেন্ট লাইফটা কতই না মজার ছিল। যদি আবার ঐ জীবনে ফিরে যেতে পারতাম! বাবার থেকে কারণে অকারণে নানান উপলক্ষে কত টাকাইনা এনেছিল স্টুডেন্ট লাইফে! 
বন্ধুদের সাথে আড্ডা। বিকেল বেলা টিএসসিতে গিয়ে সবাই মিলে গলা ছেড়ে গান ধরা। রাত তিনটার সময় ধুমকেতু দেখতে আগারগাঁওয়ের মাঠে গিয়ে বিছানার চাদর পেতে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা। অথবা থার্টিফার্স্ট নাইটে সারারাত বাইরে ঘুরে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফেরা। এই প্রোগ্রাম সেই প্রোগ্রাম, বছর ভরেই উৎসব। ফিল্ম ফেয়ারে বিদেশি ছবি দেখেইতো কাটিয়ে দিয়েছে সেই ইউনিভার্সিটি লাইফটা।  
বিপ্লব বুঝতে পারে পৃথিবীর ব্যস্ততম নগরীতে এসে এইভাবে তার আর নিজেকে চিন্তা করলে চলবে না। এখানে টাকা না থাকলে নাকি বাবাও ছেলেকে খাওয়ায় না। এটাই এই দেশের কালচার। সবাই জানে এখানে সবাই কমার্শিয়াল। সবাই এখানে স্বার্থ খোঁজে। বিনা স্বার্থে কারো এক মিনিটেরও সময় নেই কারো সাথে কথা বলার। 

বিপ্লব যখন বাসায় ফিরে এলো তখন বিকেল পাঁচটার মত বাজে। বাসায় এসে দেখে রনি ভাত রান্না করছে। লন্ডনে স্টুডেন্টরা দিনে একবারই রান্না করে। শুধু রাতের জন্য। প্রতিদিন একজন পালা করে রান্না করে। সপ্তাহে যার যেদিন ডে অফ থাকে সে সেদিন রান্না করে। আর যার রান্না করার দায়িত্ব থাকে তাকেই বাজার করতে হয়। বাকিরা যার যার সময়মত শুধু খায়। যে পরিমাণ রান্না করা হয় তা পরদিন দুপুর পর্যন্ত থাকে। আসলে কারো খাওয়ার সময়ও  যেন নেই এখানে। রনি রান্না করছে এবং ল্যান্ড লাইনটা কিচেনে নিয়ে যেয়ে বাংলাদেশে ফোনে কথা বলছে। বিপ্লব এসে রনিকে রান্নায় সহযোগিতা করল। আর রনির যখন ফোনে কথা বলা শেষ হলো তখন তার কাছে সব বলল আজকে কোথায় কোথায় গিয়েছিল সে।  
রনি বলল, হয়ে যাবে ভাইয়া, কোন চিন্তা করবেন না। রেস্টুরেন্টে যদি যেতে চান তাহলেতো একদিনের মধ্যেই জব পেয়ে যাবেন। 
আসলে লন্ডনে রনি, আরিফদের মত ছাত্র যারা আছে, তারা শুধু পড়াশুনা করার জন্যই লন্ডন থাকে, তাদের কাছে রেস্টুরেন্ট জব হল একদম লো লেভেলের জব। কারণ তাদের মতে রেস্টুরেন্টে জবে গেলে স্টুডেন্ট লাইফে আর ফিরে আসা যায় না। বছরের পর বছর লন্ডনে থাকা হয়ে যায় কিন্তু কোথাও আর পড়াশুনা করা হয় না। অথচ বাংলা রেস্টুরেন্ট জব এবং ইংলিশ জবের মধ্যে পার্থক্যটি বুঝতে বিপ্লবের প্রায় এক বছর লেগে গিয়েছিল। 


রনিদের বাসার পিছনের দিকে চমৎকার একটি বাগান আছে। ইংল্যান্ডের প্রায় সব বাড়িতেই ছোট বড় একটা বাগানের মত থাকে। কারো অতি যতনে লালন করা বাগানে ফুল ফুটে আবার কারোটা খালিই পড়ে থাকে। তবে এই গার্ডেনটায় অনেক পুরোনো কিছু ফুল গাছ রয়েছে। রনিরা কোন যতœ নেয় না। একটা বেঞ্চ পাতা আছে শুধু। এখানে বসে সবাই মনে হয় বিড়ি সিগারেট খায়। অথবা ফোনে নিরিবিলি কথা বলে। 
এই বাগানে বসে সদ্য কেনা মোবাইল ফোনটাতে নাম্বার সেভ করছে বিপ্লব। যে ফোন লিষ্টটা সে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে এসেছিল। সেই লিষ্ট থেকে নাম্বারগুলো ফোনবুকে সেভ করতে করতে পরীর নাম্বারটাও এল একসময়। পরীকে সে আজও বলতে পারেনি, যে সে তাকে ভালবাসে। অথচ বিপ্লব প্রতি মুহূর্তে পরীকে দেখতে পায় তারই চোখের সামনে। ভালবাসা এরকমই হয়। না বলা ভালবাসা যে কত গভীর হতে পারে তা বিপ্লবের হৃদয়টা না দেখলে বুঝা যাবে না। অব্যক্ত ভালাবসায় ওর মনটা যেন আচ্ছন্ন হয়ে থাকে সারাক্ষণ।
পরী একটা মিষ্টি মেয়ে। সর্বক্ষণ হাসি খুশি। গোলগাল চেহারা। খুব সুন্দর করে কথা বলে পরী। খুব বেশি লম্বা না তবে গায়ের রংটা খুব ফর্সা। ফর্সা মেয়েদের যে কোন ড্রেসে খুব ভাল মানিয়ে যায়। দেখতেও অপরূপা মনে হয়। তার পরেও পরীকে লাল রংয়ের ড্রেসে অসম্ভব সুন্দর লাগে। দেখলেই হৃদয়ের গভীরে এটকা ভাললাগা ভাব জেগে ওঠে। বিপ্লবের চোখে সে অপরুপা। স্নিগ্ধতায় ভরপুর এক মায়াবী রূপ পরীর। মিশুক প্রকৃতির মেয়ে এই পরী। সবাইকে খুব সহজে বুঝতে পারে। কোন সমস্যা হয় না তার যে কোন পরিস্থিতি সামলে নিতে। আর এজন্যেই পরীর প্রতি ওর এত টান, এত ভালবাসা। পরীকে ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না বিপ্লব।
সেই ছেলেবেলা থেকে পরীকে চিনে সে। সম্পর্কে ওদের কেমন যেন আত্মীয় হয়। বিপ্লব যখন ক্লাস টেনে পড়ে তখন পরীর ছোট খালার বিয়ে হয়। বিয়েতে পরীরা এসেছিল বেড়াতে। বিয়ের ধুমধামের সাথে সাথে কখন যেন পরীর প্রেমের পড়ে যায় বিপ্লব, সে কথা বিপ্লবেরও মনে নেই।
কিন্তু সেসময় পরীদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা বিপ্লবদের চেয়ে অনেক ভাল ছিল। তাদের চিন্তা-ধারণায় ছিল আধুনিকতার ছোঁয়া। তাছাড়া পরীরা ঢাকায় থাকত। সে হিসেবে পরী অনেক স্মার্ট একটা মেয়ে। অথচ বিপ্লব মফস্বল শহরে পড়াশুনা করা একটি ছেলে। সম্পর্কটা একেবারেই বেমানান। কিন্তু একটা কথা আছে না, ভাললাগা কখনও জানিয়ে আসে না। একটু একটু করে কারো প্রতি ভালবাসা তৈরি হয়। আবার কাউকে এক নজরেই ভাল লাগে। সেদিনের পরীর প্রতি এই ভাল লাগাটা নিতান্তই ছেলে খেলা ছিল না। কেননা আজও পরীকে যে সে তার মনের মধ্যে আগলে রেখেছে। এমনওতো হতে পারে পরীর জন্যই সে লন্ডনে এসেছে। যদিও বিপ্লবের সে খবর কেউই জানে না। কোনদিন জানতেও চায়নি কেউ।    


এখন সময় পাল্টেছে। অনেক পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় বিপ্লবদের অবস্থাও আগের চেয়ে অনেক বদলে গেছে। ঢাকাতে নিজেদের বাড়িতে থাকে ওরা। 
বিপ্লবদের বাসা থেকে পরীদের বাসায় যেতে প্রায় দুই ঘন্টার মত লাগে। বিপ্লব যখন ভার্সিটিতে পড়ে তখন থেকেই পরীদের বাসায় সে যেত মাঝে মাঝে। পরীর বাবার কম্পিউটারের প্রতি খুব ঝোঁক ছিল। বিপ্লবের কাছ থেকে সে কম্পিউটার সম্বন্ধে অনেকে কিছু জানার চেষ্টা করতো। বিপ্লবও তাকে খুব সম্মান করতো। অথবা পরীদের বাসায় আসার সুযোগের জন্যও হয়ত তাকে কম্পিউটারের অনেক জটিল বিষয়গুলো বলতো গল্পের ছলে। এ জন্যই পরীর বাবা বিপ্লবকে খুব পছন্দ করতো। এইতো লন্ডনে আসার আগের দিনও পরীদের বাসায় গিয়েছিল বিপ্লব। সকাল ৮টার দিকে পরীদের বাসার কলিংবেল টিপতেই পরী তার কেবল ঘুম থেকে উঠা মুখটা জানালা দিয়ে বের করে বলেছিলÑ 
কি খবর লন্ডনী সাহেব? 
কেমন আছো?
তুমি লন্ডনে যাচ্ছো এটা জানানোর প্রয়োজনও মনে করলা না। আমি ওর কাছে, তার কাছে তোমার খবর পাই।
বিপ্লব তখন বলেছিল, শুধু এ কথাটা বলতেই তো চলে এলাম। তোমাদের সাথে একটু দেখাও করে যাই। তোমাকে না বলে কি যাওয়া যায়?
পরীরা সেদিন কক্সবাজার যাচ্ছিল। দশটার সময় বাস। তাই ওদেরও খুব  ব্যস্ততা ছিল সেদিন। তবুও বিপ্লব পনের বিশ মিনিটের মত কাটিয়েছিল পরীদের বাসায়। চা খেয়ে তারপর চলে এসেছিল। আসার আগে পরী বিপ্লবকে বলেছিল লন্ডনে গিয়ে ভুলে যেও না,  মেইল করো কিন্তু। 


পরীর নম্বর ভুল হবার কথা নয়, তবুও বিপ্লব নাম্বারটা আবার মিলিয়ে নিল। তার পর নতুন মোবাইল দিয়ে প্রথম টেক্সটটা পরীকেই করলো সে। বিপ্লবের প্রথম লন্ডনের নাম্বারটা বাংলাদেশে যে পেল সে আর কেউ নয়, পরী। 
প্রায় একঘন্টা পর পরী এসএমএস ব্যাক করলো। তাতে লিখেছিল, কেমন আছো? কেমন লাগছে নতুন পরিবেশ? ভাল থেকো। 
এই একটা ছোট্র কথা ‘ভাল থেকো’ এটাও বিপ্লবের কাছে অনেক বড়। সারা রাত ধরে পরীর কথা চিন্তা করতে থাকে কেননা পরী যে তার জীবনের সব। তাকে নিয়ে ঘর বাধার স্বপ্ন দেখে সে। পৃথিবীর সবকিছু ছেড়ে দিতে পারে, কিন্তু পরী ছাড়া তার জীবনকে সে ভাবতে পারে না। 
পুরোনো কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়লো, তা আর মনে নেই। 
সকাল দশটার সময় ঘুম ভাঙলো বিপ্লবের। ফ্রেস হয়ে গত রাতের ভাত এবং ডাল ছিল তা মাইক্রো ওভেনে গরম করে খেয়ে বেরিয়ে পড়ল ব্রিকলেনের দিকে। হেঁটে যেতেই তার বেশি পছন্দ। হাঁটার সময় চারিদিকের  সব কিছু দেখা যায়। ইষ্ট লন্ডন হসপিটালের কাছে যখন সে এল তখন কালো একটা লোকের সাথে দেখা। দেখে মাতালের মত মনে হলো তাকে। সিগারেট চাইলো তার কাছে। ও খুব ভদ্রভাবে তাকে সরি বলল। লন্ডনে প্রায়ই দেখা যায় এই জাতীয় লোকদের। হঠাৎ করে কাউকে থামিয়ে সিগারেট চায়। তারা লোক দেখেই বুঝতে পারে কে নতুন এসেছে আর কে লন্ডনে অনেক দিন ধরে আছে। ব্যাপারটা অনেকটা ঢাকার পকেটমারদের মত। 
ব্রিকলেনে যখন সে পৌঁছালো তখন বেলা সাড়ে এগারোটা। সোনালী ব্যাংকের যে শাখাটা আছে ব্রিকলেনে তাতে গিয়ে খোঁজ নিলো কীভাবে একাউন্ট ওপেন করা যায়। তারা জানাল প্রুফ অফ আইডি ও এড্রেস লাগবে। কিন্তু বিপ্লবের তো প্রুফ বাসার এ্যাড্রেস নেই। সে তো কয়েকদিন হলো লন্ডনে এসেছে। লন্ডনে তার নিজের কোন বাসাও নাই। থাকে তার বন্ধুর পরিচিত একটা বাসায়। সোনালী ব্যাংক থেকে বের হয়ে ও সাব্বির জব সেন্টারের সন্ধান পেল। আজ জব সেন্টারটা খুব বেশি বিজি। অনেক লোক বসে আছে এখানে। জব সেন্টারের তিন-চার জন এক্সিকিউটিভের মতো আছে তাদের দেখা গেল রেস্টুরেন্ট মালিকদের সাথে ফোনে কথা বলছে। ফোনেই অনেকের জবও কনফার্ম করছে। বিপ্লব পনের বিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে শুধু দেখলো কে কি করে। 
তার পর আস্তে করে জব সেন্টারের একজনকে বলল,
আপনাদের কাছে কি ওয়েটারের কোন জব আছে? আমি দুই বছরের জব পারমিট নিয়ে বাংলাদেশ থেকে কয়েকদিন আগে এসেছি। কোথাও জব পাচ্ছি না। 
সাথে সাথে লোকটা বলল, জব একটা আছে বেলফাষ্টে। তুমি বেলফাষ্ট যাবে? তাহলে আজই যেতে পারবে। 
বিপ্লব জানে না বেলফাষ্ট কত দুরে। সে লোকটিকে জিজ্ঞেস করে এটা কোথায়? 
লোকটি ম্যাপ দেখিয়ে বলে, এই যে বেলফাষ্ট।
লন্ডন থেকে বেলফাষ্ট কত দূর হবে এটা ম্যাপে দেখে বিপ্লব বুঝতে পারে না। তার পরেও জিজ্ঞেস করে বেতন কত? 
জব সেন্টারের লোকটি উত্তর দেয় ১২০ পাউন্ড বেতন পাবে প্রতি সপ্তাহের জন্য। 
বিপ্লবের চোখ যেন হঠাৎ জ্বলজ্বল করে উঠলো। যদিও বেলফাষ্টের ভৌগলিক অবস্থান সে জানে না। সাথে সাথে সে ফোন দেয় জামসেদকে।
জামসেদ বলে, বেলফাষ্টতো অনেক দুর! এটা ইংল্যান্ডে না, নর্দান আইল্যান্ডে। তোমার সারাদিন লেগে যাবে ওখানে যেতে। তার চেয়ে তুমি দেখ কাছাকাছি কোন জব পাও কিনা। অন্তত ইংল্যান্ডের মধ্যে। কেননা তুমি একেবারেই নতুন এসেছ। এতো দুরে যাওয়া ঠিক হবে না।
কি আর করা! সাব্বির জব সেন্টার থেকে সে বের হয়ে ঠিক করলো কাল আবার আসবে এখানে। সকাল সকাল এসে বসে থাকবে। যেমন করে আর সবাই বসে থাকে। বিপ্লবের কাছে একটা বিশ্বাস হলো সাব্বির জব সেন্টার থেকে জব পাওয়া যেতে পারে।  
বাসায় এসে আরিফকে সব খুলে বলল ব্যাংক একাউন্টের কথা। সে যেখানেই গেছে সেখানেই প্রুফ অব এ্যাড্রেস চেয়েছে। আরিফ তাকে একটা বুদ্ধি দিয়ে বলল, আপনি প্রুফ অফ এ্যাড্রেস ছাড়া আপাতত একাউন্ট খুলতে পারবেন না। এক কাজ করুন, আমার ব্যাংক স্টেটমেন্ট নিয়া যান। আর আমি একটা ফরোয়ার্ডিং লেটার দিয়ে দেব তা নিয়ে সোনালী ব্যাংকে যাবেন। এভাবে অনেকেই একাউন্ট খুলেছে প্রথম প্রথম। 
আরিফ কথামতো তার কাগজগুলো বিপ্লবকে দিয়েছিল। পরের দিন সোনালী ব্যাংকে গিয়ে সে একটা সেভিংস একাউন্ট খুলে ফেললো।


আজকে সাব্বির জব সেন্টারে অনেক বেশি ভিড় মনে হচ্ছে তার কাছে। সাব্বির নিজেই কাউন্টারে বসে আছে আজ। বিপ্লবের সাথে কথা বলে তার জন্য একটা জবও চয়েস করে ফেলে সে। ওয়েটার হিসাবে যেতে হবে বিপ্লবকে। রেস্টুরেন্টটা এক্সিটারে। নাম প্যারাডাইস প্যালেস। লন্ডন থেকে ৪ ঘন্টা বাস জার্নি। বিপ্লব জবটা ফাইনাল করে ফেলে। বেতন ১০০ পাউন্ড সপ্তাহে। থাকা খাওয়া ফ্রি। 
রেস্টুরেন্ট মালিক তাকে আজকেই যেতে বলেছে। বিপ্লবও রাজি হয়ে যায়। কারণ পরের বাসায় থাকার চেয়ে কাজে চলে যাওয়া অনেক ভাল। সেখানে নিজস্বতা থাকবে। নিজের একটা অধিকার থাকবে। অন্তত উদ্বাস্তু মনে হবে না তার কাছে। যদিও রনিদের বাসায় তার থাকার কোন সমস্যা ছিল না। সাব্বির তাকে রেস্টুরেন্টের এ্যাড্রেস, মালিক শাহীদ সাহেবের নাম্বার এবং কীভাবে যেতে হবে বলে দিলো সব। সাব্বিরকে ২০ পাউন্ড দিয়ে দ্রুত বিপ্লব রনিদের বাসায় চলে এলো। 
রনি বাসাতেই ছিল। রনিদের বাসা থেকে আসার সময় রনির কাছে বিপ্লব ৩০০ পাউন্ড দিয়ে আসে।
বিপ্লব রনিকে বলল, একশ’ পাউন্ড আমি এখানে যে কয়দিন থাকলাম তার জন্য দিলাম। আর বাকি পাউন্ড  জামসেদকে দিও। কেননা এই দুইশ’ পাউন্ড জামসেদের কাছে থাকলে অন্তত রিস্ক থাকবে না। যদি পথে কোন সমস্যা হয় অথবা যদি আবার চলে আসতে হয়। কারণ জব তো নাও টিকতে পারে।
রনি খুবই আশ্চর্য হয় । কিছুতেই পাউন্ড নিতে চাইল না। 
বিপ্লব বলল, তুমি জামসেদের কাছে দিও। জামসেদ এসে সব কিছু ঠিক করবে। আমার আসলে তোমাদের এখানে ছাড়া আর  কোথাও যাওয়ার জায়গা  নেই। তাই পাউন্ডটা এখানেই রেখে গেলাম। তুমি মনে কিছু করো না। আমার জন্য দোয়া করো।   
রনির কাছে থেকে বিদায়  নিয়ে বিপ্লব ব্যাগ হাতে বেড়িয়ে পড়লো। তখন বিকাল চারটা।
ভিক্টরিয়া কোচ স্টেশনে আসতে আসতে বিকেল সাড়ে পাঁচটার মতো বাজল। টিকেট কাটার লম্বা লাইন দেখে বিপ্লব কিছুটা হতাশও। আধা ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে কাউন্টারে গিয়ে নেক্সট যে বাসটা এক্সিটার যাবে তার টিকিট কাটল। বাসটি সোয়া ৬ টায় ছেড়ে যাবে ভিক্টরিয়া থেকে আর পৌঁছবে ১০ টার পরে। বিপ্লবের খুব আনন্দ লাগছে ঠিক সময় বাস পাওয়ার জন্য। কেননা তার বেশি সময় নষ্ট হলো না এখানে।
শাহীদ সাহেবকে একটা ফোন দিলো সে।  
ফোনটা রিসিভ করেই শাহীদ সাহেব বললেন, তুমি এক্সিটার এসে ফোন দিও। আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাব।
বিপ্লব বলল, জি আচ্ছা।


বিপ্লব ছোট বেলা থেকেই রাতের বলা এরকম অজানা পথের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়াটা খুব এনজয় করে। এরকম যাত্রাতে সে একটুও ভয় পায় না। ছোট বেলায় একবার বিপ্লব, রাতে ১২ মাইলের পথ হেঁটে তার দাদার বাড়ি থেকে তাদের বাড়ি এসেছিল। অবশ্য সেদিন তার বাবাও সাথে ছিল। বাবার কাছ থেকেই সে শিখেছে কীভাবে আঁধারকে জয় করতে হয়। তার বাবা তাকে কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন অনেকবার। যাতে ছোট্ট বিপ্লবের কষ্ট না হয়।
অথচ আজ রাত দশটা কি এগারটার সময় যখন বাস এক্সিটারে পৌঁছবে, সেটা এমন একটা যায়গা যেখানে সে জীবনেও যায়নি। তারচেয়েও বড় কথা জায়গাটা বাংলাদেশে না। এটা অন্য একটা দেশ। এই দেশের ভাষা আলাদা। মানুষ আলাদা। মানুষের আচার আচরণ আলাদা। যেই দেশে রাত ৮ টার পর সব কিছু বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তায় লোকজনও তেমন থাকে না। শুধুমাত্র বার, নাইট ক্লাব ও রেস্টুরেন্ট  খোলা থাকে। তারপরেও বিপ্লব নিশ্চিত মনে ভিক্টরিয়া  স্টেশনে বাসের অপেক্ষা করছে। 
ভিক্টরিয়া স্টেশনটা অনেক বড়। এখান থেকে ইউকের প্রায় সব জায়গায় দুরপাল্লার বাস ছেড়ে যায় । বাস থেকে যাত্রী নামানো এবং উঠানোর জন্য মোট এগারটা লেন আছে। মানে এগারটা বাস একসাথে ছেড়ে যেতে পারে এখান থেকে। প্রতিটি বাস এখানে এসে দাঁড়ায় দশ মিনিটের মতো। যখন যে বাসটা এসে দাঁড়ায় তখন মনিটরে ডিসল্লে হয় বাসটার নাম্বার, গন্তব্য এবং ছাড়ার সময়।
বিপ্লব মনিটরে দেখলো তার বাস ৫০১, এক্সিটার যাবে লেন ২ থেকে। সে সোজা বাসে উঠে গিয়ে জানালার পাশের একটি সিটে বসলো।  


ন্যাশনাল এক্সপ্রেস বাসের সিটগুলো এত বড় না। বাসে যাত্রী কম ছিল তাই বিপ্লব জানালায় হেলান দিয়ে দুইটি সিট দখল করে বসলো।
বাসটি ছাড়ার আগে ড্রাইভার মাইকে ঘোষণা দিল ‘এই কোচটি কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিক্টরিয়া থেকে হিথ্রো, ব্রিষ্টল এয়ারপোর্ট, টনটন হয়ে এক্সিটারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে। মাঝে ব্রিষ্টল এয়ারপোর্ট স্টেশনে একটি ছোট্ট যাত্রা বিরতির ব্যবস্থা আছে। এই কোচের পিছনের দিকে টয়লেট সুবিধা রয়েছে। আর বাসটি ধুমপান এবং এ্যালকোহল মুক্ত। মোবাইল ফোন, এমপি থ্রি প্লেয়ার এবং আইপডের ভলিউম খুব কম রাখার জন্য সবাইকে অনুরোধ করছি। আর বাসটি চালানোর দায়িত্বে, আমি স্টিভ এবং আপনাদের সার্বিক সহযোগিতার জন্য আছেন আমার সহকারী তিনা। সবার আনন্দময় ভ্রমণের কামনা করছি।’
বাসের জানালা দিয়ে বিপ্লব তাকিয়ে দেখে, লন্ডনের কর্মব্যাস্ত মানুষের পদচারণা। অফিস শেষ করে সবাই বাসায় ফিরছে তখন। অনেকের হাতেই একটা নিউজ পেপার আর এক কাপ কফি। হাঁটতে হাঁটতেই তারা গরম কফিতে চুমুক দিচ্ছে আর পেপারে চোখ বোলাচ্ছে। এটা লন্ডনের একটা পরিচিত দৃশ্য। 
টিউবে আরো বেশি দেখা যায় এই দৃশ্যটি। টিউব যাত্রীর প্রায় সবাই পত্রিকা পড়ে। লন্ডনে সকাল, বিকাল দুই বেলা ফ্রি পত্রিকা ডিস্ট্রিবিউট হয় পথচারিদের মাঝে। ঢাকার গাবতলি, সায়দাবাদ বাসস্টান্ডেও বাসের মধ্যে তাজাখবর, গরম খবর সুর তুলে ২ টাকায় সকাল, বিকাল পেপার বিক্রি করে একদল হকার। পার্থক্য হল এই, এখানকার এই ফ্রি পেপারেও বস্তুনিষ্ঠ খবর ছাপা হয়।
বাসটি চলতে চলতে এম২৫ মটর ওয়েতে পৌঁছল। মোটরওয়ে গুলোতে একদিকে তিনটা করে লেন আছে। যে গাড়ির গতি ঘন্টায় ১০০ মাইলের বেশি সেগুলো প্রথম লেনে যায়। অপেক্ষাকৃত কম গতির গাড়িগুলো বাম সাইডের লেনগুলো ব্যবহার করে। তাই বাংলাদেশের মত ওভারটেকিং করতে হয় না তাদের। যার যেমন গতিতে গাড়ি চালানো দরকার সে সুবিধামত সেই লেন বেছে নেয়। দূর থেকে মটরওয়ের লাইটগুলোকে ভারি সুন্দর দেখা যায়। লন্ডন থেকে বিভিন্ন দিকে রাস্তা চলে গেছে সারা ইউকে জুড়ে। মোটর ওয়ে দিয়ে গেলে রাতের বেলা ওই রাস্তার লাইটগুলো মনে হয় জ্বলন্ত প্রদীপ। অনেক দূর পর্যন্ত লাইটগুলো দেখে মনে হয়, কারা যেন মোমবাতি জালিয়ে আলোকসজ্জা করেছে। ঠিক যেমনটি বাংলাদেশে বিজয় দিবস অথবা রাষ্ট্রীয় কোন উৎসবে, মফস্বল শহরগুলোতে আলোকসজ্জা হলে বহু দূর পর্যন্ত আলোকিত হয় ঠিক তেমনই ব্যাপারটা। প্রকৃতিকে যে মানুষও নিজের মত করে সাজাতে পারে তারই একটা বড় প্রমাণ ইংল্যান্ডের এই রাতের মোটরওয়ে। 
ব্রিষ্টল এয়ারপোর্ট স্টেশনে ১৫ মিনিটের একটা বিরতি নেওয়ার জন্যে বাসটি থামলো। 
ঘুমিয়ে পড়েছিল বিপ্লব । 
ড্রাইভার মাইকে ঘোষণা দিল, এখানে একটি বিরতি আছে। তাই কেউ  যদি চা, কফি খেতে চান এয়ারপোর্টের ভিতর স্টল আছে সেখান থেকে কিনে নিতে পারেন।
মাইকের শব্দে ঘুম চলে গেল তার।
বিপ্লব নেমে সিগারেট ধরাল। সাথে এক কাপ ধুমায়িত কফি। অনেকেই দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। কেউ বা একটু ফ্রেশ এয়ারের জন্য নেমে এসেছে বাস থেকে। 
ঠিক পনের মিনিট পরে আবার বাস চলা শুরু করলো। বাস এক্সিটারের  দিকে এগিয়ে চলেছে। 
বিপ্লব আধো আধো ঘুমে স্বপ্ন বুনতে থাকেÑ কেমন হতে পারে তার বাকি জীবনটা?
মনে পড়ে সেদিনের কথা, যেদিন সে সবার থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকা ছেড়েছিল। তার মায়ের সেই চিৎকার দিয়ে কান্না। বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া আশির্বাদ। অথবা বড় বোনের বিস্ময়ের সেই চোখ গড়ানো অশ্রু। আর সবার ছোট ভাইটি, সে কি এখনো দুষ্টমি করছে? পড়াশুনা বাদ দিয়ে এখনো কি সে সারা দিন, গান আর খেলা নিয়ে আছে? কেমন আছে তার সেই প্রিয়জনেরা? 
আর পরীই বা কি করছে এখন? সে কি তার কথা মনে করে? কিন্তু বিপ্লবের মনের মধ্যেতো বার বার ঘুরে ফিরে পরীই আসে। পরীই তার মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে সারাক্ষণ। কেন এমন হয়? এটাই কি তাহলে ভালবাসা? 
পরীর সাথে থাকার স্মৃতিগুলো কতইনা মধুর ছিল। রাতে রিক্সায় করে ঘুরে বেড়ানো, ঈদে শপিংমলের শপিং, কনসার্টে পরীর সেই উচ্ছলতা।
জীবনে যতটুকুই সে পরীকে পেয়েছে তাই বা কম কিসের?     

বাস যখন এক্সিটার এসে পৌছল, রাত তখন দশটা বেজে বারো মিনিট। সময়মত ঠিকই বাস তার গন্তব্যে চলে এসেছে। এদেশের মানুষেরা সময়কে খুব বেশি মূল্যায়ন করে। এই সময় জ্ঞানটা, এদের একটা চমৎকার গুণ। 
এক্সিটার স্টেশনে নেমে বিপ্লব শাহীদ সাহেবকে ফোন করল। 
শাহীদ সাহেব বিপ্লবকে বললেন, আসলে তোমাকে আসতে হবে ডাওলিশ। একটু কষ্ট করে দেখ কোন লোকাল বাস পাও কিনা। বাস না পেলে আমাকে আরেকটা ফোন দিও। আর যদি পাও তাহলে ডাওলিশ এসে আমাকে একটা ফোন দিও আমি তোমোকে ডাওলিশ স্টেশন থেকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে আসবো। 
বিপ্লব বলল, জি আচ্ছা।
পাশেই ছিল লোকাল বাস কাউন্টার। কাউন্টারে জিজ্ঞাস করতেই বলে দিল, ডাওলিশ যেতে হলে ৩২বি নাম্বার বাসে উঠতে হবে। 
বিপ্লব ৩২বি নাম্বার বাসে উঠে ড্রাইভারকে আবার জিজ্ঞেস করলো, এটা কি ডাওলিশ যাবে?
ড্রাইভার উত্তর দিলো, হ্যাঁ।
বিপ্লব তখন বলল, আমি আজই এই এলাকায় এসেছি। ডাওলিশ আমি চিনি না। যখন ডাওলিশ বাস পৌঁছেবে তখন দয়া করে আমাকে একটু জানাবেন।
ড্রাইভার বলল, ঠিক আছে।
গাড়িতে তেমন কোন যাত্রী ছিল না। ডাওলিশ আসতে তাদের প্রায় ৩৫ মিনিটের মত লাগলো। ড্রাইভার বিপ্লবকে ঠিকই মনে রেখেছিল। সে বিপ্লবকে জানালো ডাওলিশ এসে পড়েছে তারা। ও অবশ্য বাইরে বাস স্টপিজে লেখা আগেই দেখতে পেয়েছিল। তার পরও তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বাস থেকে নেমে গেল। 
শাহীদ সাহেবকে ফোন দিতেই সে অপর প্রান্ত থেকে বললেন, ওয়েলডান। তুমি একটু অপেক্ষা কর, আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।
বিপ্লব বসে আছে বাস স্টপে। চারিদিকে পিনপতন নিস্তব্ধতা। কোথাও কোন জন মানুষ নেই। কারণ তখন রাত প্রায় ১১ টার মত বাজে। বিপ্লব বুঝতে পারছে না একটা সিগারেট ধরাবে কিনা। যদি শাহীদ সাহেব ঠিকই ৫ মিনিটের মধ্যে এসে পড়ে আর দেখে ফেলে যে, সে সিগারেট খাচ্ছে তাহলে হয়তো তার উপর শাহীদ সাহেবের একটা খারাপ ধারণা হতে পারে। এই ভেবে আর সিগারেট ধরালো না। ঠিক পাঁচ মিনিট পরেই বিপ্লব দেখতে পেল একটা সাদা গাড়ি তার দিকেই আসছে। লোকটি গাড়ি থেকে নামলো। বয়স তার ষাট বাষট্টির মতো হবে। সাদা শার্ট কালো প্যান্ট পরা। তার মানে সে কাজে ছিল এতক্ষণ। এই বয়সেও একজন রেষ্টুরেন্ট মালিক হয়েও ড্রেস পরে কাজ করতে পারে। এটা দেখে বিপ্লব অনেকটা অবাকই হয়। শাহীদ সাহেবকে সালাম দিয়ে নিজের পরিচয় দিলো বিপ্লব। তার পর তারা দুজনে রেষ্টুরেন্টে চলে এলো। 
প্যারাডাইস প্যালেস রেস্টুরেন্টটি আকারে অত বড় না। মোট ৬০টির মত আসন আছে। টেবিল হবে গোটা বিশেকের মত। ফ্লোরে লাল রঙের কার্পেট পাতা। দেয়ালে ইন্ডিয়ার বিশেষ বিশেষ জায়গার পোষ্টার। তাজ মহলের পোষ্টার, নদীতে মহিলারা জল তুলছে তার পোষ্টার। আমাদের দেশের সুন্দরবনের বাঘেরও একটা পোষ্টার আছে এখানে। মোট কথা শাহীদ সাহেব তার মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজের এই ছোট্র জায়গাটাকে ইন্ডিয়া বানাতে চেয়েছেন। 
তখনও রেস্টুরেন্টে কয়েকটা টেবিলে কাষ্টমার ছিল। শাহীদ সাহেব ইসলাম নামের একজন ওয়েটারকে ডাক দিয়ে বিপ্লবকে রেস্টুরেন্টের উপরে তার রুম দেখিয়ে দিতে বললেন। ইসলাম ছেলেটাকে অনেক ভীতু মনে হল। ভয়ে ভয়ে বিপ্লবকে নিয়ে উপরে গেল। যেতে যেতে বিপ্লবকে যে প্রশ্নটা আগে করলো তা হচ্ছে, আপনাদের বাড়ি কোথায়? বিপ্লব উত্তর দিলো, আমিতো ঢাকায় থাকতাম। বিপ্লবকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করল না সে। 
দ্রুত শোবার ঘর আর বাথরুম দেখিয়ে শুধু বলল, সোয়া বারটার দিকে নিচে খেতে আসবেন। তখন রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যাবে। 
কতদুর যেয়ে আবার ফিরে এসে বলল, যদি বাথরুমে যান তবে বাথরুম থেকে বের হয়ে গেলে আবশ্যই লাইটের সুইচটা বন্ধ করবেন। 
বিপ্লবের কাছে মনে হলো ইসলামের গলায় একটা দড়ি বাধা। সে যেমন করে এত দ্রুত কথাগুলো বলল তাতে মনে হলো নিচের থেকে কে যেন তাকে দড়ি ধরে টানছে। বিপ্লব বুঝতে পারে না ইসলাম কেন লাইট বন্ধ করার ব্যাপারটা এভাবে বলল! 
তাহলে কি লাইট না বন্ধ করাটা একটা গুরুতর অপরাধ। হতে পারে হয়ত। 
কেননা ঢাকায় যারা মেস করে থাকে তেমন বেশির ভাগ মেসে কারেন্ট বিল বাড়ির মালিক দেয়। এমন মালিকরা যদি বিনা কারণে কোন দিন কাউকে লাইট জ্বালানো অবস্থায় দেখে তাহলে তিনহাত দেখে নেয়। খুব খারাপ ব্যবহার করে। অথচ ছেলেগুলো কিন্তু ভাড়া দিয়ে থাকে। হয়ত ভুল করে কেউ একদিন লাইট অফ করে নাই। কিন্তু বাড়িওয়ালা এসব শুনতে চায় না। কিন্তু ভাড়াটিয়ারা হচ্ছে বাড়ির মালিকদের জন্য লক্ষ্মী মানে কাস্টমার। বিজনেসের ভাষায় কাস্টমাররাইতো বিজনেসের প্রাণ। অথচ এখানে ডমিনেট করছে বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়াদের। 
আর এখানে তো বিপ্লব কর্মচারী। তাই তার কোন ক্রমেই লাইট অফ করার কথা ভুলে গেলে চলবে না । কারণ কোন ভাল কর্মচারী কখনোই চায় না, তার দ্বারা মালিকের এতটুকু ক্ষতি হোক । সে ক্ষেত্রে ইসলামের সতর্ক করে দেওয়াটা হয়ত ঠিক আছে।
যে রুমটা বিপ্লব পেল তার সাইজ দশ ফিট বাই দশ ফিটের মত হবে। ৩ টা বেড এবং ৩ টা সেলফ আছে সেখানে। বেড তিনটা তিন দেয়ালের সাথে লাগানো। রুমে একটা ডিভিডি প্লেয়ার সহ টিভির ব্যবস্থা আছে। ওর বেডটা ছিল ঠিক জানালার পাশেই। ভালই লাগলো তার। অন্তত থাকা খাওয়ার এবং সপ্তাহে একশ’ পাউন্ড পাবে এটা ভাবতেই মনটা ওর ভরে গেল। 
সপ্তাহে একশ’ পাউন্ড মানে মাসে চারশ’ পাউন্ড। যদি ২ দিনে এক প্যাকেট সিগারেট খায় তবে মাসে লাগবে ১৫ প্যাকেট। তার মানে পনের প্যাকেটের দাম প্রায় ৮০ পাউন্ড। ফোন বিল কলিং কার্ড বাদ দিলে সে কষ্ট করে মাসে ৩০০ পাউন্ড সেভ করতে পারবে। ৩০০ পাউন্ডকে টাকায় কনভার্ট করলে প্রায়ই ৪০ হাজার টাকার মত হয়। সহজ এই গাণিতিক হিসাব সে নিমেষেই করে ফেলে। 
১২ টার সময় ইসলাম এসে বলল, নিচে চলুন ভাই। ভাত খাবেন।
বিপ্লব বলল, আমি আসছি।
শাহীদ সাহেব বাকি সবার সাথে বিপ্লবকে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
শাহীদ সাহেবকে ইসলামরা চাচা বলে ডাকে। বিপ্লবও তাই শাহীদ সাহেবকে চাচা বলে ডাকল। ভাত খাওয়ার পর্ব শেষ করলো তারা সবাই একই সাথে। টেবিলে সবাই নতুন মানুষকে একের পর এক প্রশ্ন করছে। 
রন নামে একটা ছেলে আছে, যে কিনা ওয়েটার হিসেবেই কাজ করে এখানে। 
ও বলল, আগে কোথাও জব করেছেন? 
বিপ্লব বলল, না।
সাথে সাথে আরেকটা ছেলে যার নাম সাকিল সে বলল, কতদিন হলো ইংল্যান্ডে এসেছেন? বাংলাদেশে থাকতে কি করতেন? এই সব ফরমাল প্রশ্ন।
বিপ্লব ওদের সব প্রশ্নের উত্তর দিল। একদমই বিরক্ত হল না।
তাদের সাথেই একটি লোক বসে ছিল যার নাম মনির। বয়স পঞ্চাশ এর মত হবে। সবাই তাকে মনির ভাই বলে ডাকে। 
সে কিছুই জিজ্ঞাসা করছে না। শুধু একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছে। সে নাকি এই রেস্টুরেন্টের শেফ। তাকে শাহীদ সাহেবও নাকি খুব ভয় পায়। এই কথাগুলো মাসুক চলে যাওয়ার পর সাকিল বিপ্লবকে বলে। 
সাকিল আরো বলল, শুধু এই লোকটা বাদে বাকি সবাই খুব ফ্রেন্ডলি। বিপ্লবও বুঝতে পারে আসলেই সবাই খুব ফ্রেন্ডলি। নতুন কে আপন করে নেয়ার ইচ্ছে বাকি সবার মধ্যে আছে। 
শাহীদ সাহেব, মনির চলে যাবার পরও তারা প্রায় এক ঘণ্টা আড্ডা দিল এভাবেই।
রুমে ফিরে যাওয়ার আগে রন বিপ্লবকে বলল, প্রতিদিন সকালে ১২ টার সময় রেস্টুরেন্ট ওপেন হয়। আর খোলা থাকে ২ টা পর্যন্ত। তাই ১২ টার আগেই রেস্টুরেন্ট পরিষ্কার করতে হবে আপনার। যেহেতু আপনি নতুন এসেছেন তাই। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এর কাজ আপনাকেই করতে হবে। আমরাও করেছি প্রথম প্রথম। ডিনারের জন্য আবার রেস্টুরেন্ট সাড়ে ৫ টায় ওপেন হবে। তাই সাড়ে ৫ টার আগেই নিচে নেমে আসতে হবে। খোলা থাকবে ১২ টা  পর্যন্ত। আপনাকে প্রথম প্রথম রাতে তেমন কিছু করতে হবে না। শুধু আমরা কি করি এটা দেখবেন। আপনাকে যার যখন প্রয়োজন সেখানে যাবেন। যে যখন ডাকবে তাকে সাহায্য করবেন। এটাই আপনার কাজ হবে আপাতত। 
বিপ্লব মাথা নেড়ে সায় দিল। কোন সমস্যা নাই। আমি করবো। 
পরের দিন সকালের ক্লিনিং দিয়েই শুরু হলো বিপ্লবের ইংল্যান্ডের চাকুরী জীবন। সবকিছুতেই তার সাধ্যমত পরিষ্কার করার চেষ্টা করলো। প্রথমেই পরিষ্কার করলো নিজের ভিতরকার দাম্ভিকতা! ২টার সময় সবাই মিলে ভাত খেল। 
বাইরে বেরুনোর আগে রন বিপ্লবকে বলল, আজ শনিবার। তাই রাতে রেস্টুরেন্ট খুব বিজি থাকবে। তুমি বিশ্রাম কর এখন। আর বাইরে বের হলে ইসলামকে সাথে নিও।
ইসলামের সাথে বিপ্লবও বাইরে বেরুলো। তার সাদা শার্ট ছিল না। যেটা রেস্টুরেন্টের ড্রেস। কালো প্যান্ট বিপ্লব বাংলাদেশ থেকেই নিয়ে এসেছিল। তাই আপাতত সাদা একটা শার্ট কিনলেই তার চলবে। রেস্টুরেন্টে কাজ করার জন্য সবচেয়ে সস্তা দেখে একটা সাদা শার্ট কিনলো তারা। দাম মাত্র ৩ পাউন্ড। ইসলামই পছন্দ করে কিনে দিলো তাকে।  


ডাওলিশ শহরটা খুবই ছোট। শহরে দেখবার মত তেমন কিছু নেই। মাত্র একটা ব্যাংক আছে এখানে। অল্প কিছু দোকান পাট নিয়ে এই শহরটা। যার সামনেই বিশাল সমুদ্র। সমুদ্র সৈকতে প্রচুর পর্যটকরা আসে সামারে। সেই সুবাদে সামার টাইমে এই শহরটা খুব ব্যাস্ত থাকে। উইন্টারের সময় তাই একেবারেই নিরিবিলি। 
ফেরার পথে ওরা গেল ল্যাডব্রোকসে। ল্যাডব্রোকস হলো বেটিং সেন্টার। এখানে সবাই গ্যামলিং করতে আসে। ইসলাম জানত, এখানে এলে, মনির ও রনকে পাওয়া যাবে। তাই  তারা ভিতরে ঢুকতেই দেখে মনির আর রনকে। 
মনিরকে বিপ্লব সালাম দিল। 
কিন্তু মনির বিপ্লবের সালামের কোন উত্তর দিল না। কারণ তখন সে খুবই ব্যস্ত ছিল জুয়া খেলা নিয়ে। ঘোড়ার রেসের উপরে জুয়া খেলে সে।
 বিপ্লব তখনও জানে না ইংল্যান্ডে জুয়া খেলা বৈধ। ইসলামও বিশ্বকাপ ফাইনালের উপর ৫ পাউন্ড ধরলো। আগামীকাল হবে ফাইনাল। খেলবে ফ্রান্স ও ইতালী। বিপ্লব কিছুই বুঝল না তাদের এই বাজী ধরার সিস্টেম। 
সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার আগেই সবাই কাজে নেমে গেল। রেস্টুরেন্ট ওপেন করার সাথে সাথেই ফোন বাজতে শুরু করলো। ফোনগুলো রিসিভ করছে রন। খুব ভাল ইংরেজী বলে ছেলেটা। উচ্চারণও খুব সুন্দর। ফোনগুলো করে কাস্টমাররা খাবারের অর্ডার দেয়। এগুলোকে এই দেশে টেক এওয়ে অর্ডার বলে। খাবারগুলো প্যাকেটে ভরে দেয় কিচেন থেকে। কাস্টমাররা পরে এসে পেমেন্ট করে নিয়ে যায়। অনেকটা বাংলাদেশের পার্শ্বেল সার্ভিসের মত। 
একটা অর্ডার নিয়ে রন নিজে না গিয়ে বিপ্লবকে পাঠালো কিচেনে দিয়ে আসতে। 
বিপ্লব অর্ডারের কাগজটা হাতে নিয়ে কিচেনে গিয়ে দেখলো কিচেনের সবাই খুব ব্যস্ত। কারো সাথে কারো কথা বলার সময় নাই। সে কার কাছে দিবে অর্ডারটা বুঝতে পারছে না। এর আগেতো সে কোন দিন আর্ডার নিয়ে কিচেনে আসে নাই। 
দুই মিনিটের মত দাঁড়িয়ে থাকার পর মনির বিপ্লবের দিকে তাকিয়ে বলল, কি চাই?
বিপ্লব বলল, অর্ডার।
মনির বলল, কিসের অর্ডার? 
রন অর্ডার পাঠিয়েছে।
মনির রেগে বলল, রনকে ডেকে নিয়ে আসো। 
বিপ্লব কিছুই বুঝল না রনকে কেন ডাকতে হবে। সে রনের কাছে এসে বলল, মনির ভাই তাকে ডেকে পাঠিয়েছে। 
রন তখন হাসতে থাকলো। সে বিপ্লবকে আবার বলল, কিচেনে গিয়ে অর্ডারটা দিয়ে আস।
বিপ্লব আবার কিচেনে গিয়ে মনিরকে বলল, এটা কাস্টমারের টেক এ্যাওয়ে অর্ডার। কোথায় রাখবো?
মনির তখন মাইক্রোওভেন দেখিয়ে দিয়ে বলল, এর ভিতর রাখো।
বিপ্লব মনিরের এই অদ্ভুত আচরণের কিছু বুঝতে পারলো না। নতুন মানুষ পেলে এরকমই তামাশা করে সবাই। একটু সুযোগ পেলে সবাই মজা করে তাকে নিয়ে। এখানকার এটাই সিস্টেম। এমনিভাবেই চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে। 
আস্তে আস্তে রেস্টুরেন্টেও কাস্টমাররা আসতে শুরু করলো। এক সময় পুরো রেস্টুরেন্ট ভরে গেল। রন, ইসলাম, শাহীদ সাহেব মিলে রেস্টুরেন্টের এপাশ থেকে ওপাশে দৌড়াচ্ছে। বিপ্লবকে আগেই কাস্টমারের কাছে যেতে নিষেধ করেছিল শাহীদ সাহেব। তাই সে শুধু যে যা বলে সে কাজগুলো করছে। যেমন টেবিলে পানি দেয়া। খাবার পর টেবিল ক্লথ চেঞ্জ করা ইত্যাদি ইত্যাদি। আরো একটা কাজ সে করে। দরজা খুলে দেয় যখন কাস্টমার ভিতরে আসে বা যায়। 
সেদিন প্রায়ই ১৫ শত পাউন্ডের মত ব্যবসা হলো ওখানে। শাহীদ সাহেব খুব খুশি তার এই ব্যবসায়। 
সে খাবার সময় বলল, নতুন ছেলেটাতো খুব লাকী আমাদের জন্য। আজকে আমরা এই বছরের সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করেছি। শাহীদ সাহেবের এভাবে প্রথম মূল্যায়ন বিপ্লবের খুব ভাল লাগলো। 



রবিবার সবার মনই সকাল থেকে ফুরফুরে থাকে। সবাই কেমন জানি অনেক শান্ত এই দিনে। সকালে কাজে নেমে সবাই চা নাস্তা খায় আগে তার পর কাজ শুরু করে। বাইরের রাস্তায়ও খুব কম লোক থাকে। কারণ সবাই অনেক বেলা করে ঘুম থেকে উঠে। সপ্তাহের পাঁচ ছয়টা কর্মব্যস্ত দিনের পর মনে হয় সবাই একটু বেশি ঘরকেন্দ্রিক হয়ে যায়। শাহীদ সাহেবও আসেন সেদিন রাতে রেস্টুরেন্ট বন্ধ হবার একটু আগে। সবাইকে সপ্তাহের বেতন দেন রবিবার। এই খুশিতে মনে হয় সবাই সকাল থেকে খুব ঠান্ডা মেজাজে থাকে। এই রবিবার আবার ওয়ার্ল্ড কাপের ফাইনাল খেলা। তাই সাকিল, রনরা কিচেনে টিভি নিয়ে আসে খেলা দেখার জন্য। রাতে টিভিতে খেলা দেখবে আর কাজ করবে। ফাইনাল খেলা বলে কথা। বিপ্লব আর ইসলামের খেলা দেখার সেই চান্সটুকুও নাই। কারণ রন কিচেনে খেলা দেখলে তাদের সামলাতে হবে রেস্টুরেন্ট। অথচ বিপ্লব ২০০২ এর ওয়ার্ল্ড কাপের প্রতিটি খেলা দেখেছে। সেবার খেলা দেখানোর জন্য ধানমন্ডি আবাহনী মাঠে  বড় স্ক্রিন লাগিয়েছিল। সেখানে গিয়ে সে অনেক খেলা দেখেছে। বেশি মানুষের সাথে খেলা দেখার মজাই আলাদা। কেমন যেন গ্যালারী গ্যালারী মনে হয়। যেন সরাসরি মাঠে গিয়ে খেলা দেখার আনন্দ পাওয়া যায়। বিপ্লবের একটা সখ তার ঢাকার বাসার ড্রইং রুমে ৫৬ ইঞ্চি এলসিডি টিভি লাগাবে। তখন বাসায় বসেও গ্যালারীর মজা পাওয়া যাবে। কিন্তু ৫৬ ইঞ্চি এলসিডি টিভিরতো অনেক দাম। বিপ্লব বাংলাদেশে থাকতে মাঝে মাঝেই রাইফেলস স্কয়ারের সনির যে শোরুমটা ছিল তাতে এলসিডি টিভির দাম দেখতে যেত। আসলে ক্রিকেট, ফুটবল খেলা দেখার জন্যই তার এই টিভিপ্রীতি। তাছাড়া তেমন কোন টিভি প্রোগ্রাম সে বেশি দেখতো না। মাঝে মাঝে রাতে খবর দেখতো এই যা। 
আজ রনের ছুটির দিন। এ দিনে রন রেস্টুরেন্টেই থাকে না। বাইরে ঘুরতে যায়। ফিরে অনেক রাতে। তাই আজকে কাজ করছে ইসলাম এবং বিপ্লব। ইসলাম অর্ডার নিচ্ছে। বিপ্লব কাষ্টমারদের খাবার পরিবেশন করছে। খাবারগুলো কিচেন স্টাফরা তৈরী করে হট ওভেনের ভিতর রাখে। সেখান থেকে খাবার তুলে কাষ্টমারদের সার্ভ করতে হয়। ফলে মনিরের সাথে সরাসরি কাজ করতে হয় বিপ্লবের। মনির নিজেকে খুব বড় মনে করে। কাউকে মানুষ বলে পাত্তা দেয় না। একারণে তার সাথে কাজ করা খুবই কঠিন একটা ব্যাপার। তাছাড়া বিপ্লবতো আর খাবারের নাম জানে না। সবচেয়ে কস্টের ব্যাপার হল, অনভিজ্ঞতা। কারণ, হট প্লেট খুব গরম থাকে সেই সময়। স্টীল এর ডিস গুলো আরো গরম হয়ে যায় তখন। খাবার ট্রলিতে উঠিয়ে খুব দ্রুত নিয়ে যেতে হয়। এই অবস্থায় বিপ্লবের খাবার উঠাতে খুব দেরি হয়। তখন মনির পেয়ে যায় আরও সুযোগ।
তখন মনির বিপ্লবকে বলল, তাড়াতাড়ি সর। জায়গা খালি কর।
বিপ্লব বলল, জি আচ্ছা।
মনির বলল, জি আচ্ছা মানে? আমার খাবার ঠান্ডা করে ফেলছে। আবার মুখে মুখে তর্ক করছে? আমি কি তোমার কেনা গোলাম নাকি? তোমাকে খাবারের নাম বলে দিতে হবে। সাথে আরও কিছু অসভ্য ভাষা সে ব্যবহার করল।
যার মানে বিপ্লব জানে। কিন্তু সে কিছুই বলে না। শুধু মনিরের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। চোখের পানিও আটকে রাখতে পারছে না। কোনমতে সাকিল এর সাহায্য নিয়ে খাবারগুলো নিয়ে যায় কিচেন থেকে। 
আবার যখন কিচেনে আসলো তখন মনির তাকে জিজ্ঞাসা করে, তুমি তোমার মুখটা এমন খারাপ করে রেখেছো কেন? চেহারায় হাসি খুশী ভাব না রাখলে তো ভাল সার্ভিস দিতে পারবে না। এতে ব্যবসার ক্ষতি হবে। তার চেয়ে এক কাজ কর। তুমি কাজ করা বাদ দিয়ে দাও। 
বিপ্লবও মনে মনে কাজ ছেড়ে দিতে চাইছিল। সেও ঠিক করল আজই শাহীদ চাচাকে বলবে। কিন্তু রাতে রন, সাকিল মিলে তাকে বুঝালো, মনির সবার সাথেই এই ব্যাবহার করে। যারা নতুন নতুন খাবার পরিবেশন করে তাদের সাথে এমন ব্যবহার করাটা তার অভ্যাস। তুমি এতে কিছু মনে কর না। কয়েক দিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তুবিপ্লব কিছুতেই নিজেকে মেনে নিতে পারে না। তার কাছে এখন ইংল্যান্ডে আসাটাই ভুল মনে হছে। অথচ বাংলাদেশে থাকতে তার খুব ভাল একটা জব ছিল। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করতো ও। ৯-৫ অফিস। খারাপ ছিল নাতো সে।
আরেক দিন। মনির তাকে করিয়েন্ডার দিতে বলে। কিন্তু বিপ্লবতো করিয়েন্ডারের বাংলা মানে জানে না। বিপ্লব নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিচেনে।
মনির তাকে বলে, কি! পরাশুনা করনি জীবনে? করিয়েন্ডার মানে কি জান না? 
এমন কটু ভাবে কথাটি বলল মনির, যেন তার সারা শরীরে গিয়ে কাটা হয়ে বিধল। কেঁপে উঠল তার সমস্ত শরীর।
যেই লোকটা তার পড়াশুনা নিয়ে এত বড় একটা কথা বলল, সে নিজে ক্লাস ফাইভ পাসও করেনি। ২০-২২ বছর ধরে ইংল্যান্ডে আছে। অথচ ইংলিশ গালি ছাড়া আর একটা কথাও বলতে পারে না। সে বলছে এমন কথা। 
ভাবতেই খারাপ লাগে। এই লোকটাই কথায় কথায় বিপ্লব কে হুকুম দেয়। চা বানিয়ে আনতে বলে। সিগারেট আনতে বাইরে পাঠায়। 
তারপরেও বিপ্লব মনিরের আদেশ সবসময় শুনে। কারো কাছে কিছু বলে না। আর বলেও লাভ নেই। কারণ শেফদের নাকি মালিকরাও ভয় পায়। তারাও শেফদের কাজ নিয়ে বেশি ঘাটাঘাটি করে না। 

এই রেস্টুরেন্টের ল্যান্ড ফোন ব্যবহার করে, সবাই কলিং কার্ড দিয়ে বাংলাদেশে ফোন করে। ০৮০০ নাম্বার ব্যাবহারে কোন বিল হয় না ল্যান্ড লাইনে। তাই সহজেই ফোন করা যায় কলিং কার্ড দিয়ে। 
বিপ্লবও প্রায়ই বাংলাদেশে ফোনে কথা বলে। একদিন সে পরীদের বাসায়ও ফোন দেয়। ফোন ধরে পরীর মা। বিপ্লবকে সে খুব পছন্দ করত।
বিপ্লব বলল, কেমন আছেন খালা?
পরীর মা টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে বললেন, ভাল আছি আমরা। তোমার খবর কি?
বিপ্লব বলল, আমি ভাল আছি। একটা জব পেয়েছি। চলছে মোটামুটি। 
ভদ্র মহিলা বললেন, খুব ভাল কথা। আচ্ছা তুমি পরীর সাথে কথা বল।
পরীর মা পরীকে ফোন দিয়ে বলল, বিপ্লব ফোন করেছে। 
বিপ্লব অনেকক্ষণ পরীর সাথে কথা বলল। ফোন রেখেও পরীর কথা ভাবতে থাকে। পরীকে যে বলতেই হবে তার মনের কথাটি । কারণ পরীকে ছাড়া তার জীবন চলবে না। না বলা কথাগুলো যদি সে মনে পুশে রাখে তাহলে তারই বেশি ক্ষতি হবে। যে ক্ষতি বিপ্লবের সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। কিন্তু কীভাবে বলবে সে? আর বলার পর পরীই বা কি উত্তর দিবে? উত্তর যদি না হয় তাহলেতো সব শেষ। আর কোন দিন সে পরীকে ফোন করতে পারবে না। এখনতো অন্তত পরীর সাথে ফোনে কথা বলছে। আর না হোক তার প্রিয় মানুষের কন্ঠটা শুনছে। এটাও যদি সে হারায় তবেতো আর কিছুই থাকবে না। বেশি ভালবাসে বলেই হয়ত তার এত হারানোর ভয়। কাজের সময় এই ভয়টা থাকে না। ঘড়ির কাটার মত ব্যস্ত জীবনেও যখনই সময় পায়, তনই পরীকে নিয়ে স্বপ্ন বুনে। ছোট্ট একটা ঘরের স্বপ্ন। যে ঘরে পরী থাকবে। থাকবে তাদের দুজনার ভালবাসায় ছোঁয়া ছোট্ট সোনামনি।
সে কারণেই বিপ্লব পরীকে তার উপস্থিতি কখনো ফোনে, কখনো এসএমএস করে, কখনোবা ই-মেইল করে বোঝাতে চায়।


দুপুরে ঘুমের অভ্যাস নেই বিপ্লবের। এই ৩ ঘন্টা ব্রেকে সে হয় ফোনে কথা বলে না হয় রন, সাকিলদের সাথে ল্যাডব্রকসে যায়। একদিন দেখে রন ররুলেট নামে একটি জুয়ার গেইম খেলছে। বিপ্লব আইটির ছাত্র ছিল। তাই সে সহজেই রুলেট খেলাটি  বুঝে ফেললো।
রুলেটে ০ থেকে ৩৬ নাম্বার থাকে। বিভিন্ন ভাবে বেট ধরা যায়।
*১৮ টা জোড় বা ১৮ টা বেজোড় সংখ্যার ঘরে ধরা যায়।
*১৮ লাল বা ১৮ কালো ঘরে ধরা যায়।
*১ থেকে ১২, ১৩ থেকে ২৪, ২৫ থেকে ৩৬ এর ঘরেও ধরা যায়।
*১ থেকে ১৮ এবং ১৯ থেকে ৩৬ বেট করা যায়। 
আবার প্রতিটি সংখ্যার ঘরে আলাদা আলাদা করেও ধরা যায়।
সবচেয়ে কম ১ পাউন্ডের বেট করা যায় এখানে। যে সংখ্যার উপর রুলেটের ডাইস এসে পরবে, সে সংখাটি যদি কোন ভাবে বেট এর বাইরে থাকে তাহলে সব টাকা হাউস নিয়ে যাবে। আর যদি ডাইসটা খেলোয়াড় এর কোন ঘরে গিয়ে পড়ে, তাহলে ৩৬/১ হারে টাকা রিটার্ন দিবে হাউস। এই হিসেবে যদি ১২ টা সংখ্যার উপর ১ পাউন্ড বেট হয় তবে, ফেরত পাওয়া যাবে ৩ পাউন্ড। গেইম টা কম্পিউটারের র‌্যান্ডম নাম্বার জেনারেট এর উপর করা। খেলাটা খুব লোভনীয় এবং বুঝাটাও খুব সহজ। যে কেউ দেখলে বুঝে ফেলবে খেলার সিস্টেমটা। মনে হবে সেও জিতবে এখানে। এই লোভটা বিপ্লবও সামলাতে পারে না।
তাই সেও ৫ পাউন্ড নিয়ে খেলা শুরু করে দিল। প্রথম বার সে ১ পাউন্ড ধরে ১-১২ এর ঘরে, সে রিটার্ন পায় ৩ পাউন্ড। পরের বারও সে পেল। এভাবে তার ৫ পাউন্ড বেরে হল ৯ পাউন্ড। তার পরে পর পর ৫ বার সে খেললো কিন্তু প্রতিবারই সে পেল না। ৪ পাউন্ড নিয়ে সোজা চলে আসে সে। কিন্তু মাথায় তার রুলেট খেলাটা ঠিকই থেকে গেল।
এদিকে পুরো রেস্টুরেন্টের সবাই রুলেট খেলা শুরু করে দিল। সাকিল একদিন প্রায় ৪০০ পাউন্ডের মত হারলো। বিপ্লবেরও সব মিলিয়ে ৩০০ পাউন্ড লস। বিপ্লব তার পরেও হাল ছাড়ে না। সে ঠিক করে র‌্যান্ডম নাম্বার জেনারেটের সিস্টেমটা ইন্টারনেট থেকে শিখতে হবে। যদিও সে পরিসংখ্যান খুব ভাল বুঝে তারপরেও ভাবে ইন্টারনেটে আরও ভাল কিছু পাওয়া যাবে। এই বিষয়টাই হয়ে যায় তার পড়াশুনার নতুন বিষয়।
ডওলিস এ একটা লাইব্রেরী আছে। এই লাইব্রেরী ইংল্যান্ডের প্রতিটি শহরেই একটি করে থাকে। বিপ্লব প্রতিদিন যায় সেখানে। ৩ ঘন্টা সময় পার করে রুলেট সমন্ধে যানতে। আনেক স্ট্যাটেজি পেয়ে যায় সে কিছু দিনের মধ্যেই। কিছু সফটওয়ারও পায় সে যা র‌্যান্ডম নাম্বার জেনারেটের উপর করা। রাতে রনের কমপিউটারে সে সফটওয়ার গুলোর পরীক্ষা চালায়।
যতই দেখছে সে ততই ভয় পাচ্ছে রুলেটকে। কি এক আজব খেলা এটা। সব সময়ই হাউস জিতবে। কিছুতেই বড় অংকের টাকা এখান থেকে বের করা যাবে না। কি আর করা, খেলাটা বাদ দেওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না। পিছনে যা লস হয়েছে তা ফেরত পাওয়ার জন্যে খেললে আরও বড় লস হবে। এই ভেবে সে আর ওই জুয়ার ঘরে যায় না।

এদিকে দুই মাসের মত হয়ে গেল সে কাজ শুরু করেছে কিন্তু এখনো সে বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারেনি। তার হাতে তিনশ পাউন্ডের মত আছে। সামনে ঈদ। তাই বাড়িতে টাকা পাঠাতে হবে। কিন্তু সে জানে না কীভাবে টাকা পাঠাতে হয়। বাংলা পত্রিকা থেকে মানি ট্রান্সফার এজেন্সীর খোঁজ পায় সে। এমনি একটা মানি ট্রান্সফার এজেন্সীতে সে একদিন ফোন করে। সেখানে থেকে জানতে পারে কীভাবে দেশে টাকা পাঠাতে হয়। বিপ্লব ঠিক করে আগামী সপ্তাহের টাকাটা পেলে ৩৫০ পাউন্ডের মত পাঠাবে। লন্ডনের বাইরে থেকে টাকা পাঠাতে হলে মানি ট্রান্সফার কোম্পানির একাউন্টে টাকা জমা দিয়ে, তারপর ফোনে বলে দিতে হয় টাকাটা বাংলাদেশের যে একাউন্টে যাবে তার বর্ণনা। পরের সপ্তাহে সে ঠিকই ৩৫০ পাউন্ড পাঠায়। জীবনের প্রথম সে টাকা পাঠালো ইংল্যান্ড থেকে। তার কাছে খুবই ভাল লাগছে এখন। এখানে টাকা ইনকাম করাও যত সহজ আবার খরচ করা তার চেয়ে বেশি সহজ। হিসাব করে না চললে বারে বারে ঠোঁকর খেতে হয়। দরকারের সময় কেউ সাহায্য করে না। সবাই মুখ ফিরিয়ে নেয় তখন। তাই সে মনে মনে ঠিক করে ৩০০ পাউন্ড করে প্রতি মাসে সে পাঠাবেই।
মনির এতদিনে বিপ্লবের সাথে কিছুটা ফ্রী হয়েছে। সবার কাছেই সে টাকা ধার চায়। সে যে সপ্তাহে ৩০০ পাউন্ড বেতন পায় তা রবিবার রাতে পেলে সোমবার খরচ করে ফেলে। হয় ধার শোধ করে, না হয় জুয়া খেলে। তারপর সিগারেট কেনার টাকা খোঁজে সাকিল, রনদের কাছে। বিপ্লব নতুন এসেছে। তাছাড়া সবার চাইতে কম বেতন পায় সে। এই কারণে এতদিন তার কাছে মনির টাকা ধার চাইতো না। আজ বিপ্লবের কাছে মনির ২০ পাউন্ড ধার চেয়েই ফেলল। বিপ্লব ভয়ে তাকে না করতে পারে না। অথচ গতকালই সে সব টাকা বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। তার কাছে ছিলই মাত্র ৪০ পাউন্ডের মত।
ইসলাম নামের যেই ছেলেটি কাজ করতো তাদের সাথে সে অন্য জায়গাতে বেশি বেতন পেয়ে চলে যায় এরি মাঝে। বিপ্লবেরও বেতন বেরে যায় সাথে সাথে। তার বেতন এখন সপ্তাহে ১২০ পাউন্ড । বিপ্লবের যায়গায় আসে নতুন একটা ছেলে। নাম তার চঞ্চল। বিপ্লবের কাজ এখন একটু কমেছে। চঞ্চল ছেলেটা অনেকদিন যাবত এই দেশে আছে কিন্তু এর আগে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের কাজ সে করে নাই। তাই বিপ্লবই সিনিয়র তার থেকে। চঞ্চল এবং বিপ্লব ভাগাভাগি করে পরিষ্কার পরিছন্নতার কাজ করে নেয়। দীর্ঘ দিন ধরে ইংল্যান্ডে থাকার ফলে চঞ্চলের অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে।
বিপ্লবকে সে নানা বিষয়ে টিপস দেয়। যেমন, ব্যাংক একাউন্ট, এনআই নাম্বার, ট্যাস্ক কি কাজে লাগে এই সব।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সে বলে, সেটা হচ্ছে সিগারেট এর চেয়ে টবাকো সাশ্রয়ী। কিন্তু বিপ্লব টোবাকো দিয়ে সিগারেট বানাতে পারে না। সেটাও শিখিয়ে দেয় এই ছেলেটা। শুধু মাত্র এই কারণে বিপ্লবের খরচ সপ্তাহে অর্ধেক হয়ে যায়।
রেস্টুরেন্টে কাজ করলে তেমন কোথাও যাওয়া হয় না। কারণ একদিন করে ডে অফ থাকে সবার। ডে অফে সাধারনত সবাই বেশি বেলা করে ঘুমায়। একদিন বিপ্লবের ডে অফের দিন রন আর বিপ্লব মিলে এক্সিটে ঘুরতে যায়। পুরো এক্সিটার (বীরঃবৎ) শহরটা ঘুরল দুজনে মিলে। এই প্রথম তারা প্রয়োজন ছাড়া শুধু ঘুরতে বের হয়েছে। সারাদিন ঘুরাঘুরি করে দুপুরের খাবারটাও তারা খেয়ে নিল ম্যাক এ। ফেরার পথে কিনে আনলো প্লে-স্টেসন-২। সাথে গেইম নিল ফিফা ২০০৬। রনের কাজ ছিল তাই ৬ টার আগেই চলে আসতে হল তাদের।
বিপ্লব চলে গেল সমুদ্রের কাছে। ডাওলিশে যে ছোট্ট সী-বীচটা আছে তাতে। এটা আসলে ইংলিশ চ্যানেল। বাংলাদেশের কক্সবাজারের মত অত সুন্দর না। তারপরেও সামারে অনেক লোক আসে এখানে। ভালই লাগছে বিপ্লবের আজ।
সমুদ্রের বিশালতার সামনে দাঁড়িয়ে সে কল্পনা করে, পরী তার সাথে হাঁটছে। যেমন করে জোড়ায় জোড়ায় হাঁটছে সবাই তাদের প্রিয়জনদের সাথে নিয়ে।
বিপ্লব পরীকে একটা এসএমএস পাঠায়। পরী উত্তর দেয়, ইস! আমিও যদি এখন তোমার পাশে থাকতে পারতাম!!
বিপ্লব উত্তর দেয়, তুমি চাইলেইতো আসতে পার।
তার খুব ইচ্ছে করছিল তার পরীকে একটা ফোন করার তখন। কিন্তু এত রাতে ফোন করা কেমন দেখায়? এই ভেবে সে ফোন করে না। তারপরেও বিপ্লবের ভাবতে ভাল লাগছে। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও পরী তার সাথে ছিল।
অনেকক্ষণ বসে থাকে একাকী সমুদ্রের দিকে মুখ করে। পরীকে নিয়ে স্বপ্ন বুনে সে। ঠিক যেমন করে বিশাল সমুদ্রের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে সবাই, তেমন করে ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্ন। 
রন এবং বিপ্লব এখন দুপুরে ও রাতে কাজের শেষে প্লে-স্টেশনে ফিফা ২০০৬ খেলে। খুব মজা পায় তারা এই গেইমটা খেলে। পৃথিবীর সব নামকরা দেশের হয়ে খেলা য়ায়। কম্পিউটারের গেইমের থেকে এটা বেশি জীবন্ত। গোল হলে হাতে ভাইব্রেশন হয়। খুব বেশি এক্সসাইটিং লাগে তখন। সে মনে মনে ঠিক করে তার ছোট ভাইটার জন্য একটা কিনে পাঠাবে, যদি কাউকে পায় পাঠানোর মত।
এদিকে ২৭ তম বিসিএস এর লিখিত পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়েছে। বিপ্লবের এক বন্ধু রিপন তাকে ফোন করে জানায়। বিপ্লব ভাইভার জন্যে ডাক পেয়েছে। বিপ্লবের পরীক্ষা খুব ভাল হয়েছিল। বাসায় তার বড় বোন, বাবা, মাকে জানায় সে কি করবে এখন। তারা বলে, তুইতো চাকুরি ছেড়ে চলে গেলি সেদিন। সেটাওতো খুব ভাল চাকুরি ছিল। তাহলে এখন আবার ভাইভা দিতে আসতে চাস কেন? বিপ্লবও সাহস পায় না পরীক্ষা দিতে দেশে আসতে। তাছাড়া এইতো কয়েক দিন হল সে এখানে এসেছে। এরি মধ্যে আবার বাংলাদেশে যাওয়া আনেক টাকা পয়সা খরচের ব্যাপার।


৩ মাস পনের দিন কাজ করে বিপ্লব ছেড়ে যায় প্যারাডাইস প্যালেস। কারণ সে ভাবে তার এত অল্প বেতনে চলবে না আর। এরি মধ্যে অনেক কাজ শিখে ফেলেছে সে। নিজের থেকে সে এখন সব কিছু ম্যানেজ করতে পারে। রেস্টুরেন্টের কোন কাজই তার আর অজানা নেই। বিয়ারেরÑমেশিন পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে অর্ডার নেয়া সব কাজই তার জানা। সে অনায়াসেই ১৬০ থেকে ১৮০ পাউন্ড আয় করতে পারবে সপ্তাহে। এখানে এত টাকা দিয়ে তাকে রাখবে না। তাই এখানে পরে থেকে লাভ কি? এই কথা চিন্তা করেই শাহীদ সাহেবকে ২ সপ্তাহের নোটিসে সে কাজ ছেড়ে দেয়ার কথা বলে।
ডাওলিশ থেকে চলে আসার দিনটি হল অক্টোবর মাসের শেষ রবিবার। বিপ্লব ১৫ দিন আগে ট্রেনের টিকিট কেটেছিল দশটা পনেরর। সাধারণত অক্টোবর মাসের শেষ রবিবার শীতকালীন সময় শুরু হয়। তখন ঘড়ির কাটা একঘন্টা পিছিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বিপ্লব তা জানত না আগে। তাই সে ১০টা ১৫ মিনিটে স্টেশনে গিয়ে দেখে কেউ নেই। ট্রেনও নেই। একজনকে সময় জিজ্ঞাসা করতেই সে বলে এখন ৯.১৫ বাজে। আজকেই ১ ঘন্টা পেছানো হয়েছে সময়। তাই ট্রেন আসবে নতুন সময় অনুযায়ী।
ট্রেন ঠিক সময় মত এল। বিপ্লব উঠে বসে ট্রেনে। খুব নিরিবিলি একটা সীটে সে বসে একা। কারণ হেলান দিয়ে ভ্রমণের মজাই আলাদা। এমনিতেই রবিবার বলে তেমন কোন ভিড় ছিল না সেদিন। মনে পরে তার ইংল্যান্ডের প্রথম চাকরী করা দিন গুলোর কথা।
শাহীদ সাহেব। যে মালিক হয়েও অনেক আদর করত তাদের সবাইকে। আসার আগের দিন বিপ্লব অনেকক্ষণ ধরে কথা বলেছে তার সাথে। বিপ্লবের সাথে শাহীদ শাহেব ছবিও তোলেন সেদিন। মাত্র ৩ মাসে যে একজন মানুষ সবার মন জয় করে নিতে পারে তা আগের দিনই টের পেয়েছে বিপ্লব। মনিরের মত মানুষ তাকে ১০০ তে ৮০ মার্কস দিয়েছে কাজের দিক দিয়ে। এটাও অনেক বড় কথা। বিপ্লব শাহীদ সাহেব কে একটা একাউন্টিং সফটওয়ার বানিয়ে দিয়েছিল। এতে সে রেস্টুরেন্টের সব হিসেব রাখতে পারতেন। খুব ভাল হয়েছিল কাজটি।
একটা ছেলে দিনে ১০-১২ ঘন্টা কাজ করে এমন সুন্দর একটা কাজ করে দিতে পারবে তা দেখে ভারি অবাক হয়েছিলেন শাহীদ সাহেব। দোয়া করেছিলেন যেন বিপ্লব আবার তার নিজ কাজে ফিরে যেতে পারে। অতি অল্প দিনেও মানুষ এমন আপন হতে পারে ভাবতে পারে না বিপ্লব। 
ইংলান্ডের ট্রেনে ইকনমি ক্লাসের আসনগুলোও খুব আরামদায়ক। জানালাগুল সবসময় বন্ধ থাকে শীতের দেশ বলে। শীতাতাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকে এতে। জানালা দিয়ে প্রকৃতির রুপ দেখা যায়। প্রকৃতি আসলে সবখানেই অপরূপা। সে তার নিজের মত করে সেজে আছে একেক জায়গায় একেক ভাবে। বিপ্লব প্রকৃতি ভালবাসে। ভালবাসে প্রকৃতির সৃষ্টিকে।
খুব কাছ থেকে সে প্রকৃতি দেখার সুযোগ পেয়েছে ছোটবেলা থেকেই। গ্রামের বাড়িতে যখন তারা থাকতো তখন ষড়ঋতুর আসল বাংলাদেশকে সে  দেখেছে। ঋতু বদলের সাথে সাথে কীভাবে প্রকৃতি বদল হয় সে তা জানে। শীতের খেজুরের রসের পিঠা খাওয়ার জন্যে যেমন তার মন ছটফট করত তেমনি গ্রীষ্মের আম, জাম, কাঁঠালের সময়টাও তার কাছে রোমাঞ্চকর মনে হত। অবারিত সরিষা ফুলের খেতের মধ্য দিয়ে হাঁটার মাঝে যে মজা লুকিয়ে থাকে তেমনি মজা পেত সে বর্ষার দিনে কলা গাছ দিয়ে ভেলা বানিয়ে। কখনও বৃষ্টিতে ভিজে পারার ছেলেদের সাথে মাছ ধরা, কখনওবা নতুন পানিতে সাঁতার কাটা। শৈশবে সবই সে পেয়েছে প্রকৃতির কাছে। কিন্তু বাংলাদেশের গ্রামের যে সীমাবদ্ধতাটুকু আছে তা তাকে আজও ভাবায়। স্কুল কলেজ পড়–য়া ছেলেমেয়েরা কত কষ্টে গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায় সে কথা বিপ্লবের মত হয়ত নগরীর তথাকথিত আধুনিক মানুষগুলো জানে না। যারা গ্রামকে ভালবাসে শুধুমাত্র নাটক সিনেমা বা প্রামাণ্য চিত্রের মধ্যে। বাস্তবে যারা কখনই গ্রামে যেতে চায় না। বা যাবে না। বিপ্লব নামের এই ছেলেটি সবই দেখেছে জীবনে। সহজ সরল গ্রামে বেড়ে উঠা ছেলেটি ঢাকাকে জয় করে ফেলেছিল। যেদিন ঢাকার উঁচুতলার মানুষগুলো তাকে সমীহ করে কথা বলতো। বিপ্লবের সাথে কাজ করতো। যারা বিপ্লবের মেধা দেখে অবাক হয়ে যেত। মেধা, শ্রম দিয়ে সে ঠিকই জায়গা করে নিয়েছিল নিজের।
কে বলবে পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিযোগিতাপূর্ণ এই দেশে এসে সে কি পারবে তার সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে।

লন্ডন পৌঁছতে তার ৩ ঘন্টার মত সময় লাগে। ঘুমিয়ে পড়েছিল সে ট্রেনে। লন্ডন প্যাডিংটন স্টেশনে নেমে সে সোজা চলে আসে তার সেই বন্ধু জামসেদের বাসায়। জামসেদ এতদিনে লন্ডন এসে থাকা শুরু করেছিল। এটাকে বিপ্লবের বাসাও বলা যায় কেননা এই বাসার এ্যাড্রেস ব্যবহার করার জন্যে সে প্রতি মাসে জামসেদকে অল্প হলেও ভাড়া দেয়।   
বাসার কলিং বেলের বাটন চাপতেই দরজা খুলে দিল ছাব্বিশ সাতাশ বছরের একটা যুবক। বিপ্লব তাকে চিনে না। চেনার কারণও নেই। কারণ সে জামসেদকে আগে কোনদিন দেখেনি। শুধু ফোনে কথা বলেছে। ছেলেটির হাসিখুশি মুখ দেখে বিপ্লব ঠিকই ধরে নিয়েছিল এই ছেলেটিই জামসেদ। যে তার পাশে থেকেছে। সর্বদা পরামর্শ দিয়েছে তাকে, কখন কবে কি করতে হবে। তার অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে বিপ্লব প্রায় ৪ মাস পার করে দিয়েছে ইউকেতে। বাসায় আসার আগেও ফোন করে বিপ্লব জামসেদকে বলেছে, তার আসার কথা। তাই হয়ত তার প্রিয় বন্ধুটি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল বিপ্লবের জন্যে।
বিপ্লবকে পেয়ে গলা ধরে জামসেদ বলল, আরে দোস্ত এতদিন পর তোমার আসার সময় হল?
এই যে এলাম। তুমি কেমন আছো?
ভাল আছি। আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশ যাচ্ছি। ১ মাসের জন্যে।
বিপ্লব বলল, খুব ভাল কথা। আমি কাজ ছেড়ে দিয়েছি আগেরটা। আগামী কাল নতুন একটা কাজে যাব।
জামসেদ বলল, আর কথা না। ফ্রেস হয়ে নাও। দুজনে মিলে ভাত খাব। আমিও এখনো খাই নি। একসাথে দুজনে মিলে খাব।
বিকেলে জামসেদের সাথে বিপ্লব লন্ডন ঘুরতে বের হয়। লন্ডনের তেমন কিছু বিপ্লব চিনেও না। কারণ সে বেশিদিন লন্ডনে ছিল না। যত দিন ছিল শুধু কাজের সন্ধান করেছিল। তারপরেও বিপ্লব লন্ডনের টিউব বা বাসে করে যেকোন জায়গায় যেতে পারে।
পুর্ব লন্ডনের মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় বাস হচ্ছে ২৫ নম্বর বাস। অনেক বড় বলে এই বাসটাতে অনেকগুলো দরজা আছে। ছাত্ররা বেশিরভাগ সময়ই এই বাসে ফ্রি যাতায়াত করে। কখনো আবার এর জন্যে অনেককে জরিমানা গুণতে হয়। কিন্তু তারপরেও বিনা ভাড়ায় যাওয়াটার চেষ্টা অনেকেই করে। 
এই ২৫ নম্বর বাসের শেষ মাথা হচ্ছে লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রীট। অক্সফোর্ড স্ট্রীট হচ্ছে লন্ডনের সপিং মলগুলোর আখরা। ঢাকার যেমন গুলিস্তান ঠিক তেমনি এখানে সব কিছু পাওয়া যায়। সব ব্রান্ডের দোকান আছে এখানে।
বিপ্লবের খুব ভাল লাগছে অক্সফোর্ড স্ট্রীট আসতে পেরে। রেস্টুরেন্টের বাঁধাধরা নিয়মের গন্ডি পেরিয়ে সে যেন খুঁজেপায় আসল নগর জীবনের মজা। এক সপ থেকে আরেক সপে যাচ্ছে তারা। কোন ক্লান্তি নেই তাদের। জামসেদ তার বাংলাদেশ সফরের কারণে সবার জন্যে উপহার কিনছে। বিপ্লব ও তার ছোট ভাইর জন্যে একটা প্লে-স্টেসন ও আইপড কিনল। যেটা জামসেদের সাথেই পাঠাবে সে। সপিং সেন্টারে মেয়েদের চমৎকার সব সামগ্রী দেখে বিপ্লবের খুব কিনতে ইচ্ছে করে পরীর জন্যে। কিন্তু পরীর কোন ঠিকানায় সে পাঠাবে তা ভেবে পায় না।
ইংলিশ মেয়েরা গলায় বিভিন্ন কালারের মালা, সাথে ম্যাচ করে কানের দুল পরে। ভারি সুন্দর মানায় তাদের। এমনি একটা সেট হাতে নিয়ে বিপ্লব পরীকে কল্পনা করে। সে দেখতে পায় পরী এই সেটটা পরে তার সাথে হাঁটছে লেস্টার স্কোয়ারে। সেখানটাকে বলা হয় লন্ডনের ছবিপাড়া। হলিউড এর অনেক বড় বড় তারকারা আসে সেখানে। সারা পৃথীবির মানুষ তাদের প্রিয় তারকাকে দেখতে আসে। কপোত-কপোতীরা জোড়ায় জোড়ায় ঘুরে বেড়ায়। রেস্টুরেন্টে খায়। খুব জমকালো রঙিন একটা পরিবেশ। কারো কোন বারণ নেই। যে যার মত যেমন খুশি চলে। বিপ্লবেরও খুব ইচ্ছা পরীকে নিয়ে এভাবেই ঘুরে বেড়াবে।
এই সময় জামসেদ ডাক দিল। এই বিপ্লব মেয়েদের সেকসনে কি করছ? কি দেশে কেউ আছে নাকি? থাকলে কিনে দিতে পার। আমি পৌঁছে দেব।
বিপ্লব বলল, আছে। কিন্তু তাকে আমি ভালবাসি। সে বাসে কিনা তা জানি না। কারণ তাকে এখনো বলাই হয় নাই। তাই ভাবছি কিছু কেনা ঠিক হবে কিনা।
জামসেদ বলল, দরকার নাই। আগে তাকে বলে দেখ, সে কি বলে। তারপর যত খুশি কিনতে পারবে।
দুজনে সপিং সেন্টার থেকে বের হয়ে গেল। জামসেদ একটা নতুন ক্যামেরা কিনেছে। তা দিয়ে ছবি তুলল তারা দুজনে মিলে। অনেক গুলো ছবি তুলল তারা। এত ছবি বিপ্লব জীবনেও তুলেনি।
ডিজিটাল ক্যামেরার এই একটা সুবিধা যত ইচ্ছা ছবি তোলা যায়। আবার পছন্দ না হলে ছবি মুছে ফেলা যায়। বাংলাদেশে বিপ্লবদের বাসায় তখনো ডিজিটাল ক্যামেরা ছিল না। তাই বিপ্লবের একটা ক্যামেরা কিনতে ইচ্ছে করল। কিন্তু হাতে তেমন টাকা ছিল না বলেই তখন আর তার ক্যামেরা কেনা হল না।
পরের দিন জব সেন্টারে গিয়েই একটা জব পেল বিপ্লব। সামারসেটের এই রেস্টুরেন্ট মালিকের সাথে কথা বলার সাথে সাথেই বিপ্লব রাজি হয়ে যায় কাজে যেতে। বেতন ১৪০ পাউন্ড। ২ সপ্তা পর ১৬০ করে দিবে তাকে। মালিকের নাম ফরহাদ। শুদ্ধ বাংলায় কথা বলে। খুবই সুন্দর ব্যবহার তার। কথা বললে মনে হয় যেন, আসল ভদ্রলোক। এত ভদ্রভাবে কথা বলা মানুষ বাংলাদেশেও কম আছে। যে কেউ তার কথায় মুগ্ধ হয়ে যাবে।
বিপ্লবকে সে বলে, আমার বাড়ি সিলেটে না। তুমি এখানে কাজে আসলে, সবাই খুব আপন করে নেবে তোমাকে।
এত ভাল কথা ইংল্যান্ডে আসার পর বিপ্লব আর শোনেনি। রাতের বাসেই সে সামারসেট চলে যায়। 
রাত দশটা পনের এর মত বাজে। বিপ্লব ফরহাদ সাহেবের জন্যে অপেক্ষা করছে সামারসেটের একটা বাস স্টান্ডে। সিগারেট ধরানোর পর অর্ধেকটা শেষ না হতেই দেখে, একটা লোক বিএমডাব্লিউ চালিয়ে আসছে তার দিকে।  
বিপ্লবকে দেখে ফরহাদ সাহেব বলল, কেমন আছ বস।
বিপ্লব উত্তর দিল, ভাল আছি, বস।
অনেক দিন পর তার প্রিয় ‘বস’ ডাকটা শুনে বিপ্লবের খুব ভাল লাগল।
বিপ্লব যখন ভার্সিটিতে পড়ত। তখন সবাই তারা একে অপরকে বস ধরে ডাকতো। বস ডাকটা খুব প্রিয় এই জন্যে তার কাছে।
ফরহাদ সাহেব বলল, আমার দুইটা রেস্টুরেন্ট। একটা আমি চালাই আর একটা আমার বড় বোন চালায়। সেটা এখান থেকে ১৫ মিনিট লাগবে যেতে। তোমাকে আমি ওটাতে নিয়ে যাব এখন।


বিপ্লবের এবারের রেস্টুরেন্টটির থাকার যায়গার অবস্থাটা খুব বাজে। ৮ ফুট বাই ৬ ফুট রুমে তিন জন থাকে তারা। দুইটা বেড পাতা আছে রুমটিতে। যে বেডটাতে উপরে নিচে থাকার ব্যবস্থা, সেটার উপরের অংশে থাকতে দিয়েছে তাকে। রাতে যদি টয়লেটে যেতে হয় তাহলে আরেকজনের ঘুমের ব্যাঘাত করে তাকে যেতে হয়। শুধু এই কারণে তাকে ঘুমিয়ে পরতে হয় খুব তাড়াতাড়ি। আবার সকালেও সবার সাথে উঠতে হয় একই কারণে। বিছানার উপরে বসে থাকাও যায় না। কারণ তাতে তার মাথা উপরের ছাদের সাথে লেগে যায়। কাজ শেষ করে তার কোথাও বসার যায়গা নেই। সোজা নিজের বিছানায় শুয়ে পরতে হয়। ভীষণ এক দুর্বিসহ যন্ত্রণার মধ্যে তাকে পরতে হয়। এত খারাপ জায়গাতে সে আর কখনো থাকেনি জীবনে।
বিপ্লবের সাথে কাজ করে শেখ নামে একটি ছেলে বয়স ৩৪-৩৫ এর মত হবে। বাংলাদেশ থেকে শেখ এসেছে প্রায় ৫-৬ বছর হল। অত্যন্ত বিনয়ী এই ছেলেটা বিপ্লবকে খুব সাহায্য করে কাজে। সে-ই বলে, ফরহাদ সাহেব খুব খারাপ একটা মানুষ। ছেলেদের খুব সুন্দর করে পটিয়ে কাজে আনে। ২-৩ সপ্তা কাজ করিয়ে তার পর বিদায় করে দেয়। আবার নতুন মানুষ আনে। সবাইকে ঠিক মত টাকা পয়সা দেয় না। যাদের ভিসা নেই তাদের সাথে অমানসিক ব্যবহার করে। বেতন আটকিয়ে অনেককেই জিম্মি করে রাখে। অবৈধ ছেলেরা ভয়ে কিছু বলে না তাকে। কারও কারও গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছে সে। আমার সামনেই সে অনেক ছেলেকে মেরেছে। তাদের দোষ ছিল একটাই যে তারা তাদের পাওনা টাকা চেয়েছিল। কিন্তু তোমার সাথে মনে হয় সে এত বড় সাহস পাবে না। কারণ তোমার ভিসা আছে। তাছাড়া তোমার শরীরের শক্তি তার চেয়ে বেশি হতে পারে। হয়ত ভয়েই তোমাকে সে মারবে না। তবে খারাপ ব্যবহার করতে পারে মাঝে মাঝে। তুমি এতে মনে কিছু করো না। ফরহাদ সাহেবের মাথা ঠান্ডা হলে আবার খুব ভাল মানুষ হয়ে যায়। আমি এই রেষ্টুরেন্টে কাজ করি প্রায়ই ৩ বছর। নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি আমি। কিছুতেই এখন আর কিছু মনে করি না। বস আসে খুব কম এখানে। তাই কাজ করে মজা পেয়ে গেছি। ভালই আছি মোটামুটি। 
বিপ্লব বুঝতে পারে তার প্রথম রেষ্টেুরেন্টে বেতন কম থাকলেও সেখানে একটা মজা ছিল। সবাই সবার সাথে মিশত। এখানে কেউ কারো সাথে মিশে না। সবাই কাজ শেষে ঘুমায় সেটা রাত হতে পারে আবার দিনও হতে পারে। কিন্তু বিপ্লবের দিনে ঘুমানোর অভ্যাস নেই। তার খুব খারাপ লাগছিল এখানে এসে। তারপরেও সবার সাথে পরিচিত হয়ে যাবার পর মানিয়ে নিয়েছিল সে। 
শেখ আর বিপ্লব দুইজন মাত্র এখানে আছে, ওয়েটার বলে বিপ্লবকে সবসময় খাবার সার্ভ করতে হয়। এতে বিপ্লবের খাবারের প্রতি আরো দখলে চলে আসে কয়েক দিনের মধ্যে। 


নতুন এই জায়গাতে দেখার মতো তেমন কিছুই নেই। বিপ্লব তাই লাঞ্চ ব্রেকের পর লাইব্রেরীতে বসে ইন্টারনেট ইউজ করে। আর ডে-অফের দিন রুমের মধ্যে বসে থাকে। এমনই এক ডে-অফের দিন যখন সবাই কাজে নেমে গেছে তখন বিপ্লব ঠিক করে পরীকে সে আজ জানাবে যে, সে তাকে ভালবাসে। 
মানুষ যখন একা থাকে তখন সে খুব গভীর চিন্তা করতে পারে নিজেকে নিয়ে। এই যায়গাটা বিপ্লবের জীবনের একাকীত্বকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। 
কিন্তু সে পরীকে কীভাবে বলবে ভেবে পায় না। সে কি ফোন করবে না এসএমএস পাঠাবে। চিন্তা করে দেখলো ফোন করে যদি শেষ পর্যন্ত বলতে না পারে তার চেয়ে এমন একটা টেক্সট লিখে ফেলতে হবে যা দিয়ে পরীকে বলা হয়ে যায় তার মনের কথা। 
এই সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে লিখতে শুরু করেÑ
‘কেমন আছো পরী? আমি ভাল না। মনটা খুব খারাপ আজকে। সারাদিন শুধু তোমার কথা ভেবেছি। যে কথাটা তোমাকে আজও আমি বলতে পারিনি সে কথাটা কীভাবে বলি তোমাকে? তোমাকে যে আমি ভালবাসি। যদিও আমি একটা অসম্ভব কিছু আশা করছি তোমার কাছে। তারপরেও বলবো, যদি তুমি রাজি থাক তাহলে আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। আর যদি তুমি রাজি নাও থাক তাহলে প্লিজ কথাটা যে আমি বলেছি কেউ যেন না জানে। 
ভাল থেকো।’ 
বিপ্লব।
অনেকক্ষণ ধরে এসএমএসটা লিখে বার বার বিপ্লব শুধু পড়ছে। ভাবছে পরীকে পাঠাবে কিনা। সময় যেতে যেতে যেই ঘড়িতে ৬ টা বাজলো। মানে বাংলাদেশ সময় রাত ঠিক ১২ টা সেই সময়ই বিপ্লব মোবাইল মেসেজের সেন্ড বাটনে চাপ দিল। 
যে প্রেম সে গত দশটি বছর ধরে লুকিয়ে রেখেছিল। যে কথাটি বলার জন্যে বিপ্লবের মন এতদিন ব্যাকুল ছিল। তার সেই স্বপ্নের কথাটি সে তার প্রিয়তমাকে বলে ফেলেছে। আর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে উত্তরের জন্য নির্জন একটা রুমে একাকী। 
প্রায় এক ঘন্টা অপেক্ষা করার পরও যখন উত্তর আসে নাই তখন বিপ্লব ভাবলো হয়তো পরী ঘুমিয়ে পরেছে। তাই সে বাইরে বের হয়ে গেল। পথে পথে শুধু হেঁটে বেড়াচ্ছে। কিছুই ভাল লাগছে না তার। ভাবছে পরীকে কথাটা বলা হয়তো ঠিক হলো না। কিন্তু না বলেও তো উপায় নাই। তার তো পরীর মতামত জানতে হবে। এভাবে একতরফা ভালবাসার তো কোন মানে হয় না। রাত ৯ টা পর্যন্ত বাইরে ঘুরাঘুরি করে রুমে আবার চলে আসে সে। মোবাইল ফোনটি আবার চেক করে দেখলো কোন মেসেজ আছে কিনা। খুব হতাশ হলো বিপ্লব কোন মেসেজ না দেখে।   
বিপ্লব তার উপর নিচের বেডটার উপরের অংশে শুয়ে আছে। একসময় সে ঘুমিয়েও পরে। কিন্তু পরীর কোন মেসেজ আসছে না। হঠাৎ মোবাইলের মেসেজ এলার্টে তার ঘুম ভাঙে। পরীর নাম্বার থেকে মেসেজ পাঠিয়েছে বাংলাদেশের রাত ৪ টার দিকে। পরী লিখেছেÑ
‘বিপ্লব ভাই, 
তুমি আমাকে ভালবাসো বুঝলাম। কিন্তু আমার কিছু করার নাই। আমি আত্মিও স্বজনের মধ্যে কোন রিলেশন পছন্দ করি না। অনেক ভেবে দেখেছি। তোমাকে আমার ফিরিয়ে দিতে হলো। আমি খুব দুঃখিত। মাঝে মাঝে মেসেজ দিও, ফোন করো। ভাল থেকো। 
পরী।

পরীর মেসেজটা পেয়ে বিপ্লব কিন্তু একদমই অবাক হলো না। বরং পরী যে এটা লিখতে পারে সেটা বিপ্লব জানতো। তার কাছে ভাল লাগছে এই ভেবে প্রায় ৪ ঘন্টার মত পরী বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করেছে। ভেবেছে তাকে নিয়ে। এটাই বা কম কিসের? 
এখন চেষ্টা করে যেতে হবে আরো বেশি করে। অনেক সুবিধা হয়েছে তার কাছে এখন। অপেক্ষায়ই থাকতে হবে পরীর মন পরিবর্তন হওয়ার আগ পর্যন্ত। যত দিন সময় লাগে লাগুক। একদিন হয়তো পরী তার মন ঠিকই পরিবর্তন করবে। প্রতিদিন কাজ শেষ করে বিপ্লব মোবাইল চেক করে দেখে কোন টেক্সট আসছে কিনা। কিন্তু আর কোন টেক্সট পরীর কাছ থেকে সে পায়না।  
এদিকে একদিন দুপুর বেলা ফরহাদ সাহেব হঠাৎ এসে বিপ্লবকে ডেকে বললেন।
বিপ্লব তোমার জন্য একটা খবর আছে। 
বিপ্লব বলল, কি খবর বস?
ফরহাদ সাহেব বলল, আমার আরেকটা রেষ্টুরেন্ট আছে না তোমাকে বলেছিলাম, সেখানটায় একজন ফুল ওয়েটার দরকার। আমি ঠিক করেছি তোমাকে আমি ওখানটায় নিয়ে যাব। তুমি অনেক স্মার্ট আছো আর ইংলিশও মোটামুটি ভাল বলতে পারো। তুমি হয়তো কাজটা পারবে। তোমকে এই একটা সুযোগ আমি দিতে চাই। দেখ, মানুষ ২-৩ বছর ধরে কাজ করেও ফুল ওয়েটারের জব পায় না। আর তুমি ৫ মাসে ফুল ওয়েটারের জবের অফার পাচ্ছো।  
বিপ্লব বলল, আমি কি আসলেই পারবো বস?
ফারহাদ সাহেব বলল, অবশ্যই। তুমি পারবা বলেই আমি তোমাকে নিচ্ছি। এক কাজ করো রেডি হয়ে নিচে চলে এস। অমি অপেক্ষা করছি। 
বিপ্লব এবার ব্যাগ গুছিয়ে রওয়ানা হলো ফারহাদ সাহেবের সাথে। তার আরেকটা রেষ্টুরেন্টে। 
রেষ্টেুরেন্টে পৌঁছে তো বিপ্লবের চোখ ছানাবড়া। ফারহাদ সাহেব যে রুমটা বিপ্লবকে দেখালেন তার থাকার রুম বলে, বিপ্লবতো বিশ্বাসই করতে পারে না সে কি স্বপ্ন দেখছে কিনা। এই রুমে সব কিছু আছে। টিভি, টেলিফোন, সোফা থেকে শুরু করে সব কিছু। এখানে নাকি বিপ্লব একা থাকবে। ব্যাপারটা বিপ্লবের কাছে বিশ্বাসই হচ্ছে না। খুব ভাল লাগছে তার এই হঠাৎ পরিবর্তনে। 
বিকেল পর্যন্ত নতুন শহরটা ঘুরে বেড়ালো ও। রাতে যখন সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন ফরহাদ সাহেব বিপ্লবকে তখনও ফরহাদ সাহেব বিপ্লবকে সম্বোধন করলেন এই রেষ্টুরেন্টের নতুন ম্যানেজার হিসেবে। বিপ্লব খুব খুশি হলো মনে মনে।
বস একে একে পরিচয় করিয়ে দিলেনÑ
এই হচ্ছে সোয়েব। এই রেষ্টুরেন্টের শেফ। সুমন তান্ডুরি শেফ, আলম কুক আজিজ কিচেন পোর্টার, ওহাব ও মজনু আছে তোমার সাথে। 
বসের পরিচয়ের জন্যই হয়ত সবাই বিপ্লবকে খুব সহজে গ্রহণ করে নিল। বিপ্লবের কাছে কেন যানি মনে হলো তাহলে কি শেখ তার কাছে মিথ্যা বলেছে বস সম্বন্ধে? কিন্তু মিথ্যাই বলবে কি কারণে। শেখের কথা কেমন যেন উলট পালট লাগছে তার মনে। 
কিছুদিন পর থেকেই টের পেল বিপ্লব শেখের কথা মিথ্যে ছিল না। বিপ্লবের ডে-অফের দিন সে রেষ্টুরেন্টের ভিতর স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে ঢুকে। বিপ্লবকে স্যান্ডেল পরা অবস্থায় দেখে বস বললÑ
কি আমার ব্যবসার বারোটা (প্রচলিত একটা খারাপ গালি দিয়ে) বাজাতে এসেছো? বের হও এখান থেকে। বিপ্লব বুঝে পায় না সে কি করবে। তাড়াতাড়ি রেষ্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে গেল। 
এই বস সমন্ধে যা শুনেছে বিপ্লব তার থেকে এই ব্যবহার খুব বেশি খারাপ না। তার পরও এভাবে তাকে কেউ কোনদিন অপমান করেনি। কাঁদতে পারছে না সে। তারপরও তার কান্না চলে এসেছিল। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়েছিল সে তখন। 
বস রেষ্টুরেন্টের ফোন ব্যবহার করে কথা বলতে দেয় না। তাই সবারই মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে হয়। ইউকেতে প্রিপেইড মোবাইল থেকে কল করা খুব ব্যয়বহুল। কলিং কার্ড দিয়ে কল করা তাই হয়ই না। বিপ্লব তাই ফোন বুথে গিয়ে কথা বলে সবার সাথে। 
এদিকে আজিজ নামে যে ছেলেটি কাজ করতো তাদের সাথে, তার থেকে ফোনে কথা বলার একটা সিস্টেম শিখলো বিপ্লব। ৩০ পেন্স দিয়ে ১ ঘন্টা বাংলাদেশে কথা বলার সিস্টেম। বিপ্লবও কিনে ফেললো এমন একটা সিম আর একটা সেট।
এরপর থেকে বাংলাদেশে কথা বলা খুব সহজ হলো তার কাছে এর পর থেকে। প্রতিদিনই কাজ সেরে বিপ্লব যখন তার ফোন চেক করতে যায়, ভাবে আজ বুঝি পরী তাকে মেসেজ পাঠাবে। কিন্তু পরক্ষণেই হতাশ হয়ে যায় কোন মেসেজ না পেয়ে। 
বিপ্লবকে কিন্তু পরী ফোন করতে বলেছিল। 
বলেছিল, তুমি কিন্তু ফোন করো মাঝে মাঝে। আমাদের সম্পর্ক যেন ঠিক থাকে।    
কিন্তু বিপ্লব ফোন করেনাই এতদিন। ফোন করে কি বলবে সে পরীকে। তার তো আর কিছু বলার নাই। যা বলার ছিল সব তো বলে ফেলেছে সে। তবুও যেদিন বিপ্লবের কোন কাজ থাকে না অথচ সবাই যখন ব্যস্ত থাকে সেদিন কেন যেন পরীকে তার বেশি মনে পরে। কেন যেন তার পরীর সাথে একটু কথা বলতে ইচ্ছে করে। শুনতে ইচ্ছে করে তারই প্রিয়তমার সেই কন্ঠ। বিপ্লব নিজেকে আর আটকে রাখতে পারে না। পরীকে ফোন করলো সে। রাত তখন সাড়ে ১১টার মত বাজে। সাড়ে ১১টা এমন একটা সময় যে সময় যে কাউকে ফোন করা যায়। কারণ রাত ১২টার পর কাউকে ফোন করতে গেলে পূর্বানুমতি লাগে। কিন্তু সাড়ে ১১টায় ফোন করা তেমন কিছু না। এটা যে কাউকে যে কেউ করতে পারে। তাই পরীকে ফোন করার সময়টা সে সাড়ে ১১ টাকেই বেছে নিল এই ভেবে, যদি পরী তার সাথে কথা বলার ইচ্ছা থাকে তাহলে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলতে পারবে আর যদি কথা না বলতে চায় তবে বিপ্লব বলবে এমনিতেই ফোন করেছিল। খোঁজ খবর নিতে আরকি। তাছাড়া পরী জব করে। হয়ত আগামী কালও তার অফিস আছে। তার জন্য সাড়ে ১১টা হচ্ছে ঘুমের প্রস্তুতি নেওয়ার সময়। এই সময়টা মানুষ নিজেকে নিয়ে চিন্তা করে বেশি। প্রায় সব মানুষই ঘুমানোর আগে তার জীবনের ছোট ছোট স্বপ্নগুলো দেখে।    
বিপ্লবের ফোন ধরে অপর প্রান্ত থেকে পরী যখন হ্যালো কথাটা বলল তখন বিপ্লবের বোধে আচমকা একটা ভয় কাজ করলো। কি বলবে সে পরীকে? খুব সাহস করে বলল,
পরী আমি বিপ্লব। 
পরী কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, কেমন আছো তুমি?
গলার স্বরটা বিপ্লবের কাছে কেমন যেন অন্য রকম লাগছে। তাহলে কি পরী ঘুমিয়ে ছিল? সেতো পরীকে বিরক্ত করতে চায় না। এই ভেবে পরীকে বিপ্লব বলল, তুমি কি ঘুমিয়েছিলে? তোমার কন্ঠস্বর অন্যরকম লাগছে।
পরী বলল, না। অনেক দিন ধরে আমার মনটা খুব খারাপ। ঘুম আসে না। জ্বর আসছে মনে হয়। 
বিপ্লব জ্বর শোনার পর পরীর সাথে আর বেশিক্ষণ কথা বলার সাহস পেল না। সে শুধু বলল, ভাল থেকো পরী। আমি এমনিতেই ফোন করেছিলাম।
ফোনটা বিপ্লবই আগে কেটে দিলো। কারণ পরীকে বলার মতো কিছুতো তার কাছে বাকি নেই। এখন বলার কথা পরীর। ও যখন বলে না তহলে কেন আবার নিজেকে ছোট করবে সে। কিন্তু পরীর ফোন রেখে দিলেওতো পরীকে রেখে দিতে পারে না বিপ্লব। ফোন রাখলেও মন থেকে পরীকে সরিয়ে রাখতে পারছে না। মনে মনে আশা করে পরী যেন তাকে এসএমএস পাঠায়। আর সে এসএমএসটা পেলেইতো বিপ্লব ফোন করতে পারে। পরীর সাথে কি তার আরো কথা বলা উচিত কিনা বুঝতে পারে না সে।
ওয়াভ নামে একটি ছেলে কাজ করে বিপ্লবদের সাথে। ছেলেটা খুব চালাক প্রকৃতির। বসকে সব সময় তেল মেরে  চলে। বসের কাছে রেষ্টুরেন্টের সব কথা পাস করে। কে কি করছে? এমন কি আজ কি দিয়ে রান্না মানে দামি খাবার না কম দামি খাবার এগুলো বসের কানে সে পৌঁছে দেয়। আরো যেটা করে সেটা হলো বস সম্বন্ধে কে কি বলে তা আরো রং মেখে বসের কানে দেয়। বিনিময়ে তার মত একজন অযোগ্য লোক বসের এখানে কাজ করার সুযোগ পায়। যে কিনা ইংলিশ বলতে পারে না। অথচ ইংলিশ কাস্টমারদের সার্ভ করছে। কাষ্টমার কিছু আস্ক করলে সে বিপ্লবকে ডেকে নিয়ে যায় বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। ওয়াব টিকে আছে শুধু তেলের জন্যে। অবশ্য বিপ্লবের সম্বন্ধে তেমন কিছু সে বলে নাই। কারণ বিপ্লবকে দিয়ে তার খুব উপকার হয়। যেমন কাষ্টমার কেয়ারে ফোন, ব্যাংক সপিং ইত্যাদি কাজে সে বিপ্লবের সাহায্য পায়। তার পরেও বিপ্লব একটা ভুল করলে সাথে সাথে বসের কানে কথাটা পাস করে দেয় সে। 


একদিন শনিবার প্রচন্ড বিজি ছিল রেষ্টুরেন্ট। বস ও বিপ্লব টেলিফোনে অর্ডার নিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর একটা কাষ্টমার ফোন করলো যে তার কিছু খাবার মিসিং আছে। ফোনটা ধরলো বস। কাষ্টমারকে বস আবার এসে খাবারগুলো নিয়ে যেতে বললেন। কিন্তু কাষ্টমার আর আসতে চাইলো না। বস তখন ওই কাষ্টমারের ঠিকানায় খাবার দিয়ে আসবে বলল।  
কিন্তু এদিকে তো বস তার সেই রক্ত মাখা চোখ করে ওয়াব, বিপ্লব, মাজিদকে ডেকে নিয়ে গেল কিচেনে। সবাইকে জিজ্ঞেস করলো ওই খাবারটা কে দিছে কাষ্টমারের হাতে। 
ওয়াব সাথে সাথে বলে দিল বিপ্লবের নাম। বসতো এবার কিচেন থেকে একটা চাকু হাতে নিলো। ভীষণ গালাগালি করতে লাগলো বিপ্লবকে। এক পর্যায়ে বলল, একদম নিফাইং করে দিমু। বিপ্লব কাপছিল তখন। এই লোকটার অবস্থা দেখে। ভয় সে পেল। সে শুনেছে বস এর আগে অনেক ছেলেদের মেরেছে। কিছু বলল না। শুধু মাথাটা নিচের দিকে রেখে দিলো সে।    
যে মুখে হাসি সব সময় লেগে থাকে। যে কিনা অন্যের দুঃখও সহ্য করতে পারে না। সেই বিপ্লব মূর্তির মত অবাক হয়ে বসের গালি হজম করছে।  
কিছুক্ষণ পর বসের মাথা ঠান্ডা হলো। সবাইকে কাজে যেতে বলল। বিপ্লব কাজ করছে। শনিবার বলে কথা। পুরো রেষ্টুরেন্ট কাজতো করতেই হবে। ৩ ঘন্টা পর বস একটা চকলেট এনে বিপ্লবের মুখে তুলে দিয়ে বলে, 
মনে কিছু করো না। আমরা মেশিন হয়ে গেছি। অনেক বছর ধরে কাজ করতে করতে মেজাজটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। এখন আর মানুষের পর্যায়ে আমি পরি না। সরি বিপ্লব। 
বসের সরিটা আর্টিফিসিয়াল হলেও স্টাইলটা সুন্দর ছিল। তাই সে ডিসিশন নিতে পারে না কাজ ছেড়ে দিবে কিনা। যদিও এখানে শনিবার মোট ১৪ ঘন্টার মত কাজ করতে হয়। সমস্ত কাষ্টমার চলে যাওয়ার পর শনিবার এখানে ক্লিনিং চলে। ক্লিনিং করতে করতে ভোর তিনটার মত হয়ে যায়। তার পরেও কেন যেন ভাল লাগে এখানে কাজ করতে তার।
রুমি নামে একজন বাংলাদেশের ছেলে বউ নিয়ে থাকে বিপ্লবের পাশের রুমে। ছেলেটার বয়স ২৫-২৬ হবে। ৩-৪ বছর হলো ইংল্যান্ডে এসেছে। প্রেম করে বিয়ে করেছে তারা। খুব মিল দুজনের মধ্যে। পাশের রুমে থেক তাই বিপ্লব মাঝ মাঝে হাবিবের সেই গান শুনতে পায়Ñ
‘ভাল বাসবো বাসবোরে বন্ধু তোমায় যতনে’ 
খুব সুখের সংসার তাদের। দুজনেই জব করে দুইটা সুপার স্টোরে। লন্ডন বেইস স্টুডেন্ট হলেও তারা সামারসেটে খুব আরামেই দিন কাটাচ্ছিল। বিপ্লব ওদের লাইফ স্টাইলটা খুব পছন্দ করে। সেও স্বপ্নে দেখে যদি পরী কোনদিন তার মত পাল্টায় তবে ওদের মত ভাল বাসবো বাসবোরে গান বাজিয়ে সেও ঘুমাতে পারবে। 
রুমির সাথে বিপ্লবের খুব ভাল একটা বন্ধুত্ব হয়। রুমি বিপ্লবকে বলে, তুমি ইংলিশ জবের জন্য চেষ্টা কর। তোমার সিভি দাও আমার ওখানে আমি দিয়ে রাখবো। যদি তাদের লোক দরকার হয় তোমাকেই কল করবে তারা। বিপ্লব তখন অনেকগুলো সিভি প্রিন্ট করে।  
রুমির সাথে যেয়ে একটি ব্যাংক একাউন্টও করে ফেলে বিপ্লব। দুজনে মিলে জব খুঁজে। খুব ভাল একটা রিলেশন তৈরী হয় রুমির সাথে বিপ্লবের।
একদিন ওয়াবকে বস কাজ ছেড়ে চলে যেতে বলে। কারণ, বসের এক আত্মীয় আসছে তাকে কাজ দিতে হবে এই জন্যে।   
বিপ্লব বসকে বলল, তাহলে বস একটা কাজ করেন। আমি পারটাইম কাজ করি এখানে। ওয়াব ফুল টাইম থেকে যাক। আমাকে যা হয় একটা বেতন দিয়েন। আর আপনার এখানে থাকলাম, খেলাম। যখন আপনি যা বলবেন সেদিনই কাজ করবো। আমি দেখি একটা ইংলিশ জব পাই কিনা।  
বসতো শুনে খুব খুশি। কারণ সে ওয়াবকেও হারাতে চাইছিল না। কিন্তু উপায় না দেখে তাকে না করে দিয়েছিল।
বস (ফারহাদ সাহেব) বিপ্লবকে বলল, তুমি তাহলে শুক্রবার সারা রাত, শনিবার সারা দিন, রবিবার সকালে কাজ করো। আমি তোমাকে থাকা খাওয়া ফ্রি সাথে ৫০ পাউন্ড হাত খরচ দিব। আর যদি কোনদিন তোমার রাতে কাজ করানোর দরকার হয় তখন আমি তোমাকে ২৫ পাউন্ড রাত প্রতি দেব।  
বিপ্লবতো মহা খুশি। সে সাথে সাথে রাজি হয়ে গেল। আগামী সপ্তাহ থেকে সে পুরো ৫ দিন কাজ খুঁজে বেড়াতে পারবে। 
খুঁজতে খুঁজতে পাঁচ দিনের মাথায় একটা জব পেয়ে যায় বিপ্লব। জবটা হলো রয়েল মেইলের। ডেলিভারি ড্রাইভারের সাথে গিয়ে চিঠি পারসেল মানুষের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কাজ। সপ্তাহে ৫ দিন ৮ ঘন্টা করে করতে হবে। প্রতি ঘন্টা ৬ পাউন্ড। 
মানে সপ্তাহে ৩৯ ঘণ্টার জন্যে ট্যাক্স কাটার পর সে প্রায়ই ১৯০ পাউন্ড  পাবে...।
ওদিকে ফারহাদ সাহেব দিবে তাকে ৫০ পাউন্ড। সব মিলিয়ে সে সপ্তাহে যদি ২০০ পাউন্ড সেইভ করে মাসে ৮০০ পাউন্ড। মানে বাংলাদেশি টাকায় প্রায়ই ১ লাখ ১৫ হাজার টাকার মত।  
যদিও তাকে সপ্তাহে সাত দিনই কম বেশি কাজ করতে এর জন্য। কিন্তু ৫ দিন রাতে তার কোন কাজ থাকবে না। ঘুরে বেড়াতে পারবে অথবা টিভি দেখতে পারবে। কারণ রয়েল মেইলে যেতে হবে তাকে ভোর ৭ টার সময় আর ৪ টার মধ্যে কাজ শেষ করে বাসায় চলে আসতে পারবে সে। 
রয়েল মেইলের অফিসে প্রথম দিনটা শুরু হয়েছিল তার ট্রেনিংয়ের মধ্যে দিয়ে। বিপ্লবের সাথে আরো ৫ জন জয়েন করেছিল। সবাইকে ছোট খাটো একটা ৮ ঘন্টার ট্রেনিং করালো সেদিন। পরে রয়েল মেইলের ড্রেস দিয়ে দিলো। বলল, পরের দিন থেকে কাজ শুরু। বিপ্লবের টিম লিডার হিচ্ছে ক্রিস। এই টিমে আরো ৩ জন আছে। ২ জন পুরানো এবং বাকিজন বিপ্লবের সাথেই জয়েন করেছে। তার নাম মার্ক। 
ক্রিস বিপ্লবকে সব ইনসট্রাকশন দিয়ে দিলো। কীভাবে আগামী কাল তারা কাজ শুরু করবে। 
সকাল বেলা ৭ টার সময় যখন বিপ্লব ক্রিসের কাছে গেল। ক্রিস বলল, কফি খেয়ে নাও। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে যাব। বিপ্লব মেশিন থেকে ৫০পি দিয়ে একটি কফি বের করে গাড়িতে উঠলো। ক্রিস গাড়ি চালাচ্ছে। নিজের ওয়ার্ক প্লানটা দেখাচ্ছে। গাড়িতে রেডিও বাজায় সে। কাউন্টি রেডিও বলে এটাকে। সব জনপ্রিয় গান বাজায় এরা।  
রেডিও ইংল্যান্ডের খুব জনপ্রিয় একটা মাধ্যম। কিন্তু বাংলাদেশেতো এখন আর কেউ রেডিও বাজায় না। অথচ আধুনিক এই দেশের সবাই রেডিও শুনে গাড়িতে। ব্যাপারটা ভারি ইন্টারেস্টিং লাগে বিপ্লবের কাছে। 
ক্রিস বলল, আমরা একদিন এক জায়গাতে কাজ করি। পুরো সামারসেট ভোরে তাই আমাদের কাজ করতে হয়। প্রায় সব গ্রামেই আমাদের যেতে হয়। কাজের মধ্যেই ঘোরা হয়ে যায়। মজা পেয়ে গেছি জবটাতে। তাই আর চাকরিটা পরিবর্তন করি না। দেখো তোমারও ভাল লাগবে। 
আসলেই যদি পারসেল নিয়ে বিপ্লবকে ক্রিস কোন বাসায় পাঠায় তবে বিপ্লব ব্যাপারটা খুব এনজয় করে। অনেক ভদ্রমহিলারা খুব ভাল ব্যবহার করে তাদের সাথে। অনেক সময় চা-কফি খেয়ে যেতে বলে। 
ইংল্যান্ডের গ্রামগুলো বাংলাদেশের গ্রামগুলোর মতই। কিন্তু তফাৎ এতটুকু যে এখানে গ্রাম হলেও সব কিছু আছে। মানুষ শহরে যে নাগরিক সুবিধা পায় গ্রামেও তাই পায়। সবার বাসাতেই গাড়ি আছে। কাজেই এখানকার মানুষ বুঝতেই পারে না সে কি গ্রামে আছে না শহরে আছে। বরং গ্রামে যারা থাকে বেশিরভাগই নাকি অনেক ধনি লোক তারা। দেখেও বুঝা যায়। তাদের সাথে কথা বলেও বুঝা যায় আবার। রয়েল মেইলে কাজ করে এসে সন্ধ্যায় বিপ্লবের আসলে কিছু করার থাকে না। রুমিদের রুমে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে, চা-কফি খেয়ে তারপর আবার একা। এর কারণ অন্য সবাই তখন কাজে ব্যস্ত থাকে। বিপ্লব তাই একদিন একটা ল্যাপটপ কিনে ফেলে। 
লাইব্রেরী থেকে নাটক ডাউনলোড করে এনে রাতে তা দেখে। এভাবে কিছু দিন যাওয়ার পর রুমিও একটা ল্যাপটপ নিয়ে নেয়। এবং তারা ইন্টারনেট কানেকসও নিয়ে নেয়।
অনেক দিন পর বিপ্লব এমএসএন ম্যাসেঞ্জার ব্যবহার করছে। লাইব্রেরীতে এমএসএন ব্যবহার করা যায় না। শুধু চেক করা যায়। আজ নিজের রুমেই তার ইন্টারনেট। 
এমএসএনে হঠাৎ পরীকে পেল সে। কিন্তু পরীকে নক করছে না। পরীও তাকে নক করছে না। এমন করে প্রায় এক ঘন্টা পার হয়ে গেল। পরী লিখলো, কি করছো তুমি?
বিপ্লব উত্তর দিলো কিছু না। নাটক দেখছি ইন্টারনেটে। দুজনের কথা হলো কিছুক্ষণ। তার পর আবার নীরবতা। কেউ কিছু বলছে না। হঠাৎ করে না বলে পরী চলে যায় নেট থেকে। 
নেট নেওয়াতে খুব ভালই হয়েছে। সময় কেটে যাচ্ছে ভালভাবেই।
ক্লান্তিহীন ছুটে চলা এই ছেলেটার যে কিনা ৬৬ ঘন্টারও উপরে কাজ করে সপ্তাহের মোট ১৬৮ ঘন্টার মধ্যে। তার পরেও স্বপ্ন দেখে বড় হওয়ার। অনেক বড় হতে হবে তাকে। এমন কিছু করতে হবে যাতে পরী তার উপর ভরসা পায়।  
নিয়মিত প্রতি মাসে এক লাখ দশ হাজারের উপরে টাকা পাঠাচ্ছে বাংলাদেশে। বিপ্লবের বাসার অবস্থাও আরো উন্নতি হচ্ছে দিনে দিনে। অনেক টাকা জমিয়ে ফেলে তারা বিপ্লবের জন্যে। বাবা মা ভীষণ খুশি বিপ্লবের উপর। বিপ্লবের মা সবার কাছে গল্প করে বেড়ায়। পরীর মাও এই গল্প শুনে ওদের বাসা থেকে। চারিদিকে বিপ্লবের জয়জয়কার শুনে পরী। মেয়েটাও ভেবে পায় না কি করবে। 
রুমি যদিও স্টুডেন্ট কিন্তু সে আসলে পড়াশুনা করে না। একটা কলেজে ভর্তি হয়ে আছে লন্ডনে। বছরে একবারও কলেজে যায় না। রুমির বউ রুমিকে আবার পড়াশুনা করার জন্যে খুব চাপ দেয়। রুমিরও ইচ্ছা অটোমোবাইলে ভর্তি হবে সামারসেটের একটি লোকাল কলেজে। বিপ্লবকে রুমি বলে তার পড়াশুনা আবার শুরু করার কথা। বিপ্লবও ঠিক করে যেহেতু সে রাতে কিছু করে না তাই নাইট শিফটের একটা কোর্সে ভর্তি হতে পারে। দুজনে মিলে ওরা যায় কলেজের ওপেন ডেতে। সব খোঁজ নিয়ে আসে তারা। ২ বছর এইচএনডি কোর্সের ফি চার হাজার পাঁচশত পাউন্ড। দুই বছর পর ইউনি থেকে এক বছর করলেই মাষ্টারর্স কমপ্লিট হয়ে যাবে। বিপ্লব কোর্সটিতে ভর্তি হয়ে যায়। তাকে খুব সহজেই কলেজটি একসেপ্ট করে। কিন্তু রুমি ঠিক করতে পারে না সে কি ভর্তি হবে কিনা। বিপ্লব একাই ভর্তি হয়। সপ্তাহে ৩ দিন ক্লাস ৫ টা থেকে রাত ৮ টা। ইন্টারনেটে এসাইনমেন্ট জমা দেওয়া যায়।
এইচএনডি ইন কম্পিউটিং কোর্সটা বাংলাদেশের কম্পিউটার সায়েন্সের উপর বিএসসি অনার্স এর প্রায় সব কিছুই কভার করে। লাভ হলো এটাই, এটা একটা ব্রিটিশ ডিগ্রি। এই ডিগ্রি থাকলে খুব সহজেই ইউকেতে জব পাওয়া যায়।
বিপ্লব নিয়মিত ক্লাশে যায়। প্রায় সব পরীক্ষাগুলোতেই খুব ভাল করে। অনেক ইংলিশ বন্ধু জুটে যায় তার। তারা বিপ্লবের সাথে গ্রুপস্টাডি করে। লাইফে বিপ্লব একটা মজা খুঁজে পায়। 
সপ্তাহে পাঁচ দিন রয়েল মেইল সাথে রাতে তিন দিন ক্লাসে পড়াশুনা। আবার শুক্রবার তাকে করতে হয় ১৮ ঘণ্টার মত কাজ। প্রথমেই সকাল সাতটায় রয়েল মেইলে তারপর পাঁচটা থেকে রেষ্টুরেন্টে। শনিবার সারাদিন রেষ্টুরেন্টে কাজ করে। রবিবার শুধু সকালে। এই রবিবারে আড়াইটার পর বিপ্লব ফ্রি হয়। আসলে তার ওই ৮-৯ ঘন্টাই সপ্তাহে ছুটি। তারপরেও রুমিদের বাসায় আড্ডা। কখনো সপিং কখনোবা সবাই মিলে ফিল্ম দেখতে যায় হলে তারা। এরই মধ্যে বিপ্লব একটা সাইকেল কিনে ফেলে কাজ এবং কলেজের সময় ঠিক রাখার জন্য। সাইকেল চালানো শিখেছিল সেই ক্লাস থ্রিতে থাকতে। ও যখন প্রাইমারী স্কুলে পড়ে তখন ৩ টাকা প্রতি ঘন্টায় সাইকেল ভাড়া নিয়ে চালানো শিখেছিলো। টিফিনের পয়সার টাকা দিয়ে টিফিন না করে সেই ছোটবেলায় সাইকেল চালানো বিদ্যাটা এখন খুব ভালভাবে কাজে লাগছে তার। সেই সময় একটা সাইকেলের আবদার করেছিল বিপ্লব তার বাবা মার কাছে। কিন্তু তার বাবা মা তাকে বলেছিল যদি তুই এইবার ফার্স্ট হতে পারিস তাহলে তোকে সাইকেল কিনে দিব। ক্লাস থ্রি, ফোর ও ফাইভে টানা প্রথম হওয়ার পরও তার বাবা মা তাকে সাইকেল কিনে দিতে পারে না। কারণ তখন একটা সাইকেলের দাম অনেক ছিল। একটা সাইকেল কিনতে প্রায় চার হাজারের মত টাকা লাগতো। বিপ্লব যখন হাই স্কুলে পড়ত তখন তার একটা সাইকেলের আসলেই খুব দরকার ছিল। তখন বিপ্লবদের বাসা থেকে হাই স্কুল অনেক দূরে ছিল। ক্লাস সিক্সে থাকার সময় বিপ্লব তার বাবা মাকে বলেছিল যদি আমি এইবার এক থেকে তিনের মধ্যে থাকি তহালে কিন্তু তোমরা আমাকে সত্যি সত্যি সাইকেল কিনে দিবে। বিপ্লবের মা তখন বলেছিল ঠিক আছে, দিব। বিপ্লব ক্লাস সিক্সে সেকেন্ড হয়। জানুয়ারি মাসে যখন ও তার নানা বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল ওর মার সাথে তখন বিপ্লব তার নানাকে পটিয়ে মার কাছ থেকে ঠিকই সাইকেল আদায় করে নেয়। তাই সাইকেলের সাথে বিপ্লবের অনেক স্মৃতি জড়িত। তার নানা আজ বেঁচে নেই। কিন্তুবিপ্লবের সাইকেল চালানোর সময় আজও নানার কথা মনে পরে। যে সারাদিন বসে থেকে সাইকেলের বিভিন্ন পার্টস কিনে একটা সাইকেল কিনে দিয়েছিল বিপ্লবের জন্য। মাঝে মাঝে সাইকেল চালানোর সময় বিপ্লবের চোখে পানি চলে আসে। মাকে এই সাইকেলের জন্য কত যন্ত্রণা দিয়েছিল সে। তার মার জন্য মনটা তার আরো খারাপ হয়ে যায়। পৃথিবীর সব মা-রাই তার সন্তানদের জন্য সব কিছু উজাড় করে দেয়। বিপ্লবের মাও দিয়েছে। একটা সাইকেল হয়ত অনেকের কাছে একটা সামান্য ব্যাপার কিন্তু সেই সময় বিপ্লবদের জন্য একটা সাইকেল মানে অনেক কিছু ছিল। তবুও তার মা তাকে কিনে দিয়েছিল। হয়ত অনেকের মা-রাই পারে না তার সন্তানদের সব ইচ্ছা পূরণ করতে কিন্তু আমরা সন্তানেরা কি আমাদের মাদের ইচ্ছা, তাদের ভাললাগা, পছন্দ অপছন্দ সব পুরণ করি। হয়ত বউকে পেয়ে অনেকেই ভুলে যাই সেই ছোটবেলার কথাগুলো। হয়ত অনেকে সমাজে অনেক বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়ে মাদেরকে তখন মনে হয় গ্রাম্য আনস্মার্ট একটা মহিলা। কিন্তু নারীর টানকে আসলে অস্বীকার করা কারোই ঠিক না। বিপ্লব এটা বুঝে আর তার জন্যেও শত পরিশ্রম করেও সে কখনও মাকে একদিন ফোন না করে থাকতে পারে না। তার মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল তার ছেলেরা একদিন অনেক বড় হবে। সমাজে মাথা উচু করে দাঁড়াবে। আধুনিক মানুষ হবে। মার কথা বিপ্লব ভোলে না। তাই তো অনেক কষ্ট করে হলেও আবার পড়াশুনা শুরু করেছে। দিন রাত পরিশ্রমের পরেও তার কোন ক্লান্তি নাই। তাকে যে বড় হতে হবে অনেক বড়। প্রতিষ্ঠিত নামে যে গন্তব্যটি আছে তাতে পৌঁছানোর জন্য বিপ্লবের এই ক্লান্তিহীন ছুটে চলা। 



ক্রিস হচ্ছে রয়েল মেইলের বিপ্লবের টিম লিডার। ৬৩ এর মত বয়স হবে লোকটার। নিঃসঙ্গ একটা মানুষ। তার বউয়ের সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে প্রায় ১০ বছর আগে। ক্রিসের একটা ২৫-২৬ বছরের মেয়ে আছে। নাম ক্যারোলিন। মেয়েটাও আলাদা থাকে। রোজই বাবাকে ফোন দেয়। বাপ মেয়ে কথা বলে মোবাইলে। খুব ভাল সম্পর্ক। ক্রিস বিপ্লবকে একদিন তার মেয়ের সাথে পরিচয়ও করিয়ে দেয়। মানুষটা একা থাকতে থাকতে অনেকটা অস্বাভাবিক আচরণ করে মাঝে মাঝে। অফিসের চিঠি বিলি বাদ দিয়ে তাই ওরা গাড়ি নিয়ে চলে যায় এক গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে। লোকালয়ের বাইরে। কখনো বা গভীর কোন জঙ্গলে গাড়ি থামিয়ে বিপ্লবরা ক্যাম্পফায়ার করে। কখনওবা অতি উঁচু কোন পাহাড়ে। যেখানেই যাক চিঠিগুলো তারা ঠিকই পৌঁছে দেয় যার যার ঠিকানায়। ডিসেম্বর মাসটা খুব বেশি ব্যস্ত রয়েল মেইল অফিস। বড়দিনের গিফট পৌঁছে দিতে হয় এ বাড়ি থেকে ও বাড়িতে। ২৪ তারিখ ঠিক বড়দিনের আগের দিন। ক্রিস, ক্যারলিন ও বিপ্লব স্যাম মিলে একটা রেস্টুরেন্টে খায়। একে অপরকে বড়দিনের উপহার দেয় তারা। তার পর টানা ৮ দিন ছুটিতে চলে যায় সবাই। 
বাংলাদেশের যেমন পহেলা বৈশাখ নববর্ষ ইংলিশদেরওতো তেমনি পহেলা জানুয়ারী নববর্ষ। আর এই নববর্ষটা আসে বড়দিনের ঠিক পরেই। তাই উৎসবের উপর উৎসব। সারা ইংল্যান্ড রঙিন বাতিতে ছেয়ে যায়। থার্টিফার্স্ট যে কি জিনিস বা এর তাৎপর্য কি বাংলাদেশের মানুষ না যেনেই আনন্দ করে। নিউ ইয়ার ইভ আসলে পুরোটাই ইংলিশ কালচার। এটা ওদের সংস্কৃতি। আমাদের যেমন পহেলা বৈশাখ। ইংলিশদের সার্থকতা হলো ওরা ওদের বছরের প্রথম দিনটি সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। আমরা আমাদের পহেলা বৈশাখকে পারিনি। আমাদের বৈশাখ যেমন আমাদের আত্মার একটা অংশ। তেমনি ওদের থার্টিফার্স্ট নাইট ওদের আত্মার একটা অংশ। বিপ্লব এর আগে কখনো নিউ ইয়ার ইভে নাইট ক্লাবে যায় নাই। এবার সারারাতই ছিল প্রায় বাইরে। খুব মজা করেছে। এই অতি আধুনিক মানুষগুলোর সাথে। রাতভর নেচেছে, গেয়েছে। দুই তারিখে অফিসে এসে বিপ্লব ক্রিসকে জিজ্ঞেস করলো, নিউ ইয়ার ইভে কি করেছো ক্রিস?
ক্রিস বলল, ১০টার সময় বিবিসি নিউজ দেখে ঘুমিয়ে পরেছিলাম। 
বিপ্লব আবার বলল, কখন উঠেছো আবার, ১২টার সময় কি?
ক্রিস বলল, না। ২ টার সময়। 
বিপ্লব বলল, তাহলে ২ টার সময় বুঝি বের হয়েছিলে বাইরে?
ক্রিস বলল, দুইটার সময় বাইরে বের হই নাই। তখন আমার টয়লেট চেপেছিলোতো তাই টয়লেটে গিয়েছিলাম। 
থার্টিফার্স্ট নাইটের হাজারো মানুষের ছুটা ছুটি দেখে বিপ্লব মনে করেছিলো সবাই বুঝি রাস্তায় চলে এসেছে। কিন্তু ক্রিসের থেকে সে নিউ ইয়ার সম্বন্ধে এই মন্তব্য শুনে কিছুটা ভরকে যায় বিপ্লব। আর কিছু জিজ্ঞেস করে না সে। 
আসলেই মানুষের বয়স বারার সাথে সাথে মানসিকতাও বদলে যায়। ক্রিসের মত নিঃসঙ্গ একটা মানুষের কাছে নিউ ইয়ার বলতে কিছু নেই। তার কাছে প্রতিটি দিনই সমান। প্রতিটি দিনই সে পার করছে অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে। 
বিপ্লব নিজেকে ক্রিস এর সাথে তুলনা করে। শুধু মাত্র বয়সের ব্যবধান ছাড়া তার আর ক্রিস এর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কাজ আর ঘুম ছাড়া সেওতো আসলে কিছু করে না। তারওতো সময় কাটে ক্রিসের মতই টিভি দেখে। প্রতিটি মুহূর্ত স্মরণ করে পরীকে। কিন্তু যতবারই সে পরীর কল আসছে কিনা ভেবে মোবাইল চেক করে ততবারই হতাশ হয়ে যায় সে। পরীও তো আর তাকে ফোন করে না।  
দিনের পর দিন পার করে দেয়, সে পরীর ফোনের আসায়। কিন্তু পরীতো আর ফোন করে না।


হঠাৎ একদিন পরীর একটা ভয়েস মেসেজ আসে। 
পরী তার ভয়েস মেসেজে জানায়, তোমার সাথে জরুরী কথা আছে। ফোন করো আমাকে। 
রোববার বিকেল বেলা বাংলাদেশের সময় রাত ১১টার দিকে বিপ্লব পরীকে ফোন করে। পরী ফোন ধরে কোন কথা বলে না। বিপ্লব অপর প্রান্ত থেকে শুধু হ্যালো, হ্যালো বলতে থাকে। বিপ্লব তার পর ফোন কেটে দেয়। 
কিছুক্ষণ পর পরী ফোন করে। ফোন ধরে বিপ্লব বলে, কেমন আছো?
পরী বলে, ভাল  নেই। ঘুমের ঔষধ খেয়েছি। শুধু মরে যেতে ইচ্ছে করে। 
বিপ্লব বলে, কেন? ভাল নাই তো আমি। তোমার তো খারাপ থাকার কথা না। 
পরী বলে, তোমাকে কষ্ট দিয়ে আমিও খুব কষ্ট পাচ্ছি। তোমার মত একটা ছেলেকে না করার সাধ্য আমার নেই। আমার খুব খারাপ লাগছে। আমি অনেক দিন ধরে ঘুমাতে পারি না। তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। 
বিপ্লব চালাকি করে বলে, আমিতো একটা মেয়ের সাথে এখন ফোনে কথা বলি। 
পরী বলে, না। তুমি কারো সাথে কথা বলতে পারো না। তোমাকে আমি কারো সাথে কথা বলতে দেবো না। ঐ মেয়ের নাম্বার দাও। আমি কথা বলবো।  
বিপ্লব বলল, তুমি কি কথা বলবা। ঐ মেয়েকে তুমি কি পরিচয় দিবা?
পরী বলল, আমি বলবো, আমি বিপ্লবের বউ। সো, তুমি আর বিপ্লবকে ডিস্টার্ব করো না। 
বিপ্লব বলল, তুমি কি আমার সাথে জোক করছো?
পরী বলল, জোক কেন হবে? দেখ, আমি তোমার সাথে যোগাযোগ করিনি সত্যি। কিন্তু তোমাকে আমি ভালবেসে ফেলেছি। আমার যেন কেন মনে হয় তুমি আমাকে অনেক ছোটবেলা থেকেই পছন্দ করো। ঠিক বলেছি না?
বিপ্লব কোন উত্তর দেয় না। সে পাল্টা প্রশ্ন করে, তুমিতো আর এই রিলেশনে বিশ্বাস করো না।
পরী বলল, দেখ, আমি এত কিছু বুঝি না। আমি লন্ডন চলে আসবো কাউকে না বলে। তুমি আর আমি ছোট্ট একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকবো। তুমি যেভাবে থাক আমিও সেভাবেই থাকবো। আমি আর কিছু শুনতে চাই না।  
বিপ্লবের মাথাটা হঠাৎ করে ঘুরে যায়। এ কি বলে মেয়েটা? ও এত বড় সিদ্ধান্ত নিলো কখন? আর সেতো এর কিছুই জানে না। তাকে সে যতটুকু চিনে। যতদিন ঘুরে বেড়িয়েছে এ থেকে এতবড় একটা সিদ্ধান্ত কি করে নিতে পারে! ভাবতে পারছে না বিপ্লব। রুমের মধ্যে হিটার চালানো আছে। তারপরও শীতে বিপ্লবের সমস্ত লোম খাড়া হয়ে আসছে। বিপ্লব তার স্বপ্নের ঠিকানা পেয়েছে। সারা জীবন ধরে যাকে কল্পনা করেছে সে আজ তারই মুখ থেকে এসব কথা কেমন যেন অতি অলৌকিক মনে হচ্ছে তার। 
বিপ্লব পরীকে বলে, দাঁড়াও আমি ফোন করছি। 
পরী বলে, কোন সমস্যা নাই। তুমি কথা বল। তোমার সাথে কথা বলতে গিয়ে কি আমার ফোন বিলের চিন্তা করতে হবে? 
তারপরও বিপ্লব ফোন কেটে পরীকে ফোন করে। কারণ শুধু শুধু পরীর অনেক বিল আসবে। এটা ঠিক হবে না। বাংলাদেশ থেকে ফোন করা অনেক ব্যয় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাছাড়া বিপ্লবের তখন ফ্রি মিনিট আছে বাংলাদেশে কথা বলার জন্য। পরীর কণ্ঠটা কেমন যেন জড়িয়ে আসছিল। অথচ পরী খুব স্মার্ট একটা মেয়ে। সহজে নার্ভাস হয় না কিছুতেই। আজকের পরী যেন অন্য এক পরী। যেন আকাশ থেকে দেবতারা তাকে পাঠিয়েছে বিপ্লবের জন্যে। শুধুই বিপ্লবের জন্যে। যে কিনা বিপ্লব ছাড়া কাউকে চিনে না।   
প্রায় এক মিনিট কেউ কোন কথা বলছে না। বিপ্লবও কথা গুছিয়ে নিচ্ছে। এক মিনিট পরে প্রায় এক সাথে দুজনে বলে উঠলো, ‘তার পর’
এই ‘তারপর’ কথাটা হচ্ছে ভালবাসা দুজন দুজনের স্বপ্ন ভাগাভাগি করা। তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করা। 
পরী বলল, আমার মাকে ব্যাপারটা জানিয়েছি।
বিপ্লব বলল, বল তিনি কি বলেন, যদি আমার বিপক্ষেও হয় কথাটা তবুও শুনব। 
পরী বলল, বিপক্ষে না পক্ষে। বলেছে, বিপ্লবকে তোর কেমন লাগে? ওর সাথে ফোনে কথা বল। খুব ভাল ছেলে। তুই খুব সুখি হবি ওর সাথে তোর বিয়ে হলে। ওর মত এত পরিশ্রমী ছেলে খুব কমই আছে। 
বিপ্লব বলল, খালা এসব বলেছে বুঝি?
পরী বলল, হুম। 
তুমি কি বললা?
পরী বলল, আমি কিছু বলিনি। আমিতো আজকে কয়েক মাস ধরে তোমাকে নিয়ে ভাবছি। কেন যেন তোমাকে ছাড়া আমার অন্য কিছু ভাবতে ভাললাগে না। 
বিপ্লব বলল, আর আমি? আমিতো তোমাকে নিয়ে সেই ছোট বেলা থেকে ভাবি। তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি। আমার জীবনে তোমাকে ছাড়া আর কোন মেয়েকে নিয়ে কল্পনা করা হয়ে উঠেনি। আর ফোনের ব্যাপারটা আমি বানিয়ে বলেছিলাম। দেখি তুমি কি বল। 
পরী বলল, এক কাজ করি। আমি ইউকেতে চেলে আসি।   
বিপ্লব পরীকে বলে, এভাবে পালিয়ে আসার কি দরকার আছে? তুমি কিছু দিন সময় নাও। চিন্তা কর আরো ব্যাপারটা। আস্তে আস্তে সবাইকে জানাও। দেখ কে কি বলে। তারপর আমাকে বল। আমি বাংলাদেশে চলে এসে তোমাকে বিয়ে করে ফেলবো। 
কথা বলতে বলতে কখন যে দুই ঘন্টা হয়ে গেছে ওরা কেউ বুঝতে পারে নাই। বাংলাদেশে তখন রাত একটার মত বাজে। 
বিপ্লব বলল, কালকে তোমার অফিস নাই পরী?
পরী বলল, আছে ৭ টায়।
তাহলে তুমি ঘুমাবা না?
পরী বলল, আমি কি ঘুমাবো। তোমার সাথে কথা বলছি না। আমার ঘুম পাচ্ছে না।
পরী বিপ্লবকে একটা প্রশ্ন করে। 
আচ্ছা তুমি আমাকে কেন পছন্দ করো?
বিপ্লব উত্তর দেয়, আমার কাছে তোমার সব কিছু ভাল লাগে। তোমার কথা বলা চলাফেরা। তোমার স্মার্টনেস সবকিছু আমাকে মুগ্ধ করে। তোমার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। সবচেয়ে বেশি ভাললাগে তোমার কন্ঠস্বর। তোমার গলার স্বরটা আমার কাছে খুবই মিষ্টি লাগে। আর তোমার এই মধুর কণ্ঠে যখন আমার সাথে কথা বলো তখন মনে হয় আমি পৃথিবীর সব চাইতে বড় কিছু অর্জন করে ফেলেছি। 
আসলেই পরীর এভাবে হঠাৎ সিদ্ধান্তটা বদল বিপ্লবের কাছে যেন চন্দ্র বিজয়ের মতই মনে হয়। জীবনে সেতো বেশি কিছু আশা করে না। তারপরেও বিপ্লবের যতটুকু স্বপ্ন আছে সবটুকু পরীকে নিয়ে। আর সেই পরীই রাত জেগে বিপ্লবের সাথে কথা বলছে। ঘন্টার পর ঘন্টা ফুরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কথা বলা ফুরায় না তাদের।    
আসলে পরীও বিপ্লবকে খুব পছন্দ করতো। কিন্তু তাদের পারিবারিক রিলেশনের কারণে কোন দিন এভাবে বলতে পারেনি। যেমন বিপ্লব অনেক দিন পর তাদের বাসায় আসলে পরী বলে দিত বিপ্লবকে সে কদিন পর এসেছে। লাষ্ট কবে এসেছিলো। এমন কি, সেদিন কি শার্ট পরে এসেছিল সেটাও বলে দিত। কবে কোথায় কি কথা বলেছিল পরী সব মুখস্ত বলে দেয়। বিষয়টা বিপ্লবও লক্ষ্য করেছে অনেক আগেই। কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে পরীর সাথে বিপ্লবের দেখা হলে পরীই আগে বলতো তোমাকে তো আজ খুব মানিয়েছে। এই ড্রেসটাতে খুব ভাল লাগছে। ভাললাগার মানুষ না হলে এভাবে কেউ খেয়াল করে না। লন্ডনে আসার ইচ্ছার কথা পরীকে বিপ্লব যখন প্রথম বলেছিলো সাথে সাথে উত্তর দিয়েছিলো আমাকে কবে নিবা? তুমি চলে গেলে আমিও থাকবো না বাংলাদেশে। তারপরও ওরা কেউ কাউকে কোনদিন বলেনি। 
সেই ভাললাগার কথা বলতে অবশ্য বিপ্লব অনেক সময় নিয়ে ফেলেছে। এখন শুধু পরীকে ধরে রাখার চেষ্টা। 
ফোনে কথা বলা আর সরাসরি কথা বলার মধ্যে অনেক তফাৎ। তাছাড়া ভিওআইপি কল অনেক সময় ওভারল্যাপ হয়। সব কথা সব সময় বুঝা যায় না। তবু বলে যায় বিপ্লব তার ভবিষ্যত প্লানের কথা পরীকে। 
দুজন দুজনকে অতি আপন করে নেয় তারা। কমিটমেন্ট করে সারা জীবন এক সাথে থাকবে। তাদের স্বপ্ন কীভাবে বাস্তবায়ন করবে এই আলোচনা করতে থাকে দুজন মিলে। পরীর সাথে বিপ্লব যতদিন ঘুরেছে, যতটুকু স্মৃতি আসে তা বলে একে অপরকে।
সেই এগারোটা থেকে ভোর পাঁচটা কখন বাজলো পরীও বুঝতে পারে না। পারে না বিপ্লবও। ভাল লাগা এমনই হয়। এখানে সময় কীভাবে চলে যায় বুঝা যায় না। অথচ মন্দ লাগা সময়গুলো যে সহজে যেতে চায় না।  
পরীর সকাল ৭টায় অফিস। তাই বিপ্লব বলল, শোন, তুমি এক ঘন্টা রেষ্ট নিয়ে অফিসে যেও। আমরা পরে কথা বলবো। আজকে রেখে দেই। 
যদিও পরীর ফোন রাখার কোন ইচ্ছাই ছিল না। তবুও বিপ্লব বলেছে তাই রেখে দিল ফোন। 
এদিকে বিপ্লবও সারারাত ঘুমাতে পারে না। কিছুক্ষণ পর পর পরী এসে উপস্থিত হয় তার সামনে। অথচ তারও সকাল ৭ টায় কাজ। পরী যদি সারা রাত জেগে থেকে অফিস করতে পারে সেওতো পারবে কাজ করতে সারা রাত না ঘুমিয়ে। তাই এক ফোটা ঘুমাতে পারলো না বিপ্লব সেই রাতে। 
সকালের দিকে একটু চোখ লেগে এসেছিলো। মোবাইল ফোনে কাজে যাওয়ার এলার্ম দেওয়া ছিল বলে ঘুম থেকে উঠতে হলো তাকেও। উঠেই দেখে পরীর এসএমএস। লিখেছে, কি কর?
বিপ্লব লিখলো, কাজে যাচ্ছি। 
কাজ শেষে এসে বিপ্লব পরীকে আরেকটা এসএমএস দিলো।
সারাদিন কেন তোমায় দেখি?
পরী রিপ্লাই দিলো, আমি যে তোমায় ভালবাসি।
আজকে মিনিট দশেকের মত কথা বলল তারা। কারণ দুজনেই খুব ক্লান্ত। কারোই তেমন ঘুম হয় নি। 
ভালবাসা আসে নদীর প্লাবনের মত। তখন সব কিছু মুছে দিয়ে যায়। এক রাতে যেমন সারা গ্রাম ছড়িয়ে যেতে পারে বন্যায় তেমনি একরাতেই দুজন দুজনকে ভালবাসা এক করে দিতে পারে।  
পরী আর বিপ্লব এখন একই সুতায় গাঁথা। সমস্ত কিছুর উর্দ্ধে এখন তাদের প্রেম। এখানে কোন চাওয়া পাওয়া নাই কারো। শুধু ভালবাসা। একে অপরকে পাওয়ার আশা। 
প্রতিদিন ফোন করে একে অপরের খোঁজ খবর নেওয়া। প্রতি মুহূর্তে এসএমএস করা। কখন কে কি করছে মুঠো ফেনে জানিয়ে দেয় একে অপরকে। ইলেকট্রনিক কমিউনিকেশন অথবা ডিজিটাল প্রেম বলা যায় এটাকে। যদিও তারা দুজন দুজনকে খুব ভালমত চিনে। কিন্তু আগে যেভাবে চিনতো এখন তাদের মধ্যে অন্য সম্পর্ক, যে সম্পর্ক পবিত্র, যে দুটি মনের এক হওয়ার বাসনা মাত্র। 
বিপ্লব পরীকে রুমির সংসারের কথা বলে। রুমিরা দুজনে মিলে এখানে থাকে। খুব এনজয় করে তারা লাইফটাকে। রুমির মত পরীকে নিয়েও এভাবে থাকতে চায় বিপ্লব। যখন খুশি যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে চায় তারা। সমস্ত নিয়মের বাইরে তারা। যেখানে শুধু প্রেম থাকবে তাদের জীবনে। একে অপরের প্রতি বিশ্বাস থাকবে তাদের জামানত বা মূলধন। ভালবাসা দিয়ে তারা ছিনিয়ে নিবে স্বর্গ সুখের ছোঁয়া। তাদের ঘরটাকে তারা বানাতে চায় হ্যাভেন এন্ড আর্থ।
পরী একদিন বলে, আমাদের বিয়ে হলে যদি আমাদের ছেলে হয় তাহলে তার নাম রাখবো সূর্য আর যদি মেয়ে হয় তাহলে তার নাম রাখবো সুপ্রিয়া। বিপ্লব বলে, আমাদের যেন মেয়ে হয়। কারণ সুপ্রিয়া নামটা খুব সুন্দর। তুমি হবে সুপ্রিয়ার মা আর আমি সুপ্রিয়ার বাবা। তুমি আমাকে সুপ্রিয়ার বাবা বলে ডাকবে।   
দিন চলে যায় এভাবেই। পরী তার আত্মীয় স্বজন প্রায় সবার কাছেই বিপ্লবের কথা বলে। পরীর বাবা, মা, বড় ভাই, ভাবী পর্যন্ত ব্যাপারটা জানে। কিন্তু বিপ্লব তাদের বাসায় কিছুই বলে না। কারণ তার এখনও পরীকে বিয়ে করে ইংল্যান্ডে আনার মত অবস্থা হয় নাই। এটাই সমস্যা। কিন্তু যে করেই হোক পরীকে তার পেতে হবে। 


৪-৫ মাস পরে। পরীর জন্য তার বড় মামি একটা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। পরীর বড় মামা অনেক বড় ব্যবসা করে ঢাকাতে। সে তার এক বিজনেস পার্টনারের ছেলের জন্য পরীর বিয়ের প্রস্তাব দেয়। পরীর মা-বাবাকে পরীর বড় মামি রাজি করিয়ে নেন। পরীর মা-বাবাও পরীকে নিষেধ করে বিপ্লবের সাথে যোগাযোগ রাখতে। পরী এত বড় বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। বিপ্লবকে এসএমএস, ফোন দেয়া কমিয়ে দেয়। বিপ্লব প্রথম প্রথম বুঝতে পারে না। একদিন যখন পরী অনলাইনে ছিল তখন বিপ্লবকে না বলে পরী সাইন আউট করে ফেলে। বিপ্লব ব্যাপারটা লক্ষ্য করে। সে পরীকে সাথে সাথে ফোন করে।
কি হয়েছে তার জানতে চায়। পরী কিছু বলে না। সে একটু বিজি আছে বলে ফোনটা দ্রুত কেটে দেয়। বিপ্লবের মাথায় ব্যাপারটা কিছুই ঢোকে না। সে পরীকে ৪-৫ পৃষ্ঠার একটা মেইল করে। অস্থির মনে কি লিখেছে সে নিজেও জানে না। যা মনে আসছে তাই লিখেছে। 
মেইলটা পড়েই পরী শুধু একটা কথাই লিখে, বিপ্লব ভাইয়া। আমার তোমার মেইল পড়ার কোন ইচ্ছেই নেই। তাই এত কষ্ট করে তোমার আমাকে বুঝাতে হবে না। আগে যেমন আমি তোমার কাজিন ছিলাম আমাকে তাই ভেবো সারাজীবন। তাই আমাকে ফোন না দিলেই আমি বেশি খুশি হব।
ই-মেইলের এই উত্তর পেয়ে বিপ্লব কিছুটা থমকে যায় প্রথমে। এভাবে যে পরী আবার লিখতে পারবে এটা তার কল্পনাতেও আসে নাই। সে বুঝতে পারে না কি এমন করেছে তার সাথে যাতে পরী হঠাৎ করে এমন পরিবর্তন হয়ে যাবে।   
বিপ্লব আর একবারের জন্য পরীকে ফোন করে বা মেইল করে জানতে চায়নি যে কি হয়েছে তার। হতে পারে তার জীবনের সব কল্পনা পরী কিন্তু বার বার পরীকে বলার মত ইচ্ছা বিপ্লবের আর হল না। 
সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে আর কোনদিনই পরীকে ফোন করবে না। এখন শুধু তার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময়। মন দিয়ে কাজ করতে হবে সাথে পড়াশুনাটাও চালিয়ে যেতে হবে। একদিন তাকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে। আঙ্গুল দিয়ে পরীকে দেখিয়ে দিতে হবে, দেখ আমিও পারি।  
কল্পনাতে মানুষ অনেক কিছু করতে পারে। অনেক স্বপ্ন আঁকতে পারে। আসলে বাস্তবতা অন্য কথা বলে। বিপ্লবের ভিসার মেয়াদও কমে আসছে দিন দিন। সে ২ বছরের ভিসাতে ইংল্যান্ডে এসেছিল। ২ বছর হতে আর মাত্র ৫ মাস বাকি আছে। যদি ভিসা সুইচ করতে না পারে তাহলে বিপ্লবকে বাংলাদেশে ফিরে যেতে হবে। তাই বিপ্লব শুরু করে সলিসিটরদের সাথে দেখা করা। কি করা যায় ভেবে পায় না। অনেক ঘুরেও কোন কাজ হয় না। লন্ডনের প্রায় সব বাঙালি সলিসিটরদের কাছেই সে যায়। কেউই তাকে সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারে না।  
এদিকে রয়েল মেইলেও তার এক বছরের কন্ট্রাক্ট শেষ হয়ে আসছে। অবশ্য ৪টা হলিডের টাকা পাবে সে সেখান থেকে। সব মিলিয়ে জমানো টাকাসহ তার কাছে তিন হাজার পাউন্ডের মত আছে। এখন ভাল একটা সলিসিটর খুঁজে বার করাই তার কাজ। ভাল মত একটা এপলিকেশন করতে পারলে হয়তো ভিসার মেয়াদ বাড়ানো যাবে। 
ইন্টারনেট ঘেঁটে তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়ায় সে। কীভাবে সুইচ করা যায় তার স্টাটাস। অবশেষে এক ব্যারিষ্টার ম্যাডাম বলেন, একটা উপায় আছে, তুমি হাইলি স্কিল ইমিগ্রেশনের জন্য এপ্লাই করতে পারো। কিন্তু তোমাকে ভাল একটা কোম্পানী খুঁজে বের করতে হবে। আর তোমার যেহেতু এই দেশেরও একটা ডিগ্রী আছে তাই তোমাকে দিয়ে দিতেও পারে। কিন্তু প্রসেসিং টাইম প্রায় ছয় মাসের মত লেগে যাবে। ধৈর্য ধরে ছয় মাস তোমার অপেক্ষা করতে হবে। চান্স খুব কম কিন্তু ট্রাই করতে পারো। আর এপ্লিকেশনটা করতে হবে তোমার মেয়াদ শেষ হওয়ার জাষ্ট এক সপ্তাহ আগে। তুমি সব পেপার রেডি করে আমার কাছে চলে এসো। দুই মাস পর সমারসেটের জবটা বিপ্লব ছেড়ে দেয়। সে এক পরিচিতর মাধ্যমে চলে যায় আরেকটা নতুন জায়গায়। বিদায় বেলায় সবার কাছে দোয়া চায়। অনেকেই কেঁদেছিলো সেদিন যেদিন সে চলে আসে ওই রেস্টুরেন্ট থেকে। ফারুক ভাই নামে একজন লোক ছিল যার ছোট্ট ছেলেকে বিপ্লব পড়াতো সে গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলো বিপ্লবের জন্য। 
কাজ ছেড়ে দেওয়ার একটাই কারণ ছিল তার রয়েল মেইলের কাজটা ছেড়ে দিতে হবে তাকে। আর যদি বিপ্লব ভিসার মেয়াদ না বাড়াতে পারে তবে অবৈধ ভাবে থাকতে হবে। অবৈধ লোকরা ইংলিশ জব করতে পারে না। তাদের পালিয়ে জব করতে হয়। তাই সবচেয়ে ভাল হয় তিন মাস বাকি থাকতে নতুন একটা জায়গায় যেয়ে নিজেকে সেট করে ফেলা। যাতে অবৈধ হলেও মালিক তাকে বাদ না দেয় কাজ থেকে। 
কিন্তু নতুন এই রেস্টুরেন্টে এসে বিপ্লবের আর ভাল লাগে না। এখানে পলিটিক্স আরো বেশি। মালিকের এক ভাতিজা আছে যে ইংলিশ ঠিক মত বলতে পারে না সে কাজ করে বিপ্লবের উপরে। তার কথা শুনতে হয়। সে বিপ্লবের কাজের ভুল ধরে। আর যে ফুল ওয়েটার আছে তার অবস্থা আরো খারাপ। অনেক বছর ধরে কাজ করে ঠিকই কিন্তু ইংলিশ বলা তার হয় না তেমন করে। আর বিপ্লব এখন প্রায় ৯০% ইংলিশদের মত উচ্চারণ করে কথা বলে। ব্যাপারটা দেখে তারা ভয় পায়। দুজনে মিলে বুদ্ধি করে ওকে সরাতে না পারলে তাদের অবস্থা নড়বড়ে হয়ে যাবে।
বিপ্লবকে নানাভাবে প্রেসার দিতে থাকে তারা। শনিবার কাজ করে রবিবার কাজ করছিল মালিকের ভাতিজার সাথে বিপ্লব দুপুরে। ওই রেস্টুন্টের টেবিল ক্লথগুলো ওয়েটারদের ইস্ত্রি করতে হত। 
বিপ্লব তাকে একটার সময় বলে, আমি কাপড় গুলো লন্ড্রি করে আসি। 
লোকটা বলে, এখন না পড়ে যেও। 
বিপ্লব কিছু বলে না আর। ঠিক কাজ শেষ হওয়ার ৫ মিনিট আগে বিপ্লবকে কাপড়গুলো রেডি করে আনতে বলে সে। এতে বিপ্লব খুব খেপে যায়। সে কথা কাটাকাটি করে। এক পর্যায়ে বিপ্লব বলে, যদি আমার কাজ ভাল না লাগে আজকে রবিবার আছে। সপ্তাহের শেষ। আমাকে আজকে না করে দিতে পারেন। আমি কালকে সকালে চলে যাব। 
মালিকের ভাতিজা এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। রাতে সে বসের কাছে বানিয়ে আরো অনেক কথা বলল। বলল, এই ছেলেকে দিয়ে হবে না। কাজ বাছে বেশি। বস নতুন একটা ছেলের চেয়ে তার ভাতিজার কথার গুরুত্ব দিয়ে বিপ্লবকে বিদায় করে দিলো। বলল, নেক্সট উইকে যেন সে চলে যায়। আসলে তার আরো কম এক্সপেরিয়েন্সের একটা লোক লাগবে। তোমার মত এত এক্সপেরিয়েন্সের ছেলে আমাদের দরকার নাই।
বিপ্লব সাথে সাথে মেনে নিলো। বলল, নেক্সট উইকে না। আমি কালকেই চলে যাব। বস তাতে কিছুটা লজ্জাও পায়। কিন্তু না করে না। বিপ্লবকে তার বেতন বুঝিয়ে দিয়ে দেয়। সাথে আরো ২০ পাউন্ড বেশিও দেয়।    
আসলে বিপ্লব হচ্ছে সেই ছেলে যে ইংলিশ জব এবং ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের জব একসাথে করেছে। আবার ইংলিশ জব করলেও ইংলিশদের সাথে কথা বলা সবার হয়ে উঠেনা। যেহেতু তারা গ্রুপ মিলে রয়েল মেইলে পোষ্ট ডেলিভারি দিত তাই তাদের কথা বলার স্কোপ ছিল অনেক বেশি। প্রায়ই পুরোপুরি ইংলিশ বুঝার মত কেউ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে কাজ করে না। সমস্যাটাই এখানে। তাছাড়া আগের রেস্টুরেন্টে বস বিপ্লবের প্রতি শতভাগ আস্থা রাখতো। বস বিপ্লবের কাছে রেস্টুরেন্ট ফেলে দিয়ে ২-৩ সপ্তাহ বাংলাদেশে থেকে এসেছে। এত পাওয়ার নিয়ে কাজ করে এসে হঠাৎ করে এত কথা শুনতে তার ভাল লাগেনি। তাছাড়া তার কাছে অনেক টাকা এখন জমানো। তাকে ভাল একটা কাজ খুঁজে বের করতে হবে যেখানে অনেকদিন কাজ করা যায়। 
এই ভেবে সে চলে আসে ওখান থেকে। লন্ডন এসে জব সেন্টার থেকে সেদিন আরেকটা জব নিয়ে যায়। যায়গাটা ওয়েস্টার্ণ সুপিরিমার। রেস্টুরেন্টের ঠিকানা ও ফোন নাম্বার ইন্টারনেট থেকে নিয়ে নেয় বিপ্লব। ট্রেনে করে ওয়েস্টার্ন সুপিরিমার পৌঁছে সে রাত বারটায়। তার পর টেক্সি করে সোজা রেস্টুরেন্টে।    
তখন ইউকেতে অবৈধ ধরপাকর শুরু হয়েছে। কোন রেস্টুরেন্টই বাদ দিচ্ছে না ইমিগ্রেশন। আর ওয়েস্টার্ন সুপিরিমার এর এই রেস্টুরেন্টের পাশেই নাকি সেদিনই ইমিগ্রেশন রেইড দিয়েছিল। হয়তো দু’একদিনের মধ্যেই এখানেও দিবে। রেস্টুরেন্টে ঢুকেই এই কথাগুলো শুনলো সে। সবাই বলাবলি করছিল। একজনকে দেখলো চিত হয়ে ঘুমাচ্ছে। পাশেই লাইট জ্বলছে তবুও সে কীভাবে এমন করে ঘুমাচ্ছে বিপ্লব বুঝতে পারে না। ছেলেটাকে দেখে মনে হয় মদ খেয়ে পরে আছে এভাবে।
কিন্তু আসলে তা না। বস তাকে না করে দিয়েছে আজকে। আর ঐ ছেলের জায়গাতেই বিপ্লবকে এনেছে। বিপ্লব একদিন আগেই এসে পড়েছে বলে ছেলেটিকে দেখতে পেল। কাল সকালে ও চলে যাবে তাই ঘুমাচ্ছে ছেলেটা। গত সপ্তাহে এসেছিল ও। এক সপ্তাহ পর কাজ চলে গেল। বিপ্লব মেনে নিতে পারছিল না। ছেলেটাকে দেখে ওর ভীষণ মন খারাপ হয়। ভাবতে থকে তার নিজের যদি এমন হতো তাহলে কেমন লাগত। এই রেস্টুরেন্টের সবার সাথেই বিপ্লব পরিচিত হল। শেফ থেকে শুরু করে সবাই এখানে অবৈধ ভাবে থাকে। কারো বৈধ ভিসা নেই। কেমন যেন ঘরটা বসবাসের অযোগ্য করে রেখেছে। রুমটা বেশ অন্ধকার। দম আটকে আসে। রেস্টুরেন্টে সাধারণ একটা টিভি পর্যন্ত নেই। বিপ্লবকে কেউ খাওয়ার কথাও জিজ্ঞেস করে না। অথচ রেস্টুরেন্টের নিয়ম হলো নতুন কেউ এলে আগে জিজ্ঞেস করা সে খাবে কিনা। বিপ্লব আগের রেস্টুরেন্টে অনেক লোকের আসা যাওয়া দেখেছে। দশ জনের মত শেফ বদল হয়েছিলো এই দুই বছরে। কিন্তু এমন ব্যবহার সে কারো সাথে করেনি।  
সবাইকে কেমন যেন আতঙ্কিত মনে হচ্ছে। বস নাকি এখানে সবাইকে একটি বাড়তি চাপের মধ্যে রাখে। বৈধ কাগজত্র না থাকার জন্য সবাই তটস্থ থাকে। মনের মধ্যে ভয় কাজ করে, এই বুঝি ইমিগ্রেশন পুলিশ এল। এই রেস্টুরেন্টের বসের বয়স খুব কম। কিন্তু কাউকে সে তোয়াক্কা করে না। বিপ্লব মনে মনে স্থির করে এখানে কাজ করবে না। ও এখান থেকে স্বেচ্ছায় চলে গেলে যদি এই শুয়ে থাকা ছেলেটার কাজটা ঠিক থাকে তাহলেও ওর একটা উপকার করা হবে। তাছাড়া এখানকার পরিবেশটাও বিপ্লবের পছন্দ হয় নাই। 
সকালে ঘুম থেকে জেগেই কাজ করা শুরু না করে বিপ্লব রেস্টুরেন্টের বসকে জানায় সে চলে যাচ্ছে। বসতো সারা জীবন লোক বিদায় দেয়। আজকে বসকে বিদায় করে একজন বলছে, সে চলে যাবে কাজ না করে। এটা মেনে নিতে পারে না বস। 
সে ফোনের মধ্যেই বিপ্লবকে যা তা শুনিয়ে দেয়। বিপ্লবও কম যায় না। সে বলে তার এই যায়গায় কাজ করতে ভাল লাগবে না। থাকার জায়গা পছন্দ হয়নি। তাছাড়া এখানে কাজরে সুস্থ পরিবেশও নেই। রেস্তোরাঁর মালিক বিপ্লবের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত কথা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সে বিপ্লবের কাছে এক দিনের থাকার ভাড়া দাবি করে। বিপ্লব বলে আপনি এসে ভাড়া নিয়ে যান। বস খেপে গিয়ে বলে আমি আসবো কেন। তুমি ভাড়া কাউন্টারে রেখে যাও। রেস্টুরেন্টের শেফের সাথে একদিনেই বিপ্লবের খুব ভাব হয়ে গিয়েছিলো তাই সেও বিপ্লবকে রিকোয়েস্ট করে থাকার জন্যে। কিন্তু বিপ্লব থাকে না। অনেক কথা কাটাকাটির পর বস বিপ্লবকে বলে আগে জানলে তোমার জন্যে একটা হলিডে হাউস আমি ভাড়া করতাম।
বিপ্লব বলে, আপনিতো রেস্টুরেন্টটাকে কারাগার বানিয়ে রেখেছেন। এখানে থাকলে মানুষ আরো অসুস্থ হয়ে যাবে।  
সেদিনই বিকালে এসে বিপ্লব আরেকটা জব সেন্টার থেকে কেন্টে একটা জব পেয়ে যায়। মালিকের সাথে কথা ফাইনাল করে বিপ্লব বলে আগামীকাল থেকে সে কাজে আসবে। কারণ ইউকেতে একটা নিয়ম হলো যদি সেদিন কাজে যায় তাহলে মালিকরা ভাবে ছেলেটার থাকার যায়গা নাই। এতে তার সাথে বেশি খারাপ ব্যবহার করে। কাউকে নিজের দুর্বলতা বুঝতে দেওয়াটা ঠিক হবে না। এই ভেবে সে এক রাতের জন্য একটা হোটেলে উঠার কথা চিন্তা করে। জামসেদের বাসায়ও যেতে পারতো কিন্তু গেলো না এই ভেবে যদি জামসেদের এই সুযোগটা সে ইউজ করে ফেলে তাহলে যেদিন সত্যি বিপদে পরবে সেদিন যদি তার কাছে টাকা নাও থাকে সেদিন জামসেদের বাসায় থাকতে পারবে। অন্যথায় কাউকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না।
ইন্টারনেট থেকে সবচেয়ে চিপ একটা বেড এন্ড ব্রেকফাষ্ট ভাড়া করলো সে। জায়গাটা লন্ডনের ইলফোর্ডে। ২৫ বাসে করে সোজা চলে গেল সে ইলফোর্ড। রাত তখন দশটার মত বাজে। অনেক খুঁজে বেড এন্ড ব্রেকফাষ্টটা পেয়েও গেল। সিঙ্গেল একটা রুমের ভাড়া হচ্ছে এখানে ৩০ পাউন্ড। সকালে ৮টার মধ্যে নাস্তা খেতে হয় সবার। সকাল এগারটায় চেক-আউট। এগারটার পর থাকলে পরের দিনের ভাড়া পে করতে হয়। বিপ্লব হোটেলের রুমে এসে এসে ফ্রেস হয়ে নিল। তারপর অনেকক্ষণ রিলাক্সড মুডে বসে বসে টিভি প্রোগ্রাম দেখল। 
মানুষ যখন একা থাকে তখন তার মাথায় নানান চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে। লাস্ট এক সপ্তাহ ধরে সে স্থির হতে পারছে না। গত ক’টা দিন খালি চেঞ্জের মধ্যে আছে সে। এই রেস্টুরেন্ট ঐ রেস্টুরেন্ট করে তার মনও শরীরা এখন খুবই ক্লান্ত। অথচ বাড়িতে কাউকে কিছু বলেনি সে। এমনকি জামসেদকেও না। তার জীবনে যে এতকিছু হতে চলেছে। আর বলেই বা লাভ কি? কারো সাথে শেয়ার করেও কোন লাভ নেই। কেউ কোন উপকার করতে পারবে না। যত সমস্যা তাকেই মোকাবিলা করতে হবে। আর বিপ্লব সে রকমের একটা ছেলে যে কখনো ভেঙে পড়ে না। সমস্যা যতই আসুক সে মোকাবিলা করতে জানে। হোটেলের পরিপাটি রুমের বেডে হেলান দিতেই ঘুমিয়ে পড়লো ক্লান্ত বিপ্লব। এমন কি পরীর কথাও তার মনে এলো না সে রাতে।  
রাতটা পার করে সে সোজা কেন্টের দিকে রওয়ানা হলো। বিকাল ছ’টার দিকে যখন সে কেন্টের ঐ রেস্টুরেন্টে পৌঁছালো, তখন রেস্টুরেন্টটা দেখেই তার খুব ভাল লাগলো। অত্যন্ত আধুনিক ইন্টেরিয়র ডিজাইন করা এই রেস্টুরেন্টটা। এখানকারই একটা ছেলে, যার নাম শিমুল। তার সাথে পরিচয় পর্বটি সেরে রুমে গিয়ে ড্রেস বদলে নেমে গেল কাজে। 



শিমুলের মন মানসিকতা খুব ভাল। সে যেভাবে বিপ্লবকে স্বাগত জানালো সেটার একটা লক্ষণীয় বিষয় ছিল। বিপ্লবের মনে হলো এই রেস্টুরেন্টে আসলেই একজন লোক খুব দরকার। যা আগের রেস্টুরেন্টের কেউ করেনি। এখানে থাকার জায়গাটাও মোটামুটি ভাল। দুই জনের একটা রুম আছে। সেখানে বিপ্লব থাকবে। খুব ভাল লাগছে বিপ্লবের এখানে।  
তেমন কোন কাজ করতে হয়নি সেদিন। কারণ এখানে ডিজিটাল সিস্টেমে অর্ডার নেওয়া হয়। খাবার মেনু অনেক চেঞ্জ আছে। বিপ্লব শুধু পরিচিত হয় সেদিন নতুন এই রেস্টুরেন্টের পরিবেশের সাথে।
সব থেকে বড় সুবিধা হচ্ছে, এখানে দেড় দিনের ছুটি থাকে সপ্তাহে। যেটা আগে কোথাও পায়নি। ডে-অফের দিনটা ভালমত ঘুরে বেড়িয়ে পরের দিন আবার সারাদিন তাই ঘুমানো যায়। তাই প্রতি সপ্তাহে ও লন্ডন যায় সলিসিটরদের সাথে দেখা করতে। সাথে লন্ডন শহরটাও ঘুরে বেড়ানো যায়।
কেন্টের থেকে এক দিনের ডে-পাস করলে লন্ডনের সব বাস ও টিউব ফ্রি চড়া যায়। এতে খরচা হয় মাত্র ষোল পাউন্ড চল্লিশ পেনি। সারাদিন ঘুরে বিপ্লব লাস্ট ট্রেনে আবার কেন্টে ফিরে আসে। কয়েক সপ্তাহ বিপ্লব এভাবেই কাটিয়ে দেয়।   
একদিন টিউব লেট করার কারণে কেন্টের লাস্ট ট্রেনটা বিপ্লব মিস করে। তখন রাত পৌনে বারটার মত বাজে। বিপ্লব দিশে হারা হয়ে যায় কি করবে? ইন্টারনেট ক্যাফেও এখন খোলা নেই। যেখানে গিয়ে ও খোঁজ নিতে পারবে লন্ডনের বেড এন্ড রেস্টুরেন্টর। হুট করে কোন হোটেলে যাওয়াও ঠিক হবে না। কারণ সিটিতে অনেক দামি হোটেল আছে যার কষ্ট প্রায়ই তিনশ থেকে চারশ পাউন্ড হতে পারে পার নাইট। আগের থেকে বুকিং করে না গেলে জানতেও পারবে না হোটেলে রাতে কত ভাড়া। বিপ্লব ঠিক করে অক্সফোর্ড স্ট্রিটে যাবে। যেহেতু ওখানে অনেক নাইট ক্লাব ও সিনেমা হল আছে সেখানে অনেক রাত পর্যন্ত লোকজন চলাফেরা করে। অক্সফোর্ড স্ট্রিটে হাঁটতে হাঁটতে পেয়ে যায় সে ২৪ ঘন্টার একটা সাইবার ক্যাফে। সেখানে ঢুকে হোটেলের খোঁজ নিতে থাকে। এখানে এসে ওর মাথায় ঢোকে, হোটেলে যাওয়ার দরকার কি? সাইবার ক্যাফে যেহেতু ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে তাই এখানেইতো রাত কাটানো যায়। আর সাইবার ক্যাফেতে ৫ ঘন্টা ব্রাউজ করলে বিল আসবে মাত্র ৫ পাউন্ড। আর হোটেলে রাতে থাকলে মিনিমাম বিল আসবে ৩০ পাউন্ড। আর এত রাতে কোন হোটেল পাওয়া যাবে কিনা তারও নিশ্চয়তা নেই। সে ঠিক করে সারা রাত সাইবার ক্যাফেতে কাটিয়ে দিবে। যা বলা সেই কাজ। সাইবার ক্যাফেতে বাংলা নাটক দেখলো সারারাত। ভোর ছ’টার দিকে বের হয়ে গেল ওখান থেকে। বিপ্লবের কাছে মনে হলো এখন লন্ডনে রাত কাটানো কোন ব্যাপারই না। ফেরার পথে ট্রেনে সে ঘুমালো অনেকক্ষণ। এগারটর দিকে রেস্টুরেন্টে এসে আবার ঘুম। এভাবের রাত কাটিয়ে ওর নতুন একটা অভিজ্ঞতা হলো। বেশ মজাই পেল সে এই অন্যরকম অভিজ্ঞতায়।
কয়েক সপ্তাহ পর ইচ্ছে করেই বিপ্লব আবার ট্রেন মিস করলো। মনে করলো যেয়ে লাভ কি যদি রাতটা সাইবার ক্যাফেতে কাটিয়ে দেওয়া যায়। তাহলেতো কোন সমস্যা নেই। তাই সে অক্সফোর্ড সার্কাসের পাসের একটা নাইটক্লাবে ঢুকলো সেদিন। সারা রাত নাচানাচি করে মনটা একটু ভাল করার চেষ্টা চালালো। বাদ্যের তালে তালে কখন যে ভোর তিনটা বেজে গেছে বুঝতেই পায়নি সে। ক্লাব থেকে বের হয়ে অক্সফোর্ড সার্কাস এসে দেখলো সাইবার ক্যাফে সেদিন বন্ধ। এর আগে সে সোমবারে এখানে এসেছিল। কিন্তু আজকে বুধবার। এই ক্যাফে বুধবার রাত দুইটার সময় বন্ধ হয়ে যায়। নোটিশ বোর্ডটা আগে সে খেয়াল করেনি।    
কি আর করা উদ্বাস্তুুর মত ২৪ ঘন্টার খাবারের দোকানে বসে একটা কফি খেল সে। তার পর হঠাৎ তার মাথায় এলো ২৫ বাসের কথা। যেটা কিনা ২৪ ঘন্টা চলে। লন্ডনের সবচেয়ে লং ডিসটেন্স সিটি সার্ভিস এটা। বিপ্লব ঠিক করে ২৫ নম্বর বাসে চড়ে বসবে অক্সফোর্ড সার্কাস থেকে। চলে যাবে ইলফোর্ড। প্রায় এক ঘন্টা লাগবে ওখানে যেতে। এভাবে আবার ইলফোর্ড থেকে অক্সফোর্ড সার্কাস। শুধু বাস বদল করবে কয়েকবার। কিন্তু রুট বদল করবে না। সারা রাত বাস ভ্রমণ করেই রাতটা এভাবে পার করা যাবে।   
কিছুক্ষণের মধ্যে সে ২৫ বাসও পেয়ে গেল। তাতে যাত্রি ছিল মাত্র তিন জন। এক বেচারা মনে হয় বিপ্লবের মতই পিছনের সিটে বসে ঘুমাচ্ছে। বিপ্লবও পিছনের দিকের একটা সিটে বসে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। তার কোন ভয় নেই। সাথে ক্যাশ কোন টাকা নেই। শুধু একটা ব্যাংক কার্ড। বিপ্লব একটুও ভয় পেল না সেই রাতে। ইলফোর্ড যখন বাস এসে থামলো তখন ভোর চারটা। সবাই নেমে গেল বাস থেকে। বিপ্লবও নেমে গেল। কিন্তু সমস্যা হলো যে, ওখানে পনের মিনিট একা দাঁড়িয়ে থেকেও আর বাস পেলো না। তার মানে বাসগুলো আসে এক রুট দিয়ে আর যায় আরেক রুট দিয়ে। কাউকে জিজ্ঞেস করার মতও কোন লোক পেল না সেখানে। দূরে দেখতে পেল তিন জন পুলিশ। একজন কালো মত মানুষের পিছনে দৌরাচ্ছে। লন্ডনে ড্রাগ আদান প্রদান করে মানুষ রাতের বেলা। পুলিশরা তাই যাকে সন্দেহ করে তারই পিছু নেয়। যেমন ওই লোকটার পিছু নিয়েছে তারা। কোন পূর্ব ইনফরমেশন ছাড়া অবশ্য পুলিশ কাউকে বিরক্ত করে না। তার পরেও বিপ্লবের ভয় করতে লাগলো। তাকে যদি পুলিশ এসে কিছু জিজ্ঞেস করে, সে কি উত্তর দেবে। এখানে তো তার এত রাতে কোন কাজ নাই। তাহলে সে কি করছে এখানে। ড্রাইভিং লাইসেন্স যেটা আছে বিপ্লবের কাছে তাতে লিখা লন্ডনের ঠিকানা। তাই পুলিশকে বিশ্বাস করানো যাবে না সে ট্রেন মিস করেছে বলে এভাবে বাসে করে ঘুরে বেরাচ্ছে। আর পুলিশ যদি সিসি ক্যামেরা থেকে তাকে সেই ২টা থেকে ফলো করে থাকে তাহলেতো পুরোপুরি সন্দেহ করে ফেলবে যে, তার কোন বদ মতলব আছে।
কিন্তু পুলিশ বিপ্লবের সামনে এসেও কিছুই বলল না। কিছুক্ষণ পর একজন লোক আসে সেখানে। তাকে ভয়ে ভয়ে বিপ্লব জিজ্ঞেস করে, সে অক্সফোর্ড সার্কাস যেতে চাচ্ছে ২৫ এ করে। কোথা থেকে তার উঠতে হবে দয়া করে একটু বলবেন কি? লোকটি বিপ্লবকে দেখিয়ে দিলো বাস স্টপটি। বিপ্লব সেখানে গিয়ে এবার ২৫ এ উঠে পড়লো। এভাবে দুইবার ইলফোর্ড আসে সে সেই রাতে। সকাল আটটার দিকে মেসে যেয়ে নাস্তা করে কেন্টের ট্রেইনে করে কেন্টে ফিরে আসে আবার।     
এদিকে সলিসিটরের কাজটাও সে প্রায় গুছিয়ে ফেলে। অনেক টাকা নেয় তার কাছ থেকে সলিসিটররা। তারা একটা বড় কোম্পানি থেকে ওয়ার্ক পারমিট বের করে বিপ্লবের ফাইল প্রসেস শুরু করে। ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ আগে বিপ্লব এপ্লিকেশন জমা দেয় হোম অফিসে। সলিসিটর অগেই বলে দিয়েছে, তার ভিসা পাওয়ার চান্স শতকরা পঞ্চাশ ভাগের বেশি নাই। তারপরও ফাইলটা প্রসেসিং হতে যদি তারা বেশি টাইম নেয় সেটুকু তার লাভ। ততদিন ও ইউকেতে থাকতে পারবে বৈধভাবেই। যদিও ওর এপ্লিকেশনটা আউট সাইড দ্যা ইমিগ্রেশন রুলস। 
প্রায় এক মাস হতে চললো হোম আফিস থেকে বিপ্লব কোন উত্তর পায়নি। শুধু তার এপ্লিকেশনটা তারা পেয়েছে এই মর্মে একটা লেটার ইসু করেছে মাত্র। এদিকে ইংল্যান্ডের চারিদিকে অবৈধ মানুষদের ধরপাকড় বেড়ে গেছে। প্রায় প্রতিদিনই খবর আসে পত্রিকায়, টিভিতে রেস্টুরেন্ট রেইড দেয়ার। চারদিকে শুধু আতঙ্ক। বিপ্লব যেখানে কাজ করে ইতোমধ্যে ও সেখানে ওর কর্ম দক্ষতার প্রমাণ দিতে পেরেছে। তার জন্যে তার বস তাকে ছাটাই করছে না এখনও। কিন্তু এখন আর অবৈধ লোকদের তেমন কেউ কাজে রাখছে না। আর রাখবেই বা কেন। হোম অফিস নতুন নিয়ম করেছে, যদি কেউ অবৈধ লোকদের কাজ দেয় তবে তাদের প্রতি জন অবৈধ লোকের জন্য দশ হাজার পাউন্ড জরিমানা দিতে হবে। অনেক রেস্টুরেন্টকে ইতোমধ্যে জরিমানা করেছে হোম অফিস।
এইতো সেদিন পাশের একটা রেস্টুরেন্টে রেইড দিয়ে দুই জনকে ইংল্যান্ড থেকে বের করে দিয়েছে। শুধু তাই না, ওই রেস্টুরেন্টের মালিককে সাথে সাথে বিশ হাজার পাউন্ড জরিমানা করেছে তারা। 
বিপ্লবের রেস্টুরেন্টও বিপ্লব ছাড়া আরো কয়েকজন আছে ইলিগ্যাল। শুধু এই কারণে বিপ্লব ঘুমাতে পারে না ঠিকমত। কিন্তু তার বাড়িতে কিছু জানায়নি। কারণ যে সমস্যা সে নিজে বাধিয়েছে তা তাকে একাই মোকাবেলা করতে হবে। শুধু শুধু মা বাবাকে দুশ্চিন্তায় ফেলতে চায় না ও।
ভয়ে বিপ্লব কোথাও বের হয় না। যদিও তার ফাইল এখনও আন্ডার প্রসেসে আছে। তারপরওতো তার ভিসার মেয়াদ নাই।
ভয়ে নিজের একাউন্টে কোন টাকা রাখে না ও। বেশ কিছু টাকা ছিল তার কাছে তা জামসেদের একাউন্টে জমা দিয়ে দেয়। মাত্র এই কিছু টাকাই তার ইউকের লাইফ সিকিউরিটি যা দিয়ে বড়জোর তিন মাসই চলতে পারবে যদি কাজ না থাকে। তার পরও বিপ্লবের মনটা অনেক দুর্বল হয়ে যায়। শান্ত এই ছেলেটার যেন হঠাৎ করেই অনেক নিস্তেজ হয়ে পড়ে। বেঁচে থেকেও সে মরার মত। মাঝ নদীতে ঝড় উঠলে যাত্রিরা যেমন হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে যায় অথবা কেউ যদি মাথায় বন্দুকের নল ধরে বলে তোমার বাঁচার আর কোন আশা নাই। অথবা ফাঁসির আসামী যেমনি ভাবে মৃত্যুর দিন গুণে ঠিক তেমনি তার মনের অবস্থা।
এমনই অবস্থার মাঝেও সে প্রতি সপ্তাহে মাত্র বিশ পাউন্ড হাত খরচার টাকা রেখে বাকি টাকা বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। কারণ যদি সে ধরা খায়। আর যদি তার কাছে টাকা থাকে তাহলে হোম অফিস তার টাকাগুলো দিয়েই টিকেট কাটবে। আর যদি কোন টাকা না পায় তবে তাদের ব্যবস্থায়ই বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে। শুধু মাত্র এই সামান্য লাভ। এটাই বা কম কিসে? যেহেতু যেকোন সময় একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে তার জীবনে। আর যারা অবৈধ আছে তার সাথে তাদের অন্তত একটা সান্তনা আছে যে তারা তাদের দুঃসময়ের কথাগুলো শেয়ার করতে পারে। কিন্তু বিপ্লবের এই দুঃখের দিনে তার পাশে তো আর কেউ নেই। এতদিন ধরে যে পরীকে সে ভালবেসে এসেছে। যাকে নিয়ে ঘর বাধার স্বপ্ন দেখেছে, সেওতো আজ তার পাশে নেই। অথচ তার রুমমেট পুলক অথবা পাশের রুমের মিঠুর অন্তত এইটুকু সান্তনা আছে। ওরা ওদের কথা শেয়ার করতে পারে তাদের প্রিয়তমার সাথে। তারা হয়ত পুলক মিঠুদের ধর্য্য ধরতে বলে। কিন্তুবিপ্লবের যে কেউ নেই। ওর চারদিকে শুধু বিশাল এক শূন্যতা। নিজের কষ্টের কথা বলার মত আপনজন কেই নেই। যে পরীকে নিয়ে সারাটা জীবন স্বপ্ন দেখে এসেছে। যাকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছে সেও কেমন জীবন থেকে হারিয়ে গেছ। পরী ওকে ছিটেফোঁটাও মূল্যায়ন করেনি। পরী এখন অনেক দূরে সরে গেছে। ওকে এখন আর তেমন আপন মনে হয় না। আর হবেই বা কেন। পরীতো তাকে নিয়ে একটি বারের জন্যও আর ভাবে না। তার সাথে কোন যোগাযোগও করে না। মানুষ যত ভালই বাসুক না কেন কখনই সে মনের আকুতি বার বার জানাতে পারে না। ভালবাসার কথা কত বার আর বলা যায়! পৃথিতে সবকিছুরই তো একটা লিমিট থাকে। হয়ত বিপ্লবেরও একটা লিমিট ছিল। সে পরীকে তার ভালবাসার কথা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে। পরীর হৃদয় ছোঁয়ার মত যোগ্যতা ওর হয়নি। পরীর প্রতি যে টান তার আছে হয়ত পরী তেমন ভাবে অনুভব করে নি। আর এখন ওর যে অবস্থা এই মুহূর্তে পরীকে নিয়ে কোন চিন্তা করাও তার পক্ষে সম্ভব না। বিপ্লবের লাইফটা একটা সীমাহীন লোভোর মধ্যে পরে গেছে। প্রতিদিন নতুন সূর্য উঠে নতুন করে ঘুম থেকে উঠে কিন্তু বারে বারেই অনিশ্চয়তাটা এসে ভর করে। প্রতিদিন নতুন সূর্য ওঠে সোনালি ভোর হয় কিন্তু ওর জীবনে কোন নতুন খবর আসে না। 
তাই বিপ্লব তার বয়সটাকে দশ বছর বাড়িয়ে ফেলেছে মনে মনে। কারণ দশ বছর পর সে ইউকেতে থাকার রাইট পাবে আইনগত ভাবেই। তাই সব সময় তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায় দশটা বছর। 
আচ্ছা, দশ বছর কত সময়?  মনের মনে অঙ্ক কষে বের করে ও দশ বছর মানে ৩৬৫০ দিন। এই ৩৬৫০ দিনের মধ্যে ৬০৮ দিন ডে-অফ এবং ১০ দিন ক্রিসমাসের বন্ধ বাদ দিলে ৩০৩২ দিন তাকে কাজ করতে হবে। এই ৩০৩২ দিন রেস্টুরেন্টে কাজ করার সময় তাকে তাড়া করে বেড়াবে ইমিগ্রেশন পুলিশের ভয়। এমনি করে পালিয়ে বেড়ানো যে কতটা মানসিক কষ্টের তা ভূক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না।
একটা কবিতা খুব বেশি শুনে বিপ্লব। শিমুল মুস্তফার কণ্ঠে কবিতাটা খুব ভাল লাগে তার। নাজিম নিজামির এই কবিতাটা তার সাথে, তার জীবনের লেখচিত্রটা খুব বেশি ম্যাচ করে এখন। কবিতাটি একটা জেলখানার কয়েদিকে নিয়ে লেখা। যার এখনও বিচার শেষ হয়নি। কিন্তু সে ধরে নিয়েছে তার ফাঁসি হয়তো হয়ে যাবে। সেইখান থেকে তার প্রিয়তমার কাছে একটা চিঠি লিখে। জেলখানার মধ্যে হাজারো যন্ত্রণার মধ্যে থেকেও তার প্রিয়তমা স্ত্রী এবং সন্তানদের প্রতি যে তার গভীর ভালবাসা আছে তার বর্ণনা দিয়ে। সাথে সাথে এই কথাও বলে যে, সে জেলে আসার পর দশটি বছর পার হয়ে গেছে।
বিপ্লবও ভাবে দশটা বছর পর কেমন থাকবে বাংলাদেশ। হয়ত পদ্মা মেঘনা তেমনই থাকবে যেমন সে দেখে এসেছিল। থাকবে না শুধু মানুষগুলো যারা তার কাছের ছিল। খুব বেশি কিছু কি বদলে যাবে! হয়ত দেখবে তার বড় বোনের ঘরে ফুটফুটে একটা বাচ্চা হয়েছে যে স্কুলের পড়া নিয়ে সর্বদা ব্যস্ত থাকবে। তার বাবা মা তাকে খেলতে দেবে না বাইরে যেয়ে। হয়ত প্রিয় কিছু বন্ধু তারাও সংসার নিয়ে খুব বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়বে। তারাও হয়ত ভুলে যাবে একদিন বিপ্লবকে। খুব বেশি কিছু যদি চেঞ্জ হয় তাহলে দেখবে তার বৃদ্ধ মা বাবা একদিন অপেক্ষোর প্রহর গুণতে গুণতে চোখ বুজে ফেলেছেন। সবারই জীবন এগিয়ে যাবে। যার যার মত করে। থেমে থাকবে না কারোই পথ চলা।
আর পরীরইবা কি হবে? বিয়ে করে সেও তো তখন মাঝ বয়সি একটা মহিলা হবে। যার চিন্তা থাকবে শুধু তার সন্তানদেরকে নিয়ে। সে কি একটি বারের জন্যেও বিপ্লবকে কল্পনা করবে? আর যদি নাও করে তাতে কিছু যায় আসেনা এখন। এ বিপ্লব এখন অন্য রকম মানুষ। যে সমুদ্র সে পাড়ি দিতে যাচ্ছে তা তাকে পাড়ি দিতেই হবে। পিছনের দিকে তাকানোর তার আর কোন সময় নেই। মনে মনে এটাই সে বিশ্বাস করে তার মত অনেকেইতো আছে যারা ভালবাসা পায় না। অনেক প্রতিষ্ঠিত মানুষের সাফল্যের পিছনেও তো না পাওয়াটাই বেশি প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। স্টিভ জবস, বিল গেইটস, শাহরুখ খান শচিন টেন্ডুলকাররাও তো শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন। সেই শূন্য থেকে শুরু করা মানুষগুলোই তো এখন অসীম উচ্চতায় উঠেছেন। যে উচ্চতা শুধু দেখা যায়, কিন্তু হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায় না।
এত হতাশার মাঝেও সে আনন্দ খুঁজে পায় রাতে যখন সবাই মিলে বাংলা নাটকগুলো দেখে। ইন্টারনেট থেকে একের পর এক ধারাবাহিক নাটকগুলো দেখতে থাকে, দিনের পর দিন। পুরোনো থেকে শুরু করে গত দশ-পনের বছরের যত নাটক টিভিতে প্রচারিত হয়েছে সেগুলোই এখন বিপ্লব, মিঠু, পুলকদের একমাত্র বিনোদনের পথ। বিপ্লবরা এসব থেকেই তাদের জীবনের মজা খুঁজে বেড়ায়। কাজ শেষ করে যখন তারা সবাই খুব বেশি ক্লান্ত থাকে  তখন এই নাটকগুলোতো তাদের ক্লান্তি দূর করার মহৌষধ হিসেবে কাজ করে। কল্পনায় তারাও নাটক পরিচালনা করার স্বপ্ন দেখে। যদিও কেউই জানেনা নাটক কীভাবে তৈরী করতে হয়। 
ইন্টারনেট যে কত বেশি উপকারে আসতে পারে এই বন্দি জীবনে। তা মুক্ত জীবনে যারা আছে তারা কোন দিনই উপলব্ধী করতে পারবে না। কেননা ফেইসবুকের নতুন নতুন বন্ধু হোক না ৯০ ভাগ ফেইক। তবুও তো তারা বন্ধু। সময়টাতো কোন রকমে কেটে যাচ্ছে। এত ফেইক বন্ধুর মাঝেও বিপ্লব নুসরাতের মত একটা ভাল বন্ধু পেয়ে যায়। যে ইউএসএতে থাকে। নুসরাত ভাল একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করে। ফেইসবুকে তার সাথে পরিচয়। বিপ্লব তার সাথে সব কিছু শেয়ার করে। নুসরাত বিপ্লবকে সময় দেয়। আগ্রহ নিয়ে তার কথা শুনে। অথচ নুসরাতের সাথে বিপ্লবের কোন দিনই দেখা হয়নি। আর দেখা হবার কোন সম্ভাবনাও নাই। তবুও তারা বন্ধু।

মাঝে মাঝে বিপ্লবের কাছে মনে হয় এর চেয়ে অঁজপাড়াগাঁয়ের কোন এক বাস ষ্টপে গিয়ে ছেট্ট একটা চায়ের দোকান দিয়েও অনেক সুখে থাকা যায়। ছোট্ট সে চায়ের দোকানদার সারা দিন চা বিক্রি করে সন্ধ্যে হলে যখন ঘরে ফিরে তার প্রিয়তমা স্ত্রী তার জন্যে গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে। একসাথে ভাত খাওয়ার জন্যে। হয়ত তার বাচ্চাদের আবদার সে পূরণ সবসময় করতে পারে না কিন্তু তাদেরকে তো ভালবাসতে পারে। তারা জানে তাদের সীমাবদ্ধতা। তাই হয়ত অনেক বড় কিছুর আশাও তারা করে না। অনেক সময় হয়ত তাও পূরণ করতে পারে না। তবুও তাদের সেই ছোট্ট সংসারে যে ভালবাসা পাওয়া যায়। পৃথিবীর কোথায়ও কি সে ভালবাসা পাওয়া যাবে? 
কেন্টের এই রেস্টুরেন্টটি একেবারে সিটি সেন্টারে। দিনের বেলায় তেমন কোন কাজ বিপ্লবের করতে হয় না। সামনের বড় গ্লাসের মধ্যে দিয়ে বিপ্লব দেখতে পায় নানান রঙের মানুষের পথচলা। কতরকম মানুষ যে আছে! খুব কাছ থেকে পাখি দেখার জন্য মানুষ বনেবনে ঘুরে বেড়ায় তেমনি, বন্যপশু দেখতেও মানুষ যায় দূর থেকে দূরান্তে। পাহাড় ডিঙ্গায়  প্রকৃতি দেখতে, দূর লেকে মানুষের হেঁটে চলা বা আচরণ দেখার ভাগ্য হয়ত কম মানুষেরই হয়।
এই শহরটাতে ইউরোপের ছোট ছোট ছাত্রছাত্রী আসে বিভিন্ন স্কুল থেকে। তাদের প্রত্যেকের হাতেই থাকে একটি চেকলিষ্ট। যে সমস্ত স্থান তারা খুঁজে  পায়, চেকলিষ্টে তারা দাগ দেয়। 
মাঝে মাঝে কেউ কেউ বিপ্লবের কাছে আসে। জানতে চায়, এই জায়গাটা চিনে কিনা। কিন্তু ছোট ছোট বাচ্চারা কেউই কিন্তু ইংরেজিতে বলে না। যে ভাষা তারা ব্যবহার করে তা তাদের মাতৃভাষা। কিন্তু পৃথিবীর সব ভাষাই আসলে মনের ভাব প্রকাশের জন্য।
তাই সবচেয়ে বড় ভাষা হচ্ছে, মানুষের মুখ। মুখ দেখেই বিপ্লব বুঝতে পারে শিশুগুলি কি বোঝাতে চাচ্ছে।
কখনও দেখা যায় ছোট একটি বাচ্চাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে তার মা হাঁটছে। যাতে করে কোথাও হারিয়ে না যেতে পারে তার সন্তান।
আবার ৮০-৯০ বছরের বৃদ্ধদের জুটিও দেখা যায়। এটা অবশ্য সকালের দিকে বেশি চোখে পড়ে। তাদের দেখে বিপ্লব আরও বেশি মজা পায়। বুড়ো বয়সেও তাদের প্রেম এতটুকু কমে নি। বরং মাঝে মাঝে মনে হয় আরও বেড়েছে। রাস্তার মাঝখানে যদি কারো হাতের লাঠিটি পড়ে যায়, একে অন্যকে উঠিয়ে দেয় তারা, কখনও চুলগুলো ঠিক করে দেয়।
সবচেয়ে যে দৃশ্যটি বেশি দেখা যায়, তা হচ্ছে মানুষের দ্রুত হেঁটে চলা। বেশিরভাগ মানুষই রাস্তা খুব দ্রুত গতিতে পার হয়।
তাদের এত তাড়া দেখে, এত ব্যস্ততা দেখে বিপ্লব মনে মনে নিজেকে জিজ্ঞেস করে। মানুষগুলো আসলে কিসের পিছনে ছুঁটছে? কোথায় তাদের গন্তব্য? আর যদি এক গন্তব্য পার হলে আরেক গন্তব্যের জন্য ছুটতে হয়, তাহলে কেন এত ছুটে চলা?
বাইরে প্রচুর শীত পড়েছে। বিপ্লবরা রেস্টুরেন্টের সব কটা হিটার অন করে দিয়েছে। তবুও কেমন যেন শীত শীত লাগছে বিপ্লবের। অন্য সবারও মনটা খুব বেশি খারাপ আজকে। কেমন যেন থমথমে ভাব চারিদিকে। সন্ধ্যা সাতটার মত বাজে তখন। তেমন বেশি কাস্টমার আসেনি তখনও। হঠাৎ কালো শার্ট, কালো প্যান্ট ও হলুদ এ্যাপ্রোণ পড়া মানুষে ভরে গেল রেস্টুরেন্টটা। বিপ্লব বুঝতে পারে ওনারা হোম অফিসের লোক। ইমিগ্রেশন রেইড দিয়ে ফেলেছে পুরো রেস্টুরেন্ট। সামনে পিছনে অনেক পুলিশ। বিপ্লব ভেবে পায়না তার কি করা উচিত। দরজা দিয়ে ঢুকেই বিপ্লবকে ইনফর্ম করলো যে তারা হোম অফিস থেকে এসেছে। সবার আইডেন্টিটি কার্ড চেক করবে।
বিপ্লব যেন হঠাৎ মূর্তির মত হয়ে গেল। তার চোখের সামনে যমদূত। কি করবে ভেবে পায় না। সে অফিসারকে উত্তর দিলো, অবশ্যই। 
অফিসার প্রথমেই বিপ্লবকে জিজ্ঞেস করলো, তোমার নাম কি?
বিপ্লব সাথে সাথে জানাল, আমার নাম বিপ্লব আহমেদ।
অফিসার তখন বলল, জন্ম তারিখ কত তোমার?
বিপ্লব তখন জন্ম তারিখটাও দিলো তাদের।
অফিসারদের কাছে থাকা মেশিনে নাম ও জন্ম তারিখ দিতেই বিপ্লবের সব বিস্তারিত তথ্য তারা পেয়ে গেল। তারা তখন বলল, তোমার তো কাজ করার অনুমতি নেই। তবে তুমি যে কাজ করছো? 
বিপ্লব বলল, আমি আসলে আজই এখানে এসেছি। এটা আমার এক আত্মীয়র রেস্টুরেন্ট। তাই তাদের হেল্প করছি। 
অফিসার কোন কথা না বলে বিপ্লবকে বলল, তোমাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।
বিপ্লব বলল, ঠিক আছে আমি যাবো। 
বিপ্লবকে তারা ধরে নিয়ে যায় রেস্টুরেন্ট থেকে। নেবার পথে তারা বিপ্লবকে নানা প্রশ্ন করে তার সমস্ত রেকর্ড বের করে ফেলে। কোথায় কি করেছে বিপ্লব। কোথায় কোথায় কাজ করেছে এমন কি কয়দিন কোথায় থেকেছে সেটাও তারা কীভাবে জানলো বিপ্লব বুঝতে পারে না। পুলিশের গাড়িতে করে নিয়ে বিপ্লবকে একটা সেলে আটকে রাখলো ।
এই সেলের ভিতরটা খুব ঠান্ডা। এমনিতেই বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা। এখানে কোথাও কোন হিটারের ব্যবস্থা নেই। বিপ্লবের সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে। ভয় ও টেনশনে মনে হয় এটা আরো বেশি অনুভব করছে সে।
সেলের মধ্যে অবশ্য ক্যামেরা ছাড়া মোবাইল ফোন ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলো তারা। কিন্তু বাংলাদেশের কাউকে জানালো না বিপ্লব জেলখানায় বন্ধী হয়েছে আজ। আর কারো জানিয়েও তো কোন লাভ নেই। ওরা যদি বিপ্লবকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয় তাহলেতো সবাই এমনিতেই জানতে পারবে। শুধু শুধু টেনশন বাড়িয়ে তো কোন লাভ নাই।
ফোনে জামসেদের সাথে কথা বলে বিপ্লব। জামসেদ তাকে সান্তনা দেয়। দেখ কিছু হবে না। তোমার তো একটা এপ্লিকেশন করা আছে। ওরা তোমাকে বেশি দিন আটকে রাখতে পারবে না।
পরের দিন বিপ্লবের বায়োমেট্রিক্স টেস্ট করলো তারা। মানে ফিঙ্গার প্রিন্ট আর চোখের পিকচার রাখলো। হঠাৎ একটা ইমিগ্রেশন অফিসার এসে বলল, বিপ্লব সাহেব তুমি আসলে কি চাও? ইংল্যান্ডে কেন থাকতে চাইছো?
বিপ্লব উত্তর দিলো, আসলে আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি নিজের কাছ থেকে। এছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না। দেশে গিয়ে আমি আর কোন ভাল চাকরি পাবো না। তোমরা যদি আমাকে একটা কাজ করার অনুমতি দাও তাহলে আমি সারা জীবন তোমাদের দেশে থেকে যেতে চাই। বাংলাদেশে আমার মা বাবা, ভাই সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তাদেরকে হতাশ করতে পারবো না। 
অফিসার উত্তর দিলো, তোমার এপ্লিকেশন এখনও পেন্ডিং আছে। তার মানে তুমি এখন কাজ করতে পারবে না। আর তুমি প্রতি সপ্তাহে এসে এখানে সই করে যাবে। যেটা প্রমাণ করবে তুমি পালিয়ে যাওনি।
লম্বা একটা ফরম পূরণ করে বিপ্লবের সই রেখে ছেড়ে দিলো তারা। কিন্তু সে কোথায় যাবে। যেই রেস্টুরেন্ট থেকে এসেছে সেখানেই কি যাবে? না অন্য কোথাও? আর তারতো অন্য কোথাও যাওয়ারও তেমন যায়গা নাই। আবার সেই রেস্টুরেন্টেই চলে এল।
সবাই বিপ্লবকে একরকম ওয়েলকামই জানালো। খুব বেশি সিম্পেথি জানালো সবাই। রেস্টুরেন্টটির মালিক নিজে থেকেই বললেন, ওরা যেহেতু তোমাকে ছেড়েই দিয়েছে সেহেতু তুমি এখানেই থাকতে পারবে। তবে একটু সাবধানে চলাফেরা করো।
বিপ্লবের খুশিতে দুই চোখে জল এসে যায়। সে মুক্তি পেয়েছে এই ভেবে অথচ কিছুক্ষণ আগেও সে জানতো না তার থাকার স্থান কোথায়।
আগের চেয়ে অনেক বেশি মনোযোগ দিয়ে কাজ করা শুরু করলো ও। কখনো মোবাইল ফোন নিয়ে কাজে  যায় না। সবার আগে আসে কাজে। সমস্ত কাজ নিজের মনে করে সে। মনে করে সব কাজ তাকে একাই করতে হবে। বাকিরা কে কি করলো তার দিকে কোন খেয়ালই নেই তার। কাজের প্রতি এত অনুরাগ দেখে রেস্টুরেন্টের মালিক বিপ্লবের বেতন আরো বাড়িয়ে দিলো। এভাবেই কাজের মধ্যে খুঁজেপায় তার আসল জীবনের ঠিকানা।
সকাল এগারোটার মতো বাজে। হঠাৎ মোবাইল ফোনে রিং বেজে উঠলো। অঘোর ঘুমে ঘুমিয়ে আছে বিপ্লব। মোবাইলের ভাইব্রেশনকে মনে করলো কাজের এলার্ম। কিন্তু ফোন স্ক্রিনে চোখ পরতেই দেখে পরীর ফোন। পরী ফোন করেছে বাংলাদেশ থেকে।
বিপ্লব পরীর ফোন ধরে বলল, কেমন আছো?
পরী উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞাস করলো, তুমি কেমন আছো?
বিপ্লব বলল, আছি এইতো। 
পরক্ষণেই তার মনে হলো পাশে তার রুমমেট ঘুমাচ্ছে। ভাবল, তাকে ডিস্টার্ব করার ঠিক হবে না।
পরীকে বলল, তোমাকে বিকেলে ফোন করবো। ভাল থেকো। 
পরী বলল, তোমার সাথে কথা আছে। 
বিপ্লব বলল, ঠিক আছে। আমি তোমাকে বাংলাদেশ সময় এগারটার দিকে ফোন করবো। 
বলেই ফোনটা রেখে দিলো সে।
সেদিন দুপুর বেলা কাজ শেষ হতে অনেক দেরি হলো বিপ্লবের। রুমে এসে তাই সে একদমই সময় পেলো না পরীকে ফোন করবার। অথচ পরী কি যেন বলতে চেয়েছিলো তাকে। কিন্তু পরীর যা বলার ছিলো তা তো সে বলে দিয়েছে বিপ্লবকে। নতুন করে আর কিছু শুনতে চায় না । এমনিতেই অনেক ঝামেলার মধ্যে আছে সে।
দুদিন পরে আবার পরীর ফোন। সেদিন বিপ্লবের ডে-অফ ছিলো। তাই ফোন ব্যাক করা খুব সহজ হলো। রুম থেকে বের হয়ে একটা পার্কে গিয়ে বসলো বিপ্লব। যেতে যেতেই ফোন দিলো পরীকে। পরী ফোন ধরে কিছু বলছে না। কিছুক্ষণ পর পর শুধু কান্নার শব্দ শুনতে পেলো বিপ্লব। অনেকক্ষণ পর বিপ্লব বলল, পরী তুমি কাঁদছো, না? তোমার তো কান্নার কথা না। তোমার সুখের কথা ভেবেইতো আমি কিছু বলিনি তোমাকে। তোমারতো খারাপ থাকার কথা না। ভেবো না আমি খারাপ আছি। আমি খুব ভাল আছি। আমর কোন দুঃখ নেই। আরে তুমি মনে করেছো আমি তোমার জন্যে মরে যাবো। পরী কোন কথা বলে না। দুই থেকে তিন মিনিট পর আবার পরী কান্না শুরু করলো। বিপ্লবেরও খুব খারাপ লাগলো পরীর কান্না শুনে। কিন্তু তার তো এখন আর কিছু করার নেই। সে নিজেই কোন রকমে বেঁচে আছে। এই মুহূর্তে সে যেভাবে আছে এটা পরী কেন পৃথিবীর কাউকেই বলা যাবে না। তার পরও বলল, শুনি কি হয়েছে তোমার? 
পরী বলল, আমি ভুল করেছি। আমি আসলে তোমাকেই ভালবাসি। তুমি আমাকে নিয়ে যাও বাংলাদেশ থেকে। আমি একদিনও থাকতে চাই না আর বাংলাদেশে। 
বিপ্লব বলল, কেন? হঠাৎ বাংলাদেশ তোমার কি ক্ষতি করলো? 
পরী বলল, যে ছেলে আমার জন্য ঠিক করেছে তার বয়স আমার চেয়ে দশ বছরের বেশি। মাথায় একটাও চুল নেই।  ও হতে পারে তারা কোটিপতি। তাতে কি? আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবো না। তুমি আমাকে নিয়ে চলো। তোমার কাছে চলে আসবো। তুমি আমাকে যেমন রাখো আমার কোন আপত্তি নাই। প্লিজ, তুমি না বল না।
বিপ্লব জানে এই মুহূর্তে তার বিয়ে করা সম্ভব না। সেই পরিস্থিতিও এখন তার নেই। আবার পরীর কথায় বাংলাদেশে চলে গেলেও তার বাবা মা বিপ্লবের কাছে পরীকে বিয়ে দেবে না। কারণ তাদের পছন্দ কোটিপতি ছেলে।
পরীকে বিপ্লব তাই মিথ্যে কথা বলে, দেখ পরী ইংলিশ একটা মেয়ের সাথে আমার রিলেশন এখন। আমি তাকে ভীষণ ভালবাসি। আমরা দুজনে বিয়েও করতে চাই। তুমি আমাকে বিরক্ত করো না। আমি খুব ভাল আছি। 
এই কথা বলার পর পরীর কান্না শুনতে পেল বিপ্লব। বিপ্লবও তার আবেগকে আর ধরে রাখতে পারল না। পরীর কান্নার সাথে সাথে সেও কাঁদতে শুরু করল।
ওদের কান্নার শব্দে চারপাশ যেন ভারি হয়ে আসছিল। কারও মুখে কোন কথা নেই। চারদিক স্তব্ধ। বিপ্লবের ভারাক্রান্ত হৃদয় দেখে মনে হলো পার্কের পাখিগুলোও কাঁদতে বসেছে। পাখিগুলো তাদের কলতান বন্ধ করে দিয়েছে। কানের সাথে ফোন লাগিয়ে কতকক্ষণ যে নিরবে দাঁড়িয়ে ছিল তা নিজেও জানে না। বিপ্লব মিথ্যা বলা বা কারও সাথে প্রতারণা করা একদম পছন্দ করে না। তাই তো ক্ষণিকের জন্য পরীর সাথে অভিনয় করতে গিয়েও থমকে গেল। মনকে শক্ত রেখে কথা আর এগিয়ে নিতে পারল না। অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর আবার এক রকম অচেতন অবস্থায় সে কথা বলে যাচ্ছিল। পরী অনেক অনুনয় বিনয় করে বলার চেষ্টা করে যে, তার ভুল হয়েছে। কিন্তু পরীর কোন কথায় বিপ্লব শান্ত হতে পারে না। পরীর ব্যাপারে সে আগের মত সহজ হতে পারে না। যদিও সে জানে পরীকে ফিরিয়ে দেওয়া জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম কাজ। পরীকে ছাড়া তার জীবন অর্থহীন। পৃথিবীতে বেঁচে থাকা বৃথা।
পৃথিবীর সবাইকে ফিরিয়ে দিতে পারলেও তার তো পরীকে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা নয়। মানুষকে তার এই ইচ্ছার বিরুদ্ধে কখনো কখনো কাজ করতে হয়। বিপ্লবও তাই করল। মনের বিরুদ্ধেই সে অবস্থান নিল। তার স্বপ্নের মানুষকে সে হাতের কাছে পেয়েও হৃদয়ে স্থান না দেয়ার অভিনয় করল। সে বহু কষ্টে পরীর প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করল। আর সেই রাতে বিপ্লব পরীকে না বলে দিয়ে মানসিকভাবে অনেকটাই ভেঙে পড়ল। ওর সামনে বিশাল এক শূন্যতা। নিঃসঙ্গ একাকী। জীবনের শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে ও যেন নিঃস্ব হয়ে গেল। নিজেকেই নিজের কাছে এখন পৃথিবীর সব থেকে বড় বোঝা বলে মনে হচ্ছে।
ক্লান্ত অবসন্ন মনে রুমে এসে অচেতন অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙলো তখন রাত একটা বাজে। প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দেখে সে তার মানিব্যাগ হারিয়ে ফেলেছে। যাতে ছিল তার শেষ আইডেন্টিটি ড্রাইভিং লাইসেন্স। সাথে ব্যাংকের কয়েকটি কার্ড।
সঙ্গে সঙ্গে পার্কে ছুটল । তখন পার্ক বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। দেয়াল টপকিয়ে সেই জায়গাতে গিয়ে কিছু পেলনা সে। পরীর সাথে সাথে সে তার সব কিছুই হারিয়ে ফেলে সেদিন। 
এর কয়েক মাস পরেই পরীর চেয়ে বয়সে দশ বছরের বড় টাক মাথাওয়ালা ছেলেটির সাথেই পরীর বিয়ে হয়ে যায়। বিয়েতে নাকি অনেক ধুমধাম হয়েছে। বিপ্লবের ইচ্ছে হয় একটি বার পরীর সাথে কথা বলতে। কিন্তু  পরীকে ফোন করার মত সাহস পায় না বিপ্লব। সমস্ত আত্মবিশ্বাস, শক্তি ও আজ হারিয়ে ফেলেছে। এতদিন পর কি বলবে পরীকে? পরীই বা তাকে কতটুকু গ্রহণ করবে। সে তো এখন অন্যের স্ত্রী। পরী এখন আর বিপ্লবের কেউ না। কিন্তু মন যে মানে না। রাজ্যের অস্থিরতা পেয়ে বসে বিপ্লবকে। আকুল হয়ে পরীর কথা ভাবে। কিন্তু পরী এখন অন্যের ঘরে হয়তো সুখেই আছে। বিপ্লবও তো আজীবন পরীর সুখই কামনা করে এসেছে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ও। মনটাকে যথা সম্ভব হালকা করার চেষ্টা চালায়। ঘোরের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে। 

জীবন ঝর্নার মতই বহমান। কারও জন্য জীবন থেমে থাকে না। অন্যের মঙ্গল কামনা করাই মানুষের প্রকৃত ধর্ম। বিপ্লব মনে মনে দোয়া করে পরী যেন সুখি হয়। সে না হয় সারা জীবন এভাবেই কাটিয়ে দিবে। কিন্তু পরীতো সুখে থাকবে। ভালবাসার মানুষ সুখে থাকুক এটাই চায় বিপ্লব। আবেগ ঝেড়ে ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়ায় ও। ওকে এখনও অনেক দূর যেতে হবে। কোন মানুষ থেমে থাকার জন্য জন্মায় না।
পরীর বিয়ের পর বিপ্লবের মনের অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে। সিগারেটের পরিমাণ দিনে দিনে আরো বাড়তে থাকে। একদিকে প্রিয়তমাকে না পাওয়ার বেদনা অন্যদিকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতছানি। তার পরও মানুষ বেঁচে থাকে। বিপ্লবকেও বাঁচতে হবে। প্রতি মাসে ঠিকই টাকা পাঠায় বাড়িতে। বাড়ির মানুষদের কিছু বুঝতে দেয় না বিপ্লব। কষ্ট হলে ওর একারই হোক। অন্য কাউকে কষ্টের মধ্যে জড়াতে চায় না।



এর অনেক বছর পর আমি কিংক্রস স্টেশনে টিউবের জন্য অপেক্ষা করছি। হঠাৎ মাঝ বয়সি একটা লোককে দেখে আমার চোখটা কেমন যেন চলে গেলো তার দিকে। লোকটিকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। চশমা পরা ভদ্রলোকটি স্টেশনে দাঁড়িয়ে খুব মনযোগ দিয়ে সেদিনের পত্রিকা পড়ছে । সাথে একটা অফিসিয়াল ব্যাগ। পুরো ইংলিশ স্টাইল। চেহারাটা কেমন যেন বিপ্লবের মতো লাগলো। কিন্তু সে যদি বিপ্লব হয় তাহলে একি হাল হয়েছে তার!  সিগারেটে পুড়ে গেছে তার ঠোঁট দুটো। ত্রিশ পয়ত্রিশ বয়স্ক বিপ্লবকে কেন এত বয়স্ক দেখাবে? আমি ভেবে পাই না। কাছে গিয়ে বিপ্লব বলে আস্তে করে ডাক দিলাম।
মাথা ঘুরিয়ে বিপ্লব আমাকে দেখতে পেল। আমাকে দেখেই পাগলের মত ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, কেমন আসিস দোস্ত?
ভাল আছি। তুই কেমন আছিস? বিপ্লব কিছু বলল না। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে। তারপর উদাস ভঙ্গিতে বলল, এই তো বেশ আছি। আমি কাজের পারমিশন পেয়ে গেছি ক’দিন আগে। এখন ওটু মোবাইলের নেটওয়ার্ক ডিপার্টমেন্টে জব করছি। সাথে এম.এসও করছি ম্যানচেষ্টার ইউনিভার্সিটি থেকে। এম.এসও প্রায় শেষের দিকে। আর এটা শেষ হলে খুব ভাল একটা প্রমোশনও হবে।
বাহ্! খুব ভাল খবর। বিপ্লবের অনিচ্ছা সত্ত্বেও জানতে চাইল, তা তুই এখন কি করছিস?
আমি বললাম, চধপরভরপ খঁঃযবৎধহ টহরাবৎংরঃু, ডঅঝওঘএঞঙঘ, টঝঅ থেকে "ঋষবীরনষব ঐধৎফধিৎব অপপবষবৎধঃড়ৎং ভড়ৎ ইরড়পড়সঢ়ঁঃরহম অঢ়ঢ়ষরপধঃরড়হং" এর উপর পিএইচডি করছি তিন বছর হলো। এখানে একটা সেমিনারে এসেছিলাম। আজই চলে যাব।
বিপ্লব বলল, তোর খবর শুনে আমার খুব ভাল লাগল দোস্ত। 
আমি উচ্ছ্বাসের সাথে বললাম, এতদিন পর তোর সাথে দেখা হয়ে কি যে ভাল লাগছে তা বলে বোঝাতে পারবো না। বেশি খুশি হয়েছি তোর সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে শুনে। আমি বললাম, পরী কেমন আছে? ওর সাথে যোগাযোগ হয়? 
একথা শোনার পর বিপ্লব যেন কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। ওর চেহারার মধ্যে একটা কালো ছায়ার আস্তরণ দেখতে পেলাম আমি। ও কোন কথা বলছে না। ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে চোখে কোন জ্যোতি নেই। বিপ্লবকে এখন একজন পথহারা মানুষের মত লাগছে। ওকে দেখে আমার যারপর নেই মায়া হলো।
নীচুস্বরে বললাম, এখনো পরীকে ভুলতে পারিসনি বুঝি? 
বিপ্লব দুর্বলভাবে মাথা নেড়ে উত্তর দিলো, এ জীবনে পরীকে ভুলে থাকা কি সম্ভব! 
কথা বলতে বলতে পাশের নেরো কফি সপের দিকে এগোলাম। কফি খেতে খেতে আরও কিছুক্ষণ গল্প হলো দুজনের মধ্যে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে এক সময় বললাম, আমাকে তো আজই ওয়াশিংটন ফিরে যেতে হবে। যোগাযোগ রাখিস। সময় পেলে মেইল করিস। ভাল লাগবে। সময় সুযোগ পেলে ইউএসএ এসে একবার বেড়িয়ে যাস। তোর ভাবি তোকে দেখে খুব খুশি হবে। 
বিপ্লব অস্ফুটস্বরে বলল, আচ্ছা দেখি। তুই আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুদের মধ্যে একজন। সময় পেলে অবশ্যই যাব তোদের দেখতে।
কথা শেষ করে বিপ্লব আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। কফি সপ থেকে বেরিয়ে সোজা ফুটপাথ ধরে হাঁটতে শুরু করেছে। যতক্ষণ দৃষ্টির আড়াল না হয় ততক্ষণ আমি তাকিয়েছিলাম ওর দিকে।
আমার চোখে বিপ্লব সেরাদের সেরা। বিপ্লব আমার বন্ধু। ওকে আমি ভাল করে জানি। ও একটা নক্ষত্র। কিছু কিছু নক্ষত্র আছে আজো যারা পৃথিবী থেকে অনেক অনেক দুরে। যাদের আলো এখনও পৃথিবীতে এসে পৌঁছায়নি। মহাশুন্যের সেই সমস্ত নক্ষত্রগুলোকে আমরা হয়ত চিনি না। তাদের নামও আমরা দেই না। কিন্তু তারাওতো আপন আলোয় আলোকিত। যার যার পরিমন্ডলে সে সে অফুরন্ত শক্তির আধার। তেমনি বিপ্লবও একটি নক্ষত্র। আবদুল্লাহ আবু সাঈদ স্যার যেমন আলোকিত মানুষের সন্ধান করেন তেমনি একজন আলোকিত মানুষ। যাদের আলোতে হয়ত কোটি মানুষ আলোকিত হয় না। কিন্তু তারাতো তাদের আপন পরিমন্ডলকে আলোকিত করে। এমনি হাজার সোনার ছেলে আছে এই দেশে। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ধৈর্য্য এবং মেধা দিয়ে একটি পরিবারকে নতুন করে গড়ে তুলে। যে পরিবারটি পরিণত হয় অন্য দশটি সাধারণ পরিবারের চেয়ে সচল। তৈরি করে সমাজে তাদের পরিবারের নতুন অবস্থান। যেখান থেকে কেউ কেউ বের হয়ে এসে তৈরী করে ইতিহাস। হয়ে যায় পত্রিকার শিরোনাম। বিপ্লব তোমাকে অভিনন্দন। তোমার চারপাশের মানুষকে আলোকিত কর।
বিপ
***

No comments:

Post a Comment