ভালবাসি প্রকৃতি

ভালবাসি প্রকৃতি

Saturday, January 5, 2019

ধর্ষণ নিয়ে ধস্তাধস্তি

ধর্ষণ রুচিহীন মানুষের বিকৃত রুচির পরিচয়। শুধু আমাদের দেশেই নয়, সারা বিশ্বে বিকৃত রুচির যৌনাচার চলমান। বিভিন্ন ছল ছুতায় এক শ্রেণীর পশু মনোবৃত্তি সম্পন্ন মানুষ রুপি জানোয়ার এ রুচির পরিচয় দেন। আসলে জানোয়াররা এমন কর্ম করে কিনা জানিনা, মানুষ করে এটা নিশ্চিত। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচন পরবর্তী ৩০ ডিসেম্বর রাতে নোয়াখালির সুবর্ণচরে এমনই এক হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটে যায়। পরিবারের সদস্যদের বেঁধে রেখে আওয়ামীলীগ সমর্থক কিছু পশু মনোবৃত্তি সম্পন্ন জানোয়ার ঘটনাটি ঘটায়। যেমনটি ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত নির্বাচন পরবর্তী ৮ অক্টোবর রাতে বিএনপি-জামায়াতের পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল সিরাজগঞ্জের ১৪ বছরের মেয়ে পূর্ণিমা। সভ্য দেশের কোন সভ্য মানুষই এমন ঘটনাকে সমর্থন দেবে না। সেটা যে দলের সমর্থকই হোক না কেন।
ধর্ষণ আসলে কি? ধর্ষণ এক ধরনের যৌন আক্রমণ। সাধারণত একজন ব্যক্তির অনুমতি ব্যতিরেকে তার সঙ্গে যৌনসঙ্গম বা অন্য কোনো ধরনের যৌন অনুপ্রবেশ ঘটানোকে ধর্ষণ বলা হয়। ধর্ষণ শারীরিক বলপ্রয়োগ, অন্যভাবে চাপ প্রদান কিংবা কর্তৃত্বের অপব্যবহারের মাধ্যমে সংঘটিত হতে পারে। অনুমতি প্রদানে অক্ষম যেমন-কোনো অজ্ঞান, বিকলাঙ্গ, মানসিক প্রতিবন্ধী কিংবা অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি এরকম কোনো ব্যক্তির সঙ্গে যৌনমিলনে লিপ্ত হওয়াও ধর্ষণের আওতাভুক্ত। ধর্ষণ শব্দটির প্রতিশব্দ হিসেবে কখনো কখনো 'যৌন আক্রমণ' শব্দগুচ্ছটিও ব্যবহৃত হয়। বিচারব্যবস্থায় 'ধর্ষণ' শব্দটি ব্যবহার না করে 'যৌন আক্রমণ' কিংবা 'অপরাধমূলক যৌন আচরণ' শব্দগুচ্ছকে ব্যবহার করা হয়। অপরিচিত ব্যক্তিদের চেয়ে পরিচিত ব্যক্তিদের দ্বারা ধর্ষণের ঘটনার সংখ্যা অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক সংঘাত বা যুদ্ধের সময়ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে ও ব্যাপক হারে ধর্ষণ (যুদ্ধকালীন যৌন সহিংসতা ও যৌন দাসত্ব) ঘটে থাকে। এ ধরনের ঘটনাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ধর্ষণ গণহত্যার একটি উপাদান হিসেবেও স্বীকৃত। যে কোনো লিঙ্গ, বয়স, জাতি, সংস্কৃতি বা ধর্মের ব্যক্তি ধর্ষণের শিকার হতে পারে। ধর্ষণকে বেশ কয়েকটি ধরনে ভাগ করা হয়, যেমন- গণধর্ষণ, বৈবাহিক ধর্ষণ, অজাচার ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ, কারাগারে ধর্ষণ এবং যুদ্ধকালীন ধর্ষণ। গণধর্ষণ হচ্ছে একদল লোক কর্তৃক একজন একক ব্যক্তিকে ধর্ষণ। দুই বা ততোধিক ব্যক্তি (সাধারণত কমপক্ষে তিনজন) কর্তৃক ধর্ষণ সারা বিশ্বে প্রচুর ঘটে থাকে। গণধর্ষণের ক্ষেত্রে দেখা যায়, মদ এবং নেশাজাতীয় দ্রব্যের প্রভাবে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটে, দিনের তুলনায় রাতে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটে, এক্ষেত্রে অধিকাংশ ভুক্তভোগী নিষ্ঠুর যৌন আক্রমণের শিকার হয়। একক ব্যক্তির দ্বারা ধর্ষণের চেয়ে গণধর্ষণ বেশি হিংস্র হয়। গণধর্ষণকে কখনো কখনো 'দলগত ধর্ষণ'ও বলা হয়ে থাকে।
কিছু ঘটনা মানুষ চাইলেও ভুলতে পারে না। যেমন ২০০১ সালের সিরাজগঞ্জের ঘটনা। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানার দেলুয়া গ্রামের অনিল কুমার শীলের কিশোরী কন্যা পূর্ণিমান রানী শীল। অষ্টম সংসদ নির্বাচনের সময়টাতে ছিলেন হামিদা পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী। নির্বাচনের দিন দেলুয়া হাইস্কুল কেন্দ্রে যান তিনি। সেখানে তাঁর গৃহশিক্ষক সাধন পোলিং এজেন্ট হিসেবে কাজ করছিলেন। পূর্ণিমাকে দেখে সাধন অনুরোধ করে বলেন, ‘তিনি বাসায় খেতে যাবেন। তাই তিনি ফিরে আসার আগ পর্যন্ত যেন পূর্ণিমা একটু বসেন।’ পরে সাধন ফিরে আসলে পূর্ণিমা বাড়ির দিকে রওয়ানা দেন। পথে বিএনপি-জামায়াত কর্মী ও সমর্থকরা তাকে শাসায়। সপ্তাহখানেক যেতে না যেতেই সেই শাসানোকে বাস্তবে রূপ দেয় বিএনপি-জামায়াত সন্ত্রাসীরা। ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী অক্টোবর মাসের ৮ তারিখ রাতে পূর্ণিমার ওপর চালানো হয় বর্বরতম অত্যাচার-নির্যাতন-নিপীড়ন। রাতে জোরপূর্বক বাড়িতে ঢুকে পুরো পরিবারের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের চালায় বিএনপি-মামায়াত সন্ত্রাসীরা। এক পর্যায়ে অনিল শীলের ছোট মেয়ে পূর্ণিমাকে গণধর্ষণ করে তারা। এত মানুষ দেখে পূর্নিমার মা সেদিন বলেছিলো, ‘বাবারা, আমার মেয়েটা ছোট তোমরা একজন একজন করে এসো, নয়তো মেয়েটি মরে যাবে।’ পূর্ণিমার মায়ের সেদিনের আকুতি মানুষ কোনদিনই ভুলবে না, আমরাও ভুলিনি।
যেমনটি মানুষ ভুলবে না ২০১৮ সালের নির্বাচন পরবর্তী নোয়াখালীর ‘স্বামী-সন্তানকে বেঁধে রেখে দলবেঁধে ধর্ষণ’ এর ঘটনা। সুবর্ণ চরের ধর্ষিতা নারীর জবানবন্দিতে উঠে এসেছে সেই বর্বরতার করুন কাহিনী। তিনি বলেন, ‘তারা আমাকে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে ভোট দেওয়ার জন্য জোর করেছিলো, কিন্তু আমি তাদের কথা না শুনে ধানের শীষে ভোট দিয়েছি।মধ্যরাতে ১০ থেকে ১২ জন লোক হাতে লাঠিসোটা নিয়ে বেড়া কেটে তার বাড়িতে ঢুকে। তারপর তারা তার স্বামী ও চার সন্তানকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে। এরপর তারা আমাকে বাইরে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। এ বিষয়ে মুখ খুললে তার স্বামী ও সন্তানদের মেরে ফেলা হবে এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হবে বলে হুমকি দিয়ে যায় ধর্ষণকারীরা।’
ধর্ষিতার স্বামী বলেন, ‘তার স্ত্রী গত রবিবার সকাল ১১টায় চর জুবিলী প্রাথমিকে বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে যান। সেখানে তিনি সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের কাছ থেকে ব্যালট পেপার নিয়ে বুথে যেতে চান। ওই সময় আওয়ামী লীগের কর্মী রুহুল আমীন তাকে নৌকায় ভোট দেওয়ার জন্য জোর করেন। কিন্তু, তাকে (রুহুল আমীন) যখন বলা হয় যে ধানের শীষে ভোট দেওয়া হয়েছে, তখন তিনি ব্যালট পেপারটি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু, এরমধ্যেই তার স্ত্রী ব্যালটটি বাক্সে ঢুকিয়ে দেন। এতেই রুহুল ক্ষেপে যান এবং দেখে নেওয়ার হুমকি দেন।’
কোন রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরা তাদের কর্মীদের বলেন না এমন জঘন্ন ঘটনা ঘটাও। অতি উৎসাহী একদল কর্মী যারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য বা হীন চিন্তা চেতনার বাস্তব রুপ দিতে এমনটা ঘটায়। তারা চিন্তা করে তাদের পিছনে রাজনৈতিক হাতের ছায়া আছে। এধরনের কর্মীদের বিষয়ে সকল রাজনৈতিক দলেরই সতর্ক হওয়া উচিত। এধরনের অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা এবং কঠোর হস্তে দমন করা না গেলে ভবিষ্যতে পূনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে। ধর্ষণ সহ প্রতিটি অপরাধকেই দলীয় দৃষ্টিকোন থেকে বিবেচনা করা উচিত নয়। আমাদের দেশে দলীয় পরিচয় পাওয়ার পর সরকার একটু হলেও নমনীয় হয়ে উঠে যা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এই নমনীয়তা ত্যাগ করে অপরাধীকে অপরাধী হিসাবে বিবেচনা করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে একটি বাসযোগ্য দেশ গঠন করতে হবে। একজন ধর্ষিতার শরীর থেকে যতটা রক্তক্ষরণ হয় তার চেয়ে অনেক বেশি রক্তক্ষরণ হয় দেশবাসীর হৃদয় থেকে। এই রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে হবে। শাস্তি নিশ্চিত করলে রাজনৈতিক শক্তির ভরসায় কেউ আর অপরাধ করতে সাহস পাবে না। ২০০১ সালে সংঘটিত ধর্ষনের বিচার সম্পন্ন হয়েছে ২০১১ সালে। দীর্ঘ দশ বছর সময় লাগাটা উচিত হয়নি। এধরণের অপরাধের বিচার দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে সহনশীল হওয়া উচিত। ক্ষমতার লোভে ও মোহে পড়ে এমন সব কর্ম করে এবং প্রশ্রয় দেয় যা জাতির জন্য কলঙ্কময় অধ্যায় রচনা করে। সকলের বোধদয় হোক। মানুষ মানুষের জন্য। বিবেক জাগ্রহত হোক। বিবেক জাগ্রহত হোক। বিবেক জাগ্রহত হোক।

No comments:

Post a Comment