ভালবাসি প্রকৃতি

ভালবাসি প্রকৃতি

Sunday, January 13, 2019

বৃক্ষের রক্তক্ষরণ বন্ধে আইন হোক

প্রয়োজনে বৃক্ষকে ব্যবহার করতে কোন বাধা নেই। কিন্তু আমরা অপ্রয়োজনেও বৃক্ষকে এমন ভাবে ব্যবহার করি যা উচিত নয় বলেই মনে হয়। বৃক্ষ আমাদের পরম বন্ধু এটা সামান্য জ্ঞানসম্পন্ন মানুষও স্বীকার করবে। কিন্তু আমরা অপ্রয়োজনে বৃক্ষর উপর যে অত্যাচার করি তা বন্ধ করা উচিত। বিশেষ করে বৃক্ষের সাথে পেরেক মেরে, দড়ি বেধ বিভিন্ন বিজ্ঞাপন ঝুলিয়ে বৃক্ষের যে রক্তক্ষরণ করি তা বন্ধ করা উচিত। আর এই অন্যায় বন্ধে প্রয়োজনে আইন হতে পারে। 

প্রথমেই বৃক্ষ নিয়ে কিছু তথ্য দেই। বৃক্ষ বহুবর্ষজীবী কাষ্ঠবহুল উদ্ভিদ। বৃক্ষকে এভাবে সঙ্গায়িত করা হয়ঃ কাষ্ঠবহুল উদ্ভিদ যার মাটি থেকে সুস্পষ্ট শীর্ষ প্রকটতা বিশিষ্ট একটি একক প্রধান কান্ড অথবা গুঁড়ি থেকে বহুধাবিভক্ত অপ্রধান শাখা বিকশিত হয়। কিছু লেখকের মতে পূর্ণ বিকশিত অবস্থায় বৃক্ষের ন্যূনতম উচ্চতা ৩ মিটার থেকে ৬ মিটার হওয়া উচিত। আবার কিছু লেখক গাছের কান্ডের ন্যূনতম ব্যাস নির্ধারণ করেছেন ১০ সেমি। অন্যান্য কাষ্ঠবহুল বৃক্ষ, যারা এই শর্তগুলো পূরণ করতে পারে না, যেমন শাখান্বিত প্রধান কান্ড অথবা ছোট আকৃতির গাছকে গুল্ম বলা হয়। অন্যান্য উদ্ভিদের তুলনায় বৃক্ষ দীর্ঘজীবী হয, কোন কোন গাছ হাজার বছরও বেঁচে থাকে এবং ১১৫ মিটার পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে। বৃক্ষ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কারণ এরা ভূমিক্ষয় রোধ করে এবং এদের পত্রপল্লবের নিচে আবহাওয়া-সুরক্ষিত বাস্তসংস্থান তৈরি করে। বৃক্ষ অক্সিজেন তৈরি ও বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড দূরীকরণ এবং ভূমির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরা ল্যান্ডস্কেপিং ও কৃষির উপাদানো বটে, যার কারণ হল তাদের সৌন্দর্যগত আবেদন ও বিভিন্ন ধরণের ফল। বৃক্ষ থেকে প্রাপ্ত কাঠ ঘরবাড়ি তৈরি সহ নানান কাঠামো তৈরিতে এবং জ্বালানি কাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ২০০৫ সালের হিসাব অনুযায়ী পৃথিবীতে প্রায় ৪,০০০ কোটি গাছ ছিল, প্রতি মানুষে প্রায় ৬১ টি।

উপরে বৃক্ষ সম্পর্কে সামান্য কিছু তথ্য দেয়া হয়েছে। বৃক্ষ নিয়ে একটা গবেষণাপত্র লিখলেও লিখে শেষ করা যাবে না। আর বৃক্ষের গুণাগুণ বর্ণনা করার মত জ্ঞানও আমার নেই। তবে বৃক্ষ নিয়ে যা বলতে লিখাটা শুরু করেছি সেটাই বলি। আমাদের দেশে এখন কেউ গাছে না উঠতে পারলে নেতা হয় না। ছোট বড় সাইজের ফেস্টুন, বিজ্ঞাপন গাছের সাথে পেরেক-গজাল দিয়ে সেটে দিয়ে নিজেকে প্রচার করে। দলের মূল নেতা-নেত্রীদের পাসপোর্ট সাইজের ছবি দিয়ে আর নিজের বিশাল সাইজের ছবি ব্যবহার করে ফেস্টুন, বিলবোর্ড প্রিন্ট করে গাছের সাথে ঝুলিয়ে দেয়। এছাড়া কোচিং সেন্টার, শ্রীপুরের বড়ি, সান্ডার তেল, কলিকাতা হারবাল, তান্ত্রিক হাকিম, ডাক্তার, দোকানদার কেউ এই দৌড়ে পিছিয়ে নেই। সবাই বৃক্ষকে প্রচার প্রচারণার একমাত্র দেয়াল হিসাবে ব্যবহার করে। শুধুযে পেরেক-গজাল দিয়ে তা কিন্তু নয়। অনেকে গাছের সাথে নাইলনের মোট-চিকন দড়ি দিয়ে নিজেদের ব্যানার বেধে রেখে আত্মপ্রকাশ করে। প্রচার প্রচারণার কাজটা শেষ হলে কেউই দড়িটা খুলে নেয় না, যেমন নেয় না পেরেক-গজালে যুক্ত বিজ্ঞাপনগুলো।
আমরা সেই কবেই জেনেছি বৃক্ষেরও প্রাণ আছে। তাহলে বৃক্ষের গলায় রশি দিয়ে বেধে দিলে কি তাদের দম আটকায় না? বৃক্ষের গায়ে পেরেক-গজাল বিদ্ধ করলে কি রক্তক্ষরণ হয় না। হয়তো এভাবে কেউ ভাবে না বা নিজের অপ-প্রয়োজনে ভাবতে চায় না। তাই বৃক্ষের এ দুরবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি কঠিন আইন প্রণয়ন করা জরুরী বলে মনে হয়। বৃক্ষ আমরা ব্যবহারের জন্য, প্রয়োজনে কাটবো, ভাঙ্গবো কিন্তু এভাবে নির্যাতন বন্ধ করা উচিত।

গাছের জীবন নিয়ে একটা গল্প দিয়ে শেষ করি। আমাদের প্রিয় মহানবীও গাছপালা ভালোবাসতেন। গাছেরও জীবন আছে, গাছও কষ্ট পায়। অকারণে গাছ কাটা কিংবা গাছের পাতা ছেঁড়া মহানবী একেবারেই পছন্দ করতেন না। অবশ্য মহানবী কারণ ছাড়া কোনো কাজ নিজেও করতেন না, অন্যকেও করতে দিতেন না। তিনি বলতেন, ‘এ পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা মানুষের উপকারে লাগবে। অপ্রয়োজনে তাই কোনো কিছু নষ্ট করতে নেই। নিয়মমতো সবকিছু ব্যবহার করা উচিত। তাই প্রয়োজনে গাছ কাটতে হয়। কিন্তু অকারণে গাছের একটি পাতাও ছেঁড়া উচিত নয়। একদিন মহানবী তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে যাচ্ছিলেন এক সফরে। ক্লান্ত হয়ে তাঁরা বিশ্রাম নিতে বসলেন মাঝপথে। এমন সময় দেখেন দূরে গাছের তলায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছে কয়েকজন লোক। কিন্তু ওদের মধ্যে একজন আপন খুশিতে পাতা ছিঁড়ছে। বাতাসে ভাসিয়ে দিচ্ছে সেই পত্রগুচ্ছ। ব্যাপারটা দেখে মহানবী খুব দুঃখ পেলেন। এগিয়ে গেলেন লোকটার কাছে। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন তুমি অযথা গাছের পাতাগুলো ছিঁড়ছ?
‘ছিড়লে ক্ষতি কী? ভালো লাগছে তাই ছিঁড়ছি।’
মহানবী তখন লোকটির আরো কাছে গেলেন। চুল টেনে ধরলেন তার। লোকটি উহ্ আহ্ করে উঠতেই মহানবী বললেন, ‘এত অল্পতেই তুমি ব্যথা পাচ্ছ? যদি তোমার চুল টেনে উপড়ে ফেলতাম তবে কেমন লাগত?’
লোকটি বলল, ‘আমার চুল টানলে ব্যথা তো পাবই। গাছের পাতা ছিঁড়লে গাছ কেন ব্যথা পাবে?’
মহানবী তখন লোকটির কাছে জানতে চাইলেন, ‘গাছ যে বুড়ো হয়ে মারা যায় তা কি তুমি দেখেছ?’
লোকটি মাথা নাড়ল। সে দেখেছে। তাহলে গাছের পাতা ছিঁড়লে গাছও দুঃখ পায়। গাছেরও জীবন আছে। লোকটি মাথা নামিয়ে রাখল। সে মেনে নিল মহানবীর কথা। পরে মহানবী বললেন, ‘অকারণে গাছের পাতা ছেঁড়া ঠিক নয়। যদি তোমার প্রয়োজন হয় তবে পুরো গাছটাই তুমি কেটে ফেল। তাতে কোনো ক্ষতি নেই।’ আমাদেরও শিক্ষা নেয়া উচিত।

No comments:

Post a Comment