ভালবাসি প্রকৃতি

ভালবাসি প্রকৃতি

Tuesday, January 8, 2019

অতি উৎসাহে কাটতে কাটতে তাল উঠে গিয়েছিলো

কাটতে কাটতে অনেক সময় তাল উঠে যায়। কিভাবে তাল উঠে যায় সেই গল্প শেষে বলছি। আগে কিছু পন্ডিত সুলভ কথা বলি। প্রসঙ্গ আর কিছুই নয়, এবারের নির্বাচন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটাভুটির বিষয় সবারই জানা আছে। নির্বাচনে আওয়ামীলীগ অভাবনীয় আসনের মালিক হয়েছে। আসন পেয়েছে জোটের অন্য শরীকরাও প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি। যাদের কিছুটা পাওয়ার কথা ছিলো তারা অভাবনীয় কম পেয়েছে। এর পেছনে কারন বিশ্লেষণ করলে এত কালিও পাওয়া যাবে না, পাওয়া যাবে না কাগজও। কিন্তু নির্বাচনে আওয়ামীলীগের জয় পাওয়াটা অপ্রত্যাশিত ছিলো বলে আমার মনে হয় না, যদিও অনেকেই মানবে না কথাটা। আর তারাই মানবে না যারা ষোল কোটি মানুষকেই তাদের দলেল ভাবে, এমনকি আওয়ামীলীগের সভানেত্রীকেও! আওয়ামীলীগের জয় পাওয়াটা কতটা যৌক্তিক তা ইভিএমের ভোট দেখলেই বুঝা যায়। নির্বাচন যতটুকু প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে তা কেবলই অতি উৎসাহী কর্মীদের কারনে। অতি উৎসাহী কর্মীদের তাল উঠে গিয়েছিলো বলেই আমার কাছে মনে হয়।
দীর্ঘ দশ বছর ক্ষমতায় থাকার কারনে দেশে যে উন্নয়ন হয়েছে তা অস্বীকার করা যাবে না। আমরা সাধারণ মানুষ যারা অর্থনীতি বুঝি না, জিডিপি বুঝি না, সূচক বুঝি না, তারা এটা নিশ্চই বুঝি যে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে, জীবন মানের উন্নয়ন ঘটেছে, রাস্তা ঘাট-ব্রিজ-কালভার্ট হয়েছে, স্বাস্থ্য-শিক্ষা খাতে ব্যপক পরিবর্তন হয়েছে। এক সময় বিশ টাকা রোজে কামলা পাওয়া যেতো, এখন পাঁচশত টাকায় অগ্রিম বুকিং দিয়েও কামলা মিলে না। একসময় খুদের-কুড়ার বিনিময়ে ধান ভানার লোক পাওয়া যেতো, ভাতের ফ্যানের বিনিময়ে কাজের বুয়া মিলতো, এখন মিলে না। একটা বাই সাইকেলের জন্য বাবার কাছে ধরনা ধরতো এখন অনায়াশেই একটা মটর বাইক পায়। এতেই বুঝা যায় মানুষের হাতে এখন টাকা আছে। আর এই সার্বিক উন্নয়নের কারনেই মানুষের আওয়ামী জোটের প্রতি সমর্থন ছিলো বলেই মনে হয়, যে সুবিধাটা পেয়েছে জোট। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী জোট যথারিতি ছিলো ভোটের মাঠে। দিনে রাতে মাঠ চষে বেড়িয়েছে প্রার্থীরা, সেই চষার কারনেই উর্বর মাঠে ভালো ফসল এসেছে। পক্ষান্তরে বিরোধী গ্রুপটা ছিলো অটো পরিবর্তনের প্রত্যাশায় ও আন্দোলনের দিকে। তারা ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাওয়া, প্রচার প্রচারনা করা, সভা-সমাবেশ করা, পোষ্টার টাঙ্গানোসহ নির্বাচনী প্রচার প্রচারনায় ছিলো সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। হামলা মামলাসহ নানান ছল ছুতায় মাঠে নামেনি। একটা ঐশ্বরিক পরিবর্তনের আশায় চাতক পাখির মত চেয়ে ছিলো। ধারনা ছিলো একটানা ক্ষমতায় থেকে বিভিন্ন বিষয়ে যে বদনাম কামিয়েছে সেই কারনে পরিবর্তন হয়ে যাবে। তাদের মনোভাব কি ছিলো তা উঠে এসেছে বিরোধী নেতাদের ফোনালাপের মধ্য দিয়েও। মাঠ না চষে ফসলের আশা করা বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। আন্দোলন, সংগ্রাম, পরিশ্রম ছাড়া কোন দিন কোন কিছুই পায়নি জাতি। যেমনটি পায়নি এবারের নির্বাচনেও। ভোট গ্রহণের অনিয়মের অভিযোগ তুলে পরাজয়ের যে কথা বলে তা ইভিএমে ভোট প্রদানের হার ও রেজাল্ট দেখলেই বুঝাযায়।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট নেয়া হয়। দেশের ৩০০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ৬ টিতে ইভিএম ব্যবহার করে ভোটগ্রহণ করা হয়। ইভিএম আসনগুলোতে গড় ভোট পড়েছে ৪৫ দশমিক ৮২ শতাংশ। এসব আসনে মোট ২১ লাখ ২৪ হাজার ৫৫৪টি ভোটের মধ্যে মোট ভোট পড়েছে ৯ লাখ ৭৩ হাজার ৪৫৫টি। ইভিএম আসনের ফলাফলে দেখা যায়ঃ রংপুর-৩ আসনে মহাজোটের হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১ লাখ ৪২ হাজার ৯২৬ ভোট, নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক পেয়েছে ৫৩ হাজার ৮৯। মোট ভোটের ৫২ দশমিক ৩১ শতাংশ ভোট পড়েছে এ আসনে। ঢাকা-৬ আসনে জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ ৯৩ হাজার ৫৫২টি ভোট, নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী ধানের শীষ প্রতীকের সুব্রত চৌধুরী ২৩ হাজার ৬৯০ ভোট। মোট ভোটের ৪৫ দশমিক ২৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। চট্টগ্রাম-৯ আসনে আওয়ামী লীগের মহিবুল হাসান চৌধুরী ২ লাখ ২৩ হাজার ৬১৪টি ভোট, নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী হলেন ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী শাহাদাত হোসেন ১৭ হাজার ৬৪২টি ভোট পান। মোট ভোটের ৩২ দশমিক ৪৩ শতাংশ ভোট পড়ে। সাতক্ষীরা-৩ আসনে আওয়ামীলীগের মীর মোস্তাক আহমেদ রবি ১ লাখ ৫৫ হাজার ৬১১ ভোট, নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী মোহাম্মদ আবদুল খালেক ২৭ হাজার ৭১১ ভোট পান। মোট ভোটের ৫২ দশমিক ৮২ শতাংশ ভোট পড়ে। খুলনা-২ আওয়ামী লীগের শেখ সালাহ উদ্দিন ১ লাখ ১২ হাজার ১০০ ভোট, নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু ২৭ হাজার ৩৭৯টি ভোট। মোট ভোটের ৪৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ ভোট পড়ে। ঢাকা-১৩ আওয়ামী লীগের মোঃ সাদেক খান ১ লাখ ৩ হাজার ১৬৩ ভোট, নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী আবদুস সালাম পেয়েছেন ৪৭ হাজার ২৩২ ভোট। মোট ভোটের ৪৩ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ ভোট পড়ে আসনটিতে।
ব্যালট পেপারের ভোট নিয়ে নানা প্রশ্ন করছেন বিরোধী গ্রুপ। কতটুকু সত্যি আর কতটুকু মিথ্যা সেটা আমার চেয়ে সবাই ভালো জানেন। কিন্তু ইভিএমের পরিসংখ্যান দেখলেই বুঝাযায় এখানে ব্যালট নিয়ে ভোট বিপ্লব করা যায়নি। যদি করা যেত তবে ব্যালটের কেন্দ্রের মতই ফলাফল হতো, ভোট পড়তো নিশ্চই ৮০-৯০ ভাগ। ইভিএম দিয়ে করা আসনগুলোতেও বিরোধী জোটের ভোটের হার বলে দেয় তাদের জনপ্রিয়তার কথা, তাদের হাত গুটিয়ে থাকার কথা, নিক্রিয়তার কথা। আর অন্য কেন্দ্রগুলোর ভোটের ব্যাপারে বিরোধী গ্রুপ বলেন, জোর করে নিয়েছে, এজেন্ট বের করে দিয়েছে, পুলিশ জোটের, জওয়ান জোটের, অফিসাররা জোটের তাই বিরোধীদের জোর করে হারিয়েছে। একটা গল্প মনে পড়লো, এক গৃহস্থ মাঠে ধান নিড়ানোর জন্য কামলা নিয়েছিলো যাদের মধ্যে একজন ছিলো অন্ধ। দুপুরে যখন তদারকি করতে মাঠে গেছে তখন গিয়ে দেখে কোন ঘোপের নিড়ানিই ভালো হয়নি। গৃহস্থ রেগে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এই ঘোপ কে করছে? সবাই উত্তর দিলো কানায়, ঐ ঘোপ কে করছে, যথারিতি সবাই বললো কানায়। তখন গৃহস্থ বললো সবই যদি কানায় করে তবে তোমরা কি ছিড়ছো? এজেন্ট আওয়ামী জোটের, পুলিশ আওয়ামী জোটের, জওয়ান আওয়ামী জোটের, কর্মকর্তারা আওয়ামী জোটের, সবাই যদি আওয়ামী জোটের হয় তবেতো ভোটারও আওয়ামী জোটের, বিরোধী জোটের কি করার আছে! কি নিয়েই বা তারা ভোটের মাঠে আছে? অটো পরিবর্তনের আশায়? সে আশার গুরে মোটা দানার বালি ছাড়া আর কিছুই যে নেই তা নির্বাচনের ফলেই দেখা গেছে।
এবার তাল ওঠার গল্পে আসি। আমার ব্যাংকার বন্ধু মোঃ কামরুজ্জামান মিন্টু গল্পটা বলেছিলো। গ্রামের মানুষ গোসলে যাওয়ার আগে ছেন-কাচি-কাটাল নিয়ে বের হন। তার চাচাও গোসলের আগে একটা কাচি নিয়ে বের হয়েছে। পুকুড় পাড়ে বিভিন্ন গাছের ডাল পালা ছাটতে গিয়ে সে ডগার পাতা পর্যন্ত কেটে ফেলছে দেখে অপর চাচা বললো, ও করে কি? কাটতে কাটতে তো গাছই মেরে ফেলবে। তখন তার আরেক চাচা বলেন, কাটতে কাটতে ওর তাল উঠে গেছে! অতি উৎসাহীদের যখন তাল উঠে যায় তখন ডগা পর্যন্তও কেটে ফেলে। এমন ভাবে কাটে যে কোন কোন সময় গাছ দুর্বল হয়ে যায়, কখনো কখনো গাছ মড়েও যায়। গল্পটা যার যার মত ভেবে নিবেন। ধন্যবাদ।

No comments:

Post a Comment