ভালবাসি প্রকৃতি

ভালবাসি প্রকৃতি

Sunday, June 7, 2009

গল্প : পথের পদ্য

পথের পদ্য - ০১
জোকের তেল তাবিজ হালুয়া আর কত কাল?

০১
নিয়াজ সাহেব ফুটপাত দিয়ে হাটতে হাটতে হঠা থেমে গেলেন
তার চোখ আটকে গেলো একটি লাল প্লাস্টিকের বড় বলের দিকেবল ভর্তি তরতাজা জোক কিলবিল করছেকৌতুহল নিয়ে দাড়িয়ে গেলদেখলো বল একটি নয় পাঁচটি প্রতিটি বলে হাজার হাজার জোককিলবিল করছেকোনোটা বল বেয়ে বেয়ে উঠে যেতে চাইছে বাইরেযেই উঠতে চাইছে অমনি এক ব্যক্তি লাঠি দিয়ে বলের কাধে বাড়ি দিচ্ছেআর উঠতে থাকা জোকগুলো ঝর ঝর করে পড়ে গেল বলে রাখা পানিতেছোট খাট একটি জটলাএকজন লোক একটি প্লাস্টিকের মোড়াতে বসাহাতে একটি লাঠিবসে লেকচার দিচ্ছেতাদেরকে সবাই লেকচারার বলেই ডাকে

না, এই ব্যাক্তি পিএসসির মাধ্যমে বিসিএস দিয়ে লেকচারার হননিইনি রাস্তার লেকচারাররাস্তায় লেকচার দিতে দিতে লেকচারার হয়েছেনকথায় আছে না? বকতে বকতে হয় বক্তা, আর পিটাতে পিটাতে হয় তক্তা! উনি বকতে বকতে বক্তা অর্থা লেকচারার হয়েছেন

তো লেকচারার সাহেব বসে আছেন লাঠি হাতেবলগুলি ভর্তি জোক চতুর্দিকে সারি সারি বয়ামবয়াম ভর্তি বড় সাইজের জোকএক একটি জোকের সাইজ হবে আট থেকে দশ ইঞ্চিদেখলে মনে হবে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে জোকগুলো

নিয়াজ সাহেব দাড়িয়ে পড়লো জোকগুলো দেখে জোক দেখে তার গা ঘিন ঘিন করতে লাগলোতবুও দেখার ও শোনার ইচ্ছা সংবরণ করতে পারলো নালেকচারার সাহেব তার লেকচার শুরু করলো-

:
ভাই সাবজীবনে অনেক চিকিসা করেছেনকোন ওষুধে কাম হয় নাইআমার কাছে আজ শুনে যান কিভাবে সফল হবেনওষুধ কিনতে হবে নাশুনলে কিনতে হয় না, দেখলে ও কিনতে হবে নাকেনা না কেনা আপনার ব্যাপার! নিয়মটা শুনে যান কিভাবে বানাইবেন আর কিভাবে ব্যবহার করবেনএই জোকের তেল ব্যবহার করলে ---শক্ত মজবুত হবে ব্যাথা বেদনা দুর হবে
এভাবে প্রায় অর্ধশত রোগের নাম বললো যা কিন্তু অনেক এমবিবিএস ডাক্তাররাও ভাল করার কথা বলতে পারে নাসেই সব রোগের জন্য লেকচারার সাহেব শতভাগ গ্যারান্টিসহ চিকিসার নিশ্চয়তা দিলেন
একটু দম নিয়ে লেকচারার সাহেব আবার শুরু করলেন-

:
আমার ওষুধ আপনাদেরকে কিনতে হবে নানিয়মটা শুনে যানআর ওষুধ বানানের পদ্ধতিটা জেনে যাননিজে বানাইয়া ব্যবহার করবেনভাল না হলে মুখের উপরে ছুড়ে মারবেনএই দেহেন, এরকম দুইটি মোটা জীবন্ত জোক নিবেনজোক দুটির মুখে লবন দিয়ে মেরে একটি ঝুনা নারিকেল (পাকা নারিকেল) নিবেন নারিকেলের মুখ ছিদ্র করে পানি ফেলে দিবেনচাইলে পানিটা খেতেও পারেনপানি ফেলার পর এই জোক দু'টাকে ভিতরে ভরবেনএর সাথে ভরবেন পারদ, ---- সহ ---এর পর নারিকেলের মুখটা বন্ধ করে আমাবষ্যা-পূর্ণিমার মাঝামাঝি রাতে কালিঘাটে গিয়ে এক নিশ্বাসে মাটির নিচে পুতে রাখবেনরাতটা যেন শনিবার হয়এর পর তিন মাস পরে আবার শনিবার রাতে তুলে আনবেনহাতল ছাড়া দা দিয়ে এক কোপে কেটে নারিকেল দুই ভাগ করে ফেলবেনকাটার পরে দেখবেন ভিতরে কাদার মত হয়ে গেছেসেই কাদার মত বস্তু এক নিশ্বাসে তুলে একটি মাটির পাতিলে এক পোয়া সরিষার তেল, এক পোয়া তিলের তেল, ----- দিয়ে মাটির পাতিলে মাটির চুলায় তেতুলের লাকরি (চলা কাঠ) দিয়ে ভাল করে জাল দিতে হইবোএর পর যেই তেল হবে সেই তেল ছেকে মালিশ করবেনঘা, প্যাচরা, দাউদ, একজিমায় লাগাইবেনরাতে খাউজাইয়া রাতেই লাগাইবেন সকালে কইতে পারবেন না কোন খানে খাউজাইছেন আর কোন খানে লাগাইছেনএত ভাল কাজ করবোইনশআল্লাহভাল নিয়ত করে লাগাইবেনদেখবেন সকল রোগ ভাল হয়ে গেছেতবে ভাই একটা কথা আমার ওষুধ মনের ব্যাথা হলে লাগাইবেন নাএ ওষুধ মনের ব্যাথা সারে না কিন্ত আমি জানি আপনারা এত কিছু জোগার করতে পারবেন নাএকটা যদি ভুল হয় তবে ক্ষতি হয়ে যাবেতাই আমি আপনাদের কথা ভেবে তৈরী করে রেখেছিমূল্য এক দাম পঞ্চাশ টাকা কিন্তু প্রচার পাবলিসিটির জন্য আজ পঞ্চাশ টাকা নেব নাএকে দুই ভাগে ভাগ করে এক ভাগ ফেলে দিলামহাতে থাকে কত? জোরে বলুন

পাঁচ-ছয়জন লোক বলে উঠলো-

:
পচিশ টাকা

:
পচিশ টাকাকে পাঁচ ভাগ করে দুই ভাগ ফেলে দিলামথাকে কত
?
:
পনের টাকা

:
হ্যা! পনের টাকা দিয়ে এখন সর্ব প্রথম যে ভাই আমারে সরমান (সম্মান) করবেন আমি তাকে এমন একটা সরমান করবো যা আপনি ভাবতেও পারছেন না

প্রথম একজন হাত তুলতেই একে একে দশ-বার জন হাত তুলে দাড়িয়ে গেলবেশ ভালই বিক্রি হলোনিয়াজ সাহেব হতাশ হয়ে চলে গেল তার কাজে

০২
বিশিষ্ট আলেম মানুষচারমুষ্ঠি দাড়িকাঁচা-পাকা দাড়িতে মেহেদী দেয়ায় বেশ ভালই লাগছেনূরানী চেহারা দেখলেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করবেসামনে নানান রকম জিনিস নিয়ে বসে আছেনএকটা করে ধরেন আর একদমে বলে যান-
: এটা ধনেশ পাখির ঠোট, একটু দিয়ে দিলাম; এটা মহা সমুদ্রের কট মাছের কাটা, একটু কেটে দিলাম; এটা বনরুই এর ছাল, একটু কেটে দিলাম; এটা কুলুকুলু গাছের ছাল, একটু কেটে দিলাম; এটা ফাঁসির দড়ি, একটু কেটে দিলাম; এটা জারজ মানুষের হাড়, একটু কেটে দিলাম; ----------
এভাবে প্রয় পঞ্চাশ ধরনের জিনিস একটু কেটে দিলাম-একটু কেটে দিলাম বলে কেটে দিলোএরপর কিছু কাগজ পেচিয়ে একটা তাবিজ তৈরী করলোএকটা মাদুলিতে ভরে বলে-
: ভায়েরানিজের চোখে দেখলেন কতগুলি আইটেম একটু করে কেটে দিয়ে দিলামএর হাদিয়া যদি হাজার টাকাও ধরা হয় তবে এর মূল্য দেয়া হবে নাশুধুমাত্র আপনাদের কথা ভেবে এর হাদিয়া নেব দশ টাকা চার আনাএক দাম এক রেটকোন দামাদামি নেইএটা তেলে চুবাইয়া গায়ে মাখবেন, গায়ের রং ফর্সা হবেপানিতে চুবাইয়া পানি খাইবেন পেটের সকল ওষুক ভাল হইবোগলায় বাধবেন- ভাল গান গাইতে পারবেন, হাতে বাধবেন- হাতে শক্তি বাড়বোকিন্তু মাজায় বাধবেন নাযে যেই নিয়ত করে বাধবেন ভাল হয়ে যাবে ইনশআল্লাহএকশত ভাগ গ্যারান্টিভাল হয় নাই এমন প্রমান এখন পর্যন্ত কেউ দিতে পারে নাইদিতে পারলে মূল্য ফেরআর আমি জানি কেউ দিতে পারবেও না
এখানেও একজন প্রথম সরমানকরার জন্য দাড়িয়ে গেলোএর পর আর ক্রেতার অভাব হলো নাসরলমতি-কোমলমতি সাধারণ লোকের কান্ড দেখে হতাশ নিয়াজ সাহেব দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে চলে গেল
০৩
বিশাল একটি লাল ত্রিপল বিছিয়ে তার উপর চলচ্চিত্রের ফিল্ম রাখার বক্সে ভরা বিভিন্ন শুকনা দ্রব্যএক একটা দেখাচ্ছে, তার নাম ও গুনাগুন বলছেন হাকিম সাহেবনাএই হাকিম কোন হুকুম করার হাকিম নাইনি ইউনানী দাওয়াখানার চিকিসক বিশিষ্ট হারবাল গবেষক! হেকিম আবদুল কুদ্দুস মিয়াপাত্রে সাজানো দুই শতাধিক দ্রব্য দেখিয়ে পাশে রাখা দশ-বারটি হরলিকস এর বয়াম ভর্তি গুরা একটা চকচকে স্টিলের বলে রাখলোসেই সাথে কিছুটা মধু, ঘি, কিসমিস দিয়ে মাখালেনএর পর নাম না জানা অপরিচিত কিছু গুরা দিলেনদেয়ার সময় এক একটি দেখিয়ে বললেন-
: এটার নাম বাতাসের আগা, আর এটার নাম রৌদ্রের গুরাআর এখন দিচ্ছি কিছু পাহাড়ের ঘাম
এই সব মিশিয়ে তৈরী হলো এক অনন্য হালুয়াযা দেখতে অনেকটা চাটনির মতোহাকিম সাহেব ঘোষনা দিলেন এই হালুয়া খেলে নব্বই বছরের বুড়ার বয়স মনে হবে আটাশ কি উনিশআর বার বছরের কিশোর খেলে বিশ কি বাইশ বছরের যুবকের মত উন্মাদ হয়ে যাবেওষুখ থাকলেও খাবেন আর না থাকলেও খাবেনযতবড় কোষ্ঠকাঠিন্যই হোক না কেন এটা খেলে বাথরুমে যেয়ে কোনা দিতে হবে নাশুধু পিছনের কাপড়টা তুলে বসলেই হবেদেখবেন ওষুধের কেরামতিখেয়ে আপনি রাতে ঘুমাবেন কিন্তু আমার ওষুধ ঘুমাবে নাআমার ওষুধ সমানে কাজ করবে
চটকদার কথা শুনে রিক্সা চালক, শ্রমজীবি টাইপের লোকজন ত্রিশ টাকা, পঞ্চাশ টাকা মূল্যের বিভিন্ন ফাইল কিনে নিলোসর্ব রোগের মহাঔষধ মাত্র ত্রিশ টাকা-পঞ্চাশ টাকাএ সুযোগ হাত ছাড়া করাটাই যেন বোকামি!
নিয়াজ সাহেব বোকা বনে গেলেনহায়রে বোকার দল! এগুলো খেলে এমনিতেই পেট খারাপ হয়ে পেট নেমে যাবেকষাতো থাকবেই না নির্ঘা ডায়রিয়া হয়ে যাবে
প্রিয় পাঠকউপরের তিনটা ঘটনা কোন গাল গল্প নয়আমাদের দেশের পথের ধারের বাস্তব ঘটনাএভাবেই প্রশাসনের নাকের ডগায় আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ সকল রোগের ঔষধ হিসেবে ফুটপাতের লেকচারারদের পাতা ফাঁদ থেকে কিনে নিচ্ছে নানান তেল-মালিস করার জন্য, নিচ্ছে তাবিজ, খাচ্ছে হালুয়া আপদ-বালা-মুসিবত থেকে ভাল হবার জন্য
সবার মনে একটাই প্রশ্ন, কেনই বা তারা এসব কিনে নিচ্ছেব্যবহার করে অপ চিকিসার শিকার হচ্ছেআসলে অজ্ঞতা, অশিক্ষার সাথে সাথে সরকারের অবহেলা কি নাইআছেসরকার যদি যথাযথ স্বাস্থ্য সেবা দিতে পারতোচিকিসক নামের একশ্রেণীর কিছু কষাই এর হাতে যদি রোগিকে জবাই হতে না হতো তবে কেউ এই সর্টকাট চিকিসায় উসাহী হতো নাআমাদের যেমন শিক্ষার অভাব আছেআছে অবকাঠামোর অভাবতেমনি আছে চিকিসকদের মানসিকতার অভাবচিকিসকদের সুচিকিসা এখন সেবা নয় পন্য হয়ে গেছেচিকিসকরা যদি অজ্ঞ, সহজ, সরল রোগিদের হাসপাতালমুখি করে সঠিক চিকিসা নিতে উসাহী না করে তবে তারা হাসপাতাল বিমুখ থেকেই যাবেআর রাস্তায় দাড়িয়ে কিনবে জোকের তেল, তাবিজ আর হালুয়া
আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে আমাদের? আসুন সবাই মিলে সচেতন হইঅসুখ বিসুখ হলে চিকিসকের সরনাপন্ন হইসকল চিকিসকই খারাপ নাএখনো অনেক চিকিসক আছে যারা সমাজকে দিয়ে যাচ্ছেঅপ চিকিসা থেকে দুরে থাকি এবং সবাই মিলে অপ চিকিসা থেকে দুরে থাকি এবং সবাই মিলে অপচিকিসকদেরও মানসিক চিকিসা করাই


পথের পদ্য - ০২
ছেঁড়া দুই টাকার নোট .....
কেমন আছেন?জাবেদ সাহেব রিভলবিং চেয়ারে বসা। চোখ আধ বোজা, একটু একটু দোল খাচ্ছিল। প্রশ্নটা শুনে একটু নড়েচড়ে বসলেন। একগাল অরেঞ্জ ফ্লেভারের হাসি হেসে উত্তর দিলেন-: ভাই ছেঁড়া দুই টাকার নোটের মত।উত্তরটা শুনে একটু অবাকই হলাম। এটা আবার কেমন ভাল থাকা ! জিজ্ঞেস করলাম-: তার মানে ?: মানে? মানে বাসে বলেন, দোকানে বলেন, যেখানেই যাবেন ছেঁড়া ফাটা দুই টাকার নোটের অবস্থা খারাপ হলেও চলছে। আমার অবস্থা অনেকটা তাই। ভাল না হলেও জীবন চলে যাচ্ছে একরকম।কথাটা জাবেদ সাহেব মন্দ বলেননি। দুই টাকার নোটের যা অবস্থা ! ছেঁড়া, ময়লা, দেখলেই মনে হবে বাংলাদেশের এই দুই টাকার নোটের উপর দিয়ে সিডর বয়ে গেছে বার বার। ধ্বংসের ছাপটা তাই স্পষ্ট।দুই টাকার নোটের মূল্যমান যদিও দুই টাকা অর্থাৎ দুই শত পয়সা এটা সবারই জানা। যে বিষয়টা না জানেন সে হয় শিশু নয় পাগল। কিন্তু দুই টাকার একটি নোট জোড়া দিতে অনেক সময় দেখা গেছে পচাত্তর পয়সার আঠা, পচিশ পয়সার স্কচ টেপ, কখনবা কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে। দুই টাকার একটি নোটে দুই থেকে দুই দশে বিশটি জোড়া তালি পেলে অবাক হওয়ার কোন কারন নেই। বরং কোন দুই টাকার নোটে যদি জোড়া তালি না পাওয়া যায় তবে ভাবতে হয়;হায়! দেশের জালিয়াত চক্রের মাথা বুঝি গেছে! দুই টাকার মত মূল্যমানের নোটেরও কি শেষ পর্যন্ত জাল ছেপে নিলো? হ্যাঁ! নতুন দুই টাকার নোট দেখলে জাল কিনা সেটাই চিন্তা করে প্রথম!!তবে নোট যতই ছেঁড়া বা ফাটা হোকনা কেন তার কদর আছে। বাসের কণ্ট্রাক্টরকে যতই ছেঁড়া-ফাটা নোট দেন কোন সমস্যা হবে না। মামা ডেকে প্লাস্টিকের হাসি হেসে সাদরে গ্রহন করবে টাকাটা। আবার যখন ভাংতি দেবে তখন ঐ দুই টাকার ছেঁড়া-ময়লা নোটই আপনাকে ধরিয়ে দেবে। যদি নিতে না চান তবে হাসি মাখা মুখে বলবে-: মামা নেন। না চললে আমারে ফেরৎ দিয়েন।: তোমাকে পাব কোথায়?: গাড়ির নাম্বারটা লেইখা লন! কোন সমস্যা হইবো না।: তোমার তো সমস্যা নাই, সমস্যা তো আমার।: মামা আমারতো সমস্যা নাই, আপনারও সমস্যা হইবো না।তবে সত্যিই কোন সমস্যা নাই। যাকে দেই তাকেই বলি সমস্যা নাই। যে দেয় সেই বলে সমস্যা নাই। সত্যিই এক সময় ছেঁড়া দুই টাকার নোট এতটা ‘চল’ হয়ে গেল যে কয়েন পকেট থেকে পড়ে যাবে ভেবে মানুষ ছেঁড়া দুই টাকার নোট চেয়ে নেয়া শুরু করে।ছেঁড়া টাকার কথা বলতে বলতে ছেঁড়া টাকা নিয়ে তৈরী করা একটা বিজ্ঞাপন চিত্রের কথা মনে পড়লো।এক ভদ্র মহিলা বাজারে গিয়ে দোকানির কাছ থেকে কিছু তরি-তরকারি, শাক-সবজি কিনলেন। যার মূল্য হলো-ধরুন আটানব্বই টাকা। দোকানিকে ভদ্র মহিলা একশত টাকার একটি তরতাজা কচকচে নতুন নোট দিলেন। দোকানি ভদ্র মহিলাকে দিল ছেঁড়া দুই টাকার একটা নোট। তা আবার যেন তেন নোট নয় সিডরে বিধ্বস্ত দুই টাকার নোট! নোট দেখে ভদ্র মহিলাতো ক্ষেপে গেলেন। রাগে ক্ষোভে গজরাতে গজরাতে বললেন-: আরে! আপনাকে এত সুন্দর একটা নতুন নোট দিলাম। অথচ আপনি আমাকে এমন একটা ছেঁড়া ফাটা নোট দিলেন? বদলে ভাল একটা নোট দেন। এটা চলবে না।দোকানি বললো-: কন কি আফা! চলবো। দুই টাহার নোট আবার অচল আছে নাকি? লাম্বারটা আছে কিনা হেইডা খালি দেখবেন।: না না এটা চলবে না। আমায় টাকা বদলে দিন।দোকানি আর ভদ্রমহিলা চেচামেচি শুরু করে দিলো। ‘চলবে আর চলবে না’ এ কথা নিয়ে শুরু হয়েছে দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি। দুজনে ঝগড়া চলছে ফাটাফাটি। এমন সময় এক অতি বুদ্ধিমান মহিলা এসে বললেন-: দেখি টাকাটা চলবে কিনা?দোকানি একটু হালে পানি পেল। ভদ্র মহিলাকে টাকাটা দেখিয়ে বললো-: দেহেন তো মেডাম! টাহাডা বোলে চলতো না?: হুম!! দেখছি, চলে কি না?এই বলে ভদ্র মহিলা টাকাটা তার হাতে নিয়ে সবজির ঝুড়িতে ফেলে হাত ইশারা করে বলেন-: আসো সোনা, আসো, এদিকে আসো।ঝুড়িতে পড়ে থাকা টাকা আগের মতই পড়ে রইলো। কোন নড়াচড়া করলো না। এবার একটু ধমকের সুরে-: আয়, আয় বলছি। এদিকে আয়।এতেও যখন টাকা নড়লো না তখন জোড়ে ধমক দিয়ে বললো-: আয়, আয় বলছি। নইলে দেব মার।যথারিতি রেজাল্ট আগের মতই। অসুস্থ, ক্লান্ত দেহে নিথর হয়ে পড়ে রইল দুই টাকার নোটটি। এত ডাকাডাকির পরও যখন টাকাটা ভদ্র মহিলার কথা মত আসলো না। একটু নড়লোও না। যেখানে রয়েছে সেখানেই পড়ে রইলো। তখন ভদ্র মহিলা দোকানিকে বললো-: নাহ! দেখুন ভাই, কত বললাম। টাকাটা চললো না। মনে হয় চলবে না!ক্রেতা ভদ্র মহিলা ফিক করে হেসে দিলো কান্ড দেখে।দোকানি নোটটা রেখে দুটি কয়েন ধরিয়ে দিলো। দোকানিকে বোকা বানিয়ে গেল। এটা দোকানি বুঝতে পারলেও কিছু যে বলার নেই তাও বুঝতে পারলো।বোকা বনে কয়েন দিলেও দুই টাকার নোট ছেঁড়া হোক, ফাটা হোক এর কদর যে আছে এটা কেউ অস্বীকার করবে না।দেশের অবস্থা কি? রাজনীতির অবস্থা কি? অর্থনীতির অবস্থা কি? সামাজিক অবস্থা কি? খেলাধুলার অবস্থা কি? শিক্ষা-সংস্কৃতির অবস্থা কি? বাজারের অবস্থা কি? আয়ের অবস্থা কি? ব্যায়ের অবস্থা কি? সাধারণ মানুষের অবস্থা কি? এভাবে প্রশ্ন করলে প্রশ্নের অভাব হবে না।এসব প্রশ্নের উত্তরে যদি বলা হয় যে, দুই টাকার নোটের মত, তবে কি ভুল হবে। সব কিছুরই অবস্থা ছেঁড়া, ফাটা, জোড়া তালি দেয়া, ক্ষয়িষ্ণু তবুও চলছে, চলে এবং চলবে।আসলে ছেঁড়া দুই টাকার নোট কেন চলে? সাধারণ হিসাব এটা। যখন ভাংতি দেয়ার জন্য নতুন নোটের চাহিদা মোতাবেক যোগান থাকে না, তখনইতো চলে! দেশে যখন সুস্থ রাজনীতির অভাব, সুস্থ সংস্কৃতির অভাব, সুশাসনের অভাব, হাল ধরার যোগ্য লোকের অভাব দেখা দেয় তখন ছেঁড়া দুই টাকার মত চাহিদার যোগান হিসেবে চলে আসে অযোগ্য অপশক্তি। তাই দেশে দরকার সুস্থ রাজনীতির ধারা, গণতন্ত্রের ধারা, পরিকল্পিত অর্থনীতির ধারা। নইলে ছেঁড়া ফাটা নোট যেমন ঘুরে ফেরে হাতে হাতে আর শাসনের ভারও চলে যাবে ছেঁড়া ফাটা লোকের হাতে। যার পরিনাম ভাল হবে না।



পথের পদ্য - ০৩

নগরীর উৎপাত : লিফলেট বিলি
॥ ০১ ॥
রফিক সাহেব ব্যস্ত ব্যবসায়ী। মতিঝিল ব্যাংক পাড়া থেকে কাজ সেরে দ্রুত বেড়িয়েছেন মিরপুর যাবেন বলে। মিরপুরগামী বাসের টিকেট কেটে বসেছেন জানালার ধারে। ভয়ংকর সীসা ও কার্বনডাই অক্সাইড মেশানো ফুরফুরে বাতা আসছে জানালা দিয়ে। বসে বসে ভাবছেন ব্যবসার কথা। হঠাৎ একটি ভিজিটিং কার্ড সাইজের শক্ত কাগজের টুকরো ক্ষেপনাস্ত্রর গতিতে এসে আঘাত করলো রফিক সাহেবের কপালে। আৎকে উঠলেন! দ্রুত জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলেন, নেকাবে মুখ ঢাকা বোরকা পড়া এক মহিলা। হাতে অনেকগুলো ভিজিটিং কার্ড নিয়ে জানালা দিয়ে ক্ষেপনাস্ত্র বা রকেট লাঞ্চার এর গতিতে ছুড়ে ছুড়ে মারছে যাত্রীদের দিকে। অনেকেই রফিক সাহেবের মত আৎকে উঠে তাকাচ্ছে জানালার দিকে।
জানালা ছেড়ে অতঃপর ছুড়ে মারা কার্ডটির দিকে তাকালেন রফিক সাহেব। দেখেন একটি রুহানী দরবার শরীফ ও দাওয়াখানা’র বিজনেস কার্ড। কার্ডটিতে বড় বড় হরফে লেখা আছে ‘চিশতিয়া রুহানীয়া হুজুরীয়ার ওপেন চ্যালেঞ্জ। সাপ্তাহের সব দিন খোলা। চিঠির মাধ্যমেও দাওয়াই দেয়া হয়। দেশে থাকুন আর বিদেশে থাকুন আমাদের ওপেন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করুন। বিফলে মূল্য ফেরত পাবেন। সফল হলে আস পাশের আরো দু’একজন রুগি পাঠাবেন ইনশাল্লা। আমরা অত্যন্ত যতেœর সাথে চিকিৎসা দিয়ে থাকি। যে যে রোগের চিকিৎসা দেয়া হয়-প্রেমে ব্যর্থতা, ব্যবসায় উন্নতি হয়না, পার্টনারের সাথে মনমালিন্য, স্ত্রীর সাথে অমিল, স্ত্রী অন্যের পরকীয়ায় হাবুডুবু খাচ্ছে, স্বামীকে বস করতে চান (গাধা বানতে চান), বিদেশ যাত্রায় বাধা, পাওনা টাকা নিয়ে টালবাহানা, রাজনীতিতে ব্যর্থতা, পুরাতন হাপানি, গ্যাষ্ট্রিক, আলসার, পড়াশুনায় অমনোযোগ। যেকোন সমস্যার জন্য চলে আসুন’।
কার্ডটি পড়ে রফিক সাহেব নিজের অজান্তেই হেসে ফেললেন। লোকে বলে সব সম্ভবের দেশ আমার সোনার বাংলাদেশ! তাইতো মনে হচ্ছে এদের কথায়! কি না পারো এরা? আমাদের এতো সমস্যা!! আমাদের দেশের নেতা নেত্রীরা হিমসীম খাচ্ছে। কর্মকর্তা কর্মচারীরা দিন রাত খেটে যাচ্ছে। সমাজ কর্মীরা বিভিন্ন ফরমুলায় সমাজকে বদলাতে চাইছেন। চিকিৎসকরা চেষ্টা করে যাচ্ছে রোগ শোক সারানোর জন্য। অথচ এদের যদি আমরা নিয়োগ করে আমাদের সমস্যা গুলি তাদের হাতে ধরিয়ে দেই তবে কত সহজেই তারা সমাধান করে দিতে পারত!! এতে সময়ও বাঁচবে আবার অর্থও বাঁচবে। আমাদের বিশেষজ্ঞরা, আমাদের বিশাল জনশক্তি অন্যকাজে সময় দিতে পারবে!!
রফিক সাহেব কথাগুলো ভাবে আর মনে মনে হাসে। আহ্ কি বিচিত্র এই দেশ!!
॥ ০২ ॥
মহসিন সাহেব মেয়েকে নিয়ে মতিঝিল এসেছিলেন। থাকেন নারায়নগঞ্জে। মেয়ে একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দেবেন। ইন্টারভিউ শেষে নারায়নগঞ্জের বাসে রওয়ানা দিয়েছেন বাসায় যাবেন বলে। বাসে বসে মেয়ের কাছ থেকে ইন্টারভিউ সম্পর্কে খোজ খবর নিচ্ছেন।
বাস যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা মোড়ে ট্রাফিক সিগনালে থামার সাথে সাথে বাসের জানালা দিয়ে মেয়ের কোলে এসে পড়ল একটি রঙ্গীন ফোল্ডিং লিফলেট। তাকাতেই দেখাগেল লিফলেটের উপরে একটি রঙ্গীন ছবি যাতে এক যুবক এক যুবতীকে আলীঙ্গন করে আছে। তাকিয়ে বাবা ও মেয়ে দুজনই বিব্রত। লিফলেটটি একটি ইউনানী দাওয়াখানার।
এই লিফলেটেও একই ধরনের লেখা। যেখানে লেখা আছে- যৌন চিকিৎসা সহ সকল রোগের চিকিৎসা ১০০% নিশ্চয়তার সাথে করা হয়। হেপাটাইটিস এ-বি-সি-ডি তেকে জেড পর্যন্ত, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, এইচ আইভি-এইডস সহ সকল রোগ। তারা ছবি দেখেও রোগ নির্ণয় করে ঔষধ দিতে পারে। আবার বিদেশ থেকে নির্ধারিত ফি পাঠিয়ে দিলে তারা পোষ্ট যোগে ঔষধ পাঠিয়ে দেয়। ভাল হওয়ার বিষয়ে কোন চিন্তা করার প্রয়োজন নেই!! ১০০% নিশ্চয়তাতো আছেই।
রফিক সাহেব বা মহসিন সাহেবের মত বিব্রতকর অযাচিত বিড়ম্বনায় আমরা সকলেই পরি। এটা বর্তমানে একটি নগরের উৎপাতে পরিণত হয়েছে। নগরির যাত্রাবাড়ী, সায়দাবাদ, মতিঝিল, গুলিস্থান, শাহবাগ, প্রেসক্লাব, ফার্মগেট, মহাখালীসহ অটো ট্রাফিক সিগনালের অথবা যে কোন বাস স্টপেজের কথাই বলুন না কেন এ উৎপাদ আপনাকে সহ্য করতেই হবে।
খোজ নিলে দেখতে পাবেন এক শ্রেণীর ইউনানী দাওয়াখানা ও ঝারফুকদাতা ভন্ড হুজুরগন এসব বিজ্ঞাপন প্রচার করে সহজ সরল মানুষকে আকৃষ্ট করে। এসব দাওয়াখানা ও দরবার শরীফগুলোতে সাধারণত যৌন রোগকেই প্রাধান্য দেয়া হয় বেশী। এছাড়া সংসারে অমিল, প্রেমে ব্যর্থতা, বিদেশ যাত্রায় বাধা, শত্রুকে বধ করা, ক্যান্সার, গ্যাসট্রিক, আলসার, হেপাটাইটিস বি সহ সকল রোগের ব্যাপারে ১০০% নিশ্চয়তার সাথে কাজ করার প্রলোভন দেখায়।
এই প্রচার কার্ড বা লিফলেটগুলো বিলি করার কাজে এক শ্রেণীর হত দরিদ্র মহিলা ও যুবকদের ব্যবহার করা হয়। সামান্য পারিশ্রমিক দিয়ে এদের কাজ করানো হয়। এই কাজে নিয়োজিত যুবক ও মহিলারা অনেক সময় পকেট মারার কাজেও ব্যস্ত থাকে।
আপনি বাসে উঠছেন, সুযোগ বুঝে দক্ষ হাতে পকেট থেকে কখন যে মানিব্যাগটা নিয়ে নিয়েছে আপনি তা টেরও পাবেন না। আবার জানালার পাশে মোবাইলে কথা বলছেন। হঠাৎ মোবাইল টান মেরে উধাও!! আপনি শত চেচামেচি করেও আর মোবাইল ফিরে পাবেন না। শশুর বাড়ি থেকে নতুন ঘড়ি উপহার পেয়েছে! হাতে দিয়ে ঢাকায় এসেছেন। বাসে উঠে আনমনে বসে আছেন জানালার কাছে হাত দিয়ে। দেখবেন কেউ খুলে বিয়ে গেছে। ধরার কোন সুযোগই পাবেন না। শুধু হাত থেকে মোবাইল বা ঘটিড়ই নয়, কান থেকে দুল কানসহ ছিড়ে নিয়ে দৌর মারে এসব দৌরবিদেরা!!!! আপাত দৃষ্টিতে দেখতে লিফলেট বিলিকারী মনে হলেও এরা সময়-সুযোগ মত হয়ে যায় ছিনতাই কারী, পকেটমার।
এ বিষয়ে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির উপরে গবেষণা করেন এমন কয়েক বন্ধুর সাথে আলাপ করলে তারা বলেন, এ সকল ভন্ড চিকিৎসক, ফকির, হুজুর, কবিরাজ আমাদের দেশের কোমলমতি মানুষের মনের স্পর্শকাতর বিষয়ে আঘাত করে তাদের উদ্দেশ্য সফল করে। অজ্ঞতার কারনে স্পর্শকাতর বিষয়ে কাউকে বলতে পারে না সাধারণ লোকজন। গোপন সমস্যা বা গোপন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বা চিকিৎসকদের সাথে অনেকেই কথা বলতে চায়না এবং লজ্জা বোধ করেন। অনেক শিক্ষিত লোকও তার সমস্যা নিয়ে সবসময় যথাযথ বিশেষজ্ঞর সাথে আলাপ করেন না, লজ্জাবোধের কারনে। ফলে ঐসব ভুয়া লোকের চটকদার কথায় সাধারণ মানুষ পটে যায়।
চিকিৎসকদের সাথে আলাপ করলে তারা বলেন, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষকে সহজেই আকৃষ্ট করার জন্য এসব চটকদার বিজ্ঞাপন বিলি করা হয়। অশিক্ষা ও অজ্ঞতার জন্য সাধারণ মানুষ এদের কাছে গিয়ে প্রতারিত হয় প্রতিনিয়ত। তারা যে ঔষধ দেয় তাতে কোন রোগ ভালতো হয়ই না বরং অনেক সময় বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। নিজেদের সমস্যার কথা তো বলতেই পারে না আবার প্রতারিত হওয়ার কথাও বলতে পারে না। এসকল প্রতারকদের হাত থেকে দুরে থাকাই ভাল। শিক্ষাই পারে এ সকল প্রতারণার থেকে আমাদের রক্ষা করতে। আর প্রশাসন একটু হস্তক্ষেপ করলেই আমরা বিব্রতকর এসব লিফলেট বিলিকারীদের হাত থেকে বাঁচতে পারি, সাধারণ মানুষও প্রতারণার হাত থেকে বাঁচতে পারে।

No comments:

Post a Comment