ভালবাসি প্রকৃতি

ভালবাসি প্রকৃতি

Saturday, January 13, 2018

আপা নিয়ে চাপাচাপি

কয়েকদিন যাবৎ আপা নিয়ে বেশ চাপাচাপি চলছে দেশে। এক সাংবাদিক ভাই এক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে আপা সম্বোধন করে কথা বলেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার তাতে আতে ঘা লেগেছে। সে উত্তেজিত হয়ে গেছে এবং বলেই ফেলেছে, আপা বললেন কেন, আপনি ইউএনওর সাথে কি বলে কথা বলতে হয় জানেন না, স্যার অথবা ম্যাডাম বলবেন।
সাংবাদিক সাহেব তাকে আপা বলে কি খুব অপরাধ করে ফেলেছেন? আপা বলাটা কি তাকে যথাযথ সম্মান দেখানো হয় নি? উপজেলা নির্বাহী অফিসার কে বা কি? একজন মানুষ তার শিক্ষা জীবন শেষ করে একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়ে প্রশাসনের ক্যাডার হয়েছেন। সহকারী কমিশনার উপাধী নিয়ে কর্ম জীবন শুরু করে আস্তে আস্তে এ দপ্তর, ও দপ্তর পার হয়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি) হয়েছেন। পরে তার কর্মের বিভিন্ন ধাপে সে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদে আসীন হয়েছেন। দীর্ঘ কর্ম জীবনে সে অনেক ঘাত প্রতিঘাত দেখেছেন। কাজের ক্ষেত্রে অনেক নিয়ম মেনেছেন, অনেক অনিয়মও করেছেন। বাস্তবে আসলে সে কি? সাধারণ মানুষের কাছে প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী ছাড়া আর কিছুই নয়। সে হয়তো একটু বড় মাপের কর্মচারী, পিয়ন হয়তো ছোট মাপের কর্মচারী। এর বাইরে তো কিছু না। দুজনেই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী আর জনগণ প্রজাতন্ত্রের মালিক। প্রজাতন্ত্রের মালিক তাকে আপা বলেইতো অনেক সম্মান করে ফেলেছে, স্যার তো তারই বলা উচিত ছিলো।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিজের মধ্যে একটা অহংকার বোধ লালন করছেন। তিনি বেতন পান প্রজাতন্ত্রের আম জনতার দেয়া করের টাকায় সেটা তার খেয়াল ছিলো না। তিনি আপা বলায় এতটা ক্ষেপে যাবেন সেটা ভাবা যায়? তিনি তো কারো না কারো সন্তান, কারো না কারো বোন। তাকে আপা বলায় এতটা অপমানিত হওয়ার কিছু ছিলো না। তবুও সে অপমানিত বোধ করলেন। জোর করে কি সম্মান পাওয়া যায়? আপা মনে হচ্ছে জোর করে সম্মান আদায় করতে চায়। কিন্তু সম্মান ভূমি কর বা কোন ফি নয় যে আদায় করবেন। সম্মান আসে হৃদয়ের গহীন থেকে, কাজের মূল্যায়ন থেকে। এমন কি করে ফেলেছেন যে আপনাকে সম্মান করতেই হবে।  
একজন উপজেলা নির্বাহীর কাজ কি? তার কাজ তো উপজেলার জনগনের কাছ থেকে স্যার-ম্যাডাম শোনা না। উপজেলার সাধারণ জনগনের প্রশাসনিক কার্যকলাপ সমাধান করা, অধস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রন করা, শৃঙ্খলা বজায় রাখা, সিটিজেন চার্টার অনুযায় জনগনকে সেবা দেয়া। আর কাজগুলো করবে জনগনের জন্য। সেই জনগন কেউ এসে যদি মা বলে, কেউ যদি বোন বলে, কেউ আপা বলে তাতে ক্ষতি কি? একজন লোক কতটা আপন জেনে তাকে আপা বলেছে সেই দিকটা বিবেচনায় কি নেয়া উচিত ছিলো না? কজন অফিসার সাধারণ মানুষের আপন হতে পারে! অনেক অফিসার আছেন যারা বদলি হলে মানুষ কাদে। যাওয়ার সময় মানুষের কান্নাটাই আসল প্রাপ্তি, ঘুষ-দূর্নীতির টাকাটা কোন প্রাপ্তি নয়।
একজন সাংবাদিক তাকে আপা বলেছে, এতে সে অপমানিত বোধ করেছেন। সাংবাদিকের অবস্থান কি সেটা হয়তো তার জানা নেই। অবশ্য এখন সমাজে অপসাংবাদিকতার ছড়াছড়ি চলছে। কোথাও গেলেই সেখানকার মানসিক ভাবে দুর্বল, অপরাধ প্রবন মানুষ, ঘুষখোর, সুবিধাবাদীদের কাছ থেকে তেলের টাকা চয়। হাত পেতে দেয়, চাটুকারী করে অনেক সাংবাদিক। ঘরে কন্যা আত্মহত্যা করেছে, পিতাকে নানা ভাবে ভয়ভীতি দেখায়, নিউজ করার কথা বলে টাকা হাতায় এমন সাংবাদিকও আছে যাদের আমরা হলুদ সাংবাদিক বলি। হলুদ সাংবাদিকদের প্রতি আমার ঘৃণা আছে। তবে নির্ভীক সাংবাদিকদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আমারই নয় সবারই আছে, থাকবে। আর সেই নির্ভীক সাংবাদ কর্মীরা আছে বলেই সমাজটা টিকে আছে। তারা সমাজকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রাণপণ কাজ করে যাচ্ছে।
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা স্বীকৃত চারটি স্তম্ভের ওপর দাড়িয়ে থাকে। আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম। এ জন্য রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে সংবাদ মাধ্যমকে বিবেচনা করা হয় গুরুত্বের সাথে।
গণমাধ্যম শক্তিশালী হলে রাষ্ট্রযন্ত্র সঠিকভাবে পরিচালিত হতে বাধ্য হয়। সংবাদ মাধ্যম জনগণের প্রত্যাশা, অর্জন, চাহিদা, জনমত সৃষ্টি ও সমাজের ভালোমন্দ তুলে ধরে। তাইতো সাংবাদ মাধ্যমকে সমাজের দর্পন হিসাবে বিবেচনা করা হয়। গণমাধ্যমকে উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের প্রতিনিধিও বলা চলে। মানবজীবন ও সমাজ উন্নয়নের একমাত্র মাধ্যম হলো গণমাধ্যম। গণমাধ্যম দ্বারা সমাজের বাস্তব প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেন সাংবাদিক।
আর তৃণমূল পর্যায়ে একজন সংবাদকর্মীর চোখ থাকে সমাজের ঘটে যাওয়া ছোট থেকে বড়, ভালোমন্দ, সমস্যা-সম্ভাবনা সবকিছুতে। একজন ভালো সাংবাদিক নিজের স্বার্থের কথা না ভেবে রাতদিন জীবনের সোনালী সময় ব্যয় করে গণমানুষের সমস্যা ও সম্ভাবনার খোঁজে কান পেতে থাকেন।
একজন নির্ভিক সংবাদকর্মী হলেন সমাজের নির্মাতা। সে গণমানুষের চাহিদা ও স্বপ্নকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেন তার লেখনির মাধ্যমে। সংবাদ কর্মীর লেখালিখি সরকারের নজরে আসে, অতঃপর সরকার সেই আশা, আকাঙ্খা বাস্তবায়ন করে। একটি অবহেলিত জনপদের খরব লেখনির মাধ্যমে সভ্যতার উচ্চতায় নিতে সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের ভূমিকার বিকল্প নেই। নিজের স্বার্থ না দেখে গণমানুষের জন্য নিঃস্বার্থে কাজ করাই একজন নির্ভিক সংবাদকর্মীর কাজ। গণমাধ্যম সমাজে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটিয়ে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করে। সুবিধাবঞ্চিত জনপদের নাগরিকদের অধুনিক উন্নত সমৃদ্ধ মানুষে পরিণত করে। একমাত্র গণমাধ্যম পারে মানুষকে নতুন নতুন চিন্তা, ধারণা ও পদ্ধতি সম্পর্কে প্রতিনিয়ত তথ্য সরবরাহ করে উন্নত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে ভূমিকা রাখে।
আজকের যুগে গণমাধ্যম শিক্ষা, যোগাযেগ, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, লাইফ স্টাইল, রেসিপি, চিকিৎসা, প্রযুক্তি, আইসিটি, চাষাবাদ, ক্রয়-বিক্রয় থেকে শুরু করে নাগরিক জীবনের প্রয়োজনীয় সব চাহিদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করছে। নানা সীমাবদ্ধতা আর সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি সত্ত্বেও গণমাধ্যম সমাজের উন্নয়ন নিশ্চিত করছে। সাধারণ মানুষ ও গণমাধ্যমের কার্যকর অংশগ্রহণ ছাড়া রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমরা সবাই জানি-যে দেশে গণমাধ্যম স্বাধীন-শক্তিশালী সে দেশে গণতন্ত্র উন্নত এবং শক্তিশালী।
এ ছাড়াও বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির স্বর্ণযুগে গণমাধ্যমের কল্যাণে এসিড সন্ত্রাস, ইভটিজিং, নারী ও শিশু নির্যাতন, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ, ভেজালের বিরুদ্ধে মানুষকে প্রতিনিয়ত সচেতন করে যাচ্ছে গণমাধ্যম। আর এর মাধ্যমে দেশ ও সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে সমাজ দেহে যে বোধের জায়গা তৈরি হচ্ছে এর পেছনে গণমাধ্যমের ভূমিকাই প্রধান। গণমাধ্যম সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করে থাকে। গণমাধ্যম ছাড়া কোনোভাবেই সরকার ও জনগণের মধ্যে জনগণ কি ভাবছে, সরকার কি করছে তা প্রকাশ পাওয়া সম্ভব না।
গণমাধ্যম সমাজের জন্য এত কিছু করে বলেই তাদের অবস্থানটা একটু ভিন্নধর্মী। সমাজ তাদের সমীহ করে ব্যক্তি হিসাবে নয় তাদের কাজের কারনে। রাজধানীতে যারা সংবাদ কর্মী হিসাবে কাজ করে, বিশেষ করে সম্পাদক থেকে প্রতিবেদক সবাইকে সকল সেক্টরের কর্তাব্যক্তিরা সমীহ করে তাদের কাজের কারনে। আমাদের দেশের প্রধাম মন্ত্রীকে মহিলা, বিরোধী দলীয় নেত্রী মহিলা। সংবাদকর্মীরা তাদের আপা সংম্বোধন করে কথা বললে তারা তো কিছু মনে করে না। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা যেখানে তাদের ম্যাডাম ম্যাডাম বলে মুখে ফেনা তোলেন সেখানে সংবাদ কর্মীরা আপা বলে কথা বলছে। তাদের যদি আতে ঘা না লাগে তাহলে একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এমন কি হয়ে গেছেন যে তাকে স্যার বা ম্যাডাম বলতে হবে।
একসময় আমাদের দেশ তথা গোটা ভারত বর্ষ বিট্রিশদের শাসন কয়েম ছিলো। তখন ব্রিটিশ কর্তাব্যক্তিদের সমিহ করে চলতে হতো। ইউর এক্সিল্যান্সি, ইউর এক্সিল্যান্সি বলে মুখে ফেনা তুলতে হতো। শাসনের নামে তারা আমাদের যে শোষন করেছে তা আজও জাতি ভুলে নাই, হাজার বছর পার হলেও কোন প্রজন্মই ভুলবে না। তাদের এ অঞ্চল থেকে বিতারিত করা হয়েছিলো, সম্মানের সাথে যায়নি। কথাটা নিশ্চই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যারা তাদের অজানা নয়। বর্তমানেও যদি কেউ মনে করে তিনি বড় কর্মকর্তা, তাকে ইউর এক্সিল্যান্সি, ইউর এক্সিল্যান্সি করতে হবে তাহলে ভুল করবে। বর্তমান কর্তাব্যক্তিদের তো আর বিতারিত করার প্রয়োজন হবে না, কিন্তু তারা তাদের অবস্থানে থাকতে পারবে না। তাদের জন্য বিপ্লবীদের প্রয়োজন নেই, জাগ্রত সংবাদ কর্মীরাই যথেষ্ট।
একটি গল্প বলি। একদা এক রাষ্ট্রপতি এক সম্পাদককে বলেছিলো রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের একটা স্তর তৈরী করতে। সম্পাদক মহোদয় রাষ্ট্রপতিকে প্রথম অবস্থানে রেখে বাকি পদের নাম অবস্থান অনুযায় লিখে রাষ্ট্রপতির হাতে দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি তালিকায় সম্পাদকের অবস্থান দেখতে না পেয়ে সম্পাদক মহোদয়কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার অবস্থান কোথায় লিখেননি কেন? প্রশ্নের জবাবে সম্পাদক মহোদয় বলেছিলেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি, আমার অবস্থান যদি লিখতে হয় তবে লিখতে হবে Above President ! তাই আমি আমার অবস্থানটা নিজ হাতে লিখিনি।
আমি সিনেমার ভক্ত। সুযোগ পেলেই সিনেমা দেখি। সিনেমার ম্যাডাম নিয়ে আরেকটা গল্প মনে পড়ে গেল। হঠাৎ বৃষ্টি চলচ্চিত্রটা হলে মুক্তি না পেয়ে টেলিভিশনে মুক্তি পায়। ছবিটা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। সেখানে অমল বোসের একটা চরিত্র ছিলো। অমল বোসের মিষ্টির দোকন যার নাম ছিলো ভোলার মিষ্টান্ন ভান্ডার! দোকানে একটা টেলিফোন সেট ছিলো। আশেপাশের সকলের কল আসতো, অনেকে কল করতো। ভোলা বাবুর দোকানে মালামাল ছিলো কম। তিনি তার টেলিফোন সেটটাকে পূজো দিয়ে বেচাকেনা শুরু করতো। একদিন একজন এসে তাকে ভোলা দা বলে ডাক দেয়ায় সে বেশ অপমানিত বোধ করেছিলো। তখন ভোলা বাবু বলেছিলো, আমাকে শ্যের অথবা মেডম বলতে পারিস না! ভোলা বাবুরও ইচ্ছে হয় স্যার অথবা মেডম ডাক শোনার। কিন্তু ইচ্ছে হলেই কি এমন মধুর ডাক শোনা যায়!!

No comments:

Post a Comment