ভালবাসি প্রকৃতি

ভালবাসি প্রকৃতি

Tuesday, July 9, 2019

বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা ॥ লাগাম টানতে হবে এখনই

পত্রিকায় খবর আসে টিভি নিউজের পরে। পত্রিকা পড়ার আগেই আমরা টিভি নিউজে ঘটনার আদ্যোপান্ত জেনে যাই। টিভি চ্যানেলগুলো এখন ঘটনা ঘটার সাথে সাথে তথ্য উপাত্ত প্রচারতো করেই সেই সাথে লাইভ টেলিকাস্ট করে ঘটনার পরিবেশ প্রতিবেশ জানিয়ে দেয় দর্শকদের। টিভি চ্যানেলের চেয়ে একধাপ এগিয়ে আছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক। ফেসবুক এমন পর্যায়ে পৌছে গেছে কিছু বিষয় এখন লাইভও দেখাতে পারে এক্টিভিস্টরা। ফেসবুক একটিভিস্টরা ক্ষেত্র বিশেষ হত্যা, ধর্ষণও লাইভ দেখানোর ক্ষমতা রাখে, দেখায় না শুধু সামাজিকতা বা আইনের ভয়ে। তবে ফেসবুকের উপর অনেকসময় নির্ভর করা কঠিন। দল বিবেচনায় বা পক্ষ বিবেচনায় এক্টিভিস্টরা তাদের পছন্দ মত তথ্য প্রচার করে। কোন কোন সময় ফেসবুক এক্টিভিস্টরা মিথ্যা তথ্যও প্রচার করে আমাদের বিভ্রান্ত করে। এডিট করা ছবি, ভিন দেশের ভিডিও ফুটেজ নিজ দেশের সাম্প্রতিক ঘটনা বলে প্রচার চালিয়ে ভাইরাল করতে চেষ্টা করে। তাই ফেসবুকে কোন খবর, ছবি, ভিডিও ফুটেজ দেখার সাথে সাথে নির্ভরযোগ্য অনলাইন পোর্টাল বা পত্রিকার অনলাইন ভার্সন ঘেটে নিশ্চিত হয়ে নেই যে আসলে প্রচারিত তথ্য সঠিক আছে কী না! কর্মব্যস্ততার কারনে অনেকেরই টিভি দেখার সুযোগ হয় কম। তবুও সকালে পত্রিকার পাতায় চোখ বুলালে হৃদযন্ত্র কেপে ওঠে। প্রতিদিন এক বা একাধিক হত্যা, ধর্ষণ, ধর্ষণ শেষে হত্যা, নারী ও শিশু নির্যাতন, সড়ক দূর্ঘটনা, দুর্নীতি, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতিসহ নানান অপকর্মের সংবাদ নজরে আসলে কার হৃদয় না কাপে বলেন? যত শক্ত হৃদয়ই হোক না কেন কাপ দেবেই। বুড়া-মধ্যম-গুরা সবাই অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। এসব ঘটনা এমন পর্যায়ে পৌছে গেছে যে লাগাম টানা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু লাগামটা টানতে হবে।  
দেশে দিন দিন ধর্ষণের নজিরবিহীন রেকর্ড হচ্ছে। সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে ১০০ দিনের একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। এটা উন্নয়নের কোন পরিসংখ্যান নয়, হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণের পরিসংখ্যান! ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনে নজিরবিহীন রেকর্ড হতে চলেছে দেশে। হঠাৎ যেন মানুষের পাশবিক প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। একের পর এক ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটলেও কোনোভাবেই যেন এর লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। বিকৃত রুচির একশ্রেণির মানুষের বিকৃতি থেকে রেহাই পাচ্ছে না কোমলমতি শিশুরা এমনকি বৃদ্ধরাও। ঘরে-বাইরে সর্বত্রই নারী ও শিশুর জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠছে। বিরূপ প্রভাব পড়ছে সামাজিক জীবনে। চলতি বছরের প্রথম সাড়ে তিন মাসে ৩৯৬ জন নারী-শিশু হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। খোদ পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমনের মামলা হয়েছে ১ হাজার ১৩৯টি এবং হত্যা মামলা হয়েছে ৩৫১টি। বেসরকারি সংগঠন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এপ্রিল মাসের প্রথম ১৫ দিনে সারা দেশে ৪৭ শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। ৪৭ শিশুর মধ্যে ধর্ষণের শিকার ৩৯ জন। শিশু ধর্ষণের ঘটনায় শিশুর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৬৪ জন শিশু। এ সংখ্যা জানুয়ারিতে ছিল ৫২, ফেব্রুয়ারিতে বেড়ে হয় ৬০ এবং মার্চে ফের ৫২ জনে দাঁড়ায়। তিন মাসে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৯ জন। এর মধ্যে ৭ জন প্রতিবন্ধী শিশুও ধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষণচেষ্টা হয়েছে ৮ জনের ওপর। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১২ জনকে। এ ছাড়া অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে ১১ জনকে। শারীরিক নির্যাতনের শিকার ১৬ জন। ২০১৮ সালে প্রতিদিন গড়ে ১৩ শিশু নির্যাতন, দুই শিশু ধর্ষণ এবং এক শিশু হত্যার শিকার হতো। ২০১৭ সালের চেয়ে ২০১৮ সালে শিশু ধর্ষণ-গণধর্ষণ বেড়েছে অন্তত ৩৪ শতাংশ। সংস্থাটি বলছে, এর বাইরেও বহু অপরাধের ঘটনা নিত্যদিনই ঘটে। সেসব ঘটনা রেকর্ডহীন বলে স্থান পায় না থানার হিসাবে। চাইল্ড পার্লামেন্টের নিজস্ব জরিপে এসেছে- গত বছর ৮৭ শতাংশ শিশুই কোনো না কোনো যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। গণপরিবহনেই নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৫৩ শতাংশ। কর্মজীবী ও গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। শিশুদের আত্মহত্যা করার প্রবণতা বেড়েছে ৩৯ দশমিক ৯১ শতাংশ। ২০১৮ সালে ২৯৮ শিশু আত্মহত্যা করে, ২০১৭ সালে এ সংখ্যাটি ছিল ২১৩। অপরাধের এই যে উর্ধ্বমুখী সূচক এ সূচক আমরা চাই না। 
এতো গেলো ধর্ষণ-নারী ও শিশু নির্যাতনের কিছু পরিসংখ্যান। এর বাইরেও সংঘটিত হচ্ছে হত্যা, জখম, গুম, অপহরণ, মাদক সংশ্লিষ্ট নানান অপরাধ। প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত মানুষের সামনে কুপিয়ে, পিটিয়ে, গুলি করে মানুষ মারছে সন্ত্রাসীরা। কোন কোন ঘটনা এতটাই বিভৎস্য যা দেখা যায়না বা পড়াও যায় না। দুর্বল চিত্তের মানুষ সেসব ঘটনা পড়লে অসুস্থ হয়ে পরে। ধর্ষণের ঘটনাগুলো পড়লে গা শিউরে উঠে। কলা বাগানে নিয়ে, ধান ক্ষেতে নিয়ে, পাট ক্ষেতে নিয়ে, ছাদে নিয়ে, চলন্ত বাসে ধর্ষণের বর্ণনা পাওয়া যায়। শিশু থেকে শুরু করে এক পা কবরে এমন বৃদ্ধাকেও ধর্ষণের স্বীকার হতে হচ্ছে। যুবতী বা মধ্য বয়সী হলেতো কথাই নেই। বাবার কাছে কন্যাও নিরাপদ থাকছে না, শশুরের কাছে পুত্র বধু, শিক্ষকের কাছে ছাত্রী, আত্মীয়র কাছে আত্মীয় এমনকি মসজিদের ইমামদের কাছেও অনিরাপদ হয়ে উঠছে নারী-শিশু-ছাত্রীরা। আমরা কি এমন দেশ চেয়েছি না চাই? মানুষ একটু স্বাভাবিক ভাবে যদি বাঁচতেই না পারে তবে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীনতার কি মূল্য আছে?
সমাজে এখন এক নিদারুন অস্থিরতা বিরাজ করছে। কারো প্রতি কারো শ্রদ্ধাবোধ নেই, ভালোবাসা নেই, মমত্ববোধ নেই, আন্তরিকতা নেই, শুধু নেই নেই। দেশে বিচার নেই সে কথাতো বলা যাবে না। অঘটন ঘটাচ্ছে, আসামী গ্রেফতার হচ্ছে, বিচার হচ্ছে তবুও থামছে না। আবার একই রকম ঘটনায় প্রভাবশালীদের আত্মীয় হলে বেশি কোপাকুপি করেও হাজতে যায়, প্রভাব না থাকায় কম কুপিয়েও খরচের খাতায় চলে যায়! কেউ চুরির মামলায় আট মাসেও জামিন পায় না আবার কেউ ধর্ষণ করে আট দিনের মাথায় জামিনে মুক্তি নিয়ে ফুলের মালা গলায় দিয়ে বের হয়। এটাও কি সামাজিক অবক্ষয় বা অস্থিরতার কারন নয়?
এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে, যদি না লাগাম টানা হয়। আর লাগামটা টানতে হলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো তৎপর ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের সমাজ বিজ্ঞানীদেরও অনেক ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে, হোক সেটা পরামর্শ দিয়ে। রাষ্ট্র যন্ত্রকে পরামর্শ শুনতে হবে। অপরাধীদের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়া বন্ধ করতে হবে এবং সেটা করার জন্য আমাদের রাজনীতিবীদদের ভূমিকা রাখতে হবে। একটা কথা এখন বেশ প্রচলিত হয়ে গেছে, সেটা হলো-আগে ছিলাম দারিদ্র সীমার নিচে আর এখন আছি চরিত্র সীমার নিচে। আমাদের পরিবারগুলোর অনেক ভূমিকা রাখা উচিত। সবকিছু রাষ্ট্রের উপর আর ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেয়া ঠিক নয়। প্রতিটি পরিবার থেকে সন্তানদের সামাজিক মূল্যবোধ শিক্ষা দিতে হবে। সন্তান কি করে, কোথায় যায়, কার সাথে চলে সেই বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে। আর বড়দের বিষয়টা নাহয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উপরই ছেড়ে দিন। পরিবার থেকে শিক্ষা নিতে পারলে বড় হয়ে আর খারাপ পথে যাবে না, তবে একেবারেই যে যাবে না সেই নিশ্চয়তা আমিতো দিতে পারবোই না এমনকি পরিবারও দিতে পারবে না। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। সেবা দেয়ার ও সেবা নেয়ার, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে থাকার মানসিকতা জাগ্রত করতে হবে। সর্বপরি একটা কথাই বলবো, আমরা এ পরিস্থিতির থেকে মুক্তি চাই, স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে ও মরতে চাই। একটা সুস্থ্য সমাজ চাই, যেখানে আপনার আমার সন্তান নিরাপদে বড় হবে। 

No comments:

Post a Comment