ভালবাসি প্রকৃতি

ভালবাসি প্রকৃতি

Monday, July 22, 2019

প্রসঙ্গ ছেলেধরা ও গণপিটুনিঃ তুবা-মিনজু, ক্ষমা করে দিস মা!

গুজব কারো কারো জন্য গজব হয়ে দেখা দিচ্ছে এখন। দেশে গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনিতে মানুষ হত্যা সাম্প্রতিক সময়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গণপিটুনির এই তালিকায় ভিক্ষুক, বাক-প্রতিবন্ধী, প্রতিবন্ধীসহ উচ্চ শিক্ষিত নারীরাও বাদ যাচ্ছে না। এখনই যদি এই গুজব ও আইন নিজেদের হাতে তুলে নেয়ার প্রবনতা থামানো না যায় তবে যে কেউই হতে পারে ভিকটিম। গুজবের কাছে আমরা কেউই এখন আর নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারছি না। সরকারকে কঠোর হস্তে দমন ও বিষয়টিতে নজর দিতে হবে। আমাদেরও সচেতন হতে হবে।

সাম্প্রতিক সময়ে ‘পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে এ ধরনের গুজবের সূত্র ধরেই মূলত ‘ছেলে ধরা বা অপহরণকারী সন্দেহে গণপিটুনির সূত্রপাত হয়। জুলাই মাস ধরে এ ধরনের গুজবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ‘ছেলে ধরা সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে ২১ জুলাই রোববার পর্যন্ত নিহত হয়েছে ১১ জন এবং চার জেলায় এক দম্পতিসহ আহত হয় ৫০ জনের অধিক। এই পরিসংখ্যান থেমে নেই। যদিও পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে পুলিশ প্রশাসন ‘মানুষের মাথালাগার বিষয়টিকে পুরোপুরি গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছে। তারপরও ছেলে ধরা সন্দেহ ও গণপিটুনি থেমে নেই। পুলিশ প্রশাসন থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হচ্ছে ‘গণপিটুনির ঘটনা একটি ফৌজদারী অপরাধ। এধরনের অপরাধ থেকে বিরত থেকে কাউকে সন্দেহ হলে পুলিশে সোপর্দ করুন। কিন্তু কোন কিছুতেই শুনছে না হুজুগে বাঙ্গালি। দুটি ঘটনার বিবরণ শুনলে আপনার গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাবে। কতটা নিষ্ঠুর হলে মানুষ এমটা করতে পারে?

ঘটনা-১। স্কুলে সন্তানের ভর্তির খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন তাসলিমা বেগম রানু। হঠাৎ ছেলেধরা অভিযোগ তুলে অনেকেই তসলিমা বেগম রেনুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাকে গণপিটুনি দেয়া হলে তিনি নিহত হন। তাসলিমা বেগম রানু তার ৪ বছরের মেয়ে তাসনিম তুবাকে ভর্তি করাতে খোঁজ-খবর নিতে বাড্ডার একটি স্কুলে গিয়েছিলেন। সন্তানরা জানেন না ছেলেধরা গুজবে এই সমাজের মানুষরাই তাদের মমতাময়ী মাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। যে তুবার ভর্তির খোঁজ নিতে গিয়েছিলো সেই তুবা জানেনা তার মা আর ফিরে আসবে না, তাকে আর কোনদিন আদর করবে না! গণপিটুনির ভিডিওটি মুহুর্তের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। ভিডিওতে দেখা যায়, বাড্ডার অল্প কয়েকজন যুবকই মারছে তাকে। বাকিরা দেখছে, কেউ কেউ কাছ থেকে মোবাইলে ভিডিও করছে। ৮-১০ মিনিট লাঠিপেটার পর আবার উপর্যুপরি লাথি দেয়া হয়। আধা ঘণ্টারও বেশি সময় গণপিটুনির পর শনিবার সকাল ১০টার দিকে তাসলিমা বেগম রেনুকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে তিনি মারা যান। এ অবস্থায় তাসলিমা বেগম রেনুর পরিবারে নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার। লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করেছিলেন আড়ং, ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠানে, পড়িয়েছিলেন স্কুলেও। বিবাহ বিচ্ছেদের পর ঘরেই কাটাচ্ছিলেন অধিকাংশ সময়। উচ্চ শিক্ষিতা সংগ্রামী একজন নারীর ভাগ্যে এমন পরিণতি মেনে নিতে পারছে না কেউ। গত দুই বছর আগে স্বামী তসলিম হোসেনের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তার। এরপর ছেলে তাহসিন আল মাহিদকে (১১) তার বাবা তসলিম হোসেন নিয়ে যায়। সে নোয়াখালীর চাটখিলে তার এক ফুফুর কাছে মানুষ হচ্ছে। তাসলিমা বেগম রানু মেয়ে তাসমিন তুবাকে (৪) নিয়ে মহাখালী ওয়ার্লেস গেটে জিপি জ-৩৩/৩ নং বাসায় ভাড়া থাকতেন। কিছুদিনের মধ্যেই রানুর আমেরিকা যাওয়ার কথা ছিলো। যেতে পারলে হয়তো তার সন্তানদের জন্য আরো উজ্জল ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে পারতেন। কিন্তু কিছু হুজুগে বাঙ্গালি রানু ও তুবাদের সব স্বপ্ন মূহুর্তের মধ্যে নিঃশেষ করে দিলেন।

ঘটনা-২। গত আট মাস আগে একমাত্র মেয়েকে নিয়ে অন্য ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যায় স্ত্রী। এরপর থেকেই একা হয়ে যান বাক-প্রতিবন্ধী সিরাজ। বাক-প্রতিবন্ধী হওয়ায় দুঃখ বুঝানোর তেমন কেউ ছিলো না। স্ত্রীকে ভুলে গেলেও মেয়ে মিনজুকে ভুলতে পারেননি তিনি। তাই তাদের চলে যাওয়ার পর থেকে প্রতিদিনই মেয়ের খোঁজ নিতে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন সিরাজ। এক পর্যায়ে দুই মাস আগে সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি আলামিননগর এলাকায় কাজ করতে গিয়ে রাস্তায় মেয়ে মিনজুকে দেখতে পান সিরাজ। সেই থেকে তিন-চারদিন পরপরই সকালে স্কুলে যাওয়ার রাস্তায় মেয়েকে দেখতে যেতেন হতভাগা সিরাজ। ২০ জুলাই সকালে মেয়েকে দেখতে যান আর সেই দেখাই হয় বাবা-মেয়ের শেষ দেখা। সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি পাগলাবাড়ির সামনে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে অজ্ঞাত পরিচয় যুবক হিসাবে নিহত হন। পরে রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সংবাদ মাধ্যমে ছবি দেখে থানায় গিয়ে লাশ শনাক্ত করে নিহতের পরিবার। নিহতের পরিবার জানায়, সিরাজ ছেলেধরা নয় বরং বাক-প্রতিবন্ধী। নিজের মেয়ের সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করতে গিয়েছিলো। নিজের কাছে টাকা ছিলো না। তাই একটি মোবাইলের দোকান থেকে ১০০ টাকা ধার করে মেয়ের জন্য বিস্কুট, চিপস নিয়ে গিয়েছিলো। নিহত সিরাজ রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। চারভাই ও তিন বোনের মধ্যে সিরাজ বড়। জন্মের পর থেকেই সিরাজ কথা বলতে পারে না। পরে ১০ বছর আগে একই এলাকার শামসুন্নাহারের সঙ্গে সিরাজের বিয়ে হয়। গ্রামে কাজ না পাওয়ায় ২০১৫ সালে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জে আসেন তিনি। সিদ্ধিরগঞ্জের সাইলোগেইট এলাকায় মোহর চানের বাড়িতে ভাড়ায় পরিবার নিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন সিরাজ। নিজে কখনো রাজমিস্ত্রির সহকারী আবার কখনো দিনমজুর হিসেবেই কাজ করতেন। আর স্ত্রী শামসুন্নাহার বাসাবাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। আটমাস আগে স্থানীয় বিদ্যুৎমিস্ত্রি আব্দুল মান্নান ওরফে সোহেলের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে একমাত্র মেয়ে মিনজুকে নিয়ে পালিয়ে যান শামসুন্নাহার। পাঁচ মাস আগে সিরাজকে তালাকের চিঠি পাঠায় তার স্ত্রী। বোবা হলেও ইশারায় সব কথা বলতে পারতো। মোখলেসের মোবাইলের দোকান থেকে টাকা নেওয়ার সময় নিজেই হাতের ইশারা বুঝিয়েছে মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। মেয়েকে দেখতে যাবে তাই অনেক খুশি ছিলো সিরাজ। ছেলেধরার অভিযোগ এনে মারতে মারতে সিরাজকে মাটিতে শুয়েই ফেলেছে উৎসুক মানুষ। মাটিতে যখন সে ছটফট করছিলো তখন কয়েকজন যুবক প্রাণটা যায় না কেনো তাই একের পর এক লাথি মেরেই চলেছে। মরে যাওয়ার পর লাশটা টেনে হেঁচড়ে প্রায় ১০০ গজ দূরে ফেলে রাখে।

এতো গেলো সিরাজ ও রানুর ঘটনা। একজন স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ হয়েছে অন্য জন স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদ। আবার কোথাও মাদকাসক্ত যুবক, কোথাও ভবঘুরে ভিক্ষুক এর সাথে ঘটছে ঘটনা। কোথাও কিন্তু ছেলে ধরা বা কল্লা কেটে সেতুর নিচে দেয়ার অভিযোগ প্রমানিত নয়। প্রতিটি ঘটনায়ই সন্দেহজনক। হয়তোবা নিজেদের মধ্যে কেউ উসকে দিচ্ছে, অথবা প্রতিশোধপরায়ন হয়ে বা অতি উৎসাহী হয়ে বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে ঘটনা ঘটাচ্ছে। বিষয়টা পুলিশ বিষদভাবে খতিয়ে দেখলে প্রকৃত রহস্য উঠে আসবে। ততদিনে ঝড়ে যাবে কিছু প্রাণ, বুক খালি হবে কিছু মায়ের, পিতা-মাতা হারা হবেন কিছু সন্তান।   

বাস্তবতা বলছে, আইনের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা, গুজবে হুজুকে জনতার কান দেয়া এবং মানুষের নৈতিক-সামাজিক অবক্ষয় থেকে মানুষ হয়েও জীবিত আরেকজন মানুষকে পিটিয়ে হত্যার মতো জঘন্য কাজ করতে পারছে। এ ধরনের হত্যার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কাউকে দায়ী করতে না পারার সুযোগটি কাজে লাগায় অপরাধপ্রবণ একদল মানুষরূপি জানোয়ার। কিন্তু যারা এধরণের ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা হয়তো চিন্তাও করতে পারছে না তারা কত বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। গণপিটুনির ঘটনা একটি ফৌজদারী অপরাধ। দন্ডবিধি ১৮৬০ এর বিভিন্ন ধারায় এ অপরাধের শাস্তির বিধান রয়েছে। দন্ডবিধিতে গণপিটুনির বিষয়ে বিস্তারিত হয়তো সংগায়িত করা নেই। কারন, হয়তো আইন প্রণয়নের সময় এজাতীয় অপরাধ সমাজে ছিলো না বা মানুষ এমন ঘটনা ঘটানোর কথা ভাবতেও পারত না। আইনবিদদের মতে গনপিটুনিতে মারা গেলে দন্ডবিধি১৮৬০ এর ৩০৪ ধারায় শাস্তি প্রদান করার সুযোগ রয়েছে। আর মারা না গেলে আঘাত বা জখমের ধরন অনুযায়ী দন্ডবিধির ১৪১-১৪৮, ২৬৮ ধারায়ও শাস্তির বিধান রয়েছে।

যে কোনো গুজবে কান দিয়ে গণপিটুনিতে মানুষ হত্যা বন্ধ করা উচিত। কাজটা করতে হবে সরকারকে এবং আমাদের উচিত সরকারকে সহযোগিতা করা। অতি উৎসাহী হয়ে গুজবে কান দিয়ে গণপিটুনিতে অংশ নিয়ে অপরাধীর খাতায় নাম লিখানো উচিত হবে না। নিজেকে হিরো প্রমান করতে গিয়ে আসামীর খাতায় কেউ নাম লিখাবেন না। আপনার হিরোগিরি ভিডিও হয়ে সামাজিক যোগাযোগ মধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। সেই ভিডিও দেখেই পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। গুজবে কান না দিয়ে এ পরিস্থিতি দমনের জন্য সচেতনতা গড়ে তোলার বিকল্প নেই। অপরিচিত কোনো নারী-পুরুষকে কোনো কারণে সন্দেহজনক মনে হলে তাকে আটকে রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেয়াই সচেতন নাগরিকদের দায়িত্ব। অবিলম্বে এ বিষয়ে গণসচেতনতা তৈরির পাশাপাশি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। নতুবা এটা মহামারির চেয়েও ভয়াবহ আকার ধারন করবে, তখন আপনি আমি কেউই আর নিরাপদ থাকবো না। অতি উৎসাহীদের নির্মমতায় মা হারা তুবাকে কি জবাব দিবো সমাজ, বাক প্রতিবন্ধী বাবা হারা মিনজুকেই বা কি জবাব দিবে সমাজ? তুবার চোখের দিকে তাকানো যায় না, প্রতিটি তুবার চোখের ভাষা একই। আমাদের ক্ষমা করিস মা। এ সমাজ তোদের মা-বাবাকে হত্যা করেছে। 

No comments:

Post a Comment