ভালবাসি প্রকৃতি

ভালবাসি প্রকৃতি

Thursday, February 7, 2019

ওজনে কম দেয়া, ঠকবাজি, প্রতারণায় দুনিয়া-আখিরাতে শাস্তি


মানে কম, গুনে কম, ওজনে কম, মাপে কম, আন্তরিকতায় কম, সেবায় কম। কমতে কমতে সবকিছুই কমে আসছে। সবকিছুতেই কম আর কম। কমতে কমতে মানুষের মূল্যবোধই কমেগেছে। তবে মূল্যবোধ কমলেও মূল্য সম্পর্কে বোধটা কমেনি। কখন মূল্য বাড়াতে হবে সেই বোধটা দাড়ি-টুপিধারী লেবাসী ব্যবসায়ীরও আছে। লেবাসহীনদের বিষয়ে আর কি বলবো? সুযোগ পেলেই মূল্য বাড়িয়ে ফেলে। এক্ষেত্রে আর কমায় না! এভাবে কমতে থাকলে মানুষ কেউ কারো প্রতি আর আস্থা রাখতে পারবে না। আমাদের মূল্যবোধ কমেছে এতটাই যে সবকিছুতেই কম দিয়ে, কম করে বেশি লাভ করতে চাইছি।
ওজনে কম দেয়া, সাইজে কম দেয়া আমাদের অভ্যাসে পরিনত হয়ে গেছে। কোন প্যাকেটজাত পন্য কিনতে গেলে দেখা যায় পঞ্চাশ থেকে ক্ষেত্রভেদে একশ গ্রাম পর্যন্ত কম হয়। পানি কিনতে গেলে সেখানেও কম পাওয়া যায়। জীবন রক্ষাকারী ঔষধে উপাদান কম দেয়ার মতো ঘটনাও দেখা যাচ্ছে। মাটির তৈরী ইট। সেই্ ইট সাইজে কম দিয়ে মানুষকে ঠকানো হচ্ছে। ঠকানোটা এমন পর্যায়ে পৌছে গেছে যে গাঁজাও পরিমানে কম দিচ্ছে। হাল আমলে সবচেয়ে জনপ্রিয় ট্যাবলেট ইয়াবায়ও ভেজাল দেয়া হচ্ছে। শোনাযায় জন্মনিয়ন্ত্রনে মায়া বড়িও ইয়াবা বলে চালিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটছে, কেউ কেউ নিজেই বাড়িতে বড়ি বানানোর প্রেশার মেশিন বসিয়ে নিয়েছে! জাতা দিলেই ট্যাবলেট!
সম্প্রতি এমন কিছু কম দেয়ার ঘটনা আলোচিত হয়েছে। কুমিল্লার এক গাঁজা ব্যবসায়ীকে ১০ হাজার টাকায় দেয়ার কথা ছিল তিন কেজি গাঁজা। কিন্তু এক মাদক ব্যবসায়ী তাকে দিল মাত্র এক কেজি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি ফোন দিলেন পুলিশের জরুরি সেবা '৯৯৯'-এ। পুলিশ এসে গাঁজাসহ তাকেই গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়েছে। অবিশ্বাস্য এ ঘটনাটি ঘটেছে কুমিল্লার ব্রাক্ষণপাড়া বাজারে। তবে পুলিশের উপর যে আস্থা বেড়েছে গাঁজা ব্যবসায়ীর এটা খুব আশাব্যঞ্জক! শরীয়তপুরে ইট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে ধরা পড়েছে পরিমানের জালিয়াতি। ক্রেতারা প্রতি হাজার ইটে কমপক্ষে ২শ ৮৪টি সমপরিমাণ ইট কম পাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রত্যেকটি ইটের ভাটায় প্রস্তুতকৃত ইটের সাইজ রয়েছে দৈর্ঘ্যে ২২ সেন্টিমিটার, প্রস্থে ৯ দশমিক ৬ সেন্টিমিটার এবং উচ্চতায় ৫ সেন্টিমিটার। সরকারি বিধি মোতাবেক প্রতিটি ইটের সাইজ হবে দৈর্ঘ্যে ২৪ সেন্টিমিটার, প্রস্থে ১১ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার এবং উচ্চতায় ৭ সেন্টিমিটার। অর্থাৎ প্রত্যেকটি ইটে কমপক্ষে ২ সেন্টিমিটার করে কম রয়েছে। চালের বাজারেও চলে কমের ঘটনা। এক ব্যক্তি দুই মন চাল কিনে দেখে দুই মণের বস্তায় চাল আছে ৭৭ কেজি, অর্থাৎ তিন কেজি কম।
পরিমানে যদি কেউ কম দেয় তবে ক্ষতিগ্রস্থ বা প্রতারিত ব্যক্তির আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ ধরনের অপরাধের জন্য দণ্ডবিধির ২৬৪, ২৬৫,২৬৬ ও ২৬৭ ধারা অনুসারে নিকটস্থ মুখ্য মহানগর হাকিম ও মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে ফৌজদারি মামলা করা যাবে। সেক্ষেত্রে প্রতিকার পাবেন কিভাবে?
ফৌজদারি আদালতে মামলা করার ক্ষেত্রে অভিযোগ দায়ের করতে হয়। সে অভিযোগ শুনে আদালত অভিযোগ থাকা ব্যক্তিকে আদালতে হাজিরের নির্দেশ দিতে পারেন। সে নির্দেশ মোতাবেক হাজির না হলে, সে ক্ষেত্রে বিচারক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে পারেন।
দণ্ডবিধির ২৬৪ ধারায় ‘ওজনের জন্য প্রতারণামূলকভাবে মিথ্যা যন্ত্র ব্যবহার’ করার বিষয়ে বলা আছে। এ ধারা অনুসারে কোনো ব্যক্তি যদি প্রতারণামূলকভাবে ওজনের জন্য এমন কোনো যন্ত্র ব্যবহার করেন, মিথ্যা বলেন- তবে সেই ব্যক্তি এক বৎসর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অর্থ দণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডেই দণ্ডিত হবেন।
দণ্ডবিধির ২৬৫ ধারা অনুসারে ‘প্রতারণামূলকভাবে মিথ্যা ওজন কিংবা মাপ ব্যবহার’ করার বিষয়ে বলা আছে। এ ধারা অনুসারে, কোনো ব্যক্তি যদি প্রতরণামূলকভাবে কোনো মিথ্যা ওজন কিংবা দৈর্ঘ্যের বা ধারণশক্তির মাপকে উহা অপেক্ষা ভিন্ন ওজন কিংবা দৈর্ঘ্য বা ধারণশক্তির মাপ হিসেবে ব্যবহার করেন, তবে সেই ব্যক্তি এক বৎসর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অর্থ দণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডেই দণ্ডিত হবেন।
দণ্ডবিধির ২৬৬ ধারা অনুসারে, ‘মিথ্যা ওজন কিংবা মাপ করা’ বিষয়ে বলা আছে। এ ধারা অনুসারে, কোনো ব্যক্তি যদি এমন কোনো ওজন, পরিমাপ যন্ত্র বা বাটখারা কিংবা দৈর্ঘ্য বা ধারনক্ষমতা মাপবার যন্ত্র রাখে, যা মিথ্যা বলে সে জানে এবং উহা যাতে প্রতারণামূলকভাবে ব্যবহৃত হতে পারে তার জন্যই রাখে, তবে সেই ব্যক্তির এক বৎসর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম অথবা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে, অথবা অর্থ দণ্ডে, অথবা উভয় দণ্ডেই দণ্ডিত হবেন।
দণ্ডবিধির ২৬৬ ধারা অনুসারে, ‘মিথ্যা বাটখারা কিংবা মাপ তৈরি কিংবা বিক্রয় করা’ বিষয়ে বলা আছে। এ ধারা অনুসারে, কোনো ব্যক্তি যদি এমন কোনো ওজন বা বাটখারা কিংবা দৈর্ঘ্য বা ধারনশক্তির পরিমাপ যন্ত্র তৈরি করেন, বিক্রয় করেন বা লেনদেন করেন, যা মিথ্যা বলে তিনি জানেন এবং উহা যাতে সত্য বলে ব্যবহার করা যায়, সে উদ্দেশ্যেই তা করেন অথবা উহা সত্য বলে ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তাহলে যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডেই দণ্ডিত হবেন।
এতো গেলো আইনগত অধিকার আদায়ের বিষয়। ধর্মীয় অনুশাসন মানা ব্যক্তির জন্যও ওজনে, সাইজে কম দেয়ার, প্রতারণার অপরাধে পরপারে রয়েছে শাস্তির সু-ব্যবস্থা।
ওজনে কম দেয়া, ঠকবাজি, প্রতারণা একটি কবিরা গুনাহ। ইসলামের দৃষ্টিকোণে ঠকবাজি, প্রতারণা ও ওজনে কম দেওয়ার শাস্তি। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে প্রতারণা ও প্রতারক, উভয়ের ব্যাপারে কঠোর নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন এবং তাদের জন্য অবধারিত ধ্বংসের ঘোষণা দিয়েছেন। এ সংক্রান্ত স্পষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায় পবিত্র কালামের এই আয়াতে : “ধ্বংস তাদের জন্য, যারা মাপে কম দেয়। যারা মানুষের থেকে মেপে নেয়ার কালে পূর্ণ মাত্রায় গ্রহণ করে। আর যখন তাদের জন্য মাপে বা ওজন করে, তখন কম দেয়।”[সূরা মুতাফফিফীন : ১-৩]
এ এক কঠিন ঘোষণা, যারা ঠগবাজি করে, মাপে ও ওজনে মানুষকে কম দেয় তাদের জন্য। সুতরাং যারা পুরোটাই চুরি করে, আত্মসাৎ করে, এবং মানুষকে তাদের প্রাপ্য বস্তুতে ঠকায়, তাদের কী কঠিন অবস্থা হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। মাপে ও ওজনে কমপ্রদানকারীর তুলনায় এরা আল্লাহ তাআলার শাস্তির অধিক ভাগিদার, এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।
এমনিভাবে আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতারণা থেকে সতর্ক করেছেন এবং প্রতারকের ব্যাপারে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাবারের এক স্তুপের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। তিনি খাবারের স্তুপে হাত প্রবেশ করালেন, তার আঙুলগুলো ভিজে গেল। তাই তিনি বললেন, ‘হে খাবারওয়ালা, এটা কি ? সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল, তাতে বৃষ্টির পানি পড়েছিল। তিনি বললেন, তুমি কি তা খাবারের উপরে রাখতে পারলে না, যাতে মানুষ তা দেখে ? যে প্রতারণা করে, সে আমার দলভুক্ত নয়।’ অন্য রেওয়ায়েতে আছে ‘যে আমাদের সাথে প্রতারণার আশ্রয় নেয়, সে আমাদের দলভুক্ত নয়’। অপর রেওয়ায়েতে আছে ‘সে আমাদের দলভুক্ত নয়, যে প্রতারণার আশ্রয় নেয়।’[ইমাম মুসলিম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।]
প্রতারণার রয়েছে নানাবিধ ক্ষতি, তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে: প্রতারণা মানুষকে জাহান্নামের পথে ঠেলে দেয়, নিক্ষেপ করে ভয়াবহ ও স্থায়ী আগুনে।, প্রতারণা ব্যক্তির আত্মিক নীচুতা ও মানসিক কলঙ্কের পরিচায়ক। সুতরাং চরম নীচু মানসিকতার অধিকারীই কেবল তা করে থাকে, এবং স্থায়ী ধ্বংসে পতিত হয়।, প্রতারক ক্রমে আল্লাহ ও মানুষ থেকে দূরে সরে যায়।, প্রতারণা দুআ কবুলের পথ বন্ধ করে দেয়।, প্রতারণা সম্পদ ও বয়সের বরকত ধ্বংস করে দেয়।, ঈমানের দুর্বলতা ও কমতির পরিচায়ক।, অব্যাহত প্রতারণা ও জালিয়াতী প্রবণতার ফলে প্রতারক গোষ্ঠীর উপর যালিম ও কাফিরদেরকে চাপিয়ে দেয়া হয়।

তাই ওজনে কম দেয়ার, ঠকবাজির, প্রতারণা করার আগে একবার হলেও ভাবুন। কেন করছেন এসব? একটু বেশি লাভের আশায়, একটু ভালো থাকার আশায়তো? মানুষের জীবনধারণের জন্য খুব বেশি অর্থ-সম্পদ প্রয়োজন হয় না। আর বেশি অর্থ উপার্যন করে কার জন্য রেখে যাবেন? যাদের জন্য রেখে যাবেন তারা কেউ এই অপরাধের জন্য শাস্তির ভাগ দুনিয়াতে যেমন নিবে না তেমনি পরপারেও আপনাকে স্বীকার করবে না। তাই সাবধান হওয়ার সময় থাকতে হওয়া উচিত।

No comments:

Post a Comment