ভালবাসি প্রকৃতি

ভালবাসি প্রকৃতি

Monday, February 11, 2019

জানোয়ারও কী এত নীচ হতে পারে!

আমার খুব কুকুর পোষার সখ। ছোটবেলা থেকেই এই সখটা ছিলো এখন বড়বেলায়ও আছে। আগে আমাদের কাচা পিড়ার ঘর ছিলো। যখন স্কুলে পড়তাম তখন কুকুর ছানা এনে ঘরের পিড়া খুড়ে গুহা বানিয়ে রাখতাম। বড় হলে কোনটা রোগে আক্রান্ত হয়ে বা বয়সের কারনে মারা যেত। আবার আনতাম, লালন পালন করতাম। তবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লড়ে যেতাম, পশু হাসপাতালে নিয়ে যেতাম, চিকিৎসা করাতাম, মৃত্যু শেষে মাটি দিয়ে রাখতাম। হৃদয়ে তখন বেশ ব্যথা অনুভব করতাম। কুকুরের প্রতি আমার ভালোবাসা দেখে বাড়ির সবাই অপছন্দ করলেও আমাকে ভালোবাসে বলে সহ্য করতো। সেই পোষা কুকুর যদি কেউ বিষ খাইয়ে মেরে ফেলে তখন কেমন লাগে? সেটা যদি প্রাপ্ত বয়স্ক না হয়ে ছোট্ট বাচ্চা কুকুর ছানা হয়, যে কিনা সারাদিন পায়ের কাছে ঘুরঘুর করে, খাবার দেখলে নাচানাচি করে, একটু আদরের আশায় পায়ের কাছে গড়াগড়ি খায়, সেই কুকুর ছানাটা যদি কোন মানুষরূপি পশু বিষ খাইয়ে মেরে ফেলে তখন হৃদয়ের অবস্থাটা কেমন হয় ভাবাযায়? তাদের পশু বা জানোয়ার বলা যায় কিনা আমি জানি না। কারন জানোয়াররা কি এতটা অমানবিক-হিংস্র হয়?
আমার বন্ধু ডাক্তার মাহবুবুল হকের বাড়িতে একটা মেয়ে কুকুরের বাচ্চা আসছিলো অনেকদিন আগে। শত চেষ্টায়ও যখন তাড়াতে পারেনি তখন ওটা ওখানেই বড় হতে থাকলো। আস্তে আস্তে কুকুরটি তার প্রভূভক্তির প্রমান দিলো যাকে ওরা টমি ডাকতো। প্রথমে অবজ্ঞা করলেও টমি সকলের ভালোবাসা আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছে। এবছর টমি পাঁচটি ছানা পোষব করেছে এবং পাঁচটিই পুরুষ। আমি একটা নেয়ার আগ্রহ দেখালে একটু বড় হওয়ার পর নেয়ার জন্য বললো। আমি দেখে লাল একটা ছানা নিয়ে নিলাম। গায়ের রং লাল হওয়ায় বাড়ির সবাই লালু বলেই ডাকে। লালু লালু ডাকায় ও বুঝে গেছে ওর নাম লালু। লালু বলে ডাক দিলেই সে দৌড়ে এসে হাজির হয়। আমি লালুকে এনে যতটা না খুশি হয়েছি তার চেয়ে বেশি খুশি আমার মেয়ে প্রিয়ন্তী, বড় ভাতিজা পাপন আর একদম ছোট ভাতিজা রাফান। ভাবি ও আমার স্ত্রী অপছন্দ করলেও খাবার দাবার দিতে কখনো কার্পন্য করেনি। লালুর জন্য হাড়-কাটাতো আছেই, ভাত মেখে লালুর নির্দিষ্ট প্লেটে ঠিকই দিতো। 
কুকুর সর্বদা প্রভূ ভক্ত প্রাণী এটা নতুন কিছু নয়। কথিত আছে কুকুর হলো সর্ব প্রথম মানুষের পোষমানা কোন প্রাণী। প্রভূর জন্য কুকুরের মমত্ববোধ নিয়ে অনেক ঘটনা আছে যা লিখে শেষ করা যাবে না। আমার পোষা লালু অল্প ক’দিনে কতটা প্রভূভক্ত হয়েছিলো তার কিছু ঘটনা বলি। আমি রাতে বা দিনে যখনই বাড়ি ফিরি অন্তত দুশ মিটার দুর থেকে আমার মোটরসাইকেলের আওয়াজ পেয়ে বাড়ি থেকে এক দৌড়ে রাস্তায় চলে আসে। এর পর রাস্তা থেকে আমার সাথে বাড়ি ঢুকতো। আমি কবুতর পোষতে পছন্দ করি। আমার কবুতরকে কাকে আক্রমন করলে লালু কাকের উপর ঝাপিয়ে পড়তো এবং চিৎকার চেচামেচি করতো যাতে আমরা বুঝতে পারি যে কোন বিপদ ঘটেছে। এমন ঘটনা অনেক যা হয়তো যারা কুকুর পোষেন তাদের ঘটনার সাথে মিলে যাবে। 
তিন মাস পূর্বে লালুকে আমি বাড়িতে আনি। প্রথম প্রথম কয়েকদিন খুব কান্নাকাটি করতো। কান্নাকাটির অবশ্য অন্যতম কারন হলো রশি দিয়ে বেধে রাখা! বাড়িটা যখন ওর কাছে পরিচিত হয়ে গেছে তখন ছেড়েই দিয়েছিলাম। দরজার সিড়ির গোড়ায় শুয়ে থাকতো, কখনো পুকুর পাড়ে রোদের মধ্যে শুয়ে শুয়ে ঘুম দিতো। আমাকে দেখা মাত্র দৌড়ে পায়ের কাছে চলে আসতো। লালু একটু নবাবী স্বভাবের ছিলো। ডাল ভাত তার মুখে রুচতো না। মাংস ছাড়া সে ভাতও খেতে চাইতো না। তাই মাংসের ছাডি (মাংসের চর্বি-উচ্ছিষ্ট) লালুর জন্য রান্না করে দিতো আমার বড় বোন। সেই মাংসের ছাডি বক্সে ভরে ফ্রিজে রেখে দিতাম। ওখান থেকে নিয়ে ভাত মেখে দিতাম। লালু একটু রিষ্টপুষ্ট হয়েছে। গলা ছেড়ে ডাক দিতে শিখেছে। অপরিচিত কেউ বড়িতে ঢুকলে ঘেউ ঘেউ করতে শিখেছে। বাচ্চারা যেহেতু কুকুর ছানা পছন্দ করে, তেমনি কুকুর ছানাও বাচ্চাদের পছন্দ করে। বাড়ির আশে পাশের ছোট বাচ্চারা এসে লালুকে খুব আদর করতো। মাঝে মাঝে বাচ্চাদের সাথে বাড়ির বাইরে চলেও যেত। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে ঠিকই চলে আসতো ওর নিজ গৃহে। আজ যে ঘটনা ঘটে গেলো সেটা আমার ধারনায়ও ছিলো না। এমন একটা ঘটনার জন্য আমি মানসিক ভাবে প্রস্তুতও ছিলাম না। 
আজ দুপুরে বাড়ি থেকে আমার বড় বোন ফোন দিলো। বাড়ি থেকে ফোন দিলে প্রথমেই আমার বুকটা একটু কেঁপে উঠে। আমাকে কেউ সাধারণত প্রয়োজন ছাড়া ফোন দেয় না, আমিও দেই না। আমার মা অসুস্থ থাকতে বাড়ির ফোন পেলে বুক কেপে ওঠা শুরু হয়। মা এখন আর নেই। এখন বাবা অসুস্থ ঘরে। ফোন পেলেই মনে হয় কোন বিপদ নয়তো? বোনের ফোন পেয়ে রিসিভ করেই জানতে চাইলাম কি ব্যাপার আপা। আপা ফোনে জানালো, লালুকে কারা যেন বিষ খাইয়েছে। লালু আপার দরজার কাছে দৌড়ে এসে কিছুক্ষণ দপাদপি করে, কাকুতি মিনতি করে দৌড়ে চলে গেছে, এখন আর তাকে খুঁজে পাচ্ছে না। আপার কাছ থেকে ফোন নিয়ে আমার মেয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে একই কথা বললো। আমি বাড়ি যাওয়ার সাথে সাথে মেয়ে আমার কোলে উঠে গলা জড়িয়ে অঝরে কান্না করছে আর লালুর কথা বলছে। মেয়ের কান্না দেখে আমিও আবেগতাড়িত হয়ে গেলাম। পোশাক পরিবর্তন করে বেরিয়ে পড়লাম লালুর খোঁজে। আমার পিছু নিলো আমার মেয়ে আর বড় ভাতিজা পাপন। যেদিকে লালু ছুটে গেছে সেদিক দিয়ে খুঁজতে গিয়ে দেখি পাশের বাড়ির বাগানের মধ্যে লালুর নিথর দেহ পড়ে আছে। নাড়া দিয়ে দেখি লালুর শরীরে প্রাণের অস্তিত্ব নেই। লালুর এভাবে শুয়ে থাকা দেখে হৃদয়টা ভেঙ্গে গেলো। আমার মেয়ে ও ভাতিজা দুজনেই কেঁদে ফেললো। আমি লালুকে ওখান থেকে তুলে নিয়ে আসলাম বাড়িতে। নিজেই মাটি খুড়ে লালুর দেহটা মাটিচাপা দিয়ে দিলাম। লালুকে মাটিচাপা দিয়ে আমি দাড়িয়ে থাকতে পারলাম না। পাশের একটা গাছের গুড়ি ছিলো তার উপর বসে পড়লাম। আমার গলা শুকিয়ে আসছে। পাপন এক গ্লাস পানি এনে দিলো। আমার দুই বোন, ভাবি, স্ত্রী, ভাগ্নে দিপ্ত সবাই এসেছে আমার কাছে। সবাই হতবাক! আমাকে সান্তনা দিলো। সবাই আমার মতই হতবাক ও ব্যথিত।  
একটা ছোট্ট কুকুর ছানা। যদি কারো বাড়িতে গিয়ে থাকে, কারো অনিষ্ট করে থাকে তবে কতটাই বা করেছে, কতটাই বা করতে পারে? যদি কারো ক্ষতি করে থাকে তবে সবাইতো জানে যে লালুকে আমি লালন পালন করি, আমাকে বলতে পারতো। আমি উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতাম। যদি দিতে না পারতাম আমি ক্ষমা চেয়ে নিতাম। একটা বোবা প্রাণী। তাও আবার বাচ্চা। ছোট শিশু সে যে প্রাণীরই হোক, মানুষ বা ভয়ংকর কোন প্রাণীর বাচ্চা, তাদের কি দেখতে ক্ষতিকর মনে হয়? লালুকে বিষ খাওয়ানোর আগে একবারও কি তাদের বুক কাপলো না? তারা কি মানুষ? লালুর মত একটা বাচ্চা পশুর মুখে বিষ তুলে দিলো যারা তাদের কি পশু বলা যায়? কি নামে ডাকবো তাদের? একটা পোষা প্রাণীকে বিষ খাইয়ে হত্যার অপরাধে আমি বিচার চাইতে পারতাম। আমি বিচার চেয়েছিও। আমি মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে বিচার চেয়েছি। আল্লাহ তায়ালা, আপনি ওদের ঈমান দিন যারা এমন কাজটি করেছে! আমি মাত্র তিন মাস লালন পালন করেছি তাতে আমার এতটা কষ্ট লাগছে, যে লালুকে সৃষ্টি করেছে সেই সৃষ্টিকর্তার কেমন লেগেছে যখন লালুর মুখে বিষ তুলে দিলো! নিশ্চই মহান সৃষ্টিকর্তা তার সৃষ্টির উপর অমানবিকতার উপযুক্ত বিচার করবেন। 

No comments:

Post a Comment