ভালবাসি প্রকৃতি

ভালবাসি প্রকৃতি

Wednesday, July 4, 2018

বিচার বিভাগ ও চিকিৎসা দু’ই আস্থার জায়গা ॥ বিতর্ক করলে আমাদেরই ক্ষতি

গত ৩০ জুন ২০১৮ তারিখে দেশের জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম একটি সংবাদ প্রচার করে যার শিরনাম ‘চট্টগ্রামে ভুল চিকিৎসায় শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ’। সংবাদটি প্রকাশের আগেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকটা ভাইরাল হয়ে যায়। একটি মাসুম শিশুর সাথে তার বাবার ছবি এবং পরবর্তীতে বাবার কোলে কাফনে মোড়া সেই মাসুম শিশু, কি হৃদয় বিদারক চিত্র সেটা ভাবা যায়? প্রবাদেই আছে, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে ভাড়ি বস্তু পিতার কাধে সন্তানের লাশ।’ তাই ছবি দেখে সকলেরই হৃদয় ভেঙ্গে চৌচির। এ মৃত্যু নিয়ে প্রতিবাদ, মানব বন্ধন, চিকিৎসক আটক করে কি হয়েছে? শুধু আস্থার জায়গায় ভাঙ্গন ধরেছে মাত্র। আস্থার জায়গা নিয়ে বিতর্ক করলে ক্ষতি হবে আমাদেরই।

বিচার বিভাগ ও চিকিৎসা সেবা দুটি স্পর্শকাতর বিষয়। দুটির উপরই আমাদের আস্থা রাখতে হয়। আমরা আমাদের দৈনন্দিন কাজে কর্মে যদি ক্ষুব্ধ হই, ক্ষতিগ্রস্থ হই তবে ছুটে যাই বিচার বিভাগের কাছে। আদালতে গিয়ে মামলা করি, বিচার চাই এবং বিচার পাই। বিচার কখনো কখনো কারো পছন্দ হয় আবার কারো পছন্দ হয় না। যার পক্ষে যায় বা পছন্দ হয় সে বলে ন্যায় বিচার পেয়েছি আর যার বিপক্ষে যায় বা পছন্দ হয় না সে বলে আমি ন্যায় বিচার পাইনি। ন্যায় বিচার পাইনি মনে হলে আবার সেই বিচারকের দাড়ে কড়া নাড়ি, উচ্চ আদালতে যাই, আপীল করি, রিভিশন করি, রিভিউ করি। আস্থার জায়গা বলেই না বার বার যাই, বার বার যেতে হয়।

অপর দিকে আমরা শারীরিক কোন সমস্যা হলেই চিকিৎসকের কাছে ছুটে যাই। চিকিৎসকরা আমাদের চিকিৎসা করেন, কখনো ভালো হই, কখনো হই না। ভালো না হলে আমরা আরো অভিজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই। চিকিৎসকরা তাদের মেধা, জ্ঞান উজার করে দিয়েই আমাদের জন্য লড়ে। কোন চিকিৎসকই চায় না তার রোগি ‘ভালো না হোক’। এটাও আমাদের একটা আস্থার জায়গা। আমাদের এই আস্থার জায়গাগুলোতে বার বার যেতে হয়। আস্থা হারালে আর কারো ক্ষতি না হলেও ক্ষতি হবে আমাদেরই। তাই আস্থার জায়গাগুলোকে ঢালাওভাবে কালিমা লেপন করে নষ্ট করা ঠিক না। 

সংবাদটিতে লেখা ছিলো-‘চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসায় আড়াই বছর বয়েসী এক শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। ম্যাক্স হাসপাতালে শুক্রবার গভীর রাতে শিশুটি মারা যাওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সকে পুলিশ ধরে থানায় নিলেও পরে ছেড়ে দেয়। শিশুটির মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। মারা যাওয়া শিশু রাইফা দৈনিক সমকালের চট্টগ্রাম ব্যুরোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রুবেল খানের মেয়ে।
রুবেল খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ঠান্ডা লেগে গলা ব্যথা করায় রাইফা খাওয়া বন্ধ করে দিলে বৃহস্পতিবার বিকালে ম্যাক্স হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় তাকে। ওই রাতে রাইফাকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হলে সে অস্বস্তি বোধ করে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা শিশু বিশেষজ্ঞকে কল দেওয়ার পরামর্শ দেন। এরপর শিশু বিশেষজ্ঞ বিধান বড়ুয়াও একই ধরনের ওষুধ দেন জানিয়ে রুবেল বলেন, রাতে ওই ওষুধ দেওয়ার পর থেকে রাইফার খিঁচুনি শুরু হয়। দায়িত্বরত চিকিৎসককে জানালে তিনি ডা. বিধান বড়ুয়ার সাথে কথা বলে ‘সেডিল’ ইনজেকশন পুশ করেন। এরপর রাইফা নিস্তেজ হয়ে যায়।
রুবেল খানের মেয়ের মারা যাওয়ার খবর পেয়ে রাতেই ম্যক্স হাসপাতালে ছুটে যান সাংবাদিকরা। তাদের প্রতিবাদের মুখে পুলিশ গিয়ে কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। খবর পেয়ে রাতে কয়েকজন সহযোগী নিয়ে থানায় উপস্থিত হন চিকিৎসকদের সংগঠন বিএমএ’র চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল ইকবাল। এরপর ভোরে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের পর আটক চিকিৎসক ও নার্সকে থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় বলে জানান চকবাজার থানার ওসি আবুল কালাম। 
চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়েনের (সিইউজে) সাধারণ সম্পাদক হাসান ফেরদৌস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সাংবাদিক, বিএমএ ও পুলিশের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের পর একটি পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনকে প্রধান করে গঠিত কমিটিতে বিএমএ প্রতিনিধি, সিইউজে প্রতিনিধি, বিএমএ ও সিইউজে’র পক্ষ থেকে একজন করে শিশু বিশেষজ্ঞ থাকবেন। আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে জানিয়ে হাসান ফেরদৌস বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
শিশুটির মৃত্যুর বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এই ঘটনার প্রতিবাদে মানববন্ধন করে তদন্তের মাধ্যমে ‘দোষী’ ব্যক্তিদের শাস্তি চেয়েছে সাংবাদিক সংগঠনগুলোর নেতারা। বিএমএ নেতা ফয়সাল ইকবালের আচরণের নিন্দা জানিয়েছেন তারা।

আমার পরিবারে সাড়ে তিন বছরের একটি কন্যা শিশু আছে। ও আমার অত্যন্ত আদরের সন্তান। আমি জানি সন্তানের প্রতি প্রতিটি মানুষের মমত্ববোধ ও ভালোবাসা কতটা গভীর হয়। প্রধান মন্ত্রীর সন্তান হোক আর সাংবাদিক রুবেলের সন্তান, চিকিৎসকের সন্তান হোক আর দিন মজুরের সন্তান, আইনজীবীর সন্তান হোক আর বিচারকের সন্তান সকল পিতা-মাতার কাছেই যার যার সন্তানের গুরুত্ব সমান। যে কোন মানুষ মারা গেলেই মানুষের হৃদয় কাদে, তা যদি হয় ফুটফুটে শিশু তাহলে তো কথাই নেই। তাই সাংবাদিক রুবেলের কন্যা রাইফার মৃত্যু সকলকে কাদিয়েছে। সাংবাদিক রুবেলের কন্যার মৃত্যুতে আমাদের সমবেদনা আছে। কিন্তু সাংবাদিক রুবেলের কন্যা কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনায় মারা যায়নি। সে কোন সন্ত্রাসীর গুলিতে মারা যায়নি অথবা মারা যায়নি কোন দুর্ঘটনায়। সে মারা গেছে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। আর পৃথিবীর কোন চিকিৎসকই চায় না তার রোগি মারা যাক। চিকিৎসাবস্থায় রোগির মৃত্যু হতেই পারে। কিন্তু মুহুর্তের মধ্যে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ আনাটা কতটুকু যৌক্তিক হয়েছে আমার বোধগম্য নয়।  

আমি দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা পেশার সাথে জড়িত ছিলাম। দেশের প্রধান দুইটি জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো ও কালের কন্ঠ পত্রিকায় কাজ করার সুযোগ হয়েছে। সাংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে কি কি সতর্কতা অবলম্বন করতে হয় তা পত্রিকা কর্তৃপক্ষ বার বার শিখিয়েছে। কোন কাজকে ভুল বলতে চাইলে ঐ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়েই একমাত্র বলা যাবে যে কাজটা ভুল হয়েছে। কিন্তু সাংবাদিক রুবেলের কন্যা একজন শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন, ঐ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসা পদ্ধতি ভুল ছিলো এমন মতামত ঐ চিকিৎসকের চেয়ে বড় কোন বিশেষজ্ঞর মন্তব্য সংবাদে সন্নিবেশ করা হয়নি যা সাংবাদিকতার নীতি নৈতিকতার সাথে বেমানান। 

‘রুবেল খান বলেছেন, ঠান্ডা লেগে গলা ব্যথা করায় রাইফা খাওয়া বন্ধ করে দিলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ওই রাতে  রাইফাকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হলে সে অস্বস্তি বোধ করে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা শিশু বিশেষজ্ঞকে কল দেওয়ার পরামর্শ দেন। এরপর শিশু বিশেষজ্ঞ বিধান বড়ুয়াও একই ধরনের ওষুধ দেন জানিয়ে রুবেল বলেন, রাতে ওই ওষুধ দেওয়ার পর থেকে রাইফার খিঁচুনি শুরু হয়। দায়িত্বরত চিকিৎসককে জানালে তিনি ডা. বিধান বড়ুয়ার সাথে কথা বলে ‘সেডিল’ ইনজেকশন পুশ করেন। এরপর রাইফা নিস্তেজ হয়ে যায়।’ 

ঠান্ডা জনিত সমস্যার কারনে তাকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া এবং সেডিল ইনজেকশন দেওয়া ঠিক হয়েছে না ভুল হয়েছে সেটা সাংবাদিক বা উকিলের বা ব্যবসায়ীর পক্ষে কি নিরুপন করা সম্ভব। এটা ভুল না সঠিক হয়েছে তা বলার মত একমাত্র অথরিটি আরেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়া আর কেউ হতে পারে কি?

একটা ব্যক্তিগত বিষয় একটু শেয়ার করি। আমার বন্ধু শিশু বিশেষজ্ঞ। আমার মেয়ে জন্ম নেয়ার পূর্ব হইতে বর্তমান সময় পর্যন্ত তার কথার বাইরে একফোটা পানিও না খাওয়াতে চেষ্টা করি। কাল মেয়ের কানের ব্যাথার কারনে তাকে ফোন দিলে আমাকে একটা অ্যান্টিবায়োটিক আর নাকের ড্রপ নেয়ার পরামর্শ দেন আর যদি ব্যাথা বেশি মাত্রায় হয় তবে ব্যাথার সাপোজিটরি নিয়ে রাখতে বললো। 

আমরা সাধারণভাবে জানি, সর্দির কারনে নাক যদি বন্ধ হয়ে যায় এবং স্মাস প্রশ্বাস নিতে সমস্যা হয় তবে নাকে ড্রপ দিতে হয়। আর ঠান্ডা জনিত জর হলে যদি নাপা খাওয়ানোর পরেও সুস্থ না হলে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়। আমার মেয়ের হয়েছে কানের ব্যাথা। তাকে যে ঔষধ দেয়া হয়েছে আমি বিনা বাক্য ব্যায়ে বাজার থেকে কিনে নিয়ে ব্যবহার করা শুরু করছি এবং যথাযথ ফল পেয়েছি। নাকের ড্রপ দেওয়ার পর পরই মেয়েতো উপর্যুপরি বমি এবং কান্না করা শুরু করে দিয়েছে। এখন আমি কি আমার ডাক্তারকে বলবো যে সে ভুল চিকিৎসা দিয়েছে, কানে ব্যাথা হয়েছে, কানের তো কোন ঔষধ দিলো না! সর্দি হয় নাই, নাক বন্ধ হয় নাই অথচ নাকের ড্রপ দিলো কেন? আমাদের পক্ষে কি জানা সম্ভব যে চিকিৎসাটা ভুল না সঠিক? এটা হলো আস্থার জায়গা। ডাক্তারের উপর আস্থা রাখতে হবে, রেখেছি, রাখি এবং রাখবো। 

চিকিৎসকদের সংগঠন বিএমএর চট্রোগ্রামের এক নেতা নাকি হুমকি দিয়েছে যে ‘সাংবাদিকদের এবং তাদের ছেলে-মেয়েদের চিকিৎসা করবেন না’। পরবর্তীতে ঐ চিকিৎসকের ফেসবুক থেকে জেনেছি যে তিনি ঐ কথা বলেনি। তর্কের খাতিরে ধরেই নিলাম সে বলেছে। যদি বলে থাকে তবে কি দাড়ালো? আস্থার জায়গায় চির ধরানো হলো। এখন সাংবাদিকরা কোথায় যাবে? তারা কি উকিলদের কাছে চিকিৎসার জন্য যাবে না সাংবাদিকদের কাছে, তারা কি ব্যাংকারদের কাছে যাবে না ব্যবসায়ীদের কাছে? আমাদের চিকিৎসকদের কাছেই যেতে হবে। তদন্ত কমিটি হয়েছে, সেখানেও সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে শিশু বিশেষজ্ঞ দেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। তাহলে বিষয়টা কি হলো? সেই চিকিৎসকেরই স্মরনাপন্ন হতে হলো। তাই আস্থার জায়গা নষ্ট করতে নেই। 

রুবেলের প্রতি গভীর সমবেদনা ও রাইফার জন্য ভালোবাসা জানিয়েই একটা কথা বলছি। প্রতিদিন কতইনা শিশু মারা যাচ্ছে। কয়টা শিশু মৃত্যু নিয়ে সাংবাদিকগণ মানব বন্ধন করেন? কয়টা শিশু মৃত্যুর জন্য হাসপাতাল ঘেরাও করে চিকিৎসক আটক করান? কয়টা শিশু মৃত্যুর জন্য প্রতিবাদ সমাবেশ, মানব বন্ধন, মামলা হামলা, তদন্ত কমিটি গঠনে চাপ প্রয়োগ করেন? নিজ পেশার স্বজন মারা যাওয়ায় এসব করে আস্থার জায়গা নষ্ট করা কি ঠিক হবে? আমাদের কিন্তু ঐ জায়গাগুলোতেই যেতে হবে বার বার, তাই আস্থার জায়গাগুলো নষ্ট করা ঠিক হবে না।

No comments:

Post a Comment