দুধে
ভেজাল, মাছে ভেজাল, চালে ভেজাল, মাংসে ভেজাল, ডিমে ভেজাল, অক্সিজেনে ভেজাল, এমনকি ভেজালেও
ভেজাল পাওয়া যাচ্ছে আমার সোনার বাংলায়। এসব ভেজাল খেয়ে ভেজাল মানুষ বড় হচ্ছে ধরনীতে।
পরীক্ষা করলে মায়ের দুধেও ভেজাল পাওয়া যাবে। তাইতো কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন-“ভেজাল, ভেজাল ভেজাল রে ভাই, ভেজাল সারা দেশটায়,
ভেজাল ছাড়া খাঁটি জিনিষ মিলবে নাকো চেষ্টায়! ভেজাল তেল আর ভেজাল চাল, ভেজাল ঘি আর ময়দা,
‘কৌন ছোড়ে গা ভেজাল ভেইয়া’, ভেজালসে হ্যায় ফয়দা।
ভেজাল পোশাক ভেজাল খাবার, ভেজাল লোকের ভাবনা, ভেজালেরই রাজত্ব এ পাটনা থেকে পাবনা।
ভেজাল কথা-বাংলাতে ইংরেজী ভেজাল চলছে, ভেজাল দেওয়া সত্যি কথা লোকেরা আজ বলছে। ‘খাঁটি
জিনিষ’ এই কথাটা রেখো না আর
চিত্তে, ‘ভেজাল’ নামটা খাঁটি কেবল আর
সকলই মিথ্যে।” এই ভেজালের ভীরে খাটি
জিনিস বিলুপ্তির পথে। যেমনটা বিলুপ্তির পথে খাটি মানুষ। মায়ের গর্ভ থেকেই যখন ভেজাল
রক্ত নিয়ে পয়দা হচ্ছে তখন ধরনীতে আর সলিড থাকতে পারছে না।
আমাদের
দেশে প্রক্রিয়াজাত খাবারে ভেজাল মেশানোটা এখন একটা নিয়মতান্ত্রিক কাজে পরিনত হয়েছে।
সম্প্রতি খাটি গাওয়া ঘি নামে ভেজাল ঘি তৈরীর একটা খাটি কারখানার খবর পাওয়া গেছে। টিস্যু
পেপার গলিয়ে সাথে দুধ, চিনি দিয়ে তৈরী হচ্ছে লাচ্ছি, দধি। মেশানো ছাড়াও খাবারে বিষের
উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি দেখা গেছে চালেও বিষের উপস্থিতি রয়েছে। কারন কি? চালে
তো ভেজাল মেশানো যায় না বা প্রয়োজন পরে না তবে কেন বিষ থাকবে? প্রকৃতি এখন আমাদের উপর
মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। রাসায়নিক বর্জ্য, অতি মাত্রায় কীটনাশক, সার দেয়ায় এবং আমাদের অপরিকল্পিতভাবে
ময়লা আবর্জনা ফেলায় সেই ময়লা আবর্জনার বিষ মাটিতে গিয়ে মিশছে, সেখান থেকে ধানে প্রবেশ
করছে বলেই গবেষকরা ধারনা করছে। খাদ্যে ভেজাল বা ভেজাল খাদ্য কি সেটা একটু দেখে নিলে
সুবিধা হবে।
ভেজাল
খাদ্য বা খাদ্যে ভেজাল (Food
Adulteration)
বলতে-খাদ্যে নিম্নমানের, ক্ষতিকর, অকেজো ও অপ্রয়োজনীয় দ্র্য মেশানো। প্রকৃতিগত ও গুণগত
নির্ধারিত মানসম্মত না হলে যে কোনো খাদ্যদ্রব্যই ভেজালযুক্ত বিবেচিত হতে পারে। অসাধু
ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার জন্য সাধারণত এ কাজ করে থাকে। ভেজাল দেওয়ার প্রক্রিয়ায় খাদ্যশস্যে
বহির্জাত পদার্থ সরাসরি যোগ করা হয়, যেমন ওজন বৃদ্ধির জন্য বালি বা কাঁকর, ভাল শস্যের
সঙ্গে কীটপতঙ্গ আক্রান্ত বা বিনষ্ট শস্য মেশানো ইত্যাদি। কেউ কেউ ধানভানার সময় খুদ
ও কুঁড়া যোগ করে ওজন বাড়ায়। আজকাল দানাশস্য-এর সঙ্গে শস্যদানার আকারের প্লাস্টিকের
ছোট ছোট টুকরা আর ডালের সঙ্গে রঙিন টুকরা মেশানো হয়। অনেক সময় মজুদ খাদ্যশস্যের ওজন
বাড়ানোর জন্য কেউ কেউ তাতে পানি ছিটায়। তেল ও চর্বিতে ভেজাল দেওয়া খুবই সহজ এবং এগুলি
শনাক্ত করাও দুরূহ। ঘি-এর সঙ্গে পশুচর্বি দিয়ে ভেজাল দেওয়া হয়ে থাকে। ইদানিং কৃত্রিম
রং ও গন্ধদ্রব্য আবিষ্কারের ফলে চর্বি দিয়ে নকল ঘি বানিয়ে ভোক্তাদের সহজেই ঠকানো যায়।
এখন ডালডা, সুজি, পামঅয়েল, ফেবিকল আঠা আর কিছু ফ্লেভার মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে তৈরী করছে
খাটি গাওয়া ঘি। তিল বা নারিকেল তেলের সঙ্গে প্রায়ই বাদাম তেল বা তুলাবীজের তেল মেশানো
হয়ে থাকে। সরিষার সঙ্গে প্রায়ই শিয়ালকাঁটার বীজ একত্রে মিশিয়ে তেল বের করা হয়। উল্লেখ্য,
শিয়ালকাঁটার তেলের স্যাঙ্গুইনারিন (sanguinarine) নামের উপক্ষার অত্যন্ত
বিষাক্ত এবং তা শোথ ও পক্ষাঘাত ঘটায়। সয়াবিন তেল বা পামতেলের সঙ্গে এলাইলআইসোথিওসায়ানেট
(allylisothiocyanate) মিশালে তাতে সরিষার তেলের
মতো ঝাঁঝ হয় এবং সহজেই সরিষার তেল বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। সয়াবিন তেলের সঙ্গে পামতেলের
ভেজাল মেশানো অধিক মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ীদের একটি চিরাচরিত অপকর্ম। দুধের মাখন
তুলে নিয়ে অথবা দুধে পানি মিশিয়ে ভেজাল দুধ বাজারজাত করা হয়। কখনও কখনও সয়াবিন তেল
বা বাদাম তেল, ময়দা ও অন্যান্য দ্রব্যাদি দুধে মেশানো হয়। মহিষের দুধ পানি দিয়ে পাতলা
করে গরুর দুধ বলে সহজেই চালানো যায়। গুঁড়াদুধে ময়দা, সুজি ও অন্যান্য দ্রব্য মেশানো
খুবই সহজ যা করছে প্রতারক শ্রেণী মানুষ। দুধে পানিটাও দেয় ভেজাল (বিশুদ্ধ নয়) পানি।
ব্যবহৃত চা পাতা, কাঠের গুঁড়া ও শুকনা পাতার গুঁড়া দিয়ে চা’য়ে ভেজাল দেওয়া হয়। মসলার মধ্যে লঙ্কা বা হলুদ
গুঁড়াতে সীসাজাতীয় রঞ্জক পদার্থ মিশিয়ে রঙের উজ্জ্বলতা বাড়ানো হয় এবং দেখতে ভাল দেখায়।
মিষ্টিজাতীয় দ্রব্যাদি তৈরিতে ছানার পরিবর্তে বেশি বেশি চালের গুঁড়া বা ময়দা মেশায়।
কোমল পানীয় তৈরীতে তরল গ্লুকোজ বা চিনির সিরাপের পরিবর্তে প্রায়শ ব্যবহৃত কার্বোক্সি
মিথাইল সেলুলোজ (CMC) মেশানো হয়। বিভিন্ন ফলের
রসের নামে কৃত্রিম ও নিষিদ্ধ দ্রব্য ব্যবহার করে নকল রস তৈরী হয়ে থাকে। সম্প্রতি মিনারেল
ওয়াটার নামে বাজারে যে পানির ব্যবসা চলছে তাতে গুণ ও মানের নিশ্চয়তা অতি সামান্য বা
অনেক ক্ষেত্রে নেই বললেই চলে। প্রকৃতির এক অমূল্য নিয়ামত মধুতে চিনি, ইনভার্ট সুগার
মিশিয়ে ভেজাল মধু তৈরী করে। গুর স্বচ্ছ করতে কাপর কাচার সোডা মিশানো হয়। হাল আমলে খেজুর
গুর হোক আর আখর গুর দুটোতেই চিনি মিশিয়ে ভেজাল দেয়া হয়। মুড়িকে বেশি সাদা ও ফোলা ফোলা
করতে ইউরিয়া সার ব্যবহার করে। বিভিন্ন জুসে আলু, কুমড়া মেশানো, সসে টমেটো কম কুমড়া
বেশি, প্রশাধনীতে মেশানো হয় ভেজাল। ভেজাল প্রসাধনী মেখে ভেজাল রুপসী হচ্ছেন অনেকেই।
পার্লার থেকে সাজুগুজু করা মেয়ে বৌ হিসাবে বাড়ি নেয়ার পর মুখ ধুলে দেখাযায় যেন অন্য
কেউ।
হাত
বাড়ালেই মিলছে নকল আর ভেজাল প্রসাধনী। মোড়ক দেখে কারও বোঝার সাধ্য নেই কোনটি আসল আর
কোনটি নকল। নকলের ভিড়ে প্রিয়জনের জন্য কেনা হচ্ছে প্রসাধনীর নামে এক প্রকার বিষ। দেশি-বিদেশি
বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের প্রসাধনীর মোড়ক নকল করে তা বাজারজাত করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের
তৈরি প্যানটিন প্রো-ভি শ্যাম্পু, গার্নিয়ার, হেড অ্যান্ড শোল্ডার, ল’রেল, রেভলন ও প্যানটিন, নিভিয়া লোশন, লাক্স লোশন,
মাস্ক লোশন, অ্যাকুয়ামেরিন লোশন, ফেড আউট ক্রিম, ডাভ সাবান, ইমপেরিয়াল সাবান; সুগন্ধির
মধ্যে হুগো, ফেরারি, পয়জন, রয়েল, হ্যাভক, কোবরা সবই এখন ভেজাল আর নকলে ভরা। কসমেটিকস
দোকানগুলোতে রকমারি এসব বিদেশি পণ্যের সমারোহে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। কী নেই! বিশ্বের সব
নামকরা ব্র্যান্ডের প্রসাধনসামগ্রী থরে থরে সাজানো। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের
(ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী, বাজারে প্রতিষ্ঠিত অনেক ব্র্যান্ডের প্রসাধনীর লেবেল ও মেয়াদোত্তীর্ণের
তারিখ নেই। এক জরিপে দেখা গেছে, ৪৫ ভাগ প্রসাধন পণ্যের বিএসটিআইর সনদ নেই, ৭৫ ভাগ পণ্যের
উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা নেই।
সুকান্ত
ভট্টাচার্য আরো লিখেছিলেন-“কলিতে ভাই ‘ভেজাল’
সত্য ভেজাল ছাড়া গতি নেই, ছড়াটাতেও ভেজাল দিলাম, ভেজাল দিলে ক্ষতি নেই।” তাই আমিও বলবো আমার এ লেখাটাতেও একটু ভেজাল দিলাম।
গুগলে সার্চ দিয়ে তথ্য বের করে কপি নিলাম। এই ভেজালে নিশ্চই কোন ক্ষতি নেই। কি বলেন
পাঠক বন্ধুরা? তবে শেষ কথার এক কথা হলো, আমরা বাঁচতে চাই। জাপানের হিরোসিমা-নাগাসাকিতে
পারমানবিক বোমা ফেলা হয়েছিলো, তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব এতটাই ছিলো যে দীর্ঘদিন পরেও বিকলাঙ্গ
বাচ্চা পয়দা হতো। আমাদের দেশের যে অবস্থা তাতে অদূর ভবিষ্যতে বিকলাঙ্গ বাচ্চা পয়দা
হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আর বিকলাঙ্গ বাচ্চা একটি জাতির জন্য কতটা অভিষাপ, কতটা
বোঝা তা যে পরিবারে প্রতিবন্ধী-বিকলাঙ্গ শিশু জন্মনেয় সে পরিবারই কেবল জানে। বিকলাঙ্গ
শিশু না যায় মারা, না যায় পালা! ব্যবসায়ী, উৎপাদনকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উচিত
এখনই লাগাম টেনে ধরা। ভালো জিনিস দিন, দাম একটু বেশি হলেও ক্ষতি নেই। আর আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের
অনেক দ্বায়িত্ব রয়েছে। তাদের উচিত কঠর নজরদারি, তদারকির মাধ্যমে এই অপকর্ম দুর করা।
আবারও বলছি-আমরা বাঁচতে চাই, আমাদের বাঁচতে দিন। নতুন প্রজন্মকে সুস্থ-সুন্দর ভাবে
বেড়ে উঠতে দিন, মনে রাখতে হবে, প্রতিবন্ধী-বিকলাঙ্গ শিশু আপনার ঘরেও জন্ম নিতে পারে!
লেখাটা উপকারী। ধন্যবাদ কষ্ট কের আমাদের জন্য কিছু লেখার জন্য।
ReplyDelete