ভালবাসি প্রকৃতি

ভালবাসি প্রকৃতি

Saturday, March 30, 2019

জাজিরা থেকে কেন চলে যাচ্ছে উনিশশো কোটি টাকার তাঁতপল্লী? আশা হতাশার গল্প

শুরুতেই আশার গল্প, আষাঢ়ে গল্প নয়! বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে আমরা জানতে পারি, মাদারীপুরের শিবচর ও শরীয়তপুরের জাজিরায় এক হাজার ৯১১ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ হতে যাওয়া তাঁতপল্লী ঘিরে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন বিলুপ্তপ্রায় তাঁতিরা। এ প্রকল্পটির জন্য শিবচর উপজেলার কুতুবপুরে ৬০ একর ও শরীয়তপুরের জাজিরায় ৪৮ একর জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। তাঁতপল্লীতে থাকবে কারখানা, আবাসন, শিক্ষা, প্রশিক্ষণসহ আধুনিক সব সুবিধা। মিরপুরের বেনারসি পল্লীর তাঁতিরাও এ পল্লীর অর্ন্তভূক্ত হবেন। প্রধানমন্ত্রী ১ নভেম্বর এ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পদ্মা সেতুর দ্রুত বাস্তবায়নের সঙ্গে এ এলাকায় তাঁতপল্লী স্থাপনের কাজ শুরু হওয়ায় নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন এ অঞ্চলের তাঁতিরা। ১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী তাঁতপল্লীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেও জায়গা নির্ধারণ হয়েছে আরও আগেই। দুই মাসের মধ্যে শুরু হবে মাটি ভরাটের কাজ। প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২৫৩ কোটি টাকা। এতে ৬ তলা বিশিষ্ট ভবনগুলোতে প্রত্যেক তাঁতির জন্য ৬০০ ফুটের কারখানা ও ৮০০ ফুটের মধ্যে আবাসন সুবিধা থাকবে। সরকারের পক্ষ থেকে সুতা-রঙসহ কাঁচামালের সুবিধা দেওয়া হবে। নির্মাণ হবে আর্ন্তজাতিক মানের শোরুম ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। তাঁতিদের ছেলেমেয়েদের জন্য থাকবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম জানান, প্রধানমন্ত্রী এই পদ্মাপাড়ে তাঁতপল্লী গড়ে তোলার যে উদ্যোগ নিয়েছেন তাতে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প আবার পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠবে। এখানে সয়েল টেস্ট শেষে বিভিন্ন ভবন নির্মাণ করা হবে। প্রথম পর্যায়ে ২৫৩ কোটি টাকার কাজ শেষ করব। মূল প্রকল্প ১ হাজার ৯১১ কোটি টাকার। এটি একটি মেগা প্রকল্প। এখানে ঢাকার মিরপুরের বেনারসি পল্লীর তাঁতি ও এই অঞ্চলের তাঁতিদের পুনর্বাসন করা হবে। তাদের প্রত্যকের জন্য আধুনিক অনেক ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকবে। তাঁতিদের বিনামূল্যে অথবা ন্যায্যমূল্যে সুতা, রঙসহ বিভিন্ন কাঁচামাল সরবরাহ করা হবে। রঙ করা, ফ্যাশন ডিজাইনসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।

এবার শুনাই হতাশার গল্প। অনিয়ম রোধে মাদারীপুরের শিবচর ও শরীয়তপুরের জাজিরায় ১৯শ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হতে যাওয়া শেখ হাসিনা তাঁতপল্লীর পূর্ব নির্ধারিত স্থান পরিবর্তন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই আলম চৌধুরী। প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনকালে একথা বলেন তিনি। এ সময় চিফ হুইপ বলেন, শেখ হাসিনা তাঁতপল্লীর নির্ধারিত স্থানে অবৈধ স্থাপনা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর ও তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে দেখা গেছে এখানে ভালো কিছু হচ্ছে না। আমাদের নির্দেশনায় মাদারীপুরের প্রশাসন অবৈধ সব স্থাপনা ভেঙে ফেলেছে। কিন্তু শরীয়তপুরের প্রশাসন কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করেনি। গত ২৪ মার্চ পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মীর্জা আজম, সংলগ্ন সংসদ সদস্য ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা সবাই একমত হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেসব এলাকায় অবৈধভাবে ঘরবাড়ি, গাছপালাসহ স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে সেসব এলাকা এই প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া হবে। তিনি বলেন, দুই জেলায় এমন একটি প্রকল্প করতে গেলে শুধু এই অনিয়মই নয় ভবিষ্যতে আরও কিছু সমস্যা হবে। তাই সংসদীয় কমিটি, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা সবাই একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, শেখ হাসিনা তাঁতপল্লী একই উপজেলায় করা হবে। আর এ জন্য মাদারীপুরের শিবচরের কুতুবপুর এলাকায় জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে।

এই যে আশা হতাশা কাদের জন্য? তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেবে সরকার? প্রশাসনের যে কর্তাব্যক্তিদের কারনে ও প্রশ্রয়ে অনিয়ম ঘটলো সেই প্রশাসনের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে কি? যে জনগন এ অনিয়ম ঘটিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে কি? এমন হাজারো প্রশ্ন ঘুরছে মনে। শুধু আমার নয়, সারা শরীয়তপুরবাসীর মনে এমন প্রশ্ন। অনিয়মের অভিযোগে মুখ ফিরিয়ে নিলেই কি দায় শেষ হয়ে যাবে। যদি কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয় তবে ভবিষ্যতেও এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে কুলাঙ্গাররা। এখানে তাঁতপল্লী হোক বা না হোক অনিয়মের যে অভিযোগ উঠেছে তার তদন্ত যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে করে উপযুক্ত বিচারের আওতায় আনা উচিত। পূর্বের অনিয়মের বিচার হলে আজকে অপবাদ মাথায় দিয়ে তাঁতপল্লী সরিয়ে নেয়া সম্ভব হতো না। 

জাজিরায় পদ্মা সেতুর জন্য অধিগ্রহণকৃত জমির মালিকরা, দালালরা, প্রশাসনের কর্তারা কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে সেই খবর আজ বাসি-পঁচা। এর পর সেনানিবাস তৈরীর জন্য যখন জমি প্রয়োজন হলো তখন সেই এলাকার জমির মালিক, দালাল, প্রশাসন আবার এক হলো। হাজার হাজার গাছের চারা রোপন করে, যেনতেন ভাবে ঘর তৈরী করে, পুকুর খনন করে ফাঁদ পাতলো টাকার জন্য। পাট কাঠির মত গাছের চারা আধা ফুট অন্তর অন্তর রোপন করেছিলো। সেই গাছের জন্য এবং জমি ও ঘরের জন্য ছাব্বিশ কোটির অধিক টাকার বিল তৈরী করেছিলো প্রশাসনের সহায়তায়। অতপর মিডিয়া কর্মীদের কারনে পাঁচজন বন কর্মকর্তার সম্বয়ে নতুন করে মূল্যায়ন করলে ১৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা কমে গিয়েছিলো। সুযোগ সন্ধানীরা আবার রিট করে সেই টাকা তুলে নিয়েছে। প্রশাসন তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে টাকা প্রদান আটকাতে আগ্রহী না হলেও রিটের কারনে টাকা দিতে বেশি আগ্রহী ছিলো। প্রশাসন আদালতকে যথাযথ ভাবে বুঝাতেই পারেনি না বুঝাতে চেষ্টা করেনি সেটাই প্রশ্ন। আর চেষ্টা করবেই বা কেন, টাকা কমলে কমিশনও কমে যাবে সেটা পাগলেও বুঝে। 

এর পরই ঘোষণা আসলো তাঁতপল্লীর। আবারও সেই ঘটনার পূনরাবৃত্তি। স্থানীয় লোকজন, দালালরা, প্রশাসনেরও অনেক লোক জায়গা কিনে, ভাড়া নিয়ে গাছ লাগালো, ঘর তুললো, পুকুর খনন করলো। বিচি বুনলে যেভাবে গাছের চারা হয় ঠিক সেভাবেই লাগানো হলো গাছের চারা। দুর থেকে দেখলে মনে হবে সবজির বাগান! কারন আর কিছুই নয়। একেকটা চারা কিনে আর লাগাতে খরচ হবে দশ থেকে পনের টাকা আর বিল পাবে দশ থেকে বিশ হাজার টাকা। এমন টাকার গাছ কেউ কি না লাগিয়ে পারে? ঘর তুলেছে দোচালা, সেই ঘর হয়ে যাবে কাগজে কলমে দোতলা। এমন আয়ের পথে কে না হাটে? পুকুরে পানি আর মাছতো দুরের কথা মাটিও নেই, শুধুই বালু আর বালু। সেই পুকুরের, মাছের, এমনকি পানিরও বিল হবে! একেই মনে হয় বলে পুকুর চুরি! এই যে কাজগুলোর কথা বললাম, এগুলো কারা করে? আমার দেশের চাষা ভূষা, খেটে খাওয়া মানুষ এসব কুটকৌশল জানেন না। শিক্ষিত ব্যক্তি, চতুর, দুর্নীতিবাজরাই এসব করতে জানে এবং করেছেও। দুর্নীতিবাজরা অতীত থেকে ঠিকই শিক্ষা নিয়েছে। কে বলেছে এ জাতি অতীত থেকে শিক্ষা নেয় না? অতীতে তারা দোচালা ঘরকে দোতলা, দুই মাস বয়সী গাছের চারাকে বিশাল বৃক্ষ, বালু ভর্তি পুকুরে মাছের সমারহ দেখি বিল করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সেই অতীত তারা ভুলে যায়নি। 

অনিয়মের অভিযোগ আর দুই জেলায় প্রকল্প হলে ভবিষ্যতেও সমস্যা হবে এমন অভিযোগ এনেছেন চিপ হুইফ মহোদয়। আসলে তার এ অভিযোগ কতটুকু যুক্তিযুক্ত? দুই জেলায় হবে প্রকল্প, দুই দেশেতো নয়। একই দেশের দুটি বা তিনটি জেলার জমিতে কোন প্রকল্প হলে সমস্যা কি? যদি সমস্যাই হতো তবে কেন শুরুতেই দুই জেলায় প্রকল্পের পরিকল্পনা করেছিলেন পরিকল্পনাবিদরা? আসলে আমাদের বঞ্চিত করার অযুহাত দরকার। অনিয়মের অযুহাতের সাথে যোগ করেছেন দুই জেলার কথা এর বাইরে কিছুই নয়। 

জাজিরার মানুষ আজ কোটিপতি। এটা খুবই আনন্দের বিষয়। বাস্তবে কতজন ব্যক্তি নিয়মতান্ত্রিকভাবে কোটিপতি হয়েছেন? কতজনকে সরকার কোটি টাকার চেক দিয়েছেন সেটা খতিয়ে দেখা উচিত। বেশিরভাগ মানুষই কোটিপতি হয়েছেন অনিয়মের মাধ্যমে, দালালির মাধ্যমে। যারা অনিয়মের মাধ্যমে কোটিপতি হয়েছেন তাদের বিষয়ে খোজ খবর নেয়া উচিত রাজস্ব বিভাগের। সেই সাথে দুদকের ভূমিকাও এড়িয়ে যাওয়ার মত নয়। একটু খোজ খবর নিলে অনেক দালালই বেরিয়ে আসবে জাতির সামনে। একটু খুজুন, একটু ধরুন। 

জাজিরায় তাঁতপল্লী হলে এ অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ উপকৃত হত। আর দুর্নীতির কানে কয়েকশ মানুষ হয়তো লাভবান হতো। হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হতো। এখানে নানান রকম ব্যবসা বাণিজ্য গড়ে উঠতো। মানুষ কাজ করে খাওয়ার সুযোগ পেতো। অতি লোভের কারনে সব বন্ধ হয়ে গেলো। যারা অতি লোভে এমন কাজগুলো করেছে তাদের খুব বেশি ক্ষতি হবে না। তাদের হয়তো লাভটা হবে না কিন্তু ক্ষতিগ্রস্থ হবে এলাকার মানুষ। একটি সমৃদ্ধ শরীয়তপুর হতে পারতো। কয়েকশ লোভী মানুষের কারনে ক্ষতিগ্রস্থ হলো সাধারণ হাজার হাজার মানুষ, ক্ষতিগ্রস্থ হলো শরীয়তপুর জেলা। কিন্তু সারা দেশের মানুষ, সারা বিশ্বের মানুষ চিনে নিলো শরীয়তপুরের জাজিরার মানুষকে। সবাই জানবে, সবাই ভাববে জাজিরার মানুষ কত খারাপ, কত নিকৃষ্ট, কত দুর্নীতিপরায়ন, আত্মহননকারী। এর দায় থেকে কিভাবে এড়িয়ে যাবে জাজিরার মানুষ, শরীয়তপুরের প্রশাসন? প্রশ্নটা রেখেই গেলাম। উত্তর আমার জানা নেই, যদি কারো জানা থাকে তবে আমারই মত জানিয়ে দিন। জাজিরাবাসী দায়মোচন হতে পারবে হয়তো। 

ছবিঃ মুরাদ হোসেন মুন্সী ও গুগল।

No comments:

Post a Comment